ইলশে গুঁড়ি পর্ব-০৫

0
57

#ইলশে_গুঁড়ি
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ০৫

তিথির জ্ঞান ফিরতেই সে ঝট করে উঠে বসলো। তাঁর বুক এখনো ধড়ফড় করছে। সে জোড়ে জোড়ে শ্বাস ফেলতে লাগলো। কোথায় আছে সে? মনে হতেই সে আশে পাশে তাঁকালো। দেখলো শুধু তাঁর বাবা তাঁর পাশে বসে আছে । চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। ঘরে হালকা পাওয়ারের লাইট জ্বলছে। কেমন শান্তি শান্তি ভাব। সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। যাক বেঁচে আছে সে ?

— তুমি ঠিক আছো?

তিথি মাথা নাড়লো। তাঁর মুখ দিয়ে কথা বের হলো না।
মাহবুব পাশের বেড টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে এগিয়ে ধরে বললো, — ওর নাম শোয়েব। ভাইয়ার বন্ধুর ছেলে।কোন একটা সমস্যার কারনে হয়তো সে এই বাসায় আছে। দোতলার যে কর্নারের রুমটা সেটায় থাকে। রুম থেকে খুব একটা বেরোয় না। তাই তুমি তাঁকে দেখোনি।

তিথি গ্লাস নিয়ে অল্প একটু পানি খেলো। সে এই লোকটার কথা শুনেছে। দিসা নিসা বলেছে। তাঁদের কথা শুনেই বুঝেছে তাঁদের খুব প্রিয় একটা মানুষ। এরকম বনমানুষের মতো যার বসবাস সে কিভাবে কারো প্রিয় হতে পারে? এই ভাবেও কোন মানুষ থাকতে পারে? চুল, দাঁড়ি কতো বছর ধরে কাঁটে না কে জানে। আরেকটু হলে তো সে মরেই যেত।

দরজার শব্দ তিথির ধ্যান ভাঙলো। নোমান উঁকি দিয়ে আছে । তাঁর মুখে মুচকি হাসি। তিথি বিরক্ত লাগলো। এভাবে উঁকি দিয়ে দরজায় টোকা দেওয়ার মানে কি?
— আসবো চাচ্চু।
— এসো
— তুমি নাকি এই রুমের জন্য কার্ফু জারি করেছো। কাওকে এলাউ করছো না। দাদু নিচে দুশ্চিন্তায় হাঁসফাঁস করছে। আমাকে পাঠালো খোঁজ খবর নিতে। তো বলেন মহারাজা আপনার মেয়ের খবর কি?

মাহবুব একটু হাসলো! এই বাসায় প্রাণ খোলা হাসিটা হয়তো এক মাএ নোমানই হাসে। সাথে সাথে তাঁর মনে একটু বিষন্নতাও ছেয়ে গেলো। তাঁর মেয়ে! হ্যা তাঁর মেয়ে! এই মেয়েটাই তাঁর, তাঁর একমাএ অংশ। এই কথাটা মনে হলেই কেমন শান্তি লাগে। অথচে মেয়েটা যে আমার সব জেনেও তাকে তাইয়্যেবার প্রমাণ দিতে হয়েছিলো ।

______

— তো, তিথি প্রজাপতির কি খবর? জ্ঞান ফিরেছে?

নোমান হাসলো! হেসে বললো,– হুম ফিরেছে! তবে খুব ভয় পেয়েছে।

— হুম! প্রজাপতি তো এই কারণে। স্পর্শ করতে গেলে ভয়ে উড়ে যাবে। মুগ্ধতায় কাঁচের বোতলে ধরে রাখতে চাইলে ছটফটিয়ে মরে যাবে। আর ভালোবেসে তাঁর দিকে হাত বাড়ালে নিজে থেকেই এসে ধরা দেবে।

নোমান শোয়েবের দিকে তাঁকালো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেটে বিষন্নভাবে টান দিচ্ছে। তাঁর জানা মতে শোয়েব ভাই সিগারেট খায় না। অন্তত এই বাসায় আসার পর থেকে তাঁকে সিগারেট খেতে দেখেনি। অসখ্য বার তাঁর সামনে বসে বসে সে সিগারেট খেয়েছে। তাঁর মধ্যে কখনও সিগারেটের তৃষ্ণা দেখেনি। তাই আজ যখন নোমানের পেকেট থেকে সিগারেট নিয়ে অনায়াসেই ধরিয়েছে । সে একটু অবাকই হয়েছে। সিগারেট নেওয়ার জন্য না, হয়েছে সিগারেট খেতে দেখে। নোমান জানে প্রথম বার কেও সিগারেট ধরিয়ে এভাবে খেতে পারে না। তাঁর মানে তাঁরা শোয়েব ভাইকে চেনে না। সে তাঁদের যা দেখিয়েছে তাঁরা তাই দেখেছে।

নোমান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আসলে কোন মানুষকেই পুরোপুরি জানা যায় না। অবশ্য তাঁরা জানতেও চায়নি। তাঁরা কি কখনও জানতে চেয়েছে। শোয়েব ভাই এখানে কেন পরে আছে? না! তবে নোমান জানে, জিজ্ঞেস করলে শোয়েব ভাই সত্য কথাই বলবে। মিথ্যা বলে ভালো থাকা দিকটা তাঁর মধ্যে নেই। এজন্যই সে ঠিক করেছে সত্য সে কখনও জানতে চাইবে না। কারণ! সত্য সব সময়ই তিক্ত।

নোমান হেঁটে হেঁটে বারান্দায় আসলো! এসে শোয়েবের পাশে দাঁড়ালো। নিচের দিকে তাঁকিয়ে রেলিংয়ে ভর দিয়ে বললো,— প্রজাপতি শব্দটা তোমার মুখে শুনতে আমার ভালো লাগছে না। যখনি বলছো তখনি তোমার নাক টাক ফাটিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। বলোতো কেন?

শোয়েব একটু হাসলো! হেসে বললো, — বিকজ ইউ আর ইন লাভ মাই ডেয়ার,ইউ আর ইন লাভ।

— আর তুমি?

শোয়েবের মুখ গম্ভীর হলো। তবে কিছু বললো না।

নোমান একটু হাসলো। হেসে সিগারেটের পেকেটা টা রেলিংয়ের উপর রেখে বললো,— হঠাৎ জিনিস টায় সত্যিই একটা ব্যাপার আছে। সত্যিই আছে! এই যে পাথরকেও হেলিয়ে ফেলেছে। বলেই সে বেড়িয়ে গেলো।

শোয়েব দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ফেলে রুমে আসলো। এসে ড্রয়ার থেকে মোবাইল বের করলো। সে বলতে গেলে এখন মোবাইল ব্যবহারই করে না। অবশ্য বলতে গেলে প্রয়োজনও পরে না। সে একজন কে কল করলো। রিসিভ হতেই সে এই টুকুই বললো,— একজনের নাম, ঠিকানা বলছি। ডিটেলস বের করো।
____

তিথি হালিমার দিকে তাঁকালো। তাঁর হাতে কয়েকটা শপিং ব্যাগ। সে এসেছে এগুলো তিথিকে দিতে। আজ বাসায় ছোট খাটো একটা ফ্যামিলি গেট টুগেদার রেখেছে রেহনুমা। সকাল থেকে তাঁরই আয়োজন চলছে। অনেকে হয়তো এসেও গেছে।
ব্যাগ নিয়ে তিথির কোন আগ্রহ দেখা গেলো না। সে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলো। পাখির খাঁচার সামনে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। দেখতে খুবই সুন্দর। সে হালিমার দিকে তাঁকিয়ে বললো,— এটা কে?

হালিমা হেসে বললো,— নিশি আম্মা! আপনার বড় চাচার বড় মেয়ে। এই কিছুক্ষণ আগেই আসছে। এই পাখিগুলা তো তাঁরই। ছোট বেলা থেকেই পাখির খুব শখ। তাঁর এক জন্মদিনে বড় ম্যাডাম এই খাঁচা গুলো বানাইয়ে তাঁরে গিফ্ট দিছিলো।

তিথি আর কিছু বললো না। হালিমা ব্যাগ রেখে চলে গেলো। সে এক দৃষ্টি মেয়েটার দিকে তাঁকিয়ে রইলো। তাঁর কেন জানি মনে হচ্ছে, মেয়েটা কাঁদছে। সিগারেটের কটু গন্ধে সে পাশে তাঁকালো। গ্রিলে হেলান দিয়ে নোমার দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি তাঁর দিকেই।

তিথি মনে মনে নিশ্বাস ফেলল। এই এক বান্দা, যার দিন দুনিয়ায় কোন হুশ নেই। তিথি চলে যেতে চাইলো কিন্তু থামলো নোমানের কথায়, — আমাকে দেখতে নিশ্চয়ই ভূতের মতো লাগে না। যে দেখলেই পালিয়ে যেতে হবে।

তিথি মধ্যে কোন ভাবান্তর হলো না । সে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক ভাবেই বললো, “— তো কি নিজেকে হিরো ভাবেন। যে দেখলেই সবাই গদগদ করে গলে যেতে থাকবে।
— এতোদিন তো তাই ভাবতাম। তবে এখন একটু সন্দেহ হচ্ছে।

তিথি আড়চোখে নিচে তাঁকালো। মেয়েটা চলে যাচ্ছে। হাঁটছেও বিষন্নভাবে। সে আবার নোমানের দিকে তাঁকিয়ে বললো —- কেন ঘরে আয়না নেই?

নোমান একটু হাসলো! হেসে এগিয়ে এলো। একেবারে গ্রিলের কাছাকাছি। দাঁড়ালো তিথির একদম বরাবর। তিথির চোখের দিকে তাঁকিয়ে বললো, — না নেই! তাইতো সামনে পড়লেই দাঁড়িয়ে যাই। ঘুরেফিরে দেখি। কেমন লাগে নিজেকে এই আয়নায়।

তিথি কিছু বললো না। সে গাধা না। এই ছেলে যে তাঁকে দেখেই প্রেমে পড়েছে। সে প্রথম দিনই বুঝেছে। সে মনে মনে বিদ্রুপের হাসি হাসলো আর উপরে তাঁর ভাসা ভাসা চোখে তাঁকিয়ে রইলো।

নোমান একটু ঝুকে ফিসফিস করে বললো,— তো মিস আয়না! কেমন দেখলে আমায়?

তিথিও একটু ঝুকে ফিসফিস করে বললো — সত্য সহ্য হবে তো মিষ্টার নুনির পুতুল?

— বলেই দেখো।

তিথি কিছুক্ষণ তাঁকিয়ে রইলো ! তাঁর ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি। সে ঘুরে বারান্দায় থেকে যেতে যেতে বললো, — অবশ্যই বলবো। বলতেই তো এসেছি।

তিথি চলে গেছে। নোমান দাঁড়িয়ে রইলো। চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস নিলো। বাতাসে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ । তিথি আশে পাশে থাকলেই এই ঘ্রাণ টা তাঁর নাকে লাগে। এই মেয়েটা হয়তো জানেও না তাঁর আশে পাশে থাকলে এই যে তাঁর অতি প্রিয় সিগারেট, এটাও বিষাদ লাগে।

—–

মাহবুব নিচে আসলো অনেকটা সময় পরে। ছেলেরা সবাই দু-তলায় বসে ছিলো। তাই সে নিচে আসতে পারে নি। এমনিতেই সবার সাথে তাঁর খুব একটা দেখা হয় না। তাই সবার সাথে কথা বলতে বলতে অনেকটা সময় পেড়িয়ে গেছে।

সে আশে পাশে তাঁকালো। কোথাও তিথিকে দেখলো না। দেখলো রেহনুমা কে। সে সব সময়ের মতো মধ্যমণি হয়ে বসে আছে । সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল! সে এসেছিলো তিথির জন্য, এতো মানুষের মধ্যে অস্বস্তি পড়েছে কিনা কে জানে। সে আবার উপরে যেতে লাগলো দাঁড়ালো রাইসার ডাকে। রাইসা রেহনুমার বোন। তাঁর পাশেই তাঁর এক কাজিন।

— কেমন আছেন মাহবুব ভাই?

— ভালো তোমাদের কি খবর?

— আর আমাদের খবর। যাক তবুও জিজ্ঞেস করলেন। আমিতো ভেবেছি এসে আমাদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেন কিনা কে জানে। যে ভাবে গেলো।

মাহবুব একটু অবাক হলো। আর বললো, — কে?

— কে আবার! আপনার আদরের মেয়ে। আরে ভাই এতো দিন পরে এসেছো। সবার তো কৌতুহল থাকবেই। তাই বলে এতো রুড। সবাই কে অপমান করে চলে গেলো। কেও তো থাকতেই চাইছিলো না। ভাগ্যিস আপা ছিলো। কতো কষ্টে ম্যানেজ করলো।

রেহনুমা এগিয়ে এলো। রাইসার দিকে তাঁকিয়ে বললো, — আহ্ রাইসা! কি বলছো? বাচ্চা মেয়ে! সে কি আমাদের সোসাইটির হাবভাব বুঝবে? না জানি কোথায় কি ভাবে ছিলো। তুমি যাও ওদিকটা একটু দেখো। কারো কিছু লাগবে কি না।

রাইসা চলে গেলো। রেহনুমা মাহবুবের একটু কাছে এসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে করুণ ভাবে বললো,— তুমি জানো মাহবুব! এই ঘর, এই সংসার, এই মানুষগুলোর সম্মানের জন্য আমি সব ছেড়েছি। নিজেকে, নিজের ক্যারিয়ার কে এবং তোমাকেও।

মাহবুব চোখ তুলে তাঁকালো। তবে কিছু বললো না। তাঁর চোয়াল শক্ত হলো।

রেহনুমা মনে মনে হাসলো! হেসে বললো,— আমি জানি তুমি তিথিকে নিয়ে খুবই কনসার্ন। এবং অবশ্যই থাকবে। সে তোমার একমাএ মেয়ে। তবে সে যেহেতু এখন এ বাসায় থাকছে। এ বাড়ি, এ বাড়ির মানুষ, বাড়ির সম্মানের কথা কিছুটা হলেও তাঁকে ভাবতে হবে। কিছুটা হলেও এই বাড়ির মতো চলতে হবে । সে তোমার মেয়ে। মাহবুব আহমেদের মেয়ে। অথচো সে নিচে এসেছে তাঁর সাধারণ ড্রেস পরে। আমাদের দেওয়া ড্রেস সে ছুঁয়েও দেখেনি। আর তাঁর ব্যবহার সেটা আর আমি তোমাকে বলতে চাইছি না মাহবুব ।

মাহবুব আর দাঁড়ালো না। সে ধীরে ধীরে উপরে উঠে গেলো। রেহনুমা একটু হতাশ ই হলো। সে যে ভাবে ভেবেছিলো, মাহবুবের রেসপন্স সে রকম পেলো না। তবে খুব যে একটা কাজ হয়নি তা কিন্তু না। বীজ বোনা হয়েছে এখন শুধু সময় মতো হাওয়া আর পানি দেওয়ার পালা।

রাইসা এগিয়ে এলো। পাশে দাঁড়িয়ে বললো,— তবে বলতেই হচ্ছে আপা। মেয়েটার নার্ভ খুবই ঠান্ডা। মিষ্টি মুখে এতো অপমান করা হলো। এমনকি তাঁর মাকে নিয়েও তবুও মেয়েটি টু শব্দ করলো না। শান্ত ভাবে সবার কথা শুনলো। আমিতো ভেবেছি তাইয়্যেবার মতো কেঁদে কেঁটে ঘর ভাসিয়ে ফেলবে।

রেহনুমার চোয়ালও শক্ত হলো। কথাটা সত্য! মেয়েটা দেখতে রেহনুমার মতো হলেও স্বভাবে না। সব কিছু সে মনোযোগ দিয়ে শুনেছে। তবে তাঁর মধ্যে কোন ভাবান্তর দেখা যায়নি । যেন সে জানতো এ রকমই হবে। আর শেষে মেয়েটা যখন চলে যেতে লাগলো। তখন সে একবার রেহনুমার দিকে তাঁকালো। সে তাঁকানোতে কি ছিলো রেহনুমা বুঝতে পারলো না। শুধু দেখলো দুটি চোখ যা একেবারে শান্ত আর শীতল।

চলবে…….