আড়ালে আবডালে পর্ব-১০+১১

0
6399

#আড়ালে_আবডালে
#পর্ব_১০
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________________

আজ সকালেও বৃষ্টি হয়েছে। তবে ভোরের দিকে। তাই ঠান্ডাও লাগছে। সকালে রেডি হয়ে তাড়াতাড়ি কলেজে আসে নিহি। গতকাল বিকেলে প্রাইভেটে গিয়েও অনলকে ভালোবাসার কথা বলতে পারেনি। এজন্য উপমা খুব রেগে আছে। কলেজে গিয়ে দেখল এখনো তেমন কেউ আসেনি। কয়েকজন বাদে ক্লাস পুরো ফাঁকা। দীপ্ত নিহিকে দেখে বলে,
“গুড মর্নিং নিহি।”
“গুড মর্নিং।” হেসে বলে নিহি।

দীপ্ত সামনের বেঞ্চে বসে পড়ছিল। নিহির উত্তর পেয়ে আবার পড়ায় মনোযোগ দেয়। নিহিও একটা বই নিয়ে বসে পড়ে। উপমা না আসা পর্যন্ত পড়তে থাকুক। একটুপর পর দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে সময় দেখছে। উপমা কখনো লেট করে আসে না। আজকে কি তবে ইচ্ছে করেই লেট করছে? এই মেয়েটাকে নিয়েও আর পারা যায় না! ক্লাস শুরু হওয়ার ঠিক ১০ মিনিট আগে এসেছে উপমা। নিহি দ্বিতীয় বেঞ্চে বসেছিল। আর পাশে উপমার জন্য জায়গা রেখেছিল। উপমা সেখানে না বসে লাস্ট কয়েক বেঞ্চের আগে বেঞ্চে বসেছে। বই বন্ধ করে নিহি উপমার কাছে যায়। ওর পাশে বসে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আমার উপু বেবি রাগ করেছিস?”

উপমা ছাড়ানোর চেষ্টা না করেই বলে,
“সর তুই। ঢং করবি না একদম।”
“রাগ কেন করেছিস সেটা তো বল?”
“জানিস না তুই? কাল কী কথা ছিল?”
“এত রেগে কেন যাচ্ছিস? আমিই বা কী করতাম? অনেক ভেবেচিন্তেও বুঝতে পারছিলাম না কীভাবে বলব।”
“তোর বলা লাগবে না। যা তুই।”

উপমার রাগ ভাঙাতে গিয়ে ঐদিকে ঘণ্টাও পড়ে যায়। এখনই স্যার চলে আসবে। তবুও উপমার রাগ এখনো ভাঙেনি। নিহি সামনের বেঞ্চ থেকে ব্যাগ নিয়ে এসে উপমার পাশে বসে। একটুপর পর উপমাকে খোঁচায়।উপমা রাগ দেখিয়ে ফিসফিস করে বলে,
“রাগাবি না। স্যারকে বলে দেবো কিন্তু।”
“বল। আমিও বলব।”
“তুই কী বলবি?”
“আমিও বলব যে, তুই আমায় খুঁচিয়েছিস।”
“সত্যি কথা তো বলতে পারিস না। মিথ্যে ভালোই শিখেছিস।”
“তোর থেকে শিখেছি।”

উপমা চোখ গরম করে তাকায়। স্যার অনেকক্ষণ ধরেই দুজনকে ফিসফিস করতে দেখছিল। এবার দুজনকেই দাঁড় করিয়ে বলেন,
“ক্লাসে এত ফিসফিস কীসের?”
দুজনই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। নিহির ভীষণ হাসি পেলেও হাসি আটকে রাখছে। উপমা তো রেগে ফায়ার। স্যার দুজনকেই ক্লাস থেকে বের করে দেন। বাইরে গিয়ে নিহি হো হো করে হেসে ফেলে। উপমা ক্ষেপে বলে,
“খুব হাসি পাচ্ছে না? এবার, আমিও কী মজা দেখাই দেখ।” বলে, উপমা সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে। পেছনে নিহিও আসতে আসতে বলে,
“ঐ দাঁড়া।কোথায় যাস? স্যার আমাদের বাইরে না পেলে বকবে পরে। শোন!”

উপমা কোনো কথাই শুনে না। নিচ তলায় আসতেই দেখতে পায় অনল অফিস রুম থেকে বের হচ্ছে। অনলের মুখোমুখি হয়ে উপমা থেমে যায়। কিছুক্ষণ পর নিহিও উপমার পিছনে এসে দাঁড়ায়। অনল চলে যাওয়া ধরলে উপমা বলে,
“দাঁড়ান। আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।”
নিহি কিছুই বুঝতে পারছে না। অনল ভ্রু কুঁচকে একবার নিহির দিকে তাকায়। পরে উপমার দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমার ক্লাস আছে এখন। টিফিন টাইমে কথা বলি?”
“না, এখনই বলব। বেশি সময় নেব না।”
“আচ্ছা বলো।”
“নিহি আপনাকে ভালোবাসে। কিন্তু কিছুতেই এটা আপনাকে বলতে পারছে না।”

উপমার কথা শুনে নিহির মুখটা হা হয়ে যায়। অনল নিজেও অবাক হয়ে একবার নিহির দিকে তাকায় তো আরেকবার উপমার দিকে তাকায়। নিহির অবস্থা এখন, পারে না শুধু মাটির ভেতর ঢুকে যেতে। উপমার হাত ধরে টানতে টানতে বলে,
“মিথ্যে। সত্যি না। আল্লাহ্! উপমার বাচ্চা আয় তুই।”
নিহি উপমাকে টানছে। উপমা বলেই চলেছে,
“সত্যিই বলেছি ভাইয়া। ওর মুখ থেকে শুনে নিবেন কিন্তু!”

ক্লাসের সামনে নিয়ে উপমার পিঠে কয়েটা কিল-ঘুষি দিয়ে নিহি বলে,
“অসভ্য মাইয়া! ক্যান বলতে গেলি?”
“উফ! নিজে বলবে না। আবার আমি বললেও দোষ।”
“তোরে বলতে বলছি আমি? আল্লাহ্! কীভাবে যাব আমি তার সামনে।”
“ইশ! ঢং কম কর।”
“তোরে তো আমি পরে দেখতেছি। ঘণ্টা দিছে, এখন ক্লাসে চল।”
.
টিফিন টাইম

এখন নিহি উল্টো উপমার ওপর রাগ করেছে। তাই ক্যান্টিনে খেতেও যায়নি। লাইব্রেরীতে বই নিয়ে বসে আছে। উপমা রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করছে। অনল ক্যান্টিনে গিয়ে দেখে নিহি আর উপমা কেউই নেই। লাইব্রেরীতে এসে দুজনকেই পেয়ে যায়। টিফিনের সময় বলে সবাই খেতে গেছে। লাইব্রেরীতে এখন শুধু ওরা দুজনই আছে। অনলকে দেখে উপমা বলে,
“ঐযে রাগ ভাঙানোর মানুষ চলে এসেছে। আমি যাই এখন।”
“ঐ না। উপমা যাবি না।”

উপমা কোনো কথা শুনে না। চলে যায়। অনল নিহির পথ আটকে বলে,
“কী হু?”
নিহি থতমত খেয়ে বলে,
“ক..কই কী?”
“এমন চোরের মতো করছ কেন?”
“কী আজব! চোরের মতো করব কেন?”
“সেটাই তো আমার প্রশ্ন।”
“সরেন। বাইরে যাব।”
“কথা শেষ হয়নি আমার।”
“কী কথা?”
“উপমা যা বলল তা কি সত্যি?”

নিহি নিশ্চুপ। অনল আবার জিজ্ঞেস করে,
“সত্যি?”
“জানি না।” নিহির উত্তর।
“জানি না বললে তো হবে না। যেটা উপমা বলেছে এখন বলো আমায়।”
“কিছু বলার নাই। আমি যাব।”
“না বললে জড়িয়ে ধরব কিন্তু!”
“ঐ না।”
আচমকা অনল নিহিকে জড়িয়ে ধরে। নিহি বলে,
“ছাড়েন।”

প্রিন্সিপাল স্যার যাচ্ছিলেন লাইব্রেরীর পাশ দিয়ে। অনল নিহিকে ছাড়ার আগেই প্রিন্সিপাল স্যার লাইব্রেরীতে ঢুকে যায়। দুজনের অবস্থা তখন পাথরের মতো।
অনল আর নিহিকে লাইব্রেরিতে জড়িয়ে ধরা অবস্থায় দেখে ফেলে প্রিন্সিপাল স্যার। দুজন ছিটকে সরে যায়। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে কী বলা উচিত স্যার বুঝতে পারছেন না। স্যার ধমক দিয়ে বলেন,
“এসব কী? এখানে কী করছ তোমরা? কলেজে আসো প্রেম করতে?”
একটু থেমে আবার বলেন,
“তোমাদের সাথে আমি কোনো কথা বলব না। কথা হবে তোমার গার্জিয়ানদের সাথে। তারাও জানুক তোমাদের কীর্তি।”

প্রিন্সিপাল স্যার চলে যাওয়ার পর নিহি কেঁদে ফেলে। অনল নিহিকে বলে,
“কেঁদো না তুমি প্লিজ। একদম ভয় পাবে না। যা হওয়ার হবে। আমি আছি তো তোমার পাশে। প্রয়োজনে আমরা বিয়ে করে ফেলব। তবুও কেউ আমাদের আলাদা করতে পারবে না।”
অনলের কথায় কিছুটা ভরসা পেলেও ভয় কমেনি। না জানি, বাবা কতটা কষ্ট পাবে!
.
.
প্রিন্সিপাল স্যারের অফিস রুমে বসে আছে নিহির বাবা নিজাম ইসলাম আর অনলের মা অনামিকা ম্যাম। একপাশে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে অনল আর নিহি। স্যার আগেই সব বলেছেন দুই পরিবারকে। নিহির বাবা নিজাম ইসলাম বলেন,
“স্যার যা বলল তা কী সত্যি?”

নিহি নিরুত্তর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিজাম ইসলাম এবার ধমক দিয়ে বলেন,
“কথা বল।”
ধমক খেয়ে ভয়ে কেঁপে উঠে নিহি।
“রিল্যাক্স। আমি কথা বলছি ওদের সাথে।” বলেন স্যার।
স্যার এবার দুজনের দিকে তাকিয়ে বলেন,
“লাইব্রেরির ঘটনা তো তোমরা নিশ্চয়ই অস্বীকার করতে পারবে না? আমি নিজের চোখে দেখেছি তোমাদের।”
দুজনই নিশ্চুপ। স্যার আবার বলেন,
“এখন দুজনই আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। তোমরা কি দুজন দুজনকে ভালোবাসো?”

দুজনকে চুপ থাকতে দেখে অনামিকা ম্যাম নিহির উদ্দেশ্যে শান্তস্বরে বলেন,
“তুমি কি অনলকে ভালোবাসো নিহি? যদি ভালোবাসো তাহলে আমায় বলো।”
নিহি মাথা তুলে একবার ম্যামের দিকে তাকায়। তারপর অনলের দিকে তাকায়। নিজাম ইসলামের দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে ফেলে। কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলে,
“হ্যাঁ।”
“আর অনল তুমি?” জিজ্ঞেস করেন স্যার। অনল স্যারের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমি নিহিকে ভালোবাসি না স্যার।”

নিহি অবাক হয়ে তাকায় অনলের দিকে। অনল এসব কী বলছে? অনল আবার বলে,
“আমি লাইব্রেরীতে গেছিলাম একটা বই আনতে। নিহি লাইব্রেরীতেই ছিল। আমায় দেখেই নিহি জড়িয়ে ধরে। আর তখনই স্যার লাইব্রেরীতে আসে।”

নিহির চোখজোড়া পানিতে টইটুম্বুর হয়ে যায়। পায়ের নিচের মাটিকে বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। নিজের কানকেই নিহি বিশ্বাস করতে পারছে না। অনল কী এসব সত্যিই বলছে? অনল একটাবারও নিহির দিকে তাকায়নি। আর নিহি অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে আছে অনলের দিকে।

স্যার বলেন,
“সবই তো শুনলেন আপনারা। এখন বলেন আমি কী করব?”
লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে নিজাম ইসলামের। নিহির থেকে তিনি এমন কিছু কখনোই আশা করেননি। তবুও সঙ্কোচ নিয়ে বলেন,
“যা আপনার সিদ্ধান্ত।”
স্যার বলেন,
“আমি নিহিকে টিসি দিয়ে দেবো। এমন স্টুডেন্ট আমার কলেজে রাখা সম্ভব নয়।”

কথা শেষ করে নিজাম ইসলাম নিহির হাত ধরে বাইরে নিয়ে যায়। পিছু পিছু অনলও আসে। নিহি অনলের দিকে তাকিয়ে দেখে অনলের ঠোঁটে হাসি। কোনোকিছু জয় করার হাসি। নিহি দাঁড়িয়ে পড়ে। নিজাম ইসলামকে বলে,
“আব্বু আমার অনলের সাথে কিছু কথা আছে।”
“দয়া করে আর সিনক্রিয়েট করিস না। মানসম্মান তো কিছুই বাকি রাখলি না।”

নিহি হাত ছাড়ানোর জন্য জোড়াজুড়ি করছে। নিজাম ইসলাম নিহির হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যায়। অনল এগিয়ে এসে নিহির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় নিহির কানের কাছে আস্তে করে বলে যায়,
“সেদিনের সেই থাপ্পড়ের প্রতিশোধ নেওয়া শেষ আমার।”
নিহি যেতে যেতে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে থাকে অনলের দিকে।

চলবে…

#আড়ালে_আবডালে
#পর্ব_১১
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________

“এমন একটা কাজ করার আগে কী তুই একটাবারও ভাবলি না আমার সম্মানের কথা?”
নিহি সবার সম্মুখে ড্রয়িংরুমে মাথা নিচু করে বসে আছে। আর অনবরত চোখের পানি ফেলছে। কিছুতেই অনলের করা কাজগুলোকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না। এত বড় গেম অনল খেলতে পারল? নিহিকে প্রশ্ন করে উত্তরের আশায় চেয়ে আছেন নিজাম ইসলাম। নিহি নিরুত্তর। নীলম বলে,
“নিহি কী করেছে আব্বু?”
“কী করেছে? জিজ্ঞেস কর তোর আদরের বোনকে। বেশি ভালোবেসে নষ্ট করে ফেলেছি। জন্মের সময়ই যদি মুখে লবণ দিয়ে মেরে ফেলতাম তাহলে আজকের এই দিনটা আমায় দেখতে হতো না।” চেঁচিয়ে বলেন নিজাম ইসলাম। একটু দম নিয়ে আবার বলেন,
“আমার সব বিশ্বাস তুই ভেঙে দিলি নিহি।”
নীলমের দিকে তাকিয়ে বলেন,
“প্রিন্সিপাল স্যার কলেজে ডাকলেন আমায়। কলেজের এক ছেলেকে লাইব্রেরীতে জড়িয়ে ধরেছে। বাবা হয়ে এসব কথা বলতে মুখে বাঁধছে আমার! সেখানে আমার মেয়ে এমন কাণ্ড করেছে।”
“দুজন কি দুজনকে ভালোবাসে?” প্রশ্ন করে নীলম।
নিজাম ইসলাম ব্যাঙ্গ করে বলেন,
“ঐ ছেলে নিহিকে ভালোবাসে না। সবার সামনে বলেছে এই কথা। আর তোর বোন! ও আমার সামনে, সবার সামনে বলে যে ঐ ছেলেকে ভালোবাসে! তাও না হয় বুঝতাম যদি, ঐ ছেলেও নিহিকে ভালোবাসতো!”

কারো কোনো কথাই নিহির সহ্য হচ্ছে না। বাঁধ ভাঙা চোখের পানিকেও আটকাতে পারছে না। দৌঁড়ে রুমে চলে যায়। দরজা আটকে দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়ে। বালিশের নিচ থেকে ফোন বের করে অনলকে ফোন করার জন্য। অনেকবার চেষ্টা করে অনলের সাথে যোগাযোগ করার। নিহির ফোন রিসিভ করে না অনল। সোশ্যাল মিডিয়ার সবকিছু থেকে নিহিকে ব্লক করে দেয়। নিহির নাম্বারও ব্লকলিস্টে ফেলে রেখেছে এখন। কোনোভাবেই অনলের সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না। এত অসহায়ত্ববোধ আর কষ্ট এর আগে কখনো অনুভূত হয়নি। ফোন নিয়ে ফ্লোরে শুয়ে পড়ে। চোখের কোণা বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রুজল। কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতেও পারেনি। ঘুম ভাঙে দরজায় নক করার শব্দে। ভাবি ডাকছে। উঠে দরজাটাও খুলতে ইচ্ছে করছে না। ছোঁ মেরে ফোনটা চেক করে দেখে, অনল কোনো ম্যাসেজ করেছে কী না! আশায় পানি। অনলের না কোনো ম্যাসেজ এসেছে আর না কোনো কল। ফেসবুকে গিয়ে দেখে আনব্লক করেছে কী-না! সেখানেও ব্লক। এতটা পরিবর্তন? দরজায় অনবরত নক করেই যাচ্ছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিহি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। খাবার হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তমা। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে উপমা। নিহিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে উপমা বলে,
“সব আমার জন্যই হয়েছে না?”
নিহি মৃদু হেসে উপমার পিঠে হাত বুলিয়ে বলে,
“কিছুই হয়নি। ঘরে আয়।”

নিহির পরনে এখনো কলেজের ইউনিফর্ম। উপমা প্রাইভেট পড়ে সরাসরি নিহির বাসায় এসেছে। নিহির মনে পড়ে যায়, এমনই একদিন প্রাইভেট শেষ করে অনল উপমাকে নিয়ে এসেছিল। নিহি দৌঁড়ে ব্যলকোনিতে যায়। আশা করেছিল, অনল আজও উপমাকে নিয়ে এসেছে। তীর্থের কাকের মতো নিচে চোখ বুলিয়েও অনলের দেখা মেলে না। উপমা নিহির কাঁধে হাত রেখে বলে,
“তুই যার আশা করছিস, সে আসেনি।”

নিহি ডুকরে কেঁদে ফেলে। বলে,
“অনল কেন করল এমন? শুধুমাত্র একটা থাপ্পড়ের জন্যই?”
“অমানুষ একটা! ছিঃ! আমি কল্পনাতেও ভাবেনি সে এমন। প্রাইভেট পড়তে গিয়ে দেখি বন্ধুদের নিয়ে রুমে হাসি-ঠাট্টা করছে। সে দিব্যি ভালো আছে নিহি।”
“আমার মনে হয় উপমা, অনল ইচ্ছে করে এমনটা করেনি।”
“তুই কি পাগল নিহি? সবটা নিজের কানে শুনে, চোখে দেখেও এমনটা কীভাবে বলতে পারিস? তুই কি অন্ধভাবে ভালোবেসে ফেললি? আমার কথা শোন, এখনো তেমন কিছুই হয়নি। ভাগ্য ভালো যে, সম্পর্ক গভীর হওয়ার আগেই সব শেষ হয়েছে। না হলে, তুই এখনই যতটা ভেঙে পড়েছিস, পরে তো মরেই যেতি।”
“মরেই তো গেছি আমি! আমি তো অনলের পরিবর্তন মেনে নিতে পারছি না।”
“মানুষ চিনে রাখ। মুখোশের আড়ালে কত নিকৃষ্ট চেহারা দেখেছিস?”

তমা বারান্দায় এসে বলে,
“সময় থাকতে নিজেকে সামলে নাও নিহি। এসব ট্রমা থেকে বেরিয়ে এসো। সব ভাবনা-চিন্তা মাথা থেকে দূর করো। এখন খাবে এসো।”
তমা জোর করে অল্পকিছু খাইয়ে দেয়। উপমা আরো কিছুক্ষণ সময় দিয়ে বাড়িতে চলে যায়। সবার এত বুঝও নিহির মনকে ধাতস্থ করতে পারছে না। শান্ত করতে পারছে না। বুকের ভেতর দহন কমাতে পারছে না এক চুল পরিমাণও। নিস্তেজ শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দেয়।
.
.
দু’দিন পার হয়ে গেছে অনলের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ হয়নি নিহির। লুকিয়ে ভাবির ফোন থেকেও নিহি অনলকে ফোন করেছিল। নিহির কণ্ঠ শুনে অনল ফোন কেটে দিয়েছে। ফেক আইডি দিয়েও নিহি নক করেছিল। বলেছিল একটু কথা বলতে। অনল নিহির কোনো অাকুতি শোনেনি। ব্লক করে দিয়েছে। কষ্টে দগ্ধ হয়ে নিহির মরে যেতে ইচ্ছে করছে। নিজাম ইসলাম নিহির সঙ্গে কথা বলেন না। যেই মেয়ে বাবার কলিজা ছিল এখন সেই মেয়ের মুখও দর্শন করতে চান না তিনি। নীলমও আগের মতো কথা বলে না। মা-ও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। যেই পরিবারে নিহি সকলের চোখের মনি, ভালোবাসার,আদরের মেয়ে ছিল সে এখন সকলের চোখে বিষ। যেই জায়গাটা সবার মনে নিহির জন্য ছিল সেই জায়গাটা নিহি হারিয়ে ফেলেছে। শুধু অনলের জন্য!

কলেজ থেকে ফোন এসেছে। প্রিন্সিপাল স্যার ফোন করেছেন। জানিয়েছেন অনামিকা ম্যাম নিহিকে টিসি দিতে বারণ করেছেন। এবং তার জন্যই নিহি আরেকটা সুযোগ পাচ্ছে এই কলেজে পড়ার। নিজাম ইসলাম প্রিন্সিপাল স্যারের সঙ্গে কথা শেষ করে নীলমকে বলেন,

“কলেজ থেকে ফোন করেছিল। তারা আরেকটা সুযোগ নিহিকে দিতে চায়। এখন, তুই যা করার কর। আমি আর এসবের মাঝে নেই। যেই সম্মান একবার হারিয়েছি দ্বিতীয়বার একই ভুল করতে চাই না। মোট কথা, আমার আর ইচ্ছেই নেই ও’কে পড়ানোর। কলেজে পড়তে পাঠালে কী হবে? মেয়ে তো যায় প্রেম করতে। ছিঃ!”
তমা ভয়ে ভয়ে বলে,
“বাবা, নিহি বাচ্চা মানুষ। একটা ভুল করে ফেলেছে। তাই বলে এভাবে শাস্তি দেওয়া ঠিক হবে না। অন্তত ইন্টারটা শেষ করুক? অন্য কলেজে এডমিট করাতে গেলেও অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে। তাই বলছিলাম যে…”
পুরো কথা শেষ করার আগে নিজাম ইসলাম বলেন,
“তোমাদের যা ভালো মনে হয় করো। আমার কোনো কিছুতেই কোনো সমস্যা নেই।” বলে নিজাম ইসলাম রুমে চলে যান। নীলম তমার কথা শুনে রাজি হয় নিহিকে কলেজে যেতে দিতে। এবং বলে,
“ও’কে বলে দিও, দ্বিতীয়বার এক ভুল যেন না করে।”
________________________

পরেরদিন থেকে কলেজে যায় নিহি। কলেজে গিয়েই অনলকে খুঁজে। সব প্রশ্নের উত্তর অনলকে দিতেই হবে।অনলকে ক্যান্টিনে পাওয়া যায়। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিল। না চাইতেও অনলকে দেখে নিহির চোখে পানি চলে আসে।নিহি কাঁদতে কাঁদতে অনলের শার্টের কলার চেপে ধরে বলে,
“সমস্যা কী আপনার? আমার ফোন কেন তুলছেন না আপনি? আমার সাথে কথা কেন বলেন না?”
অনল ঝাঁকি দিয়ে নিহির হাত সরিয়ে দিয়ে বলে,
“কলার ছাড়ো আমার! এতকিছুর পরও বোঝো না কেন ইগনোর করি তোমায়? আমি তো ভেবেছিলাম তুমি বুদ্ধিমতি মেয়ে। যেদিন অফিসে সবার সামনে আমি তোমাকে ভালোবাসার কথা অস্বীকার করলাম সেদিনই তো বুঝে ফেলার কথা ছিল। এরপরও যখন বুঝতে পারোনি তখন বুঝিয়েই বলি। কলেজে যেদিন তুমি আমায় থাপ্পড় মেরেছিলে সেদিনই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কঠিন প্রতিশোধ নেব আমি। বোঝার পর থেকে কেউ কখনো আমার গায়ে হাত তুলেনি। আর সেখানে তুমি অতি তুচ্ছ সাধারণ একটা মেয়ে হয়ে সবার সামনে আমায় মেরেছ। এত সহজে তোমায় আমি কী করে ছেড়ে দিতাম বলো? চাইলেই হয়তো পাল্টা থাপ্পড় আমিও মারতে পারতাম। কিন্তু সেই প্রতিশোধে কোনো মজা থাকত না। যেই মজাটা এখন পাচ্ছি। তোমার নিজের লাইফ এবং স্টাডি লাইফ দুটোই হেল করে দিয়েছি। কিন্তু আমার মায়ের জন্যই আবার তুমি এই কলেজে পড়ার পারমিশন পাচ্ছ। তাই আমার সাথে এমনকিছু করতে এসো না যাতে আবারও প্রিন্সিপাল স্যারকে তোমার নামে নালিশ করতে হয় আমার।”
নিহির কষ্টে বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে। একটুও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না অনলের কথা। গলা ভারী হয়ে আসছে। চোখ দুটো ক্রমাগত ঝাপসা হয়ে আসছে। ভারী গলাতেই বলে,
“তাহলে এসব ভালোবাসা…”
“সব নাটক সব। আমি তোমায় ভালোবাসব এটা ভাবো কী করে তুমি? যেদিন আমাদের বাড়িতে প্রথম তুমি আসো তখন আমি কোনো হ্যালুসিনেশনে ছিলাম না। সেদিন যা করেছি সজ্ঞানে বুঝে-শুনেই করেছি। আমি জাস্ট তোমায় এটাই বুঝাতে চেয়েছিলাম যে, সারাক্ষণ তোমার কথাই ভাবি আমি। তোমায় ভালোবাসি আমি। আর তুমি বিশ্বাসও করে নিয়েছ।
তোমার বোনের বাড়ির সামনে যে আমাদের দেখা হয় সেটা ছিল কাকতালীয়। আমি জানতামও না তুমি ওখানে আছো। আমি গিয়েছিলাম আমার প্রয়োজনীয় কাজে। তোমায় দেখে ভাবলাম একটা টোপ ফেলেই দেখি। তখন তোমায় বলি, তোমায় খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসেছি। তুমি সুবোধ বালিকার মতো এটাও বিশ্বাস করেছিলে। এইযে এতগুলো মাস তোমার পেছনে ব্যয় করেছি। সেটা কি এমনি এমনিই? শুধুমাত্র এই প্রতিশোধের জন্যই। আমার ফ্রেন্ড লিসার সাথে আমি মিজবিহেভ করেছি তোমার হয়ে? এটাই তো ভাবতে তুমি। আসলে তা নয়, তোমার মনে জায়গা পাওয়ার জন্যই এমন করতাম। এইযে এত সুন্দর প্ল্যান করেছি, এটা কিন্তু আমার বন্ধুমহলের কেউই জানত না। কেন জানো? কারণ আমি কোনো রিস্ক নিতে চাইনি। আর লাইব্রেরীর ঘটনাটা? সেদিনও আমি তোমায় জড়িয়ে ধরতে চাইনি। জানালা দিয়ে আমি প্রিন্সিপাল স্যারকে আসতে দেখেই তোমায় জড়িয়ে ধরেছিলাম। আর তার পরের ঘটনা তো তুমি জানোই। আরো কিছু শোনা লাগবে?”

নিহির মাথা ঘুরছে। নিজেকে স্থির রাখতে পারছে না। অনল সানগ্লাসটা চোখে দিয়ে হাসতে হাসতে বন্ধুদের নিয়ে ক্যান্টিন থেকে বের হয়ে যায়। নিজের ভারসাম্য বজায় রাখতে না পেরে নিহি একটা চেয়ারে বসে পড়ে। একটা মানুষ এত নিখুঁত অভিনয় কী করে করতে পারে? দেয়ালের সাথে মাথা ঠেকিয়ে মনে মনে বলে,
“আপনার নামের অর্থ আজ সত্যিই স্বার্থক মনে হচ্ছে অনল। আপনি সত্যিই আগুনে আমায় জ্বালিয়ে, পুড়িয়ে মারলেন। যেই আগুন দেখা যায় না, ধরা যায় না। শুধু বুকের দহনের সাথে সাথে অনুভব করা যায়।”
দু চোখের কার্ণিশ বেয়ে দুপাশে চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে নিহির।
উপমা কলেজে আসার পর থেকেই নিহিকে খুঁজছে। দীপ্ত উপমাকে দেখে বলে,
“তাড়াতাড়ি ক্যান্টিনে চলো। অনল ভাইয়ার কাছে গেছে নিহি।”
দীপ্ত আর উপমা দৌঁড়ে যায় নিহির কাছে। নিহি স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। শুধু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে নোনাজল। দীপ্ত আর উপমা দুজনে নিহির পাশে বসে বলে,
“অনল ভাইয়া তোকে কিছু বলেছে? এই নিহি? চুপ করে আছিস কেন?”
নিহি নিশ্চুপ। দীপ্ত বলে,
“এই নিহি, কথা বলো।”

নিহি দাঁড়িয়ে হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছে ক্যান্টিন থেকে বের হয়। পিছু পিছু দীপ্ত আর উপমাও আসছে। উপমা জিজ্ঞেস করছে, ‘কোথায় যাচ্ছিস?’ নিহি কোনো উত্তর না দিয়েই এগোতে থাকে। সেই কৃষ্ণচূড়া গাছটির কাছে যায়। এখন সেখানেই আছে অনল আর ওর বন্ধুরা। নিহিকে আসতে দেখে লিসা বলে,
“অনল, নিহি আসছে।”
অনল নিহির দিকে তাকিয়ে বলে,
“আসতে দে।”

নিহি কাছাকাছি আসতেই অনল উঠে দাঁড়ায়। নিহি মুখোমুখি দাঁড়ায় অনলের। সবসময়ের মতো অনলের ঠোঁটে হাসি। অনল বলে,
“কোনো প্রশ্ন করতে এসেছ সুন্দরী?” অনলের ব্যঙ্গ করে বলা কথা শুনে ওর বন্ধুরা সবাই হো হো করে হেসে ফেলে। নিহি তখনও অনলের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। অনল হাসছে মন খুলে। জিতে গেলে কেই বা মন খারাপ করে থাকবে? নিহি বলে,
“নিঃসন্দেহে আপনি একজন নিখুঁত অভিনেতা।”
“থ্যাঙ্কিউ।” বলে, মুখ টিপে হাসে অনল। জিজ্ঞেস করে,
“আর?”
“এইযে আপনার ঠোঁটে আজ জয়ের হাসি, একদিন এই আপনার চোখেই থাকবে বিষাদের পানি। আপনি যদি শুধু আমাকেই অপদস্থ করতেন তাহলে আমি মেনে নিতাম। কোনো অভিযোগ করতাম না। কিন্তু আপনি আমার বাবাকে অপমান করেছেন।পরিবারের সবার কাছে আমায় ছোট করেছেন। কলেজের সবার কাছে আমায় খারাপ প্রমাণ করেছেন। সত্যি মানতেই হবে, আপনি আপনার প্ল্যান এবং প্রতিশোধে সাক্সেসফুল। খুব জঘন্য আরো একটা অন্যায় কাজ করেছেন আমার ইমোশোন নিয়ে খেলে। আপনি অন্যভাবেও প্রতিশোধ নিতে পারতেন। আমার ইমোশোন, আমার ভালোবাসাকে কেন ইস্যু করলেন অনল? শুধু একটা থাপ্পড়ের জন্যই? চাইলে এখনই আমি আপনাকে আরো একটা থাপ্পড় দিতে পারতাম। কিন্তু আমি দেব না। কারণ আমি আপনার ধাতের না। কোনো দোষ না করা সত্ত্বেও মিথ্যে প্রতিশোধ নিয়েছেন আপনি জেদের বশে। আর আমার প্রতিশোধ নেবে প্রকৃতি। ‘রিভেঞ্জ অফ ন্যাচার’ বলতে একটা কথা আছে জানেন তো? আমি আপনায় ছেড়ে দিলাম। না কোনো অভিযোগ রাখলাম আর না কোনো প্রতিশোধের ইচ্ছে। আপনার প্রতিশোধের উত্তর দেবে আল্লাহ্। যেই ভালোবাসা নিয়ে আপনি খেলেছেন, একদিন এই ভালোবাসা পাওয়ার জন্যই উন্মাদ হয়ে থাকবেন। সেটা আমার জন্য হোক বা অন্য কোনো মেয়ের জন্য। পস্তাতে আপনাকে হবেই। অবশ্য আপনি ধন্যবাদ পাওয়ারও যোগ্য। আপনার কারণেই আমি মানুষ চিনতে শিখলাম। যেই ভুলটা আমি করেছি আপনাকে ভালোবেসে সেই ভুলটা আর কেউ না করুক। আপনি তৈরি থাকিয়েন আপনার পরিণতি দেখার জন্য!”

চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]