উড়ো পাতার ঢেউ পর্ব-৪+৫

0
331

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ০৪
__________________

গতরাতে সাজিদ কল দিয়েছিল। মোবাইল সাইলেন্ট থাকার কারণে টের পায়নি ইরতিজা। তাছাড়া জোনাসের সাথে কথা বলার পর থেকে সে মোবাইলের ধারে কাছেও ছিল না। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেছে সাজিদের একটা মিসড কল। এখন কল ব্যাক করতে ইচ্ছা হচ্ছে না। আর লোকটার আচরণ দেখে তো সে অবাক! লোকটা এমন কেন? মাত্র একটা কল দিয়েছে। দুটো কল দিলে তার কী এমন ক্ষতি হতো? কল দেওয়া নিয়েও কেউ কিপ্টামি করতে পারে এই প্রথম জানলো। এই লোককে তো কখনোই বিয়ে করা সম্ভব নয়। বিয়ে করার কথা মাথায়ই বা আনছে কেন? এই লোককে তো বিয়ে করবেই না সে।

ইরতিজা বৃষ্টি দেখার জন্য বাসার ব্যাক সাইডে এসে বসেছে। ব্যাক সাইডে একটা গ্লাস ডোর আছে। গ্লাস ডোর খুলে বের হলেই পিছনের ছোটো লনটা। ডোরের কাছেই টুলে বসেছে সে। আকাশের মুখ ভার ছিল গতকাল বিকেল থেকে। রাত পর্যন্ত মুখ ভার করা আকাশ নিজের কান্না চেপে রেখেছিল। কিন্তু সকাল হতেই সে পিটপিট করে কান্না শুরু করেছে।
রেডমন্ডে জুন-সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সর্বদা রৌদ্রজ্জ্বল পরিবেশ থাকে। ডিসেম্বর মাসে এখানে বেশি বৃষ্টি হয়। এটা ইরতিজা আগে জানতো না। কাল জুহি জানালো। শীতের সময় বৃষ্টি ব্যাপারটা অনেকের কাছেই বিরক্তির কারণ। তবে স্নো ফল হওয়ার পর যদি বৃষ্টি হয় তাহলে বরফ তাড়াতাড়ি গলে যায়।

“তুমি দরজার কাছ ঘেঁষে বসেছো কেন? বৃষ্টি লাগছে না তোমার গায়ে?”

মায়ের কথাটা কানে আসতেই ঘুরে চাইলো ইরতিজা। মায়ের মুখখানিতে গভীর ভাবে দৃষ্টি আটকে গেল। মাঝে মাঝেই মাকে দু চোখ ভরে দেখার তৃষ্ণা জাগে তার মাঝে। সব সময়ের দেখার থেকে এই দেখায় ভিন্নতা আছে। আজও তেমনভাবে দেখতে ইচ্ছা হলো। এই নীরব-নিশ্ছিদ্র প্রহরে মায়ের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা হলো তার।
মাকে দেখতে দেখতে মুখ ভার করা আকাশের মতো মন ভার হয়ে এলো। অভিমানী মনে প্রশ্ন জাগলো, মা কেন ঘৃণা করে তাকে? এই প্রশ্নটা মাঝে মাঝেই জাগে তার মনে। উত্তর খুঁজে বেড়ালো না সে। উত্তর জানা। তবে এটার যে উত্তর তা যুৎসই নয়। ইরতিজা আবেগি মনকে ঝেড়ে ফেলে বললো,
“বৃষ্টি লাগছে না আমার গায়ে।”

শারমিন আর কিছু বললেন না। মেয়ের প্রত্যুত্তর শুনে নীরব চলে গেলেন।
ইরতিজা ক্ষুদ্রতম নিঃশ্বাস ত্যাগ করে আবারও চাইলো বৃষ্টিতে। সাজিদকে আর তার কল ব্যাক করতে হলো না, কিছুক্ষণ পর সাজিদ নিজ থেকেই কল করলো। ইরতিজা সময় ব্যয় না করে কল আসার সাথে সাথেই রিসিভ করে ফেললো। শুনতে পেল সাজিদের কাঠ কণ্ঠ,
“গতরাতে আমি আপনাকে কল করেছিলাম, আপনি কল রিসিভ করেননি।”

ইরতিজার শান্ত মুখে রাগের ঝাপটা লাগলো। লোকটাকে তাৎক্ষণিক একটা উপাধি দিয়ে দিলো সে, ‘বেয়াদব’! কল করে মানুষ তো আগে খোঁজ-খবর নেয়। ‘কেমন আছেন?’, ‘নতুন শহর কেমন লাগছে?’, এসব প্রশ্ন তো করতে পারতো। তা না করে বেয়াদবের মতো কী বললো এটা? বেশ, সেও এমনই জবাব দেবে। কাঠ গলায় বললো,
“আজও যদি এই কলটা রিসিভ না করতাম তাহলে কিপ্টামি করে একটা কল দিয়েই স্টপ হয়ে যেতেন, তাই না? গতকালকের মতো।”

“বুঝলাম না।” বিস্ময় কণ্ঠে বললো সাজিদ।

“কল দেওয়া নিয়েও যে কেউ কিপ্টামি করতে পারে সেটা আপনাকে না দেখলে জানতাম না। কিপ্টামি করে মাত্র একটা কল দিয়েছিলেন গতকাল।”

“ভদ্র মানুষদের একটার বেশি কল দিতে নেই।”

“কে বানিয়েছে এই নিয়ম?”

“আমি।”

“তাহলে কল কেটে দিচ্ছি। ভদ্র মানুষদের একটার বেশি কথাও বলতে হয় না।”

“ফাঁকি দিতে চাচ্ছ?”

“কীসের ফাঁকি?”

“আমার জন্য বউ খুঁজে দেওয়ায় ফাঁকি দিতে চাচ্ছ।”

“মোটেই না। আমি ইতোমধ্য আপনার জন্য বউ খোঁজা শুরু করে দিয়েছি। যেদিন এসেছি সেদিনই আমি এই মিশনে নেমেছি। আপনার তো আমার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। আমি কোনো প্রকার রেস্ট না নিয়ে আপনার জন্য বউ খুঁজে যাচ্ছি এক নাগাড়ে। দুটো মেয়েকে আমি নির্ধারণ করেও ফেলেছি। দাঁড়ান, আমি ছবি পাঠাচ্ছি আপনাকে। যদি আপনার পছন্দ হয় তাহলে আমি মেয়েটার সাথে কথা বলতে যাব।”

ইরতিজা ইন্সট্রাগ্রাম থেকে সংগ্রহ করা দুটো মেয়ের ছবি পাঠিয়ে দিলো সাজিদের কাছে। তারপর বললো,
“খুব কষ্টে মেয়ে দুটোর ছবি তুলেছি। বলুন, পছন্দ হয়েছে একজনকেও?”

“সিরিয়াসলি? এই ছবি আপনি তুলেছেন?”

“কেন? সন্দেহ হচ্ছে আপনার?”

“না, হচ্ছে না। মেয়ে দুটো কোন দেশি?”

“আমেরিকান।”

“মেয়ে দুটো ক্রিশ্চিয়ান?”

“হলে সমস্যা কোথায়?”

“এর মানে আপনি চান আমি ক্রিশ্চিয়ান মেয়ে বিয়ে করি?”

“আমি সেটা কখন বললাম?”

“বলার কী বাকি রেখেছেন? মেয়ে দুটোকে পছন্দ হয়নি। অন্য মেয়ে খোঁজার ব্যবস্থা করুন। আর অবশ্যই মুসলিম মেয়ে খুঁজে বের করবেন। আর তাদের অবশ্যই ভালো মেয়ে হতে হবে। আপনার মতো খারাপ নয়।”

“আমি খারাপ মেয়ে?” কিছুটা রেগে গিয়ে বললো ইরতিজা।

“অবশ্যই। নিজেই তো নিজেকে খারাপ বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, মনে নেই?”

“রাখছি।”
কথা দীর্ঘ না করে কল কাটলো ইরতিজা। নিজের কর্মতে নিজেরই কথা শুনতে হচ্ছে। লোকটার কত বড়ো সাহস তাকে খারাপ বলছে? প্রথমে লোকটার কোনো খুঁত খুঁজে পায়নি, কিন্তু এখন একটার পর একটা খুঁত বের হয়েই চলেছে। লোকটা বেশরম, কিপ্টা এবং বেয়াদব!

______________

বাথরুম থেকে বের হয়ে রিশন দেখলো তার বিছানায় সুন্দরী এক শ্বেতাঙ্গ মেয়ে বসে আছে। মেয়েটার সোনালি রেশমি চুল আর নীল স্বচ্ছ চোখ জোড়া সর্বপ্রথম দৃষ্টি কেড়ে নিলো।
সদ্য গোসল সেরে বের হয়েছে সে। মাথার চুল ভেজা। চুল মুছতে মুছতে বের হয়েছিল। মেয়েটাকে দেখে একদম বরফের ন্যায় স্থির হয়ে গেল। অগাধ বিস্ময়ে ভ্রু কুঁচকে গিয়ে ভ্রুর মধ্য স্থানে দুটো ভাঁজ পড়েছে। মেয়েটার ঠোঁটে লেগে আছে আলতো নরম হাসি। তার দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে হাসি বহাল রেখেছে।
রিশন কুঁচকানো ভ্রু জোড়া আরও প্রখর করে বললো,
“হু আর ইউ?”

মেয়েটা বসা থেকে উঠে এলো। হ্যান্ডশেকের জন্য একহাত বাড়িয়ে দিলো রিশনের দিকে। রিশন হ্যান্ডশেক করলে মেয়েটা বললো,
“আমি লুসিল। তোমার সিস্টার জু-হি আমাকে ডেকেছে…”

জুহি কখন ফিরবে? ইরতিজার ভালো লাগছে না একা একা। জুহি তাকে ডেকে এনেছে নিজের বাসায়। কিন্তু ‘এমা’ নামের একটা মেয়ে ফোন করলো বলে সে ছুট দিলো জিমে। কী যেন একটা ঝামেলা হয়েছে জিমে। জুহিকে প্রয়োজন ওখানে। যাওয়ার সময় বলে গেছে দশ মিনিটের ভিতর ফিরে আসবে। দশ মিনিট থেকে অলরেডি ছয় মিনিট অতিক্রম হয়ে গিয়েছে। যাওয়ার আগে ইরতিজাকে কোথাও যেতে নিষেধ করে দিয়েছে। সে ফিরলে দুজন মিলে বাইরে বের হবে। কিন্তু ইরতিজা একা বসে থাকতে বিরক্ত বোধ করছে। চাচা-চাচি কেউ নেই বাসায়। নিজ নিজ কর্মস্থলে অবস্থানরত তারা। মানবশূন্য একটা বাসায় এরকম ঠাঁয় বসে থাকতে কার ভালো লাগে?
বাইরে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি এখনও ঝরছে। ইরতিজা বার বার জানালা দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছে জুহি আসে কি না সেটা দেখার জন্য।
জনমানবহীন বাসার কোনো এক প্রান্ত থেকে অকস্মাৎ এক পুরুষালি রাগি চ্যাঁচানো কণ্ঠস্বর ভেসে এলো কানে। ইরতিজা কেঁপে উঠলো ওই কণ্ঠের দাপটে। তার চোখের তারা ব্যস্ত হয়ে ঘুরতে লাগলো এদিক-ওদিক। কে চ্যাঁচাচ্ছে এরকম? কোত্থেকে ভেসে আসছে এই কণ্ঠস্বর? সে তো ভেবেছিল সে একা এ বাসায় উপস্থিত। আরও কেউ আছে? ইরতিজা চ্যাঁচানোর বিষয় বস্তু ধরার চেষ্টা করলো। পুরুষালি কণ্ঠস্বরটি খুব রাগান্বিত ভাবে কাউকে চলে যেতে নির্দেশ দিচ্ছে। ইরতিজা কান পেতে রেখেছিল। হঠাৎ দেখলো সোনালি কেশের অপরূপ এক মেয়ে ব্যস্ত পায়ে লিভিং রুমে এসে দাঁড়িয়েছে। কিঞ্চিৎ ভয় আভা ফেলা নীল চোখ জোড়া দিয়ে একবার তাকালো তার দিকে, তারপরই আবার ব্যস্ত পায়ে ছুটে গেল বাসা থেকে বের হওয়ার উদ্দেশ্যে। কোত্থেকে কী হলো কিছুই বুঝতে পারলো না ইরতিজা! বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেল সে।

রিশন ভীষণ ক্ষেপে গিয়েছে। সকাল সকাল তার বোন তার মাথা গরম করে দিয়েছে। কোন চেতনায় এমন আহাম্মক ধরনের কাজ করলো তার বোন? যেখানে গত রাতে তার ব্রেকআপ হয়েছে, সে এখন এক্স গার্লফ্রেন্ডের শোকে কাতর, সেখানে এই মেয়েকে পাঠিয়েছে তার সাথে ডেটে যাওয়ার জন্য? উফ, আসলেই বড়ো পাগল এই জুহি! সে সময় এতটাই রেগে গিয়েছিল যে বোনের উপর থাকা রাগ বেচারি শ্বেতাঙ্গ মেয়েটার উপর ঝেড়ে দিয়েছে। মেয়েটার তো কোনো দোষ ছিল না, সব দোষ তার বোনের। মনে মনে হাজারো ক্রুর ধ্বনি তুলে রিশন তার বেডরুম থেকে বের হলো। মনে মনে বকবক করেই চলছিল সে। লিভিং রুমে এসে আরেক দফা বিস্ময়ে জমে গেল। এখানেও সোফার উপর বসে আছে আরেকটা অপরিচিত মেয়ে। তবে এ শ্বেতাঙ্গ নয়। এর গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা। কুঞ্চিত ভ্রু আর বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে শ্বেতাঙ্গ মেয়েটাকে যেভাবে প্রশ্ন করেছিল, ঠিক সেভাবে প্রশ্ন করলো,
“হু আর ইউ?”

রিশনের প্রশ্ন শুনে দাঁড়ালো ইরতিজা। বলবে, ‘আরে, আমাকে চিনতে পারছো না রিশন? এটা আমি। তোমার কাজিন ইরতিজা।’
কিন্তু সে একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারলো না।
রিশন যেই না বুঝতে পারলো এই মেয়েকেও তার বোন তার সাথে ডেটে যাওয়ার জন্য পাঠিয়েছে, অমনি ব্যস্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,
“দেখো, এটা একটা ভুল বোঝাবুঝি! আমার বোন একটা পাগল। আমি জানি না ও কী কী বলেছে তোমায়, কিন্তু আমার পক্ষে তোমার সাথে ডেটে যাওয়া সম্ভব নয়। গতকালই আমার ব্রেকআপ হয়েছে, আমি এখনও আমার এক্স গার্লফ্রেন্ডকে ভুলতে পারিনি। সে আমার হৃদয়ে তীরের মতো বিঁধে আছে এখনও। সো প্লিজ, তুমি যাও। আমার পাগল বোন তোমার মতো আরও একজনকে নিয়ে এসেছিল। এই একটু আগে আমি তাকে বকা-ঝকা করে তাড়িয়ে দিয়েছি। শুধু শুধুই মেয়েটার উপর ক্ষেপে গিয়েছিলাম আমি। আমি চাই না এখন তোমার উপরও আমি ক্ষেপে যাই। আমি রাগারাগি করতে চাই না। তুমি চলে যাও ডিয়ার।”

ইরতিজা বুঝতে পারলো রিশন তাকে ভুল বুঝছে। ভুল ভাঙানোর জন্য মুখ খুললো,
“আমি…”

“উহ্, জাস্ট গেট লস্ট। আমি এই মুহূর্তে কারো একটা কথা শোনারও মুডে নেই। তোমাকে আমি ভালোয় ভালোয় চলে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছি। তুমি কি সেটা হারাতে চাও? যতক্ষণে না ওই নীল চোখের মেয়েটার সাথে করা চ্যাঁচামেচি তোমার সাথে শুরু করবো ততক্ষণে কি যাবে না? হুহ? যাবে না?” শেষের প্রশ্নটা অতি ক্ষিপ্রভাবে কণ্ঠ হতে ছুটে বেরিয়ে এলো।

ইরতিজা কেঁপে উঠলো ভয়ে।
ইরতিজার মুখটা এতক্ষণে ভালোভাবে খেয়াল হলো রিশনের। এতক্ষণ সে অতটা খেয়াল চক্ষুতে তাকায়নি। কিন্তু তাকানোর পর কিছু একটা উপলব্ধি হলো। চোখ দুটো সরু করে বললো,
“ওয়েট, তোমাকে চেনা চেনা লাগছে না?”

ইরতিজা কিছু বললো না। রিশনের মনে পড়ছে তাকে। কষ্ট করে নিজেই মনে করুক। সে কোনো রকম সাহায্য করবে না।

“হ্যাঁ, তোমাকে তো আমি চিনি। কে যেন তুমি?”

তাকে চিনতে রিশনের এতটাই কষ্ট হচ্ছে? শত হলেও সে রিশনের চাচাতো বোন। ইরতিজার ভিতর হালকা অপমানবোধ অনুভব হলো। মানুষজন কি তাকে খুব তুচ্ছ করে দেখে? না হলে চিনতে এতটা অসুবিধা তো হওয়ার কথা না।

“তুমি টিজা না?” অবশেষে পুরোপুরি মনে করতে সক্ষম হলো রিশন।

ইরতিজা এবার বললো,
“হুম, আমি টিজা।”

রিশন প্রসন্ন হাসলো। তার গালেও জুহির মতো টোল ভেসে উঠলো। উচ্ছ্বসিত হয়ে ইরতিজাকে হাগ করতে এলেই ইরতিজা দূরে সরে গিয়ে বললো,
“নো নো নো, ডো’ন্ট হাগ মি।”

রিশন বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। অবাক দৃষ্টি মেলে চাইলো সে। ইরতিজার দু চোখে নিষেধাজ্ঞা জারি।

রিশন কী ভাবলো জানে না ইরতিজা। তবে সে যা ভাবার ভেবে নিয়েছে। এরা জন্ম থেকে আমেরিকা বসবাস করে বলে এদের মাঝে দেশীয় শিক্ষাবোধ নেই। এদের প্রতিটা রক্তকণিকায় বোধহয় আমেরিকার সংস্কৃতি প্রবাহমান হচ্ছে।

রিশন প্রথমে বিচলিত হয়ে গেলেও মানিয়ে নিয়ে বললো,
“আমি স্যরি, আমি প্রথমে চিনতে পারিনি তোমায়। আসলে আমি মানসিক ভাবে ভীষণ হার্ট এখন। গতকাল আমার গার্লফ্রেন্ডের সাথে ব্রেকআপ হয়েছে আমার।”
বলতে বলতে রিশনের মুখ কাঁদো কাঁদো হয়ে উঠলো। ইরতিজার খুব মায়া লাগলো। প্রথম থেকেই লক্ষ করছে, রিশনের জন্য মায়াটা একটু বেশি অনুভব করছে সে।

আবেগি হয়ে পড়ছে বুঝতে পেরে রিশন নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
“যাই হোক, এটা তেমন কোনো ব্যাপার নয়। আসলে কি জানো তো, মেয়ে জাতিটাই হচ্ছে নির্দয়! এদের হৃদয় নামক বস্তুটি নেই। এরা হচ্ছে চরম নির্মম, পাষাণ!”

ইরতিজার খুব করে লাগলো। কণ্ঠে কখন যে রাগের ছোঁয়া লেগে গেল নিজেও বুঝলো না।
“আজেবাজে কথা বলবে না রিশন। মোটেই সব মেয়েরা নির্দয় হয় না। তুমি তোমার গার্লফ্রেন্ডকে বলবে ঠিক আছে, কিন্তু তাই বলে তুমি পুরো মেয়ে জাতিকে কেন টানবে? সব মেয়েরা নির্দয় হয় না এটা মাথায় রাখা উচিত তোমার।”

কথাটা বলে ইরতিজা থমকে গেল। মনে পড়লো নিজের কথা। সে নিজেও তো কম নির্দয় নয়। জোনাসের মনে কষ্ট দিয়েছে। সাজিদের সাথেও দেখা করে কত কী বলেছিল। লোকটাকে বউ খুঁজে দেওয়ার মিথ্যা আশা দেখিয়েছে। সে নিজেও মনে হয় নির্দয় মেয়েদের কাতারেই পড়ে।

রিশন বললো,
“ওহ, আমি স্যরি! আমার মাথা আসলে ঠিক নেই। কী বলতে কী বলছি নিজেই বুঝতে পারছি না। তুমি কি খুব বেশি রাগ করলে?”

“না, রাগ করিনি আমি।”

রিশন আলতো হেসে বললো,
“তোমরা এসেছো অথচ এই ব্রেকআপের চক্করে তোমাদের সাথে দেখা করাই হয়ে ওঠেনি। তা তুমি একা কেন? আমার স্টুপিড সিস্টার কোথায়?”

“ও তো জিমে গেল, দশ মিনিটে ফিরে আসার কথা। কিন্তু এখন…”

“তুমি ভুল মানুষকে বিশ্বাস করেছো টিজা। আমার বোন সময়ের প্রতি যত্নশীল নয়। আচ্ছা, তুমি বলো, কী খাবে? কফি বানিয়ে আনবো?”

রিশনকে দেখে অবাক হলো ইরতিজা। একটু আগেও ব্রেক আপের শোকে কাতর ছিল এই ছেলেটা, অথচ এখন মনে হচ্ছে না এর মাঝে শোকাহত অবস্থা আছে। কত সরল এখন এর আচরণ। জোনাস কেন তাহলে রিশনের মতো সহজ হতে পারে না? ও কেন এখনও সেই পুরোনো স্মৃতিটা মনে ধরে বসে আছে? অযথাই বা কেন ঘৃণা করে তাকে?

রিশন কফি বানানোর জন্য কিচেনে চলে গেল। ইরতিজার মনে পড়লো, সেও ভীষণ ঘৃণা করে জোনাসকে। জোনাসের জন্যই এখন সাজিদের সাথে এনগেজমেন্ট হয়েছে তার। জোনাসের জন্যই সাজিদকে তার বউ খুঁজে দেওয়ার মিথ্যা আশা দেখাতে হচ্ছে। সে ঘৃণা করে জোনাসকে, খুব ঘৃণা করে!

“আমি এসে গেছি।” সরু করিডোর থেকে জুহির কণ্ঠ শোনা গেল।
রিশন কিচেন থেকে শুনেই যত্রতত্র বেরিয়ে এলো। জুহি কেবল করিডোর পেরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল। রিশন চোখে-মুখে চাপা রাগ ধরে বললো,
“কেন করেছো তুমি এটা? ওই মেয়েকে কেন বাড়িতে ডেকে এনেছিলে? তুমি কি পাগল?”

“কার কথা বলছো?”

“তুমি জানো না?”

তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়ে গেল রিশন আর জুহির মাঝে। ইরতিজা দুই ভাই-বোনের ঝগড়ার প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কখনো এর দিকে তাকাচ্ছে, কখনো ওর দিকে। এর মাঝে তার মোবাইলটা জানান দিলো কেউ কল করেছে। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখলো জোনাসের নাম। হৃদয়ে দমকা হাওয়া এসে ঘৃণার পৃষ্ঠাটা মেলে দিলো। কল রিজেক্ট করার জন্য আঙুল বাড়িয়েও হঠাৎ আবার রিসিভ করে ফেললো। ওপাশ থেকে জোনাস বললো,
“আমি আমার সাইকেলটা বিক্রি করে দিয়েছি টিজা।”
বলেই কল কেটে দিলো সে।

(চলবে)

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ০৫
__________________

সকালটা শুরু হয় পাহাড় দেখা দিয়ে। সারাদিন এই পাহাড় দেখাটা বিদ্যমান থাকে। বাড়ি থেকে বের হলেই দেখা যায় পাহাড়ের ভ্যালি। কত মনোমুগ্ধকর সেই দৃশ্য! ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। এখানে আসার পর থেকে শুধু একটা কথাই ভাবছে ইরতিজা, এ শহরটা এত সুন্দর কেন? এই শহরের সৌন্দর্যে মুগ্ধ সে। প্রকৃতি রৌদ্রজ্জ্বল থাকলে পাহাড় ভালো করে দেখা যায়। কুয়াশা, মেঘলা পরিবেশ থাকলে অতটা ভালো দেখা যায় না। গত তিনদিন রোদ ছিল। আজ আকাশ আবার মেঘলা। বৃষ্টি হওয়ার পূর্বাভাস নেই। তবে সারাদিন মেঘলা প্রকৃতি থাকবে। এখানের তেমন কিছু ঘুরে দেখা হয়নি এখনও। তবে একদিন আগে সে এবং নওরিন জুহির সাথে একটা ফরেস্ট এরিয়া ঘুরতে গিয়েছিল, ‘Redmond west wetland’। বাসা থেকে সাত-আট মিনিটের পথ ওটা।
শীত শীত বাতাস, পাখির কলকাতান আর সবুজের বিশাল অরণ্য মুগ্ধতায় জড়িয়ে ধরেছিল। সত্যি কথা বলতে ওখান থেকে আসতে ইচ্ছা করছিল না। সরু ওয়াকওয়ে ধরে হেঁটেছিল অনেকক্ষণ। তাও প্রকৃতি দেখার স্বাদ মিটছিল না। ওয়াকওয়ের দুই পাশে বিশাল বিশাল গাছ। দুটো খরগোশ দেখেছিল। দেখেছিল কাঠবিড়ালিও। আরও বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী আছে ওই ফরেস্ট এরিয়ায়। সব প্রাণীর সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি।
ইরতিজার কাছে সবচেয়ে অবাকপূর্ণ বিষয় হলো- রেডমন্ডে সচরাচর হরিণ দেখা যায়। রিশন যখন বলেছিল তখন বিশ্বাসই করতে পারেনি। ভেবেছিল মজা করছে রিশন। কিন্তু পরেরদিন বিকেলে হাঁটতে বেরিয়ে যখন নিজ চোখেই হরিণ দেখলো, বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল। রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছিল সে আর জুহি, এর মাঝেই কোত্থেকে একটা হরিণ সামনে এসে পড়েছিল। একটু পরই আবার ছুট দিয়ে চলে গিয়েছিল। কী দারুণ একটা ব্যাপার না? আসলেই মুগ্ধকর!

বাসার সামনে রাস্তায় হাঁটছে ইরতিজা। শীত লাগছে, তবে তেমন পুরু কাপড় জড়ায়নি গায়ে। গায়ে শুধু একটা জাম্পার সোয়েটার। খোলা চুলগুলো হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। হাতে কফির মগ। কফি খেতে খেতে ঘর থেকে বের হয়েছিল। এখন হাঁটতে শুরু করে দিয়েছে। মাঝে মাঝে আকাশ পানে তাকাচ্ছে। গম্ভীর আকাশ। আকাশের গম্ভীরতায় তাকালে আড়ি করে বসতে ইচ্ছা হয় আকাশের সাথে।

আজাদ চৌধুরী বাইরে বেরিয়ে ইরতিজাকে ডাকলেন,
“ইরতিজা, খেতে এসো।”

ইরতিজা ঘরে চলে এলো। ডাইনিংয়ে বসলো শুধু সে এবং তার বাবা। নওরিন বাইরে গিয়েছে, এখনও ফেরেনি। আর মা অসুস্থ বোধ করছে বলে শুয়ে আছে। ব্রেকফাস্ট তৈরি করেছে সে আর বাবা। পরোটা, ব্রেড এবং ডিম পোচ। এর বেশি কিছু তৈরি করেনি। বাবাকে হেল্প করে দিয়ে কফি নিয়ে বাইরে গিয়েছিল। বাবা টেবিলে খাবার সাজিয়েই ডাকলেন। বাবা আসলে রান্না-বান্নার কাজে দক্ষ। ইরতিজা নিজেও দক্ষ হওয়ার চেষ্টা করে। পারে মোটামুটি সব কিছুই।

আজাদ চৌধুরী ব্রেকফাস্টের এক পর্যায়ে বললেন,
“জুহির সাথে মার্কেটে যাচ্ছ না কি ব্রেকফাস্টের পর?”

“হ্যাঁ, তবে জুহি শুধু আমাকে নামিয়ে দিয়ে যাবে মার্কেটে। ওর ইম্পরট্যান্ট কাজ আছে, ওকে সেখানে যেতে হবে।”

“একা কেনাকাটা করতে পারবে? অপরিচিত জায়গা তো!”

“সমস্যা নেই, পারবো।”

আজাদ চৌধুরী এ বিষয়ে আর কথা বললেন না। ব্রেডের উপর জেলি মাখাতে মাখাতে বললেন,
“গাড়িটা খুব শীঘ্রই কিনে ফেলবো। গাড়ি ছাড়া চলাচল করা মুশকিল।”

ইরতিজা হ্যাঁ মিলালো,
“হ্যাঁ, গাড়ি ছাড়া চলাচল করা কষ্টের।”

জুহি কল করে পাঁচ মিনিট সময় দিলো। পাঁচ মিনিটে রেডি হয়ে বাইরে বের হলো ইরতিজা। কিন্তু জুহি তাকে পাঁচ মিনিট সময় দিয়ে নিজেই দেরি করছে। রিশনের কথাই সত্যি, মেয়েটা সময়ের প্রতি যত্নশীল নয়। আমেরিকার মানুষের কাছে সময়ের মূল্য অনেক, কিন্তু জুহি তো দেখছে তার ব্যতিক্রম!

রিশন চেয়ারে বসে আছে বাড়ির সামনে। হাতে ট্যাব। ইরতিজা একটু দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে লক্ষ করেছে। সে ইরতিজার কাছে এসে ট্যাবটা ওর সামনে ধরলো। ইরতিজা ট্যাবের দিকে একবার তাকিয়ে বললো,
“এটা কী?”

রিশন ট্যাবটা নামিয়ে নিয়ে বললো,
“আমার ইউটিউব চ্যানেল। সাবস্ক্রাইব করবে।”

“তুমি একজন ইউটিউবার? কই আগে তো জানতাম না।”

“আগে জানতে না এখন তো জানলে। সাবস্ক্রাইব করো কিন্তু, আর ভিডিয়ো গুলোও অবশ্যই দেখার চেষ্টা করবে।”
রিশন টোল পড়া হাসি উপহার দিয়ে আলতো করে ইরতিজার গাল টেনে দিয়ে ঘরে চলে গেল।
ইরতিজা বিমূঢ় হয়ে রিশনের গাল টেনে দেওয়া স্থানটা স্পর্শ করলো। এমন করলো কেন রিশন? তাকে কি বাচ্চা ভাবলো? যে বাচ্চা মেয়ে গাল টেনে আদর করি? কিন্তু তারা দুজন তো সমবয়সী। ব্যাপারটা ভালো লাগলো না ইরতিজার। ভালো না লাগাটা প্রখর হলো যখন এই গাল টেনে দেওয়ার জন্য জোনাসকে মনে পড়লো। আচ্ছা, সমস্যাটা কী? রিশনের সাথে দেখা হলে প্রায়ই তার জোনাসকে মনে পড়ে! জোনাসও আগে হুটহাট করেই তার গাল টেনে দিতো। তখনও ইরতিজার নিজেকে বাচ্চা বাচ্চা মনে হতো। সেদিন জোনাস যখন ফোন করে বললো,
‘আমি আমার সাইকেলটা বিক্রি করে দিয়েছি টিজা!’
ওটা শোনার পর টের পাচ্ছিল, হৃদয়ের গহীন প্রান্তে ব্যথারা শান্ত অথচ বিষাক্ত রূপ নিচ্ছে ধীরে ধীরে। জোনাস এমনও করতে পারে? অযথাই কেন নিজের প্রিয় সাইকেলটা বিক্রি করেছে?

“লেট’স গো টিজা!” জুহির কণ্ঠস্বরে ইরতিজার ভাবনায় ছেদ পড়লো। জুহিকে দেখে মৃদু হাসলো সে। জুহিকে আজ সব দিনের চেয়ে সুন্দর দেখাচ্ছে। আজ একটু বেশিই সেজেছে বোধহয়। ইরতিজা জিজ্ঞেস করলো,
“ঠিক কোথায় যাবে তুমি?”

জুহি হেসে উত্তর দিলো,
“আন্দ্রেজের বাসায়। কয়েকজন ফ্রেন্ড মিলে যাব।”

“আন্দ্রেজ কে?”

জুহি হাঁটা শুরু করে বললো,
“একটা হাঁটতে না পারা ছেলে!”

“মানে? হাঁটতে পারে না?”

“একেবারে হাঁটতে পারে না সেটা নয়। হাঁটা-চলা সবই করতে পারে। কিন্তু ওর ডান পায়ে সমস্যা আছে। এক্সিডেন্টে আঘাত প্রাপ্ত হয়েছিল পা। ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটতে হয়। আমাদের মতো স্বাভাবিক ভাবে হাঁটতে পারে না!”

অজানা কারণেই ইরতিজার হৃদয়ে কষ্ট অনুভব হলো ছেলেটার জন্য। বললো,
“ছেলেটা তোমার বন্ধু হয়?”

“হুম।”

“কিন্তু গতকাল ইউনিভার্সিটিতে তোমার যেসব বন্ধুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলে তাদের মধ্যে তো এমন কোনো ছেলে ছিল না।”

গতকাল ইরতিজা ভার্সিটিতে গিয়েছিল। কিন্তু ক্লাস এটেন্ড করেনি। ক্যাম্পাস ঘুরে-ফিরে দেখেছিল। আগামী কাল অথবা পরশু ক্লাস এটেন্ড করবে।
জুহি জানালো, আন্দ্রেজ সেদিন ভার্সিটিতে যায়নি। ইরতিজার একটু মন খারাপ হলো। সেদিন ছেলেটা ভার্সিটিতে উপস্থিত থাকলে দেখা হয়ে যেত ছেলেটার সাথে।

_________________

মিরান্ডা তাকিয়ে আছে বিছানায় ঘুমন্ত ক্যানিয়লের মুখের দিকে। খুব যতনে দেখছে সে ওকে। ফর্সা মায়াবী একটি মুখ। কালো-বাদামি রঙা চুল কপালের অধিকাংশ ঢেকে রেখেছে। ভ্রু জোড়াও কালো। তবে চোখের পাতা মেললে হালকা কমলা রঙের মণি দুটো হেসে উঠবে। এখনও এভাবে ঘুমোচ্ছে কেন? ড্রিংক করেছে না কি গতরাতে? ভাবতে ভাবতে ভ্রু জোড়া কুঁচকে উঠেছিল মিরান্ডার। এরমধ্যে দেখলো ক্যানিয়লের বন্ধ আঁখি জোড়া মৃদু কম্পমান হচ্ছে। মূলত ঘুম থেকে জেগে উঠছে ও।
মিরান্ডা জানে সে ব্যর্থ হবে, তাও একবার অযথাই চেষ্টা চালালো। ক্যানিয়লের ঠোঁটে চুমু খাওয়ার জন্য ঝুঁকে পড়লো সে। অধরে অধর স্পর্শ করার আগেই অধরে অনুভব করলো আঙুলের ছোঁয়া। মনে মনে হাসলো মিরান্ডা। ছেলেটা আটকে দিয়েছে তাকে। প্রকাশ্যেও হাসলো সে। বললো,
“জানতাম বাধা দেবে। অপ্রস্তুত থেকেও এত নিখুঁতভাবে সামলে নিলে কীভাবে এটা? তুমি আসলেই দক্ষ!”

ক্যানিয়ল হাত দিয়ে মিরান্ডার ঠোঁট আরও জোরে চেপে ধরে বললো,
“কতবার নিষেধ করেছি এমন করতে?” শান্তস্বরের প্রশ্ন।

মিরান্ডা হাত সরিয়ে দিয়ে বললো,
“বহু বার।”

“তারপরেও এমন কেন করো?”

মিরান্ডা ফিচেল হেসে বললো,
“ভালো লাগে করতে।”

ক্যানিয়ল বিরক্তিতে মুখ বিকৃত করে চোখ সরিয়ে নিলো। শোয়া থেকে উঠে নমনীয় দৃষ্টি মেলে চাইলো। ঢিমে গলায় বললো,
“আমি তোমার জন্য অনুভূতি অনুভব করতে এখনও ব্যর্থ মিরান্ডা।”

মিরান্ডার মুখ কালো হয়ে এলো। বললো,
“আমাদের বিয়ে হয়ে গিয়ে বাচ্চা পর্যন্ত হয়ে যাবে তারপরও বোধহয় তুমি আমার জন্য অনুভূতি ফিল করতে পারবে না ক্যানি। এক বছর ধরে একই কথা শোনাচ্ছ তুমি। আমি তোমার উডবি ওয়াইফ। আমার সাথে অবশ্যই তোমার সহজ হওয়া উচিত।”
অভিমানপূর্ণ শোনালো মিরান্ডার কথা।

ক্যানিয়ল বেড থেকে নেমে বললো,
“ফ্রেশ হতে যাচ্ছি আমি।”

মিরান্ডা ফ্রেশ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলো। ক্যানিয়ল ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ঢুকে গেল আবার ড্রেসিংরুমে। সময় নিয়ে রেডি হয়ে বের হলো। কালো লেদার কোটটা গায়ে ঢুকিয়ে বললো,
“সকাল সকাল বাড়িতে আসার কারণ?”

“সকালে তোমার বাড়িতে আসা কি আমার জন্য নিষেধ?”

“না, কিন্তু কেন এসেছো? কারণ আছে নিশ্চয়ই। শুধুমাত্র আমাকে চুমু খাওয়ার উদ্দেশ্যে তো আসোনি।”

মিরান্ডার মন একটু ভালো হয়েছে। সে বেডে বসে ছিল এতক্ষণ। ক্যানিয়লের কাছে এসে দাঁড়ালো এখন। ধূসর চোখ জোড়া ক্যানিয়লের কমলা রঙা চোখে নিবদ্ধ করে বললো,
“ফ্রেন্ডসদের সাথে পাঁচদিনের ট্রিপে ক্যালিফোর্নিয়া যাচ্ছি। এটা জানাতেই এসেছিলাম। তুমি কি এখন বাইরে যাবে?”

“হ্যাঁ, হাঁটতে বের হবো।”

ক্যানিয়ল টেবিল থেকে মোবাইলটা পকেটে ঢুকিয়ে নিলো। যাবে, কিন্তু হঠাৎ একটা কথা মনে করে দাঁড়ালো। মিরান্ডার কাছে এগিয়ে এসে ওর হাত তুলে নিয়ে চুমু খেলো। বললো,
“তোমার আশা আর অপূর্ণ রাখলাম না। ভিন্নভাবে হলেও আংশিক পূরণ করে দিলাম। ট্রিপ ভালো কাটুক মাই ফিউ…”
থেমে গেল ক্যানিয়ল। ‘ফিউচার’ শব্দটা উচ্চারণ করতে গিয়েও আবার করলো না। কথাটা সংশোধন করে বললো,
“মিরান্ডা!”

বলে বেরিয়ে গেল। লিভিং রুম পেরিয়ে আসার সময় মিসেস সোফিয়া বললেন,
“মিরান্ডা এসেছে তো, ওর সাথে ব্রেকফাস্ট সেরে যাও।”

“ওয়াকিং শেষে একা ব্রেকফাস্ট করে নেবো।”

বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলো ক্যানিয়ল। মেঘলা পরিবেশ গুমোট অনুভূতি লিখে চলেছে এক নাগাড়ে। খারাপ নয়। মেঘলাময় দিন ভালো লাগে তার। বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। হাঁটতে হাঁটতে পার্কে চলে যাবে।
প্রকৃতির মতো আজ আশপাশটাও কেমন গুমোট হয়ে আছে। মানুষজন নেই। কর্মদিবসে অবশ্য মানুষ থাকেও না তেমন। তবে আজকে একটু বেশিই ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।
ক্যানিয়ল হাঁটছিল। হঠাৎ একটা খারাপ শঙ্কা হলো তার। মনে হলো কেউ পিছন পিছন ফলো করছে তাকে। আড়চোখে দেখার চেষ্টা করলো। হ্যাঁ, একজন লোক ফলো করছে। হাঁটা অব্যাহত রাখলো সে। আরও কিছুক্ষণ সহ্য করলো এটা। দেখছিল চলে যায় কি না লোকটা। কিন্তু গেল না। বিরক্তিতে অতিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল ক্যানিয়ল। কিছুদূর পিছনে থাকা লোকটাও দাঁড়িয়ে গেল। ক্যানিয়ল অকস্মাৎ পিছন ঘুরে লোকটার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
“হোয়াই আর ইউ ফলোয়িং মি ড্যাম?”
বলেই দৌড়ে গেল লোকটার দিকে।

লোকটা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল প্রথমে। কিন্তু যখন বুঝলো ক্যানিয়ল তার দিকে দৌড়ে আসছে, অমনি সেও উল্টোদিকে ছুটতে শুরু করলো। ক্যানিয়ল পিছন থেকে চেঁচিয়ে বললো,
“স্টপ। স্টপ হিয়্যার।”

কিন্তু লোকটা কি থামবে তার কথায়?

(চলবে)