আয়নামতী পর্ব-১৬+১৭

0
389

#আয়নামতী
#পর্ব_১৬
#পুষ্পিতা_প্রিমা

কয়েক মাস পরের কথা,,,,

সকাল পৌঁনে নয়টা। রূপার স্কুলের যাওয়ার তাড়া পড়েছে । আয়না তাকে ড্রেস পড়িয়ে দিয়ে চুল আঁচড়ে দিল। টেবিলের ঢেকে রাখা প্লেট দেখিয়ে বলল
‘ এগুলো খেয়ে নিয়ে ব্যাগ নিয়ে সোজা স্কুলে চলে যাবি। আমার হসপিটালে যেতে হবে।
রূপা চোখ পাকিয়ে তাকালো।
‘ কেন? হসপিটালে কী? ভাবির কি বাবু আসবে?
আয়না এদিকওদিক ছোটাছুটি করতে করতে জবাব দিল।
‘ হ্যা। যদি আল্লাহ চায়।
‘ ভাবিরে কি এখানে নিয়া আসবা? বাবুকে ও? আমি খেলব বাবুর সাথে।
আয়না থেমে গেল। ঝাঁঝাঁলো গলায় বলল
‘ বেশি কথা বলবি না রূপা। খেয়ে নে চুপচাপ।
রূপা মন খারাপ করে খেতে বসলো। এতগুলো দিন আয়নার হাতে খেতে খেতে এখন আর নিজের হাতে খেতে মন চায় না। আয়না বলল
‘ কি হয়েছে? খাহ?
রূপা মাথা নাড়ালো। আয়না বুঝে গেল যা বুঝার। প্লেট হাতে নিল। হাত ধুঁতে ধুঁতে বলল
‘ আশ্চর্য! আমার কত কাজ তুই কি জানিস না? তারপর ও এসব কেমন কথা? তাড়াতাড়ি আয়, আমাকে ছুটতে হবে। আম্মা দেরী হলে বকবে।
রূপা গ্রোগ্রাসে গিললো। পানি খেয়ে ব্যাগ নিয়ে দৌড় দিল বাইরে। আয়না বলল
‘ আরেহ বাকিগুলো কে খাবে? এই রূপা?
রূপা দৌড়ে যেতে যেতে বলল
‘ তুমি খাও। আমার পেটে জায়গা নেই।
আয়না প্লেট রেখে দিল। বাকিটুকু নিজে কোনোমতে খেয়ে বেরিয়ে পড়লো ঘর গোছানোর কাজে। তাকে তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে হসপিটালের উদ্দেশ্য। নামিরার সময় কাছে এসেছে। ব্যাথা উঠায় হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছে নাওয়াজ শেখ। আয়শা বেগম সকাল সকাল চলে গিয়েছেন, আজহার সাহেবকে নিয়ে। খোঁড়াতে থাকা মানুষটা আজ আর বসে থাকতে পারেনি। নিজের বংশধরের আগমন ঘটবে আজ। এত এত ব্যাথা বেদনার ভেতর আজ এই দুটো মানুষের চোখে কিঞ্চিৎ খুশির ঝলক দেখতে পেয়েছে আয়না।
নামিরার ঘরে থেকে তার একটা পুরোনো সুতির শাড়ি আম্মা হসপিটালে নিয়ে যেতে বলেছে। আয়না অনেক খোঁজাখুঁজি করলো। শাড়িটা হাতে পেয়ে বেরোনোর সময় আয়ানের সেই খয়েরী রঙের শার্টটি দেখতে পেল আয়না। হাতে নিল। কিছু সময় পার হতেই আয়না চোখ চেপে ধরলো সেই শার্টে। শার্টটা ভিজলো ভাইয়ের। থাকলে বোধহয় দুষ্টুমি করে বলতো
‘ টুনি শার্টটা পঁচায় ফেললি?
আয়না চোখ মুছলো বারবার। চোখ ভিজলো ও বারবার। ক্ষীণ কন্ঠে আওয়াজ তুলে আয়না বিড়বিড় করলো
‘ তুমি কোথায় হারালে ভাইয়া? আজ কত খুশির দিন জানো না? এমনটা তো না হলেও পারতো।

___________

খ্যাঁচখ্যাঁচ কান্নার শব্দে মুখোরিত হাসপাতালের পরিবেশ। নতুন অতিথির আগমনে রঞ্জিত আপনদের মুখখানা। খুশিতে কারো ঠোঁটে হাসি, কারো চোখে কান্না। নবাগত শিশুটির সেসব দেখার সময় কোথায়? সে তো ব্যস্ত তার আগমন জানানোর ।
আয়শা বেগম কোলে নিয়েছেন মাত্রই। নাওয়াজ শেখ, আর নাজমা বেগম আসলেন। আয়শা বেগমের দিকে তাকাতেই নাওয়াজ শেখ চুপসে গেলেন। আর পা বাড়ালেন না। নাজমা বেগম হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন
‘ আমাকে একটু দিন না আপা। মেয়ে বাবু না ছেলে বাবু?
আয়শা বেগম চোখ তুললেন না। নাজমা বেগম আবার ডাকলেন
‘ আপা?
আয়শা বেগম দাঁড়িয়ে পড়লেন। উচ্চস্বরে কেঁদে দিলেন আচমকা। নাজমা বেগমের কোলে বাচ্চাটাকে দিয়ে পালালেন যেন। নাজমা বেগম চেয়ে রইলেন তার যাওয়ার দিকে। পরক্ষণে বাচ্চাটাকে দেখে নাওয়াজ শেখকে বললেন
‘ ভাই এসেছে আমাদের।
নাওয়াজ শেখ একটুখানি হাত রাখলেন বাচ্চাটার মাথায়। বললেন
‘ তোমার মেয়ের তো বাবা আরেকটা চলে এসেছে, এখন আমাকে একেবারেই ভুলে যাবে।
নাজমা বেগম চোখ নামিয়ে ফেললেন। বাচ্চাটার মুখে আদর করে বললেন
‘ নানুভাই বাবার আদর ছাড়া বড় হবি? পোড়া কপাল নিয়ে এলি?

আয়নার গলার আওয়াজ শোনা গেল। নাজমা বেগম আর নাওয়াজ শেখ ফিরলো। আয়না দৌড়ে আসলো। আবার দু পা পিছু হাঁটলো আয়শা বেগম ডাক দেওয়ায়। তিনি দেশলাই নিয়ে এসে দিলেন আয়নার হাতে। চোখ মুছতে মুছতে ভার গলায় বললেন
‘ আগুন ধর, তারপর ধরবি আমার ভাইরে।
আয়না দেশলাই জ্বালিয়ে আগুন ছুঁলো। তারপর ছলছল চোখে তাকালো বাচ্চাটার দিকে। কান্না শুরু হয়েছে ইতোমধ্যে আয়না কম্পিত কন্ঠে বলল
‘ আমার ভাইয়ার মতো নাহ? আল্লাহ এই তো পুরো আমার ভাই। আমার ভাইয়া ফিরে এসেছে। ওর নাম সায়ান হবে। কেমন আম্মা?
আয়শা বেগম মুখে আবার শাড়ি গুঁজলেন। আয়না ভেজা গাল দু’হাতে মুছলো। তারপর হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল
‘ আমি নেই?
নাজমা বেগম দিল। আয়না দুহাত ওড়নায় মুছে নিল। কান্নার আওয়াজ খানিকটা থামলো।
আয়না বলল
‘ এত কাঁদে কেন পঁচা ছেলে? কত আদর করছে সবাই।
নাজমা বেগম বলল
‘ ফুপীর গায়ে বোধহয় বাবার গন্ধ পাচ্ছে। এক রক্ত তো। তাই শান্ত হয়ে গিয়েছে।
আয়না চোখ তুলে তাকালো। চক্ষুপটে যেন ভাসলো ভাইয়ের হাসিমাখা চেহারাটা। আর খুশিতে খলবলিয়ে যেন বলে উঠলো
‘ টুনি দেখ আমি বাবা হয়ে গেছি। তোর কি এখন আমাকে বাবা বাবা লাগছে না?
আয়না আঁখিজলে হাসলো। পবিত্র ফুলের মতো বাচ্চাটার কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে বলল
‘ চলো তো, তোমার আম্মাটাকে দেখে আসি। তুমি দেখবেনা? তুমি না দেখো, কিন্তু তোমার মায়ের তো তোমাকে দেখতে হবে। কত্ত আদুরে বাচ্চা। আমার আরেকটা আব্বা। আব্বা ডাকি তোমায়?
বকবক করতে করতে আয়না গেল কেবিনের কাছে। নার্সকে বলল
‘ সব ঠিকঠাক আছে তো? আমি কি আমার ভাবির সাথে দেখা করতে পারব?
নার্স বলল
‘ জ্বি। তবে এখন একটু রেস্টে রাখবেন।
আয়না মাথা নাড়ালো। নামিরার দিকে তাকালো। হেঁটে গিয়ে বসলো নামিরার পাশে। ছোট্ট বাচ্চার কান্নার আওয়াজ পেয়ে চোখ মেললো নামিরা । কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে রইলো আয়নার কোলের দিকে। আয়না হাসিহাসি মুখে বলল
‘ ভাবি দেখো, তোমার বাচ্চাকে। দেখো একটা আব্বা এসেছে। দেখো পুরো ভাইয়ের মতো হয়েছে। নাক চোখ সব আমার ভাইয়ের।
নামিরা উৎফুল্ল চোখে তাকালো। আয়না তার পাশে শুয়ে দিল বাচ্চাটাকে। বলল
‘ এই দেখো, আব্বাকে ।
নামিরা একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো। আয়না তাড়াতাড়ি দুচোখ লুকোতে সরে পড়লো। কানে আসলো
‘ তুমি মিথ্যেবাদী আয়না। তুমি যে বলেছিলে আয়ান মরেনি, ও ফিরবে আমার কাছে। কোথায় ফিরেছে? কেন আমাকে মিথ্যে আশ্বাস দিয়েছ? আমার সাথে কেন এমন ছলনা করছো? আমার বাচ্চা কাকে বাবা বলে ডাকবে?
আয়না লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেল। মুখ চেপে কাঁদতেই মুখোমুখি হলো আয়শা বেগমের। আয়না ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো মাকে। বলল
‘ আম্মারে আমি আর পারছিনা আম্মা। আমার কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। আমার অসহায় লাগছে। আমার ভাইটা কোথায় আম্মা ? আল্লাহ এত কষ্ট কেন দেয়?
আয়শা বেগম কাঁদা শুরু করলেন আবার। কেঁদে কেঁদে আওড়ালেন
‘ বাবুরে আয়। ফিরে আয় আমার কোলে। তোর আম্মার কোলটা খাঁ খাঁ করে রে আব্বা। বড্ড মন পুড়ে তোর জন্য। তোর আম্মা ডাকটা কতদিন শুনিনা। কতদিন তোকে নিজ হাতে খাওয়ায় না। আমাদের এভাবে নিঃস্ব করে কোথায় হারিয়ে গেলি আব্বা?
আজহার সাহেব বসে রইলেন কাঠের বেঞ্চে। আয়নাকে ডাক দিয়ে বললেন
‘ আমার দাদুভাইরে আমারে দেখাবি না?
আয়না এসে বসলো বাবার পাশে। বললো, দেখাবো আব্বা, একটু সবুর করো।
আয়শা বেগম বলল
‘ আমি বউরে নিয়া যাব আমার কাছে।
নাজমা বেগম তা শুনে বললেন
‘ ওর ভরনপোষণ কিভাবে চালাবেন?
আয়না বলল
‘ আমি চালাবো। ভাবি এবার থেকে আমাদের সাথে থাকবে।

নামিরা হাত বাড়িয়ে ছুঁলো বাচ্চাটাকে। মাথায় হাত বুলালো ঘনঘন। একটু আগ বাড়িয়ে এসে চুমু খেল কপালে। বাচ্চাটার দিকে তাকাতেই একটু চুপসে যাওয়া ব্যাথাগুলো আবার বাড়ছে। একটু শুকিয়ে আসা ক্ষতগুলো ব্যাথা আবার জাগ্রত হচ্ছে। ঝাপসা ঝাপসা চোখে ভাসছে সেই পুরোনো দিনের কথা। যখন আয়ানকে বাচ্চার কথা বললেই ঠোঁটে ফুটতো একরত্তি হাসি। যেই হাসিতে মাখানো ছিল বাবা হওয়ার তৃপ্তি, দুচোখ ভর্তি একটু আবেগী স্বপ্নের মেলা।
আজকের দিনে হয়ত তার পাগলামির সীমা থাকতো না। এই মুহূর্তে এই জায়গায় থাকলে ঠোঁটের সেই চিরাচরিত নীরব হাসিটা উপহার দিত, হৃদয় গলানো, মন ভুলানো মিষ্টি সোহাগে একটুখানি ভাসাতো। পরক্ষনে মিরাকে রাগিয়ে দেওয়ার জন্য বলতো
‘ মিরা দেখো আমার বাচ্চা আমার মতো হয়েছে। তোমার মতো হয়নি। তারমানে এটা শুধু আমার বাচ্চা।
নামিরা খুব রেগে যেত আর সেই রাগ ভাঙার জন্য একটু হিমশীতল স্পর্শই যথেষ্ট।

_____________

নামিরাকে নিজের কাছে নিয়ে আসলেন আয়শা বেগম। সারাদিন থাকেন নাতিকে নিয়ে। রান্নাবান্না সবই আয়না আর রূপা মিলেই করে। ঘরের এককোণে নির্জীব প্রাণীর মতো শান্ত হয়ে বসে পড়ে থাকে নামিরা। জীবনের সংজ্ঞায় যেখানে মানিয়ে নেওয়া, মেনে নেওয়া সেখানে নামিরার কেন এই সংজ্ঞাকে ভুল প্রমাণ করতে ইচ্ছা করে সে জানেনা। সে মেনে নিতে পারবে না,পারছেনা, পারার নয় ও।

অন্যবারের তুলনায় এবার বেশি ফুল এসেছে বাগানে। ফুলতোলা আর ফুলের বাগান পরিচর্যা করার জন্য মানুষ রেখেছিল আয়না। তারা দেখাশোনা করে। মূল তদারকি করে রহমত মিয়া। চারজনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে এই বাগানকে ঘিরে। আয়না ভাবলো যদি আর ও বড় করে বাগানের পরিকল্পনা করা যায় সেক্ষেত্রে আর ও অনেক লোকের কর্মসংস্থান হবে আর একটি দোকান দিয়ে দিলে সেদিকে ও কর্মসংস্থান বাড়বে।
ফুল বেশি আসার কারণ হিসেবে আয়শা বেগম বললেন
‘ আমার দাদুভাই আইছে তাই বেশি বেশি ফুল আসছে। আমার দাদুভাই ভাগ্যবান।

আয়না বলল
‘ আমি ওর জন্য একটা দোলনা আনব আম্মা কেমন?
আয়শা বেগম বলল
‘ দরকার নেই। ওর নানা দিছে না? আর দরকার নেই।
আয়না বলল
‘ আচ্ছা। ওর জন্য বচ্ছু কিনে আনব।
আয়শা বেগম বলল
‘ নাহ। ও মায়ের দুধ ছাড়া এখন অন্য কিছু খাইতে পারব না।
আয়না চলে গেল রাগ করে।
আয়শা বেগম বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বললেন
‘ ভাই তোর বাপটা পাষাণ। খুব পাষাণ। কখনো বাপের মতো হবি না। মায়ের মনে আঘাত দিবি না। কোথাও হারাবি না।
রূপা এসে পাশে বসল। বলল
‘ জেম্মা তোমার নাতিকে আমার পছন্দ হইছে।
আয়শা বেগম গাট্টি মারলো তার মাথায়। বলল
‘ সর। তুই বুড়িরে ক্যান আমার নাতবউ বানামু। পাইকা গেছিস তুই।
রূপা খিলখিল সুরে হাসলো। বলল
‘ আমার বয়স তো এখনো সাত চলে। বুড়ি কখন হইলাম?
আয়শা বেগম কপাল কুঁচকে রাখেন। বলেন
‘ তুই এত লাল বর্তার মতো সুন্দর কেমনে হইছোস? তোর মা কি সুন্দর আছিলো?
রূপা বলল
‘ হ আম্মা বেশি সুন্দর ছিল। আমার তো মনে নাই ওসব। নানা বলছে। আমি আম্মার মতো হইছি।
আয়শা বেগম বলল’ আর তোরে ছাইড়া চইলা গেল। কপালপুড়ি।
রূপা মন খারাপ করে ফেলল। আয়না এসে টেনে নিয়ে গেল তাকে। এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে নিয়ে যেতে যেতে বলল
‘ আমি তোর অভিভাবক। শোন একটা কাজ কর, একটা লিখা পাঠাতে হবে চৌধুরী বাড়ি। পারবি?
রূপা বলল
‘ ছোটসাহেবের কাছে?
আয়না বলল
‘ হুম। খুব জরুরি।
রূপা বলল
‘ ছোটসাহেব তো গ্রামে নেই দেড় মাসের মতো। জানো না?
আয়না বলল
‘ সে কি? আসবে না? আমার তো খুব প্রয়োজন। একটা কথা জানার ছিল।
রূপা বলল
‘ জানিনা আসবে কিনা। ওনি তো অনেক বড় মানুষ। শহরে শহরে সময় কাটায়।
আয়না বলল
‘ এখন আমি কি করব? কেন শহরের অলিতে-গলিতে খুঁজব আমার ভাইটাকে? কবে আমাদের সেই হাসিখুশি দিনগুলো ফিরে আসবে। প্রফেসর কথা দিয়েছিল আমায়, ওনি যেকোনো প্রকার সাহায্য করবেন আমায়। কিন্তু এখন পলাতক। অবশ্য উনি কতবড় রাজনীতিবিদ হতে চলেছেন। এখন ওসব মনে রাখার সময় কোথায়? সে যাইহোক, আমি লেগে পড়বো আমার কাজে। কাউকে লাগবে না আমার।

সপ্তাহ একটা না যেতেই অনুরাগের লিখা পেল আয়না। তাতে লিখা, আয়নামতী” দেরী হওয়ায় দুঃখিত আমি। প্রচুর কাজের চাপে থাকায় ব্যস্ত ছিলাম। গ্রামে ফিরেছি দুদিন হয়েছে, আবার ফিরে যেতে হবে। কিন্তু তার আগেই ভাবলাম তোমাকে আসল সত্যিটা জানিয়ে যাই।
তোমার ভাইয়ের এই দশার সবকিছুর মূলে ছিল তোমার ভাবির ছোট চাচা। ওনার লোককে ভাঙচুর করতে দেখা গেছে ছাপাখানা। আর তোমার ভাইকে ওনিই মেরে কোথাও গুম করে রেখেছে। প্রমাণ নেই আমার কাছে, তবে আমার তথ্য ভুল না। প্রমাণ শীঘ্রই যোগাড় হবে, আর আমি তোমার হাতে ঠিকই প্রমাণ তুলে দেব।

আয়না শক্ত হয়ে গেল। চোয়াল শক্ত হলো মুহূর্তেই। হাতের মুঠো শক্ত হলো। ঘৃণায় গা গুলিয়ে আসলো। কত বড় অমানুষ ভাবির চাচা। সে ছাড়বে না ওই মানুষটাকে। যে তাদের প্রত্যেকের সুখ কেড়ে নিয়েছে। তার ভাইপোকে এতিম করেছে। তার ভাবিকে বিধবা করেছে। তার মা বাবাকে সন্তানহারা করেছ। ছাড়বে না সে। কখনোই ছাড়বে না।

__________

আর ও মাস দুয়েক পার হলো তখন। আয়নার দ্বাদশ শ্রেণীর ফাইনাল পরীক্ষা সামনে। বাগান বাড়ি আর নতুন দোকান খোলা নিয়ে তীব্র উত্তেজনা কাজ করছে। সেই সাথে আর ও কতকাজ। নিজেকে লুকিয়ে রাখতে হচ্ছে ভীষণ। সবার মুখে হাসি ফোটানোর জন্য কত না লড়াই। মলিন মুখে সাদাটে শাড়ি পড়া ভাবিকে দেখলে বুক মোচড়ে উঠে। চোখ জলে ভাসে।
দেখতে দেখতে পরীক্ষার সময় চলে আসলো। কোনোমতে দিনরাত এক করে পড়ে পরীক্ষা দিল আয়না। সামনে তার আরও বড় পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই দোকানের কাজে লেগে পড়লো সে। দোকান দেওয়ার জন্য ঋণ নিল মাসিক কিস্তিতে। সরকারি চাকরি করে এমন একজনের স্বাক্ষরের যখন খুব দরকার পড়লো অনুরাগ এসে তখন সেই বিপদ থেকে রক্ষা করলো তাকে । আমরা আসলেই যাদের হেলাফেলা করে ফেলে রাখি দিনশেষে কোনো না কোনো কাজে তাদের আমাদের লাগে। এই বন্ধনহীন, অপরিচিত মানুষটা কিছুদিনের মধ্যেই এক অন্যরকমভাবে নিজের ভেতরের সত্ত্বাটাকে উপস্থাপন করেছে আয়নার সামনে। কত ঋণ আয়নার। এত ঋণ সে শোধ করবে কবে?
দোকান দেওয়া শেষ হলো। বাগানের যেই খালি পাশটা ছিল সবখানে চারা লাগানো হলো। বিকেলবেলায় অনেক মানুষ ও ঘুরতে আসে এই বাগানবাড়ি। কাটাতারের বেড়া লাগিয়ে দিল রহমত মিয়া চারপাশে। যাতে ঘুরতে আসা কেউ ফুল ছিঁড়তে না পারে। সরু সরু পথ করে রেখেছে বাগানের ভেতর যাতে লোকজন ঘুরতে পারে। ডুবে যেতে ফুলের বাগানের মনোমুগ্ধকর পরিবেশে।

অনুরাগ একদিন একটি বড় সাইজের সাইনবোর্ড এনে লাগিয়ে দিল বড় একটি গাছের মগডালে। সেখানে লিখা আয়নামতীর বাগানবিলাস।
আয়না আচমকা সেসব দেখে বলল
‘ এসব কি শুরু করেছেন প্রফেসর। মানুষ এখন আমাকে দেখলেই আয়নামতী ডাকবে।
অনুরাগ বলল
‘ আয়নামতী নামে চিনবে। ডাকবে না। আমি সেই অধিকার কাউকে দেব না।
আয়না মুখ বেঁকিয়ে বলল
‘ আপনার বউ জানে বিয়ে ভেঙে দেওয়া সেই কনের সাথে আপনার আজকাল ভীষণ ভাবসাব?
অনুরাগ রেগে গেল মুহূর্ত।
‘ জানলে কি হবে? সবসময় সবকিছুকে নেগেটিভ ভাবাটা তোমাদের মেয়েদের স্বভাব। ভাগ্যিস মনে করে দিয়েছ, আসলে কি জানো, তোমরা মেয়েরা ভীষণ খারাপ। এতটাই খারাপ যে বলার কিছু বাকি রাখে না। আমি ও শালা আছি পাগল ছাগলের মতো, যে যা বলে তার জন্য লাপায়। আর পেছন পেছন ঘুরঘুর ঘুরঘুর। জীবনে ও আর তোমার সামনে আসব না। মনে রেখো। যত্তসব।
বলেই হনহনিয়ে চলে গেল। গেল যে গেল আর দেখা সাক্ষাৎ পাওয়া গেল না তার।
আয়না ভেবে পেল না সে দোষের কি বললো? সমাজের মানুষ আজকাল তার দিকে অন্য চোখে তাকায়। অনুরাগের কারণে কিছু বলে উঠার সাহস পায় না। আয়না কি তা বুঝে না? কি দরকার ওসবের? তার জীবনটা ফুলের মতো নয়, কাঁটাযুক্ত। এই কাঁটায় ভরা জীবনটাতে যে আসবে সে কাঁটায় বিঁধে গিয়ে শুধু যন্ত্রণা ভুগবে। তাছাড়া বাস্তবিক অর্থে ভালোলাগা কিংবা ভালোবাসা শব্দগুলোতে সে বিশ্বাসী নয়। প্রাণ উজাড় করে ভালোবেসে ও যদি ভালোবাসার মানুষকে ধরে রাখা না যায় তাহলে ভালোবেসে লাভ কি? কষ্ট ছাড়া কিছুই নেই ওই শব্দটাতে। জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ তার ভাবি। মানুষটা শুরু থেকেই কষ্ট পেয়ে গেল। কি পেল ভাইকে ভালোবেসে? শুধু দিয়েই গেল। পাওয়ার বেলায় সব শূন্য পড়ে রইলো খাতা । আয়না অত উদার কখনো হতে পারবে না। সে ততটুকুই দেবে যতটুকু সে পাবে। নিজ স্বত্বা বিসর্জন দিয়ে ভালোবাসতে গেলেই ক্ষতি।

_______

বাচ্চা অসুস্থ হওয়ায় শহরে হসপিটালে চলে আসলো নামিরা আর আয়না। আয়শা বেগম থেকে গেছেন। এসেছেন নাওয়াজ শেখ। চিকিৎসার দুদিন হতেই চলে আসার সময়
নামিরাকে করিডোরে বসিয়ে আয়না চলে গেল ফার্মেসিতে। নাওয়াজ শেখ বিল পে করার জন্য। নামিরা এদিকওদিক তাকালো। হঠাৎ ভীষণ কষ্ট হলো বুকে। চোখ জ্বালাপোড়া করলো ভীষণ। বসে থাকতে পারলো না সে। ছেলে চেঁচিয়ে কাঁদছে। নামিরা উঠে দাঁড়ালো৷ বাচ্চাকে কোলে নিয়ে এদিক ওদিক পায়চারি করতে লাগলো । করিডোরে বসে থাকা একটা লোক নম্র গলায় বিরক্ত ভঙ্গিতে বললো
‘ বাচ্চাটাকে এদিকে দিন। কেন কাঁদছে?
নামিরা থমকে গেল। কথা আটকে গেল। বাচ্চাকে দিয়ে দিল সে। কান্না থেমে গেল বাচ্চার । লোকটা বাচ্চাটাকে দুলাতে দুলাতে বলল
‘ কান্না থেমে গেছে।
নামিরা আঁখিজলে হাসলো। বহুকষ্টে কান্না চেপে কম্পিত গলায় বলল
‘ এই প্রথম বাবার কোল পেয়েছে তো তাই।
লোকটা চোখ তুলে তাকালো নামিরার দিকে। পকেট থেকে টিস্যু বের করে দিয়ে বলল
‘ চোখ মুছুন। চোখে কি সমস্যা আছে আপনার? আমার ও আছে। দেখুন চশমা ইউজ করতে হচ্ছে।
নামিরা কান্না চোখে হাসলো।
‘ হয়ত আছে। জানিনা ঠিক। আমার মাথা ঠিক নেই।

চলবে,,,,,

#আয়নামতী
#পর্ব_১৭
#পুষ্পিতা_প্রিমা

বাচ্চা কোলে নিয়ে হসপিটাল থেকে বের হয়ে আসলো নামিরা। সায়ান কাঁদছে। নামিরার সেদিকে হেলদোল নেই। সে কালো রঙের গাড়িটার পিছু ছুটতে ব্যস্ত। গাড়িটার নাম্বার ঝাপসা দেখাচ্ছে। স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে না।

আয়না ফার্মেসী থেকে এসে নামিরাকে কোথাও দেখতে পেল না। পাগলের মত হন্য হয়ে দৌড়াল পুরো করিডোর। তারপর নাওয়াজ শেখ যখন আসলেন তখন উনাকে নিয়ে বের হলেন হসপিটাল থেকে। তখনি নামিরাকে চোখে পড়লো। আশপাশ না তাকিয়ে হাঁটছে নামিরা। সায়ান ভীষণ রকম কাঁদছে। আয়না ছুটে গেল। নামিরার কোল থেকে সায়ানকে কেড়ে নিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল
‘ ভাবি কি করছ তুমি? সব ধুলোবালি বাতাস ওর নাকে গিয়ে লাগছে আবার। ছেলেটাকে কি তুমি বাঁচতে দেবে না? ভাবি?
নামিরার কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। সে ওই চলে যাওয়া গাড়িটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল
‘ আয়ান? ওই তো আয়ান, চলে যাচ্ছে কেন?
আয়না গর্জে বলল
‘ মাথা খারাপ হয়েছে তোমার? ভাবি চলো।
নামিরা হাত ছাড়িয়ে নিল। নাওয়াজ শেখকে দেখে দৌড়ে গেল। হাত ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল
‘ বাবা আয়ান। বাবা ও বাবুকে কোলে নিয়েছে। আমি সত্যি বলছি।
নাওয়াজ শেখ কিছু বলেন না। শুধু তাকিয়ে থাকেন। দিনদিন মেয়েটার পাগলামো বাড়ছে বৈকি কমছে না।
আয়না বলল
‘ আঙ্কেল বাবুর ক্ষতি হবে। গাড়ি ডাকুন তাড়াতাড়ি।
নামিরা এলোমেলো কেঁদে বলল
‘ আয়না আমি যাব না তো। তোমরা চলে যাও। আমি যাব না। বাবুকে তুমি দেখে রেখো। আমি আয়ানের কাছে যাই।
আয়না চোখের পলক চেপে রাখলো। বিরক্তি নিয়ে খুলে বলল
‘ যা ইচ্ছা করো, কিন্তু আপাতত বাড়ি ফিরতে দাও। তোমার সন্তানের শরীর খারাপ। আর তুমি এখনো পাগলামি করছো? কেন সত্যিটা মেনে নিচ্ছ না?
নামিরা চুপসে গেল। ভেজাগলায় বলল
‘ তুমিই তো আমাকে বলেছিলে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। বলোনি? তাহলে এখন এমন বলো কেন? আয়ান থাকলে এভাবে কথা বলতে পারতে? ও নেই তাই এভাবে বলছো। ও ছাড়া কেউ আমায় বুঝে না। আমাকে ভীষণ রকম বুঝার মানুষটাকেই কেন হারিয়ে যেতে হলো? আমি কখনো কারো সাথে কোনো অন্যায় করিনি।
নাওয়াজ শেখ মেয়েকে বুকে টেনে নেন। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেন
‘ এভাবে কাঁদলে লোকে কি ভাববে? দেখ আশেপাশের মানুষ কিভাবে তাকিয়ে আছে। ধৈর্য ধর মা। তোর সন্তানের কথা ভাব। ও তোর একটা পৃথিবী।
নামিরা বাচ্চার দিকে তাকায়। আয়নার বুকে গুঁজে রয়েছে সায়ান। লাল জিহ্বাটা বের করছে, আবার ভেতর নিয়ে নিচ্ছে। বড় বড় চোখদুটো দিয়ে পিটপিট করে তাকিয়ে দেখছে নামিরাকে। নামিরা কোলে নিয়ে নিল বাচ্চাকে। শান্ত চুপচাপ হয়ে হাঁটতে হাঁটতে ঠোঁট ছুঁয়ালো ছেলের কপালে। এখানেই আয়ান ছুঁয়েছিল। এখনো স্পর্শ লেগে আছে। সেই চিরপরিচিত স্পর্শ। সেই ঘ্রাণ।

__________

আয়শা বেগম নাতি আর ছেলের বউকে ফিরতে দেখে খুশি হয়ে গেলেন। নাতিকে ঝাপটি মেরে নিয়ে নিলেন আয়নার কোল থেকে। সারামুখে অজস্র আদর দিতে দিতে বললেন
‘ ভাই তুই ছাড়া ঘরবাড়ি আন্ধার। কেন এত অসুখে পড়িস? আল্লাহ ভালা রাইখো আমার ভাইরে।
সায়ান দন্তহীন গাল এলিয়ে হাসে। ছোট্ট হাতের তালু লাগায় আয়শা বেগমের মুখে। খুশিতে আনন্দে চোখে জল আসে তার। মনে হয় একদম তার ছেলে হাসছে।
নামিরাকে মলিন চেহারায় দেখে আয়শা বেগম বিভ্রান্ত হলেন। বললেন
‘ কি হইছে বউ? মন খারাপ করে রাখছো ক্যান? তোমার বাবু ভালা হয়ে যাইবো। আল্লাহ আমার ভাইরে ভালা কইরা দিবো। মন খারাপ কইরোনা। আসো, কিছু খাও আগে।
নামিরা ছলছল চোখে আয়শা বেগমের দিকে তাকালো। আয়না চলে যাওয়ায় ফিসফিসিয়ে বলল
‘ আম্মা আমি আয়ানের কাছে যাব। আমাকে যেতে দিবে?
আয়শা বেগম হতাশ গলায় বললেন
‘ বউ, তোমারে কইছি না তোমার বাবুর দিকে মনোযোগ দিতে। তার কথা বারবার কেন মনে করো? সে তো তোমার চিন্তা করে নাই। উলটপালট চিন্তা কইরোনা বউ।
নামিরা কেঁদে দিল এবার। বলল
‘ আমাকে একটু বিশ্বাস করো আম্মা। আমি আয়ানকে দেখেছি। ও বাবুকে কোলে নিয়েছে। আদর করেছে। তুমি জানো বাবু একদম শান্ত হয়ে গিয়েছে। আমি যাই আম্মা? আয়না তো ধমকায়। তুমি যেতে দাও আম্মা।
আয়শা বেগম নাতিকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে রাখেন। আয়না আসতেই নামিরা চুপসে যাওয়া চোখে তাকালো। আয়না বলল
‘ কোথায় যাবে তুমি? কার কাছে যাবে? আমি নিয়ে যাব তোমায়? কোথায় যাবে?
নামিরা বলল
‘ সত্যি?
আয়না মাথা নাড়ালো।
নামিরা ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো তাকে। আওয়াজ করে কাঁদলো। আয়না চোখ চেপে ধরলো তার কাঁধে। বলল
‘ পাগলামির একটা সীমা থাকে ভাবি। তোমার মনে হচ্ছেনা তুমি অতিরিক্ত করছ?
নামিরা ছাড়লো না তাকে। শক্ত করে ধরে রেখে অনুরোধ করে বলল
‘ আমাকে একটু বুঝো। একটুখানি।
আয়শা বেগম চোখ মুছতে মুছতে নাতিকে নিয়ে চলে গেলেন৷

____________

থানায় নাওয়াজ শেখের নাম বলতেই পুলিশ নামিরার দেওয়া নাম্বারটা নিল। কার গাড়ি, এবং সেই মালিকের বাড়ির ঠিকানা যোগাড় করে এনে দেবে বললো। নামিরা ততক্ষণ থানায় বসেছিল। আয়না চুপচাপ পাশে বসে আছে। নামিরা কি করছে সে বুঝতে পারছেনা। পুলিশ প্রায় আধঘন্টা পর সমস্ত ডকুমেন্ট নিয়ে হাজির হলো। গাড়ির মালিকের ঠিকানা দিল নামিরাকে। আয়না দেখে বলল
‘ এখন শহরে কিভাবে যাবে ভাবি? বাবুর গাড়ির বাতাস লাগলে ক্ষতি হবে। আর চেনা নেই, জানা নেই কার না কার বাড়ি। জানিনা কি করছ তুমি।
নামিরা হাত ধরলো আয়নার। বলল
‘ তুমি চিন্তা করো না। আমি যেতে পারব। আব্বা তো আছে।
আয়না বলল
‘ আমি তোমাকে একা ছাড়তে পারব না।
নামিরার মুখ অন্ধকার হয়ে এল।
নাহ, আয়নাকে যেতে দেওয়া যাবে না। সে একা যাবে। আয়না তাকে কোনোকিছু করতে দেবে না। তাছাড়া তার মনের ভুল ও হতে পারে।
আয়না বলল
‘ ঠিকানা দাও আমি গিয়ে দেখে আসি ওই বাড়িতে কে কে থাকে।
নামিরা দিল না কাগজটা। বলল
‘ থাক লাগবে না। যাব না আমি। আমার কোথাও ভুল হচ্ছে বোধহয়।
আয়না স্বস্তি পেল। যাক ভাবির পাগলামি অন্তত কমেছে।

কিন্তু আয়নাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে নামিরা তারপরের দিন ঘুমন্ত ছেলেকে নিয়ে আয়নার পাশ থেকে উঠে ভোররাতে বের হয়ে গেল ছেলেকে নিয়ে। নাওয়াজ শেখ মেয়ের আবদার ফেলতে পারেননি। তাই গাড়ি এনে রেখেছেন আয়নাদের বাড়ির কিছুটা দূরে। নামিরা আয়শা বেগমের কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে বেরিয়ে গেল। আয়শা বেগম তখন ও ঘুম। আয়না ও কিছু জানেনা। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে যখন নাতিকে দেখতে গেলেন আয়শা বেগম তখন দেখলেন পুরো ঘর খালি। নেই নাতি, নেই ছেলের বউ। হায়হায় করে কেঁদে উঠলেন তিনি। আয়না চমকে গেল। অজানা আশঙ্কায় বুক ভার হয়ে এল। রাগ হলো নামিরার উপর। বাবুর শরীরটা খারাপ। ঠান্ডা সইতে পারছেনা ছেলেটা। গাড়ির বাতাস লাগলেই ক্ষতি। ভাবি কি যে করছে।
আয়না সান্ত্বনা দিল মাকে। বলল
‘ ভাবিকে আমি নিয়ে আসব।
কিন্তু ওই বাড়িতে পুলিশের সাহায্যে খবর নিয়ে জানা গেল নামিরা নামের কেউ যায়নি ওই বাড়িতে। আয়না চিন্তায় ফেটে পড়লো। আম্মা অসুস্থ হয়ে পড়বে এসব শুনলে। তাকে কে এই বিপদে সাহায্য করতে পারে?

নামিরা বলায় নাওয়াজ শেখ কাউকে কিছু বললেন না। নামিরা সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি শহরে তার বড় খালামণির বাসায় ছিল। তারপর বের হলো ওই বাড়ির উদ্দেশ্যে তার ছোট খালাতো ভাইকে নিয়ে। তখন ঝড়ের প্রকোপ বেড়েছে। শাঁ শাঁ বাতাসে ভারী পরিবেশ। গম্ভীর, থমথমে চারপাশটা। নামিরা তার খালাতো ভাইকে চলে যেতে বলল। তাহিম যেতে চাইলো না। বলল
‘ আপু ওই বাড়ির গেইটে গাড়ি ঢুকলে সমস্যা হবে না। নইলে বাবুর গায়ে বৃষ্টি পড়তে পারে।
নামিরা ঢেকে নিল সায়ানকে ভারী পাতলা নকশা করা কাঁথা দিয়ে। বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল
‘ গাড়ি গেইটের কাছে থামুক। আমি নেমে যাই। তুই গাড়ি নিয়ে চলে যাহ।
তাহিম যেতে চাইলো না। পরক্ষণে যেতেই হলো। নামিরা গাড়ি থেকে নেমে গেল বৃষ্টি মাথায়। দাঁড়োয়ান বলল
‘ কোথায় যাবেন?
নামিরা বলল
‘ আমি এই বাড়িতে যাব। আমাকে তাড়াতাড়ি যেতে দিন। আমার বাচ্চার গায়ে বৃষ্টির ফোটা পড়ছে।
দারোয়ান যেতে দিল। ছাতা বাড়িয়ে দিল। বলল
‘ দিনের বেলা আসতে পারেন নাই? এমন সন্ধ্যায় কেউ বাচ্চা নিয়ে বের হয়?
নামিরা কিছু বললো না। দুরুদুরু বুক নিয়ে, একবুক আশা নিয়ে পা দিল শেখওয়াত বাড়ির বারান্দায়। দারোয়ান দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেল। গেল যে গেল, আর আসার নাম নেই। নামিরা দাঁড়িয়ে রইলো দরজার কাছে। ভেতরে উঁকি দিল না। সায়ানের কান্না শুরু হয়েছে। ছেলেটা একদম বাবার মতো পাজি হয়েছে। অন্ধকার পছন্দ করে না। তাছাড়া বৃষ্টির ফোটা ও পড়েছে। নামিরা মুছতে লাগলো। নিজের মুখ থেকে সরাতে লাগলো বৃষ্টির পানি।
ছেলেকে দুলাতে দুলাতে বললা
‘ এই তো এখনি আলো আসবে। এখুনি আসবে আব্বা। সারাক্ষণ কান্না।
বলতে না বলতেই কেউ দরজা খুলে দিল। নামিরা সায়ানের মুখ থেকে চোখ তুলে তাকালো। আলো আধারিতে দেখলো সৌষ্ঠব একটি পুরুষ অবয়ব। মুখ ভেজা থাকায় চোখের পানি টের করা গেল না নামিরার। সায়ান আর ও জোরে কাঁদছে। লোকটি দরজার হাতল ছেড়ে দিল। নামিরার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ডাকলো
‘ মিরাহ!!!!
টপটপ করে নামিরার কপোল বেয়ে জল গড়ালো। থুতনি বেয়ে চোখের জল পড়ে ভিজে গেল সায়ানের মুখ। ঠান্ডা পানি মুখে পড়ায় হাত পা নেড়ে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলো সায়ান। নামিরা আরও একবার নিজের নামটা শোনার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লো। অতিআগ্রহে চেয়ে রইলো তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির দিকে।

চলবে,,