আ না ম পর্ব-৯+১০

0
81

“আনাম”- ৯
-Azyah সূচনা

কিছু মানুষ বিনা কারণে অপছন্দের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।হোক পরিচিত অথবা অপরিচিত।কাছের অথবা দূরের। শাবাবের অধিক বিরক্তির একটা লিস্ট আছে। সেখানটায় সর্বপ্রথম নাম যোগ হলো লিয়ানার।তার অস্তিত্ব অসহ্য লাগছে। বিভীষিকাময় এক নারীর সহসেও তার চরম আক্রোশ।কি করে মুখের উপর বলে ফেললো অতিরিক্ত ইগো আর অ্যাটিটিউড এর কথা?অথচ দিব্যি গাড়িতে বসে বাহিরের পরিবেশ দেখছে। ঘাড় ঘোরায়নি অল্প সময়ের জন্যও। পথতো অল্প নয়।চার ঘণ্টা অন্তত।পাশে ড্রাইভ করছে রবিন।তার পাশেই বিরক্তিতে ঠাসা শাবাব।পিছনের সিটে জায়গা হয়েছে দুই রমণীর।দুজনের মধ্যে একজনকেও শাবাবের পছন্দ নয়।

লিয়ানা মুখ ঘোরালো।গাড়ীর ফ্রন্ট মিররে চাইতেই দেখতে পেলো শাবাব আর রবিনকে।একজন মনোযোগী।আরেকজন চরম বিরক্ত।মাথা এলিয়ে দিল গাড়ীর সিটে।

তখনই রবিন বলে উঠে, -“মিস লিয়ানা আপনাকে কোথায় ড্রপ করতে হবে?”

-“আমি বলবো।চিন্তার কারণ নেই”

রবিন সামান্য হেসে বললো, -“আপনার বাড়ি আবার জঙ্গলে নাতো?আপনি যেই গাছ প্রেমী বাব্বাহ!”

শাবাব আর লিয়ানা ব্যতীত রামশা আর রবিন হেসে উঠে।লিয়ানার ঠোঁটের এক কোণে সামান্য মিথ্যে হাসি দেখা যায়। শাবাব বসে আছে মূর্তির মতোন।যেনো তাদের মাঝে থেকেও নেই।কোনো কথা শুনছে না।

রামশা হাসি থামিয়ে জবাব দেয়, -“তুমি জানো রবিন?এই পিচ্চি মেয়েটা কত ভালো কাজ করে?আর তুমি ওকে নিয়ে মজা করছো না?”

এবার আরচোখে চাইলো শাবাব।লিয়ানা নির্বিকার।রবিন জানতে চেয়ে প্রশ্ন করে,

-“কি ভালো কাজ?”

-“ওর নিজের একটা আশ্রম আছে।যেখানে বৃদ্ধ বয়সের মানুষ আর পরিবারহীন বাচ্চারা থাকে।সেখানেই থাকে লিয়ানা।ঐটাই ওর বাড়ি।”

-“বাহ! খুবই ভালো চিন্তাধারা আপনার।”

লিয়ানা সবার সম্মুখে বলে উঠে,

-“চিন্তাধারা সুন্দর হতে হয়।ভালো কয়জনের হয়?”

ফোঁসফোঁস নিঃশ্বাস ফেলে শাবাব। নীরব শ্রোতার কাছে একদমই পছন্দ হচ্ছে না এসব কথোপকথন।রবিন বুঝতে পারে শাবাবের ব্যাপারটা।আর কথা বাড়ালো না। নীরবতায় কেটেছে সারা পথ। কক্স বাজারে প্রবেশের পরপরই রামশা জানায় আশ্রমের লোকেশন।নিজ থেকে আর বেশি কিছু বলতে হয়নি লিয়ানার।রবিনের গাড়িকে লক্ষ্য করে সাইফাদের গাড়িও ‘শূন্য আশ্রম’ এর দরজায় এসে থেমেছে।রবিন আর রামশা নেমে দাঁড়ায়।বিদায় দেবে লিয়ানাকে। শাবাব সামান্য মুখ ঘুরিয়ে ভুতুড়ে আশ্রমের দিকে নজর বুলায় কয়েকবার।তাদের দেখাদেখি সাইফাও নেমে এলো।

রামশা রবিনের দিকে চেয়ে বলল, -“আমি লিয়ানার সাথে থাকি?”

রবিনের অভিব্যক্তি নাখোশ।চাইছে না আশ্রমে থাকুক সে।তবে লিয়ানার সামনে সরাসরি নাও করতে পারলো না।চুপচাপ ঠোঁট ভেজায় দাঁড়িয়ে।লিয়ানা সঠিক বুঝলো রবিনের মনের কথা।

বললো, -“শুধু রামশা কেনো?আপনারা সকলেই থাকতে পারেন এখানে।”

রবিন জবাব দেয়, -“না না এটা কিভাবে হয়!”

সাইফাও নীচু দুষ্টু হেসে বলে উঠে, -“শাবাব স্যার এটা কখনো হতে দিবে না মেয়ে।আমরা ফ্রি সময় হলে ঠিক আসবো তোমার সাথে দেখা করতে কেমন?”

সময়ের অপচয় তীক্ষ্ণতার মাত্রা বাড়িয়ে তুললো।হনহন করে বেরিয়ে আসে শাবাব।কি এমন বিদায় অনুষ্ঠান চলছে তাদের?সেও দেখুক।এসেই তার ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠে,

-“হয়নি আপনাদের?”

কেউ কোনো জবাব দিলো না। সাইফা কিছু বলতে যাওয়ার পূর্বেই লিয়ানা কদম এগোয়।শাবাবের দিকে।আবারো দাঁড়িয়েছে সোজা শক্ত হয়ে শাবাবের সামনে।সেই প্রথমদিনের মতন সাহসিকতায় পরিপূর্ণ দৃষ্টি।

বলে উঠলো, -“ইনভাইট করছিলাম আপনাদের।আমার আশ্রমে আতিথেয়তা গ্রহণ করুন।”

-“আমরা হোটেলে থাকবো”

-“ইচ্ছা আপনাদের!”

শাবাব রাজি হয়নি।তবে রামশা জোর করেই রয়ে গেছে লিয়ানার সাথে। পরিস্থিতির দায়ে চুপ ছিলো রবিনও।কল করে আচ্ছামত শায়েস্তা করবে এই মেয়েকে।একে একে দুটো গাড়ি গতি ধরেছে।পনেরো মিনিটের দুরত্বে হোটেল।সাধারণ মানুষ হিসেবেই চেক ইন করে আলাদা ভাবে।পরিচয় গোপন রেখে। গাড়িও এনেছে ভিন্ন।নিজেদের ব্যক্তিগত।

__

-“কি ভাবছো মির্জা?”

হোটেল বারান্দায় দুই পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। উচ্চতায় স্থান পেয়েছে।ছয় তলায় রুমের পাশের বারান্দাটাও বিশাল। শাবাব কাঁধ ঠেকিয়ে আছে দেয়ালের সাথে। ঠোঁটের মধ্যিখানে সিগারেট।মির্জার দিকে প্রশ্ন এগিয়ে দিয়ে লাইটার জ্বালাচ্ছে।বাঁকানো ঘাড় আর চক্ষু নত।মির্জা দেখলো তাকে সামান্য ঘুরে।

নিজের ভাবনার বিশ্লেষণ না করেই উল্টো প্রশ্ন করে,

-“ধোঁয়া উড়িয়ে কি শান্তি পাও?”

-“শান্তি পাই কে বলেছে?”

উত্তরের সাথেসাথেই নাক মুখ থেকে সিগারেটের ধোঁয়া নির্গত হয়।এক টান শেষেই সোজা হয়ে দাড়ালো শাবাব।মুখ তুললো শূন্যে।বৃদ্ধাঙ্গুল আর তর্জনী আঙ্গুলের মধ্যিখানে ঠায় হয়েছে জ্বলন্ত সিগারেট এর।

মির্জা বললো, -“তাহলে চেইন স্মোকার এর মতন স্মোক করো কেনো?আর মাঝেমধ্যে এমনভাবে ছেড়ে দাও যেনো কোনোদিন সিগারেট ছুঁয়েও দেখোনি।”

ইন করা শার্টটা ঝাড়া দেয় শাবাব।শার্টের হাতা গুটিয়ে নিল।কথার মাঝেমাঝে তার কর্মকাণ্ডগুলো চোখে পড়ছে মির্জার।চিনে বিগত তিন বছর যাবত।আজ অব্দি বোঝার চেষ্টায় তাকে।

শাবাব নিজের কাজ শেষ করে বলে উঠে,

-“সবকিছুরই প্রয়োজন আছে।কিন্তু প্রয়োজনকে স্বভাব বানানো যাবে না।অভ্যাসে পরিণত করা যাবে না।এইযে আমার এখন প্রবল ইচ্ছে হচ্ছিলো একটা সিগারেট ধরাই।চাইলেই এই অর্ধ সিগারেট ফেলে দেওয়ার মতন গাটস আমার আছে।ইচ্ছে থাকা ভালো তবে এডিকশন না।”

-“নাইস কনসেপ্ট!”

ঠিক যেমনটা বলেছে শাবাব।পাশে থাকা ডাস্টবিনে ফেলে দিলো সিগারেট।পিঠ এলিয়ে দাঁড়ালো দেয়ালে। ফোন হাতে তুলে বলতে লাগলো,

-“কি ভাবছিলে তুমি?বললে না যে?”

-“আমি লিয়ানা নামের মেয়েটার কথা ভাবছিলাম”

-“ওই পাগলটার কথা?কেনো মাথা ঘামাচ্ছ ওকে নিয়ে?”

-“না শাবাব।সে ভয়ঙ্কর মানসিক অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।”

-“মানে?”

-“সাইকোসিস সম্পর্কে জানো?

-“নো” বেখেয়ালি হয়ে উত্তর দেয় শাবাব।

-“এটা একটা মানসিক অবস্থা।যেখানে একজন মানুষ ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে।বাস্তবতা থেকে দূরে এক ভিন্ন জগতে থাকার প্রবণতা দেখা যায় তাদের মধ্যে।”

-“সাউন্ডস ইন্টারেস্টিং! ব্যাপারটা বিস্তারিত বলো দেখি।”

শাবাবকে উৎসাহী দেখালো।আগ্রহী তার গলার আওয়াজ।বিস্তারিত জানতে চায়। মির্জাও উদ্যত হলো।বলতে লাগলো,

-“এই ধরনের রোগীরা বিশেষত কল্পনার জগতে বসবাস করে।বাস্তবতা থেকে অনেকটা দূরে। যা স্বাভাবিক মানুষের চোখে অদ্ভূত লাগতে পারে।তারা কল্পনাটাকেই বিশ্বাস করে বসে থাকে।যেমনটা লিয়ানা করছে।সিজোফ্রেনিয়া আর বাইপোলার ডিসঅর্ডার।এই দুটো মানসিক রোগ সাইকোসিস এর প্রাথমিক কারণ।”

মনোযোগ সহকারে মির্জার কথাগুলো শুনলো শাবাব। মনোনিবেশকালীন ভ্রু কুঁচকে আছে তার। মির্জার কথার শেষে পলক ঝাপটে শাবাব বলে,

-“সিজোফ্রেনিয়া আর বাইপোলার ডিসঅর্ডার কি?”

নিজের জ্ঞান ভান্ডারের মধ্য থেকে সহজ সরল ভাষা খুঁজে মির্জা উত্তর দেয়,

-“সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রোগীরা হ্যালুসিনেট করে, ডিলিউশন।যেমন ধরো এমন কিছুর উপর প্রখর বিশ্বাস যেটার বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই। অবাস্তবিক ধারণা পোষণ করে বাঁচে। হ্যালুসিনেশন আর ডিলিউশন মোটামুটি কাছাকাছি।ঘুরে ফিরে বিভ্রম আর অবাস্তবিক ধারণাকেই বোঝায়।”

-“আর বাইপোলার ডিসঅর্ডার?”

-“বাইপোলার ডিসঅর্ডারে হয় কি?এরা এদের মেজাজ বারবার পরিবর্তন হয়।কখনো খুব হাসিখুশি আবার কখনো বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে।”

শাবাব বললো, -“তো তুমি কি ভাবছো?লিয়ানা মেয়েটা একজন মানসিক রোগী?”

মির্জা নিঃশ্বাস ফেলে।বিশাল বারান্দার এক কোণায় রাখা একটি মাত্র সোফা।গিয়ে আরাম করে বসে পড়লো।হাত পা এলিয়ে দিয়ে বললো,

-“সে মনস্তাত্ত্বিক অস্থিরতার মধ্যে আছে এটা সত্যি।আমি তার মধ্যে বাইপোলার ডিসঅর্ডার এর লক্ষণ দেখতে পাই না তেমন। সিজোফ্রেনিয়ার ৯০ শতাংশ চান্স আছে।আর যদি মাল্টিপল পার্সোনালিটির হয় তাহলে….”

-“তাহলে কি মির্জা?ইজ শি ডেঞ্জারাস?”

-“সামটাইমস! আবার নাও হতে পারে। আবার হতে পারে আত্মঘাতী আবার আশপাশের মানুষের জন্য ভয়ঙ্কর।”

-“তোমার কি মনে হয় সেটা বলো?এত গভীরের সাইকোলজি বোঝার মতন সময় আর ইচ্ছা আমার নেই।আমার মাথা চালাতে হবে কেসে।আর তোমারও”

-“আমার মনে হয় না সে আশপাশের মানুষের জন্য ক্ষতিকর।নাহয় এতগুলো মানুষ তার আশ্রমে?যদি সে হিংস্র হতো কোনোদিন সেখানে মানুষ থাকতে পারতো না।শি ইজ সো কাম। বাট ডিস্টার্বড।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে শাবাব।খুব ইন্টারেস্ট নিয়ে শুনতে শুনতে ইন্টারেস্ট হাওয়ায় মিশে গেলো।কেস শব্দটা উচ্চারণ এর সাথেসাথে রুবি নামক মেয়েটাকে খুঁজতে হবে এই চিন্তা মাথায় এসে চেপে বসে।তার মধ্যে এই সন্দেহজনক রামশা।

মির্জা আবার বলে উঠলো, -“আমাদের এই কেসটা সলভ হলে আমি লিয়ানা নামক এই মেয়ের কেসটা হাতে নিবো।তোমাদের যন্ত্রণায় নিজের মস্তিষ্ক আর জ্ঞানের যথাযথ ব্যবহার করতেই পারছি না।”

-“শাট আপ মির্জা।ঘুমাতে যাও।ওই পাগলের টপিক এখানেই ক্লোজড।”

__

সকালের শুরু, বাহিরের পরিবেশ বৃষ্টিতে আচ্ছন্ন।বাদল ধারা বইছে অঝোরে।আকাশটা ধূসর। রিনিঝিনি আওয়াজ কানে এসেই ঘুম তাড়িয়েছে শাবাবের।চুলের গভীরে হাত রেখে টেনে ধরলো।বিছানার একপ্রান্তে পড়ে থাকা শার্ট তুলে উঠে যায়।গায়ে চড়িয়ে বোতামগুলো বন্ধ করতে করতে বাহিরে চাইলো।মেজাজটা খিটখিটে হয়ে গেছে এই বৃষ্টি দেখে।আজই বের হওয়ার কথা ছিলো। ছদ্মবেশে কক্স বাজারে ঘুরেঘুরে খোঁজ করার কথা ছিলো রুবির।বৃষ্টি দেখে মন মস্তিষ্ক ছ্যাঁত ছ্যাঁত করে উঠলো। সিদ্ধান্ত নিলো হোক ঝড়,বৃষ্টি অথবা ভূমিকম্প।এরই মাঝে কাজে পা বাড়াবে।

দরজায় টোকা পড়ে। শাবাব বিরক্তিমাখা মুখে দরজার দিকে এগোয়।খুলে সামনে দেখলো সাইফাকে। শাবাব প্রশ্ন ছুঁড়ে,

-“কি?”

সাইফা উত্তর দিলো না। সোজা হাত এগিয়ে একটি কাগজ ধরলো শাবাবের সম্মুখে। শাবাব আরো খানিকটা মুখে বিরক্তি ভাব টেনে বললো,

-“কি এটা?”

-“আজ সকালে হোটেলের স্টাফ আমাকে এই কাগজটা দিয়ে গেছে।বললো একটা ছেলে এই খামটা আপনাকে দিতে বলেছে। আপনার রুমে কয়েকবার নক করার পরও পায়নি।মির্জা স্যার বাহিরে গিয়েছেন।তিনি যাওয়ার পথে বলেছেন এই কাগজটা যেনো আমার কাছে দিয়ে যায়।কে পাঠিয়েছে হোটেল এর কেউ জানে না।”

-“তুমি দেখেছো খুলে?”

-“না স্যার”

শাবাব খামটি হাতে নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল।তারপর খামটির ভেতরে থাকা আরো একটি কাগজ বের করে দেখলো কিছু লিখিত আছে এর মাঝে। মনোযোগ দেয় শাবাব।সামনেই সাইফা দাঁড়িয়ে।জানতে কি আছে এই চিঠিতে।

-“অফিসার শাবাব,আমি রুবি।আমি জানি আপনারা আমায় খুঁজতে কক্স বাজার এসেছেন। পারাবার হোটেলে আছেন এটাও আমি জানি। দয়া করে আমাকে খোঁজার চেষ্টা করবেন না।আমি হাত জোড় করে রিকোয়েস্ট করছি।আমার আর আমার পরিবারের জীবন রিস্ক এ আছে।সাথে আপনাদের জীবনও।কেউ আপনাদের উপর নজর গেড়ে বসে আছে।এক এক করে নিঃশেষ করে দিবে।চলে যান স্যার এখান থেকে।আমি যেখানেই আছি সেফ আছি।আমার জীবন নিয়ে ভয় নেই।আপনারা চলে যান! পারলে আমার পরিবারকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নিন।আমি সময়মত আপনাদের কাছে নিজ থেকে আসবো।”

বারেবারে প্রত্যেকটা লাইন পড়ছে শাবাব।রুবি কি করে জানলো তারা এখানে?এই হোটেলে আছে? সন্দেহের মেঘ চতুর্দিকে ছড়িয়ে গেছে তৎক্ষনাৎ।সবার উপরে।নিজের মানুষ এর উপরেও।তারপর মাথায় আসলো রামশা নয়তো? লিয়ানাওতো জানে।কে খবরটা দিতে পারে? সাইফার দিকে কাগজটি দিয়ে মির্জাকে কল করলো শাবাব।

ফোন রিসিভ হতেই বললো, -“যেখানেই আছো আধ ঘণ্টার মধ্যে হোটেলে এসো”

ঝড়ের গতিতে প্রতিটি এর কাছে পৌঁছেছে এই খবর। চিঠিটা সন্দেহজনক।আদৌ রুবি পাঠিয়েছে কিনা কে জানে? শাবাবের ঘরে উপস্থিত সকলেই। সাইফা আর ফাহাদ হোটেলের ম্যানেজার এর সাথে যোগাযোগ করতে গিয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজ চাই তাদের।কে এসে এই চিঠি দিয়েছে তার খোঁজও দরকার।একটা চিঠির উপর নির্ভর করেতো ফিরে যাওয়া যায় না। শাবাব যাবেও না।আবির এখন অব্দি আসেনি।এখানে এসেছে কেস সলভ করতে।যে যার মতন ঘুরে বেড়াচ্ছে।একের পর এক কল করে পাওয়া গেলো না তাকে।

অপেক্ষা করতে করতে মির্জার ফোন বেজে উঠে। সাইফা কল করছে।মির্জা ফোন তুলতেই অন্যপাশ থেকে সাইফা বললো,

-“স্যার!”

অস্থির শোনালো সাইফার কন্ঠস্বর।মির্জা জানতে চাইলো,

-“কি হয়েছে সাইফা?”

-“আবির স্যার এর উপর গুলি ছুঁড়েছে কেউ।আমরা তাকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি।”

-“হোয়াট!”

-“জ্বি স্যার।তেমন চিন্তার কারণ নেই গুলি শুধু বাহুতে ছুঁয়ে গেছে।আপনারা চাইলে আসতে পারেন।বাকি ডিটেইলস পড়ে জানাচ্ছি”

বিপদের আভাস দিয়ে বিপদ এসেছে।খুব দ্রুত। হসপিটালের দিকে রওনা হয়ে আবিরকে দেখতে পেলো শাবাব,রবিন আর মির্জা।ড্রেসিং চলছে তার। রক্তাক্ত হাত তার।সাইফাকে প্রশ্ন করলে জানতে পারে সমুদ্র সৈকত থেকে হোটেলে ফেরার পথে তার উপর গুলি ছুঁড়ে কেউ।গুলিটা দুর থেকে আসায় ডান বাহুতে ছুঁয়ে গেছে।

শাবাব উদ্যমী গতিতে হোটেলে ফিরে রিসিপশনে এসে হাজির।শব্দ করে হাত রাখলো রিসিপশন ডেস্কে। অগ্নিচক্ষু হয়ে বললো,

-“রিসিপশনে বসে কি করেন? হ্যাঁ! কোনো গেস্ট এর জন্য কোনো ডেলিভারি আসলে যে ডেলিভার করেছে তার সমস্ত ডিটেইলস রাখতে হয় সেটা জানা নেই?এই সিকিউরিটি আপনাদের?একজন মাস্ক পরিহিত ছেলেকে সন্দেহের চোখে না দেখে উল্টো তার কাছ থেকে কাগজ নিয়ে বিদায় করেছেন?কোনো সই নেই কোনো ইনফরমেশন নেই!”

ভীত রিসিপশনিস্ট ইতিমধ্যে একবার সাইফা আর ফাহাদের কাছে জেরা হয়েছে।এখন শাবাবের কাছে।বুঝতে বাকি নেই সেও সি. আই. ডি এর লোক।আমতা আমতা করে বলল,

-“কোন এজেন্সি থেকে এসেছে নাম আর অ্যাড্রেস রেখেছি শুধু স্যার।”

-“হ্যাঁ! খুব ভাল কাজ করেছেন। এওয়ার্ড পাওয়ার মতন কাজ!দেন দেখি এজেন্সির নাম, অ্যাড্রেস।ফর শিউর নাম এড্রেসও ভুয়া।”

আবিরকে পেইন কিলার দিয়ে হোটেলে আনা হয়।এসেই সমস্তটা খুলে বললো। জনমানবহীন নির্জন এরিয়ায় গাড়ি পার্ক করা ছিলো।সেখানেই এই ঘটনা ঘটে। তরিহরি করে ফাহাদ এর নাম্বারটায় ডায়াল করার সুযোগ পায় সে।আবির সন্দেহ করলো গানে সাইলেন্সার লাগানো থাকতে পারে।কোনো আওয়াজ পাওয়া যায় নি।বুঝেও উঠতে পারেনি আবির এমন কিছু হবে তার সাথে।

শাবাব বললো, -“প্রফেসর বেঁচে আছে এই খবরটা নিশ্চয়ই কিলার এর কান অব্দি চলে গেছে। রুবি তার চিঠিতে উল্লেখ করেছে আমাদের জীবনের রিস্ক আছে।হেরে যাওয়াটা মানতে না পেরে আমাদেরকেও টার্গেট করে।”

-“এখন কি করবো শাবাব?চলে যাবো এখান থেকে?” মির্জা বললো।

রবিন বলল, -“নিজেদের জীবনের ভয়ে পালিয়ে যাওয়া আমাদের সাথে যায় না। রুবির জীবন সংকটে আছে নিশ্চয়ই!”

রবিনের কথার প্রেক্ষিতে মির্জা বললো, -“নতুনভাবে প্ল্যান করতে হবে।আমরা এখানে ছদ্মবেশে এসেছি এটা রুবি আর কিলার উভয়েই জেনেছে।”

-“রুবিকে সবার আগে সেফ করতে হবে স্যার।ভুল এজেন্সি ভুল অ্যাড্রেস।আমরা ওখানে গিয়ে খালি ময়দান ছাড়া কিছুই পাইনি।” সাইফা বললো।

আবির ব্যথার্থ।বাহুতে হাত চেপে কাতর গলায় বলে উঠলো, -“আর রুবিই যদি হয় সবকিছুর মাষ্টারমাইন্ড?”

এতক্ষন যাবৎ শাবাব চুপচাপ।আলোচনায় নাক গলালো না।মাথা নিচু করে কিছু একটা ভাবছে।সকলের দৃষ্টি তার দিকে গেলে সে মাথা তুলে।

বলে,

-“সবাই সবকিছু গোছাও”

মির্জা প্রশ্ন করলো, -“আমরা কি চলে যাচ্ছি?”

-“যাচ্ছি….তবে যাচ্ছি না”

চলবে…

“আ না ম”- ১০
-Azyah সূচনা

-“কি খবর ফিরোজ?কেমন চলে দিনকাল?শুনলাম হোটেলের কাজ বাদ দিয়ে ডাক পিয়ন হয়ে ঘুরছো?”

পুরোনো বস্তিতে আটসাট একটা ঘর। ছাদ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে।রাত নামার পূর্বেই বাড়ি ফিরেছে মোড়ের হোটেল থেকে কাজ সেরে।একা বাড়িতে থাকে।ঘরে রাখা চৌকিতে সুঠাম দেহের একজন অজ্ঞাত পুরুষ দেখে ভরকে উঠলো হ্যাংলা পাতলা দেহের ফিরোজ।তারই ঘরে তারই বিনা অনুমতিতে বসে আছে।কি করে ঢুকলো এখানে? হাতে রয়েছে সকালে পরিহিত কাপড়গুলো।অন্যহাতে জ্বলন্ত সিগারেট।

ফিরোজ সাহস করে বললো, -“কে আপনি?”

-“তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী।এসো দু চারটে সুখ দুঃখের আলাপ করি”

বলেই উঠে দাঁড়ায় শাবাব।পালানোর ফন্দি এটে ফেলে চট জলদি।তার দিকে এগোলেই পিছু ফিরে দৌড় দিতে চাইলো।পিছু ঘুরে তাকাতেই আরো একজনের সাথে ধাক্কা খায়।রবিন ফিরোজকে ধাক্কা দিয়ে পেছনে ঠেলে দিল।কলার চেপে ধরে শাবাব। চৌকিতে বসিয়ে বলতে লাগলো,

-“লাভ নেই।এখন আমি শুধু একটা প্রশ্ন করবো।তুমি গরগর সব উত্তর দিবে কেমন?”

-“আমি কিছু করিনি স্যার!”

-“কিছু না করলে ভয় পাচ্ছো কেনো?তোমার গায়ের ঘ্রাণ শুকতে শুকতে এলাম এখানে। আপ্যায়ন না করেই পালিয়ে যাচ্ছো?নট ফেয়ার ফিরোজ!”

-“আমি সত্যিই কিছু করিনি।”

-“পারাবার হোটেলে চিঠি দিতে কে বলেছে তোমাকে?” প্রশ্ন করে রবিন।

-“নাম বলতে পারবো না স্যার।”

শাবাব তেজী গলায় বলে উঠলো,

-“ওকে তুলুন। পশ্চাতে দুয়েকটা লাঠির বারি দিলেই মুখ দিয়ে সব বলবে।”

ফিরোজের দিকে চেয়ে রবিন বলে,

-“মার খেতে চাও নাকি সব সত্যি বলবে?”

চাপ প্রয়োগ করে শাবাব।শার্টের কলারটা পেছন থেকে আরো একটু চেপে ধরলো। ঘামর্ত কৃষ্ণবর্ণের মুখটা চিকচিক করছে আবছা আলোয়। ফিরোজ ভীত গলায় বলে উঠলো,

-“বলবো স্যার বলবো!”

শাবাব বলে, -“শুরু করো”

-“একটা ম্যাডাম এসেছিল হোটেলে।দুপুরের খাবার নিতে।আমার হাতে পাঁচ হাজার টাকা ধরায়।সবার চোখের আড়ালে আমাকে বলে আমি যেনো তার সাথে দেখা করি।আমি প্রথমে অবাক হই।আমাকে কেনো টাকা দিচ্ছে।আমি কেনো দেখা করবো?আমি তার টাকা ফেরত রেখে দেই টেবিলে।নেই না।”

-“তারপর?”

-“তারপর উনি আবার আসেন।মুখে মাস্ক পড়ে ছিলেন।আমার মালিককে টাকা দিয়ে ভুলিয়ে ফুঁসলিয়ে আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাজি করেন।আমার মালিক টাকার লোভে আমাকে হুমকি দেয় ম্যাডামের সাথে না গেলে নাকি আমাকে চাকরি থেকে বের করে দিবে।আমি গেলাম অনিচ্ছা স্বত্বেও।তিনি আমাকে বললেন তার নাকি খুব ছোট্ট কাজ।শুধু এই কাপড় পড়ে পারাবার হোটেলে গিয়ে শাবাব নামের লোককে এই চিঠি দিতে। ছয়শত আট নম্বর রুম তার।কিন্তু আমাকে হোটেল এর লোকেরা যেতে দেয়নি।নিজের কাছে রেখে দিয়েছে।”

রবিন প্রশ্ন করলো, -“আর এজেন্সির নাম? ঠিকানা?”

ফিরোজ উত্তর দেয়, -“সেটাও ম্যাডাম শিখিয়ে দিয়েছে আমাকে।”

শাবাব গা এলিয়ে বসে ছিল এতসময়।কথার শেষে উঠে বসলো।তীক্ষ্ম নজর গাড়লো ফিরোজের দিকে।তার শার্ট এর কলার ঠিক করতে করতে প্রশ্ন করলো,

-“আমার অফিসার এর উপর গুলি ছুঁড়েছো?”

-“না স্যার”

পুনরায় শার্টের কলার চেপে জোরালো কণ্ঠে বললো,

-“আমার অফিসার এর উপর ছুঁড়েছো ফিরোজ!”

-“আম….আমি ছুড়িনি স্যা.. র”

-“তাহলে কে ছুঁড়েছে?”

-“ওই ম্যাডাম..”

-“তুমি সেখানে উপস্থিত ছিলে তখন?”

-“হ্যাঁ….স্যার।আমি আমার কাজের পাওনা টাকা নেওয়ার জন্য তার দেওয়া ঠিকানায় যাই।সেখানে দেখি সে আর একটা লোক। ম্যাডাম হাতে বন্দুক ধরে ছিলেন।তারপর গুলি ছুঁড়তে দেখে আমি পালিয়ে এসেছি।আমাকে ছেড়ে দিন স্যার আমি সত্যিই কিছু করিনি শুধু চিঠি পৌঁছে দেওয়া ছাড়া।”

-“তুমি!…ওই ম্যাডামের ঠিকানা দাও!”

ফিরোজ কাঁদো স্বরে বলে উঠলো,

-“আমি জানি না স্যার।আমার সাথে তার দেখা হয়েছে রাস্তায়।”

-“কোন রাস্তায়!চলো আমাদের সাথে”

একথা বলেই রবিন আর শাবাব নিয়ে গেলো ফিরোজকে তাদের সাথে।ফিরোজ এর কথা মোতাবেক এসে হাজির।আশপাশে হোটেল আর হোটেল। জনসমাগমে ভরপুর এরিয়া।নিশ্চয়ই রুবি এই হোটেলগুলোর মধ্যে কোনো না কোনোটায় আছে।এই মুহূর্তে কোনো পদক্ষেপ নিলো না শাবাব আর রবিন। ফিরোজকে গাড়িতে তুলে একটি ছোট্ট ফোন ধরিয়ে দেয়।

আর বলে,

-“ওই ম্যাডাম যদি আসে আমাদের কল করবে।আর হ্যাঁ কোনো ধরনের চালাকি করলে তোমাকে কি করবো এটা তুমি নিজেও জানো না।আর ম্যাডাম যদি জিজ্ঞেস করে তোমাকে পুলিশের লোক বা সি. আই. ডি এর লোক কোনো জিজ্ঞাসাবাদ করেছে কিনা সরাসরি একটা শব্দ বলবে “না”।তুমি যে আমার কাছে ধরা পড়েছো।এটা কোনোভাবে যেনো সে জানতে না পারে।সে কোথায় যায় সেটা বিশেষভাবে নজর দিবে।”

শাবাবের কথা শেষে রবিন বলল,

-“এখন ছেড়ে দিচ্ছি।কিন্তু চব্বিশ ঘন্টা তোমার উপর নজর আছে আমাদের ফিরোজ। অতিরিক্ত চালাকি করলেই তোমাকে সারাজীবন জেলে কাটাতে হবে।কথাটা যেনো মনে থাকে।”

__

সুস্থ, সজীব, নানা রঙের পুষ্প।মেঘের ছায়ায় বিন্দু নিত্যফল।পাখির গানে মিশে সুরভিত সঙ্গীত গাছ গাছালিতে।স্বপ্নময় সন্ধ্যা পরিপূর্ণ কোলাহলে। ‘শূন্য আশ্রম’ এর দৃশ্য অনেক মনোহর এবং অত্যন্ত সমৃদ্ধ। মনোরম পরিবেশের মাঝে শিশু আর বৃদ্ধের জীবনের জীবনের গল্প।পরিপূর্ণ প্রত্যাশা আর সহানুভূতিতে আবৃত।কেউ সেলাই এর কাজ করছে।কেউ গল্প।বাচ্চাদের খিলখিল আওয়াজ আর বৃদ্ধের গল্পে কোলাহলপূর্ন বাগানটি। অদ্ভূত ভুতুড়ে আভাস যেনো তাদের নিত্যদিনের।প্রতিদিন সূর্যের কিরণের সাথে নিয়ে আসে ভালোবাসার উজ্জ্বল আলো।একে অপরের সাথে মিশে আছে একে অপরে।পার্থক্য নেই, ভেদাভেদ নেই। হৃদয় প্রশন্তকারি স্থানে ঝাঁপটা হাওয়া শীতল।এদের দিনগুলো কাটছে বেশ।দেখা যাচ্ছে না কারো মুখে হাহাকার।

বাগানের এক কোণায় হাজির হলো রবিন।পায়ের আওয়াজ বুঝতে পেরে সবুজ রাঙা মণিজোড়া পিছু ফেরে। হাতে মাটি লুটোপুটি খাচ্ছে।হাত ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।

লিয়ানা ধিমা গলায় বলে উঠে, -“নাস্তা করেছেন?”

-“জ্বি” উত্তর দিলো রবিন।

-“কোনো অসুবিধে হচ্ছে এখানে?”

-“অসুবিধে?একদমই না!উল্টো আপনার কোনো সমস্যা নেইতো?আমরা এখানে থাকছি।আমাদের কাজটা রিস্কি।আপনার আশ্রমে অনেক বাচ্চা আর বৃদ্ধরা আছেন।”

-“কেউ টেরই পাবে না আপনারা এখানে আছেন।অসুবিধে আর রিস্ক এর কিছু তেমন আমার চোখে পড়ছে না।..পড়লে জানাবো”

পাশে রামশা এসে হাজির।রবিন হেসে লিয়ানাকে বললো,

-“আমাদের এতবড় উপকার করার জন্য কি বলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো আমি বুঝতে পারছি নাম”

মেকি হাসে লিয়ানা।বলে,

-“কৃতজ্ঞতারতো কোনো প্রয়োজন নেই।…. কিন্তু হ্যাঁ আমার সাহায্যে হয়তো কিছু মানুষ আমাকে একজন স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে ভাবতে শুরু করবে।পাগল ভাববে না”

রবিন পিছু ফিরে চায়।বাগানের অন্য প্রান্তে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে শাবাব আর মির্জা।টেবিলে বিছানো ফাইল আর ল্যাপটপ। সাইফা দাঁড়িয়ে। তাঁদের দুজনের আলাপের অংশ সেও।

পুনরায় লিয়ানার দিকে চেয়ে বলল,

-“আপনি শাবাবের ব্যবহারে কিছু মনে করবেন না।আমরা আমাদের কাজ নিয়ে অনেকটা ফ্রাস্ট্রেটেড।”

-“আমি কারো কথায় কিছু মনে করিনা।….কিন্তু হ্যাঁ ভ্রান্ত ধারণা পোষণকারী মানুষকে শুধরাতে ইচ্ছে হয় মাঝেমধ্যে।”

সম্পূর্ণ আলাদা একটা এরিয়াতে জায়গা হয়েছে পুরো টিম এর।কিছু সত্য আর কিছু মিথ্যে যোগ করেই লিয়ানাকে বলা হয়।তবে শাবাবের মনের হাঁসফাঁস ভাবটা দূর হচ্ছে না কিছুতেই।শেষমেশ কিনা পাগলের কারখানায় এসে হাজির হতে হলো? জায়গাটা উপযুক্ত।কিছুটা দুরত্বে,কিছুটা আড়ালে।লিয়ানা কোনো রকম সমস্যা না করলে অনায়াসে এখানে থেকে প্ল্যান এক্সিকিউট করা যাবে।

মির্জা বললো,

-“তোমার মনে হয়না লিয়ানাকে একটা ধন্যবাদ দেওয়া উচিত তোমার শাবাব?”

শাবাব জোর গলায় ‘না’ শব্দটা বলতে যাচ্ছিলো।তবে ঠেকে গেলো নিজের বিবেকের কাছেই।আকষ্মিক উদ্দীপনায় ভরপুর শাবাব মিয়ে যায়।উত্তর দিলো না কোনো।

ছলনা করেই বলল,

-“আমি কেস সলভ এর জন্য উচুতে উঠতেও রাজি আর নিচে নামতেও।ইচ্ছেকৃত পিকনিক করতেতো আসিনি এখানে।এসেছি কাজে।কাজ শেষ করে চলে যাবো।”

মির্জা উপহাস করার সুরে বলে উঠে,

-“ঠিক বলেছিলো লিয়ানা।তোমার মধ্যে ইগো আছে ভরপুর।”

-“আজকাল খুব লিয়ানাকে নিয়ে ভাবা হচ্ছে?কি ব্যাপার মির্জা?পথ হারাচ্ছ বুঝি?” তীর্যক দৃষ্টি ছুঁড়ে বলে উঠলো শাবাব।

-“আমার কাছে ওর ক্যারেকটার ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে।এটাই আর কিছু না”

-“এত ইন্টারেস্ট?”

-“ভাই তুমি একটা জিনিস বটে!কোন কথা কোথায় নিয়ে গেলে।আমরা বরং বের হই?হোটেল সার্চ করতে হবে।”

এই সংস্থায় নিত্য নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়।যেমনটা এখন শাবাব আর মির্জা করছে। অ্যাংরি ইয়াং ম্যান এর লুক বদলে বাঙালি সরল পুরুষে রূপান্তরিত শাবাব।কালো রঙের পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে আয়নার সামনে দাড়ালো।এমনেতেই এটা কোনো মানুষের ঘর বলে মনে হয়নি তার।কবুতরের খাঁচা মনে হচ্ছে।আয়না পেয়েছে এটাও সৌভাগ্য।নিজের সাধের চুলগুলোকে নামিয়ে বোকা সাজার চেষ্টায়।তবে মুখের দাড়ি সেটা কিছুতেই হতে দিচ্ছে না।

মির্জা রঙিন টি শার্ট গায়ে দিয়ে পিছনে এসে দাঁড়ায়।একজন সমুদ্র ভ্রমণকারী বেশভূষা ধারণ করেছে সেও।শাবাবের দিকে চাইলো।

বললো, -“দাড়ি ট্রিম করে ফেলো”

-“নট পসিবল” সোজাসুজি উত্তর দেয় শাবাব।

ফাহাদ এসে বললো, -“স্যার আমি কি করবো?কি পড়বো?বুঝতে পারছি না।”

মির্জা হেঁসে বললো, -“তুমি ভিক্ষুক সাজো বেশ মানাবে তোমায়”

ফাহাদ এর মুখ লটকে যায়।তাকে ভিক্ষুকের ক্যারেকটারে মানাবে?এই তার অবস্থান? অপমানিতবোধ করে চলে গেলো সেখান থেকে। সাইফা কাউকে কোনো বিরক্ত না করেই নারী পোশাকে তৈরি। শালিনভাবে সালওয়ার কামিজ পড়েছে। শাবাবকে বেরিয়ে আসতে দেখেই পা জোড়া থমকে যায় সাইফার।কালো পাঞ্জাবিতে অপরূপ সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে।হোক বোকাসোকা বেশভূষা।অক্ষি আকৃষ্ট আর মস্তিষ্ক দ্রুততম গতিতে অচল হয়ে পড়লো।কখন যে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি প্রস্ফুটিত হয়েছে সে নিজেও জানে না।ততক্ষনে শাবাব এসে দাঁড়ায় তার মুখোমুখি।

কপাল কুঁচকে বলে উঠলো, -“কি সমস্যা?”

ক্যাটক্যাটা আওয়াজে হুশ ফিরে সাইফার। কয়েকদফা এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে।বলে উঠে,

-“কোনো সমস্যা নেই স্যার।কখন বের হবো?”

-“দশ মিনিট পর।”

বলে চলে গেলো শাবাব সামনের দিকে।পেছন থেকে আরো একটি ভারী গলা ভেসে আসে সাইফার দিকে।নারী কন্ঠ বলছে,

-“কিছু সংখ্যক অনুভূতি সিন্দুকে তালাবদ্ধ রাখতে হয়।প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সঞ্চারণ দুঃখ হানে”

সাইফা পিছু ফিরে চায়।বলে,

-“লিয়ানা?”

লিয়ানা সামনে এসে দাঁড়ায়। হাত বাড়িয়ে সাইফার এলোমেলো চুলগুলো পরিপাটি করলো। বাঁকা হয়ে থাকা গলার চেইন সোজা করে দিয়েছে।বলে উঠলো,

-“এলোমেলো সবটা গুছিয়ে দিলাম”

সাইফা মুচকি হেসে বলল, -“থ্যাংকস”

-“ধন্যবাদ শব্দটা আমার পছন্দ নয়।” একই কথা বলতে বলতে বিরক্ত লিয়ানা।মুখে সেই ছাপটা ফুটে উঠেছে।

-“কেনো?”

-“জানি না।বেস্ট অফ লাক অফিসার সাইফা।জীবনের কেসে সফল হন”

সাইফা চোখ নামায়।বলে,

-“তুমি যা ভাবছো তেমন কিছুই না।”

-“আমি যা ভাবছি সেটাই”

-“মানুষের মন পড়তে জানো বুঝি?”

-“চোখ পড়তে জানি”

শাবাবের ডাকে পায়ের গতি দ্রুতগামী হয়।লিয়ানার সাথে কথোপকথন আর পূর্ন হলো না।এখনই বেরিয়ে পড়তে হবে।নানা পন্থা অবলম্বন করে ছড়িয়ে পড়তে হবে। মিথ্যে পরিচয়ে খোঁজ চলবে আরো একজনের। যার সূত্র ধরে হয়তো আসল খেলোয়াড় অব্দি পৌঁছানো সম্ভব। আশাবাদী সকলেই। প্যাঁচানো এই কেসের জট খুলতে উঠে পড়ে লেগেছে টিমের প্রত্যেকটি মেম্বার।

রাত তিনটে,

আড়াইটের দিকে চোরের মতন করেই আশ্রমে প্রবেশ করেছে একে একে সকলে।কি লাভ হল!এই প্রশ্ন শাবাবের।মেজাজ অত্যন্ত চড়া। চোঁখ ফাঁকি দিতে এক্সপার্ট একেক অপরাধী।এতটা সময় সার্চ চালিয়ে কোনো লাভ হলো না।কিছু জায়গায় তাদেরকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।নিজেদের পরিচয় ফাঁস করতেও আছে বাঁধা। আশা আছে শুধু ফিরোজের।তার পেছনে চব্বিশ ঘন্টা মানুষ নিয়োগ করা।একটাবার যদি রুবি আসে?কোনো কারণে? ফিরোজকে পেয়েছে। রুবিও হাতের কাছাকাছি এই ভেবে বারান্দায় পা বাড়ালো শাবাব।রেলিংয়ে হাত রাখতেই ঠিক মাথার উপর থেকে ভেসে এলো গিটারের আওয়াজ।শব্দটা প্রকট।যেনো খুব কাছাকাছি বসেই কেউ বাজিয়ে চলেছে গিটার। উন্মুক্ত বারান্দার খোলা অংশ থেকে মাথা উচিয়ে দেখবার চেষ্টা করে।কে এমন রাত বিরাতে গিটার বাজাচ্ছে?

“অবিরাম রঙিন বিভ্রম কল্পনা,
সেই জগতে আমি ভাসা,
স্বপ্নের পাখি আমাকে নিয়ে
আলোয় ভরা পথে পাশাপাশি।

স্বপ্নের বনে আমি স্বর্গের মতন,
চলছি অবিরামে হৃদয় মিলিয়ে,
সময়ের জলে ভেসে যাওয়ার জন্য
অচেনা দেশে আমি যাই।

কোনো সীমানা নেই সেই জগতে,
পৃথিবীর সকল রঙ মিশে মিলে,
স্বপ্নের কল্পিত আলোয়ে ঝিমঝিম,
আমি বাজাই স্বর্গের সুরে।”

গিটারের সাথে গানের আওয়াজে আওয়াজে পা চলেছে শাবাবের। আত্ম স্বরে সুর তুলছে কেউ গভীর রাতে।হৃদয়ের কথন প্রকাশ চলছে একাকী।ঘরের পাশের সিড়ি বেয়ে কদম থামে ছাদে এসে।দরজায় দাঁড়িয়ে একদম চিনতে ভুল করলো না শাবাব।রাত বিরাতে এই আশ্রমের একজন পাগলই এসব কারবার ঘটাতে পারে।আগেই বোঝা উচিত ছিলো। অনবরত এই আওয়াজ কানে ভীষণ রকমের লাগছিলো।এসেই মেজাজটা আর ঠিক থাকলো না।বিরক্ত হয়ে পা ফেরানোর পূর্বেই গিটার আর কন্ঠ উভয়ের সুর থামে।

আকস্মিক বলে উঠে,

-“ভয় পেয়েছিলেন অফিসার শাবাব?”

চলবে……