আসল সম্পর্ক পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব

0
224

#আসল_সম্পর্ক
#শেষ_পর্ব
#ইশরাত_জাহান

ভোর তখন প্রায় চারটা।যে যার মত ঘুমিয়ে আছে।প্রিয়তা নিজের ঘরে ঘুমাচ্ছে।ঘুমের ঘোরে অনুভব করে কেউ হাঁটছে।তার দিকেই হেঁটে হেঁটে আসছে। আগন্তক এখন তার অতি নিকটে এসেছে।ঘুমু ঘুমু অবস্থায় চোখ খুলে প্রিয়তা।ঠিক তখনই তার নাকে স্প্রে করা হয়।তারপর প্রিয়তাকে ওখান থেকে নিজ কক্ষে নিয়ে আসে।

মুখে পানির ছিটা পেয়ে জেগে ওঠে প্রিয়তা।দেখতে পায় তার হাত চেয়ারের সাথে বাধা।পাশে খোলা জানালা দিয়ে আলো।দেওয়াল ঘড়িতে সকাল ছয়টা বাজে।সামনে দাড়িয়ে আছে অনুপম।প্রিয়তা রেগে গেলো।সাথে সাথে বলে,”আমাকে এখানে কেনো এনেছো?”
“তোর সাথে সংসার করবো বলে।”
“ইয়ার্কি কর আমার সাথে?”
“দেখ আমি একপাক্ষিক ভাবে কিছু করছিনা।আমি সেদিন তোর আর মায়ের কথা শুনেছি।রাতে আমার সাথে এক বিছানায় যখন ঘুমাতে রাজি হয়েছিস।আমি তখনই বুঝেছি তুই এই সম্পর্ক রাখতে চাস।আমিও তাই চাই।তাহলে সমস্যা কথায়?”
“সমস্যা কোথায় মানে বুঝনা?তুমি কাল রুহির সাথে দেখা করেছিলে। আর ও তোমাকে যা যা বলেছিলো আমি সব শুনেছি।তোমরা বিয়ে করবে।রুহি তো এটাও বলেছিলো যে,”আমরা এবার হ্যাপি লাইফ পাবো।অবশেষে বিয়ে করছি আমরা।”

অনুপম বুঝলো প্রিয়তার সমস্যা কোথায়।এক এক করে দুই মিলিয়ে সে এই ঝামেলা করেছে।প্রিয়তা আরো কিছু বলতে যাবে অনুপম প্রিয়তার মুখ চেপে ধরে।তারপর অনুপম বলে,”আরে ওইদিন রুহি আমাকে কল করে ডাকে।আমিও যাই কারণ আমি চাই বিয়ের সম্পর্কটিকে স্ট্রং রাখতে।আমার কাছে মনে হয় প্রণয়ের সম্পর্ক ধরে রাখতে যেয়ে আমরা পাপ করছি।একটি বিয়ে হল বৈধ সম্পর্ক আসল সম্পর্ক।এখানে তৃতীয় ব্যাক্তি আমাদের প্রাক্তন। হ্যা আমি জব করার সময় মা অনেকবার জিজ্ঞাসা করেছিলো যে আমার কোনো পছন্দ আছে কি না।আমি বলেছিলাম না।কারণ তখন রুহি বিয়ে করবে না বলেছিলো। আর আমাকে মা ছোট থেকে প্রেমে জড়াতে না করতো।বলতো প্রেম ট্রেম কোনো কিছু করবে না যদি কোনো মেয়ে ভালো লাগে আমাদের বলবা।আমরা বিয়ে দিবো।আমি রুহিকে বিয়ে করতে চাইতাম রুহিও আমাকে বিয়ে করতে চাইতো।কিন্তু রুহির বড়বোনের বিয়ে না হলে ওর বিয়ের কথা বাসায় বলতে সমস্যা ছিলো।এর ভিতর আসে মায়ের এক কল।সেইদিন তাড়াহুড়ো করে বাসায় যাই।মা আমাকে বিনা বাক্যে ওখানে কবুল বলতে বলে।অনেক চেষ্টা করি মায়ের সাথে আলাদা কথা বলতে।
মা রাজী হয় না।শুধু এতটুকু বলে,”রাজীব মারা গেছে আজ।গ্রামের লোকেরা প্রিয়তাকে কটু কথা বলছে।আমি আর ভাই দুজনে স্কুল মাস্টার।আমাদের এদিকে মান সম্মান তো যাবেই সাথে প্রিয়তার পুরো জীবন।মানুষ ভুল ধরতে ব্যাস্ত।কিন্তু কেউ অবস্থা বুঝতে চায় না।আজ একজনের সাথে লড়াই করবি তো কাল ওই ব্যাক্তি আরেকজনকে পাঠাবে।এটা তাদের কর্ম।নিজের কাজ দেখবে না কেউ।কিন্তু অন্যের ভুল ধরে অপমান করে মাটিতে পিষে ফেলে। প্রিয়তাকে যদি আজ তুই বিয়ে না করিস গ্রামের লোকদের কাছে আমরা আর মাথা উচু করে বাঁচতে পারবো না।এখনই এই অবস্থায় বিয়ে করবি।এটা তোর মায়ের একটা জীবন মরণের ব্যাপার।লোকজনের কাছে বড় মুখ করে বলেছি আমার ছেলে এই বিয়ে করবে।আমার সম্মানের কথা ভেবে বিয়ে কর।”বলেই মা চলে যায় ওখান থেকে।

আমি কিছু বলে ওঠতে পারি না।কি বলবো?কাকে বলবো? কারো আমার কথা শোনার মত সময় নেই।মায়ের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে কাজী আসে।আমি যদি বিয়ে না করতাম তাহলে তোকে দ্বিতীয়বার কলঙ্কিত করা হতো।আমার মায়ের উচু মুখ নিচু হতো।একজন শিক্ষক হিসেবে যে মর্যাদা পেয়েছিলো তা একদিনে শেষ হতে যেতো।তাই বাধ্য হয়ে বিনা প্রতিবাদে বিয়ে করি।রুহিকে আমি পরের দিন সকালে সব বলি।ও কান্না করলেও আমার অবস্থা বুঝে।ও অনেক মেচিউর্ড একটি মেয়ে।আমার অবস্থা বুঝে আমাকে সাপোর্ট করে।কোনো অভিযোগ ছাড়াই সম্পর্কের বিচ্ছেদ করে।এর মাস কয়েক পর তুই আবার ওকে নিয়ে আসলি।প্রথমে রেগে যাই তোর উপর।পড়ে তুই যখন বললি তোর এই সম্পর্ক মেনে নিতে আপত্তি।তুই থাকতে রাজি না সাথে আমিও তোর প্রতি কোনো অনুভূতি পাইনি।তাই আমরা মিউচুয়াল ডিভোর্সের চেষ্টা করি।এরপর বাবা মা আসলো।বাবার কাছ থেকে মায়ের ভালোবাসা ও সম্পর্কের বাঁধনের কথা শুনি।ওগুলো শোনার পর আমারও মনে হতে থাকে যে বৈবাহিক সম্পর্কের আগে যত যাই থাকুক বৈবাহিক সম্পর্ক আসল সম্পর্ক।আমাদের প্রথম দিকে একসাথে থেকে দুজনকে বোঝা উচিত ছিলো।তুই আমাকে আর আমি তোকে কখনও সময় দেই নি।একটিবার সময় দিয়ে দেখি আমাদের কি হয়।এই এক সপ্তাহে এক ঘরে একসাথে গল্পের বই পড়ে রান্না বান্না করে কখনও ফিল করিনি যে আমি হারাম কিছু করছি।আমার কাছে মনে হয় আমি তোর সাথে থাকতে পারবো। আর তোর চলাফেরা আমাকে প্রকাশ করে তুইও আমার সাথে থাকতে আগ্রহী।”বলেই একটু দম নেয় অনুপম।

কিছুক্ষণ পর আবার বলে,”ওইদিন শুধু আমিই রুহির সাথে শেষ দেখা করতে যাই নি। রূহিও এসেছিলো আমার সাথে শেষ দেখা করতে।রুহির বড়বোনের বিয়ে হয়েছে আমাদের বিয়ের তখন চারমাস।রুহির বোনের দেবর রুহিকে পছন্দ করেছেন।অনেক দিন হয় বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে।রুহি বাসায় সবকিছু বলে।রুহির বাবা মা আমার কথা শুনে না করে দেন।তাদের মতে আমাদের সেপারেশন হওয়াটা ভুল সিদ্ধান্ত।রুহির উচিত আমাদের মাঝে না থাকা। তাই রুহি আমাকে বলে এই ডিভোর্স না দিতে।আমিও খুশি হই।আমাদের আসল সম্পর্ক রক্ষা পেলো।”

অনুপমের কথা একাধারে মন দিয়ে শুনতে থাকে প্রিয়তা।প্রিয়তা বুঝলো অনুপমের দোষ নেই।সে তো সবকিছুর সলিউশন করতে চেয়েছে।প্রিয়তা কিছু বলছে না দেখে অনুপম বলে,”কি হলো বল কিছু?”

প্রিয়তা চোখ দিয়ে ইশারা করে দেখায়।তার মুখ অনুপম হাত দিয়ে সেই কখন বন্ধ করে রেখেছে।তাহলে বলবে কিভাবে?অনুপম হাত সরিয়ে নিলো।
প্রিয়তা বলে,”তুমি আমার সাথে সুখে থাকবে তো?”
“কেনো থাকবো না?আসল সম্পর্ক যে এটা।জন্ম বিয়ে মৃত্যু যে লিখেছে তার ইচ্ছার বাইরে গেলে আমি সুখী হতাম না।”
“তাহলে চলো।”
“কোথায় যাবো?”
“কোনো এক কাজী অফিসে।বিয়ে করবো আমরা আবার।”
“আমরা তো ডিভোর্স দেইনি।তাহলে বিয়ে কেনো করবো?”
“তুমি কি জানো না!বিয়ের পর তিন মাস স্বামী স্ত্রী আলাদা থাকলে সম্পর্ক থাকে না।নতুন করে বিয়ে করতে হয়।”
“ওহ আচ্ছা।কিন্তু আমরা যাবো কিভাবে?বাইরে তো বাবা মা।”
“কি ভাগ্য আমার বিয়ের পর দ্বিতীয়বার আসলাম। তাও কি না কিডন্যাপ হয়ে। কোথায় অনুষ্ঠান করে বউ সাজিয়ে আনবে তা না।”কিছুটা মন খারাপ করে।
“ওলে লে লে বউ আমার।কষ্ট পায় না সোনা।চল কাজী অফিসে যাওয়ার আগে বেনারসি কিনে দেই।আমি একটি পাঞ্জাবি কিনবো।দুজনে বর বউ সেজে বিয়ে করে নেই।কিন্তু বের হব কিভাবে?রাতে তো চুরি করে তোকে এনেছিলাম।সবাই ঘুমে ছিলো।অজ্ঞান হওয়ার স্প্রে পাশের বাসার থেকে নিয়েছিলাম।অল্প একটু ছিলো সব তোর উপর এপ্লাই করেছি।এখন উপায়!”
“তোমার এত বড় বেলকুনি থাকতে পালানোর জায়গা খুজছো! চলো বেলকুনি দিয়ে পাইপ বেয়ে পালাই।বিয়ে করে সবাইকে সারপ্রাইজ দেই।”
“আচ্ছা চল।”

অনুপম আর প্রিয়তা বেলকুনি দিয়ে নেমে গেলো নিচে।তারপর একসাথে হাত ধরে দিলো দৌড়।গ্রামের ছোট ছোট দোকান খুলেছে।সেখান থেকে একটি লাল শাড়ি ও পাঞ্জাবি কিনে পার্লারে যেয়ে সাজলো প্রিয়তা।তারপর দুজনে মিলে গেলো কাজী অফিসে। কাজী তাদের বিয়ে পড়ালো।

বিয়ের পর অনুপম বলে,”কি ভাগ্য আমাদের।জীবনের দ্বিতীয়বার বিয়ে করলাম।তাও আবার নিজের বিয়ে করা বউকে ভাগিয়ে নিয়ে।আমাদের তো ইতিহাসের পাতায় নাম রাখা উচিত।বিশেষ করে আমাকে।বউয়ের জন্য না খেয়ে খাটনি করে আসলাম।তাও লাভ হলো না।শেষমেশ কি না কিডন্যাপ করে বউয়ের রাগ ভাঙ্গাতে হয়।”
“আমার মেয়েকে পেতে হলে একটু তো কষ্ট করতেই হবে।”
কথাগুলো শুনতে পেলো অনুপম ও প্রিয়তা।কণ্ঠ শুনে চিনে ফেলেছে এটি প্রিয়তার বাবা।অনুপম ও প্রিয়তা তাকায় পিছনে।দেখে পুরো পরিবার মিটিমিটি হাসছে আর দেখছে তাদের।

অনুপম ও প্রিয়তা কিছু বুঝলো না।তখন রুবিনা বলে,”ফুফু আর ফুফা সীমান্তের সাথে কথা বলে রুহির নাম্বার জোগাড় করে।রুহির সাথে কথা বলে সবকিছু জেনে যায়।প্রিয় তখন বেরিয়ে পড়ে বাসা থেকে।ফুফু তোদের ঘরে ঢুকে দেখে ডিভোর্স পেপারে তোদের নাম নেয়।বুঝে যায় ভুল পেপার ওটা।ফুফু চায় তোদের মান অভিমান ভেঙ্গে এক হোক।এজন্য প্রিয়কে আগে পাঠায়।তারপর সকালে তোকে না বলেই চলে আসে।আমরা সবকিছু আগেই বুঝে যাই।শুধু চেয়েছি পরবর্তী জীবন গুছিয়ে চল তোরা।দূরে দূরে থেকে সংসার হয় না।সম্পর্কের মূল্য বোঝা যায় না।এতদিন ফুফা ফুফু তোদের একঘর করেছিলো।আবার আমরা ইচ্ছা করে তোদের দূরে রাখি।জাতে তোরা এই দূরত্বের কষ্ট বুঝিস।ফুফুর থেকে শুনেছি রাতে কিছুই খাস নি।প্রিয় সারারাত কান্নাকাটি।তোদের সংসার করার এই আগ্রহ যেনো আমাদের কাছে বিনাবাক্যে প্রকাশ পায়।তবে তোরা পালিয়ে বিয়ে করবি এটা বুঝিনি।তোদের দুলাভাই দেখলো তোরা রাস্তায় বর বউ সেজে কাজী অফিসের এলাকায় যাচ্ছিস।আমরা বুঝে গেলাম কি করতে এসেছিস তোরা।তাই পুরো পরিবার চলে এলাম।”

রুবিনার কথায় শান্তি পেলো অনুপম ও প্রিয়তা।তারা একসাথে বাসায় ফিরলো।মিসেস পুরোভি বউমাকে মিষ্টি খাইয়ে গ্রহণ করলেন।

বাসর ঘরে বসে আছে প্রিয়তা।অনুপম এসেছে প্রিয়তার কাছে।প্রিয়তা সালাম করে অনুপমকে।অনুপম প্রিয়তার মুখের ঘোমটা খুলে বলে,”মাশাআল্লাহ।”

লজ্জায় মুখ নিচু করে রাখে প্রিয়তা।অনুপম বলে,”এত লজ্জা পেতে হবে না।দুইবার বিয়ে করেছি আমরা।আমাকে অনেক দৌড়ানির উপর দিয়ে যেতে হয়েছে।দুইদিন না আমার পেট শান্তি পেলো না আমার পা।এখন আমার হাত পা ম্যাসাজ করে দিবি তুই।”

অবাক হয়ে প্রিয়তা বলে,”এ কেমন বাসর?বিয়ে দুইবার হলেও বাসর তো একবার হচ্ছে।আমি হাত পা টিপতে পারবো না।”
“কি বউ জুটলো আমার ভাগ্যে।এত কষ্ট করলাম একটু হাত পা টিপেও দিবে না।”আফসোস করে বলে অনুপম।

প্রিয়তা টিপতে যায় অনুপমের হাত পা।সাথে সাথে অনুপম প্রিয়তাকে কাছে টেনে আলিঙ্গন করে।হার্টবিট ফাস্ট হতে থাকে প্রিয়তার।অনুপম বলে,”আজ থেকে তোমার স্থান আমার বক্ষে প্রিয়।থাকবে না আর কোনো দূরত্ব।পরিপূর্ণ হলো আমাদের আসল সম্পর্ক।”

সমাপ্ত