আয়নামতী পর্ব-১৪+১৫

0
392

#আয়নামতী
#পর্ব_১৪
#পুষ্পিতা_প্রিমা

অনিমা ইন্ডিয়া থেকে ফিরলো সপ্তাহ খানেক হয়েছে। অনুরাগ না থাকায় তার ভালো লাগছেনা। অনেক জোরাজোরি করে অনুরাগকে আসার জন্য রাজী করালো সে। অনুরাগ এল। তবে ওই ঘরটাতে আর গেল না।
কুহেলীর ব্যাপারে সব ইতোমধ্যে জানাজানি হয়ে গেছে। কুহেলীর পরিবারের সবাই জেনে থম মেরে আছে। শায়খ চৌধুরীর সামনে আসার সাহস করেনি। এত চরিত্র খারাপ মেয়েকে রঙ চঙ মাখিয়ে বিয়ে দেওয়ার কি খুব দরকার ছিল? শায়খ চৌধুরী তো ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে থাকলেন। সুযোগ পেলে ওদের এমন শিক্ষা দেবে!
সমাজে এখন তার অবস্থান ধরে রাখাটা খুব কষ্টকর হয়ে গেছে । নাওয়াজ শেখ সুযোগ বুঝে পদ নিয়ে নেবে। ব্যাটা ভদ্রলোকের পক্ষে অনেকেই। কিন্তু শায়খ চৌধুরী পণ করলেন নিজের কাছে তিনি নাওয়াজ শেখকে কখনো চেয়ারম্যান পদ নিতে দেবেন না। কিছুতেই না। যা করতে হয় তার জন্য তিনি সব করবেন। তবু ও তিনি পদ ছাড়বেন না। কিন্তু চট্টগ্রামের এমপি সাহেবের সাথে নাওয়াজ সাহেবের বেশ ভালো সম্পর্ক। কি যেন আত্মীয় লাগে? বেশ চিন্তায় আছেন শায়খ চৌধুরী।

_______________

সকাল সকাল রহমত মিয়ার হাঁকডাক শোনা গেল। আয়না মাথায় কাপড় দিয়ে বের হয়ে এল ঘর থেকে। পেছন পেছন আয়শা বেগম ও বের হয়ে এলেন। রহমত মিয়া এসে দশ হাজার টাকা দিল আয়নাকে। বলল
‘ এগুলা বড় সাহেব পাঠাইছে আপা। জরিমানা বাগান পুড়ার।
আয়না বলল
‘ উনি কেমনে পাঠালেন? এগুলো নিশ্চয়ই উনার ছেলের কাজ। আমি এগুলো নেব না। নিয়ে যান।
রহমত মিয়া আয়শা বেগমকে বলল
‘ কিসব বলে দেখেন খালাম্মা? নিয়া গেলে তো আপনি ঠকে গেলেন। দেখেন ফুল বিক্রি হলে আপনার তো বিশ ত্রিশ হাজার লাভ হইতো। এখন দশ হাজার দিছে তো আরও কম দিছে।
আয়শা বেগমের দিকে তাকালো আয়না। আয়শা বেগম কিছু না বলে চলে গেলেন। আয়না টাকাগুলো নিয়ে নিল। যে ধারগুলো হয়েছে ওগুলো শোধ করে দিতে পারবে এই টাকাগুলো দিয়ে।
রহমত মিয়া এদিকওদিক তাকিয়ে একটা কাগজ বের করলো পকেট থেকে। আয়নার দিকে সযত্নে বাড়িয়ে দিয়ে বলল
‘ আপা ছোডসাহেব লিখাটা মন দিয়া পড়তে কইছে। পড়বা। অনেক ভালা কথা লিখা আছে।
আয়না নিল। সাথে সাথেই খুললো। তারপর কাগজের লিখাটুকু পড়ে বলল
‘ রেণু কোথায়? আজকে তো এখানে আসার কথা ছিল। ওদের বাড়িটা কোথায় দিয়েছে?
রহমত মিয়া বলল
‘ চৌধুরী বাড়িদের পেছনের বাগানবাড়িটা ফজলু মিয়ারে দিছে। বড়সাহেব কিন্তু জায়গা দিছে, বাড়ি ও দিছে।
আয়না মাথা নাড়ালো। শুধু তারই ক্ষতি করলো। আয়না কাগজে আবার চোখ বুলালো। সেখানে লিখা
‘ আয়নমতী তোমার বাগান পুড়ে গেছে শুনে খারাপ লাগলো। কিন্তু এখন তো আর কিছু করার নেই। এই যে দশ হাজার টাকা দিল সেগুলো বাবা দিয়েছে। আর কত টাকা তোমার লস গেছে তা রহমত মিয়াকে বলে দিও, চেষ্টা করব দিয়ে দেওয়ার। নতুন করে বাগানবাড়ি শুরু করো। ভেঙে পড়োনা।
আয়না কাগজটা মোচড়ে নিল। ঘরে গিয়ে লিখলো
‘ প্রথমবার ফুল বিক্রি করে পেয়েছি পনের হাজার টাকা। লাভ ছিল সাতহাজার টাকা। ২য় বার ফুল বিক্রি করলে আর ও লাভ পেতাম আমি অনেকগুলো ফুল ২য় বার তোলার জন্য তুলিনি। পর পর সাত আটবার ফুল তোলা যেত বাগান থেকে। তারমানে বুঝতে পারছেন কত টাকা লস গেছে। সব হিসেব করে পাঠিয়ে দেবেন। আমি আবার বাগান শুরু করব।

অনুরাগ কাগজটা পেল। কিন্তু সময় হয়নি বিধায় পড়া হলোনা। তবে যখনি সময় পেল পড়ে নিল। আয়নামতীর স্পষ্ট উত্তর দেখে ভালো লাগলো। ব্যবসাতে যেহেতু লস গেছে সেহেতু সব জরিমানা আয়নামতীর প্রাপ্য। অনুরাগ আবার লিখে পাঠালো।

‘ ঠিক আছে, নগদ টাকা দিচ্ছি না। ফজলু মিয়াকে যেখানে থাকতে দেওয়া হয়েছে ওখানে বিশাল একটা সাজানো গোছানো বাগান বাড়ি আছে। ওখানে চাষ শুরু হয়ে যাবে কিছুদিনের মধ্যে। ফুল চারা ও কিনে রাখা হবে তুমি শুধু চারা আর কন্দ রোপণ করে দিতে আসবে। বাকি কাজ তোমার। তারপর ও চারা রোপণের কাজটা ও আমার লোক করে দিতে পারবে যদি তুমি বলো। তারপরও কত টাকা বাকি থাকে তা হিসেব করে বলে দেবে।

চিরকুটটা আয়না সন্ধ্যায় পেল। মনের মাঝে থাকা সুপ্ত আশাগুলো জেগে উঠলো। ঔ যে কাল স্বপ্নে দেখলো সে দাঁড়িয়ে আছে এক বিরাট বাগানের মাঝখানে। তার চারপাশে ফুল আর ফুল। রঙ বেরঙের ফুল। সেই স্বপ্ন তাহলে এমনি এমনি দেখেনি? অনেকদিন পর মুখে হাসি ফুটলো তার। একদিন যখন তার অনেক অনেক বাগান হয়ে যাবে তখন সে একটা বাগান চৌধুরী সাহেবকে দিয়ে দেবে এই এতগুলো সাহায্য করার জন্য। সব ঋণ একসাথে শোধ হয়ে যাবে তখন। এখন তার অনেক কাজ। নামিরা কপাল কুঁচকে আয়নাকে দেখলো। আয়না ঘরে চলে গেল। কাগজ কলম নিয়ে লিখলো,

‘ ধন্যবাদ প্রফেসর সাহেব। স্ত্রী সন্তান নিয়ে ভালো থাকুন।

অনুরাগ ভেবেছিল আয়না খুব জরুরি কিছু লিখবে। কিন্তু কাগজ খুলে এই স্ত্রী সন্তান শব্দটা দেখে নিজের নামের শেষ দু অক্ষরের যথার্থতা দেখাতে দিয়ে আবার দেখালো না। তবে ক্ষেপে গেল ভীষণ। তবে এটুকু ভাবনায় এল, মেয়েমানুষ মানেই বিরক্তিকর। হায়রে, তার ও আয়নামতীকে ভালো লাগতো নাকি, ভাগ্যিস কুহেলীর সাথে বিয়েটা হলো নইলে তো আবার এই আয়নামতীর খপ্পরে পড়ত সে। বলা তো যায় না, এই আয়নামতী কত বড় দুর্দান্ত মহিলা। হতেই পারে। মেয়েমানুষকে বিশ্বাস করা মানেই, জেনেশুনে নিজের পায়ে কুড়াল মারা। কে জানে আয়নামতী আবার কাকে ঠকানোর জন্য জন্ম নিয়েছে।
সে যাইহোক অনুরাগ রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়ে লিখলো
‘ দেখো আয়নামতী তোমার ভালো চাইছি আমি। তুমি ও আমার ভালো চাও। বেশি বাড়াবাড়ি করো না। যা বলছি তাই করো। আর কি কি পাবে তুমি আমার কাছে তা বলে দাও। কত টাকা পাবে?
আয়না চিরকুটটা পেয়ে হাসলো। লিখলো,
‘ পাবো বোধহয় লাখখানেক, হয়ত আর ও বেশি।
অনুরাগের ভাবান্তর দেখতে পেল না আয়না, পরের চিঠিতে। কারণ তাতে অনুরাগ লিখলো,
‘ লাখ পেলে পাবে। দেব। সমস্যা কি? সমস্যা তো নেই। যখন যা টাকা লাগবে বাগানে ফুল না আসা পর্যন্ত আমি দেব।
আয়না লিখলো।
‘ তো ওটা তো আপনার বাগান হচ্ছে। আমার বাগান তো হলো না।
অনুরাগ লিখলো,
‘ বাজে কথা বলো না মেয়ে। ওটা তোমার বাগান হবে। তোমার টাকাই তো তোমাকে দিচ্ছি। সমস্যা নেই সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেব
আয়নামতীর বাগান।
আয়না চিরকুট পেল কিন্তু আর কোনোকিছু লিখলো না। যখন বাগান দেখতে গেল দেখলো পাশেই চৌধুরী বাড়ি। চৌধুরী বাড়ির ছাদে দাঁড়ালে তো এখানকার পুরোটা দেখা যাবে। আয়না চোখ নামিয়ে নিল। এই এত বড় প্রাসাদে সে দাসী হয়ে থাকতো ভাগ্যিস বিয়েটা হয়নি।
ফজলু মিয়া আয়নাকে দেখে খুশি হলো। বলল
‘ ফুলবানু এই বাগানবাড়ির জমিটা আমি তোরে লিখা দিমু। তুই শুধু আমার রেণুরে দেইখা রাখিস। একটা ভালোর পোলা পাইলে বিয়া দিস। আমি বেশিদিন বাঁচুম না।
বলেই খুকখুক করে কেশে উঠলো ফজলু মিয়া। রেণু মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। আয়না বলল
‘ সব জমি রেণুর নামে হবে।
রেণু বলল
‘ উকিল বাবু কইছে আঠারো বছর না হইলে করা যাইবো না।
আয়না কিছু একটা ভাবলো। বলল
‘ আচ্ছা এসব নিয়ে পরে কথা হবে। চল বাগান দেখে আসি।
রেণু এদিকওদিক দৌড়াদৌড়ি করলো। ফর্সা গাল নেয়েঘেমে একাকার হয়ে গেল। তারপর কি যেন ভেবে রেণু দৌড়ে এল। আয়নার আঙুল ধরে যেতে যেতে বলল
‘ আপা তুমি জানো কাল ছোডসাহেব এখানে আইছিল। আমারে ফুলটুসি ডাকে।
আয়না বলল
‘ বাহ নামটা তো সুন্দর। ফুলটুসি! তোর স্কুলে তোরে কি নামে ডাকে?
রেণু বলল
‘ আমার আসল নাম তো রূপা। নানা আমারে রেণু ডাকে। ফুলের রেণু নাকি।
আয়না হাসলো। বলল
‘ আমি তোরে রূপা ডাকব তাহলে। নামটা খুব সুন্দর।
রেণু খুশি হয়ে বলল
‘ ঠিক আছে। আমি ও সবাইরে আমার নাম এইডায় কমু। সুন্দর নাহ?
আয়না বলল, হুমম।
রেণু বলল
‘ ছোডসাহেবের লগে একটা পোলা আইছে না? কি নাম যেন, ওমি ওমি। নাহ নাহ ওমি নাহ। অমি। ছেলেডা আমারে ছোডসাহেবের সাথে সাথে ফুলটুসি ডাকছে। আমার রাগ লাগছিল তখন।
আয়না খিক করে হেসে ফেলল। বলল
‘ অমি সাহেবের কি রূপাকে মন ধরেছে নাকি? হুহ হুহ?
রেণু মুখ কালো করে বলল
‘ ওগুলা তো বেয়াদব কথা আপা। তুমি কইয়ো না তো।
আয়না হাসিতে ফেটে পড়লো। চৌধুরী বাড়ির ছাদ থেকে কে যেন জোরে হাঁক ছেড়ে বলল
‘ এই আয়নামতী একটু আস্তে হাসো। তোমার হাসির জ্বালায় তো ঘরে থাকা যায় না। আশ্চর্য!
আয়না হাসি থামিয়ে রূপার দিকে চাইলো। বলল
‘ আমার হাসির আওয়াজ কি ওখানে যাবে? যত্তসব ফালতু কথা বলে এই চৌধুরী। মাথা পাগল একটা।
অনুরাগ চায়ের কাপে চুমুক দেয়। তারপর বাগানের দিকে চোখ বুলিয়ে চলে গেল। রূপা বলল
‘ আপা ছোডসাহেবের বউ পালাইছে। আমি কাল স্কুল থেইকা আসার সময় দোকানে বসা লোকদের মুখে শুনছি।
আয়না তার মুখ চেপে ধরলো। বলল
‘ যে যা করার করুক। আমাদের কি? ওসবে কান দিস না। খবরদার ওসব আর মুখে আনবি না। ওদের বিস্তর টাকা পয়সা, বিয়ে দশটা করে দশটা তালাক দিলে ও সমস্যা নাই।
রূপা চুপ হয়ে গেল। কিছু বললো না। আয়না তার মাথায় গাট্টি মেরে বলল
‘ ভালো করে কথা বলা শিখ। উল্টাপাল্টা কথা আমার সাথে বলবি না। খুব মারব। চলিত ভাষা শিখে নে।
রূপা বলল
‘ আইচ্ছা।
আয়না ধমক দিয়ে বলল
‘ আচ্ছা ” হবে।
রূপা বলল
‘ আচ্ছা।

________________

পুরো গ্রামে পাবলিসিটি শুরু হয়েছে ইতোমধ্যে। শায়খ চৌধুরী আর নাওয়াজ শেখের পাবলিসিটি তো আছেই। সাথে মেম্বার পদপ্রার্থীদের ও। আহা ঘরে থাকা যায় না। অনুরাগ শায়খ চৌধুরীকে বলল
‘ বাবা এসবের তো দরকার নেই আর। আপনার বয়স হচ্ছে এগুলো বাদ দিয়ে রেস্টে থাকুন।
শায়খ চৌধুরী ছেলের উপর ক্ষেপে গিয়ে বললেন
‘ তোমার কথা কেন আমি শুনব অনুরাগ? বাড়াবাড়ি করো না। বলা যায় না, তোমাকে এমপির পদে দাঁড়ানো লাগতে পারে।। কাল তোমার মামার সাথে কথা বলেছি। এই যে এমপি খালিদ্দে আছে, শালা লুটপাট করে খায়। শালা সন্ত্রাস! তুমি কি ওসব সহ্য করবে?
অনুরাগ বলল
‘ মাঝেমাঝে আপনাকে আমি বুঝে পাইনা বাবা।
আনহিতা এসে অনুরাগকে টেনে নিয়ে গিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন
‘ আমার একটাই ছেলে। আপনার কি মাথা খারাপ? ও রাজনীতিতে জড়াবেনা। আমি দেব না।
শায়খ চৌধুরী বলল
‘ সময় হলে তোমার ছেলে নিজেই দাঁড়াবে। সবসময় নিজেই তো বলে মানুষের জন্য কিছু করে কিছু করো। এবার দেখি সে কি করে?
অনুরাগ ভুরু কুঁচকে বাবার দিকে চেয়ে রইলো। আনহিতা বলল
‘ সোহাগ ওসব কথা কানে নেবে না।
অনুরাগ মায়ের হাত মুখ থেকে সরিয়ে বলল
‘ আহা মা আমি কি আর ছোট আছি? এবার আমাকে নিজের মতো করে বাঁচতে দাও। আর কত ভালো করবে আমার জন্য? ভালো করেছ তো, ফল ও পেয়েছি।
আনহিতা মাথা নামিয়ে নিল। বলল
‘ ঠিক আছে আর কিছু বলব না। তবে তোমার সব সিদ্ধান্ত যাতে ঠিক হয়। আমি তোমার মা, সবসময় তোমার ভালো চাই।
অনুরাগ বলল
‘ ঠিক আছে। মন খারাপ করোনা। ভালো লাগেনা।
আনহিতা মাথা তুললো। অনিমা এসে বলল
‘ ভাই ওসবে জড়াস না। দেখ টিভিতে দেখাচ্ছে এমপি খালিদুজ্জামান সন্ত্রাস হামলায় আহত হয়ে কক্সবাজার সেন্ট্রাল হসপিটালে ভর্তি। খুব মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে।
অনুরাগ বলল
‘ ওর লোকই ওকে মারে। মানুষ ভালো না। ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণেই এই দশা।

____________

আয়ানের ছাপাখানায় ভীড় দেখা দিল। ভোটের কাগজ ছাপানোর অনেক কাজ পড়েছে। আয়না ও হাত লাগিয়েছে। এখান থেকে গিয়ে আবার বাগানে যেতে হবে, যদি ও প্রফেসর লোক দিয়েছে। তারপরও আয়নার দেখা দরকার। দোকানে অনেক ভীড় হতে দেখে আয়ান আয়নাকে বলল
‘ টুনি তুই চলে যাহ। অনেক মানুষ আসছে।
আয়না নিকাব টেনে নিয়ে বলল
‘ কেউ তো দেখছেনা। কিচ্ছু হবে না।
আয়না দেখলো সব শায়খ চৌধুরীর ভোটের ব্যানার। আয়ানকে বলল
‘ ভাইয়া উনার প্রতিদ্বন্দ্বী কে?
‘ নামিরার বাবা।
‘ তো আমি কার পক্ষ নেব?
আয়ান বলল
‘ কারো না। শায়খ চৌধুরীর পক্ষে ও না নামিরার বাবার পক্ষে ও না। নামিরার বাবার সাথে খালিদুজ্জামানের হাত আছে,ওনি ক্ষমতায় আসলে অপব্যবহার করবেন সেটা আমি নিশ্চিত।
আয়না বলল
‘ যেখানে মূলে সমস্যা সেখানে এরা মেম্বার, চেয়ারম্যানরা তো এসব করবেই। এই এমপিগুলোই সব সমস্যার মূল। ওরা চাইলেই অসহায় মানুষদের জন্য অনেককিছু করতে পারে কিন্তু এরা তো শুধু নিজেই খেতে থাকে।
আয়ান বলল
‘ কাল মরতে মরতে বেঁচেছে খালিদুজ্জামান। মেরেই ফেলতো বিরোধী দলের নেতাখেতা।
আয়না বলল
‘ কেন যে ওসব করে কে জানে? মরার ভয় ও নেই।
আয়ান বলল
‘ এজন্যই দিনদিন দেশটা রসাতলে যাচ্ছে।
আয়ান বলল
‘ শায়খ চৌধুরীর ছেলে, মানে অনুরাগ চৌধুরীকে এমপি পদে দেখা যাবে আশা করা যাচ্ছে। ওদের ও অনেক উপরের লেভেলের মানুষের সাথে হাত আছে। পারবে।
আয়না বিস্ময় নিয়ে বলল
‘ ওই ভ্যাবলাকান্ত? নাহ নাহ এখন অবশ্য ভ্যাবলাকান্ত নেই। সে যাইহোক, আমার তো ভাবতেই অবাক লাগছে।
আয়ান বলল
‘ কেন? খুশি হসনি?
আয়না কাজে মনোযোগ দিয়ে বলল
‘ আমার কি?
আয়ান হাসলো।

___________

ভোট খোঁজার জন্য নাওয়াজ শেখ গ্রামের প্রতিটি পাড়ায় গেলেন শুধু উত্তর পাড়ায় যাননি। কারণ ওখানে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি। তার আত্মসম্মানে লাগবে। নামিরা অনেক অপেক্ষায় ছিল। বাবা আসবে। সে বাবাকেই ভোট দেবে, আম্মা আব্বা আর আয়ানকে ও দিতে বলবে। কিন্তু না বাবা আসেনি। মন খারাপ হলো। ঘরে বসে একা একা কাঁদলো। বুকে যন্ত্রণা হলো। আয়ান দুপুরে খেতে এসে দেখলো নামিরার মুখ অন্ধকার। সে খেয়েদেয়ে রুমে আসলো। বেরোনোর আগে পেছন থেকে নামিরাকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে ঠোঁট ছুঁয়ে থুঁতনি ঠেকালো। জিজ্ঞেস করলো
‘ মন খারাপ?
নামিরা গলা একপাশে কাত করে দেখার চেষ্টা করলো আয়ানকে। ফুঁপিয়ে উঠে বলল
‘ বাবা আজ এখানে আসেনি।
আয়ান হেসে ফেলল। বলল
‘ তো?
‘তো কি? আমি ওনার মেয়ে না? আমাকে না দেখলে চিল্লিয়ে বাড়ি একখান করতেন তিনি। সেই বাবা আমাকে দেখতে আসতে অপমানবোধ করেন এখন।
আয়ান বলল,
‘ রাজকন্যাকে বাবারা কুঁড়ে ঘরে দেখতে পারেন না মিরা। ওনারা চাই তাদের রাজকন্যা রাজপ্রাসাদে রাজপুত্রের কাছে থাকুক।
নামিরা ফিরলো আয়ানের দিকে। নাক টেনে বলল
‘ রাজকন্যাকে রাজপুত্রই পায়। কোনো সেনাপতি পায় না। এই বাড়ি আমার কাছে রাজপ্রাসাদ, আর তুমি রাজপুত্র। বাবার বুঝা উচিত, তার মেয়ে সুখ এই কুঁড়েঘরেই খুঁজে পায়। রাজার পোশাক পড়লেই রাজা হওয়া যায় না। তোমার গায়ে রাজার পোশাক নেই ঠিক, কিন্তু আমার কাছে তুমিই রাজা।
আয়ান কপাল মিলালো তার কপালে। কপালে চুমু এঁকে বলল
‘ আচ্ছা আমি আসি। মন খারাপ করে থাকবেনা আর। ঠিক আছে। কি খাবে? আসার সময় কিছু আনবো?
নামিরা হাসার চেষ্টা করে বলল
‘ নাহ কিছু লাগবে না।
আয়ান যেতে যেতে বলল
‘ আমি আনব।
নামিরা না চাইতে ও হেসে ফেলল।

________

বাগানে চারা রোপণ করা হয়েছে। আয়না এসে দেখলো বাগানের চারপাশটা ঘেরার কাজ চলছে। অনুরাগ তাকে এককোণায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল
‘ যাও তোমার সব জরিমানা দিয়ে দিলাম। এবার আমার কাজ শেষ। ভাইরে ভাই এত কাজ আমি জীবনে করিনি।
আয়না বলল
‘ আপনি কোথায় করলেন? সব তো আপনার লোকই করলো।
অনুরাগ বলল
‘ নাহ নাহ আমি কোনো কাজ করিনি। সব ওরাই করলো। আমি বসে আঙুল চুষছিলাম।
আয়না মুখ ফিরিয়ে নিল। রূপা খিক করে হেসে দিল। অমি দৌড়ে এসে বলল
‘ ফুলটুসি তোমার পায়ে জুতো নেই কেন?
রূপা মুখ ফুলিয়ে আয়নার পেছনে লুকোলো। বলল
‘ আপা আমি এই ছেলেরে ঢিল মেরে মাথা ফাটাই দেব।
আয়না বলল
‘ তোকে তো ভালো কথায় বলছে। পায়ে জুতো কোথায়?
অমি অনুরাগের আঙুল ধরে দাঁড়ালো। আয়নাকে বলল
‘ রাগী আন্টি আপনার বাগানে আমি খেলতে আসলে বকবেন?
আয়নার ভুরু কুঞ্চন হলো। অনুরাগ তার পিঠ চাপড়ে বলল
‘ বকবে মানে? এত বড় সাহস? আয়নামতী তুমি ওকে বকলে তোমাকে আমি দেখে নেব।
আয়না বলল
‘ আশ্চর্য! আমি কখন বলেছি বকবো? ভারী পাজি মানুষ তো আপনি।
অনুরাগ বলল
‘ হয়েছে হয়েছে। তোমরা মেয়েরা কত সাধু তা জানা আছে। সবই ঠকবাজি।
আয়না বলল
‘ কি বললেন?
‘ অনুরাগ বলল
‘ কিছু বলিনি।
আয়না বাগানে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।
অনুরাগ ডাকলো
‘ আয়নামতী শোনো?
আয়না ফিরলো। বলল
‘ কিহ?
অনুরাগ আবার মাথা নাড়িয়ে বলল
‘ নাহ কিছুনা। তোমার সাথে আমার কিসের কথা?
আয়না বাগানের ভেতরে চলে গেল। অনুরাগ গিয়ে টিলার উপর দাঁড়ালো পেছনে হাত দিয়ে। যাতে বাগানের ভেতরটা দেখা যায়।
তারপর ফোন আসলো মুঠোফোনে। কথা বলতে বলতে দ্রুত পা বাড়ালো।
রহমত মিয়া এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল
‘ আপা আপনের ভাই।
আয়না বলল
‘ কি হয়েছে ভাইয়া? কি হয়েছে?
রহমত মিয়া গামছা দিয়ে মুখ মুছে বললেন
‘ মারামারি লাগছে ছাপাখানার পাশে । আপনার ভাইয়ের দোকানে ও ভাঙচুর করছে। সব ভাঙি দিছে। গোলাগুলি হইছে। অনেক মানুষ মরছে। খালিদুজ্জামানরে নিয়া কথা বলায় ওর দলের মানুষ এসে মারামারি লাগায় দিছে। অনেক মানুষ মরছে। কারে যেন কুপায়ছে ও।
আয়নার দুচোখ টলটলে করলো নোনাজলে। সে বলল
‘ আমার ভাইয়া ঠিক আছে। কেউ মারেনি তো?
রহমত মিয়া চুপ থাকলো। আয়না দৌড় লাগালো। অনুরাগ ফোনে কথা শেষ করে আয়নার কাছে এল। বলল
‘ তুমি কোথায় যাচ্ছ? ওখানে অনেক মানুষ। আমি দেখছি।
আয়না বলল
‘ আমার ভাইয়ার যদি কিছু হয়?
অনুরাগ বলল
‘ কিছু হবে না। আমি সামলে নেব। ওখানে অনেক মানুষ। তুমি যেওনা।
আয়না বলল
‘ নাহ আমি যাব।
অনুরাগ আর না পেরে বলল
‘ গাড়িতে উঠো।
আয়না গাড়িতে উঠলো না। বলল
‘ আমি রিকশায় যাব।
অনুরাগ গর্জে বলল
‘ রিকশার চাইতে গাড়িতে তাড়াতাড়ি যাওয়া যাবে পাগল। মাথা খেওনা তো। উঠো।
আয়না অন্য কিছু না ভেবে তাড়াতাড়ি গাড়িতে বসলো। ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখলো লাশ নিয়ে টানাটানি পড়েছে। অনেক গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে। আয়না দৌড়ে দোকানে ঢুকলো। দেখলো দোকানে ভাঙচুর হয়েছে। মনিটরটা বাঁকা হয়ে পড়ে আছে। প্রিন্টারমেশিন নিচে পড়ে আছে। ছোট ছোট পথশিশুরা মাউস নিয়ে খেলা করছে৷ খাঁ খাঁ করছে চারপাশ।
আয়না চেঁচিয়ে ডাকলো অনুরাগকে। বলল
‘ আমার ভাইয়া কোথায়? আমার ভাইয়া? আল্লাহ!
অনুরাগ বলল
‘ শান্ত হও। আমি দেখছি।
আয়না কান্নায় ভেঙে পড়লো। এতলোকের ভীড়ে আয়ান কোথায় তা খুঁজে পাওয়া গেল না। লাশের লাশ পড়ে রয়েছে রাস্তায়। পুলিশে পুলিশে থমথমে পরিবেশ। হাসপাতালে গেল অনুরাগ। আয়ানকে কোথাও পাওয়া গেল না। খালি হাতে শুকনো মুখে ফিরলো অনুরাগ। আয়না তখন ও দোকানে বসা ছিল। অনুরাগ এসে নরম গলায় বলল
‘ মর্গে গিয়ে দেখে আসতে হবে। হসপিটালে আহতদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
আয়না কান চেপে ধরলো। মাথা চেপে ধরলো। কাঁপতে কাঁপতে গাল বেয়ে উত্তপ্ত জল গড়ালো। সাথে সাথেই জ্ঞান হারালো সে। অনুরাগ ধরে ফেলল। মুখ ধরে ডাকলো। আয়নার সাড়া পাওয়া গেল না। অনুরাগ ভাবলো এই মেয়েটা মরেই যাবে একদিন। সে সাক্ষী থাকবে।
নামিরার কানে আসলো সেই খবর। আজহার সাহেব খোঁড়াতে খোঁড়াতে স্ত্রী আর ছেলে বউকে নিয়ে চলে আসলো হাসপাতালে। আয়নাকে অনুরাগ সেখানে নিয়ে এসেছে। আয়শা বেগম পাগলের মতো প্রলাপ করছে। নামিরা এদিকওদিক দিশেহারার মতো তাকালো। মৃত ব্যাক্তিদের কান্নার আওয়াজে চারপাশটা আর ও ভয়ংকর হয়ে উঠলো।

মর্গে দুটো লাশ দেখানো হলো অনুরাগকে। একজনের চেহারা বুঝা যাচ্ছেনা। অপরজনের চেহারাটা রক্তে ভাসা। দুজনই তরুণ। হঠাৎ একজনের হাতের মোড়ানো থাকা একটা ঘড়ি দেখলো অনুরাগ। সেটি খুলে নিল। সেখানকার মানুষটিকে বলল
‘ এটা আমার লাগবে।
তারপর সেটি নিয়ে আসলো। রক্তে মাখামাখি ঘড়িটা। নামিরার কাছে এনে বলল
‘ এটা চেনেন?
নামিরা ঘড়িটার দিকে চেয়ে রইলো একদৃষ্টিতে । ফোটা ফোটা জল গাল বেয়ে গড়ালো পায়ের আঙুল অব্দি। বুক চিরে বেরিয়ে এল প্রিয় মানুষ হারিয়ে যাওয়ার আর্তনাদের স্ফুলিঙ্গ।
অনুরাগ মুখ ঢেকে বসলো বেঞ্চে। মর্মাহত, জর্জরিত মানুষগুলো আর্তনাদে যন্ত্রণা ধরলো মাথায়।

চলবে

#আয়নামতী
#পর্ব_১৫
#পুষ্পিতা_প্রিমা

আয়ানের লাশটা দাফন হলো মসজিদের পাশে। নাওয়াজ শেখ ছুটে আসলেন এই মর্মান্তিক ঘটনা শুনে। নিজ চোখে মেয়ের বুকফাটা আর্তনাদ দেখে তিনি এবার মুষড়ে পড়লেন। মনে হলো, এক্ষুনি গিয়ে ওই ছেলেটাকে নিয়ে আসতে। আর বলতে আমার মেয়েকে কাঁদানোর এত সাহস কোথায় পেলে? কিন্তু নাহ, তা অসম্ভব।
আয়শা বেগমের জ্ঞান নেই অনেকটা সময়। বড় আদরে যত্নে, মায়া মমতায় বড় করেছেন দুই ছেলেমেয়কে। সংসারে অভাব অনটন থাকলে ও কখনো তা ছুঁতে দেননি ছেলেমেয়েকে। নিজে না খেয়ে ছেলেমেয়ের মুখে তুলে দিয়েছেন। দুটো শাড়ি পড়ে বছরের পর বছর পার করেছেন। স্বামী সংসার নিয়ে একটু ভালো থাকতে চেয়েছেন সারাজীবন। এত বড় করে তোলার পর, কলিজা ছিঁড়ে চলে গেল সন্তান। মায়ের কোমল হৃদয়ে এই আঘাত কভু সহনীয় নয়। আজহার সাহেব যেটুকু দাঁড়াতে পারতেন তা ও একেবারে নিস্তেজ হয়ে গেল। পড়ে রইলেন হুইল চেয়ালে গলা কাত করে। বাকহীন হয়ে পড়লো।
অনুরাগ দোকানের জিনিসপত্র সব নিয়ে আসলো ভ্যানগাড়ি করে, এগুলো বিক্রি করলে অনেক টাকা পাওয়া যাবে। শক্তপোক্ত আয়নাকে এভাবে ভেঙে পড়া দেখতে ভালো দেখাচ্ছে না। এই ভালো মানুষগুলোর কেন এরকম দশা হয়?
দিন দুয়েক পার হতেই নামিরার অসুস্থতা বাড়লো। একফোঁটা পানি ও পেটে না পড়ায় তার অবস্থা কাহিল। নাজমা বেগম এতদিন এখানেই ছিলেন। মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার জন্য সুযোগ খুঁজছিলেন। এভাবে তো চলতে পারেনা। যে চলে গেছে সে তো আর ফিরবে না। সবকিছু মেনে নেওয়ায় শ্রেয়।
শুকনো ফোলা মুখে, ভেজা গালে নামিরা এসে বসলো আয়শা বেগমের কোলের কাছে। ধপ করে মাথা রেখে এলোমেলো হয়ে কাঁদলো। আয়শা বেগম শক্ত পাথরের মতো বসে আছেন। নামিরা শক্ত করে হাতের মুঠোয় নিল আয়শা বেগমের শাড়ি। বেদনার সুর টেনে বলল
‘ আম্মা আমি এই ঘর ছেড়ে কোথাও যাব না। কোথাও যাব না আম্মা। আয়ান মরেনি। আয়ান আমাকে এভাবে অসহায় করে যেতে পারেনা। আমি বিশ্বাস করিনা।
আয়না দরজার কাছে ছিল, নামিরার কান্না দেখে আর দাঁড়াতে পারলো না। ঘরে চলে গেল দৌড়ে। ভাইয়ের কাপড়চোপড় কুড়িয়ে নিয়ে বুকে জড়ায়। আর বলে
‘ তুমি আমাদের কথা ভাবোনি ভালো কথা, ভাবির কথা ভাবতে পারতে। ওই মানুষটা মরে যাবে ভাইয়া।

নাজমা বেগম নামিরাকে ধরলো। পিঠে হাত বুলিয়ে বলল
‘ ওদের অবস্থা দেখ। ওরা ভালো নেই মা। তোকে এভাবে দেখলে ওনাদের কষ্ট আরও বাড়বে।
নামিরা আয়শা বেগমের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আয়শা বেগম মুখে শাড়ি গুঁজে বলল
‘ চলে যাও বউ। ভালো থাকো। ভুলে যাও বাবুকে। ও ভাবেনি তোমার কথা, তুমিও ভেবোনা। চলে যাও।
নামিরা চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলো। মাথা জোরে চেপে ধরলো। তারপর ঢলে পড়লো মায়ের কোলে।
গলার হাড় ভেসে উঠেছে, চোখের নিচে কালো দাগ জুড়ে বসেছে,মুখ সরু হয়ে গেছে, মাথার কুচকুচে কালো চুলগুলো ময়লা দেখাচ্ছে। নাওয়াজ শেখ মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর জোরে ডাকলেন নাবিলকে। বললেন
‘ গাড়ি ডাকো। ওকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। নামিরা মা উঠ।
আয়শা বেগম আওয়াজ করে কাঁদেন এবার। আর্তনাদে ভাসে পুরো ঘরটা।

এই এত বড় দুঃসংবাদের মাঝে খুশির সংবাদ আসলো যখন শোনা গেল নামিরা অন্তঃসত্ত্বা। তার গর্ভে বেড়ে উঠছে আয়ানের সন্তান। নামিরাকে তার বাড়ি নিয়ে যেতে পারলো না নাওয়াজ শেখ। আবার নিজের স্বামীর ঘরে সে ছুটে আসলো। আয়শা বেগমের পায়ে পড়ে বলল
‘ আম্মা আমাকে যেতে দিওনা। আমাকে দূরে পাঠিওনা। আয়ান ফিরলে আমাকে না দেখে কষ্ট পাবে। ওর সন্তানের জন্য হলেও আমাকে থাকতে দাও। কেউ বুঝিয়ে কূল পেল না তার স্বামী নামক মানুষটা না ফেরার দেশে চলে গেছে।
আয়শা বেগম বুকে জড়ালো তাকে। কপালে অজস্র চুমু এঁকে বললেন
‘ কপালপুড়ি ভালোবাসার জন্য আর মানুষ পেলি না? এই ভাঙা ঘরে তুই সর্বসুখ খুঁজে পেলি? দেখ তোর ভালোবাসাকে লাতি মেরে কিভাবে সে চলে গেল। নিজের অনাগত বাচ্চার কথা ও ভাবলো না। আমার বাবু তো এরকম পাষাণ নয় রে। তাহলে কেমনে চলে গেল? তার আম্মার আব্বার কথা একটুও ভাবলো না।

বাইরে অনুরাগের ডাক শোনা গেল। আয়না তড়িঘড়ি করে বের হলো। অনুরাগ একটা নীল রঙের কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে বলল
‘ এটা পোস্টমর্টেম রিপোর্ট। ভালো করে দেখ।
আয়না ঝাপসা ঝাপসা চোখে রিপোর্টে চোখ বুলালো
তারপর চোখ তুলে অনুরাগের দিকে তাকালো। অনুরাগ পকেট থেকে রুমাল বের করে দিয়ে বলল
‘ ওদের কথা ভেবে শক্ত হও। এখন সব দায়িত্ব তোমার।
আয়না রিপোর্টটা বাড়িয়ে দেয় অনুরাগের দিকে। তারপর হাতের কব্জি দিয়ে চোখ মুছে বলল
‘ আমার ভাইকে ফিরিয়ে এনে দিন প্রফেসর৷ আমার আর কিচ্ছু চাই না। এসব রিপোর্ট দিয়ে আমি কি করব? আমার ভাইকে চাই। আমাকে টুনি ডাকার মানুষটা কোথাও নেই। নিজের সন্তানের কথা ও জানতে পারলো না। আমাদের সবাইকে অসহায় করে হারিয়ে গেল। একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেলাম আমি।
অনুরাগ চুপচাপ চেয়ে রইলো। পরক্ষণে বলল
‘ যারা এই সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, তাদের আমি দেখে নেব। কতগুলো পরিবার নিঃস্ব করেছে এরা। কারো সন্তান, কারো বাবা, কারো স্বামী,কারো ভাই কেড়ে নিয়েছে এরা। এদের তো একটা শিক্ষা দেওয়ায় উচিত। এগুলো থামানো উচিত আয়নামতী।
আয়না চোখের পানি মুছলো।

অনুরাগ বলল
‘ আমি আসি। ভালো থেকো। সবাইকে দেখে রেখো। ভালো থাকাটা দক্ষতা, আর ভালো রাখাটা যোগ্যতা। তোমার ওটুকু যোগ্যতা নিশ্চয়ই আছে।
আয়না বলল
‘ আপনি আমার জন্য অনেক করেছেন প্রফেসর। আমি জানিনা এই ঋণ কি করে,,

অনুরাগ বলল
‘শোধবোধ একসাথেই করে দিও। সময় সুযোগ পেলে। এখন থাক।
আয়না মাথা নাড়ালো।
নামিরার ঘর থেকে কান্না ভেসে আসছে। বুকটা ভার হয়ে গেল আয়নার।
রহমত মিয়া আসলো কিছুক্ষণ পর। বলল
‘ ভাইডা ভালা মানুষ আছিলো। কোনোদিন বড় গলায় কথা বলতে শুনিনাই। রাগ দেখিনাই। সোজাসাপ্টা মানুষ আছিলো। আল্লাহ ভালা মানুষগুলারে কষ্ট দেয় বেশি। ভালা মানুষরাই বেশি ঠকে এই মিছা দুনিয়ায়।
আয়নার চোখ ভিজে উঠলো আবার। পেছনে ফিরে চোখ মুছে নিল সে। কান্না মেশানো গলায় বলল
‘ রূপাকে দেখলে এদিকে পাঠাইয়েন।
রহমত মিয়া মাথা দুলিয়ে চলে গেল।

আয়না নামিরার ঘরে গেল। নামিরা তাকে দেখে কান্না থামিয়ে দিল। দৌড়ে এসে বলল
‘ আয়না দেখো না আমাকে ওরা সাদা শাড়ি পড়তে বলছে। নাকফুল খুলতে বলছে। ওদের কিছু বলোনা। আয়ান এসে দেখলে ভীষণ কষ্ট পাবে, ওদের কিছু তো বলো।

আয়না পিছু করে দা্ঁড়ালো। গাল মুছতে মুছতে ভার গলায় বলল
‘ ভাবি তুমি তোমার বাপের বাড়ি চলে যাও। তোমার এই অবস্থায় ভালো ভালো খাবার দরকার, ঔষধ দরকার। আমাদের অত টাকা কোথায়? আব্বার চিকিৎসা খরচ কোথা থেকে দেব জানিনা। চলে যাও, আমাদের কষ্ট আর বাড়িও না।
নামিরা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। পরক্ষনে চেঁচিয়ে বলল
‘ আমার ঘর। এটা আমার ঘর। আমি যাব না এখান থেকে। তুমি কে আমাকে বের করে দেওয়ার? আয়ান থাকলে বলতে পারতে? ও চলে গেল, আর তোমাদের রূপ পাল্টে গেল। তোমরা এতদিন ওর সামনে অভিনয় করতে? আমাকে কেউ ভালোবাসেনা। কারো আপন নই আমি? আয়ান ও তো ভালোবাসেনি। ভালোবাসলে এভাবে আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারতো না৷ আমি কি করব এখন? আমার পৃথিবীটা বিবর্ণ করে দিয়ে চলে গেল সে। আল্লাহ আমার সাথে কেন এমন করলো?
আয়না কাঁদলো কিন্ত নামিরা তা দেখলো না। নাজমা বেগম এসে ধরলো নামিরাকে। নাওয়াজ শেখ ইশারায় নাজমা বেগমকে বলল যাতে সব গোছগাছ করে নেয়। গাড়ি আসছে।
আয়না চলে গেল মায়ের কাছে। আজহার সাহেব গলা কাত করে বসা হুইল চেয়ারে। চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে। আয়না হাঁটুগেড়ে বসলো বাবার কাছে। বাবার চোখমুখ মুছে দিয়ে বলল
‘ আব্বা আমি ভাবির সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি। ভাইয়ের বউয়ের আগে ভাবি আমার বোনের মতো। বোনের ভালোবাসা কাকে বলে তা আমি ভাবির কাছ থেকে পেয়েছি। আমি আজ তার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি। আমি আর কি করতাম বলো? এভাবে না বললে ভাবি এখানে থেকে যাবে। ভাইয়ের প্রতিটি জিনিস দেখে দেখে কান্না করবে সারাক্ষণ। গর্ভের বাচ্চাটার ক্ষতি হবে। আমি চাইনা এই বাড়ির বংশধরের কোনো ক্ষতি হোক। ভাবি ওনার মা বাবার কাছে ভালো থাকবে। এখানে থাকলে কষ্ট আরও বাড়বে।
আয়শা বেগম মুখ ঢেকে ফেললেন। আয়না মায়ের কাছে গিয়ে বলল
‘ আম্মা ভাবির কান্নায় গলে গেলে হবে না। ভাবিকে ভালো থাকতে হবে। তুমি প্রশয় দিওনা আম্মা।
আয়শা বেগম আহাজারি করে বলল
‘ খোদা কি করলে এটা? কেন আমার বাবুটারে নিয়া গেলা? আমারে কেন নিয়া গেলেনা? ওই মেয়েটা শুধু শুধু কষ্ট পাচ্ছে। আমি ওই মেয়ের কান্না সইতে পারিনা খোদা। আমাকে তুমি আমার বাবুর কাছে নিয়া যাও।

বাড়ির উঠোনে গাড়ি এসে থামলো। কয়েকজন মহিলা এসে জড়ো হলো উঠোনে। বলাবলি করলো
‘ পোলা যেমন শান্ত ছিল, বউডা ও শান্ত। এত বড় বাড়ির মাইয়্যা দেমাক দেখিনাই কোনোদিন। জামাই যেমন চলায় তেমন চলতো। আহারে সুখ সইলোনা বেশিদিন। পেটে বাচ্চা ও আইছে। আল্লাহ এ কেমন ভালা করলো কে জানে? বউটার কান্নায় চোখ ভিজে যায়। কত সুন্দর একটা সংসার আছিলো।
নামিরা গাড়ির আওয়াজ শুনে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো। আয়শা বেগম ঘরে থাকতে পারলেন না। আজহার সাহেব চোখ বন্ধ করে ফেলেন। চোখের জল গড়ালেন নীরবে। আয়না ধপ করে বসে পড়লো নিচে। নাওয়াজ শেখ মেয়েকে ধরলেন। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন
‘ মাঝেমাঝে নিয়ে আসবো তো। কাঁদিস না মা। অসুস্থ হয়ে পড়বি।
আয়শা বেগম আসতেই নামিরা হাত বাড়িয়ে দিল। চেঁচিয়ে বলল
‘ আম্মা আমাকে যেতে দিওনা আম্মা। আমাকে আটকাচ্ছ না কেন আম্মা? আম্মারে আমি যাব না এই ঘর ছেড়ে। আমাকে কেন তাড়িয়ে দিচ্ছ? আব্বা কোথায় তুমি? আব্বা? দেখোনা সবাই আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে।

আয়শা বেগম দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। আর গেলেন না। নামিরাকে নিয়ে আসলেন নাওয়াজ শেখ। নামিরা ছাড়াছাড়ি করতে করতে আবার দৌড়ে গেল ঘরের ভেতর। ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো আয়শা বেগমকে। শক্ত করে ধরে বলল
‘ ও আম্মা তুমি যা খাও, আমিও তাই খাবো। আমাকে তাড়িয়ে দিওনা আম্মা। ওই ঘরে আয়ান থাকে, আমি ওকে ছাড়া খুব একা হয়ে যাব। আম্মা একটু বুঝো। এভাবে পর করে দিওনা আম্মা। আম্মা!
আয়শা বেগম টু শব্দ করলেন না। মাথা নামিয়ে রাখলেন। ভালো রাখার জন্য এটুকু শক্ত হতেই হবে। শুধু মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন
‘ আমার বাবুটা চলে গেল। তুই তোর বাবুটারে ভালো রাখিস। তোকে আবার নিয়ে আসবো। আমার ঘরের রাণী তুই।
নামিরাকে আবার নিয়ে গেল নাওয়াজ শেখ। নামিরা কেঁদে উঠে বলল
‘ আম্মা ওরা আমায় আর আসতে দেবে না। আসতে দেবে না আম্মা।
কাঁদতে কাঁদতে আবার জ্ঞান হারায় নামিরা।

নাওয়াজ শেখ মেয়েকে কোলে তুলে নেন। গাড়িতে বসিয়ে দেন। তারপর আয়নার কাছে যায়। গলার স্বর নরম করে বলে,
‘ কিছু টাকা রাখো মেয়ে। তোমার বাবার চিকিৎসা খরচ আর সংসারটা।
আয়না শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। নিল না টাকা। বলল
‘ আপনার মেয়ের এই দশার জন্য আপনি দায়ী। আপনার ক্ষমতা লোভী ভাই দায়ী। ছাড়ব না আমি। দেখে নেব।
নাওয়াজ শেখ কপালে ভাঁজ ফেলে চেয়ে রইলেন। আয়না ভেতরে চলে গেল। আয়ানের ঘরে গিয়ে দেখলো ঘরটা শূন্য, খাঁ খাঁ। কেউ নেই, কেউ নাহ। না ভাই, নাই সেই ভাইয়ের বউ। আয়না মাটিতে বসে পড়লো।

নামিরার জ্ঞান ফিরলো বাড়িতে পৌঁছে। পাগলের মতো প্রলাপ করতে লাগলো সে। নাওয়াজ শেখকে দেখে থেমে গেল কান্না। নাওয়াজ শেখ চোখ মুছে দিতে আসতেই নামিরা জোরে ধাক্কা মারলো। নাজমা বেগমকে বলল
‘ মা এরা খুনী। আয়ানের খুনী। এরা মেরেছে আয়ানকে। বাবা মেরেছে, যাকে আমি বাবা ডাকি, যার ঔরস থেকে আমার জন্ম সেই বাবা আমার সব সুখ কেড়ে নিয়েছে। আমাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। আমার সন্তান বাবা ডাকবে কাকে? মা তোমার স্বামী আমার স্বামীকে মেরে ফেলেছে। তোমার স্বামী খুনী মা। খুনী। নাওয়াজ শেখ শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
নওফুজ শেখ এগিয়ে আসতেই নামিরা ফুলদানি ছুঁড়ে মারলো। বলল
‘ খবরদার এগোবেনা। সম্পত্তির লোভে তুমি মেরে ফেলেছ আয়ানকে। সরিয়ে ফেলেছ? আমার কোনোকিছু লাগবে না। আমাকে শুধু আয়ানকে এনে দাও৷ আমার কিচ্ছু লাগবে না। আয়ানকে এনে দাও। সব নিয়ে নাও শুধু ওকে এনে দাও।

নামিরার কাছে গেল নাওয়াজ শেখ। বলল
‘ মা দেখ আমার দিকে তাকা। আমাকে বল, কি করেছে তোর চাচ্চু?
নামিরা চেঁচিয়ে উঠে বলল
‘ কে আমার চাচ্চু? কে? মরে গেছে চাচ্চু। আমার সেই আগের চাচ্চুটা মরে গেছে। এখন যে আছে সে আমার সন্তানের এতিম হওয়ার কারণ, আয়ানের খুনী। আয়ান সম্পত্তির ভাগ পাবে বলে সরিয়ে ফেলেছে সুযোগ বুঝে। সব তোমার ভাই করেছে। আমি জানি, আয়ান বলেছে কিছুদিন আগে, এই লোকটা তাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে। অনুসরণ করে। আয়ান বলতো আমায়। এই লোক করেছে সব।
নাওয়াজ শেখ নওফুজ শেখের দিকে তাকালো। নওফুজ শেখ বলল
‘ মাথা খারাপ হয়ে গেছে নামিরা? আমি কেন আয়ানকে মারব? ওখানে আমি ছিলাম না। ওখানে আমি গিয়েছি তখন হত্যাযজ্ঞ শেষ হয়ে গিয়েছে। ওখানে রাজনীতির ছেলেপেলে ছিল। ওরাই যাকে পেয়েছে তাকে মেরেছে।

নওফুজ শেখের স্ত্রী হামিদা এসে নাওয়াজ শেখকে বললেন
‘ ভাইজান নামিরার মাথা ঠিক নেই। ওকে ঘরে যেতে দিন। মেয়েটা অসু্স্থ।
নাওয়াজ শেখ মাথা নাড়ালেন। সন্দিগ্ধ চোখে তাকালেন ভাইয়ের দিকে। আর যাইহোক, মেয়ে কখনো বিধবা হোক তিনি তা চাননি। কখনোই চাননি।

______________

সন্ধ্যার দিকে আয়শা বেগম ছুটে আসলেন শেখ বাড়ি। ওই বাড়িটা আঁধার তার ছেলে ছাড়া। তার ছেলের বউ ছাড়া। মন ঠিকেনা ওখানে। কলিজা ছিঁড়ে যায়। শুকনো শুকনো চারপাশটা। হঠাৎ হঠাৎ যেন মনে হয় দূর থেকে গালভরে কেউ একজন আম্মা আম্মা বলে ডাকে। নামিরার গায়ে তখন সাদা শাড়ি। আয়শা বেগম তা দেখে আর ও জোরে কাঁদেন। নামিরা আয়শা বেগমকে দেখে ছুটে আসে। বলে
‘ আম্মা সবাই বলে, সাদা শাড়ি পড়লে নাকি আয়ানের ভালো হবে। তাই পড়লাম। আয়ান চলে আসবে তো আম্মা?
আয়শা বেগম অনবরত কাঁদতে থাকেন। নাজমা বেগম বলল
‘ নামিরার সাথে থাকেন আপা। আমার মেয়েটার একটু ভালো চান। থেকে যান।
আয়শা বেগম এক রাতের জন্য থেকে গেল। নামিরা তার সাথে ঘুমোলো একরাত। হঠাৎ হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠে। মাঝরাতে বউ শ্বাশুড়ির কান্নায় ভারী হয় পরিবেশ। নামিরা জানালা খুলে ঘুটঘুটে অন্ধকার দেখে বলল
‘ আম্মা আয়ান অত অন্ধকারে ভয় পাচ্ছে তো। ও ভয় পাচ্ছে আম্মা। ও কবরে কি করে ঘুমায়? ও অন্ধকার ভয় পায় তো। তুমি জানোনা ও রাত করে বাড়ি ফেরার সময় কতবড় টর্চলাইট ব্যবহার করে। ও ভয় পাচ্ছে আম্মা।
আয়শা বেগম একটা রাত থেকে তারপর চলে আসেন নামিরাকে না বলে। বুকটা ছিঁড়ে যায় মেয়েটার দিকে তাকালে। তার ছেলেটা মেয়েটা ভালো রাখলোনা একটু ও। রাখতে পারলো না। শুধু ভালোবাসলেই হয় না, আগলে রাখতে হয়। পাশে থাকতে হয়। মেয়েটাকে কেমন ভালোবাসলি আব্বা? ফাঁসিয়ে দিয়ে চলে গেলি। আমাদের বুড়ো বুড়ির নাই ভাবলি, মেয়েটার কথা তোর সন্তানের কথা তো ভাবতে পারতি।

_____________

সময় তো থেমে থাকেনা। চলতেই থাকে তার নিজস্ব নিয়মে। নিজের স্বকীয়তা ধরে রাখতে সময়ের কৃপণতা নেই। সে গড়াতেই থাকে। কিন্তু প্রিয়জন হারানোর সেই ব্যাথা, ক্ষতগুলো যেন তাজা থেকে যায়। কমে না সেই ব্যাথা। ক্ষণে ক্ষণে দগ্ধ হতে হয়। পুরোনো ব্যাথাগুলো সহজে যেন কমার নয়। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। সেই দীর্ঘশ্বাসই বলে কতটা যন্ত্রণা ভেতরে পুষে রেখে একজন মানুষ স্বাভাবিক আচরণ করে কিংবা অস্বাভাবিক। রাত বাড়তেই নামিরাকে গ্রাস করে একাকীত্ব। কতটা রাত জেগেছে সে আয়ানের জন্য। মাঝে মাঝে তার রাত ১১টা বেজে যেত ছাপাখানা থেকে ফিরতে। মাঝে মাঝে বারোটার কাছাকাছি। নামিরা জেগে থাকতো। একসাথে খাওয়ার জন্য খেত না। সারাদিন পরিশ্রম করে এসে নামিরাকে এক চিলতে হাসিটা উপহার দিতে ভুল হতোনা প্রাণপ্রিয় স্বামীর। এই যে হাসিটা দিত, এটার মর্মার্থ মানেই নামিরাকে একটুখানি প্রশয় দেওয়া। হৃদয় গলানো একটুখানি আদরে ভাসিয়ে দেওয়া। পকেট থেকে বের করা সেই আচার আর ঝাল চাটনি বের করে বুঝিয়ে দিত সারাদিন পরিশ্রম করে ও প্রিয়তমার করা সেই ছোট্ট ছোট্ট আবদারগুলো সে ভুলে না। ভুলতো না। মাঝেমাঝে পকেটের ভেতর থেকে বের করতো পথশিশু থেকে কেনা মুচড়ে যাওয়া গোলাপ। প্রিয়তমার কানে সেই ফুল গুঁজে দিতে দিতে ততক্ষণে ফুলের সুবাস উদাও। বড্ড মন খারাপ হতো তখন। কিন্তু নাহ ফুল গুঁজে দিতেই যখন সে এক টুকরো হাসি উপহার পেত মনে হতো সেই হাসিটার সুবাস ফুলের চাইতে ও বেশি সুগন্ধ। দিনগুলো যেন হঠাৎ করে কোথায় হারিয়ে গেল।
নামিরার চোখে ঘুম নামেনা রাত গভীর হলেও কারণ তার ঘুমানোর সেই আশ্রয় টুকু হারিয়ে গেছে। যার বক্ষতলে তার ঘুমানো জায়গা ছিল, যার হাতের আঙুলের ভাঁজে তার আঙুল বন্দী হতো রোজ, যার তপ্ত নিঃশ্বাসের ভারে সে নেতিয়ে পড়তো, যার বুকের সাথে লেপ্টে ঘুমানো তার নিত্যদিনের অভ্যাস তার একটু ধরাছোঁয়া ও নেই এই ধরায়। ভুলে ও একটু ছায়া ও আসেনা এই ঘরে। ভুলে কেউ পাশে শুয়ে টেনে নেয়না বক্ষমাঝে। বাবা হওয়া সুবাদে খুশিতে আত্মহারা হওয়া সেই মুখখানা দেখার সৌভাগ্য হলো না তার।
চোখের জল মুছে দিয়ে কপাল ভিজিয়ে দিয়ে কেউ ভরসা দিয়ে বললো না
‘ আমি আছি তো, কিচ্ছু হবে না।
ছোট্ট কুঁড়েঘরের সেই ছোট্ট ঘরটায় কত মধুর স্মৃতিরা ঘুরে বেড়ায়। খুঁজে পায় না কাউকে। ঘরের প্রতিটা বাঁশ কাঠ ও বোধহয় কাঁদে। চুপিচুপি প্রজাপতিরা খেলা করতে ও আসেনা। বড্ড একা লাগে নামিরার। এত আপন মানুষ থাকতে ও যেন মনে হয়, সে ভীষণ একলা একটা মানুষ। কেউ নেই তার। কেউ নেই বলার
‘ তোমাকে আমি একটু বেশিই বুঝি মিরা।

সময় গড়িয়ে তখন চার মাসের মাথায় পড়লো। শায়খ চৌধুরীকে ঠেলে নাওয়াজ শেখ পদে এলেন। কিন্তু মনে শান্তি নেই। মেয়েটা ভালো নেই তার। সারাদিন একঘরে নিজেকে বন্দী করে রাখে। আল্লাহ এ কোন অন্যায়ের শাস্তি দিচ্ছে?

আয়না একবার এসেছিল দেখতে নামিরাকে। আয়শা বেগম ও কয়েকবার এসে দেখে গেলেন। হাতের বানানো পিঠা নিয়ে আসলেন একবার। না খেয়ে না খেয়ে নামিরা শুকিয়ে কাঠ। আয়শা বেগমের আহাজারির শেষ নেই তাকে নিয়ে। আয়না একদিন এল রোদেপুড়ে। নামিরাকে একটুখানি আলো দেখিয়ে গেল, সেই থেকে নামিরার স্বাভাবিক হয়ে উঠার চেষ্টা করলো। আয়না যে বলল একদিন সব ঠিক হয়ে যাবো। আসলেই সব ঠিক হয়ে যাবে তো? নাকি আবার ছলনা? সে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য সবাই নাটক করছে। আয়ান আসবে তার মিরার কাছে?

চারমাসের মাথায় আয়নার বাগানবাড়িতে ফুল এল। রজনীগন্ধার স্টিক আসতে শুরু করেছে। প্রথমবার ফুল তুলে ফুল বিক্রি করার সমস্ত কাজ রহমত মিয়া করলো। আয়না সেদিকে খেয়াল দেয়নি। ফুল বিক্রির প্রথম পর্যায় শেষ হতে না হতেই ফজলু মিয়া মারা গেল। শুক্রবার ছিল দিনটা। আয়না খোঁজ পেয়ে ছুটে এল। চৌধুরী বাড়ি থেকে আনহিতা আর অনিমা আসায় আয়নার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। আয়নার যেন নিজের ভাইয়ের চেহারাটা আবার ভেসে উঠলো। রূপার বুকফাটা কান্না দেখে সে নিজেই কান্নায় ভেঙে পড়লো। জানাজা পড়তে আসা অনুরাগের চোখে পড়লো আয়নাকে। সে ছুটে আসলো। আয়নাকে দাঁড়ানোর জন্য বললো। আয়না দাঁড়ালো না। মুখ তুলে অনুরাগকে দেখলো। বলল
‘ আমার ভাইকে কবে ফিরিয়ে দেবেন? আমি আর পারছিনা। আমি কতদিন আমার ভাইকে দেখিনা।
অনুরাগ বলল
‘ আমার হাতে কিছু নেই আয়নামতী। আমি পারলে তোমার ভাইকে তোমার সামনে এক্ষুনি হাজির করতাম। আমি পারব না।
আয়না কাঁদতে কাঁদতে বলল
‘ তাহলে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? চলে যান আমার সামনে থেকে। আসবেন না আমার সামনে। আপনারা রাজনীতিবিদ। আপনাদের কাছে মানুষের জীবনে খুব তুচ্ছ। মূল্যবান শুধু ক্ষমতা। ক্ষমতা ছাড়া কিচ্ছু বুঝেন না আপনারা।
অনুরাগ বলল
‘ আমি তো ভালোর জন্য, আমি কারো খারাপ করার জন্য দাঁড়াচ্ছি না আয়নামতী। আমি এই অন্যায় রুখে দেওয়ার জন্য।
আয়না বলল
‘ আমার ভাইকে ফিরিয়ে দিতে পারবেন? কি হবে অন্যায়কারীদের শাস্তি দিয়ে? আমার ভাই তো আর ফিরবে না। আমার আম্মা আব্বার কোলে তো তাদের সন্তান আর ফিরে যাবে না।
অনুরাগ আর কিছু বলতে পারলো না। তবে একহাঁটু মুড়ে বসলো আয়নার সামনে। বলল
‘ তোমার এই খারাপ দিনগুলো চলে যাওয়ার জন্য যা করতে হয় আমি তার একটু ও কমতি রাখব না আয়নামতী। দেখো, মানুষের জীবনটা হাসিকান্না সব মিলিয়ে, একপাক্ষিক কোনোকিছু হয় না। হাসির পাশাপাশি কান্না, সুখের পাশাপাশি দুঃখকে বরণ করে নেওয়ায় প্রত্যেকটা মানুষের ধর্ম। প্রকৃতির বিরুদ্ধে তো কিছু হয়না। আমাদের হাত নেই কোনো। তবে উপরওয়ালা যা করেন নিশ্চয়ই ভালো করেন।
আয়না চোখমুখ মুছে বলল।
‘ কিছু ভালো হয়নি। আমার ভাইকে এভাবে কষ্ট দিয়ে মেরে ভালো করেনি উপরওয়ালা। আমার ভাই তো নিষ্পাপ শিশুর মতো ছিল। কারো সাথে তার শত্রুতা ছিল না। তাহলে তার সাথে কেন এমন হলো?
অনুরাগ বলল
‘ খুব আঘাত পেয়েছ তাই একথা বলছ, তবে একদিন এই আঘাত দেখবে ঠিকই মুছে যাবে। শুধু সময়ে অপেক্ষা।
আয়না বলল
‘ সময়?
অনুরাগ বলল
‘ হ্যা।
আয়না মাথা নামিয়ে আবার কাঁদলো। রূপা বেহুশ হয়ে পড়ে আছে এক মহিলার কোলে। আজ থেকে এই মেয়েটির দায়িত্ব তার।
অনুরাগ বলল
‘ রূপার নানা সব কাগজপত্র আমাকে দিয়ে গেছে। সব তোমার নামে করে দিতে বলেছে। আর রূপাকে তোমার দায়িত্বে রেখে গিয়েছে।
মেয়েটাকে তুমি দেখে রেখো। কেউ নেই ওর তুমি ছাড়া।
আয়না তাকিয়ে থাকলো রূপার দিকে। ধীরপায়ে হেঁটে গিয়ে বসলো রূপার কাছে। টেনে নিল নিজের বুকে। জড়িয়ে ধরে ঝরঝরে কেঁদে দিল আওয়াজ করে। তাদের আপনমানুষগুলোকে কেন হারিয়ে যেতে হয়? দুনিয়ার এত কঠিন নিয়ম কেন? হারিয়ে যখন যেতেই হবে তখন কেন মায়া দেয় আল্লাহ? কেন এত বন্ধন দেয়? কেন এত টান দেয়?
রূপাকে নিয়ে আয়না চলে এল তাদের বাড়িত। নতুন করে শুরু হলো জীবনের আরেকটি অধ্যায়।

চলবে,,,,,,,