উড়ো পাতার ঢেউ পর্ব-২৫+২৬+২৭

0
174

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ২৫
_________________

রুমের ভিতরের দৃশ্যটা দেখে জুহি আর স্থির রাখতে পারলো না নিজেকে। দরজাটা হাট করে খুলে ভিতরে প্রবেশ করে বললো,
“চলো টিজা, বাসায় যাই।”

ক্যানিয়ল, ইরতিজা দুজনে তাকালো জুহির দিকে। ক্যানিয়ল এখনও ইরতিজার মাথাটা নিজের নিকটে ধরে রেখেছে। ইরতিজা সরে যেতে চাইলে ক্যানিয়ল সরতে দিলো না। সে জুহির দিকে তাকিয়ে বললো,
“তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে আমাদের দেখছিলে প্লে-গার্ল?”

‘প্লে-গার্ল’ কথাটা শুনে জুহির গায়ে আগুন জ্বলে গেল।
“আমি লুকানো ছিলাম না, বুঝেছো? ছাড়ো টিজাকে।”

জুহি কাছে এসে ইরতিজাকে টেনে আনলো ক্যানিয়লের কাছ থেকে। ক্যানিয়লকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ইরতিজাকে নিয়ে বেরিয়ে এলো।

“তোমাদের দুজনের ভিতর অবশ্যই কিছু চলছে টিজা, অবশ্যই কিছু চলছে! তুমি এটা সম্পর্কে আমাকে কিছু না বলে কীভাবে পারলে?”

ইরতিজা চমকালো জুহির কথায়।

“তোমাদের দুজনের মাঝে রিলেশনশিপ চলছে। ইয়েস চলছে। আমি খুবই খারাপ বোধ করছি যে তুমি আমাকে কিছু জানাওনি!”

“তুমি…”

“নো, আমি কিছু শুনতে চাইছি না।”
জুহি কেমন কাঁদো কাঁদো ভাব ধরে ইরতিজাকে রেখে আগে আগে পা চালিয়ে চলে গেল। যে মানুষটাকে তার ভালো লাগতো, যে মানুষটার আকর্ষণ পাওয়ার চেষ্টা করতো, সেই মানুষটা তাকে একটুও পাত্তা দিতো না! অথচ এখন সে অন্য একটা মেয়ের সাথে মেলামেশা করছে এমনভাবে। ব্যাপারটা মেনে নিতে জুহির যেন একটু কষ্টই হচ্ছে।

জুহি আর ইরতিজা বাসায় ফিরলো আলাদা আলাদাভাবে। জুহি ইরতিজাকে রেখে চলে এসেছে। ইরতিজা আসলো এইমাত্র। লিভিংরুমে প্রবেশ করে চোখ পড়লো সর্বপ্রথম সোফার উপর। নওরিন শুয়ে আছে সোফায়। চোখ বন্ধ। কপালের উপর এক হাত ফেলে রেখেছে। কিচেন থেকে ভেসে আসা ক্ষীণ আওয়াজে ইরতিজা সচকিত হয়ে কিচেনের দরজায় তাকালো। মস্তিষ্কে ক্ষণিকের জন্য ঘটে গেল ছোটো একটা বিস্ফোরণ। ক্রন্দনের শব্দ!
ইরতিজা এগিয়ে গেল কিচেনের দিকে। মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ইরতিজার বুঝতে বাকি রইল না নওরিনের সাথেই মনোমালিন্য হয়েছে মায়ের। সে জিজ্ঞেস করলো,
“কাঁদছো কেন মা? কী হয়েছে?”

শারমিন মেয়ের দিকে তাকালেন। তার চোখে জল। কঠিন গলায় বললেন,
“কোনো প্রশ্ন না করে নিজের রুমে যাও ইরতিজা।”

ইরতিজার হৃদপাহাড় ধ্বসে পড়লো এক অংশ দিয়ে। মা অন্য সবকিছুর সাথে কোমল থাকলেও তার সাথে কখনোই কোমল ছিল না। মায়ের অহেতুক ঘৃণার কারণ হয়ে নিজের প্রতি নিজের বিস্বাদ অনুভব হয় মাঝে মধ্যেই। সে কিছু না বলে বেরিয়ে এলো।
আজাদ চৌধুরী এ সময় বাসায় নেই। তিনি হাঁটতে বের হয়েছেন প্রতিবেশি বন্ধুর সাথে।
ইরতিজা নওরিনের কাছে এসে বললো,
“কী বলেছো তুমি মাকে? মা কাঁদছে কেন? এমন কেন করো তুমি? সব সময় মায়ের সাথে ভালো আচরণ করা যায় না?”

নওরিন কপাল থেকে হাত সরিয়ে চোখ খুলে শক্ত চেহারায় বললো,
“তুমি জাস্ট চুপ করো! কার সাথে কীভাবে কথা বলছো তুমি? আমার বোন সাজার একদম চেষ্টা করো না। তুমি কখনও আমার বোন ছিলে না, আর বোন হয়ে উঠতেও পারবে না!”

কথাটা ইরতিজার চোখে অশ্রু এনে দিলো। সে নওরিনকে বলে উঠলো,
“তুমি খুব খারাপ! যখন ভালো থাকো তখন খুব ভালোই মনে হয় তোমায়। আর যখন খারাপ থাকো তখন এতটা বাজে হয়ে যাও যে ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না আমি। এমন ধরনের মানুষ ভংয়কর হয়! তুমিও ভংয়কর ব্যতীত কিছু নও।”
কথাগুলো বলে ক্ষণিকের বিরতি নিলো ইরতিজা। তারপর বললো,
“হ্যাঁ, আমি তোমার বোন নই! বোন হয়ে ওঠার প্রয়োজনও নেই। আমি আমার বাবার মেয়ে। আর এই পরিচয়টুকুই আমার সুখী থাকার জন্য যথেষ্ট।”

ইরতিজা নিজের রুমে চলে এলো। দরজা বন্ধ করে দিতেই টপটপ করে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়ালো চোখ থেকে।

__________________

ক্যানিয়ল পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেনি এখনও, তবে হসপিটাল থেকে রিলিজ পেয়েছে। হসপিটাল থাকাকালীন সময়টাতে ইরতিজা আরও তিনবার দেখতে গিয়েছিল ক্যানিয়লকে। একবার একা গিয়েছে, একবার রিশনের সাথে গিয়েছে, আর একবার গিয়েছে জুহির সাথে। ক্যানিয়লের সাথে কিছুটা বন্ধুত্ব সম্পর্ক গড়ে উঠেছে এরই মধ্যে। আগে ক্যানিয়লকে যেমন অসহ্য ধরনের লাগতো, এখন আর তেমন লাগে না। তবে ক্যানিয়ল কিন্তু সেই আগের মতোই আছে।
যেদিন ক্যানিয়ল আহত হলো সেদিন সাজিদের থেকে একটা পার্সেল এসেছিল। সেদিন আর সেই পার্সেল খুলে দেখা হয়নি। পরের দিন খুলে দেখেছে। ভিতরে ছিল একটা সবুজ শাড়ি, শাড়ির সাথে মিলিয়ে চুড়ি, আর ছিল ছোটো একটা চিরকুট। চিরকুটে লেখা ছিল–
‘খারাপ মেয়ে,
এই শাড়ি পরে সুন্দর করে সেজে ছবি তুলে পাঠাবেন আমার কাছে। নয়তো শাড়ি পরা খারাপ মেয়েটাকে দেখতে আমি মেয়েটার বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হবো স্বয়ং।’

চিরকুটটা পড়ে হেসেছিল ইরতিজা। কী কথাবার্তা সাজিদের! ওইদিন আর ‘খারাপ মেয়ে’ কথাটাও খারাপ লাগেনি তার। শাড়ি সে সেদিন পরেনি। আর ছবিও পাঠানো হয়নি। আজ সকালে শাড়িটা পরলো। তবে শাড়ি পরায় সে কাঁচা। ইউটিউব দেখে দেখে খুব সময় নিয়ে শাড়িটা পরিধান করেছে। এখন যাবে এন্ডারসন হাউজে। গতরাতে হঠাৎ আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছিল। আলাপের শুরুর দিকে ইরতিজা যখন রং নাম্বার বলে কল কাটতে যাবে তখন ওপাশের মানুষটা বলে ওঠে,
“হেই নীচু মন মানসিকতার মেয়ে, কোনো ভুল নয়, আমি তোমাকেই কল করেছি। তুমি পাকিস্টানি গার্ল। আমি ভালো করেই চিনি তোমায়, ভালো করেই জানি তোমায়। আমি সহজে ভুল করার পাত্র নই।”

ওপাশের মানুষটা ক্যানিয়ল এটা বুঝতে পেরে অবাক হলো ইরতিজা।
“তুমি আমার ফোন নাম্বার পেয়েছো কোথায়? সামুরার কাছ থেকে নিয়েছো?”

“সেটা কি তোমার জানা জরুরি? লিসন, আগামীকাল সকালে ব্রেকফাস্ট রেডি করে এন্ডারসন হাউজে নিয়ে আসবে। আমি ওয়েট করে থাকবো ব্রেকফাস্টের জন্য।”

“আমি কেন নিয়ে যাব? আমাকে কি তোমার মাইনে দিয়ে রাখা সার্ভেন্ট মনে হয়?”

“মনে হয় কি না জানি না। তবে তোমাকে নিয়ে আসতে হবে, নয়তো…”

“নয়তো?”

বাঁকা হাসলো ক্যানিয়ল,
“নয়তো ব্রেকফাস্ট করতে আমি তোমার বাড়িতে চলে যাব।”

কথাটা শুনে গায়ের লোম সব দাঁড়িয়ে গিয়েছিল ইরতিজার। মজা নয়, ক্যানিয়ল যেমন মানুষ তাতে ওকে ঠিক বিশ্বাস করা যায় না। দেখা গেল চলে আসতেও পারে। তাই অবাধ্য হলো না ইরতিজা। সকাল সকাল উঠে সে রান্না করলো বিরিয়ানি। জানে বিরিয়ানি খেতে সমস্যা হবে ক্যানিয়লের। দুই-তিন চামচ খেতে পারবে কি না সেটাই সন্দেহ। কিন্তু সে ইচ্ছাকৃতভাবেই এটা রান্না করেছে।

ইরতিজা একটা ব্যাপার খেয়াল করেছে। সাজিদ, ক্যানিয়ল দুজনই বাড়ি আসার হুমকি দিয়েছে। দুজনের সাথে আজবভাবে মিলে গিয়েছে এই ব্যাপারটা। এটা যেন এক ধরনের ব্ল্যাকমেইল। ইরতিজা একদমই চায় না দুজনের একজনও তার বাড়ি আসুক। তাই শাড়ি পরা ছবি তুলে একটা ছবি পাঠিয়েছে সাজিদকে। কিন্তু সাজিদ ছবিগুলো এখনও দেখেনি, আর কিছু প্রশংসার লাইনও ইনবক্সে আসেনি। ইরতিজা অপেক্ষা করে ছিল সাজিদ কী লিখে পাঠাবে সেটা দেখার জন্য। কিন্তু…
লোকটা কি এখনও ঘুম থেকে ওঠেনি?
সাজিদের ঘুম সম্পর্কে জানে না, তবে জুহির ঘুম দেখে সে প্রচণ্ড বিরক্ত হয়েই বের হলো বাসা থেকে। চেয়েছিল জুহিকে সঙ্গে নিয়ে যাবে। কিন্তু মেয়েটা ঘুমেই কাতর। টানা দশ মিনিট ধরে ডাকাডাকি করেও তুলতে পারেনি ঘুম থেকে। একটু নড়েচড়ে উঠে আবার নিশ্চুপ হয়ে যায়। অগত্যা তার একারই বের হতে হলো। শাড়ি পরে হাতে খাবারের বক্স নিয়ে বের হতে দেখে বাবা-মা উভয়ই এবং নওরিনও প্রশ্ন করলো সে কোথায় যাচ্ছে। ইরতিজা সবাইকে একই উত্তর দিলো,
“ফ্রেন্ডরা মিলে ছোটো গেটটুগেদারের আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে যাচ্ছি।”

কথাটা শুনে সবাই-ই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“এটা আবার কেমন গেট টুগেদার যেখানে খাবার নিয়ে যাচ্ছ?”

“এটা এমনই গেট টুগেদার। যেখানে প্রত্যেকে নিজের ব্রেকফাস্ট নিজে নিয়ে আসবে।”

পরাপর তিন জনকেই এক কথা বলে বুঝিয়ে চলে এসেছে।
এন্ডারসন হাউজে এসে ক্যানিয়লের দেখা পাওয়া গেল না। মি. হেনরি আছে। ইরতিজা মি. হেনরিকে জিজ্ঞেস করলো,
“ক্যানিয়ল নেই? ও তো আমাকে আসতে বলেছিল।”

“আছে, ফরেস্টে।”

ইরতিজা ভ্রু কুঞ্চন করে অবাক চিত্তে বললো,
“ফরেস্ট?”

মি. হেনরি ইরতিজাকে ফরেস্টের পথ দেখিয়ে দিলো। এন্ডারসন হাউজের পিছন দিয়ে বেশ কিছুটা হেঁটে আসার পর একটা ফরেস্ট এরিয়া আছে। ক্যানিয়ল কেমন ধরনের মানুষ সেটাই ভাবছে ইরতিজা। ব্রেকফাস্ট নিয়ে আসতে বলে সে জঙ্গলের ভিতর ঢুকে বসে আছে।
ইরতিজা পা রাখলো ফরেস্ট এরিয়ায়। গাছপালা থাকায় এদিকটা ছায়াছন্ন ঢাকা। কুয়াশা নেই। কুয়াশা থাকলে কখনও ফরেস্ট এরিয়ায় পা রাখতো না সে।
পাখির কলকাকলিতে পরিবেশ মুখরিত। বুনোফুলগুলো খিলখিলিয়ে হাসছে যেন। ইরতিজা আশপাশ দেখতে দেখতে এগিয়ে চলছে। আরেকটু এগিয়ে যেতেই ক্যানিয়লকে চোখে পড়লো। মাদুর বিছিয়ে একটা ওক গাছের নিচে বসে আছে। ওর পাশেই একটা ঝুড়ি রাখা। ঝুড়িতে ফল। হাত বাড়িয়ে আঙুর উঠিয়ে মুখে পুরে নিতে দেখা গেল।
ইরতিজা দূরে থাকাকালীনই ক্যানিয়লকে বললো,
“মানুষকে ব্রেকফাস্ট নিয়ে আসতে বলে তুমি জঙ্গলে এসে বসে রয়েছো কেন? ধ্যান করছো না কি এখানে নিরিবিলিতে?”

“হুম, তবে তুমি এসে ধ্যানে ব্যাঘাত ঘটিয়েছো। শাস্তি স্বরূপ…” ক্যানিয়ল পিছন ঘুরে ইরতিজার দিকে ফল কাটার ছুরিটা তাক করে বললো,
“এটা দিয়ে কে/টে ফেলবো তোমাকে।”

ইরতিজা ভয় পেল না। আগে ক্যানিয়লকে ভয় লাগলেও এখন লাগে না। সে এগিয়ে এলো। ক্যানিয়লের হাত থেকে ছুরিটা নিয়ে বললো,
“তুমিও সাবধানে থাকবে, কারণ তোমাকেও যেকোনো সময় মে’রে বসতে পারি।”

ক্যানিয়ল ঠোঁটের বাম কোণ টেনে অদ্ভুতভাবে হাসলো। ইরতিজা বসলো মাদুরের উপর। খাবারের বক্সটাও রাখলো। মি. হেনরি তাকে বলেছে ক্যানিয়ল এখানে বসে খাওয়ার প্ল্যান করেছে। তাই আগে ভাগেই রেডি-সেডি হয়ে বসে ছিল ক্যানিয়ল। তবে ইরতিজা বিরক্ত। বাড়ি থাকতে এই জঙ্গলের ভিতর বসে খেতে হবে কেন?
ক্যানিয়ল হঠাৎ ইরতিজার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
“তুমি একটু-আধটু আমার সাথে থাকতে থাকতে বুদ্ধিমতি হয়ে যাচ্ছ ইজা।”
ক্যানিয়লের ঠোঁটে হাসি লেগে রয়েছে। হাসিটা এখন আর অদ্ভুত নেই, সরল।

ক্যানিয়ল এতক্ষণ ইরতিজাকে ভালো করে খেয়াল করেনি। শুধু মাথায় একটা সুন্দর হিজাব পরিধান করে আছে এটাই খেয়াল করেছিল। আজকে হিজাব পরিধানের স্টাইলটা সাধারণ হিজাব পরার থেকে ভিন্ন। ক্যানিয়ল ইরতিজার ড্রেসের দিকে লক্ষ করে চমকালো,
“এটা কী? তুমি এ কেমন অদ্ভুত পোশাক পরেছো ইজা?”

ইরতিজা মনে মনে আহত হলো। সে এত শখ করে পরলো আর ক্যানিয়ল এরকম করে বলছে কেন?

“ভালো লাগছে না দেখতে?”

ক্যানিয়ল নাক ছিটকানোভাবে বললো,
“অদ্ভুত লাগছে তোমায়। এখনই খুলে ফেলো এই পোশাক।”

ইরতিজার ভিতরটা ছ‍্যাঁত করে উঠলো। চোখ কপালে তার। এখনই খুলে ফেলো মানে? সে গমগম কণ্ঠে বললো,
“কী বলছো তুমি?”

“আমিও কি অদ্ভুত কিছু বলেছি?”
ক্যানিয়ল খেয়াল করলো ইরতিজার গায়ে শীত পোশাক নেই।

“তোমার শীত লাগছে না?”

ইরতিজা গায়ের কোট এন্ডারসন হাউজে রেখে এসেছে। শাড়ির সাথে কোট পরলে শাড়ির আসল সৌন্দর্যটা ক্ষুণ্ণ হবে বলে মনে হলো তার। তাই রেখে এসেছে। কিছুটা শীত শীত লাগছে, কিন্তু বললো,
“না, লাগছে না।”

“লাগলে বললেও লাভ হতো না। ভেবো না যে শীত লাগছে বললে আমি নিজের জ্যাকেট খুলে দিতাম তোমায়।”

ইরতিজা কিছু বলতে চাইলে তার আগেই ফোন বেজে উঠলো ক্যানিয়লের। ক্যানিয়ল হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দিলো ওকে। মি. হেনরির কল। রিসিভ করে বললো,
“কল দিচ্ছ কেন?”

“মিস বেলা লিমাস এসেছেন হাউজে। আর তিনি তোমার বেডরুমের দিকেই গেলেন।”

ক্যানিয়লের শান্ত চোখ দুটোয় বিস্ফোরণ ঘটলো।
“হোয়াট?”

(চলবে)

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ২৬
_________________

ওয়্যারড্রোবের ভিতর জামাকাপড়ের পিছনে লুকায়িত নিজের ছবিটা দেখে বেলা লিমাসের চোখে অজান্তেই বিন্দু বিন্দু পানিকণা জমে অক্ষি কোটর পূর্ণ করলো। হৃদয়ভার হয়ে এলো তার। শান্ত ব্যথিত মুখটার পিছনে প্রশান্তির উন্মাদিনী ঝড় প্রলয় তুলছে। সে হাত বাড়িয়ে আলতো ছোঁয়া রাখলো ছবিটার গায়ে। চোখের কোল ছাপিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে চাইছে। সব সময় ‘ঘৃণা করি’ বলা ছেলেটা তার ছবি সযতনে লুকিয়ে রেখেছে এখানটায়! তার মানে মনের অন্তঃস্থলেও লুকায়িত ভালোবাসার পরিধি আছে।

রুমের দরজাটা হঠাৎ কঠিন শব্দ করে খুলে গেল ব্যস্ত ভঙ্গিতে। ক্যানিয়ল এসে দাঁড়িয়েছে। ওর পিছনেই এসে থেমে গেছে ইরতিজা এবং মি. হেনরি।
ক্যানিয়ল বেলা লিমাসের উদ্দেশ্যে গর্জন করে উঠলো,
“কোন সাহস এবং অধিকারে তুমি আমার বেডরুমে প্রবেশ করেছো? কোন সাহসে এসেছো তুমি এখানে?”

বেলা লিমাস পাশ ফিরে দরজায় তাকালেন। তার দু চোখে জল থলথল করছে।
মায়ের দু চোখের এই জল থলথল ভাব ক্যানিয়লের কঠিন মনোবলকে দুর্বল করে দিতে চাচ্ছে। কিন্তু সে নিজেকে যথাসাধ্য অনড় রাখলো। যেরকম সব সময় রাখে।
বেলা লিমাস ওয়্যারড্রোবের সামনে দাঁড়িয়ে আছে প্রথমে এটা খেয়াল হয়নি ক্যানিয়লের। কিন্তু যখন খেয়াল হলো এবং দেখলো ওয়্যারড্রোবের দরজা খোলা তখন আকাশ ভাঙার শব্দ বেজে উঠলো দু কানে। অনড় রাখা কঠিন মনোবলে ভাঁজ পড়ে কুঁচকে গেল। টের পেল তার হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। পাথরের মতো জমে যাচ্ছে সে। সেই সাথে তার মনে বিদ্যমান কঠোরতারও পতন ঘটছে। দুর্বলতার আভাস গ্রাস করে ফেলছে তাকে। নিঃশ্বাসের পথে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে।

বেলা লিমাস অশ্রু ভরাট চোখে সরল হাসি অঙ্কন করলেন মুখে। অঙ্কিত ওই হাসিটুকু মর্মান্তিক এবং ভারি সুন্দর দেখালো। সে শিথিল পা ফেলে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন ক্যানিয়লকে। দুই হাতের শক্ত বাঁধনে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন এই বহু বছর পর। তার দু চোখের কোল ছাপিয়ে ঝরতে লাগলো বর্ষণ। কান্না রুদ্ধ কণ্ঠে বললেন,
“মমকে কেন ভালোবাসো ক্যানিয়ল? কেন ভালোবাসো?”

ক্যানিয়ল স্তব্ধ হয়ে গেল। মাতৃ পরশের সংস্পর্শে এসে গুঁড়িয়ে গেল তার ভিতরের যাবতীয় কাঠিন্য বিষয়। বুকে সৃষ্টি হলো একরাশ হাহাকার! জ্বালাপোড়া অনুভব হলো হৃদয়ে। আজ সে ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়লো। যে ছবিটা সে লুকিয়ে রেখেছিল এতদিন ধরে, যে ছবিটা সে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতো, সেই ছবিটা প্রকাশ্যে আসায় সে ভীষণ দুর্বল অনুভব করলো। এই ছবি প্রকাশ্যে আসুক এটা সে কখনও চায়নি। অন্তত বেলা লিমাস কখনও এই লুকায়িত ছবিটা দেখে ফেলুক একদমই চায়নি।
ক্যানিয়লের মনে হলো দুটো বৃহৎ আঙুল তার হৃৎপিণ্ড চেপে ধরেছে অতি সজোরে। এই ব্যথা সহ্য করতে না পেরে তার চোখের উপর স্বচ্ছ জল ভেসে উঠলো। অনুভব হলো গলায় বিঁধে আছে সূচালো কাঁটা। সেই কাঁটাকে উপেক্ষা করে ক্যানিয়ল বললো,
“ছাড়ো। আমাকে জড়িয়ে ধরার অধিকার তুমি হারিয়ে ফেলেছো বহু বছর আগে! ছাড়ো…”

বেলা লিমাস ছাড়লেন না, বরং আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরলেন। অতঃপর ছেলের কপালে চুমু খেয়ে বললেন,
“ঘৃণা করো ওটাই তো ঠিক ছিল। ভালোবাসো জেনে তো আরও কষ্ট হচ্ছে মমের। দগ্ধ হৃদয় আরও বেশি করে পুড়বে এরপর থেকে!”

ক্যানিয়লের দু চোখ বেয়ে পাল্লা দিয়ে জলের দুটি ধারা গড়িয়ে পড়লো। উচ্ছল হয়ে উঠতে চাওয়া কান্নাকে পোষ মানিয়ে বললো,
“আমি চাই তো তোমার হৃদয় আরও বেশি করে পুড়ুক! কিন্তু ওটা শুধু ঘৃণাতে পুড়বে। বোকার মতো ভেবো না যে ঘৃণার পাশাপাশি তোমাকে ভালোওবাসি! এটা ভাবা বোকামি বা ভুল ছাড়া কিছু হবে না।”

বেলা লিমাস হাসলেন। হাসিটায় ক্যানিয়লের কথা অবজ্ঞা করার ছাপ। বললেন,
“তুমি অভিনয় ভালো জানো ক্যানিয়ল। কিন্তু এই মুহূর্তে তুমি একজন ভালো অভিনেতার পরিচয় বহন করছো না। এটা তোমার দোষ নয়। তুমি কেবল তোমার মাঝে ঘৃণাটা প্রতিস্থাপন করতে চাইলেও, অন্যায়ভাবে তোমার মন এটা মানছে না।”

ক্যানিয়ল অন্যদিকে শূন্য দৃষ্টি স্থাপন করে রেখেছে। জল টলমল চোখ জোড়া ইতোমধ্যে লাল হয়ে উঠেছে তার। ক্যানিয়ল নিজেকে দেখে নিজে বিস্মিত। কাঁদছে সে? এতটা ছিঁচকাঁদুনে কবে হলো সে?
বেলা লিমাস হঠাৎ ক্যানিয়লের হাত দুটো আলতো করে ধরে বললেন,
“মমকে একবার মুখে ভালোবাসি প্রকাশ করা যায় না ক্যানিয়ল? এটা কি এতটাই কঠিন?”

ক্যানিয়ল চোখ বন্ধ করলো। উষ্ণ দুটো ধারা গাল বেয়ে গলা পর্যন্ত বর্ধিত হলো। চোখ খুলে বেলা লিমাসের দিকে তাকিয়ে বললো,
“নির্লজ্জের মতো আর কখনও আমার সাথে দেখা করার জন্য আসবে না! বছরের পর বছর কেটে গিয়েছে। দেখা যেত বছরের ভিতর কেবল দুই কি তিন বার আমাকে দেখার জন্য উঁকি দিয়েছো তুমি। অথচ এই বছরটায় এমন কি হলো যার জন্য এত ঘন ঘন দেখা করতে আসছো? পুরোনো দিনগুলো আমি ভুলে গিয়েছি ভেবেছো? তুমি চলে যাওয়ার পর কতটা দুর্বিষহ অবস্থায় ছিলাম আমি ভুলে যাইনি। অবজ্ঞার ভিতর দিয়ে বড়ো হয়েছি। যেখানে আমাকে নিজের মমই ফেলে রেখে গেছে সেখানে অন্যরা কতটাই বা দেখভাল করবে? কত কেঁদেছি সেই হিসাব কেবল নিজের কাছেই জমা আছে। আমার কান্নার হিসাবটাও কারো জানা নেই। নতুন করে আর কাঁদতে চাই না আমি। সুতরাং আর এসো না। কান্নাকে ভুলে গিয়েছি আমি।”

“তাহলে এখন কেন কাঁদছো?”

“আজবভাবে তুমি কাঁদিয়ে ছেড়েছো। কিন্তু…আমি আর কখনো চোখের জল ফেলতে চাই না। প্লিজ! প্লিজ আর কখনও আমার সামনে এসো না। তোমার উপস্থিতি আমি সহ্য করতে পারি না! আ-আমার কষ্…”
থেমে গেল ক্যানিয়লের ক্রন্দন জড়িত কণ্ঠ। দু চোখ দিয়ে জল নামার প্রতিযোগিতা হচ্ছে বোধহয়। সে তো আসলেই ছিঁচকাঁদুনে হয়ে গিয়েছে! লজ্জা! তার জন্য বড়ো লজ্জা এটা।

বেলা লিমাস বললেন,
“থামলে কেন? কী হয়? কষ্ট হয় তোমার?”

ক্যানিয়ল আর সহ্য করতে না পেরে ডেকে উঠলো,
“মি. হেনরি, তাকে নিয়ে যাও আমার সামনে থেকে।”

“নিজেই চলে যাচ্ছি। তোমার উত্তেজিত হওয়ার প্রয়োজন নেই ডিয়ার।”

বেলা লিমাস এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে। ক্যানিয়ল হঠাৎ পিছন থেকে প্রশ্ন করে উঠলো,
“আমাকে একা রেখে তুমি কেন চলে গিয়েছিলে?”

বেলা লিমাসের চলতি পা থেমে গেল। পিছন ফিরে চাইলেন। ক্যানিয়লের প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। শুধু বললেন,
“হয়তো তোমাকে একা রেখে গিয়ে ঠিক করিনি, হয়তো বা করেছি!”

কথাটা বলে বেলা লিমাস পা বাড়ালেন। দরজার কাছে হঠাৎ আবার থামলেন তিনি। ইরতিজার দিকে তাকালেন। ইরতিজা হকচকিয়ে গেল। বেলা লিমাস আর দাঁড়ালেন না চলে গেলেন। চোখের অদৃশ্য হওয়ার আগ পর্যন্ত ইরতিজা তাকিয়ে রইল তার যাওয়ার পথে। চলে গেলে দৃষ্টি এনে ফেললো রুমের ভিতর ক্যানিয়লের উপর। ক্যানিয়ল কাঁদছে। বিস্ময়কর আর অবিশ্বাস্য একটা দৃশ্য মনে হলো ইরতিজার ক্যানিয়লের কান্নাকে। তার কেন যেন কোনো দিন মনে হয়নি এই ছেলেটা কাঁদতে পারে বা এই ছেলেটার চোখ দিয়ে কখনও কান্না ঝরেছে। কিন্তু পাজি ছেলেটার কান্নার হিসাব না কি কেউ জানে না!

_______________

ইরতিজা চুপচাপ চলে এসেছে এন্ডারসন হাউজ থেকে। এমন একটা পরিস্থিতির মাঝে পড়েছিল যে পরিস্থিতিটার চিন্তা তার মাথা থেকে দূর হচ্ছে না। ভাবতে ভাবতে মাথা ব্যথা হয়ে গিয়েছে। কেন ক্যানিয়লকে রেখে চলে গিয়েছিল ওর মা?
বাসায় এসে ড্রেস চেঞ্জ করলো আগে। তারপর রুমের ভিতর বসে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবলো কিছুক্ষণ। এক সময় ভাবতে ভাবতেই বের হলো বাসা থেকে। বাসায় কেউই নেই এখন।
ইরতিজা এরিয়ার ভিতর হাঁটাহাঁটি করলো কিছুক্ষণ। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলো সুইমিং পুলে। এখানে এসে রিশন আর জুহির দেখা পেল। রিশন সুইমিং পুলের ওই মাথায় একা একা কী যেন বকর বকর করছে। একটু দেখার পর বুঝতে পারলো, না একা একা বকর বকর নয়। রিশন লাইভে আছে। ইরতিজা জুহির পাশের বেঞ্চটায় বসলো। প্রকৃতিতে রোদের ছড়াছড়ি। তবে সে রোদ পানসে। কোনো তাপ নেই। সুইমিং পুলের পাশেই রয়েছে জিম। ইরতিজা একবার গিয়েছিল জিমে। কাল আবার একবার যাবে ডিসাইড করলো। এরপর থেকে রোজই জিমে যাতায়াত করা উচিত বলে মনে করছে।
জুহি মোবাইলে কী এক ভিডিয়ো দেখায় মগ্ন। ইরতিজা পাশে এসে বসেছে সেটা বোধহয় খেয়ালও করেনি। ইরতিজাও জুহিকে কিছু না বলে আবার ক্যানিয়ল আর ওর মমকে নিয়ে ভাবনায় মগ্ন হয়ে গেল।
ভাবনা এ দেয়ালের সাথে ও দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে অন্য বিষয়ে গিয়ে স্থির হলো। মনের মধ্যখানে জন্ম নিলো গুরুত্বপূর্ণ এক প্রশ্ন। সে জুহিকে ডাকলো,
“হেই জুহি…”

জুহি তাকালো।

ইরতিজা সরাসরি প্রশ্ন করলো,
“আচ্ছা, ক্যানিয়লের কি আসলেই উডবি ওয়াইফ আছে? ও বলে ওর না কি উডবি ওয়াইফ আছে, এটা কি সত্যি?”

জুহি মাথা নেড়ে বললো,
“হ্যাঁ এটা সত্যি।”

ইরতিজার মুখে গাম্ভীর্য দেখা গেল।
“তুমি চেনো ওর উডবি ওয়াইফকে? দেখেছো কখনো?”

“অবশ্যই। ইউনিভার্সিটির সবাই চেনে তাকে। সে একজন ফেমাস বেলে ড্যান্সার।”

“ফেমাস?”

“হুম, শেখ মিরান্ডা ওয়ালিদ!”

ইরতিজা বিস্মিত হলো। হ্যাঁ, সেও তিন-চারবার মোবাইলে শেখ মিরান্ডা ওয়ালিদের শো পারফরম্যান্স দেখেছিল। মেয়েটা দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি তার ড্যান্সও মুগ্ধ করে। ইরতিজা বিশ্বাস করতে পারছে না শেখ মিরান্ডা ওয়ালিদ ক্যানিয়লের উডবি। জুহি মিথ্যা বলছে না তো?

“মিরান্ডা ক্যানিয়লের থেকে দুই বছরের বড়ো। ছোটো বেলা থেকেই দুজন পরিচিত। ক্যানিয়লের ড্যাড এবং মিরান্ডার ড্যাড দুজন একে অপরের ভালো বন্ধু। ক্যানিয়ল আর মিরান্ডাকে নিয়ে কোনো প্রেম সম্পর্কিত নিউজ কখনও প্রকাশ হয়নি, তাই ধরে নেওয়া যায় ওদের এনগেজমেন্টটা পারিবারিকভাবে হয়েছে।” জুহি বললো।

ইরতিজা চুপ করে বসে রইল। এ বিষয়ে কথা বাড়াতে ইচ্ছা করছে না আর। মেঘ জমার মতোই আঁধার হলো তার মুখ। কিছুক্ষণ উদাসী বসে থেকে অন্যমনস্কভাবে বললো,
“আচ্ছা, এনগেজমেন্ট হয়ে গেলে কি বিয়ে হওয়াটাও আবশ্যক?”

“না, এমনও নয়। এনগেজমেন্ট হওয়ার পরও অনেক সম্পর্ক বিয়ে পর্যন্ত গড়ায় না। এটা…”
থামলো জুহি। হঠাৎই তার কিছু ঠাহর হলো, যেটা এতক্ষণ হয়নি। ইরতিজার দিকে সন্দিহান চোখে চেয়ে বললো,
“হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন করছো টিজা? তুমি কি আসলেই …”

জুহির কথার মাঝেই ইরতিজা দাঁড়িয়ে গিয়ে বললো,
“সাজিদের সাথে আমার এনগেজমেন্ট হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমাদের এনগেজমেন্টও কখনও বিয়ে পর্যন্ত গড়াবে না। লোকটাকে আমি মেনেই নিতে পারি না, আর পারবোও না কখনও! তার সাথে এ ব্যাপারে খোলামেলা কথা বলবো আমি।”

বলে ইরতিজা দ্রুত পায়ে বাসায় চলে এলো।

________________

রাতে সাজিদের কাছে কল দিলো ইরতিজা। সাজিদ তার শাড়ি পরা ছবিটা সিন করলেও কিছুই লিখে পাঠায়নি। আর কোনো কলও দেয়নি। ইরতিজার কল রিসিভ হলো একটু সময় নিয়ে। ওপাশ থেকে সালাম দিলো সাজিদ,
“আসসালামু আলাইকুম!”

“ওয়াআলাইকুমুস সালাম! আপনাকে একটা কথা বলার জন্য কল দিয়েছি। জরুরি কথা।”

“হ্যাঁ বলুন, শুনতে অসুবিধা নেই আমার।”

“অসুবিধা থাকলেও শুনতে হতো। আমি কিন্তু সত্যি সত্যিই বিয়ে করবো না আপনাকে। আ…”

“তাহলে কি আপনি মিথ্যা মিথ্যা বিয়ে করবেন আমাকে?” সাজিদ নীরব হাসলো, শব্দহীন।

ইরতিজা তবুও বেশ বুঝতে পারলো সাজিদ হেসেছে। সে বললো,
“এটা মজা নয়। আমি কিন্তু প্রথম থেকেই সিরিয়াস। আর…”
কথাটা বলতে ইতস্তত বোধ কাজ করছে ইরতিজার ভিতর।
“আমি কিন্তু আপনার জন্য মেয়ে-টেয়ে খুঁজিনি। না, একেবারে যে খুঁজিনি সেটা না। তবে আপনার কাছে যে মেয়েগুলোর ছবি পাঠিয়েছিলাম ওগুলো সব ইন্সট্রাগ্রাম থেকে সংগ্রহ করা মেয়েদের ছবি। তবে আমি একবার একটু খোঁজ লাগিয়েছিলাম। পেয়েও গিয়েছিলাম একজনকে। মেয়েটা লাইব্রেরির একজন স্টাফ। মুসলিম। দেখতে-শুনতে খুবই ভালো। কিন্তু সমস্যাটা হলো…”

“সমস্যা?”

“সমস্যাটা হলো মেয়েটা বিবাহিত এবং এক বছরের একটা বাচ্চাও না কি আছে!”

সাজিদ হেসে বললো,
“দেখুন ইরতিজা, আমার পক্ষে একজন লোকের ওয়াইফ এবং একটা বাচ্চার মাকে বিয়ে করা সম্ভব না।”

“হ্যাঁ সেজন্যই তো ওটা নিয়ে আর সামনে এগোইনি আমি।”

সাজিদ কিছু বললো না। ক্ষণকাল নীরব থেকে ইরতিজা বললো,
“আমার পক্ষে আপনাকে বিয়ে করা সম্ভব নয়। আমি আমাদের এনগেজমেন্টটা মেনেই নিতে পারিনি কখনও। আর বোধহয় পারবোও না কোনোদিন!”

“কেন মেনে নিতে পারছো না? কোনো কারণ?”

“জানি না কোনো কারণ আছে কি না। আমি এই মুহূর্তে খুঁজে পাচ্ছি না কোনো কারণ। ধরে নিন কারণহীনই মেনে নিতে পারছি না। আপনি আমার হাসব্যান্ড হবেন এটা আমি কল্পনাও করতে পারি না সাজিদ!”

“কিন্তু আমি তো খুব করে কল্পনা করতে পারি হবু স্ত্রী। এই মুহূর্তেও আমি তোমাকে আমার স্ত্রী রূপে কল্পনা করতে পারি। আমি কি একবার কল্পনা করবো?”

“এই খবরদার! আমাকে নিয়ে কোনো আজেবাজে কল্পনা করবেন না। আমাদের বিয়ে হবে না। সুতরাং এমন কল্পনা করাও অন্যায়। আপনি শুধু একবার আমার আব্বুকে কল করে বলবেন। সে আমার কথা শুনবে না সহজে। আপনি যদি বিয়েতে অসম্মতি জানান তাহলে এ বিয়ে সেকেন্ডের ভিতর ভেঙে যাবে। আপনি আমাকে বিয়ে করে সুখী হবেন না।”

“আমার সুখী হতে হবে না। আমি তোমাকে সুখী রাখবো।”

“উহুঁ, আপনি বুঝতে পারছেন না!”

“আমি তোমাকে গ্যারান্টি দিতে পারি ইরতিজা। তুমি আমাকে বিয়ে করে সুখী হবে। ওই ছেলেটার থেকে আমার কাছেই বেশি সুখী থাকবে তুমি।”

সাজিদের কথায় চমকে উঠলো ইরতিজা,
“কোন ছেলের কথা বলছেন আপনি?”

“জানো না? যদি না জানো তাহলে তুমি বোকা। এছাড়া তুমি এমনিতেও বোকা। কল কাটছি বোকা মেয়ে।”

সাজিদ কল কেটে দিয়ে বিড়বিড় করলো,
“আমি অবশ্যই গ্যারান্টি দিতে পারি, আপনি জোনাসের থেকে আমার কাছেই বেশি সুখী থাকবেন। এই গ্যারান্টি এক-দুই বছরের জন্য নয়, সারা জীবনের জন্য দিতে পারি আমি।”

(চলবে)
____________

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ২৭
_________________

ভোর রাত থেকে স্নো ফল শুরু হয়েছে। ঢেকে গেছে রাস্তাঘাট, গাছপালার ডাল, বাড়ি-গাড়ির উপরিভাগ। হাড় কাঁপানো শীত! তুষারপাত ঝরছে বাধাহীন। ইরতিজা গায়ে মোটা কাপড় জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। তুষারপাত এসে বারান্দার রেলিংয়েও দখল বসিয়েছে। যতদূর চোখ যায় সব সাদা। বাড়িগুলোর ছাউনির উপর পড়া তুষারপাত দেখতে দারুণ লাগছে। ইরতিজা হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলো রেলিংয়ের উপরে থাকা তুষারপাত। ইরতিজার মনে হচ্ছে এগুলো আইসক্রিম। দেখলে একটুখানি খেয়ে দেখতে ইচ্ছা হয় তার। খাওয়া যায়ও অবশ্য। কারণ এগুলো একদম পরিষ্কার।
ইরতিজা বাইরে বের হওয়ার চিন্তা ভাবনা করছে। তুষারপাত বাইরে বের না হয়ে দেখলে তৃপ্তি মেটে না তার। রিশনকে দেখা যাচ্ছে। ও এখন রাস্তায়। কোন জায়গাটা রাস্তা ছিল, আর কোন জায়গা ঘাসে মোড়ানো সবুজ ছিল তা এখন তফাৎ করা দুষ্কর। বরফের পুরু আস্তরণ ঢেকে ফেলেছে সব। রিশন বরফের উপর শিথিল পা ফেলে হাঁটছে। পা ফেলার সাথে সাথে সেই স্থানে পা ঢুকে গিয়ে অগভীর গর্তের সৃষ্টি করছে। রিশন কিন্তু কাজহীন শখের বসে বাইরে বের হয়ে হাঁটছে না এই তুষারপাতের মাঝে। ও কাজে ব্যস্ত। বিরামহীন বক বক করে যাচ্ছে ভিডিয়ো রেকর্ডিংয়ের সাথে সাথে।
রিশন যেহেতু এখন বাইরে আছে সেহেতু এখন বাইরে বের হওয়াই ভালো হয় মনে হলো। ভাবতে যতটুকু দেরি, বাসা থেকে বের হতে দেরি হলো না ইরতিজার।

“এখন কোথায় বের হচ্ছ?” দরজা অতিক্রমের ক্ষণে প্রশ্ন করে বসলেন শারমিন আহমেদ।

“তুষারপাত দেখতে বের হচ্ছি। বাসার আশেপাশেই থাকবো।”

“এই ঠান্ডার ভিতর বাইরে বের হওয়া কি জরুরি?”

“সমস্যা নেই, রিশনও তো বাইরে এখন। নিশ্চয়ই ঠান্ডার জন্য ওর সমস্যা হচ্ছে না। তাহলে আমার কেন হবে?”

বাইরে বের হয়ে তুষারপাতের সান্নিধ্যে এসে অন্যরকম ভালো লাগার সৃষ্টি হলো। শব্দহীন ঝরে পড়া তুষারপাতের মাঝেও আসলে একটা নিঝুম নিভৃত শব্দ বিরাজ করছে। বরফের ক্ষুদ্র খণ্ড গায়ে পড়ে পিছলে যাচ্ছে। বাইরের এই শুভ্র সাদার মায়া মনে প্রবল মুগ্ধতার প্রতিস্থাপন রেখে যাচ্ছে। রিশন হাঁটতে হাঁটতে এতক্ষণে খানিক দূরে চলে গেছে। ইরতিজার মনে হয়েছিল এই তুষারপাতের মাঝে বোধহয় কেবল সে আর রিশনই বাইরে বের হয়েছে। কিন্তু না, আরও কয়েকজনকে দেখা যাচ্ছে। তারা বিভিন্ন রকম ফটোশ্যুট করছে। মাতামাতি করছে তুষারপাতের সঙ্গে।
ইরতিজা রিশনকে আর বিরক্ত করলো না। একা একা হাঁটতে হাঁটতে চলে এলো সুইমিং পুলে। পুলের পানি এখন বরফ। ইরতিজা ওখান থেকে প্রস্থান করলো। হেঁটে হেঁটে এরিয়ার বাসাগুলো দেখছিল। কেউ কেউ বাসার অভ্যন্তরে দাঁড়িয়ে উপভোগ করছে তুষারপাত। এই তুষারপাতে ক্যানিয়লের বাড়িটার কী অবস্থা জানতে ইচ্ছা করলো হঠাৎ। সে ক্যানিয়লের বাড়ির এদিকটায় চলে এলো।
ওই তো ক্যানিয়লের দুই তলা গাঢ় ব্রাউন রঙের বাড়িটা দেখা যাচ্ছে। বরফের প্রলেপ ছুঁয়ে রেখেছে বাড়িটার শরীর। দরজায় তালা ঝুলতে না দেখে অবাক হলো। বাড়ির ভিতরে কেউ আছে? ক্যানিয়ল কি এখন এই বাড়িতে?
ইরতিজার হৃদয় ঢিপ ঢিপ করে শব্দ তুললো। ক্যানিয়লের কথা ভাবলে ইদানিং তার অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়। কেমন অসহ্যকর ঠেকে এই অনুভূতি। ক্যানিয়লের সাথে তার দেখা হচ্ছে না দুই দিন হলো। ক্যানিয়ল ভার্সিটি যায়নি। তার মন আর চোখ দুটো ভার্সিটি থাকার পুরোটা সময় ধরে নীরবে খুঁজে যাচ্ছিল ক্যানিয়লকে। ক্যানিয়ল আর ওর মায়ের ব্যাপারে জানার প্রবল ইচ্ছা ছিল তার। জেনেছে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টাই অজানা। ক্যানিয়লের মা কেন ক্যানিয়লকে রেখে চলে গিয়েছিল? ক্যানিয়ল নিজেই যেখানে এই প্রশ্নটার উত্তর জানে না সেখানে তার উত্তরটা খুঁজে পাওয়া এত সহজ হবে না।
ইরতিজা বাড়িটার উপর আরেকবার চোখ বুলালো। প্রথমে চেয়েছিল ক্যানিয়ল ভিতরে আছে কি না দেখবে, কিন্তু পরে মত পরিবর্তন করলো। এই মুহূর্তে সে ক্যানিয়লের মুখোমুখি হতে চায় না। অস্বস্তি আর অস্থির বোধ হবে তার। ইরতিজা ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। একই জায়গায় কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থাকার জন্য পা কেমন আটকে গিয়েছিল বরফে। বরফের মাঝ দিয়ে সাবধানে পা ফেলে চলে গেল।
ঘরের ভিতরে বসে ক্যানিয়ল লক্ষ করলো মেয়েটা চলে যাচ্ছে। মেয়েটা তাকে লক্ষ করেনি, কিন্তু কাচের জানালা দিয়ে বাইরে চোখ পড়তেই সে দেখেছিল মেয়েটাকে। এবং মেয়েটার দিক থেকে চোখ সরায়নি সে। এমনকি এখনও মেয়েটার দাঁড়িয়ে থাকা শূন্য স্থানটার দিকে অন্যমনাভাবে তাকিয়ে রইল।

ইরতিজা এসে দাঁড়িয়েছে একটা ওক গাছের নিচে। ওক গাছের পাতার উপর বরফের সাদা আস্তরণ। পাতার উপর থাকা বরফে সে এত গভীরভাবে কী দেখছিল নিজেও জানে না। অন্যমনস্ক হয়ে সকল ধ্যান সে ওই বরফের উপরই নিবদ্ধ রেখেছিল। ওক গাছের ডাল নিচু হয়ে ঝুলে পড়েছে। চাইলেই হাত বাড়িয়ে একটা তুষারে আবৃতকরণ ডাল ছুঁয়ে দেখা যায়। ইরতিজা হাত বাড়িয়েছিল ডাল ছুঁয়ে দেখার জন্য। কিন্তু ছুঁয়ে দেখার আগেই তার হাত অতিক্রম করে পিছন থেকে আসা দুটি হাত আঁকড়ে ধরলো ডালটা। ডালটা ধরে ঝাঁকুনি দিতেই ডালের উপর থাকা বরফ ঝরে পড়তে লাগলো। ইরতিজা চোখ খিঁচে ধরে মাথা নিচু করে ফেললো। বরফ সব পড়লো তার মাথার উপর। কে এমন একটা বেয়াদবি কাজ করলো সেটা দেখার জন্য নিদারুণ রাগ নিয়ে ইরতিজা পিছন ফিরলো। কিন্তু ক্যানিয়লের মুখখানি দেখে গুড়মুড় শব্দ করে ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল তার সকল রাগ।
ক্যানিয়ল ইরতিজার মাথার উপর দখল বসানো বরফ দেখে হাসছে। ইরতিজার মাথার উপরিভাগ ডাল থেকে ঝরে পড়া বরফে সাদা দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ লবণ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিয়েছে তার মাথায়।

ক্যানিয়ল বললো,
“মাথা ঝেড়ে নাও। নয়তো তোমার মস্তিষ্ক ফ্রিজ হয়ে যাবে।”

কথাটায় অপ্রস্তুত হয়ে ইরতিজা দুই হাতের সাহায্যে চুলের উপর থাকা বরফ ঝেড়ে নিলো। এখনও কিছুটা সাদা সাদা দেখাচ্ছে চুল। পুরোপুরি ঝেড়ে পরিষ্কার করা যায়নি।
ক্যানিয়ল এক পা এগিয়ে এসে বললো,
“আমার বাড়িতে উঁকিঝুঁকি মারছিলে কেন?”

“কখন?”

“এই একটু আগে। কেন উঁকি মারছিলে? রহস্য কী?”

ইরতিজা বুঝতে পারছে না সে কখন উঁকিঝুঁকি মারলো ক্যানিয়লের বাড়িতে? একটু সময় তাকিয়ে ছিল কেবল। সেটা কি উঁকিঝুঁকির ভিতর পড়ে? বললো,
“আমি তোমার বাড়ির ওদিকে যাইনি।”

“যাওনি? তাহলে কি আমি ভূত দেখেছি?”

“দেখতেও তো পারো।”

“তাহলে তুমি এখনও বেঁচে আছো কেন?”

ইরতিজা কথাটার মানে বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো।
ক্যানিয়ল বললো,
“শুনেছি মরে গেলে অনেকের আত্মা ভূত হয়ে যায়। তুমি তো ভূত। জীবিত চলে ফেরা করা উচিত নয় তোমার। তুমি এখনই মরে যাও।”

ইরতিজা হতবিহ্বল! ক্যানিয়ল কেমন ধরনের কথা বলছে? এখনই মরে যাও মানে? ইরতিজা কিছু বলবে তার আগেই ক্যানিয়ল প্রসঙ্গ পাল্টে বললো,
“সেদিন তুমি আমাকে কিছু না বলে চুপি চুপি এন্ডারসন হাউজ থেকে চলে কেন এসেছিলে?”

এই কথাটা এখন উঠানোর কি কোনো প্রয়োজন ছিল? না, কোনো প্রয়োজন ইরতিজার চোখে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। প্রশ্নটা ইরতিজাকে বেশ বিভ্রান্তিতে ফেলে দিলো। তবুও সে উত্তর দিলো,
“তুমি কান্না করছিলে, পরিস্থিতিটা অস্বাভাবিক থাকায় চলে এসেছিলাম।”

“এই তোমার মানবিকতা ইজা? একটা মানুষ কান্না করছে আর তা দেখে তুমি চুপচাপ চলে এলে? কেউ কান্না করলে চুপি চুপি চলে আসতে হয় না গার্ল…”
ক্যানিয়ল ইরতিজার মাথায় আলতো করে একহাত রেখে বললো,
“এইভাবে হাত রেখে তাকে সান্ত্বনা দিতে হয়। জানো না এটা?”

মনঃস্থলে অদ্ভুত সব কার্যকলাপের সূচনা হয়েছে। যা নিয়ে এসেছে ইরতিজার মাঝে তটস্থ বোধ। সে দ্রুত ক্যানিয়লের হাতটা সরিয়ে দিলো। তার চোখে-মুখে স্পষ্টতর তটস্থবোধ প্রস্ফুটিত। ক্যানিয়ল হঠাৎ ইরতিজার মাঝে এমন ভাবগতি দেখে বিস্মিত হলো। ইরতিজা নিজেও বিস্ময়ান্বিত! আজকে কী হলো তার?
ক্যানিয়ল বিষয়টাতে গুরুত্ব না দিয়ে বললো,
“এমনভাবে কেউ কোনোদিন আমার মাথায় সান্ত্বনার হাত রাখেনি। ভেবেছিলাম তুমি হয়তো রাখবে, যেহেতু তুমি আমার প্রেমে পড়েছো। কিন্তু তুমিও তা করলে না।”
ক্যানিয়ল হতাশার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। তারপর যাওয়ার জন্য উল্টো দিকে পা বাড়িয়ে দিয়ে যেতে যেতে বললো,
“এই দুনিয়ার সবাই নিষ্ঠুর! তুমিও নিষ্ঠুর ইজা!”

বলে বরফের উপর সাবধানী পা ফেলে এগোতে লাগলো।
ইরতিজার কানে কেবল কথা দুটো বাজতে থাকলো,
‘এই দুনিয়ার সবাই নিষ্ঠুর! তুমিও নিষ্ঠুর ইজা!’

ইরতিজা পিছন থেকে বলে উঠলো,
“তাহলে কি তোমার মাথায় সান্ত্বনার হাত বুলানো উচিত আমার?”

থামলো ক্যানিয়ল। ইরতিজা এগিয়ে এলো। ক্যানিয়লের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
“একটা মানুষ কাঁদলে তখন তার মাথায় কীভাবে সান্ত্বনার হাত রাখা উচিত?”

ক্যানিয়ল ভ্রু কুঁচকে অবাক হয়ে দেখলো ইরতিজাকে। অতঃপর আবার বিরক্ত ভঙ্গিতে বললো,
“ছাড়ো এসব।”

“কীভাবে রাখতে হয়? এভাবে?”
কথাটা বলে ইরতিজা একটা হাত রাখলো ক্যানিয়লের মাথায়।
ক্যানিয়লের হৃদস্পন্দন যেন থেমে গেল ওই মুহূর্তে। সে অবাক চিত্তে দেখতে লাগলো সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আজব মেয়েটিকে। সে উপলব্ধি করছিল নিঃশ্বাসও যেন স্বাভাবিক গতিতে চলছিল না তার।

ইরতিজা বললো,
“এরপর থেকে যখন কাঁদবে তখন আমাকে জানাবে যে তুমি কাঁদছো। তোমার কান্নার মাঝে আমি গিয়ে তোমার মাথায় হাত রাখবো।”

ক্যানিয়ল অনিমেষ তাকিয়ে রইল। ক্ষণকাল নীরব থেকে বললো,
“মানুষের সামনে কাঁদতে আমি অস্বস্তিবোধ করি। আর আমার কান্নার হিসাবটা আমি ব্যতীত সকলের থেকে গোপন থাকুক সেটাই চাই।”

ইরতিজা স্মিত হেসে বললো,
“আমার সামনে কাঁদতে স্বস্তিবোধ করবে। আর সকল কাজেরই একজন সাক্ষী প্রয়োজন। তোমার কান্না করাটাও একটা কাজ। এই কাজটার সাক্ষী না হয় আমাকেই বানিয়ে নাও। তুমি কান্নার হিসাবটা ভুলেও যেতে পারো, তোমার মনে নাও থাকতে পারে। আমি তখন মনে করিয়ে দেবো ঠিক কতটা কেঁদেছিলে তুমি।”

ক্যানিয়ল বিমূঢ় ইরতিজার কথায়। কয়েকটা সেকেন্ড চুপ কেটে গেল। তারপর বললো,
“আর তোমার কান্নার কী খবর? তুমি কান্না করো না? তোমার কান্নার হিসাবের কী হবে?”

ইরতিজা একটুখানি নীরব হেসে বললো,
“কান্না করে না এমন মানুষ কি পৃথিবীতে আছে? সবার জীবনেই কান্না আছে। হুম আমিও কাঁদি। তবে আমাকে অত বেশি কাঁদতে হয় না। কান্নার পরিমাণটা কম বলে একাই এর হিসাব রাখতে পারি। কিন্তু আমাকেও হয়তো বেশি কাঁদতে হতো, যদি না আমার বাবার মতো একজন বাবা পেতাম। তখন হয়তো আমি আমার কান্নার পরিমাণটা হিসাব করে কূলোতে পারতাম না! আমার কান্নার সাক্ষী হিসাবে একজনকে খুব করে প্রয়োজন পড়তো আমার। কিন্তু বাবার জন্যই এই প্রয়োজনবোধটা নেই।”

ক্যানিয়ল মনোযোগ দিয়ে শুনছিল ইরতিজার কথা। জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি কি তোমার ড্যাডকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসো?”

“ইয়েস। আব্বু আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দরতম মানুষ। আব্বুর সাথে আমি অন্য কাউকেই কখনও তুলনা করতে পারবো না। সে আমার চোখে আদর্শ একজন ব্যক্তি। খুব ভালোবাসি আমি আমার আব্বুকে।”
বেশি কিছু বললো না ইরতিজা। বাবার প্রতি তার ভালোবাসা, শ্রদ্ধা মুখে প্রকাশ করে প্রমাণ করা যাবে না।
ইরতিজা ক্যানিয়লকে প্রশ্ন করলো,
“তুমি কাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসো?”

“আমি?”
ক্যানিয়ল দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বললো,
“যদি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসার প্রসঙ্গই ওঠে তাহলে আমি বলবো, আমি আমাকেই সবচেয়ে বেশি ভালবাসি। মানুষ নিজের থেকে অন্য কাউকে বেশি ভালোবাসতে পারে না।”

“এটা ভুল কথা।”

“হতে পারে ভুল। নিজে যতটুকু বাস্তবতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছি, তা থেকেই কথাটা মনে হলো। তবে আমি সবচেয়ে বেশি আমাকেই ভালোবাসি।”

ক্যানিয়ল মাথার টুপিটা খুলে ইরতিজার মাথায় দিয়ে বললো,
“বাসায় যাও ছিঁচকাঁদুনে মেয়ে। এই ঠান্ডার মাঝে বেশিক্ষণ থাকলে তোমাকে তো আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। দেখা যাবে বরফের নিচে ঢাকা পড়ে গেছো।”
ক্যানিয়লের পকেটে থাকা মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো। মোবাইল বের করে দেখতে পেল মিরান্ডার কল। মোবাইলটা ইরতিজার দিকে ফিরিয়ে বললো,
“লুক ইট, আমার উডবি ওয়াইফ কল করেছে। আমাকে এখন চলে যেতে হবে। টানা বিশ মিনিট কথা বলবো আমি ওর সাথে। বাই দ্য ওয়ে, তুমি কিন্তু নিজের কথা রক্ষা করোনি। বলেছিলে তোমাকে হিজাব ছাড়া আর কখনও দেখা যাবে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তোমার মাথায় আমি আজ কোনো হিজাব দেখতে পাচ্ছি না পাকিস্টানি গার্ল!”

ইরতিজার হিজাবের কথা খেয়ালই ছিল না একেবারে। এই মুহূর্তে সে ভীষণ লজ্জা বোধ করলো। বাইরে বের হওয়ার আগে অবশ্যই তার হিজাব পরে বের হওয়া উচিত ছিল।

ক্যানিয়ল বললো,
“বাইরে প্রচণ্ড ঠান্ডা। অন্তত একটা টুপি পরে তো বের হওয়া উচিত ছিল তোমার। কেন পরোনি? যাতে আমার টুপিটা পেতে পারো সেজন্যে? হঠাৎ আমার টুপির প্রতি তোমার এত ইন্টারেস্ট কেন জন্মালো? তুমি কি এখন আমাকে রেখে আমার দামি দামি টুপি গুলোর প্রেমে পড়ে যাচ্ছ?
আমার দামি জ্যাকেটগুলোর প্রেমে পড়লেও একটা কথা ছিল। কিন্তু টুপি? ইশ, তোমার চয়েজ এত বাজে পাকিস্টানি গার্ল? তোমাকে নিয়ে আমি হতাশ!”
ক্যানিয়ল কথাগুলো বলে চলে গেল।

ইরতিজা বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। টুপি… জ্যাকেটের প্রেম… কীসব বলে গেল ক্যানিয়ল?

_______________

জোনাস ব্যাগ প্যাক করছে। ঝিমঝিম শব্দে উদ্দীপনার বৃষ্টি নামছে তার অন্তঃকরণে। আনন্দও হচ্ছে। অনেক অপেক্ষার পর তার যাওয়ার সবকিছু ফাইনাল হলো। এতটাই খুশি লাগছে যে সে এই খুশিতে মনে মনে একটা পণ করে ফেললো। ইরতিজার সাথে তার দেখা হলেই সে একবার শক্ত বাঁধনে জড়িয়ে ধরবে ইরতিজাকে! ইরতিজা যদি এতে তাকে কঠিন কোনো শাস্তি দেয় তাতেও দ্বিমত করবে না সে।
রুমের বাহির থেকে মম-পাপার বিতর্কিত কথোপকথন শোনা যাচ্ছে। মম পাপাকে উদ্দেশ্য করে বলছে,
“জোনাস আমাদের একমাত্র সন্তান। ওকে কি করে অত দূরে যেতে দিতে পারি? ও ওখানে গেলে কি আমাদের যখন-তখন দেখা করার সুযোগ থাকবে? একটা অপরিচিত জায়গায় তুমি ওকে কীভাবে পাঠাতে সম্মত হলে হ্যারি? তুমি পাগল হয়ে গেছো, তাই বলে আমিও এটা মেনে নিতে পারি না। জোনাস কোথাও যাবে না। ওকে না দেখে থাকা পসিবল নয়!”

মায়ের কথাগুলো জোনাসের মনে কষ্ট দেয়। কিন্তু এখন এই কষ্টকে প্রাধান্য দেওয়ার চেয়ে ওখানে যাওয়াটা বেশি জরুরি বলে মনে করছে সে।
এই মুহূর্তে ইরতিজাকে একটা ম্যাসেজ পাঠালে কেমন হয়? ম্যাসেজটা হবে এমন,
‘ভালোবাসি টিজা। আমার জীবনের থেকেও তোমায় অত্যাধিক ভালোবাসি আমি। আমি ভালোবাসি তোমার চোখ, কান, নাক, ঠোঁট, চুলকে। ভালোবাসি গোটা তুমিটাকেই। আমি ভালোবাসি তোমার আচরণকে। ভালোবাসি তোমার বিরক্ত হয়ে বলা আগেকার সেই ‘স্টুপিড বয়’ কথাটাকে। এমনকি আমি ভালোবাসি তোমার করা সেই প্রত্যাখ্যানকেও!’

কিন্তু ম্যাসেজ লিখতে গিয়ে জোনাস আর এসব কথা লিখতে পারলো না। মনে মেঘ জমে কালো করলো আকাশ। মনে হলো ইরতিজাকে আসলে সে ঘৃণাই করে! মোবাইলটা ছুঁড়ে লাগেজের উপরের জামাকাপড়ের উপর ফেললো। বিড়বিড় করে বললো,
“ঘৃণা করা সত্ত্বেও আমি কেন তোমার কাছে ছুটে যাচ্ছি টিজা? তোমার প্রতি এ কেমন অদ্ভুত ঘৃণার জন্ম নিয়েছে আমার মাঝে?”

(চলবে)