আসমানী পর্ব-০৬

0
165

#আসমানী
#পর্ব_৬
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা

“আমার মনে হচ্ছে আমার আদরে ভাগ বসিয়েছো তুমি ভাবী।” মুখ গোমড়া করে বলে নাতাশা।
“কেন?কি দেখে মনে হচ্ছে তোমার যে আমি তোমার আদরে ভাগ বসিয়েছি? ”
“তুমি আসার আগে আমি বাবা আর ভাইয়াকে কত বলেছি আর কিছু না হোক,টিউবওয়েল এর চারপাশে বেড়া দাও।কিন্তু দেয় নি।আর তুমি আসতে না আসতেই নতুন ঘর বানাবে।তাও নাকি ছাদ সহ।এতোদিন টাকা নেই টাকা নেই আর এখন এতো টাকা কোথা থেকে এলো?”
আসমানী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এই বয়সের মেয়েরা হুট করেই কাউকে ভালোবেসে ফেলে।আবার হুট করেই তার প্রতি বিতৃষ্ণা আনতেও দ্বিধাবোধ করে না।কাউকে মন দিয়ে ফেললে তার থেকে সহজে মন উঠাতে পারে না।আবার কারো থেকে মন উঠে গেলে সারাজীবনেও তাকে আর মনে জায়গা দিতে পারে না।নাতাশা যে তাকে পছন্দ করে সেটা আসমানী বুঝতে পারে।কিন্তু এই সামান্য কারণে যদি ওর মনে খারাপ প্রভাব পড়ে,তবে আসমানীকে সে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতেও দুবার ভাববে না।
আসমানী নিজের চুল আঁচড়ে চিরুনি রেখে বলে,”তুমি কি খুশী নও যে তোমাদের বাড়িতে বড় ঘর হচ্ছে?”
“হ্যাঁ, আমি খুশী।কিন্তু আমার কথা তো ভাবলো না ওরা কেউ আগে।তুমি আসলে বলেই তো এতো আয়োজন সবার।”
“আসলে কিন্তু বিষয়টা এমন না।”
“তাহলে বিষয়টা কেমন?”
“এতোদিন তোমার ভাইয়ের চাকরি ছিল না।তোমার বাবার টাকায় সংসার চলেছে।তোমার বাবা খুব হিসেবী মানুষ সেটা তো তুমি জানোই।নিজের চাকরির বেতন থেকে কিছু টাকা সে জমিয়ে রেখেছিল যদি তোমার ভাই তার অবসর নেওয়ার পরেও চাকরি না পায়,তবে কোনো বিজনেস শুরু করার জন্য। কিন্তু যেহেতু তোমার ভাই এখন চাকরি পেয়েছে,এখন ভবিষ্যতের খাওয়া পড়ার চিন্তা নেই।তোমার ভাইয়ার টাকায় সংসার চলে যাবে ইনশাআল্লাহ। আর তোমার বাবার পেনশনের টাকা তোমার বাবা নিজের কাজে খরচ করতে পারবে।আর আমিও তো আছি।আমি তো টিউশনি করাই।যথেষ্ট ভালোই ইনকাম হয়।আর যদি এর মাঝে একটা চাকরি পেয়ে যাই,তাহলে কোনো সমস্যাই থাকার কথা না। কিছু কি বুঝলে?”

নাতাশা মাথা নাড়ায়। যার অর্থ সে বুঝেছে।আসমানী আবার বলে,”সবকিছুই নির্ভর করছিল তোমার ভাইয়ার চাকরির উপর।তাই তোমার বাবার বিজনেস এর জন্য রাখা টাকায় ঘর বানাতে পারছে।নতুন ঘর হলে অনেক ভালো হবে বলো?”
“হ্যাঁ, অনেক ভালো হবে।পানির ট্যাংক থাকবে,আমার রুমের সাথেই এটাস্ট বাথরুম থাকবে।আমি ইচ্ছে মতো গোসল করতে পারবো।যতো খুশী ততো পানি খরচ করতে পারবো।আর থাকবে একটা ছাদ।আমি ছাদে উঠে কত কিছুই না করবো।ছোট বেলা থেকেই একটা ছাদওয়ালা বাড়ির ভীষণ শখ আমার।আমাদের বেশিরভাগ আত্মীয়দের বাসায়ই ছাদ আছে।শুধু আমাদের নেই।আমাদের একটা ওয়াল করা টিনের বাসা।ভালো লাগে না আর।”

নাতাশার কথা শুনে আসমানী কেমন উদাস হয়ে যায়।একটা ছাদওয়ালা বাসার স্বপ্ন কি তারও নেই?চব্বিশ ঘন্টা পানি থাকবে যেখানে?নিজের অতীতের কথা ভাবলে ভীষণ কষ্ট হয় তার।কেমন ছিল তার জীবন আর এখন কেমন।সকালে মা খাইয়ে দিলে তবেই ভার্সিটি যেতো।সারাক্ষণই পানি থাকতো।গরমের দিনে বাথটাব ভর্তি বরফ কুচি দিতো।আর শীতে গীজারের গরম পানি।সন্ধ্যায় বন্ধুদের সাথে দামী রেস্টুরেন্টে আড্ডা সাথে গরম গরম কফি।আর ছিল এক ছাদ যেখানে মনের সাথে মনের আনন্দে কথা বলা যেতো নিশ্চিন্তে।সেই সব গেলো কোথায় সব?আর কি কখনো ফেরত পাবে সেইসব?আসমানী জানে সে পাবে না।তবু যখন খুব করে পেতে ইচ্ছে করে,তখন সে চোখ বন্ধ করে থাকতো।আর ভাবতো,”আমি চোখ খুলবো আর দেখবো আমার বোন আমার সব লিপস্টিক নষ্ট করে দিয়েছে।চোখ খুলেই দেখবো আমার ভাই আমার বরফ কুচি দেওয়া ঠান্ডা পানিতে গোসল করে নিয়েছে।চোখ খুললেই দেখবো আমার ভাই-বোন আমার নামে মায়ের কাছে মিথ্যে নালিশ দিচ্ছে।আর আমি মাথা পেতে হাসি মুখে সেই সব মিথ্যে নালিশ মেনে নিবো।”
কিন্তু বারবারই আশাহত হয় আসমানী।হোস্টেলে থাকাকালীন সময়ে চোখ খুললেই ৫ জন মেয়ের চিল্লাপাল্লা,নোংরা বাথরুম আর বারান্দা বিহীন একটা রুম দেখতে পেতো।আসমানীর ইচ্ছে করতো গলা ফাটিয়ে কান্না করতে।কিন্তু নিজেকে যতোটা সম্ভব শক্ত করে নিয়েছিল সে।সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।সে তার কথা রাখবেই।

“কোথায় হারালে ভাবী? তোমরা না আজ ঘুরতে যাবে?ভাইয়া আসবে কখন?”
নাতাশার কথায় হুশ ফিরে আসে আসমানীর।ধীরে ধীরে বলে,”যাবো তো।তোমার ভাইয়া আসলেই যাবো।”
“ওকে।তাহলে তুমি বরং রেডি হও।আমার আবার কোচিং আছে।যেতে হবে।নাবিলকে বলে দেখি আমাকে সাইকেলে করে দিয়ে আসে নাকি।”
“এই,তুমি নাবিলকে নাম ধরে ডাকো কেন?ও তোমার বড় ভাই না?”
নাতাশা ঠোঁট উলটে বলে, “বড় ভাই না ছাই।এতো সম্মান কই থেকে দিব ওকে?মাথা মোটা গ*বে*ট একটা।”
নাতাশা চলে গেলে আসমানী আবার নিজের ভাই-বোন এর কথা ভাবতে থাকে।ওরাও তাকে আপু বলতো না।বোনটা তো তাও মাঝে মাঝে ডাকতো।কিন্তু ভাই টা মোটেও আপু ডাকতো না।বলতো আসমান।ভাই-বোনের কথা ভেবেই পানি চলে আসে আসমানীর চোখে।নিজের কাছেই আরো একবার প্রতিজ্ঞা করে সে তার প্রতিজ্ঞা সে রক্ষা করবেই।
★★★
“তোমাকে সুন্দর লাগছে আসমানী।ইচ্ছে করছে না বাইরে যেতে।মন চাইছে এখন বসে বসে তোমাকেই দেখি।”
“বাজে কথা বলবেন না।সবাইকে বলেছেন আমরা বাইরে যাবো।এখন যেতে না চাইলে কি ভাববে সবাই?”
“যা ভাবার ভাববে। তাতে আমার কি?”
“এখন আবার কোথায় গিয়েছিলেন?”
“ইট,সিমেন্টের দোকানে।”
“কেন?এখন আবার কেন গিয়েছিলেন? কালকেই না কথা বলে আসলেন।”
“হুমম। বাবা আবার সকালে বললো ছাদের উপরেও নাকি ছোট ছোট দুটো রুম বানাবে।আবার একটু উঁচু করে রেলিং দিবে।”
“হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত আবার?”
“বাবার নাকি মনে হচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি এই বাড়ির সদস্য সংখ্যা বেড়ে যাবে।তাই এতো আগাম উদ্যোগ।আর রেলিং না থাকলে তারা পড়ে যাবে না?”
নাহিদের কথা শুনে আসমানী ভীষণ লজ্জা পায়।কথা ঘুরাতে তাড়াতাড়ি বলে, “আপনি বের হোন।বাইক বের করেন।দেরি হয়ে যাবে কিন্তু আমাদের।”
নাহিদ প্রায় আর্তনাদের মতো করে বলে,”বাইক?আমি বাইক পাবো কই?আমার তো বাইক নেই।”
আসমানীও অবাক হয়ে বলে,”আপনার বাইক নেই?তাহলে ঐ রাতে বাইক কোথা থেকে পেয়েছিলেন?আর হ্যাঁ, সত্যিই আমি সেই রাতের পর আপনাদের বাড়িতে কোনো বাইক দেখিনি।আমি খেয়াল করিনি ব্যাপারটা।”
নাহিদ মাথা নিচু করে বলে, “ওটা তো আমার বন্ধুর বাইক ছিল আসমানী।আমি এমনিতেই একটা কাজের জন্য নিয়েছিলাম।তোমার কি প্রবলেম হবে যদি আমার বাইক না থাকে?”
আসমানী বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বলে,”কোনো প্রবলেম নেই।তবে হ্যাঁ, আপনার বাইকওয়ালা বন্ধুকে অবশ্যই ধন্যবাদ দিবেন।”
“কেন?”
আসমানী চোখে কৌতুক এনে বলে,
“না হলে আমরা একে অন্যকে পেতাম কই থেকে?”
★★★
আসমানীর খোলা চুলে বিলি কেটে নাহিদ বলে,”আজকের দিনটা কেমন লেগেছে আসমানী?”
“অনেক ভালো।বাবা-মা মারা যাওয়ার পর এই প্রথম আমি আজ এতো আনন্দ করলাম।”
“তোমার বন্ধুবান্ধব নেই তেমন?”
“ছিল।এখন নেই।”
“মানে?সবার বিয়ে হয়ে গেছে? ”
“নাহ।অনেকের হয়েছে, অনেকের হয়নি।কিন্তু সবাই বদলে গেছে।”
“মানে?”
“আমার বেশিরভাগ বন্ধুরাই রিচ ফ্যামিলির।বাবা-মার মৃত্যুর পর তাদের সাথে তাল মিলিয়ে চলার মতো অবস্থা তো আমার ছিল না।যেহেতু সবকিছুই চাচার কব্জায় ছিল।আর ওরাও অস্বস্তি বোধ করতো।আমিও আমার অবস্থান বুঝতে পেরেছিলাম।তাই নিরবেই সরে এসেছি।আর মধ্যবিত্ত ঘরের যারা ছিল,বেশিরভাগেরই বিয়ে হয়ে গেছে।”
“মানুষ কিভাবে এতোদিনের পুরোনো বন্ধুকে ছেড়ে দিতে পারে একা একা?”
আসমানী খিলখিল করে হাসে।সেই হাসিতে লুকানো থাকে বুক ভরা কষ্ট আর অভিমান।
নাহিদ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,”হাসছো কেন?”
“নিজের আপন চাচাই বেঈমানী করলো আর বন্ধুরা তো পর।”
“হুমম।”
“শুনুন।”
“কি?”
“আমি কিন্তু টিউশনি পড়াবো।”
“বেশ,তোমার ইচ্ছে। আমি বাধা দিবো না।কিন্তু আগে যেমন প্রায় সারাদিন পড়িয়েছো,তেমন পড়িও না।”
“হ্যাঁ, আমিও সেটা ভেবেছি।দুজনকে পড়াবো।”
“অহ।কত দূর ওদের বাসা? এখান থেকে যেতে কত সময় লাগবে?”
“বিশ মিনিটের মতো।”
“দুজনকেই কেন পড়াবে?”
“কারণ, একজনের থেকে আমি বেশ ভালো বেতন পাই।ওর বাবা পুলিশ তো।আবার ওর মা ও কম্পিউটারে কি যেন জব করে।আর আরেকজনের অবস্থা খারাপ।আমি খুব কম টাকাতেই ওকে পড়াই।কারণ ওর বাবার হাটুর নিচ থেকে প্যারালাইজড।ওর মা জব করে কোনোমতে সংসার টা চালায়।”
“প্যারালাইজড লোকের বউয়ের বয়স কতো?”
“৩৫ এর মতো হবে হয়তো।”
“তাহলে তো অনেক কম বয়স।ঐ পঙ্গু লোকের সংসারে আছে?”
“হুমম।ভালোবাসে বলেই আছে।”
নাহিদ আসমানীকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলে,
“আমার কিছু হয়ে গেলে তুমি আমার পাশে থাকবে তো আসমানী?”
আসমানী হেসে বলে,”সারাজীবন থাকবো।কথা দিচ্ছি।নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও আপনাকে আর আপনার পরিবারকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করবো।কিন্তু আপনি কোনো অন্যায় করলে আপনাকে গুলি করতেও দ্বিধাবোধ করবো না।”
নাহিদ ওর কথা শুনে ফিক করে হেসে বলে,”এই নরম নরম হাত দিয়ে গুলি করবে কিভাবে সখী আমার?”
★★★
“আপনার কি মনে হয় স্যার,আসমানী মেয়েটা আমাদের কাজ টা করে দিতে পারবে?” নরমাল পোশাকে থাকা একটা মেয়ে বেশ উৎকন্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করে সামনে বসে থাকা টুপিওয়ালা লোক কে।

সিগারেটে টা*ন দিয়ে সামনের লোক টা বলে,”নিশ্চয়ই পারবে।ঐ মেয়েই পারবে।তুমি ওর চোখ দেখেছো?পুরাই আ*গু*ন।প্রতিশোধের নেশায় জ্বলছে।”

“সেটাই তো চিন্তা স্যার।ও তো ওর নিজের প্রতিশোধের চিন্তায় আছে।আমাদের কাজ কিভাবে করবে?আর ও তো সম্পূর্ণ নতুন।তেমন পূর্ব অভিজ্ঞতাও নেই।আমাদের সাথে দু একটা কাজ করেছে। তাও ব্যাকআপ হিসেবে।”

“স্বর্নকার কি কখনো খাটি সোনা চিনতে ভুল করে মেয়ে? করে না।আমিও করিনি।আমি জানি ও পারবে।পারতেই হবে ওকে।নিজের জন্যই সব পারতে হবে ওকে।”

“কিন্তু ওর জীবনটা তো ঐ বাড়িতে আঁটকে গেল।বিয়ে হয়ে গেল ওর।এখন কি হবে?আর বড় স্যার যদি জানে আপনিই ওকে উস্কেছিলেন এই মিশনের সবার আগে থাকতে,তাহলে আপনার অবস্থা কেমন হবে ভাবতে পারছেন?”

“তোমার কি মনে হয় নীহারিকা আমি কিছুই জানি না?”
নীহারিকা নামের মেয়েটি পিছনে ঘুরে দেখে এক যুবক তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।টুপিওয়ালা লোকটাও সিগারেট ফেলে কোনামতে উঠে দাঁড়ায়।যুবক কে দেখে যে তার সব পাওয়ার হাওয়া হয়ে গেছে সেটা নীহারিকা নামের মেয়েটি ভালোভাবেই বুঝতে পারে।

যুবকটি বেশ ধীর পায়ে টুপিওয়ালা লোকটির সামনে গিয়ে ওর কলার ধরে বলে,”অনেক খারাপ কাজ করলে মঈন।অনেক খারাপ কাজ করলে।আসমানীকে এমন ভাবে ব্রেইন ওয়াশ করলে যে শেষ মুহুর্তে এসে এতোগুলো প্ল্যান ফেইল হওয়ার পরও শেষ উপায়ে ও বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেল।তবু এই মিশনের মেইন ক্যারেক্টার হলোই।আমি যদি শেষে দেখি সবকিছুই ভুল,এমনকি তোমার সন্দেহ আর প্রমানও,খোদার কসম তোমাকে খুন করতে আমার হাত একবারও কাঁপবে না।”
যুবকটি লোকটির কলার ছেড়ে দিয়ে চলে যাওয়ার আগে শেষ একবার বলে,”তুমি জানতে না মঈন,আমি আসমানীকে ভালোবাসি?তারপরও তুমি কিভাবে এমন একটা কাজে ওকে পাঠাতে পারলে?”
যুবকটি চলে গেলে মঈন নামের টুপিওয়ালা লোকটির ভীষণ বলতে ইচ্ছে করলো,”আপনি কি জানেন না স্যার,এইখানে আবেগ ভালোবাসার কোনো স্থান নেই?এইখানে আসা আমরা বেশিরভাগ মানুষই যাযাবর।বাবা-মা আর পরিবারহীন।আমাদের কারোই হারানোর কিছুই নেই।আর বাদ বাকি যারা আছে,তারা তো কাজ করে পেটের দায়ে।
চলবে….