আসক্তিময়_ভালবাসা পর্ব-১৬

0
3107

#আসক্তিময়_ভালবাসা
#Part_16
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

গোধূলির আমেজ চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সূর্যমামাও হারিয়ে গিয়েছে পশ্চিম আকাশের অন্তরালে। অন্ধকার ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে হিম হিম ভাবও তীব্র হয়ে আসছে। এর সাথেই ব্যস্ত শহরটি হয়ে উঠেছে আরও ব্যস্তময়। মানুষের সোরগোল দরদর করে বেড়ে উঠছে। বড় রাস্তার ধারে সিগনালের জ্যাম লেগেছে। টানা হর্ণের শব্দে পরিবেশ তিক্ত হয়ে উঠছে। কিন্তু একজনের কাছে এই পরিবেশ তিক্ত নয় বরং বিষাক্ত লাগছে। অতি বিষাক্ত! ঘড়ির একেকটা কাটা যেন তার কাছে হাজারো বছরের সমান মনে হচ্ছে। বার বার ছটফট করছে। মন একদম অস্থির হয়ে আছে নিজের গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য। বড় রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছে বলে গাড়ি রেখে দৌঁড়ে যেতে পারছে না। নিজেকে যেন আজ তার বড্ড অসহায় লাগছে। বড্ড! হুট করেই জীবনটা বিষাদময় লাগছে। বার বার ঘড়ির দিকে নজর দিচ্ছে সে। সময়ের প্রহর যেন কাটতেই চাইছে না তারই সাথে সিগনালের জ্যামটিও। নিজেকে শান্ত রাখা এখন দায় সমান হয়ে উঠেছে। অবশেষে অপেক্ষার প্রহর শেষ আসে। সিগনাল জ্যামটি ছুটে যায় আর সেই লোকটি দ্রুত গতিতে গাড়ি ছুটিয়ে নিয়ে চলে ধানমন্ডি ক্লিনিকের সামনে।
বেশ কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়িটি এসে থামে ধানমন্ডি ক্লিনিকের সামনে। লোকটি হন্তদন্ত হয়ে গাড়ি থেকে নেমে ভিতরের দিকে অগ্রসর হয়। এগিয়ে যায় রিসেপশনের দিকে। ব্যাকুল কন্ঠে রিসেপশনিস্টকে জিজ্ঞেস করে,

— এক্সকিউজ মি মিস! আজকে বিকেলের দিকে এইখানে একজন মেয়েকে আনা হয়েছিল। নাম রিয়ানা। রাস্তায় একটা এক্সিডেন্ট হয়েছি তার। সে এখন কোন দিকে বলতে পারবেন?

রিসেপশনিস্ট অতি বিনয়ী সুরে বলে,

— লেট চেক স্যার।

অতঃপর সে জানায় এমন একজনকে এইখানে আনা হয়েছে। সে থার্ড ফ্লোরে আছে। সে আর অপেক্ষা না করে সিড়ি বেয়ে তিন তলায় উঠে পড়ে। দ্রুত পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। কিছু দূর যেতেই সে দেখতে পায় সামনের বেঞ্চেই রিয়ানা বসে আছে। দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। সে দ্রুত রিয়ানার কাছে চলে আসে। আলতো স্বরে ডেকে উঠে,

— রিয়ুপাখি!

আমি দেয়ালের সাথে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে ছিলাম। এমন সময় কাউরো অতি মধুর ডাকে চমকে উঠি। চটজলদি চোখে সামনে তাকাতেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটির চেহেরা ভেসে উঠে। আমি তাকে দেখে আলতো স্বরে বলে উঠি,

— ডা. রিয়ান!

রিয়ান কিছু না বলে আমার সামনে হাটু গেড়ে বসে। তার এহেন কান্ডে চমকে উঠি। আশেপাশে তাকিয়ে দেখি সকলে হা করে তাকিয়ে আছে। আমি তাদের দিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে রিয়ানের দিকে চোখ স্থির করি। তাকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকি। চুলগুলো একদম অগোছালো আর উষ্কখুষ্ক। চোখ দুটি অসম্ভব লাল। গায়ে এপ্রোণ নেই। পড়নের ইন শার্টটি খুলা। মুখ একদম রক্তশূণ্য হয়ে আছে। কেন জানি খুব মায়া হচ্ছিল তার উপর।

রিয়ান তার একটি হাত আমার গালে রাখে। সাথে সাথে আমি কেঁপে উঠি। অতি শীতল তার স্পর্শ। আমি কিছু বলতে যাব তার আগেই রিয়ান করুণ কন্ঠে বলে,

— তুমি ঠিক আছো? এইসব কিভাবে হলো?

এই বলে আমাকে করুণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। ডান সাইডের হাতের কুনই থেকে একটু নিচে ব্যান্ডেজ করা। ডান পায়ের নিচের দিকে আরেকটা ব্যান্ডেজ। মাথার একটি কোনায় ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ। বাম পায়ের আগাতে সেভলন দিয়ে ওয়াশ করে খোলা রাখা। মুখ একদম মলিন হয়ে আছে। আমি জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে ছোট করে বলি,

— মাঝ রাস্তায় রিকশার চাকা ছুটে যায় আর এক্সিডেন্টটা হয়ে যায়।

রিয়ান হুট করে রুদ্ধদ্বার কন্ঠে বলে উঠে,

— সব আমার দোষ। আমি তোমায় একা না ছাড়লে এমন কিছুই হতো না। সব আমার দোষ।

আমি দ্রুত বলে উঠি,

— একদম না। এতে আপনার দোষ ছিল না। ইট ওয়াস জাস্ট এন কয়েনসিড্যান্স।

রিয়ান কিছু না বলে চুপ করে থাকে। তার চোখ দুটো আরও রক্তিম হয়ে আসে। বেশ কিছুক্ষণ মৌনতা বজিয়ে রেখে সে উঠে দাঁড়ায়। কাঠ কাঠ গলায় বলে,

— বাসায় চল।

এই বলে আমার পিঠের নিচে হাত দিয়ে আমাকে উঠতে সাহায্য করে। আমি দাঁড়াতে নিলেই খট করে “আহ” বলে বসে পড়ি। ডান পা একদম মচকে গিয়েছে যার জন্য উঠে দাঁড়াতে পারছি না। তার উপর সারা শরীর জুড়ে টুকরো টুকরো ব্যথা তো আছেই। রিয়ান তা দেখে কিছুক্ষণ আমার মুখ পানে তাকিয়ে রইলো। আমি করুণ চোখে তাকাতেই সে আমায় কোলে তুলে নেয়। আর হাঁটা দেয়। ক্লিনিকে উপস্থিত সকলেই বিস্ময়কর চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। রিয়ান সেইসব তোয়াক্কা না করে এগিয়ে যেতে থাকে। আর আমি এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকি।

____________________________________________

বিছানায় পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছি। আমার মুখোমুখি হয়ে বসে আছেন রেনু আন্টি। তার মধ্যে বিচলিত ভাব স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। সে বার বার অস্থির ভরা কন্ঠে এইটা ওইটা জিজ্ঞেস করছেন। কথা বলতে গিয়ে চোখ তার নরম হয়ে এসেছে। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর তিনি চলে যান আমার জন্য সুপ করে আনতে। আন্টি যেতেই আমি বা দিকে তাকাই। রিয়ান দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। গভীর তার চাহনি। বেশিক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। চোখ ঘুরিয়ে নিলাম। কিছু সময় ব্যতীত তিনি ধীর পায়ে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। আমার পাশে বসে মৃদু কন্ঠে বলেন,

— আর ইউ ফিলিং বেটার নাও?

আমি কিছু না বলে মাথা দুইপাশে দুলাই। সে আমার হাত ধরে চেক করতে থাকে আমি অন্য কোথাও ব্যথা পেয়েছি কি না। পায়ে হাত দিতে নিলেই আমি চেঁচিয়ে উঠি,

— আরেহ আরেহ কি করছেন?

রিয়ান এক রাম ধমক দিয়ে আমায় চুপ করিয়ে দেয়। তারপর আমার পা দেখতে থাকে। তারপর আমার কাছে এসে মাথার চোটটা দেখতে থাকে। অতঃপর দেখা শেষে, তিনি ছোট করে বলেন,

— রেস্ট নাও।

এই বলে তিনি উঠে দাঁড়ান। আমাকে বিছানায় শুয়ে দিয়ে সিঙ্গেল কম্বলটা জড়িয়ে দেন। অতঃপর তিনি হুট করে আমার কপালে ভালবাসার পরশ এঁকে দেন। তারপর দ্রুত পায়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যান। আর আমি তার যাওয়ার দিকে হ্যাবলার মত তাকিয়ে থাকি। সব কিছু এত দ্রুত হলো যে আমার সবকিছু বুঝে উঠতে বেশ সময় লাগলো। অতঃপর বুঝতে পেরে আমার গাল দুটো লাল হয়ে যায়। সাথে সাথে আমি কম্বলের নিচে মুখ লুকাই।

_____________________________________________

একটু আগেই আদিব অফিস থেকে বাসায় ফিরেছে। ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে আসতেই পায়েল চায়ের কাপ নিয়ে হাজির। আদিব সেইদিকে একবার তাকিয়ে কিছু না বলে আয়নার সামনে চলে যায় চুল মুছার জন্য। পায়েল এতে একটু কষ্ট পেল ঠিকই কিন্তু তাও সে মুখে মিথ্যে হাসি ঝুলিয়ে নেয়। চায়ের কাপটা পাশের ছোট টি-টেবিলে রেখে দেয়। তারপর আদিবের দিকে এগিয়ে যায়। আদিবের হাত ধরে টেনে বিছানায় বসিয়ে দেয়। তারপর আদিবের কাছ টাওয়ালটা নিয়ে সুন্দর করে আদিবের মাথা মুছে দিতে থাকে। অতঃপর মুছা শেষ হলে পায়েল আলতো হাতে আদিবের চুলগুলো এলোমেলো করে দেয়। আদিব কিছু না বলে উঠে দাঁড়ায়। পায়েল তা দেখে পিছন থেকে হাত টেনে ধরে,

অতঃপর করুণ কন্ঠে বলে,

— আর একটা সুযোগ কি দেওয়া যায় না? পিছনের গ্লানি ভুলে নতুনভাবে সব শুরু করা যায় না?

আদিব এক ঝাটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,

— সব এতটা সোজা না। যে ঘা তুমি দিয়েছ তা অতি গভীর। এত সহজে তা লাঘব হবে না। আচ্ছা তোমার জায়গায় যদি আমি থাকতাম আর ঠিক এমন অবহেলা, কষ্ট উপহার দিতাম তাহলে কি তুমি পারতে আমাকে ক্ষমা করতে? সব ভুলে যেতে?
ডু ইউ নো হোয়াট? আমি নিজেও সব ভুলতে চাই কিন্তু পারি না। যতবারই তোমাকে দেখি ততবারই সেই তিক্ত স্মৃতি গুলো আমায় তাড়া করে। বড্ড পোড়ায় আমায়। কষ্ট ততোটুকুই দেওয়া উচিৎ যতটুকু সহ্যের সীমা থাকে। কিন্তু তুমি তো শুধু সেই সীমা লঙ্ঘন করোনি বরং আমায় এখন ছন্দছাড়া করে দিয়েছ।

পায়েল করুণ কন্ঠে বলে,

— আ’ম সরি!

আদিব তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,

— সরি বললেই কি সব ঠিক হয়ে যায়? তোমার দেওয়া কষ্টের সামনে এই সরি কি অতি তুচ্ছ নয়?

পায়েল ছলছল চোখে আদিবের দিকে তাকায়। আদিব পায়েলের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে দ্রুত পায়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। এইখানে থাকলে হয়তো সে দূর্বল হয়ে পড়বে যা সে চায় না। সে চায় পায়েলকে বুঝাতে আসলে সে কি হারাতে বসেছিল। সাথেই ভবিষ্যতে এমন কথা যাতে দ্বিতীয় বার লুকাবার আগে ও একশবার ভাবে।

এইদিকে পায়েল আনমনে বলতে থাকে,

— যত যাই হোক আদিব আমি আপনাকে মানিয়েই ছাড়বো। এর জন্য যদি আপনার উপর আমাকে স্ত্রীর অধিকার দেখাতে হয় তাহলে তাই হোক।

_____________________________________________

বিছানায় আধশোয়া হয়ে শুয়ে আছি। একটু আগেই আন্টি আমায় খাবার আর মেডিসিন খায়িয়ে দিয়ে গিয়েছেন। খাওয়ার সাথে সাথে শোয়া ভালো নয় বিধায় এইভাবে বসে আছি।চোখ বন্ধ করে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে আছি। এমন সময় কাউরো পায়ের আওয়াজ পেয়ে চোখ খুলে তাকাই। দরজার দিকে তাকাতেই রিয়ানকে চোখে পড়ে। চেহেরায় তার গম্ভীরতা। সে আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে একটা চিরকুট এগিয়ে দেন। তা দেখে আমার ভ্রু কুটি কুঞ্চিত হতে আসে। আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তার মুখপানে তাকিয়ে থেকে চিরকুটটার দিকে তাকাই। অতঃপর আলতো হাতে চিরকুটটা নেই। চিরকুটটা খুলে দেখি একটা নাম্বার। আমি কৌতূহলী দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাই। সে কাঠ কাঠ গলায় বলে,

— আমার নাম্বার এখনই মুখস্থ করো। যতক্ষণ না তুমি এই নাম্বার মুখস্থ করছো ততোক্ষণ আমি তোমার রুম থেকে যাচ্ছি না।

তার কথা শুনে আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে যাই।
অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলি,

— মানে?

রিয়ান ট্রাউজারের পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে বলে,

— আমি চাইনিজে বা বাংলিশ ভাষায় কিছু বলি নি যে তোমার বুঝতে অসুবিধা হবে।

আমি এইবার নিজেকে সামলে বলি,

— না মানে কেন?

রিয়ান আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

— এক্সিডেন্ট করে মোবাইল হারিয়েছ ভালো কথা। অতঃপর সাহায্যের জন্য ফোন দিয়েছ কার কাছে আঙ্কেলের কাছে। সে আবার আমায় ফোন দিয়ে জানিয়েছে আর আমায় যতদ্রুত সম্ভব তোমার কাছে যেতে বলেছে…

আমি কথার মাঝে ফোড়ন দিয়ে বলি,

— এতে আমার কি দোষ? আমার আব্বু বাদে কাউরো নাম্বার মুখস্ত নেই। এখন একা একা আসতে পারছিলাম না বলে বাধ্য হয়ে আব্বুকে ফোন দিতে হয়। তখন আমি আব্বুকে বলি আপনাকে ফোন দিয়ে জানাতে।

রিয়ান কঠোর কন্ঠে বলে,

— বাই এনি চান্স ভবিষ্যতে যদি আবার কোন বিপদ হয় আর তোমার আর্জেন্ট সাহায্য প্রয়োজন তখন কি আজকের মতই করবে নাকি? ষ্টুপিড!
এখন যা বলছি তা করো। মুখস্থ করো নাম্বারটা।

আমি কাঁদো কাঁদো হয়ে বলি,

— আমি তো এখন অসুস্থ। তাই বলছি কি কালকে মুখস্থ করি?

রিয়ান সোজাসাপটা ভাবে বলে,

— সো নো মোর এক্সকিউজ। চুপচাপ মুখস্থ করো আমি এইখানেই আছি। হারি আপ!

আমি বিরবির করে বলি,

— আস্ত খাটাশ একটা। অসুস্থ দেখার পরও একটু মায়া দয়া করে না। বদদোয়া দিলাম, এর কপালে যাতে কোন কালেই বউ না জুটে। হুহ! খাটাশ! খাটাশ! খাটাশ!

রিয়ান এইবার গলা খেঁকিয়ে বলে,

— হারি আপ!

আমি এইবার কাঁদো কাঁদো হয়ে নাম্বার মুখস্থ করতে থাকি। আর মনে মনে রিয়ানের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করতে থাকি।

#চলবে