ইলশে গুঁড়ি পর্ব-০৩

0
54

#ইলশে_গুঁড়ি
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ০৩

নোমান নিচে নামতেই তাঁর অধর জোড়া প্রসারিত হলো। তাঁর মনে হচ্ছে তাঁদের এই বোরিং মার্কা বাড়িতে একটা প্রজাপতির আগমন হয়েছে। সেই প্রজাপতি পুরো বাড়িতে নিজের ইচ্ছা মতো ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। কারো সম্পর্কে তার তেমন কোন আগ্রহও নেই। নিজের মতো ঘুরছে, খাচ্ছে, নিজের মতো থাকছে। এই যে এখন টুল পেতে বাড়ির মেইন দরজার পাশে বসে আছে। তাঁর দৃষ্টি সামনে। গতরাত থেকে অবিরাম গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। তাই সে বসে বসে মুগ্ধ চোখে দেখছে। তাঁর দু পাশে দিসা আর নিসা। তাদের ছোট চাচার দুই মেয়ে। অবিরাম বকবক করছে। তাঁর সে দিকেও খেয়াল। মাঝে মাঝে দুনিয়ার বুঝদারের মতো মাথাও নাড়ছে।

নোমান তিথির দিকে দেখতে দেখতেই, কিচেন রুমে উঁকি দিলো । তাঁর মা ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে। আজ কি কি রান্না করবে বিরক্ত মুখে দেখিয়ে দিচ্ছে। হালিমা খালার মুখ ভার। নিশ্চয়ই মা রাগারাগি করেছে।

নোমার হাসলো! মার রাগের কারণ নোমান কিছুটা হলেও বুঝতে পারছে। মার একটা বাজে স্বভাব হচ্ছে। সে সবকিছু নিজের মতো চায়। এই বাড়িতে সবাই যে যার মতো থাকে। আর ঐ যে যার মতো থাকাতেও তাঁর ইচ্ছা থাকা চাই। আর চলছেও এভাবে। এই বাড়িতে যাই হোক যাই ঘটুক শেষ হবে মা যেমনটা চাইবে সে ভাবেই। তবে তাঁর ক্ষেএে একটু ভিন্ন। একমাএ ছেলে হওয়ার সুবাদে সব কিছু থেকে অনেকটাই ছাড়। তবে আজকাল একটা জিনিস মা নিজের মতো করতে পারছে না। তা হলো তিথি! তিথির আগমনটাই হয়েছে হঠাৎ বৃষ্টির মতো। যেটা মা হজম করতে পারছে না আবার কিছু বলতেও পারছে না।

তিথি আছে নিজের মতো । এই যে দরজার সামনে বসে আছে। এটা মার সহ্য হওয়ার কথা না। কারণ! মার কাছে এটা শোভনীয় না। এটা এভাবে না, এটা করবে না, ঐটা করবে না । করতে করতে মা সবাই কে রোবট বানিয়ে ফেলেছে। এই যে এই বাসায় এতোগুলো মানুষ। তবুও এই বাসায় হইচই, হইহুল্লা হবে না। সন্ধ্যা বেলা হাসি তামাসার শব্দ শোনা যাবে না। সবাই যে যার মতো থাকছে। সেই থাকার মধ্যেও আছে মার কঠোর নিয়ম।

নোমান দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তিথিকে মা শক্ত ভাবে কিছু বলতে পারছে না। কারণ! তিথি এমন একজন যাকে নাড়াতে চাইলে তাঁর সাজানো গোছানো রাজত্ব নড়ে যেতে পারে। কারণ এই রাজত্ব তৈরিতে একমাএ অবদান মেজো চাচার। তাই আর কেও জানুক আর না জানুক মা ঠিকিই জানেন তিথি ফিরে আসায় মেজো চাচা কি পরিমাণ খুঁশি হয়েছে। আর মেজো চাচা তাঁর নিজের কোন কিছুতে হস্তক্ষেপ একেবারেই পছন্দ করে না। তাই তাঁর মেজাজ খারাপ। তবে অবশ্য বেশিদিন এভাবে মা চলতে দেবে না। তিনি কিছু না কিছু অবশ্যই করবেন।

— কিরে এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
— কফি লাগবে মা। দু- কাপ কফি শোয়েব ভাইয়ার রুমে পাঠিয়ে দাও তো। আমি সেখানেই আছি।

বলেই নোমান তাড়াতাড়ি চলে এলো। সে এখন মায়ের সাথে কথা বলতে চাচ্ছে না। কথা বললেই অফিসে কেন যায়নি জানতে চাইবে। সে কেন যায়নি তা নিজেই জানে না। মাকে কি বলবে। সে এগিয়ে যেতে যেতে আবার তিথির দিকে তাঁকালো । মেয়েটা এখন হাত নেড়ে নেড়ে দিসা নিসাকে কিছু একটা বলছে। দিসা নিসা মন দিয়ে শুনছে। যাক তাঁদের একটা ভালোই সঙ্গি হয়েছে।

নোমান সিঁড়ি ভেঙে এগিয়ে গেলো। সে এখন যাবে শোয়েব ভাইয়ের রুমে। শোয়েব ভাই তাঁদের রক্তের কোন ভাই টাই না। বাবার বন্ধুর ছেলে। একদিন বাবা এসে বললো। “তাঁর এক বন্ধুর ছেলে কিছুদিন এই বাসায় থাকবে। সে থাকবে নিজের মতো। তাঁর খাবার দাবার রুমে দিয়ে আসবে। কেও তাঁকে বিরক্ত করবে না। ”

এবং সে আছে। নিজের মতোই আছে। তবে বাবার কথা কেও শোনেনি। তাঁর রুমের দরজা সব সময় থাকে খোলা। আর আমরা সেই খোলা দরজা দিয়ে যখন তখন আসি আর যাই । এতে সে বিরক্ত হয় কিনা জানি না। সবচেয়ে বেশি করেন মা। তিনি আর কারো সাথে হেসে কথা না বললেও শোয়েব ভাইয়ের সাথে বলেন। তিনি প্রায়ই এটা সেটা তৈরি করে, নিধির হাতে ধরিয়ে দিবেন। তাঁর কি উদ্দেশ্য বুঝতে শালোক হোমস হওয়ার প্রয়োজন নেই। নোমানই যথেষ্ট। কিন্তু নিধি বেচারী পরে ঝামেলায়। সে মর্ডান যুগের মর্ডান মেয়ে। তাঁর পছন্দ এলোমেলো সুরের গিটার। তাঁর কি আর এই হারমোনিয়াম প্যা প্যা টাইপ ছেলে ভালো লাগবে। মার ভয়ে কিছু বলতেও পারে না। তাই সে সেই অপেক্ষায় আছে কবে এই আপদের কিছুদিন শেষ হবে। এটা অবশ্য নোমানও জানে না। জানতে চায়ও না। কারণ শোয়েব ভাইকে সে খুবই পছন্দ করে। বয়সে অবশ্য তাঁর চেয়ে তিন চার বছরের বড় । তবুও তাঁর খুব পছন্দ। শুধু তাঁর না। এই বাড়ির প্রায় সব মানুষের পছন্দ। তাকে একবার জিজ্ঞেস করলাম। কি ভাই! কারণ কি? যাদু টাদু জানো নাকি?

সে হেসে বললো, “– মাথা ঝুলানো টাইপ মানুষ কে সবাই পছন্দ। সে সবার কথায় হ্যাঁ হ্যাঁ মাথা ঝুলায়। তাই সবাই তাঁকে পছন্দ করে।

নোমানেরও অবশ্য তাই ধারনা। কারণ শোয়েব ভাই সব কথাই পজিটিভ। না বোধক শব্দ বোধ হয় তাঁর মধ্যে নেই।

শোয়েব ভাইয়ের দুনিয়া তাঁর রুমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তবে মাঝে মাঝে ছাদে যান। এই বাড়িতে কি হচ্ছে না হচ্ছে তাঁ নিয়ে তাঁর কোন মাথা ব্যাথা নেই। সে আগে লেখা লেখি করতো। বেশ কয়েকটা বইও বের হয়েছে। এবং অনেকটা ফেমাসও। তবে বিশেষ কোন কারণে এখন সব বাদ। এখন তাঁর একমাএ কাজ দিন ভরে বই আর পএিকা পড়া। এই মোবাইল ইন্টারনেটের যুগে কেও এভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে যে পএিকা পড়তে পারে, তাঁকে না দেখলে সে জানতোও না।

— কি ব্যাপার! এই সময়ে! অফিস টফিস নেই।

নোমান কিছু বললো না। সে আয়েশি ভঙিতে
সিগারেট ধরাতে লাগলো । সে আর অফিস! অফিস টফিস তাঁর একদম ভালো লাগে না । তাঁর তো ভালো লাগে রং তুলি। তবুও যেতে হয়। বাড়ির একমাএ ছেলে সে । এই বাড়ির ভূত ভবিষ্যৎ সব তাঁর হাতে। যেই দিন লেখাপড়া শেষ করেছে । তারপরের দিনই অফিসে জয়েন করতে হয়েছে। তাঁর মার এক কথা বাবার মতো হলে চলবে না। মেজো চাচার মতো হতে হবে। তাই তাঁর সাথে লেগে থাকতে হবে। আর তাই সে লেগেই আছে। যেন তেন টাইপ লাগা না। একেবারে কচ্ছপের কামড় টাইপ লাগা।

নোমান সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে শোয়েবের দিকে তাঁকালো। সে খাটে হেলান দিয়ে বসে আছে। তাঁর হাতে বই। এতোক্ষণ সম্ভাবতো পড়ছিলে। নোমান হেসে ফেললো! কারণ! তাঁকে লাগছে আদিম যুগের মানুষের মতো। হঠাৎ দেখলে যে কোন মানুষের চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হওয়ার সম্ভাবনা আছে। নিধি বেচারীর আর কি দোষ। চুল, দাঁড়ি, গোঁফ আর না জানি কি কি দিয়ে লেটকে চেটকে আছে।

কাজের লোক কফি রেখে গেছে। শোয়েব বই রেখে কফির মগ হাতে নিয়ে বললো,”— হাসছো কেন?

— আমাদের বাসায় তিথি নামের একটা প্রজাপতি এসেছে। শুনেছো?

শোয়ের নির্বিকার ভাবে বললো,”– শুনেছি। দিসা নিসা বললো।

— সে যা দেখে তাতেই মুগ্ধ হয়ে যায়। হা করে তাঁকিয়ে থাকে। আমার ইচ্ছা সে তোমাকে দেখুক। দেখে তাঁর কি রিয়েকশন হয়। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে।

— জানতে ইচ্ছা করলে নিয়ে এসো। আমিও দেখি হালচাল কি? দিসা, নিসা তো গুণ গান করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে। মাথার চুলই নাকি তিন হাত।

নোমান হাসলো। হেসে সোফায় শুয়ে পড়লো। চোখ বন্ধ করে বললো, — উঁহু! এভাবে না। দেখা হতে হবে হঠাৎ। হঠাৎ দেখার মধ্যে একটা ব্যাপার আছে।

শোয়েব কিছু বললো না। উঠে দাঁড়ালো! তাঁর পড়নে সাদা ঢুলাঢালা পায়জামা আর গেঞ্জি । আর সেই ঢুলাঢালা পায়জামা আর গেঞ্জি তাঁর পেশিবহুল শরীরকে আড়াল করতে পারেনি।

সে এগিয়ে এসে নোমানের সামনে দাঁড়ালো। হাতের সিগারেট নিভে গেছে। চোখ বন্ধ। মুখে মুচকি হাসি। নোমান কি জানে সে প্রেমে পড়েছে। হয়তো এখনো জানে না বা বুঝে উঠতে পারে নি। হঠাৎ দেখার মাঝে সত্যিই ব্যাপার আছে। ম্যাজিকাল একটা ব্যাপার। এই ম্যাজিকাল ব্যাপারটা সহজে বুঝা যায় না। বুঝা যায় ধীরে ধীরে। আর এই ধীরে ধীরের সময়টা হবে জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়। প্রেমে পড়ার সময়। এই প্রেমের প্রাপ্তি হোক বা না হোক এই সময় গুলো হবে জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়।

শোয়েব বারান্দায় দিকে এগিয়ে গেলো। এই বাড়ির সব কয়টা রুম পরেছে পিছনের দিকে। বারান্দাও পেছনে। শুধু তাঁর রুমের বারান্দাটা সামনে। কারণ তাঁর রুমটা পড়েছে একদম কর্নার সাইডে।

সে কফিতে ঠোঁট ছোঁয়ালো। তাঁর দৃষ্টি সামনে। গেইটের কাছে ছাতা মাথায় একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গেইটের দিকে তাকানো! যার কারণে মুখ দেখা যাচ্ছে না। বৃষ্টি কারণে মেয়েটা পায়জামাটা একটু ধরে উঁচু করে রেখেছে। যার কারণে পায়ের রুপার নূপুর চিকচিক করছে। তাঁর দু পাশে দিসা, নিসা। তাঁরা বাগান বিলাস গাছ দেখছে আর কিছু বলছে।

শোয়েব রুমে ফিরে আসলো। তাঁর সামনে একটা বই। কলম নিয়ে বইয়ে লেখার উপরই লিখলো,

“আমাদের গল্পগুলো অল্প সময় ঘর পাতালো
তারপর পথ হারালো তোমায় আমায় নিয়ে।”

চলবে……