ঈশানুর তাসমিয়া মীরা পর্ব-১৬+১৭

0
437

প্রিয় বেলা
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
১৬.+১৭

নতুন টিউশন পেয়েছে বেলা। বাড়ি থেকে বেশ অনেকটা দূরে। ম্যানরোডের কাছকাছি। ভার্সিটি শেষে রাস্তার ওপারে করিম চাচাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে গেল সে। রিকশায় উঠে বসলো। নতুন স্টুডেন্টের বাসার ঠিকানা বলতেই করিম চাচা ভ্রু কুঞ্চিত করে বিরক্ত কণ্ঠে বললেন,
—“এত টিইউশন-ফিউশন কইরা কোনু লাভ আছে মা? এক ফড়াশোনা কইরাই কেলান্ত হইয়া পরেন। আদ্র স্যার তো এইজন্যই আফনার লাইগা আমারে রাখছে।”

প্রতিউত্তরে হালকা হাসলো বেলা। আজ সত্যিই বড্ড ক্লান্ত হয়ে পরেছে সে। বাসা থেকে দেড়িতে বের হওয়ায় ক্লাস টেস্টে খুব দ্রুত হাত চালিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মাঝে প্রশ্ন শেষ করতে হয়েছে। হাতটা টনটন করছে। ক্ষীণ যন্ত্রণা হওয়ায় সহ্য করা যাচ্ছে। রিকশা চালক আবার বললেন,
—“আফনার কাছে ফানি আছে মা? আইজ যা গরম পরছে! গলা শুকাই গেছি এক্কেবারে।”

ব্যাগ থেকে ছোট্ট পানির বোতলটা বের করলো বেলা। করিম চাচার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
—“আমি আপনার মেয়ের মতো চাচা। আমাকে তুমি করে ডাকবেন। আর এইযে, পানির বোতল।”
করিম চাচা যেন খুশি হলেন খুব। স্নিগ্ধ হাসি ভীর জমালো ঠোঁটের কোণে। চোখ জোড়া জ্বলজ্বল করে উঠলো। মাথা দুলিয়ে পানির বোতলটা নিলেন তিনি। একহাতে রিকশার হেন্ডেল ধরে, অন্যহাত দিয়ে একটু করে পানি পান করলেন। উনার পা দু’টো তখনো অবিশ্রান্ত রিকশার পেন্ডেল ঘোরাচ্ছে। পানি পান করা শেষে তিনি বোতলটা আবার ফেরত দিয়ে রিকশা চালাতে মনোযোগী হলেন। বেলা চারপাশটায় একবার চোখ বুলালো। ম্যানরোডের প্রায় অধিকাংশ জায়গা জুড়ে আদ্রদের দলের পোস্টার টানানো। তবে আদ্রর ছবি দেখা যাচ্ছে না। বড় বড় অক্ষরে নাম উল্লেখ করা আছে মাত্র।

রিকশা ঘুরিয়ে একটু ফাঁকা রাস্তায় ঢুকতেই হঠাৎ কালো রঙা একটা গাড়ি এসে থামলো রিকশার একদম সামনে। আকস্মিক হওয়ায় নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে রিকশা থামালেন করিম চাচা। রিকশা দুলে উঠলো। ভয়ে হুটের হাতল শক্ত করে ধরল বেলা। চোখ খিঁচে বুজে নিলো। রিকশা চালক করিম চাচা মনে মনে অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিতে উদ্যাগী হলেও পরক্ষণেই ফোনের রিংটোনের শব্দে থেমে গেলেন। পুরাতন গানের কিছু লাইন বেজে উঠছে। সাবানার গান। অত্যন্ত বিরক্তের সঙ্গে পকেট থেকে ফোন বের করে তা কানে রাখলেন তিনি। ওপাশ থেকে কিছু বলতেই থতমত গলায় বললেন,
—“আইচ্ছা। দিতাছি।”

তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে বেলার পানে তাকালেন। নিজের কিপেড ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললেন,
—“আদ্র স্যার কথা কইব তোমার লগে। লও।”
ঘন পাঁপড়ির মিশ্রণে তৈরি নেত্রপল্লব পিটপিট করলো তার। অবাক হয়ে ফোনটা নিলো। কানে রাখলো। তাকে কিছু বলতে না দিয়ে আদ্র ভারি গলায় বললো,
—“রিকশা থেকে নেমে আসুন বেলা।”

বলে সে দুই সেকেন্ড থামলো। পরপরই কেটে গেল কল। সামনের কালো গাড়িটায় দৃষ্টি ফেলতেই আবছা ভাবে আদ্রর মুখশ্রী খেয়ালে এলো বেলার। কিছুক্ষণ হাঁসফাঁস করে ইতস্তত ভঙ্গিতে নেমে পরলো রিকশা হতে। মাথার বিন্যস্ত ঘোমটা-টা প্রয়োজন ছাড়াই আবারও টেনে ঠিক করলো। করিম চাচা দাঁত বের করে হাসছেন। অস্বস্থিতে সেদিকে একবার চেয়ে বেলা মাথা নুয়ালো। আদ্র আগে থেকেই তার পাশের দরজা খুলে রেখেছে। বেলা গাড়িতে উঠে বসলে আর কালবিলম্ব করলো না সে। করিম চাচাকে ইশারা করে গাড়ি ঘোরালো।
গাঢ় নিরবতায় ছেদ ঘটিয়ে বেলাই প্রথমে জিজ্ঞেস করলো, “আমরা কোথায় যাচ্ছি?”

আদ্র উত্তর দেয় না। কি দৃঢ় আকর্ষণ নিয়ে গাড়ি চালাতে ব্যস্ত সে! এই গরমেও মুখে মাক্স তার। পরনে ছাই রঙের সাধারণ পাঞ্চাবী। বেলা আবার জিজ্ঞেস করলো,
—“উত্তর দিচ্ছেন না কেন? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?”
আদ্রর ত্যাড়া গলায় উত্তর,
—“কেন? আমি কোথাও নিয়ে গেলে সমস্যা আছে নাকি?”

আদ্রর হঠাৎ রাগের কারণ ঠিক ঠাওর করতে পারলো না বেলা। কপাল কুঁচকে তাকালো। জিজ্ঞেস করলো,
—“এভাবে কথা বলছেন কেন? আমি কি করেছি?”
উত্তরে দীর্ঘশ্বাস ফেললো আদ্র। স্টেয়ারিং থেকে হাত সরিয়ে বেলার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো। গম্ভীর গলায় অভিযোগ করলো,
—“আপনি আমার শান্তি কেড়ে নিয়েছেন বেলা। কাজ শেষে আপনাকে পাওয়ার শান্তিটুকুও আমার ভাগ্যে মেলে না। এমন যন্ত্রণা দিচ্ছেন কেন?”

বেলা কাতর নয়নে একবার তাকালো। নুয়ানো মাথার থুতনি ঠেকে গেল গলার সঙ্গে। ধীর গতিতে হাত সরাতে চাইলেই জোড়ালো ধমক দিয়ে সাবধান করলো আদ্র, “খবরদার! হাত সরাবেন না।”

বেলা থেমে যায়। হাত সরানোর ক্ষীণ চেষ্টাও আর করে না। প্রকট নিরবতায় ছেয়ে যায় পুরো সময়টা। শুধু যানবাহনে কড়া হর্ণের শব্দ কানে আঘাত হানছে একটু পরপর।
মাঝরাস্তায় গাড়ি থামিয়ে সরব দরজা খুলে বেরিয়ে যায় আদ্র। বেলাকেও নামিয়ে পেছনের সীটে বসিয়ে দেয় কোনো কথা ছাড়াই। বেলা হকচকিয়ে যায়, ভড়কায়, অবাক চোখে তাকায়। মিনমিন করে কিছু বলতে গিয়েও পারে না। আদ্র ভালোভাবে গাড়ি লক করে বেলার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরেছে। এই ছোট্ট জায়গাটিতেই। পা দু’টো ভাঁজ করে গুটানো। ঝাঁকড়া মাথার চুলগুলো বেলার উদরে কাতুকুতু সৃষ্টি করছে। শিরশির করছে স্থানটা। বেলা চাপা গলায় চিৎকার করে উঠে,
—“কি করছেন এসব? উঠুন।”

আদ্র চোখ বন্ধ থাকা অবস্থায়ই কপাল কুঁচকায়। ললাটে তৈরি হয় অসংখ্য বলিরেখা। দাম্ভিক স্বরে বলে,
—“চুপ থাকুন। ঘুমাতে দিন।”
বেলা আমতা আমতা স্বরে বললো,
—“আমার টিউশন আছে।”
আদ্রর একরোখা উত্তর, “যেতে হবে না।”
—“আমার নতুন টিউশন এটা। না গেলে কিভাবে কি হবে? আমি যাবো। আপনি সরুন।”

সরার পরিবর্তে বেলার সঙ্গে আরও মিশে রইলো যেন সে। ঘুম ইতিমধ্যে চোখে এসে হানা দিয়েছে। পল্লবজোড়া মেলতে পারছে না আদ্র। ঘুমিয়ে যেতে যেতে লহু স্বরে বললো, “মাত্র আধঘণ্টা ঘুমাবো। তারপর পৌঁছে দিব। এখন বিরক্ত করবেন না। ঘুমাচ্ছি।”

আদ্র ঘুমিয়ে পরেছে। বেলার একহাত তার গলা পেরিয়ে নিজের হাতের ভাঁজে ভাঁজে আটকে রেখেছে। বেলা অনভ্যস্ত হাতে আদ্রর ঝাঁকড়া মাথার চুলগুলোয় কিছুক্ষণ হাত বুলালো। তারপর কপাল, গাল, নাক ছুঁয়ে দিলো একে একে। আদ্র গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তখন। চোখের নিচটায় কালি পরে গেছে। ফর্সা ত্বকে তা বড্ড বেমানান। তার ঘুমন্ত মুখখানায় স্পষ্ট কান্তির ছাপ। বেলা সন্তপর্ণে আদ্রর মাক্সটা খুলে নিলো। ওড়না দিয়ে কপালের ঘাম মুছলো। খুব আস্তে করে বললো,
—“রাজনীতি মানুষ থেকে কতকিছু কেড়ে নেয় আদ্র, আপনি কখন বুঝবেন?”

আদ্র কি শুনলো তার কথা? কি জানি! একটু নড়েচড়ে উঠলো সে। বেলার হাত আরও শক্ত করে ধরলো। হাতের পিঠে অধর ছোঁয়ালো হঠাৎ। বেলা চমকিত হলো। ধূলিসাৎ হলো সব। নিশ্বাসের গতি বাড়লো। এলোমেলো দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকালো সে।

মাঝরাত। ধীর পায়ে বাড়িতে ঢুকছিল আদ্র। সোফায় আয়াজকে এবড়োখেবড়ো ভাবে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকালো। প্রশ্ন করলো,
—“তুই এখানে কি করিস? ঘুমাস নি এখনো?”

আদ্রর তন্দ্রা কেটে গেল। ধড়ফড়িয়ে উঠলো সে। আদ্রকে দেখে অল্প হাসার চেষ্টা করলো। ঠিক হয়ে বসে বললো,
—“ভালো লাগছিল না। তাই টিভি দেখতে এসেছি।”
—“টিভি তো তোর রুমেও আছে। ওটা বাদ দিয়ে এখানে বসে টিভি দেখছিস কেন?”
সন্দিহান কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো আদ্র। আয়াজ মুখের সবকটি দাঁত বের করে হাসলো। একহাতে মাথার পেছনের চুল চুলকালো। ক্ষীণ তোতলিয়ে বললো, “আমার রুমেরটা নষ্ট হয়ে গেছে। তাই আরকি।”

আদ্রর সন্দেহ কমলো না। তবুও সে এ নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন করে না। টিভিতে আয়াজ তার ভাষণ শুনছে। নির্বাচনের জন্য কালকে সেখানে যেতে হয়েছিল তার। আদ্র আয়াজের পাশে বসে সোফায় গা এলিয়ে দিলো। হাত ঘড়ি খুললো। শার্টের প্রথম তিনটে বোতাম খুলে হাতা গোটালো। বললো,
—“মা কোথায়? ঘুমিয়ে গেছে?”
—“হ্যাঁ। ঘুমাতে যেতে চাচ্ছিল না। তোর জন্য অপেক্ষা করছিল। আমি কিছুক্ষণ আগেই ঠেলেঠুলে পাঠিয়েছি।”

শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো আদ্র। সোফায় মাথা হেলিয়ে চোখ বুঝলো। আয়াজ তার দিকে চিন্তিত নেত্রে তাকিয়ে আছে। টিভির সাউন্ড আস্তে করে কমিয়ে দিলো সে। ডাকলো,
—“ভাই। একটা কথা ছিল তোর সাথে।”
আদ্রর ক্লান্ত গলায় ছোট্ট সম্মতি, “বল।”

আয়াজ সময় নিলো। এলোমেলো গলায় বললো, “বেলাকে আজ সন্ধ্যায় ছেলে পক্ষ দেখতে এসেছিল।”

_______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

প্রিয় বেলা

১৭.
কথাটা মস্তিষ্কের স্নায়ুতে পৌঁছাতে বেশ সময় নিলো। আদ্র স্থির ভঙ্গিতে তখনো সোফায় মাথা হেলিয়ে রেখেছে। সে কি শুনেনি তার কথা? নাকি বুঝতে পারে নি? জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেঁজালো আয়াজ। আদ্রর ক্লান্ত, কঠিন মুখপানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। মনে মনে সাহস জুগিয়ে আবার বললো,
—“ভাই শুনছিস আমার কথা? বেলাকে পাত্র দেখতে এসেছিল আজকে।”

আদ্র শুনলো এবার। চোখ মেললো। সঙ্গে সঙ্গে ক্লান্তিতে ভেঙ্গে আসা রক্তিম নেত্রজোড়া দৃশ্যমান হলো। কি ভয়ংকর সেই লাল শিরাগুলো। চোখের মণি ঘিরে রেখেছে। আদ্র আয়াজের মুখোমুখি বসল। খুব শীতল চাহনি নিক্ষেপ করে শান্ত গলায় সাবধান করলো,
—“ক্লান্ত লাগছে আমার। মাথাও ঠিক নেই। চটে আছি। তুই কি চাচ্ছিস আমার মেজাজটা আমি তোর ওপর দেখাই?”

আয়াজ চোখ বড়সড় করে তাকালো। দ্রুত মাথা নাড়িয়ে না করলো। তারপর সর্তক কণ্ঠে বললো,
—“সত্যি বলছি ভাই। সন্ধ্যায় এসেছিল ওরা। মাও গিয়েছিল। পাত্রর নাকি বেলাকে খুব পছন্দ হয়েছে। সায়েদ আঙ্কেল এখনো কিছু জানান নি। তোর বিশ্বাস না হলে সকালে মাকে জিজ্ঞেস করিস। আমি মিথ্যা বলছি না।”

আদ্রর চোয়াল শক্ত। নিদারুণ কঠিন্যতায় ভরপুর মুখশ্রী। কোনোরকম রাগ আটকে রেখেছে সে। আয়াজের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে একবার তাকিয়ে সোফা ছেড়ে উঠে পরলো আদ্র। আয়াজ তাড়াতাড়ি করে বললো, “মা তো এখন ঘুমাচ্ছে ভাই। সকালে জিজ্ঞেস করিস। তোর কি আমার কথায় বিশ্বাস নেই?”
আদ্র উঁচু গলায় সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয়, “নেই।”
আয়াজের চোয়াল যেন হা হয়ে যায়। বিড়বিড় করে বলে, “একেই বলে মীরজাফর। নিজের প্রাণপ্রিয় ঘুম ধ্বংস করে তার কলিজা, ফুসফুসের সব খবরাখবর রাখছি আমি। অথচ আমারই দাম নেই। এইজন্যই ভালো মানুষগুলো দুনিয়া থেকে বিলুপ্ত আজ। কি একটা অবস্থা!”
আপন মনে কথাগুলো বলে সটান হয়ে সোফায় শুয়ে পরলো আয়াজ। রুমে যাওয়ার শক্তি নেই। ঘুমে শরীর ভেঙ্গে আসছে তার।

রুমে যেতে যেতে দুইতিনবার বেলাকে কলও করে ফেললো আদ্র। অস্থির হয়ে শরীর থেকে শার্ট খুলে নিলো। উষ্কখুষ্ক চুলগুলোয় হাত চালালো বারংবার। হাতের ব্যান্ডেজ, বুকের ব্যান্ডেজ অসহ্য লাগছে খুব। ঠিকমতো হাত নাড়ানো যাচ্ছে না। একটানে তা খুলে ফেলতেই ক্ষীণ রক্ত বেড়িয়ে এলো বুকের ক্ষত হতে। ক্ষত স্থানটা তখনো শুকায়নি। বিরক্ত হয়ে টিস্যু দিয়ে রক্তগুলো মুছে নিলো আদ্র। বিছানায় বসে আবারও কল লাগালো বেলাকে। একবার, দু’বার, তিনবার, অনেকবার। মেয়েটা তবুও ফোন ধরলো না। অসহ্য অবহেলায় তন্দ্রা কাটিয়ে দিলো তার। চাপা রাগে মাথার যন্ত্রণা দ্বিগুণ বেড়ে গেল যেন। হাতের ফোনটা শক্ত করে চেপে ধরলো আদ্র। হাতে ব্যথা পেল। তবে তা হৃদয়ের রক্তক্ষরণ হতে খুব কমই বটে।

টিউশন শেষে করিম চাচাকে দেখতে পেল না বেলা। অনেক্ষণ অপেক্ষার পরও উনার দেখা মেললো না। ব্যাগে মাত্র বিশটাকা আছে। এই অল্প টাকা দিয়ে বাড়ি পর্যন্ত যাওয়া যাবে না। তবে হেঁটে হেঁটে অর্ধেক রাস্তা অতিক্রম করলে এই টাকায় রিকশা পেলেও পেতে পারে। তাই আর আশপাশটায় নজর দিলো না সে। কাঁধের ব্যাগটা শক্ত করে ধরে হাঁটতে লাগলো। রাস্তা পার হয়ে ফুটপাতে আসতেই হঠাৎ কালো রঙের আদ্রর গাড়িটা এসে থামলো তার একদম পাশে। বেলা চমকে গেল। কয়েক কদম পিছু হটে দাঁড়ালো। বিস্মিত হয়ে কিছু বলতে নিয়েও পারলো না। এর পূর্বেই তার হাত টেনে গাড়িতে বসিয়ে দিলো আদ্র। নিষ্ঠুর চোখেজোড়া মেলে একবার তাকালোও না বেলার পানে। শুধু গম্ভীর, ক্রোধপূর্ণ স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
—“আজকাল দেখছি বিয়ের খুব সখ জেগেছে। পাত্রদের সামনে সেজেগুজে বসে যাচ্ছে। নিজের রুপ দেখাচ্ছে। এত সাহস কোথায় পাচ্ছে এরা? ভয় লাগে না? বুক কাঁপে না একটুও?”

বেলা ভয়ে ঢোক গিললো। কি বলবে বুঝে পেল না। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এলো ক্রমশই। লোকটাকে তো সে ভয় পায় না৷ আজকে পাচ্ছে কেন? কাঁপা স্বরে কিছু বলতে নিলেই আদ্র আবার প্রশ্ন করলো,
—“ফোন কোথায় থাকে তোমার? কাল রাত থেকে কতবার কল করেছি। দেখো নি?”
বেলা ঠোঁট কামড়ে চারপাশটায় এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো। ক্ষীণ স্বরে বললো, “দেখেছি।”

আকস্মিক জোড়ে ধমক দিয়ে উঠলো আদ্র, “তাহলে কলব্যাক করোনি কেন? আমাকে কি মানুষ বলে মনে হয়না তোমার? বলো! হয়না?”
বেলা কেঁপে উঠলো। ভীতু চোখে তাকালো। লোকটাকে সে চিনতে পারছে না। এমনটা তো করেনি কখনো। আজকে এভাবে রাগ দেখাচ্ছে কেন? ধমকাচ্ছে কেন? বেলা মাথা নুয়ালো। কাঁপা গলায় থেমে থেমে বললো,
—“সকালে দেখেছিলাম। পরে কলব্যাকও করতাম। কিন্তু মনে ছিল না আর। সরি।”

আদ্র সশব্দে স্টেয়ারিংয়ে ধাক্কা মারলো। হকচকিয়ে তাকালো বেলা। আড়চোখে আদ্রকে দেখল। সে ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলছে। নিশ্বাসের গাঢ় শব্দ শোনা যাচ্ছে খুব প্রখর ভাবে। দাঁতে দাঁত চেপে রেখেছে। কপালের রগগুলো ফুলে ভয়ংকর অবস্থা। গৌর বর্ণের মুখশ্রী কি রুঢ়, দাম্ভিক! সাহস নিয়ে কম্পয়মান হাতটা আদ্রর হাতের পিঠে রাখলো বেলা। কোমল স্বরে বললো, “এত রেগে যাচ্ছেন কেন? শান্ত হন। আমার তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না।”
আদ্র প্রবল ক্রোধ নিয়ে আবারও ধমকের রেশ নিয়ে বললো,
—“তোমার এই হয়ে যাচ্ছে না নিয়ে বসে থাকবো আমি? যদি হয়ে যেত? তখন আমি কি করতাম?”

বেলা চুপ হয়ে গেল। লোকটা তাকে তুমি করে বলছে, আপনি ডাকছে না। ব্যাপারটা প্রথম থেকেই খেয়াল করেছে সে। ভালো লাগায় সিক্ত হলেও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনি। কি প্রাণনাশক ডাকটা। কি মধুময়!
আদ্র ড্রাইভ করছে। নিজ থেকে বেলার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। বেলা একবার বাহিরে তাকালো। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। সূর্য ডুবে গেছে সেই কবে। বেলা মিনমিন করে জিজ্ঞেস করলো, “বাসায় ফিরবেন না?”

আদ্রর উত্তর নেই। কপাল খানিক কুঁচকে গেছে। দৃষ্টিতে তীক্ষ্ণ ভাব। বেলা ইতস্তত করলো। আধো গলায় বললো,
—“আমি তো বিয়ে করতাম না।”
—“কেন করতে না?” তৎক্ষণাৎ উত্তর এলো ওপাশ থেকে।
বেলা আদ্রর দিকে তাকালো। লোকটা এতক্ষণে শান্ত হয়েছে। কপালের ভাঁজগুলো মিলিয়ে গেছে। তবে গম্ভীর ভাব এখনো বিরাজমান। বেলা সময় নিয়ে, আমতা স্বরে আগের মতোই বললো,
—“আপনাকে রেখে কিভাবে করবো?”

শুনে ক্ষীণ থমকালো আদ্র। এরপরই নিঃশব্দে হেসে ফেললো সে। বেলা দেখতে পেল না। গাড়ি থামিয়ে দিলো কড়া ব্রেকে। উজ্জ্বল চোখে তাকালো। নিষ্প্রভ স্বরে বললো, “দেখি, বুকে আসো। অনেক জ্বালিয়েছ।”

বেলা পিটপিট করে তাকালো। মানা করার জন্য উদ্যোগী হলেও সুযোগ দিলো না আদ্র। টেনে নিয়ে বুকে জড়িয়ে নিলো তাকে। খুব প্রগাঢ় ভাবে, ঘনিষ্ট হয়ে। বেলা লজ্জিত ভঙ্গিতে একটু জড়োসড়ো হলো। আদ্র কি ভেবে হঠাৎ বললো, “ছেলেটার নাম কি?”

বেলা বুঝলো না যেন। জিজ্ঞেস করলো,
—“কোন ছেলে?”
—“তোমাকে যে দেখতে এসেছিল।”
—“কেন?”
—“লাগবে আমার।”

বেলা আতঙ্কিত হয়ে তাকালো। উৎকণ্ঠ হয়ে বললো, “আপনি কি মারপিট করতে চাইছেন?”
আদ্র ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো। উত্তর দিলো,
—“হ্যাঁ।”

________________

চলবে~