উপসংহারে ভালোবাসা পর্ব-০৮ এবং শেষ পর্ব

0
370

#উপসংহারে_ভালোবাসা
#অন্তিম_পর্ব
#তিয়াশা_জেরিন

তিশপি আপুর বিয়েটা ভালোভাবে সম্পন্ন হয়ে গিয়েছে।সেদিন প্রিয়ার পরে যাওয়াতে মেহেরাব দ্রুত তার কাছে দৌড়ে যায়।তার জন্য অস্থির হয়ে পরে।প্রিয়া সেদিন বুঝতে পেরেছিল মানুষটা তাকে কত ভালোবাসে।তারপর বেশ চেষ্টা করে মেহেরাবের অভিমান ভাঙানোর।কিন্তু মেহেরাব তো মেহেরাবই সে প্রিয়ার সাথে কথা বলছিল না।

তাই একদিন প্রিয়া মেহেরাবের ঘরে যায়।আর মনে মনে বলতে থাকে,

-“ব্যস অনেক হয়েছে।আজ এসপার নয় ওসপার করেই ছাড়বো।পেয়েছেটা কি লোকটা হ্যা।”

প্রিয়া মেহেরাবের ঘরে এসে দেখে মেহেরাব ল্যাপটপে খুব মনোযোগ দিয়ে কোনো কাজ করছে।প্রিয়া মেহেরাবের কাছে এসে বলে,

-“মেহেরাব ভাইয়া আমার তোমার সাথে কথা আছে।”

মেহেরাব কিছু বললো না।প্রিয়ার এবার ভীষণ রাগ উঠছে,সাথে কান্না পাচ্ছেও।সে না হয় ভুল করে দু একটা কথা তাকে বলেই ফেলছে এর জন্য তো কতবার সরি বলেছে।সে কথা না বললেও বেহায়ার মতো কতবার কথা বলতে এসেছে।এদিকে কথা বলছে না ঠিকই কিন্তু প্রিয়ার যত্নে কোনো কমতি রাখছে না।কি অদ্ভুত অবহেলা তার।

প্রিয়া আর পারলো না ধপ করে নিচে বসে কান্না করে দিলো।প্রিয়ার কান্নার শব্দে মেহেরাব চমকে প্রিয়ার দিকে তাকালো।কি হলো সে তো তাকে বকে নি বা তার সাথে কোনো খারাপ ব্যবহারও করেনি তাহলে প্রিয়া এভাবে কান্না করছে কেন।মেহেরাব তাড়াতাড়ি করে প্রিয়ার কাছে যেয়ে প্রিয়ার দুগাল আকড়ে ধরে বলে,

-“কি হয়েছে প্রাণপ্রিয়া,কাঁদছিস কেন এভাবে?বল কি হয়েছে,কেউ কিছু বলেছে?”

প্রিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলে,

-“তুমি জানো না কি হয়েছে?আর কতদিন আমার সাথে এভাবে কথা না বলে থাকবে তুমি বলো।”

এরপর প্রিয়া হুট করে মেহেরাবকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মাথা রেখে বলে,

-“আমার কষ্ট হচ্ছে মেহেরাব ভাইয়া।এবারের মতো ক্ষমা করে দাও না।”

প্রিয়ার এমন কাজে মেহেরাব অনেকটা চমকে যায় কিন্তু পরক্ষণেই কিছু একটা ভেবে তার মুখে হাসি ফুটে উঠে।তার প্রাণপ্রিয়ার মনের মধ্যে তার জন্য অনুভূতি রয়েছে।না হলে যে মেয়েটা আমি তার সাথে এত কথা বলতাম বলে আগে বিরক্ত হতো আর সেই মেয়েটাই এখন বলছে কি না আমি কথা না বলাতে তার কষ্ট হচ্ছে।মেহেরাব তারপর প্রিয়াকে বলে,

-“কেন রে আমি কথা না বলাতে তোর আরো ভালোই হয়েছে,তোকে আর কেউ বিরক্ত করে না।”

প্রিয়া মেহেরাবের বুক থেকে তার মাথাটা হালকা তুলে বলে,

-“তুমি কথা না বলাতে আমি আরো বিরক্ত হচ্ছি।”

প্রিয়ার কথায় মেহেরাব হালকা হেসে প্রিয়াকে সরিয়ে দিয়ে বলে,

-“আমার এতটা কাছে আসিস না,আমি তো চরিত্রহীন কে বলতে পারে,জোর করে তোর কাছ থেকে নিজের চাহিদা মিটিয়ে নিলাম।”

প্রিয়া খেয়াল করেছে কথাটা বলার সময় মেহেরাবের চোখদুটো কেমন ছলছল করছিল,গলাটা ধরে এসেছিল তার।সত্যি সে তার মেহেরাব ভাইয়াকে ভীষণ কষ্ট দিয়ে ফেলেছে।তার ভালোবাসাকে অপমান করেছে।প্রিয়া আর কিছু না বলে উঠে গেল মেহেরাব তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো।প্রিয়া দরজাটা বন্ধ করে এসে মেহেরাবের মুখোমুখি বসলো।এরপর মেহেরাবের সেই ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলো।এই চোখ যে তাকে চিৎকার করে বলছে,

-“আমি তোকে খুব ভালোবাসি রে প্রাণপ্রিয়া।তুই কি করে ওই বাজে কথাগুলো বলতে পারলি আমাকে।”

প্রিয়া কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুচকি হেসে মেহেরাবের গালে চুমু দিয়ে বলে,

-“জোর করবে কেন,আমি তো তোমারই।”

প্রিয়ার এমন কাজে মেহেরাব যেন অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল।প্রিয়া হঠাৎ এসব কি বলছে।মেহেরাব প্রিয়ার সামনে থেকে উঠে পরে এবং প্রিয়াকে বলে,

-“এসব তুই কি বলছিস প্রিয়া,তুই বুঝতে পারছিস তুই কি বলছিস?”

-“হুম আমি তো বুঝতে পারছি,আমি কি বলছি।কেন তুমি বুঝতে পারছো না,আমি তো অন্য কোনো ভাষাতে বলিনি বাংলাতেই বলছি।”

এই বলে প্রিয়া মিটিমিটি হাসতে থাকলো।মেহেরাব প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে বুঝলো নিশ্চয় এ মেয়েটার মাথার মধ্যে কিছু একটা চলছে।

প্রিয়া এরপর মেহেরাবের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো,

-“দেখো আমি যা বলার সোজাসুজি বলছি,বাবা মা চাচ্ছে যে এখন আমাকে বিয়ে দিতে।আমার কাছে জিজ্ঞেস করেছিলো আমার পছন্দের কেউ আছে কিনা।আমি তোমার কথা বলে দিয়েছি।”

-কি?

মেহেরাব অবাকের উপর অবাক হচ্ছে এসব কি বলছে আর কি করছে প্রিয়া।ওর মাথা ঠিক আছে তো।প্রিয়া আবার মেহেরাবকে বললো,

-“এবার বলো তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে?”

মেহেরাব যেন ভাষাই হারিয়ে ফেলেছে।তার এখন কি বলা উচিৎ।মেহেরাবের এমন চুপ থাকা দেখে প্রিয়ার এবার বিরক্ত লাগলো।সে বিরক্ত হয়ে বললো,

-“ওহ তুমি মনে হয় আমাকে বিয়ে করবে না,আমারই ভুল।আমি ভেবেছি তুমি আমাকে সত্যি ভালোবাসো।সরি।আমি যেয়ে বাবা-মা বলে দিচ্ছি তারা যেন তাদের পছন্দ করা ছেলেকেই আমি বিয়ে করবো।”

এই বলে প্রিয়া বেরিয়ে গেল।মেহেরাব অবাক হয়ে প্রিয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।

দেখতে দেখতে প্রিয়ার বিয়ের দিন এসে গেল।প্রিয়ার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।মনের সাথে যুদ্ধ করে সে এ বিয়েটা করছে।মেহেরাব কখনো কখনো তাকে ভালোবাসেনি,কখনো না।যদি ভালোইবাসতো তাহলে প্রিয়ার অন্য কোথাও বিয়ের কথা শুনেও কেন আটকালো না।তার ভীষণ অভিমান হলো মেহেরাবের উপর।সে জানে কিছুক্ষণ পর তার এই অভিমানটা করাও সাজবে না।

ইপ্সিতা আর তার স্বামী একসাথে প্রিয়ার বিয়েতে এসেছে।ইপ্সিতার দুইমাস আগেই বিয়ে হয়েছে তবে রিশাদের সাথে নয়।ইপ্সিতা পরে জানতে পেরে গিয়েছিল রিশাদ কেমন ছেলে।সে কখনোই ইপ্সিতাকে ভালোবাসেনি।মেহেরাব ইপ্সিতার ভাই ইফসানকে বিষয়টা জানিয়েছিল।এরপর ইপ্সিতা তার ভাইয়ের কাছে সবটা শুনে প্রথমে বিশ্বাস না করলেও পরে নিজের হাতে নাতে প্রমাণ পেয়েছিল।ইপ্সিতা ভীষণ ভেঙে পরেছিল তখন তার পরিবার,প্রিয়া সবাই তাকে সামলেছে।ইপ্সিতা প্রথমে বিয়েটা করতে না চাইলেও পরে তার বাবা-মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে করেছে।কি হবে সেই বিশ্বাসঘাতকটার কথা ভেবে তার জন্য নিজের জীবনকে শেষ করে তার চেয়ে বরং নিজের জীবনকে আরেকবার সুযোগ দিয়ে দেখি।ইপ্সিতা তার স্বামীর সাথে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে।মানুষটা ভালো।তাকে বোঝে,সম্মান করে।সে তাকে সময়ও দিয়েছে।ইপ্সিতা তার স্বামীকে বলে প্রিয়ার সাথে দেখা করতে যায়।তার স্বামী একজন নামকরা ডাক্তার আর তার কাছেই প্রিয়াদের পরিবার চেকাপের জন্য যায়।সে সুবাদে ইপ্সিতার স্বামীকে তারা ভালোভাবেই চিনে।

ইপ্সিতা প্রিয়ার কাছে গেলে প্রিয়া ইপ্সিতাকে দেখা মাত্রই তাকে জড়িয়ে কেঁদে দেয়।এতক্ষণের জমানো কান্না যেন সে আর ধরে রাখতে পারলো না।সে কাঁদতে কাঁদতে ইপ্সিতাকে বললো,

-“দেখ,মানুষটা কতটা নিষ্ঠুর।আমাকে কিভাবে শাস্তি দিলো।আমার যে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।তার যত্নগুলোতে আমি তাকে ভালোবেসে ফেলেছি রে আমি কি করবো বল।”

ইপ্সিতা প্রিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

-“কাঁদিস না,দেখবি যা হবে ভালোর জন্যই হবে।তুই পাত্রকে দেখেছিস না।”

-“না,আমার তো এই বিয়েটাই করতে ইচ্ছে করছে না।কিন্তু এবার আর মনের কথা শুনবো না,তার যদি এতে কিছু যায় না আসে তবে আমিও এই বিয়েটা করবো।”

ইপ্সিতা আর কিছু বললো না।এরপর সেই কাঙ্ক্ষিত সময় উপস্থিত হলো।প্রিয়াকে কবুল বলতে বললে প্রিয়া আরো একবার চারিদিকে চোখ বুলিয়ে মেহেরাবকে খুঁজলো কিন্তু না কোথাও তাকে দেখলো না।তার আশা ছিল মেহেরাব হয়তো বিয়েটা আটকাবে।কিন্তু না।প্রিয়া রাগ,জেদ থেকে আর দেরি না করে কবুল বলে দিল।বিয়েটা ভালোভাবে সম্পন্ন হয়ে গেল।বিদায় বেলা উপস্থিত হলে প্রিয়ার বুক ফেটে কান্না আসছে।বর বউকে একসাথে বসানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হলে বরবেশে মেহেরাবকে দেখে সে চমকে উঠলো।সবাই প্রিয়াকে নিয়ে যেয়ে মেহেরাবের পাশে বসিয়ে দিলে প্রিয়া হা করে মেহেরাবের দিকে তাকিয়ে থাকলো।প্রিয়ার এমন অবস্থা দেখে মেহেরাব হালকা হাসলো।সে জানে প্রিয়া একবারও তার বাবা-মায়ের কাছে পাত্রের কথা জানতে চায় নি বা পাত্রকে দেখতেও চায়নি।আর সে যে এটা তার উপর রাগ থেকে করেছে এটাও সে জানে।

মেহেরাব সামনে তাকিয়েই বললো,

-“এবার হা টা বন্ধ কর,নাহলে মাছি ঢুকে যাবে।”

মেহেরাবের কথায় যেন প্রিয়ার হুশ ফিরলো।প্রিয়া কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,

-‘আ..আপনি?’

-“তা তুই অন্য কাউকে আশা করেছিলে বুঝি।তুই না সেদিন বলেছিলি তুই আমার,তাহলে তুই ভাবলি কি করে যে আমার জিনিসকে আমি অন্যজনের হতে দিবো।”

প্রিয়া যেন কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল।তার এই মূহুর্তে ঠিক কেমন অনুভূতি হচ্ছে সে বুঝতে পারছে না।ভালোবাসার মানুষটিকে পাওয়ার আনন্দ,নাকি পুরো বিষয়টাকে না জেনে এতদিন কষ্ট পেয়েছে তার সেই নির্বুদ্ধিতার জন্য কষ্ট।প্রিয়া যেন এতক্ষণে দম ছাড়লো।যত যাই হোক,তার মানুষটাতো তারই আছে।এরপর প্রিয়ারা সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পরে।

প্রিয়ার খালামণি অর্থাৎ বর্তমানে তার শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার পর সব নিয়ম-কানুনগুলো শেষ করে।প্রিয়াকে মেহেরাবের ঘরে দিয়ে যাওয়া হয়।প্রায় বেশ কিছুক্ষণ পর মেহেরাব ঘরে আসে।এসে দেখে প্রিয়া ঘরে নেই।সে জানে প্রিয়া তার বেলকনিতে রয়েছে।এরপর মেহেরাব একটা হতাশার শ্বাস ফেলে বললো,

-“এবার আবার আমাকে প্রাণপ্রিয়ার অভিমান ভাঙাতে হবে।আমাদের এই মান-অভিমানের পালাই তো মিটছে না।”

মেহেরাব বেলকনিতে গিয়ে দেখে প্রিয়া বিয়ের পোশাক ছেড়ে এখন একটা হালকা নীল রঙের শাড়ি পরেছে কি দারুণ দেখাচ্ছে তাকে।মেহেরাব যেয়ে পিছন থেকে প্রিয়াকে জড়িয়ে ধরে।প্রিয়া সাথে সাথে বলে উঠে,

-ছাড়ো।

-“উহুম প্রশ্নই উঠে না।এ জীবন থাকতে তো তোকে ছাড়তে পারবো না।আর আমার কি দোষ বলতো তুই তো নিজেই পাত্রের কথা জানতে চাস নি।তুই জানতে চাইলে কি আর কেউ তোকে মিথ্যা বলতো আমি তো আর নিষেধ করে দেয়নি বল।”

প্রিয়া তাকে ছাড়িয়ে তার দিকে ঘুরে বলে,

-“আচ্ছা মানলাম,এখানে আমার নির্বুদ্ধিতা ছিল।কিন্তু তুমি কেন এতদিন আমার সাথে কথা বলোনি?”

-“আমার ভালোবাসাটা,আমার উপস্থিতিটা,আমার প্রতি তোর অনুভূতিটা তোকে বোঝাতে,তুই আমাকে কতটা ভালোবাসিস সেটা তোকে বোঝাতে।”

প্রিয়া গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,

-“যাও তোমার সাথে কোনো কথা নেই।”

মেহেরাব হালকা হেসে প্রিয়ার কাছে এসে প্রিয়াকে কোলে তুলে নিলো তারপর কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,

-“তোকে কিছু বলতে হবে না।তুই শুধু অনুভব করবি।আমার ভালোবাসার রাজ্য থেকে তোকে ঘুরিয়ে আনবো।এই মেহেরাব যে তার প্রাণপ্রিয়ার জন্য কতটা পাগল আজ সে বুঝবে।যতই মান-অভিমান হোক দিনশেষে এই আমার আমিটার কাছেই তোকে ফিরতে হবে।আমার ভালোবাসায় তোকে সাজতে হবে।উপসংহারে ভালোবাসাটাই থাকবে।”

এই বলে প্রিয়াকে নিয়ে মেহেরাব তার ঘরে চলে যায়।তাদের ভালোবাসার এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে,এক নতুন জীবনের শুরু করতে।

সমাপ্ত