আষাঢ়ে প্রণয় সন্ধি পর্ব-০২

0
254

#আষাঢ়ে_প্রণয়_সন্ধি
#লেখিকা:#ইশা_আহমেদ
#পর্ব_২

তপ্ত দুপুর। চৈত্র মাসের মাঝামাঝি সময়। অবশেষে সরূপে ফিরেছে চৈত্র। রোদে নাজেহাল শহরতলীর মানুষ। চিত্রা মাত্র গোসল সেরে বের হয়েছে। চুলগুলো মুছছিলো সে। তখনই রুমে প্রবেশ করে তার ছোটভাই প্রহর। চিত্রা ভ্রু কুচকে তাকায়।

“আপু জানিস পাশের বাসার আষাঢ় ভাইয়া আছে না। কি
সুদর্শন। আমার তাকে ভীষণ পছন্দ হয়েছে। তোর জন্য তো
আমি মনে মনে তাকে ঠিক করে ফেলেছি।দুলাভাই হলে সেই হবে”

চিত্রা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে।প্রহর ভীষণ দুষ্টু।তবে এসব কথা সে আগে বলেনি। অষ্টম শ্রেণীতে পরছে।চিত্রা বিষ্মিত কন্ঠে বলল,,
“এগুলো কি ধরনের কথা প্রহর।থা*প্প*ড়ে গাল লাল করে ফেলবো ফাজিল ছেলে”

“সত্যি বলছি আপু আষাঢ় ভাই খুব সুন্দর। মেয়ে হলে আমিই তুলে নিয়ে যেতাম।”

“ এই সব ফালতু কথা বলার জন্য এসেছিস তুই?বের হ ফাজিল ছেলে।বড় হয়ে যাচ্ছো তাই না। আজ আব্বু আসুক তোর একটা ব্যবস্থা করছি আমি”

প্রহর দৌড়ে পালালো। এখানে থাকলে নির্ঘাত দুই একটা থা*প্প*ড় খেতে হতো।প্রহর বের হতেই চিত্রা ঘনঘন শ্বাস ফেললো। ছেলেটা দিনদিন বাঁদরে পরিনত হচ্ছে। এতো দুষ্টমি করে। প্রতিদিনই প্রায় বাড়িতে নালিশ আসে তার নামে।চিত্রা ভীষণ বিরক্ত প্রহরের উপর।তবে আষাঢ়টা কে! সে তো চিনে না এই নামে কাউকে। এই এলাকায় এ নামে কেউ থাকেও না বোধহয়।চিত্রা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললো এসব চিন্তা। মাথাটা ধরেছে তার ভীষণ। এক কাপ চা না খেলে মাথা ব্যাথা কমবে না তার মোটেও। যদিও এই ভর দুপুরে মা যদি তাকে চা বানাতে দেখে তাহলে আরেক কেলেংকারী বাঁধাবে।চিত্রা নিঃশব্দে রুম থেকে বের হলো।মায়ের রুমে উঁকি দিয়ে দেখলো মা নামাজ পরছে।এই ফাঁকে চা বানাতে হবে।

চা খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। আজ সকালে কতো কিছুই না হলো।অরিহা মেয়েটার জন্য একটু বেশিই খারাপ লাগছে চিত্রার।ছোট্ট মেয়েটার সাথে অসভ্য লোকটি কি করেছে। ভাবতেই ঘৃণা লাগছে। এইসব পুরুষ মানুষকে ঘৃণা করে চিত্রা।যে পুরুষ নারীকে সম্মানই করতে পারে না। সে পুরুষের কাতারেই পরে।সমাজে অনেক আবর্জনা আছে। ভালো মানুষের মুখোশের আড়ালে আসলে একজন নোংরা মস্তিষ্কের লোক। আজকের লোকটা তার মধ্যে একজন।

“নারী মানেই দাসী নয়। নারী সব পারে।নারী শান্ত,নারী প্রলয়ংকারী, আবার নারীই বুননকারী।যে নারীকে সম্মান,শ্রদ্ধা করে সেই আসল পুরুষ।”

চিত্রা ঘুম থেকে উঠেছে মাত্র। দুপুরে না খেয়েই ঘুমিয়েছে।মুখ ধুয়ে রুম থেকে বের হতেই বসার রুমে মরিয়ম সুলতানার সাথে পাশের বাড়ির রেহানা আন্টিকে দেখলো।কথা বলছেন তারা।সালাম দিয়ে রান্নাঘরে আসলো।খাবার নিয়ে টেবিলে বসে খাচ্ছে চিত্রা। তখনই বসার ঘর থেকে সেই মহিলার কন্ঠ শুনতে পেলো।মহিলাটি মরিয়ম সুলতানাকে বলছেন,,

“আপা আপনার মেয়ের তো কুড়ি পেরোলো তো এক দু বছর আগে বিয়ে কবে দিবেন?বয়স হলে কিন্তু ভালো পাত্র পাবেন না। আমার কাছে ভালো পাত্র আছে আপা”

মরিয়ম সুলতানা জোরপূর্বক হেসে বলেন,,,“আপা আমরা এইসব নিয়ে ভাবছি না। চিত্রার পড়াশোনা শেষ হোক তারপর দেখা যাবে।”

মহিলা মুখ বাঁকিয়ে বললেন,,,
“ভালো কথা বলেছি ভাবি শুনলেন না তো।বয়স বাড়লে ছেলে পাবেন না। এখন বিয়ে দিলেই ভালো পরের বাড়ি চলে যাবে আপনাদের আর চিন্তা করতে হবে না। তার উপর আবার মেয়ে বেশিই সাহসী, রঙডং করে বেরায়”

চিত্রা হাত ধুয়ে বসার রুমে আসলো। মরিয়ম সুলতানা চমকে উঠলেন। মেয়ে যে এখন কথা শুনিয়ে দিবে এই মহিলাকে তা ভালো মতোই জানা তার। তিনি চোখ দিয়ে ইশারা করলেন চিত্রাকে যেনো কথা না বাড়ায়। তবে চিত্রা কি থেমে থাকা মেয়ে।

“আমার চিন্তা আপনায় করতে হবে আন্টি।আমি সাহসী বা রঙডং যাই করি তা আপনাকে দেখতে বলেনি কেউ। আপনি আমাকে খাওয়াচ্ছেন না পড়াচ্ছেন ও না। আমার বাবা মা খাওয়াচ্ছে এবং পড়াচ্ছে। আমায় বয়স বাড়লে ছেলে পাওয়া গেলো কি গেলো না তাও দেখতে বলেনি কেউ আপনায়।অন্যের বিষয় নিয়ে কথা বলার আগে দশবার ভাববেন। আশা করি বুঝাতে পেরেছি”

চিত্রা স্থান ত্যাগ করলো।মহিলার মুখটা অপমানে শুকিয়ে গিয়েছে। সে তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে গেলো।চিত্রা এখনো রাগে ফুঁসছে। এই সমাজের কিছু মহিলাই সমাজটাকে নোংরা করছে। আসলে নারীই নারীর শত্রু।কিভাবে পারে একটা মেয়েকে অপমান করতে নিচু করতে।চিত্রা দুইটা টিউশন করায়।সন্ধ্যার একটু আগে একজন নবম শ্রেনীতে পড়ুয়া মেয়েকে পড়ায় সে।তৈরি হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো।মরিয়ম সুলতানা এখনো সোফাতেই বসে আছেন হতভম্বের ন্যায়।মেয়েটা স্পষ্টভাষী,মুখের উপর সত্য বলে দিবে।অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করতে ঝাপিয়ে পরবে।

চিত্রা বাড়ি থেকে বের হতেই দেখলো প্রহর ক্রিকেট খেলছে।চিত্রাকে দেখে প্রহরসহ তার সাথে থাকা বাকি ছেলেগুলো চুপ হয়ে গেলো।কোলাহলপূর্ন পরিবেশটা নিমেষেই শান্ত হয়ে গেলো। তারা ভীষণ ভয় পায় চিত্রা আপাকে।চিত্রা আপা যে ভীষণ রাগী তা ভালো মতো ঢুকে গিয়েছে ছেলেগুলোর মাথায়।চিত্রা এক পলক সবাইকে পর্যবেক্ষণ করে দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে গেলো।দেরি হয়ে যাবে নয়তো তার।

আষাঢ় বন্ধুদের সাথে বসে চা খাচ্ছে। পাশের সিটি কলেজে সে শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত হয়েছে।জয়েনিং ডেট দু’দিন পর।এখানে তার অনেক বন্ধুরাই থাকেন।ভার্সিটি লাইফে তার বন্ধুর অভাব ছিলো না। তবে প্রিয় বন্ধু তো একজনই হয়। নিশীথ তার প্রিয় বন্ধু। কয়েক বছর যোগাযোগ ছিলো না তাদের। তবে এইখানে আসতেই দেখা পেয়েছে তার।

“মামা চাকরি তো পেলি বিয়ে-শাদি করবি না।এবার না হয় বিয়েটা করে ফেল”

আষাঢ় তার বন্ধু সমুদ্রের কথায় হাসলো।আষাঢ় চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,,,“মনের মতো কাউকে পেলেই বিয়ে করবো”

নিশীথ মুখ বাঁকিয়ে বলল,,
“তোর মনের মতো মেয়ে এ জন্মে পাবি না তুই।তা বলো তো তোমার মনের মতো মেয়ে কেমন হবে?”

“হয়তো পায়নি তবে পেয়ে যাবো।আচ্ছা চিত্রাকে কেউ চিনিস?”

সমুদ্র এবং নিশীথ চিত্রার নাম শুনে বিষম খেলো।চিত্রা!আষাঢ় চিত্রার কথা জানলো কিভাবে?সমুদ্র এবং নিশীথকে বিষম খেতে দেখে আষাঢ়ের ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকালো।এরপর বিরক্ত হয়ে বলল,,
“তোরা চিত্রা নাম শুনে বিষম কেনো খেলি?”

সমুদ্র নিজেকে সামলে বলল,,

“মামা চিত্রা কে তা তুই কিছুদিনের মধ্যে জেনে যাবি।আর এই এলাকার প্রায়ই সবাই চিত্রাকে চিনে।ওর মতো মেয়ে এই এলাকায় একটাও নেই!”

“কেনো মেয়েটি বেয়াদব?তবে তাকে তো আমার এমন মনে হয়নি।স্বাধীনচেতা,প্রতিবাদী একজন নারী মনে হয়েছে”

নিশীথ আষাঢ়ের কাঁধে হাত রেখে বলল,,,“চিত্রা বেয়াদব নয়। হ্যাঁ অন্যায় দেখলে সে কখনো চুপ থাকে না। প্রতিবাদী একজন নারী।তবে ছেলেদের থেকে সে দূরে থাকে।এই এলাকায় তেমন বাজে ছেলেও নেই। শুধু ওই মেয়েটার জন্য।মেয়েটাকে প্রথমবার কেউ দেখলে নির্ঘাত সাধারণ সহজ সরল মেয়ে বলবে। তবে সে ততটাই ভয়ংকর। পুরুষ বলতে বাপ ভাই ছাড়া কারো সাথে মিশে না সে।যতটুকু শুনেছি মেয়েটি প্রেম ভালোবাসায় বিশ্বাসী নয়”

আষাঢ়ের আগ্রহ বাড়লো চিত্রার প্রতি।মেয়েটাকে তার ভীষণ ইন্টারেস্টিং লেগেছে।তারও এমন স্বাধীনচেতা মেয়ে পছন্দ।আষাঢ় চায়ের কাপটি ফেরত দিলো এবং টাকা পরিশোধ করে বলল,,
“চিত্রা!বেশ ইন্টারেস্টিং। তাকে আমার ভালো লেগেছে।”

সমুদ্র এবং নিশীথ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রয় আষাঢ়ের পানে। আষাঢ় স্বাভাবিক ভঙ্গিতে পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে।দু’জন একে অপরের দিকে তাকিয়ে আবারও আষাঢ়ের দিকে তাকালো।সমুদ্র মাথায় হাত দিয়ে বলল,,,

“ভাই তোর ভালো লাগাকে এখানেই দমিয়ে রাখ। চিত্রার থেকে দূরে থাকাটাই শ্রেয়।চিত্রা একজন অন্যরকম নারী তবে পুরুষদের তেমন পছন্দ করে না।বাপ ভাই ছাড়া তাকে এখন পর্যন্ত কারো সাথে কথা বলতেও দেখা যাইনি”

“সো হোয়াট।তার ব্যক্তিত্ব আমার চমৎকার লেগেছে।”

“বাদ দে ভাই চিত্রার কথা। আর দয়া করে ওর সাথে কথা বলতে যাস না অপমান করে দিবে। আমার তো প্রথম দিন তাকে দেখে ভীষণ পছন্দ হয়েছিলো।আমাকেও দু একটা কথা শুনিয়ে দিয়েছে।

সমুদ্রের কথায় আষাঢ় ও নিশীথ ফিক করে হেসে দেয়।টুকটাক কথা বলে বিদায় নেয় আষাঢ় তাদের থেকে।আষাঢ়রা এই এলাকাতে এসেছে তিনদিন হয়েছে। আষাঢ়ের জন্যই মূলত এখানে আসা। বাড়িটা তাদের ভাড়া দেওয়া ছিলো।আষাঢ়ের যে কলেজে চাকরি হয়েছে এখান থেকে সেইটা অনেকটা কাছে তাই এখানে আসা। আষাঢ় বাড়ি এসে সোজা বোনের রুমে চলে আসে।সে খোঁজ নিয়েছিলো ব্যাপারটা নিয়ে।লোকটা হাসপাতালে ভর্তি।লোকজন ভালোই মেরেছে তাকে।দরজায় টোকা দিয়ে বলে,,

“অরিহা আসবো”

অরিহা ভেতর থেকে বলল,,,“হ্যাঁ ভাইয়া আসো”

আষাঢ় রুমে প্রবেশ করে।অরিহা পড়ার টেবিলে বসে পরছে।আষাঢ় বিছানায় বসে। বোনকে কাছে ডাকে।অরিহা বই বন্ধ করে আষাঢ়ের পাশে এসে বসে।আষাঢ় বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,,

“আজ যা হয়েছে তার জন্য আমি দুঃখিত অরি। আমি যদি তোকে দিয়ে আসতাম তাহলে কখনোই এমন হতো না”

“ভাইয়া যা হয়েছে, হয়েছে বাদ দাও। চিত্রা আপু সব সামলে নিয়েছে।আপুর থেকে আমি অনুপ্রেরণা পেয়েছি। এখন থেকে আমিও অন্যায় হলে চুপ থাকবো না”

আষাঢ় ঠোঁট বিস্তৃত করে হেসে বলল,,,,“গুড মাই কিউট সিস্টার। তোমাকেও সাহসী হতে হবে। তুমিও তাহলে তোমার চিত্রা আপুর মতো হও”

অরিহা মাথা নাড়ায়। আষাঢ় ভালো করে পড়তে বলে বের হয়ে যায় রুম থেকে।মায়ের সাথে দেখা করে রুমে আসলো।একটু বিশ্রাম নিবে এখন সে।বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বিড়বিড় করে বলল,,
“চিত্রা আপনায় জানার আগ্রহ আমার প্রতি মুহূর্তে বেড়ে চলেছে।কি করে নিজের আগ্রহ দমাবো বলুন তো?”

#চলবে~