#আসক্তিময়_ভালবাসা
#Part_17
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
চারদিকে মিষ্টি রোদের ছড়াছড়ি। দক্ষিণা জানালা দিয়ে এক ফালি রোদ এসে পড়ছে রুমের মেঝেতে। দূর আকাশে উড়ে চলেছে কাকপক্ষী। জানালার কার্নিশে দুই জোড়া চড়ুই পাখি বসে খুনসুটি করছে। মৃদু বাতাসে শুকনো পাতা গুলো ঝরে ঝরে পড়ছে। বেশ মিষ্টি এক পরিবেশ। আমি বাবার কাধে মাথা রেখে দক্ষিণা জানালার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি৷ মা আমাকে পরম যত্নে নাস্তা খায়িয়ে দিচ্ছে। আমার এক্সিডেন্টের কথা শুনে বাবা আর মা দুইজনই সকাল সকালই চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে হাজির হয়। এসেই আমাকে দেখার জন্য একদম অস্থির হয়ে পড়েন। অতঃপর রুমে এসে একদম প্রশ্নের ঝড় তুলে ফেলে। বাবা সব জানার পরও কেমন হাস-ফাস করছিল। হয়তো আমার হাতে, পায়ে ব্যান্ডেজ গুলো দেখে। মা তো একদম কেঁদে দেয় দেয় অবস্থা। মা আমার একটু বেশি ইমোশনাল। সবার বেলায় না। শুধু আমার বেলায়। এইদিকে আমি তাদের দুই নয়ন ভরে দেখছিলাম। কতদিন পর দেখছি তাদের। আমি তাদের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিতেই তারা মূহুর্তে শান্ত হয়ে যায়। অতঃপর তাদের বুঝাই আমি ঠিক আছি। তখন গিয়ে তারা প্রশান্তির নিঃশ্বাস নেয়। তাও মনের মধ্যে তখনও কিছুটা সংকোচ রয়েই যায়।
এইদিকে আন্টি বাবা-মাকে দেখে তোড়জোড় লাগিয়ে দেয়। ভালো-মন্দ রাঁধতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আঙ্কেল গিয়েছে বাজারে। আঙ্কেল বাবাকে দেখে আজকের সকল মিটিং ক্যান্সাল করে দেয়। কতদিন পর দেখা। তাই আজকে সে বাবার সাথে জমিয়ে আড্ডা দিবে। রিয়ান বাবা-মার সাথে দেখা করে চলে যায় মেডিক্যালে।
মা আমাকে খায়িয়ে দিচ্ছে আর সমান তালে বকে চলেছে।
— রিকশায় উঠার আগে ভালোমত দেখে শুনে উঠবি না?
আমি মার দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলি,
— রিকশা আবার কেমনে দেখে মা? আমি এখন মেকানিকের সকল পার্ট খুলে খুলে চেক করে তারপর উঠবো নাকি?
মা এক ধমক দিয়ে বলে,
— একদম বেশি কথা বলবি না। এখন থেকে রিকশায় উঠলে দেখে উঠবি ব্যাস।
আমি শান্ত ভঙ্গিতে বলি,
— আচ্ছা! তাহলে আমাকে একটা কথার উত্তর দাও। যদি উত্তরটা দিতে পারো তাহলে আমি তোমার কথা শুনবো।
মা আমার মুখে খাবার ঢুকিয়ে দিয়ে বলে,
— আচ্ছা বল।
আমি খাবার চিবুতে চিবুতে বলি,
— টেবিলের উপর রাখা ওই দুই কলমের দিকে তাকিয়ে বলতো কোনটায় কালি আছে আর কোনটায় কালি নেই?
আমার কথায় মা যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলে,
— ফাজলামো করছিস? দুইটা কলমই তো এক। বাহির দিক দেখে কিভাবে বলবো যে কোনটায় কালি আছে কোনটায় নেই?
আমি এক চিলিক হাসি দিয়ে বলি,
— এক্সেক্টলি! যেমন তুমি কলম দুইটির বাহির দিক দেখে বুঝতে পারলে না কোনটায় কালি আছে আর কোনটায় নেই, তেমনেই রিকশার বাহির দেখে আমি কিভাবে বুঝবো সেটা ত্রুটি আছে নাকি নেই? আর এইটা শুধু রিকশার বেলায় নয় বরং সকল জিনিসের উপরই প্রযোজ্য। এমন কি মানুষদের উপরও৷ বাহির দিক দিয়ে কখনোই বুঝা যায় না তার ভিতর কেমন। তাই তো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সকলে মানুষ চিনতে ভুল করে।
মা আমার দিকে চোখ রাঙ্গিয়ে বলে,
— এত জ্ঞানী জ্ঞানী কথা তোকে কে বলতে বলেছে? ডাক্তারি পড়ে কি জ্ঞান বেশি বেড়ে গিয়েছে তা বুঝাচ্ছিস?
আমি কিছু না বলে হাল্কা হাসি। বাবাও আমার সাথে মিটিমিটি করে হাসছে। তা দেখে মা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বলে,
— বাপ-মেয়ে হয়েছে একপদ। দুইজনেই বদের হাড্ডি। এদের নিয়ে যে আমি এতবছর ধরে কিভাবে সংসার করছি তা আল্লাহ মাবুদই জানে।
এই বলে খাবার প্লেট নিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে চলে যায়। তা দেখে আমি উচ্চ স্বরে হেসে উঠি। মাকে এইভাবে রাগাতে আমার বেশ লাগে। বাবা তা দেখে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
— এইভাবেই সবসময় হাসি খুশি থাকিস মা।
বাবার এমন কথা শুনে আমি চমকে উঠি। সোজা হয়ে বিসে তার দিকে তাকিয়ে দেখি সে আমার দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে। তা দেখে আমার বুক ছেত করে উঠে। পুরানো কিছু স্মৃতি টনক নেড়ে উঠে। আমি অস্পষ্ট স্বরে বাবাকে জিজ্ঞেস করি,
— আব্বু তুমি হঠাৎ এই কথা কেন বললে? কিছু কি হয়েছে?
বাবা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,
— তোর থেকে কিছু লুকাতে চাচ্ছি না। কেন না লুকালে তোরই ক্ষতি। আবার তোকে সেই ঘটনা মনে করে দিতেও চাইছি না।
আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করি,
— কি বলতে চাইছো?
বাবা আমার দিকে করুন চোখে তাকিয়ে বলেন,
— ওরা খুঁজছে তোকে। আমি কথাটা জানার সাথে সাথে বিষয়টা কোন মতে চাঁপিয়ে দেই। কিন্তু তা কতক্ষণ তা আমার জানা নেই। তাই তোকে সাবধান থাকতে হবে। যেকোন মূহুর্তে তারা তোর খবর পেতে পারে।
আমি ভয়ে কয়েকটা ঢোক গিলি। অস্থির হয়ে উঠি। অতঃপর লম্বা লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করি। নিজের মনোবল শক্ত করি। বাবার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলি,
— পরিনতি কি খুব খারাপ হবে?
বাবা আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
— পরিনতি তো সেই শুরু থেকেই নির্ধারিত। সব জেনে শুনেই তো তুই ডিসিশনটা নিয়েছিলি। ডিসিশনটা তো সম্পূর্ণ তোর ছিল আমার না। তাই এখন খুব খারাপ হবে নাকি কম তা ভেবে লাভ কি?
আমি বাবার দিকে তাকিয়ে মৃদু গলায় বলি,
— এখনো রেগে আছো?
— রেগে থেকে আর কি লাভ বল? যা হওয়ার তা তো হয়েই গিয়েছে। সবই এখন ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছি। কিন্তু এর মাঝে মধ্যে এর পরিনতির কথা ভাবলে বুকটা হাহাকার করে উঠে। তোর…
আমি বাবাকে বলতে না দিয়ে বলি,
— যা হওয়ার হবে। তুমি ভালো করেই জানো তোমার মেয়ে এইসবে ভয় পায় না। আর না কখনো পাবে৷
বাবা মিষ্টি হাসি হেসে বলে,
— তার প্রমাণ তো আরও কয়েক বছর আগেই পেয়েছি। কিন্তু কি করবো বল? বাবার মন তো। কিভাবে মানবো বিষয়টা আমি বল?
— অপ্রিয় সত্য হলেও এইটা তোমায় মানতেই হবে। নিজেকে নিয়ে আমার কোন চিন্তা নেই। চিন্তা তো শুধু অন্য কিছু না। সে যাই হোক! এখন আর এই বিষয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না। যা হওয়ার হবেই। তোমাকে এইসব নিয়ে ভাবতে হবে না। আর হ্যাঁ! তুমি প্লিজ নরমাল থেক। প্লিজ!
বাবা আর কিছু না বলে আমার দিয়ে করুণ চোখে তাকালেন। তারপর বলেন,
— আরেকবার কি ভেবে দেখে যায় না?
আমি কাঠ কাঠ গলায় বলি,
— না!
বাবা আর কিছু না বলে চুপ হয়ে রইলেন। আমিও চুপ করে রইলাম। মাথাটা এখন ভনভন করছে৷ সবকিছু ঘোলাটে লাগছে। ধোঁকা ধোঁকা লাগছে সব। জীবনটাকে বিষাদময় লাগছে।
____________________________________________
বিকেলে আধশোয়া হয়ে শুয়ে আছি। চোখ দুটো বন্ধ করে গভীর ভাবে কিছু ভাবছি। এমন সময় দরজা খুলার আওয়াজ কানে আসতেই চোখ খুলি। দরজার দিকে তাকাতেই রিয়ানকে দেখতে পাই। সে ধীর পায়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। পড়নে নেভি ব্লু টি-শার্ট আর গ্রে কালারের ট্রাউজার। হাত দুইটি ট্রাউজারের পকেটে ঢুকানো। চুলগুলো ভেজা অবস্থায় থাকায় কপালের সাথে একদম লেপ্টে গিয়েছে। বুঝাই যাচ্ছে মেডিক্যাল থেকে এসে কিছুক্ষণ আগেই শাওয়ার নিয়ে বেড়িয়েছেন। চোখে মুখে স্নিগ্ধতা ছেঁয়ে আছে। একবার তার মুখপানে তাকালে চোখ ফিরানো দায় সমান। আমি বেশকিছু ক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নেই৷ এইভাবে তাকে চেক আউট করা ঠিক না।
এইসব ভাবতে ভাবতেই রিয়ান আমার একদম কাছে চলে আসে। মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
— শরীর এখন কেমন?
আমি তার তার দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বলি,
— হ্যাঁ ভালো।
রিয়ান কিছুক্ষণ আমার মুখপানে তাকিয়ে থেকে নিজের পকেট থেকে চারটি ডেইরি মিল্ক সিল্ক বের করে এগিয়ে দেয়। তারপর বলে,
— তোমার জন্য!
আমি মুচকি হেসে চকলেট গুলো নিয়ে নেই। তারপর মিষ্টি হাসি হেসে বলি,
— এইগুলা আমার ফেবারিট। থেংক ইউ সো মাচ। বাই দ্যা ওয়ে হঠাৎ চকলেট দিলেন যে?
রিয়ান পুনরায় পকেটে হাত গুঁজে বলে,
— এমনি!
আমি তার দিকে ছোট ছোট করে তাকিয়ে থেকে বলি ,
— উহু! আপনি মিথ্যে বলছেন। আপনি মোটেও এমনি এমনি আমায় চকলেট দেন নি। বরং আমার সাথে উঁচু গলায় কথা বলেছিলেন প্লাস জোর খাটিয়েছেন বলেই আপনার এখন খারাপ লাগছে। তাই ক্ষমা হিসাবে এই চকলেট গুলো দিচ্ছেন। কিন্তু মুখে তা শিকার করছেন না।
কিন্তু কথা গুলো আর রিয়ানকে বলতে পারলাম না। বরং মনে মনেই বললাম। অতঃপর দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বললাম,
— অহহ আচ্ছা৷
তখনই আমার চোখ যায় রিয়ানের ডান হাতের কুনোই এর দিকে। সেখানে ছোট ছোট দুইটা ওয়ানটাইম ব্যান্ডেজ লাগানো। আমি চট জলদি পায়ের দিয়ে তাকিয়ে দেখি সেখানেও এমন দুইটো ওয়ানটাইম ব্যান্ডেজ লাগানো। তা দেখে আমি রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলি,
— হাতে পায়ে ব্যথা কিভাবে পেলেন?
রিয়ান ভাবলেশহীন ভাবেই বলে,
— এইতো!
আমি এইবার চুপ করে তারদিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। আমার আর বুঝতে দেরি নেই যে রিয়ান আবার নিজেকে আঘাত করেছে। এমনই হয়! আমি কোথাও ব্যথা পেলে পরের দিনই রিয়ানও সেই একই জায়গায় ব্যথা পেয়ে বসে আছে। প্রথমত সবই কয়েন্সিড্যান্স ভাবলেও পরে বুঝতে পারি সবই ইচ্ছাকৃত। কিন্তু আমি কখনো তার কারণ জিজ্ঞেস করিনি। এর মূখ্য কারণ উত্তর হয়তো বা আমি জানি। কিছু কিছু জিনিস মুখে বলা লাগে না। এইভাবেই তা অনুভব করা যায়, বুঝা যায়। রিয়ানের বেলায়ও সেম। আমি ছোট এক নিঃশ্বাস নিয়ে রিয়ানের দিকে তাকাতেই দেখি সে গভীর নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার যেন কি হলো জানি না। আমি চট করে বলে উঠি,
— ডু ইউ লাভ মি?
#চলবে