আসক্তিময়_ভালবাসা পর্ব-২৮

0
2795

#আসক্তিময়_ভালবাসা
#Part_28
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

এক হাত কপালে রেখে শুয়ে আছি। আমাকে বাহির দিয়ে যতই শান্ত দেখাক না কেন, ভিতর দিয়ে আমি একদম অশান্ত হয়ে আছি। পুরো মস্তিষ্ক জুড়ে ঘুরচ্ছে হাজারো প্রশ্ন। অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে প্রশ্নগুলোর শুরু আর শেষ সেই একটি জায়গায় এসে স্থির হচ্ছে। সেই ১ বছর আগের ঘটনার উপর। মন মস্তিষ্ক বার বার সেই ১ বছর আগের ঘটনার সাথে সকল ঘটনা সংযুক্ত করে উত্তর খুঁজতে চাইছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে উত্তর তো মিলছেই না বরং ঘুরে ফিরে নতুন প্রশ্ন বেড়িয়ে আসছে। কেন এমন হচ্ছে জানি না।

এক বছর আগে, সেইদিন রিয়ান আমায় বাসায় নিয়ে এসেছিল। আমিও রিয়ানকে বিশ্বাস করে তার হাতে মেডিসিন আর পেনড্রাইফটা তুলে দিয়েছিলাম। তিনি সেগুলো নিয়ে শুধু এইটাই বলেছিলেন, “এখন কোন প্রশ্ন করো না। উত্তর আমি দিতে পারবো না। সময় হোক সব প্রশ্নের উত্তর তুমি পাবে। যা যেভাবে চলছে চলতে দাও। শুধু তুমি স্বাভাবিক থেক। আর হ্যাঁ ইউ আর সেফ নাও। সো ডোন্ট ওয়ারি।” আমিও বিনাবাক্যে তার কথা মেনে নিয়েছিলাম। ঠিক এতটাই গাঢ় ছিল আমার বিশ্বাস। সেই ঘটনার এক সপ্তাহ পরেই রিয়ান নিজের জব ছেড়ে সিডনি চলে যায়। যাওয়ার আগে তিনি সবাইকে বলেছিলেন সিডনিতে তার একটা কাজ আছে। আসতে আসতে বেশ সময় লাগবে। সেইদিন আমি তাকে না করেছিলাম কোন প্রশ্ন, না বলেছিলাম কোন কথা। শুধু নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। আর এই দৃষ্টিতেই যেন ছিল হাজারো না বলা প্রশ্ন।

কিন্তু আজ নতুন করে মনে প্রশ্ন জাগছে যে, “এই এক বছর রিয়ান কোথায় ছিল? আদৌ কি রিয়ান সিডনিতেই ছিল? সে ওই মেডিসিন আর পেনড্রাইভ দিয়ে কি করেছে? সেগুলো এখন কোথায়? সে কেন এই একবছর একবারের জন্যও কাউরো সাথে কোন যোগাযোগ করে নি? সে কি ভালো আছে?”
এমন হাজারো প্রশ্নের বসবাস এখন আমার মস্তিষ্ক জুড়ে। প্রশ্নের গভীরতায় তলিয়ে যাচ্ছি। এমন সময় দরজায় টোকা পড়ে। সাথে সাথে আমি আমার প্রশ্নের জগৎ থেকে বেড়িয়ে আসি। আন্টি খাওয়ার জন্য ডাকছে। আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে উঠে বসি। অতঃপর এগিয়ে যাই দরজার দিকে।

ডাইনিং এ আসতেই বা পাশে বসে থাকা একটি যুবকের উপর চোখ পড়ে আমার। সে মাথা নিচু করে বসে আছে। বুঝতে দেরি নেই সেই রিয়ান। রিয়ান মাথা তুলে তাকাতেই আমাদের চোখাচোখি হয়ে যায়। সাথে সাথে আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। যেই সাক্ষাৎটির জন্য এতটা সময় অপেক্ষা করেছি অবশেষে আমাদের সেই কাঙ্ক্ষিত সাক্ষাৎটি পূর্ণ হয়েছে। আমি এক ধ্যানে রিয়ানের দিকে তাকিয়ে আছি। গায়ের রঙ আগের চেয়ে আরেক সেড নিচে নেমে এসেছে। মুখ একদম মলিন হয়ে আছে। চোখের নিচে বেশ কালি পড়েছে। বুঝাই যাচ্ছে অনেক দিন ধরে ঘুমান না। চুলগুলো কেমন ধূসর রঙ ধারণ করেছে। যেন এতে কোন প্রাণ নেই। সরু ঠোঁট দুটো কেমন কালচে হয়ে আছে। কিন্তু এখনো তার বাম গালের তিলটা আমার কাছে স্পষ্ট। তার এই অবস্থা দেখার সাথে সাথে আমার ভিতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগতে শুরু করে। কান্নাগুলো যেন দলা পাকাতে শুরু করে। কণ্ঠনালী ভারী হয়ে আসে। মনে হচ্ছে যেন ছোট এক নুড়িপাথর আটকে আছে এতে। আমি তার দিকে করুণ চোখে তাকাতেই সে মলিন হাসি হাসে। সাথে সাথে বুকটা আমার দুমড়ে মুচড়ে যায়। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। মন বার বার একই চরণ উচ্চারণ করতে থাকে, “রিয়ান ভালো নেই। একদম ভালো নেই।”
আমাকে কিছু বলতে না দেখে রিয়ান নিজ থেকেই বলে উঠে,

— ভালো আছো?

তার কন্ঠেটা আজ কেমন যেন শুনাচ্ছিল। মনে হচ্ছে এই একটি কথার মাঝে লুকিয়ে আছে অজস্র যন্ত্রণা। আমি অনেক কষ্টে জবাব দেই,

— হ্যাঁ। আপনি?

সে প্রত্যুত্তরে শুধু ম্লান হাসে। যা ক্ষণে আমার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। তার মানে কি সত্যি রিয়ান ভালো নেই? কিন্তু কেন? আমি কিছু না বলে চুপচাপ রিয়ানের অপর পাশে গিয়ে বসি। চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখি আন্টি রান্নাঘরে আছে আর আঙ্কেল এখনো টেবিলে এসে উপস্থিত হন নি। আমি রিয়ানের দিকে তাকাতেই দেখি সে গভীর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমিও তার দিকে তাকাই। বেশ কিছুক্ষণ পর রিয়ান হুট করেই বলে উঠে,

— রাতে ছাদে এসো।

কথাটি বলেই রিয়ান মাথা নিচু করে ফেলে। আমি তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর যেই না মুখ খুলতে যাব তখনই আঙ্কেল এসে হাজির হয় আমাদের মাঝে। আমিও তাকে দেখে চুপ হয়ে যাই। ক্ষণেক এর মাঝেই আন্টি সালাদের প্লেট নিয়ে হাজির হয়। আন্টি আর আঙ্কেলের চেহেরায় স্পষ্ট অভিমান ফুটে উঠেছে। অভিমান হওয়ারই কথা। এই একটা বছর তিনি সবার থেকে দূরে থেকেছেন। তার উপর আমি যেমন তার কোন খোঁজ-খবর পাই নি তারাও পায় নি। যোগাযোগের কোন মাধ্যমই তিনি খোলা রাখেন নি। রিয়ানের জন্য সবসময় তাদের টেনশন লেগেই থাকতো। এত সহজে হয়তো রিয়ান এই-বার ক্ষমা পাবেন বলে মনে হয় না। অবশ্য সে জানে কিভাবে তাদের রাগ ভাঙ্গাতে হয়। কথাটা ভেবেই নিঃশব্দে নিঃশ্বাস ফেলি।

____________________________________________

ছাদে পা রাখতেই কেউ আমাকে টান দিয়ে দিয়ে ছাদের ভিতর নিয়ে আসে এবং দরজাটা আটকিয়ে দেয়। আমি আতঙ্কিত চোখে সামনে তাকাতেই রিয়ানের মলিন চেহেরাটা ভেসে উঠে। মূহুর্তেই আমার অশান্ত মন শান্ত হয়ে যায়। সে কিছু না বলে আমাকে জড়িয়ে ধরে। সাথে সাথে আমার নাকে সেই চিরচেনা ঘ্রাণটি এসে বারি খায়। ঘ্রাণটি নাকে আসতেই আমার ঠোঁটের কোনে ভেসে উঠে। কিন্তু পরক্ষণেই আমি দ্বিধাদ্বন্দে ভুগতে থাকি। তাকে কি আমি জড়িয়ে ধরবো নাকি না? বেশ কিছুক্ষণ নিজের মন ও মস্তিষ্কের সাথে যুদ্ধ করে আমি আলতো হাতে তার পিঠে হাত রাখি। রিয়ান ধীর কন্ঠে বলে,

— আজ প্রায় এক বছর নিজের নিঃশ্বাস ফিরে পেয়েছি আমি।

কথাটা শুনা মাত্র মনের মধ্যে ভালো লাগার স্নিগ্ধ হাওয়া বয়ে যায়। আমি মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞেস করি,

— আপনি ভালো আছেন?

রিয়ান ধরা গলায় বলে,

— আগে বলো তুমি ভালো আছো?

— হ্যাঁ ভালো আছি।

— তাহলে আমি কিভাবে ভালো থাকি বলো?

আমি আর কিছু না বলে চুপ করে থাকি। মূহুর্তটা নিজ মত করে উপভোগ করতে থাকি। রিয়ান এইবার মৃদু কন্ঠে বলে,

— কেউ যদি কাউরো প্রতি তীব্রভাবে আসক্ত হয়, তাহলে সে তাকে ছাড়া কিভাবে ভালো থাকতে পারে? আমি তো পারি না।

আমি হাল্কা হেসে বলি,

— কিন্তু পেরেছেন তো ঠিকই।

কথাটা স্বাভাবিক ভাবে বলতে গেলেও সেটা অভিমানী সুরে বেড়িয়ে আসে। তা শুনে রিয়ান বলে,

— আজ তোমার সব অভিমান দূর করে দিব। তোমার সকল প্রশ্নের উত্তর দিব আজ। ইতি টানবো তোমার আর আমার অপেক্ষার প্রহরের।

#চলবে