আসমানী পর্ব-০৮

0
157

#আসমানী
#পর্ব_৮
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা

নাহিদের বিয়ের জন্য সবচেয়ে বেশি যে লাভবান হয়েছে, সে হচ্ছে নাবিল।ড্রয়িংরুমে তার জন্য থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।তখন থেকেই মনে মনে সে বেশ খোশমেজাজে আছে।শুরুর দিকে একটু মন খারাপ করে থাকলেও সেটা সম্পূর্ণই ছিল লোক দেখানো।প্রথমত একা থাকা যায় তাও আবার দরজা আঁটকিয়ে।তার মানে ছোট হলেও তার একটা পার্সোনাল রুম আছে।যখন তখন যে কেউ ঢুকে যেতে পারে না।
কলেজের একটা ফর্সা কিন্তু বোঁচা মেয়েকে তার ভীষণ মনে ধরেছে।কিন্তু এখনও সাহস করে বলার সুযোগ পায়নি।বলার সাহস কোনোদিন হবেও কি না সে জানেনা।কিন্তু ফেসবুকে মেয়েটা তার রিকুয়েষ্ট এক্সেপ্ট করেছে।কি ভেবে করেছে কে জানে।রাতে সে অনেক বার চেষ্টা করে মেয়েটাকে মেসেজ করার।কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হয় যদি সে খারাপ মনে করে?যদি বাজে ছেলে ভাবে?এতো রাতে মেসেজ দেওয়ার অপরাধে যদি তাকে ব্লক করে দেয়?তাই সে ভয়ে ভয়ে শুধু তার আইডিতে থাকা ছবিগুলো দেখে।আরও একটা কারণ আছে এই রুমে থাকার।সেটা হচ্ছে টিভি।সে রাতে মাঝে মাঝে সাউন্ড কমিয়ে টিভি দেখে।মা-বাবা গভীর ঘুমে থাকে।বড় ভাইয়ার ঘরেও কোনো শব্দ শোনা যায় না।নাতাশার রুমেরও আলো নিভে গেলে সে টিভি চালু করে দেয়।কিন্তু কোনোভাবে নাতাশা বুঝে গেছে সে রাতে টিভি দেখে।তাই মাঝে মাঝে সেও দেখতে আসে।দুই ভাই-বোন মিলে মাঝেমাঝে চানাচুর মেখে খেতে খেতে টিভি দেখে।একজন আরেকজন কে ব্ল্যাকমেইলও করে।কিন্তু রাত পোহালে দুজনেই চুপ করে থাকে।কেউ কারো বিরুদ্ধে কারো কাছেই নালিশ করে না।কারণ দুজনেই অপরাধী।

কিন্তু নাহিদ আজ টিভি চালু করেনি।নাতাশাও আজ আসেনি।কারণ তাদের দুজনেরই মন খারাপ।রোজিনা আপুকে তারা দুজনেই ভালোবাসে।তার এতো খারাপ মুহুর্তে নিশ্চয়ই তাদের ভালো থাকার কথা না।রাত পোহালে যে কি হবে সেটা কেউই বুঝতে পারছে না।রোজিনা আপুকে এখন একা ঘরে রাখে না।বড় চাচী তার সাথে ঘুমোয়।ভয় হয় সবারই।যদি সে আবার উল্টোপাল্টা কিছু একটা করে বসে?

নাহিদের ঘুম না আসায় সে মোবাইলে ফেসবুকিং করতে থাকে।হঠাৎ সে খেয়াল করে বোঁচা মেয়েটা তার নিজের একটা ছবি পোস্ট করেছে।নাহিদ এতোদিন অনেক চেষ্টা করেছে অন্ততপক্ষে তার ছবিগুলোতে রিয়্যাক্ট দেওয়ার।কিন্তু সাহসে কুলোয় নি।আজ কি ভেবে সে মেয়েটির ছবিতে একটা লাইক দিয়ে দিলো।তার মনে হলো সে যেন বিশ্ব জয় করে ফেলেছে।একটা কমেন্ট করলে হয়তো আরো ভালো হতো।কিন্তু তার অতো সাহস নেই।সে মেয়েটির আইডিতে ঘোরাঘুরি করছিল হঠাৎ মেসেঞ্জারে টুংটাং শব্দ করে একটা মেসেজ আসে।সে চেক করে দেখে মেয়েটি তাকে মেসেজ দিয়েছে।মেয়েটির মেসেজ পেয়ে তার তো রীতিমতো হাত পা কাঁপা-কাঁপির অবস্থা।কিন্তু মেসেজটি ভালোভাবে লক্ষ্য করলে সে পুরোপুরি দমে যায়।কারণ মেয়েটি লিখেছে,
“আমার ছবি থেকে লাইক সরাও নাবিল।দরকার হলে হাহা দিও কিন্তু লাইক না।”
নাবিল মেসেজ সিন করে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকার পর লাইক সরিয়ে একটা কেয়ার রিয়্যাক্ট দিয়ে দেয়।তারপর মেয়েটাকে মেসেজ দেয়,” Done.”
মেয়েটাও প্রতিউত্তরে তাকে ধন্যবাদ জানায়।
নাবিলের হঠাৎ মেয়েটার সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা বলার ভীষণ ইচ্ছে করে।কিন্তু মেয়েটি কি ভাববে বলে আর মেসেজ দেয় না।
“এতো রাতে জেগে আছো যে?তোমার পড়া কমপ্লিট হয়নি?”
মেয়েটি আবার মেসেজ দিলে নাবিল একেবারে লাফ দিয়ে উঠে বসে।তার হাত কাঁপতে থাকে।কাঁপা-কাপাঁ হাতেই সে টাইপ করে,”আসলে শেষ।এমনিতেই ঘুম আসছিলো না।তাই জেগে আছি।”
মেয়েটি প্রতিউত্তরে শুধু বলে,”অহ,আচ্ছা।”
এরপর আর কোনো কথা হয় না।মেয়েটি কি আরো কোনো কথার অপেক্ষা করছে কি না নাবিল বুঝতে পারে না।কিন্তু সে এটুকু বুঝতে পারে,মেয়েটি তাকে চিনে।কি ভেবে তার ভীষণ হাসি পায়।ফোন হাতে মেয়েটির ছবির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,”এই যে বোঁচা সুন্দরী, তুমি কি রাতের বেলায় ঘুমের মধ্যে নাক ডাকো নাকি?”
★★★
দরজার পর্দা সামান্য সরিয়ে রোজিনাদের ড্রয়িংরুমে মানুষগুলোকে দেখার চেষ্টা করে আসমানী।সেখানে তার স্বামী, দেবর, শ্বশুর আর চাচা শ্বশুরদের দেখতে পায় সে।বাকি মানুষদের কে সে চিনে না।তিনজন পৌঢ় মানুষ আর দুজন শক্তসমর্থ মানুষকে দেখতে পায় সে।একজন বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বসে আছে।কিন্তু আরেকজনের চোখ মুখ দেখেই সে বুঝতে পারে মানুষটি মোটেও ভালো নেই।সে যে এখানে যে কাজ টা করার জন্য এসেছে, তাতে তার বিন্দুমাত্র সায় নেই।কিন্তু নিয়তির কাছে আজ সে পরাজিত। চাইলেও ভালোবাসার মানুষটিকে আর কাছে পাবে না সে।আর কিছুক্ষণের মধ্যেই মানুষ দুজন একে অন্যের জন্য হারাম হয়ে যাবে।অথচ বিগত ৭ বছর যাবত মানুষ দুজন একই ছাদের নিচে বসবাস করছে।শুধু একটা সাদা কাগজে দুজনের সাক্ষরই দুজন মানুষকে আলাদা করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
হঠাৎ আসমানী দেখে যে লোকটি ঘরের মধ্যে থেকে উঠে বলে,”আমি একটু রোজির সাথে দেখা করতে চাই।একটু কথা বলতে চাই।”
★★★
“আমাকে ছেড়ে যেও না রোজি।আমি কিভাবে থাকবো তোমাকে ছাড়া?” কাঁদোকাঁদো গলায় কথাগুলো বলে তার স্বামী নয়ন।
রোজিনা এই ব্যাপারে কোনো কিছু না বলে শুধু বলে,”আমাকে রোজি ডাকবেন না।আমি আপনার কেউই না।”
” আমি তোমাকে ভালোবাসি রোজি।আমি জানি তুমিও আমাকে ভালোবাসো।বাসো না ভালো?”
“বাসি।আমিও আপনাকে ভালোবাসি।কিন্তু বাস্তবতা আমাদের মেনে নিবে না।”
“আমার কিচ্ছু যায় বা আসে না।আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।আমার লাগবে না সন্তান।”
“কিন্তু আমার লাগবে।”
রোজিনার কঠোর কন্ঠে বলা কথায় থমকে যায় নয়ন।শুধু বলে,”আমরা বাচ্চা দত্তক নিবো রোজি।আগেও তো আমি বলেছি।”
“নাহ।তা আর হয় না নয়ন সাহেব।শেষ সময়ে এসে তা আর হয় না।আমি জানি আপনি আমাকে ভালোবাসেন।আমিও আপনাকে ভালোবাসি। তাতে কোনো সন্দেহ নেই।কিন্তু একটা কথা জানেন তো,প্রয়োজনীয়তা ভালোবাসার চাইতে অনেক বেশি দামী।আমি চাই আমাকে ছেড়ে আপনি আরেকটা মেয়েকে বিয়ে করেন।তার মাধ্যমে আপনি বাবা হবেন।আপনার বংশ রক্ষা হবে।আপনার বাবা-মা, পরিবার সবাই খুশি হবে।”
“আর তুমি?তোমার কি হবে?”
“আমিও মা হবো।কোনো মা হারা সন্তানের মা হবো।তারা আমাকে মা বলে ডাকবে।”
নয়ন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,”তুমি এইসব কথা এতো স্বাভাবিক ভাবে বলছো কিভাবে?আমাকে ছেড়ে থাকতে তোমার কষ্ট হবে না?”
রোজিনা হাসে।হাসতে হাসতেই বলে,”আমি আমার জীবনে তিনজন পুরুষকে ভালোবাসি।একজন আপনি,আরেকজন আমার হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা। তার কথা তো আপনি জানেনই।আরেকজন হচ্ছেন আমার মেজো বাবা। তার ব্যক্তিত্ত্ব সম্পর্কে তো আপনি আরো ভালোভাবে জানেন।তাইনা?সে আমাকে বলেছে জীবনকে শুধুশুধু এতো জটিল করার কোনো দরকার নেই।না হলে একসময় হয়তো এতোটা জটিল হবে যে শেষে আর সেই জটিলতা কখনোই কাটিয়ে উঠতে পারবো না আমরা। জীবন জীবনের নিয়মেই চলে যাবে সবসময়।তাকে থামিয়ে রাখার আমরা কারা?”
“আমি অন্য কাউকে তোমার জায়গা কিভাবে দিব রোজি? তাকে মেনে নেওয়া যে আমার পক্ষে এতো সহজ না।”

রোজিনা এবার তার স্বামীর সামনে গিয়ে বলে,”৭ বছরের বিবাহিত জীবনে আমি আপনার থেকে তেমন কিছুই মুখ ফুটে চাইনি।আপনিই আমাকে দিয়েছেন।আজ একটা জিনিস চাইবো আমাকে দিবেন?”
নয়ন মাথা নাড়ায়।রোজিনা বলে,”আমাকে কথা দিন,আপনি যাকে বিয়ে করে আনবেন,তাকে আপনি ভালোবাসবেন।আমাকে কথা দিন আমাকে তার মাঝে খোঁজার চেষ্টা করবেন না।আমি জানি আপনি ভালো মানুষ।অনেক ভালো মানুষ।আপনি যে কোনো অসহায় মেয়েকে বিয়ে করবেন আমি তাও জানি।আপনাকে আমি বিশ্বাস করি।আমি জানি আপনি আমার কথা রাখবেন।রাখবেন না?বলুন না,রাখবেন না?”

নয়ন চোখের পানি মুছে বলে,”রাখবো।কথা দিচ্ছি তোমাকে। আমি একটা জিনিস চাই তোমার থেকে?”
“কি?”
“একটু জড়িয়ে ধরি তোমায়? একটু খানি?”
রোজিনা একটু হেসে জলভরা চোখে বলে,”তা আর হয় না নয়ন সাহেব।তা আর হয় না।”
★★★
“মা।দেখো মিস এসেছে।”
ছোট্ট রাহার কথায় দরজার সামনে আসে আতিকা।দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে সেখানে আসমানী এসেছে।তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,”অভিনন্দন আসমানী।বিবাহিত জীবন কেমন চলছে তোমার? শ্বশুর বাড়ির সবাই ভালো তো?”
আসমানী হাসিমুখে বলে,”আলহামদুলিল্লাহ ভাবী।সবকিছুই আলহামদুলিল্লাহ।আল্লাহ আমার জন্য ভালো কিছুই রেখেছেন।আর ধন্যবাদ।”
“হ্যাঁ,তোমার ছাত্রী তো তোমার জন্য চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছিল।”
“তাই নাকি রাহা সোনা?আমাকে মিস করছিলে?”
ছোট্ট রাহা মাথা নাড়িয়ে বলে,”হ্যাঁ, মিস।”
“মাই প্লেজার বেবি।পড়াশোনা ঠিকমতো করেছো তো? নাকি মায়ের কাছে কিছুই পড়োনি?”
“পড়েছি মিস।সব পড়া কমপ্লিট।”
“চলো,তাহলে দেখি কেমন পড়া পড়েছো।”
আসমানী আজ প্রায় ১ মাস পরে তার স্টুডেন্ট এর বাসায় এসেছে তাকে পড়ানোর উদ্দেশ্যে। বিয়ের কথা জেনে স্টুডেন্ট এর বাবা-মা তাকে কিছুদিন ছুটি কাটাতে বলেছিল।সে তাই আসেনি কিছুদিন।রাহার সাথে আধাঘন্টার মতো সময় কাটানোর পর রাহার মা তার জন্য নাস্তা নিয়ে এসে রাহার সামনেই তার শ্বশুর বাড়ি সম্পর্কে অনেক গল্প করতে থাকে।ছোট্ট রাহা তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে।রাহার বাবা কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসায় ফিরে আসে।সেও আসমানীকে দেখে খুব খুশী হয় আর তাকে অভিনন্দন জানায়।রাহা বাবাকে দেখে তার কাছে গিয়ে বলে,”আজ আর পড়বোনা বাবা।আজকে মিসের গল্প করার দিন।মিস মায়ের সাথে গল্প করছে।আমি টিভি দেখি?”
রাহার বাবা হেসে বলে,”তোমার মিসের থেকে পার্মিশন নাও রাহা।”
রাহা আসমানীর দিকে ফিরলে আসমানী বলে,”ঠিক আছে রাহামনি।আজকে তোমার ছুটি।”

রাহা ছুটে যায় টিভির রুমে।রাহা রুম থেকে বের হতেই রুমে থাকা তিনজন মানুষের চেহারার অভিব্যক্তি পালটে যায়।রাহার মা নিজের ল্যাপটপ বের করে বসে কি যেন বের করতে যায়।রাহার বাবা বলে,”সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো ম্যাম?ঐ বাড়িতে কেউ আপনাকে কোনো সন্দেহ করেনি তো?”
আসমানী পায়ের উপর পা তুলে বসে বলে,” নাহ।কিন্তু আমি ওদের মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা খুঁজে পাচ্ছি না।খুবই সাদামাটা মধ্যবিত্ত পরিবার।”
রাহার মা বলে,”আমিও অনেক জায়গায় খোঁজ নিয়েছি।সবার ব্যাকগ্রাউন্ডই ভালো।কোনো বাজে কিছু নেই।বুঝতে পারছি না মঈন স্যার ঐ বাড়িকেই কেন টার্গেট করলেন।”
আসমানী টেবিলে রাখা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে,”সাধারনের মাঝেই অসাধারণ কেউ লুকিয়ে থাকে।এখনও আমাদের হাতে অনেক সময় আছে।”
“আপনার কি আর কাউকে সন্দেহ হয় ম্যাম?”
“সন্দেহ তো সবাইকে করা যায় রফিক সাহেব।কিন্তু ভিত্তি ছাড়া সন্দেহ করে কি প্রমাণ করবো?”
রাহার মা বেশ চিন্তিত হয়ে বলে,”যদি এই সব কিছু মিথ্যে হয় তবে আপনার জীবন তো ওখানেই আঁটকে যাবে।আপনাদের তো বিয়ে হয়ে গেছে।”
আসমানী মনে মনে বলে,”আল্লাহ চান তো তাই যেন হয়।যেন সবকিছু মিথ্যে হয়।আমি ঐ বাড়িতেই আঁটকে থাকতে চাই।সারাজীবনের জন্য।”
চলবে…..