#আড়ালে_আবডালে
#পর্ব_১২
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
ড্রয়িংরুমে বসে পত্রিকা পড়ছিলেন নিজাম ইসলাম। নিহি ধীরপায়ে তার দিকে এগিয়ে যায়। পত্রিকা পড়ার সময় তিনি কারো দিকে নজর দেন না এটা সত্যিই। কিন্তু মেয়ের উপস্থিতি তিনি টের পেয়েছেন। নিহি চুপ করে পাশের সোফায় বসে। অপেক্ষা করতে থাকে, কখন নিজাম ইসলামের পত্রিকা পড়া শেষ হবে। প্রায় ২০ মিনিট ধরে তিনি পত্রিকা পড়েন। পত্রিকা ভাঁজ করতে করতে সালেহা বেগমের উদ্দেশ্যে বলেন,
“বাজারে যাচ্ছি আমি। তোমার কিছু লাগবে?”
“না।” রান্নাঘর থেকে উত্তর দেন সালেহা বেগম।
নিহি কথা বলতে গিয়েও কথা বলতে পারছে না। সাহসে কুলাচ্ছে না। বাবার সামনে দাঁড়াতেও এখন পা কাঁপে। সাহস সঞ্চয় করে বলেই ফেলে,
“আমার জন্য আইসক্রিম নিয়ে এসো আব্বু।”
নিজাম ইসলাম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিহির দিকে তাকান। পকেট থেকে টাকা বের করে টেবিলের ওপর রেখে বলেন,
“যার যা ইচ্ছে এনে খেতে পারে।”
বাজারে না গিয়ে তিনি ঘরে চলে যান। নিহি মাথা নিচু করে বসে থাকে। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে। তমা খেয়াল করে নিহির পাশে বসে। নিহির দু’গালে হাত রেখে বলে,
“কাঁদবেনা একদম।”
“আব্বু আমার সঙ্গে কথাও বলছে না ভাবি।” ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে নিহি।
“রাগ কমেনি তো। রাগ কমলে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“আমি খুব বড় ভুল করে ফেলেছি ভাবি। আমার কারণে আব্বুকে অপমানিত হতে হয়েছে। আমি খুব বাজে ভাবি। খুব বাজে।”
তমা নিহিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“তুমি অনেক লক্ষী নিহি। নিজেকে এতো ছোট কখনো ভাববে না। মানুষ মাত্রই ভুল। তুমিও একটা ভুল করে ফেলেছ। একটা কথা মনে রাখবে, মানুষ কিন্তু ভুল থেকেই একদিন শিখে। তোমার বয়স কম। সাফল্যর দিকে যত এগিয়ে যাবে, ততই হোঁচট খাবে। আর ততই শিখবে। ব্যর্থতার পরই সফলতা আসে। তোমার ওপর বাড়ির সবাই এখন রেগে আছে। তবে এই রাগটা ক্ষণিকের। তোমাকে বাবা-মা যতই দূরে ঠেলে দেবে, তুমি ততই ঘেঁষে থাকবে। মনে রাখবে, এরা তোমার আপনজন। তোমার বাবা-মা। একদিন, দু-দিন তোমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে হয়তো। কিন্তু তৃতীয় দিন ঠিকই তোমায় বুকে টেনে নেবে। আদর্শ বাবা-মা কখনো সন্তানদের ঠকায় না নিহি। তুমি মানো তো তাদের আদর্শ বাবা-মা?”
নিহি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উপর-নিচ মাথা ঝাকায়। যার অর্থ ‘হ্যাঁ।’তমা নিহির চুলগুলো হাত-খোঁপা করে দিতে দিতে বলে,
“ব্যস! তাহলেই হবে। এখন মায়ের কাছে যাও। শক্ত করে গিয়ে জড়িয়ে ধরবে।”
নিহি রান্নাঘরে যাওয়ার পথে থেমে যায়। পিছনে ঘুরে আবার ভাবির দিকে এগিয়ে যায়। ভাবিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,
“মায়ের পরে তুমি আমার দ্বিতীয় অনুপ্রেরণা। যারা মনে করে, ননোদ-ভাবি মানেই ঝগড়া, হিংসা তাদেরকে উদাহরণ হিসেবে তোমাকে দেখানো উচিত। ভালোবাসি ভাবি।”
তমা নিহির কপালে চুমু খেয়ে বলে,
“পাগলী! তুমি কি শুধুই আমার ননোদ? আমার বোন তুমি। আমার লক্ষী।”
নিহি তমার গালে চুমু দিয়ে রান্নাঘরে যায়। সালেহা বেগম রান্না করছিলেন। নিহি পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“মা।”
তিনি নিশ্চুপ। নিহি জিজ্ঞেস করে,
“কী রান্না করছ?”
“মাছ।”
“আমার নুডুলস্ খেতে ইচ্ছে করছে। বানিয়ে দেবে?”
সালেহা বেগম নিহির থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে নুডুলস বানানোর জন্য পানি বসায়। নিহি মায়ের হাত জড়িয়ে ধরে বলে,
“আমার সাথে কথা কেন বলো না মা? আমায় কি ক্ষমা করা যায় না? একটা সুযোগ দেওয়া যায় না আমায়?”
সালেহা বেগম নিহিকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন। কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
“কেন এমন ভুল করলি মা?”
নিহি নিজেও কেঁদে ফেলে। কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“আর করব না মা। আমি বুঝতেও পারিনি অনল এমন কিছু করবে।”
“আমায় বল তো, শুরু থেকে কী হয়েছিল?”
সালেহা বেগম তমাকে রান্নাঘর সামলাতে দিয়ে নিহিকে নিয়ে নিহির রুমে যান। বিছানায় নিজে বসে নিহির মাথা কোলে নেন। এরপর বলেন,
“এবার বল।”
নিহি শুরু থেকে সবটা বলে তাকে। সব শুনে তিনি শান্তস্বরে বলেন,
“অনলকে যা বলেছিস একদম ঠিক বলেছিস। এখন শোন, মাত্র এক সপ্তাহ্ তুই এই কলেজে পড়বি। তারপর নিজে গিয়ে টিসি চাইবি।”
নিহি শোয়া থেকে উঠে বসে। অবাক হয়ে তাকায় মায়ের দিকে। মায়ের চোখে দৃঢ়তা বিদ্যমান। সালেহা বেগম বলেন,
“ঠিকই বলছি। এই কলেজ তোকে রিজেক্ট করতে চেয়েছিল না? তুই নিজেই এই কলেজকে রিজেক্ট করবি এবার। আর এক সপ্তাহ্ কেন পড়তে বলছি সেটাই ভাবছিস তো? এই এক সপ্তাহ্ তুই অনলকে দেখিয়ে দিবি, ও’কে ছাড়া তুই দিব্যি ভালো থাকতে পারিস। ওর প্রতারণা ক্ষণিক সময়ের জন্য তোকে আটকে রাখতে পারলেও সারাজীবনের জন্য কখনোই আটকে রাখতে পারবে না। আমি তোর মামার সঙ্গে কথা বলব। তোর মামার বাসায় সিলেটে থেকে তুই পড়বি। পারবি না?”
নিহি মায়ের দু’হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,
“তুমি যা বলবে, আমি তাই শুনব।”
.
.
সন্ধ্যার দিকে পড়তে বসেছে নিহি। পড়ার টেবিলটা জানালার সাথে। জানালা বন্ধ করাই ছিল। কী মনে করে যেন জানালাটা খুলে দেয় নিহি। সঙ্গে সঙ্গে শাঁ শাঁ করে বাতাস প্রবেশ করে ঘরে। সারা শরীরে কম্পন তুলে যায়। এমনিতেই ঠান্ডা পড়েছে খুব তার মধ্যে আবার জানালা খুলে দেওয়ায় বাতাসও যোগ হয়েছে। তবুও নিহির মন্দ লাগছে না। জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে মৃদু স্বচ্ছ আকাশ। তারাদের মেলা আজ নেই। তবে ঘোলা চাঁদ রয়েছে। সম্ভবত হালকা কুয়াশা বা মেঘের জন্যই চাঁদটাকে ঘোলা মনে হচ্ছে। মনোযোগ সহকারে প্রকৃতিকে দেখে উপলব্ধি করছে। মুহূর্তেই একরাশ বিষণ্ণতা নিহিকে ঘিরে ধরে। অনলের কথা মনে পড়ে যায়। অনলের এমন প্রতারণা করাটা নিহির ভাবনা-চিন্তার বাহিরে ছিল। কিন্তু এটাই হলো। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে চেয়ারের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসে। সকলের সামনে যতই শক্ত হয়ে থাকুক না কেন, দিনশেষে ঠিকই একাকিত্ব চেপে ধরে। অনলের কথা মনে পড়ে বুক চিরে কান্না আসে। কিছুতেই মেনে নিতে পারে অনলের এহেন প্রতারণা। তবুও মেনে নিতে হয়। যত যাই হোক, কারো সামনে ভেঙে পড়া চলবে না। নিজেকে শক্ত রাখতেই হবে। চোখের কোণে হাত দিয়ে দেখে, কার্ণিশে কিছু অশ্রুজল জমা হয়েছে। ক্লেশকর হাসিতে ঠোঁটকে মুখরিত করে অশ্রুটুকু মুছে নেয়। মনের অজান্তেই বিড়বিড় করে বলে, ‘জানি না, কবে কাটিয়ে উঠতে পারব এসব ক্লেশময় যন্ত্রণা!’
পড়ায় মন বসাতে না পেরে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। ঘুমানোর চেষ্টা করেও কোনো লাভ হচ্ছে না। বিছানায় একবার এপাশ আরেকবার ওপাশ করেও যখন ঘুম এলো না তখন কম পাওয়ারের একটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়ে। আস্তে আস্তে ঘুমেরা ধরা দিতে বাধ্য হয় নিহির আঁখিদ্বয়ে।
______________________
কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসে আড্ডা দিচ্ছে অনল ও ওর বন্ধুরা। ক্লাস শুরু হওয়ার ঘণ্টা দিয়েছে মিনিট বিশেক হবে। অনলদের ক্লাস শুরু হতে এখনো দেরি আছে। তবুও আড্ডা দেওয়ার জন্য আরো আগেই বন্ধুরা মিলে চলে আসে। আড্ডার এক পর্যায়ে কথা ওঠে নিহিকে নিয়ে। লিসা বলে,
“অনল, তোমার মাঝে যে এত প্যাঁচ তা কিন্তু বুঝাই যায় না। আমাদের বন্ধুত্ব এতদিনের, আমরাই বুঝতে পারিনি আর তো পরে রইল ঐ পিচ্চি মেয়ে!”
অনল হাসে। সাকিব বলে,
“তুই একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের এত খারাপ পরিস্থিতিতেও হাসছিস? এটা যদি তোর সাথে হতো?”
“ফালতু কথা বলিস না তো। ঐ মেয়েকে আমার এমনিতেও পছন্দ নয়।”
সুমাইয়া করুণস্বরে বলে,
“নিহি আজ কলেজে আসেনি। খেয়াল করেছিস?”
উত্তরে অনল বলে,
“না আসলে নাই। তোর এতো মাথা ব্যথা ক্যান? দেখ গিয়ে কোথায় লুকিয়ে আছে। কাল কত বড় বড় কথা বলে গেছে শুনিসনি? শুধু বড় কথা বললেই হয় না। কাজে প্রমাণ করতে হয়। আর তার জন্য থাকতে হয় সাহস।”
“সেই সাহস নিহির আছে!” গেইটের দিকে তাকিয়ে বলে সুমাইয়া। সকলেই সুমাইয়ার দৃষ্টি অনুসরণ করে গেইটের দিকে তাকায়। নিহি দৌঁড়ে দৌঁড়ে আসছে। রাতে ঘুমের ওষুধ খাওয়ার জন্য সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে। তাই কলেজে আসতেও দেরি হলো। নিহি কোনোদিকে না তাকিয়েই ক্লাসে চলে যায়। অর্ধেক ক্লাস হয়ে গেল প্রায়। এখন গেলে স্যার বকবে। তাই প্রথম ক্লাসটা করবে না ভাবে নিহি। পাশের খালি ক্লাসে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে ক্লাস শেষ হওয়ার। পরের ক্লাসের বই বের করে পড়তে থাকে। কাল তো এমনিতেও পড়তে পারেনি। প্রথম ক্লাস শেষ হওয়ার পর নিহি ক্লাসে যায়। নিহিকে দেখে কয়েকজন মেয়ে বেশ হাসাহাসি করছে। কিছু ছেলে নিজেদের মধ্যে বাজে মন্তব্যও করছে নিহিকে নিয়ে। উপমা নিহিকে বসার জায়গা দিয়ে বলে,
“এত দেরি হলো কেন?”
“ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে।”
পেছন থেকে, সামনে থেকে সকলের কানাঘুষা করে বলা কথা উপমা আর নিহির কানে আসছে। উপমা জবাব দিতে গেলেও নিহি আটকাচ্ছে। ক্লাস চলাকালীনও শুনতে হয়েছে সকলের ফিসফিস। স্যার,ম্যামরাও অন্য দৃষ্টিতে দেখছে নিহিকে। সম্মান এমন একটা জিনিস যা হারিয়ে গেলে ফিরে পাওয়া দুষ্কর। টিফিন টাইমে ক্যান্টিনে গেছে দুজনে খেতে। কলেজের প্রায় সবাই ক্যান্টিনে খায়। কয়েকজন আবার বাইরে গিয়ে হোটেলে খায়। ক্যান্টিনে ঢোকার সময়ই নিহির এক ক্লাসমেট ছেলে বলে,
“বান্ধবী আমাদেরও তো একটু জড়িয়ে ধরতে পারো? আমরা অবশ্য প্রিন্সিপালকে বিচার দেবো না।”
ছেলেটার সঙ্গে আরো কয়েকজন ক্লাসমেট ছেলে শব্দ করে হাসে। অপমানে নিহির কান্না চলে আসছে। মনের ভেতর প্রবল দৃঢ়তা এনে ভাবে, ‘ভেঙে পড়লে চলবে না। ভাঙা হৃদয় কাউকে দেখানোও যাবে না। নরম হওয়া যাবে না কারো সামনে।’ নিহি নিশ্চুপ থাকতে থাকতে আরো কিছু বাজে কথা শুনিয়ে দিয়েছে ওরা। তখন ক্যান্টিনের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে অনল, সাকিব, মিলন, সুমাইয়া, লিসা ও ওদের ক্লাসের আরো কয়েকজন। বেশকিছু ছেলে নিহির চারপাশে দাঁড়িয়ে নিহিকে উক্তক্ত করছে। যেই ছেলেটা নিহিকে বাজে কথা বলেছে তার দিকে তাকিয়ে নিহি নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে থাপ্পড় বসায় ছেলেটার গালে। চিৎকার করে বলে,
“কাউকে কিছু বলার আগে ভেবে বল। কোনো মেয়েকে অসম্মান করার আগে তার জায়গায় নিজের বোনকে, নিজের মাকে, নিজের প্রিয়তমাকে ভেবে দেখ। তাকে পারবি তো এভাবে অসম্মান করতে? কোনো মেয়ে যদি খারাপও হয় তবুও তাকে অসম্মান করিস না। মা নিশ্চয়ই মেয়েদের অসম্মান করতে শেখায়নি? কতটুকু চিনিস আমাকে? কতটুকু জানিস ঐ সত্যটা? একটা কথা শুনলি তো সেটা নিয়েই পড়ে গেলি! কীভাবে, কতভাবে অসম্মান করা যায় সেটা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছিস তোরা। একটা কথা কান খুলে শুনে রাখ, আমায় নিয়ে বাজে মন্তব্য করার আগে দশবার ভাববি। নয়তো আজ তো হাত দিয়ে মেরেছি। এরপর জুতো খুলে মারব। জানোয়ার!”
আচমকা এসব হওয়ায় সব হাসি-ঠাট্টা, ফিসফিসানি থেমে যায়। সব ছেলে-মেয়েরা চুপসে যায়, যারা নিহিকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করেছিল।
কথাগুলো বলতে বলতে নিহির কান্না চলে আসে। দৌঁড়ে ক্যান্টিন থেকে বের হওয়ার সময় অনলকে দেখে থমকে দাঁড়ায়। কন্ট্রোল করে নেয় অশ্রুগুলোকে। অনলকে বলে,
“খুশি তো এবার আপনি? আপনি যা চেয়েছিলেন, তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি অপদস্থ হতে হচ্ছে আমায়। ভালো লাগছে না আপনার? জানি আমি! আপনার ভীষণ ভালো লাগছে এখন। ভেতরে ভেতরে আপনি পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছেন। ভাববেন না, আজ যারা আমায় অপমান, অপদস্থ করছে একদিন তারাই তাদের ভুলটা জানতে পেরে অনুতপ্ত হবে। আর ভুলটা যে কতটা ভুল সেটা সবচেয়ে ভালো জানেন আপনি। আমার অনুভূতিকে নরম ভাবার কোনো কারণ নেই। মেয়েদের অনুভূতি ভীষণ শক্ত। শুধু পাত্রভেদে অনুভূতির প্রকাশ ঘটায়। সময় একদিন কথা বলবে।”
অনলকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিহি মাঠের এক কোণায় গিয়ে বসে। নিহির পিছনে পিছনে যায় উপমা আর দীপ্ত। নিহির দু’পাশে দুজনে বসে। উপমা বলে,
“আমি তোর পাশে সবসময়ই আছি নিহি। আমি সেদিন সেখানে উপস্থিত না থেকেও বলতে পারি তোর কোনো দোষ ছিল না। তার উপযুক্ত শাস্তি সে একদিন ঠিক পাবে দেখিস।”
“ওদের জন্য আমায় তুমি ভুল বুঝো না। ওরা আমার ক্লাসমেট হলেও, আমি ওদের পছন্দ করতাম না। আজকের পর তো আরো নয়। সব ছেলে খারাপ হয় না। আমায় তুমি বন্ধু হয়ে পাশে থাকতে দিও। তোমার বিশ্বাসের অমর্যাদা আমি করব না, মা কালীর দিব্যি।” বলে দীপ্ত।
উপমা আর দীপ্ত নিহির দু’হাত জড়িয়ে ধরে অপর হাত দিয়ে নিহির চোখের পানি মুছে দেয়। হোঁচট খেয়ে ফের আবার পথ চলতে সব মানুষের দরকার হয় না। কিছু প্রকৃত মানুষ থাকলেই চলে।
চলবে…
#আড়ালে_আবডালে
#পর্ব_১৩
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________________
সোফায় আধশোয়া হয়ে বসে কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনছে অনল। অনামিকা ম্যাম তখন রান্না করছিলেন। রান্নাঘর থেকে ফিরে এসে গভীরভাবে ছেলেকে পর্যবেক্ষণ করেন তিনি। তার ছেলেটা ভীষণ সুন্দর, ভীষণ মায়াবী। সেই সঙ্গে আনলিমিটেড দুষ্টু। মনটা ভালো। তবে নিহিকে সে যতটা চিনেছে, তাতে এমন নিচ কাজ অন্তত নিহি করতে পারে বলে তার মনে হয় না। সকলের সামনে অকপটে অনলকে ভালোবাসার স্বীকারোক্তি তাও নিজের বাবার সামনে করেছে! ও চাইলেই পারত সব দোষ অনলের ঘাড়ে দিতে। কিন্তু ও তা করেনি। বরং সবার সামনে স্বীকার করেছে ভালোবাসার কথা। তাহলে কি এখনে কোনো গোলমাল আছে? নাকি নিহিকে বিশ্বাস করতে গিয়ে নিজের ছেলেকেই দোষী বানাচ্ছি! হিসেব মেলাতে পারেন না তিনি। সেদিনের পর থেকে নিহি আর কোনোদিন প্রাইভেট পড়তে আসেনি। ক্লাসেও চুপচাপ ছিল। হাসে কম। তাকায়ও না। হঠাৎ করেই চঞ্চল মেয়েটি যেন চুপসে গেল! কিছু তো অবশ্যই ছিল এবং আছে আড়ালে।
অনামিকা রহমানকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনল বলে,
“কী ভাবো আম্মু?”
হুশে এসে মৃদু হেসে উত্তরে তিনি বলেন,
“কিছু না। ভার্সিটিতে যাবে না?”
“যাব তো! সময় আছে এখনো।”
অনামিকা রহমান এসে অনলের পাশে বসে বলেন,
“আগে তো সময়ের অনেক আগেই যেতে।”
“বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম তো তাই।”
“এখন আড্ডা দাও না?”
“দিই তো। ত্রিশ থেকে পয়চাল্লিশ মিনিট আগে যাই এজন্য।”
“কিছুদিন আগেও কিন্তু তুমি প্রায় দেড় ঘণ্টা আগে কলেজে যেতে।”
“তাই নাকি?”
“হ্যাঁ।”
“কী জানি! হতে পারে। এত খুঁটে খুঁটে প্রশ্ন করছ কেন বলো তো?”
“হিসেব মেলাচ্ছি।”
“হিসেব? কীসের হিসেব?”
“আগে এত তাড়াতাড়ি যেতে। আর এখন কিছু সময় আগে যাও। কারণটা কী?”
“উহ্ আম্মু! কোনো কারণ নেই। দরকারি কোনো কাজ থাকলে বেশি আগে যাই।”
“তোমার সেই দরকারি কাজটা কি নিহিকে নিয়ে থাকত তখন?”
অনলের দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন অনামিকা রহমান। অনল মায়ের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে। হেসে হেসে বলে,
“কী যে বলো না আম্মু! ওর জন্য কেন যাব?”
“আমি তো বলিনি, তুমি ওর জন্যই যাও। আমি শুধু জিজ্ঞেস করেছি।”
“আল্লাহ্! টিচার না হয়ে তোমার উকিল হওয়া উচিত ছিল। এখন উঠি আমি। রেডি হব।”
অনল চলে যাওয়ার পরও অনামিকা ম্যাম বেশকিছুক্ষণ বসে থাকেন।
.
.
শীতের ঠান্ডা বেশ ভালোই পড়েছে। গায়ে সুয়েটার জড়িয়ে পড়তে বসেছে নিহি। ফজরের নামাজ পড়ে আর ঘুমায়নি। ক্লাসের পড়া বাকি ছিল। সেটাই এখন কমপ্লিট করছে। অনলের জন্য মনের অস্থিরতা কমাতে নামাজ ম্যাজিকের মতো কাজ করছে। নামাজ পড়তে বসলেই দুনিয়ার সব কষ্ট, গ্লানি ধূলিসাৎ হয়ে যায়। আল্লাহ্-র দরবারে চাইলে আল্লাহ্ কখনো কাউকে ফিরিয়ে দেন না। হয়তো কখনো সময়টা বেশি লাগে তবে খালি হাতে আল্লাহ্ কাউকেই ফিরিয়ে দেন না। দরজায় দাঁড়িয়ে সালেহা বেগম বলেন,
“নিহি দরজা খোল।”
রুমের ভেতর থেকে নিহি বলে,
“দরজা খোলাই আছে মা। আসো।”
সালেহা বেগম ভেতরে এসে বলেন,
“পড়ছিস?”
“হ্যাঁ। কিছু বলবে?”
“একটু হাঁটতে বের হতাম।”
“এত সকালে? খুব শীত বাইরে।”
“পড়ার চাপ না থাকলে চল। সুয়েটার তো গায়েই আছে।”
“আচ্ছা বেশ! চলো।” বই বন্ধ করে হেসে বলে নিহি।
মা-মেয়ে মিলে ছাদে যায়। শীতের ঠান্ডা প্রবাহে শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। নিহির ঠোঁট কাঁপছে অনবরত। সালেহা বেগম সেটা খেয়াল করে হাসেন। নিহি কপাল কুঁচকে বলে,
“হাসো কেন?”
ছাদের একটা চেয়ারে বসে উত্তরে বলেন,
“তোকে দেখে।”
“কেন? আমায় দেখে হাসির কী আছে?”
“বাচ্চাদের মতো ঠোঁট কাঁপছে তাই। বোস এখানে।”
নিহি মায়ের পাশে বসে। ছোট বেলাকার অনেক গল্প শুনায় সালেহা বেগম। নিহিকে খুব কম সময়ই একা থাকতে দেন তিনি। একাকিত্ব থেকে দূরে রাখেন। অনেক সময় নিহি রাত জেগে পড়ে আর মা পাশে বসে থাকেন। বিষণ্ণতা যেন নিহির ধারেকাছে ঘেঁষতে না পারে সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখেন। রান্নাঘর আর সংসার সামলায় তমা। তবে নিহির কষ্ট এখনো একটি জায়গাতেই। নিজাম ইসলাম এখনো নিহির সঙ্গে কথা বলেন না। কলেজের সময় হওয়ায় দুজনই নিচে নেমে আসে। নিহি রেডি হতে চলে যায়। আর সালেহা বেগম নিহির জন্য নাস্তা রেডি করেন।
নিহিকে সকালের নাস্তা খাইয়ে দেন সালেহা বেগম। উপমা আসলে দুজনে এক সঙ্গে কলেজে যায়। কলেজের মাঠেই দেখা হয় দীপ্তর সঙ্গে। ব্যাডমিন্টন খেলছিল। নিহিকে দেখে দীপ্ত হাত নাড়িয়ে ‘হাই’ বলে। নিজের ব্যাগটা উপমার কাছে দিয়ে নিহি দীপ্তকে বলে,
“আমিও খেলব।”
“তুমি পারো?”
“অবশ্যই।”
দীপ্তর অপজিটে নিহি খেলে। খেলা দুজনেই অল্প সময়ে জমিয়ে ফেলেছে। হঠাৎ করেই কক’টা লিসার মাথায় গিয়ে লাগে। ঐ সময়েই লিসা এসে পড়েছিল। লিসা মাথায় হাত দিয়ে ‘আহ্’ বলে শব্দ করে। নিহির দিকে রাগ নিয়ে এগিয়ে বলে,
“তোমার সাহস তো কম নয়।”
“আমি ইচ্ছে করে মারিনি।”
“চুপ! সাধু সাজার চেষ্টা কোরো না।”
“ইচ্ছেও নেই।”
“যেটা পারো না সেটা খেলতে আসো কেন?”
“কী পারি আর না পারি সেটা কাজেই প্রকাশ পাবে। আপনার কথায় নয়।”
“বেয়াদবি করবে না একদম।”
“বড়রা যদি ছোটদের যথাযথ সম্মান দিতে না পারে, তাহলে বড়দের থেকে সম্মান আশা করা বোকামি। তাছাড়া বেয়াদবের সঙ্গে বেয়াদবি করা ফরজ।”
“খুব ফাজিল মেয়ে তো তুমি।”
“সে আর নতুন কী?”
নিহির এমন স্পষ্ট কথায় লিসার রাগ বেড়ে যায়। সুমাইয়া লিসার পাশেই ছিল। সুমাইয়া লিসাকে বলে,
“হঠাৎ লেগে গেছে। চল ক্লাসে চল।”
“থাম তুই। কীসের ভুল হয়েছে? ইচ্ছে করে করেছে এমন।”
নিহির দিকে তাকিয়ে বলে,
“সামান্য লজ্জাটুকুও নেই না? এত বড় কাণ্ডের পরও বড় বড় কথা বলা বন্ধ হয়নি।”
“হাহ্! কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা সেটা আপনার বন্ধু বেশ ভালো করেই জানে। আর আপনারাও। তাছাড়া লোকে তো হাজারটা কথা বলবেই। সব কথা কানে কেন নেব আমি? দু’দিন না খেয়ে থাকলে তখন তো কেউ এসে খাবার দিয়ে যায় না। পারলে কী, কী ত্রুটি আছে সেসব খুঁজে বের করে। কে কী ভাববে, সেসব ধার আমি ধারি না। আর কিছু বলবেন? বললেও পরে বলতে হবে। ক্লাস শুরু হয়ে যাবে একটুপর। আরেকটু খেলেই ক্লাসে চলে যাব।”
নিহি চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই লিসা বলে,
“তোমাকে একমাত্র অনলই শায়েস্তা করতে পারবে। অনলকেই বলব আমি।”
নিহি থেমে যায়। পিছনে ফিরে লিসার কাছে এগিয়ে যায়। ঠোঁটে তাচ্ছিল্যর হাসি ফুঁটিয়ে বলে,
“আসতে বলিয়েন এবার। আমি যেমন ভালোবাসতে পারি, তেমনই উচিত শিক্ষা দিতেও পারি। ভুলেও আমায় ক্ষেপানোর চেষ্টা করিয়েন না। তাহলে ফলাফল না আপনার জন্য ভালো হবে আর ঐ প্রতারক অনলের জন্য।”
লিসার উত্তরের আশায় আর অপেক্ষা না করে নিহি খেলতে শুরু করে। অনলও তখন কলেজে আসে। অনলকে দেখে লিসা সবকিছু বলে অনলকে। সঙ্গে আরো কিছু বানিয়ে বানিয়ে বলে। অনল নিহির দিকে তাকিয়ে দেখে, নিহি হেসে হেসে খেলছে। দৌঁড়াচ্ছে। দেখে মনেই হবে না, কিছুদিন আগেও নিহির চোখে ছিল বিষাদ। দিব্যি আছে নিহি। অনল কিছু না বলে ক্লাসে চলে যায়।
পুরো ক্লাস না করেই টিফিন টাইমে বাড়ি যাওয়ার জন্য বের হয় নিহি। নিচ তলায় এসে অনামিকা ম্যামের সঙ্গে দেখা হয়। নিহি হেসে সালাম দিয়ে বলে,
“ভালো আছেন ম্যাম?”
তিনি মৃদু হেসে বলেন,
“হ্যাঁ, তুমি?”
“আলহামদুলিল্লাহ্।”
“বাড়িতে চলে যাচ্ছ যে?”
“একটু খারাপ লাগছে।”
“আচ্ছা যাও।”
নিহি চলে যায়। নিহির চোখেমুখে বিষাদের ছায়া। এত কীসের বিষাদ? কলেজ ক্যাম্পাস পাড়ি দিয়ে রিক্সায় ওঠে নিহি। বুকচিরে লুকিয়ে রাখা কান্নাগুলো বেরিয়ে আসে এবার। যতই ভালো থাকার অভিনয় করুক না কেন সবার সামনে, কষ্টগুলোকে কিছুতেই দূর করতে পারে না। আত্মসম্মান বজায় রাখতে পারলেও কষ্টগুলোকে দূরে রাখতে পারছে না। অনলকে দেখলেই বুকের ভেতর অসহনীয় কষ্ট হয়। কান্নাগুলোকে আটকে রাখতে কষ্ট হয়। কষ্টের সঙ্গে পেরে ওঠে না নিহি!
বাড়ির সামনে এসে ভাড়া মিটিয়ে চোখের পানিটুকু মুছে নেয়। বাড়ির সবার সামনে ভালো থাকার অভিনয়টা এখন যে আবার করতে হবে! বাড়ির ভেতর ঢুকেই মাকে খুঁজে বের করে। সালেহা বেগম তখন টিভি দেখছিলেন। নিহি গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। সালেহা বেগম বলেন,
“আহা! ছাড়। সিরিয়ালটা দেখতে দে।”
“সারাদিন শুধু সিরিয়াল, সিরিয়াল আর সিরিয়াল! সিরিয়াল দেখে দেখে ওদের মতো বজ্জাত শ্বাশুরী হচ্ছ।”
“তোর ভাবিকে জিজ্ঞেস করে দেখ, আমি বজ্জাত শ্বাশুরী নাকি ভালো শ্বাশুরী।”
নিহি উঠে ভেংচি কেটে বলে,
“আমার বয়েই গেছে।”
এরপর হাসতে হাসতে নিজের রুমের দিকে আগায়। হাসতে হাসতেই ঠোঁট উল্টে আবার কেঁদে ফেলে।
.
বিকেলে তিতিরকে নিয়ে ফোনে কার্টুন দেখছিল। তখনই তমা এসে বলে,
“নিহি বাইরে এসো তো।”
“কী হয়েছে?”
“পিয়ন এসেছে। তোমার চিঠি নিয়ে।”
নিহি শোয়া থেকে উঠে বসে। এই যুগেও কেউ আবার চিঠি পাঠায় নাকি? কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা থাকলে সহজেই ফোন করা যায়। ম্যাসেজ করা যায়। এছাড়াও সোশ্যাল মিডিয়া তো রয়েছেই। সেই যুগে এসে চিঠি! তাও নিহির নামে। ভেরী ইন্টারেস্টিং! কৌতুহল নিয়ে নিহি বাইরে যায়। দরজার সামনে ডাকপিয়ন দাঁড়িয়ে আছে। নাম সই করে চিঠিটা নিয়ে ঘরে আসে নিহি। পেছন থেকে তমা বলে,
“লাভ লেটার হলে আমায়ও দেখিও।”
নিহি হাসে। ঘরে এসে আকাশী রঙের খামটা খোলে। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে শুভ্র কাগজ। যেন বিশাল আকাশের বুকে এক টুকরো শুভ্র মেঘ! কাগজটিতে নীল কলম দিয়ে গোটা গোটা অক্ষরে মুক্তর দানার মতো লেখা। চিঠির শুরুতেই লেখা,
‘এইযে এলোকেশী,
তোমার দীঘল কালো চুলগুলোকে সুন্দর করে আটকে রাখবে। যেন, কারো নজরে না আসে। আর এই মেয়ে, বাচ্চাদের মতো এমন কাঁদো কেন? আজকে রিক্সায় দেখলাম তোমায় কাঁদতে। এই এলোকেশী, তুমি কেঁদো না কখনো। জানো, আমি কখনোই কাউকে চিঠি লিখিনি। তুমিই প্রথম। বুঝতে পারছিলাম না, কী দিয়ে লেখা শুরু করব। অগোছালো লেখাগুলোকে নিজের মতো একটু সাজিয়ে নিও।’
চিঠির নিচে বা খামের কোথাও নাম-ঠিকানা কিচ্ছু লেখা নেই। নাম-ঠিকানা ছাড়া কেউ চিঠি কী করে পাঠায়? ভুল করে অন্যের চিঠি এসে পড়ল নাকি আমার কাছে? না, ভুল কী করে হবে? লেখাই তো আছে, আমায় সে কাঁদতে দেখেছে। ভুল হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না! তাহলে কে এই উড়োচিঠির মালিক?
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]