আ না ম পর্ব-০১

0
153

“আ না ম”-১
-Azyah সূচনা

নিস্তব্ধ ঘর জুড়ে চামচের আওয়াজ। কটকটে রোদের আলো কাঁচের গ্লাস ভেদ করে পড়ছে মোজাইক করা ফোর্স।সাদা সচ্ছ প্লেটে সেজেছে সকালের নাস্তা। বড় ডাইনিং এর দুই প্রান্তে দুজন পুরুষ মাথা ঝুঁকিয়ে পেট পুজো করতে ব্যস্ত।কোনো প্রকার কন্ঠধ্বনি নেই।যেনো খাওয়াটাই মুখ্য উদ্দেশ্য। দ্রুত খাবার শেষ করে ধূসর রঙের তোয়ালেতে হাত মুছে নিলেন ফটাফট।শার্টের হাতা গুটিয়ে ইংরেজি খবরের কাগজ হাতে তুললেন এ্যারিক রোজারিও। ফ্রন্ট পেজের বড় অক্ষরের শিরোনাম এর নিচের অংশে চোখ যায়।

সেখানে লিখিত ছিলো এরূপ,

“দেশ জুড়ে চলছে মৃত্যুর তাণ্ডব।নাম না জানা এক খুনি ঘুরে বেড়াচ্ছে চারিদিকে।একজন সিরিয়াল কিলার।ভিন্ন ভিন্ন স্থানে খুঁজে বেড়াচ্ছে তার শিকার।স্থান ভেদে ভিন্ন ভিন্ন মানুষের মৃত্যুতে আতঙ্কিত সাধারণ জনগন।কে জানে?হয়তো আগামীতে শিকারের তালিকায় উঠতে পারে তাদের মধ্যে কোনো এক সাধারণ মানুষের নাম।অপরাধ তদন্ত বিভাগ দীর্ঘ সময় যাবৎ এই কেসের তদন্ত করে যাচ্ছে।এখন পর্যন্ত কোনো আশানুরূপ সাফল্য আসেনি। উপরী মহল থেকে সিদ্ধান্ত এর অপেক্ষায় আছে সকলে। রহস্য উদঘাটন হবে?নাকি অন্যান্য হাজারো কেসের মতন অমীমাংসিত রয়ে যাবে?”

কাগজের খচখচ আওয়াজে খবরের কাগজের জায়গা হলো ডাইনিং টেবিলের এক কোনায়। চেয়ার পিছু হটিয়ে উঠে দাঁড়ান এ্যারিক রোজারিও। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছেলের পানে প্রখর দৃষ্টি ছুঁড়ে দেন।সে ব্রেড চিবুতে ব্যস্ত। মাত্রাতিরিক্ত ভাজ কপালে ফেলে বললো।

-“খাবার গেলা শেষ হলে লাইব্রেরীতে এসো।ফাস্ট!”

কেমন যেনো এক গুমোটভাব। সর্বদা এই লাইব্রেরী রুমটায় এমনি নিবাত টের পাওয়া যায়। এমনিতে গ্রন্থাগারকে নীরবতার সাথেই তুলনা করা হয়।পুস্তক সঞ্চয় ভান্ডারের জ্ঞান দৃষ্টিতে ধারণ করে মস্তিষ্কে জমা করা হয়।এই নিস্তব্ধতা কখনো ভয়ঙ্কর। মনে হয়! ভয়ঙ্কর পরিবেশে আহরিত হচ্ছে জ্ঞান।ভারী নিঃশ্বাসের ফোঁসফোঁস ধ্বনি ব্যতীত আর কোনো শব্দ আগমনের উপায় নেই।তবে আজ শোনা যাবে কন্ঠস্বর।রাগী,তেজী পুরুষালি ভার স্বর।

-“একটা কেস সলভ করতে পারছো না?একটা খুনিকে ধরতে পারছো না?গুনে গুনে এক বছর চারমাস!একের পর এক মানুষ খুন হচ্ছে আর তুমি এখন পর্যন্ত ক্লু খুঁজে যাচ্ছো ড্যাম ইট!”

এ্যারিক রোজারিও অপমানজনিত সুরে ছেলের দিকে কথাগুলো ছুঁড়েছেন।তাচ্ছিল্যে টইটুম্বুর।এই তীক্ষ্ণতায় চক্ষু নত রবিন রোজারিও এর। ললাটের মধ্যিভাগে দুখানা আঙ্গুল চেপে বসে আছে বড়সড় লাইব্রেরী রুমে। আটটা ফাইল।বাকি তিনটে এখনও ফাইলই করা হয়নি।প্রত্যেকটা ভিন্ন ভিন্ন মার্ডার কেস।ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়।কারণও তাদের ভিন্ন।একটাও সলভ হয়নি।হচ্ছে না।অনেক চেষ্টা করার পরও হচ্ছে না।

-“লুক অ্যাট মি রবিন।”

লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে রবিন দৃষ্টি নিবেশ করে বাবার দিকে।বলে ফেলে চট করে,

-“বাবা অ্যাম ট্রাইং!”

কালচে খয়েরী রঙের টেবিলে জোরেশোরে হাত রাখেন এ্যারিক।চেচিয়ে বলেন,

-“তোমার ট্রায়!তোমার ট্রায় তোমার কাছেই রাখো।আর কত ট্রায় করবে?তোমার একটা কেসে ট্রায় করতে করতে অন্য মার্ডার হয়ে যাচ্ছে।”

দুহাতে চুল খামচে ধরে রবিন বলল,

-“কোনো ক্লু বের করতে পারছি না বাবা।অন্যান্য শহরের সিআইডি ব্যুরো এর অফিসারদের দ্বারাও কিছু হচ্ছে না। খুনগুলো এক জায়গায় হচ্ছে না বাবা।ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় হচ্ছে।আমি ঢাকা থাকলে চট্টগ্রামে খুন হয়।চট্টগ্রাম থাকলে খুলনায়।আমার মাথা কাজ করছে না।এত এত খুন!”

-“সাব ইন্সপেক্টর রবিন রোজারিও!খুন ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন মানুষের হলেও খুন করছে একজনই”

মাথা তুলে বাবার দিকে চেয়ে বলল,

-“তুমি কি সেই লেখাটার প্রেক্ষিতে বলছো?”

-“হ্যাঁ।প্রত্যেকটা ভিক্টিম এর কপালে কি লেখা থাকে তুমি জানো না? দেখোনি?”

আরাম কেদারায় পিঠ এলায় রবিন।মাথার উপর জ্বলজ্বল করা হলুদ বাল্ব এর দিকে এক ধ্যানে চাইলো।চোখ ধাঁধাতে শুরু করেছে।মস্তিষ্কে শুধু একটা শব্দ;একটা প্রতিচ্ছবি ঘুরছে।প্রত্যেক লাশের কপালে লিখিত সেই ইংরেজি শব্দ,

“লুজার”

আজকাল নিজেকেও ওই লুজারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে ইচ্ছে হচ্ছে।অপরাধ তদন্ত বিভাগে কর্মরত আছে অল্প সময় যাবত নয়।কত কেস দেখেছে।কত অপরাধ ঘটেছে।কত রহস্য উদঘাটন করেছে। বিগত এক বছর চারমাস যাবৎ তার পতন ঘটছে।বাবাকে উপর মহল চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে বারংবার।খুবই ক্রিটিকাল সিচুয়েশন।কত মানুষ এলার্ট কত লোক লাগিয়ে রেখেছে চারপাশে।ফলাফল শূন্য। খুনিতো দূরের কথা তার ছায়াটা অব্দি পাওয়া যাচ্ছে না। এ্যারিক রোজারিও এর রেগে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।সেও ছিলো এই সংস্থায়।সফল ছিলেন তার কর্মে। চারশত কেস সলভ করেছেন নিজের কর্ম জীবনে। রিটায়ার্ড করার পরও তাকে মানুষ সম্মান করে।এক নামে চেনে।তারই ছেলে একটা কেসের পেছনে এত সময় নিয়ে পড়ে আছে পুলিশি মহলে সমালোচনার শেষ নেই।

রাতের আধারে কালো জিপ নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।মানসিক শান্তি দরকার। ব্যুরোতে যাবে।কেস সলভ করার জন্য নিজে প্রত্যেকটা কেস স্টাডি করবে শুরু থেকে।কোনো না কোনো ভুল অবশ্যই করেছে খুনি।একটা ছোট্ট কিটের মতনও কোনো ভুল যদি পায়?

বড়ো বোর্ডের উপর এক এক করে প্রত্যেকটা ভিকটিম এর ছবি টানানো।এগারো জনের মৃত দেহ।কপালে লাল কালিতে লিখিত ‘ লুজার ‘ শব্দটা। তাছাড়া আর কোনো চিহ্নতো নেই। প্রত্যেকটা মানুষকে।প্রত্যেকটা মানুষকে এক ভিন্ন ধরনের পয়জন দেওয়া হচ্ছে।দেহে প্রবেশের দশ ঘণ্টার মধ্যে একজন সুস্থ সবল মানুষকে শেষ করতে সক্ষম।

মনোযোগী হতে শুরু করার পূর্বমুহূর্তেই মনোযোগ হরণ হলো।ফোন ভাইব্রেট করছে।নাম ভাসলো ‘ভবঘুরে’।ইজি চেয়ারে নিজেকে শান্ত করে ফোন রিসিভ করে রবিন।অন্যপাশ থেকে আওয়াজ আসলো,

-“এত রাতে ব্যুরোতে যাওয়া কি খুব জরুরী?”

রবিন এর তরফ থেকে উত্তর আসে,

-“তোমার ভবঘুরের মতন এক শহর থেকে অন্য শহরে ঘুরে বেড়ানোটাও কি খুব জরুরী?”

-“মনের শান্তি বড় শান্তি।”

-“সেটা হয়ে দাড়ায় আমার জন্য অশান্তি।তুমি মেয়ে মানুষ কেনো বুঝো না? সোলো ট্রাভেল করা অত্যন্ত রিস্কি”

-“বুঝবো না।যে পর্যন্ত রামশা ডিসুজা থেকে রামশা রবিন রোজারিও না হবো ততদিন তোমার কোনো বারণ মানবো না।”

অপরাধের কেস এর চেয়ে ব্যক্তিগত কেসটা বেশি জটিল। বছর দুয়েক আগে তীব্র শৈত্যপ্রবাহে সাক্ষাৎ হয়েছিলো এই নারীর সঙ্গে।এরপর থেকে শেষ নিঃশ্বাস অব্দি পিছু নেওয়ার পণ করেছে।বলেছে পিছু নিবে সবখানে।ছেড়ে যাওয়াই যদি আধুনিক প্রেমের নিয়ম হয়?তাহলে এই নিয়ম ভাঙবে সে নিজ হাতে।সেই গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাওয়া নিয়ম নিজ হাতে তুলে দেখাবে সমগ্র মানবজাতিকে।আবারো এক লম্বা শ্বাস ফেলে রবিন।

বলে,

-“বাবা আমাকে খাবার দেওয়া বন্ধ করে দিবে এই কেস সলভ না হলে।আর যদি শুনে বিয়ে করতে চাচ্ছি তাহলে পৃথিবী ছাড়াও করতে পারে।”

-“বিয়ের বয়স হচ্ছে। বিয়ে একটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সামাজিক রীতি।” উত্তর দেয় রামশা।

-“যত সহজে বলে ফেলছ তার চেয়ে অনেক বেশি জটিল।”

-“দৃষ্টিভঙ্গি সহজ করলেই পারো”

আকস্মিক আবেগপ্রবন হয়ে উঠে রবিন। কাতর কন্ঠে বলল,

-“আই লাভ ইউ এলোট।আই ওয়ান্ট টু ম্যারি ইউ।কিন্তু!….আর কিছুদিন অপেক্ষা করো।এবার পাক্কা প্রমিজ। কেসটা আমি সলভ করবোই।”

রবিনের মন ভালো করতে রামশা বললো,

-“আমার কি মনে হয় জানো?তুমি আমার চেয়ে বেশি অপরাধকে ভালোবাসো। ভিক্টিমকে ভালোবাসো; ক্রিমিনালকে ভালোবাসো।সারাদিন এদের দিয়েই পড়ে থাকো” বলেই হেসে উঠলো রামশা।

রবিনও স্মিথ হাসে। অতিরিক্ত হাসি না আবার অপরাধী থেকে একশত গুন দূরে ঠেলে দেয়। রামশা এর দুষ্টুমির উদ্দেশ্য বুঝে রবিন।

বললো, -“মন ভালো করতে জানো কিন্তু”

-“এতো আমার দায়িত্ব।আমার হবু লাইফ পার্টনার এর মন সবসময় তরতাজা,সতেজ রাখতে হবে।”

গভীর গলায় আওরায় রবিন, -“আই মিস ইউ”

-“কাল দেখা করি?মিস করছো যেহেতু।”

-“ঢাকা এসেছো?”

-“আধ ঘন্টা আগেই ফিরলাম।তোমাকে কক্স বাজারের অনেক গল্প শোনানোর আছে।”

-“রাতের বাসে চড়তে নিষেধ করেছি কিন্তু রামশা।”

-“উফ!এত ভীতু কেনো তুমি?আমি মার্শালাট জানি সেটা ভুলে গেছো।এক লাথি দিয়ে উড়িয়ে দেবো দশ বারোজনকে”

রামশার ছেলে মানুষী কথা শুনে রবিনের মুখ ফুটে বেড়িয়ে এলো,

-“পাগল কোথাকার।”

-“আপনার দোষে পাগল মিষ্টার রোজারিও”

-“রাখছি। কাল সন্ধ্যায় রুফ গার্ডেনে চলে আসবে।”

_

-“হ্যালো সাব ইন্সপেক্টর শাবাব স্পিকিং”

উত্তরে রবিন বলল, -“হ্যালো অফিসার।আমি এস. আই রবিন রোজারিও, ঢাকা ব্যুরো।”

চট্টগ্রাম অপরাধ তদন্ত বিভাগের এস. আই শাবাব দ্রুত গতিতে চিনে ফেললো রবিনকে।জানতো শাবাব।কলটা আসবে।কিন্তু এত দ্রুত আসবে সেটা ভাবতে পারেনি।ফোনের অন্যপাশে হালকা মুচকি হাসিটা রবিনের আড়ালেই রয়ে গেলো।একটা কেস এর পেছনে অনেক সময় নিচ্ছে রবিন এটাও অজানা নয় শাবাবের।আগে কল করলে একসাথে কাজ করা যেত।একের চেয়ে ভালো দুই।অপরাধের কারণ আর অপরাধীকে ধরা নিজেদের সেলফ ইগো থেকে বেশি দরকারি।মাথার পেছনে এক হাত রেখে অন্যহাতে ফোন চেপে আছে শাবাব।এখনই রবিন বলবে তার মনমত কথা।এতদিন যাবততো এটাই চাচ্ছিলো।এই কেসটা হোক নিজে সামলাবে নাহয় রবিন আর সে একত্রে।

শাবাব বললো,

-“স্যার এ্যারিক রোজারিও এর ছেলে তাই না?কেমন আছেন?”

-“আম ফাইন ইন্সপেক্টর।”

-“তা আমাকে কল করলেন যে?”

ফোনটা সামান্য দুরত্বে রাখলো রবিন।মুখ ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ফেলে।চোখ বুজে প্রস্তুত করে।পরপর বললো,

-“আপনিতো জানেন একটা কেস বেশ কিছুদিন যাবত আমরা সলভ করার চেষ্টা করছি।কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে অসফল।এবার আমার মনে হলো টাইড ইনভেস্টিগেশন দরকার।তার জন্য আমার আপনার সাহায্য চাই।আপনার নাম শুনেছি এস. আই শাবাব।আপনার পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে আমার মনে হলো আমরা দুজনে একসাথে এই কেসটা হাতে নিলে অল্প সময়ে সফলতা পাবো।”

হ্যাঁ অথবা না কোনো উত্তর দিলো না শাবাব।রবিনের কথার প্রেক্ষিতে তেমন কোনো বিশ্লেষণমূলক কথাও বললো না।লম্বা নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে ছেড়ে দেয় পরপর।শুধু ইঙ্গিত দিয়ে বললো,

-“চট্টগ্রাম আসুন। বিস্তারিত আলোচনা হবে।”

চাইলে সেও ঢাকা আসতে পারতো।কথার ধাঁচে অহংকার মনে হলো।তারপরও রবিন বাধ্য।বাধ্য বাবার কাছে,কর্মের কাছে।বললো,

-“শিউর।আপনাকে জানাবো কবে আসছি।আপনার হাতে অন্য কোনো কেস আছে এখন?”

-“জ্বি না।তবে আপনার কেসটাই দেখছিলাম।স্টাডি করছিলাম।অনেক কিছু আলোচনার আছে।সম্ভব হলে দ্রুত আসবেন।আমাদের দেরির ফলে আরেকটা খুন যেনো না হয়ে যায়”

__

“আমরা এক যন্ত্র,
যাকে ‘মানুষ’ বলে ডাকা হয়।
মাঝেমধ্যে হৃদয়ের চৈতন্যে ভুগি,
আবার কখনো মস্তিষ্কের ধড়িবাজিতে।”

সুঠাম কায়া রেলিংয়ে হেলান দিয়ে আছে। পনেরো তলা বিশিষ্ট বিশাল বিল্ডিংয়ের নিচে দেখা যাচ্ছে মায়ার শহর। অম্বরে সমাহার শশাঙ্ক আর তারার মেলা।উপর থেকে তড়িৎ গতিতে নিচে চোখ ফেরালে দেখা যায় কৃত্রিম আলোয় চকচক করা শহর। দুর থেকে দেখে এই শহর,এই দেশ,এই পৃথিবীকে যত সহজ,সুন্দর মনে হয়? আদৌতে কি তাই?এই আধার আড়ালে ছুটবে মানুষ অপরাধের নেশায়।

জুতোর খটখট শব্দে হাত নামায় শাবাব।পিছু ফিরে তাকায়। পুরো ছাদ জুড়ে আরো একটি নারী অস্তিত্বের আগমন।এসেই পিছনে হাত বাঁধলো।

সম্মান আর বিনয়ের সুরে বলল,

-“জিপ রেডি স্যার। বেরোতে হবে।”

শাবাব বললো, -‘জায়গার নাম বলো?”

-“এখান থেকে এক কিলোমিটার দূরে যে জঙ্গল আছে?সেই জঙ্গলের পাশের রাস্তায়।”

শাবাব কপাল কুঁচকে বললো,

-“উফ সাইফা!তোমাকে বলেছি অন্তত চট্টগ্রামের ম্যাপটা স্টাডি করো।এখনও কোনো এরিয়ার নাম জানো না।অসহ্য!”

শাবাবের উত্তরে ব্যথিত হয় হৃদয়।তবে ভুলতো তারই। অপরাধ তদন্ত বিভাগে শুধু অপরাধীকে ধরার বিচক্ষণ মস্তিষ্ক নয়। ভূগোলবিদ্যায়ও পারদর্শী হতে হয়। হাটা ধরেছে শাবাব। সাইফা গতি বাড়িয়ে এগিয়ে গেলো লিফটের দিকে।বোতাম চাপার আগেই তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকায় শাবাব। সাইফা ঢোক গিললো।কারণ দুটো।এক, কোনো কাজে যাওয়ার আগে মেজাজ চড়াও থাকে এস. আই শাবাবের।দ্বিতীয় কারণ ভাবার আগেই সিড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলো শাবাব।সিড়ি বেয়ে উঠবে আবার সিড়ি বেয়েই নামবে।এটাই দুই নম্বর কারণ।
ঘন সবুজ ঘেরা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এক সরু রাস্তা বয়ে গেছে।নেই কোনো যানবাহন আর নাই কোনো মানুষ আছে।এই রাস্তার কোন ঘেঁষে শির উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে রাশি রাশি ল্যাম্পপোস্ট।হাত পা ছড়িয়ে জমিনে পড়ে থাকা এক প্রাণহীন পুরুষের দেহে আলো ছড়াচ্ছে। ফরেন্সিক টিম আগেই এসে হাজির।পাশে অ্যাম্বুলেন্সও।আরো এক জিপ এসে থামলো।দ্রুত পায়ে সাইফা এগোলেও শাবাবের পায়ের গতি অত্যন্ত ধিমে।সামনে একটি লাশ পড়ে আছে তাতে তার কোনো ইয়াত্তা নেই।হাঁটছে আপন গতিতে। মৃতদেহের সামনে এসে হাঁটু ভাঁজ করে বসলো।হাত উচু করে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করলো সাইফাকে।

বোকা সাইফা।বুঝতে পারলো না কি চাচ্ছে শাবাব। আমতা আমতা করে জানতে চাইলো,

-“কি..কি চাই স্যার?”

শাবাব মুখ তুললো।ঠোঁট জুড়ে হাসির রেখা ফুটিয়ে অবলীলায় বলে ফেললো,

-“গ্লাভস দাও আহাম্মক!”

ইশারা না বুঝলেও হাসি দিয়ে অপমানটা বেশ বুঝেছে সাইফা।মনে বেদনা দ্বিগুণ হলো।ঠোঁট চেপে নিলো আপনাআপনি।নতুন বলে সিনিয়ররা এভাবে তাচ্ছিল্য করবে? শিখিয়ে পড়িয়েওতো নিতে পারে? নাক ফুলিয়ে গ্লাফস এগিয়ে দিয়েছে।নিজেও হাতে সাদা রঙের গ্লাফস পড়ে হাঁটু ভাঁজ করে বসলো। শাবাব নিস্তেজ দেহের মুখ এদিক ওদিক বেকিয়ে দেখলো।তবে চোখ ঠেকে এক জায়গায়।কপালে লিখিত সেই শব্দ।

“লুজার”

হাত ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায় শাবাব। সাইফাকে বডি চেক করতে বলে ফোন বের করলো পকেট থেকে।কয়েক মিলি সেকেন্ডে ফোন মেলায়।
অন্যপাশ থেকে ফোন রিসিভ হতেই শাবাব বললো,

-“কতদূর?”

-“আম অন দ্যা ওয়ে ইন্সপেক্টর।”

-“আপনার জন্য গুড নিউজ আছে।”

রবিন চমকালো। গুড নিউজ? উৎসাহী গলায় জানতে চাইলো,

-“কি গুড নিউজ?”

-“আরেকটা মার্ডার হয়ে গেছে”

কি অদ্ভুত! ফোন কানে রেখে কিছুক্ষন থম বনে রইলো রবিন। মার্ডার হয়েছে।এটা গুড নিউজ?আসলেই? আজব মানুষতো বাপু।হতেও পারে হেয় করছে রবিনকে। শুনেছে শাবাব প্রতিদ্বন্দ্বী মানসিকতার।রাগ হচ্ছে।কাজের খাতিরে সেটিও সংবরণ করে নিলো। চোয়াল শক্ত করে জবাব দিল,

-“আমি ওয়ান অ্যান্ড হাফ আওয়ার এর মধ্যে চট্টগ্রাম ব্যুরোতে পৌঁছাচ্ছি”

শাবাব জবাব দেয় হেঁয়ালি করে,

-“সময়টা অনেক দীর্ঘ…বাট ইটস ওকে। আই’ল ওয়েট”

সাইফা নামক মেয়েটাকে ভীষণ বিরক্ত লাগে শাবাবের।কারণ? জানা নেই।হয়তো যেকোনো বিষয়ে মেয়েটি ভীষণ নার্ভাস তাই। ঝটপট কাজ করতে পারেই না।ফোন আলাপের সময়কালীন পেছনে দাড়িয়ে হা করে ছিলো।সেটাও অজানা নয় শাবাবের।পেছনে ফিরে চাইলো।
ভনিতা করে হেসে জানতে চাইলো,

-“আমি কি দেখতে খুব সুন্দর সাইফা?”

থতমত খেয়ে গেল সাইফা।কেমন ধরনের প্রশ্ন এটা?চোখ পিটপিট করে মাথা নাড়ায়।মুখ ফস্কে বেরিয়ে যায়,

-“নাহ!… নাহ স্যার”

-“আমায় অসুন্দর বলছো?”

আরেকদফা কথার মারপ্যাঁচে পড়ে জবাব দেয়,

-“আমি সেটা বলিনি স্যার?”

-“বুঝি না তোমাকে সি. আই. ডিতে কে এনে ফেলে রেখে গেলো।একজন মানুষ সুন্দর আর অসুন্দর দুটো একসাথে কি করে হয়?”

অপমানিত হতে হতে একদিন ডিপ্রেশনে ডুবে যাবে।উদ্ধার করার জন্য তথাকথিত সিনিয়র ইন্সপেক্টর শাবাব হাতটা পর্যন্ত এগিয়ে দেবে না।শুধু কোমরে হাত রেখে বলবে -আহাম্মক একটা।চক্ষু নত করে কাটকাট দাঁড়িয়ে রইলো।উত্তর দেওয়ার সাহস নেই।

-“মির্জা আছে ব্যুরোতে।নিজের মগজটা ভালোভাবে চেক করিয়ে নেবে তার কাছে।”

মুখে মধু পড়েনি ছোটবেলায়।তারই প্রমাণ শাবাবের রুক্ষ গলা আর বাচন।তাকে কি পাগল ভেবেছে?পাগলের ডাক্তারের কাছে কেনো যাবে? মির্জার কাজ নিজের মনোবিজ্ঞানী মস্তিষ্ককে কাজে লাগিয়ে অপরাধীকে পাকড়াও করতে সাহায্য করা।একজন সাইবার এক্সপার্ট সাইফা আহমেদ এর চিকিৎসা করবে সে?

বিষাদগ্রস্ত মন নিয়ে সামান্য দ্রুত গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে।সস্তি মিলছে না একটু দুঃখবিলাসেও। তীব্র সিগারেটের ধোঁয়া বাতাসে উড়ে সাইফার নাকে মুখে।পাশে বসা মানুষটি মাঝেমধ্যে সিগারেটের কোম্পানি খালি করে দিতে সক্ষম।আর মাঝেমধ্যে সিগারেট এমনভাবে অবজ্ঞা করবে যেনো কখনো ছুঁয়েও দেখেনি।ভাবনা চিন্তার ঘোর কাটলো বিকট আওয়াজে।গভীর রাতে জঙ্গলের এলাকা ক্রস করার পূর্বেই কেউ গুলি ছুঁড়েছে। অপ্রস্তুত শাবাব এবং সাইফা উভয়ই মাথা ঝুঁকিয়ে নিল।গাড়ি নিয়ন্ত্রন হারিয়ে গাছ বরাবর গিয়ে লেগেছে।

চলবে…