এই মন তোমাকে দিলাম পর্ব-০২

0
192

#এই_মন_তোমাকে_দিলাম
#পর্ব-২
#আরাদ্ধা_সাদাত_খান
সায়নের বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে ৯টা বেজে গেলো।বাড়ির সবাই জানে যে সায়ন এই মাসের মধ্যে আসবে,কিন্তু কবে সেটা জানে না।তাই আজকে হুট করে আসাটা বাকিদের জন্য এক প্রকার সারপ্রাইজ।
গাড়ি থেকে বের হয়ে ব্যাগ,লাগেজ নামালো।বাড়ির চারপাশে গার্ডে ঘেরা।বাবা কি নিরাপত্তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে?!দিতেই পারে, এমপি মানুষ।শত্রুর অভাব নেই।
গার্ডরা নতুন বিধায় সায়নকে চিন্তা পারলো না।কিন্তু পুরাতন একজন চিনতে পেরে এগিয়ে আসলো।সায়ন ও তাকে চিনে।গার্ডটা ভেতর থেকে ড্রাইভারকে ডেকে আনলো। ড্রাইভারও নতুন, সায়ন একেও চিনে না!
ড্রাইভার লাগেজ নিতে হেল্প করলো ভেতরে। সদর দরজার বেল পড়ার পর জয়া হাসান,অর্থাৎ সায়নের মা গেট খুললো।ছেলেকে অসময়ে দেখে অবাক হলো।
সায়ন ভেবেছিলো এখন তাকে ধরে কান্নাকাটি করবে।কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে জয়া “ভেতরে আয়” বলে নিজেও চলে গেলেন।
ড্রাইভার ভেতরে লাগেজ রেখে চলে গেলো।সায়নও ঢুকে অল্প এগোতেই সীমন্তী মেয়েকে কোলে নিয়ে নামলো।ভাইকে দেখে খুশি হলেও প্রকাশ করলো না। বরং একটা ধমক মারলো,
– আহাম্মক! দরজাটা লাগা।
সায়ন ফিরে আবার দরজা লাগিয়ে আসলো।
এবার জয়া এসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন।ছেলের কপালে একটা চুমু খেয়ে বললেন,
– আব্বু?!আগে বললে কি হতো আজ আসবে? আজ আমাদের বাড়ির বাহিরে থাকার কথা ছিলো।তুমি আসলে কাওকে পেতে না।
সায়নও মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
– সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম মা।বাবা কই?
-উপরে মিটিং করছে।তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো, ততক্ষনে উনিও চলে আসবে। আমি যাই খাবার রেডি করি।
মা চলে যাওয়ার পর পর সায়নের সামনে সীমন্তী এসে দাঁড়ালো।কোলে ৪মাসের ছোট্ট রুহি।
সীমন্তীর জহুরি নজর দেখে সায়ন জিজ্ঞেস করলো,
– কি সমস্যা?
– তুই এত সুন্দর হয়ে গেছিস কেমনে?!
সায়ন হাফ ছাড়লো।সীমন্তীর দিকে তাকিয়ে বলল,
-সেটা বল।তুই যেভাবে তাকিয়ে ছিলি, মনে হলো কাওকে খুন করে এসেছি।
সীমন্তী আর কিছু বলল না।সায়নের নজর পড়লো ছোট্ট পুতুলটার দিকে। হাত বাড়িয়ে সাবধানে ভাগ্নিকে নিজের অধীনে নিয়ে আসলো।ঘাড় শক্ত হতে এখনো অনেক সময় লাগবে। তাই ঘাড়ের পিছে হাত দিয়ে সাপোর্ট দিলো।রুহি বড়বড় চোখ করে মামার দিকে তাকালো। এবং পরপর সায়নের বুকে একটা তীর মেরে ফোকলা দাঁতে হেসে দিলো।সায়নের সেই দৃশ্য দেখে চোখে রীতিমতো পানি চলে আসলো।ঠোঁট বাড়িয়ে গালে, কপালে চুমু খেতে যাবে তার আগেই সামনে, পিছে উভয় দিক থেকেই আতংকিত চিৎকার শুনলো।বেচারা নিজেও ভড়কে গেলো।সে স্বাভাবিক হয়ে উঠার আগেই সীমন্তী মেয়েকে নিজের কোলে নিয়ে নিলো।আর পেছন থেকে সায়নের দুলাভাই,রায়ান এসে শালার মাথায় একটা চাপড় মারলো।
সায়ন সবকিছু একসাথে নিতে পারলো না।অবাক হয়ে বোন,বোনের জামাইর দিকে তাকাতেই রায়ান বলে উঠলো,
– ডাক্তার হয়ে এটা জানিস না যে ছোট্ট বাচ্চাদের পরিষ্কার হয়ে ধরতে হয়।
সায়নের এবার বোধগম্য হলো তার বোন আর বোনের জামাইর চিৎকারের কারন।
সীমন্তী এবার অভিমানি গলায় বলে উঠলো,
– ভাগ্নির জন্য এখন আদর উথলে পড়ছে।অথচ আমার ডেলিভারির সময় আসলি না।সেটা তো দূরে থাক,প্রেগ্ন্যান্সির টাইমে একটু খোঁজ খবর ও নিতি না।
বলেই সে মেয়েকে কোলে হাঁটা দিলো। সায়ন অস্থির কণ্ঠে বলতে লাগলো,
– আরে আপু!শোনো তো….
– কথা বলবি না কোনো।আমার কোনো ভাই নাই।
সায়ন অসহায় চোখে রায়ানের দিকে তাকাতেই রায়ান ওর কাঁধে চাপড় মারলো। বলে উঠলো,
– একটা মাত্র ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে এতটুকু আশা করতেই পারে।
বলে সেও চলে গেলো নিজের রুমে।
সায়ন খালি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।এদের কিভাবে বোঝাবে ডাক্তার হওয়া সোজা ব্যাপার না।গত দেড় বছর এক এফ.সি.পি.এস পাশ কর‍তেই তার সব কিছু বাদ দিয়ে দিতে হয়েছে।ভবিষ্যৎ এর কথা না বললেই নয়।
নিজের লাগেজ নিয়ে সেও হাঁটা দিলো রুমের উদ্দ্যেশ্যে।

তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো যখন তাকে জানানো হলো সামনের শুক্রবার, অর্থাৎ আর আটদিন পর তার বিয়ে।কথাটা বলেছে তারা বাবা তারিফ চৌধুরী ।
সায়ন বিনিময়ে খালি একটা প্রশ্নই করেছে।
“এত তাড়াহুড়ো কেন?”
উত্তর দিয়েছে তার মা।
– মেয়েটা খুবই লক্ষী।তবে একটু জেদি।কিন্তু একজন এমপির পুত্রবধূর এমনটাই হওয়া দরকার।তোর বাবার সাথে আমাদেরও জীবন জড়ানো। সেখানে তোর বউরও স্ট্রং হওয়া লাগবে।মেয়েটা আত্মনির্ভরশীল, শিক্ষিত। বিদেশ থেকে মেডিকেল পড়েছে।অর্থাৎ তোর জন্য পার্ফেক্ট।আশা করি তোর কোনো দ্বিরুক্তি থাকবে না।

সায়ন কিছুই বলতে পারলো না।তাছাড়া বিয়ের বয়স হয়ে যাওয়াতে আরো কিছু বলতে পারলো না।চুপচাপ খাবার খেয়ে উঠে চলে গেলো।পেছন পেছন রায়ান ও গেলো।
গিয়ে শালার কাঁধ জড়িয়ে বলল,
– তোর তো কোনো গার্লফ্রেন্ডও নেই। বিয়েটা করে নে। তোর বোনেরও মেয়েকে পছন্দ হয়েছে। যদিও সবাই ছবিতে দেখেছি। তবে আব্বু আর আম্মু মেয়েকে সরাসরি দেখেছে।
তাছাড়াও,
এরপর সায়নের কানের কাছে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল,
– বয়স হয়েছে। এখন মন মানলেও শরীর আর মানবে না।
সায়ন চোখ ছোট ছোট করে তাকালো তার দিকে।রায়ান মেকে হেসে গলা ঝেড়ে বলল,
– করে ফেল বিয়েটা। পথ চলায় একটা সঙ্গী থাকলে খারাপ না!
তারপর স্মিত হেসে বলল,
– আমিও দিন শেষে তোর বোনের কাছে সুখ,স্বস্তি খুঁজে পাই।আমার সমস্ত ক্লান্তির অবসান সে।
.
রূপন্তী রুমে এসে তপ্তকর নিশ্বাস ফেললো একটা।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো ১০টা বাজে।আজকের দিনটাই খারাপ!
প্রথমত তার রাগ পড়তে সময় নিয়েছে।এমনিতে সে এতও বদমেজাজি না।রাগ উঠলেও খুব দ্রুত আবার ঠান্ডা হয়ে যায়।বরং তাকে প্রচন্ড জেদি বলা যায়। তাছাড়া ডাক্তাররা রাগ নিয়ে টিকতে পারে না। যেখানে তাদের কর্ম ই হলো মানুষের সেবা করা, সেখানে চোটপাট করার কোনো মানে হয় না।তবে সে যে নিজের কোনো পেশেন্টকে ঝাড়ে না,এমনটা নয়।অবশ্য অযথাই ঝাড়ে না।কোনো রোগী নিজের সমস্যা নিয়ে তার কাছে এলো,সে ঔষধ দিলো। এক মাস পর দেখা করতে বলল।সেই রোগী এক মাস পর ঠিকই আসলো, কিন্তু রোগটাকে আরো মারাত্মক আকারে ধারণ করে আসলো।ঔষধগুলো ঠিকভাবে নিয়েছে নাকি জিজ্ঞেস করলে মাথা নাড়বে। কারন জিজ্ঞেস করলে বলবে ভুলে গেছি। এই কথাটা শুনে কোনো ডাক্তারের মেজাজ ভালো থাকবে? আরে বাপ!ঔষধ খেতে ভুলে গেছিস ভালো কথা, সাথে তুই যে অসুস্থ সেটাও ভুলে যা না!আশ্চর্য!
তারপর আর কি?!অন্যান্য ডাক্তাররা একটু রাগারাগি করে পুনরায় চিকিৎসা শুরু করে।কিন্তু রূপন্তী সেটার ধার ধারে না।হয় অন্য ডাক্তারের কাছে রেফার করে দেয়, কিংবা মুখের উপর বলে দেয়ে তার কাছে না আসতে আর।এজন্যই হসপিটালের নার্স,স্টাফ আর তার পেশেন্টরা তাকে সমীহ করে চলে। তবে আড়ালে বদরাগী ডাকতে ভুলে না!

তার রাগ দ্রুত কমে গেলেও আজ সময় লাগলো।তার কারন ওয়ান এন্ড ওনলি ‘সায়ন
চৌধুরী ‘।এই বে’য়া’দ’ব টার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকেই সময় খারাপ যাচ্ছে। এই যেমন সায়ন চলে যাওয়ার পর সে যে ফোনটা আছাড় মেরেছে, এবং তার কিছুক্ষন পর বোধ হয়েছে যে সে তার কলিজা সমতুল্য ফোনটা আছাড় মেরেছে, এই তো প্রথম ব্যাড বায খেলো!তারপর গাড়ি বের করে সেটাতে উঠে পড়লো।ফোন চেক করে রাতে যে হোটেলটায় থাকার কথা সেখান ফোন দিলো। এবং তারা খুব বিনয়ের সঙ্গে জানালো যে উক্ত হোটেলটিতে উল্লেখিত নামের কোনো মানুষের রিজার্ভেশন ছিলো না।সেকেন্ড ব্যাড বায!রূপন্তীর প্রায় হার্ট অ্যাটাক চলে আসলো।সে রিজার্ভ করেছে এবং কনফার্মেশন ইমেইল ও পেয়েছে।ফোন কেটে ইমেইল ঘাটতেই নজরে আসলো যে সে রিজার্ভ করেছে। ভালোমতো খেয়াল করে দেখলো হোটেলটার চট্টগ্রাম ব্রাঞ্চে তার নামে রুম রিজার্ভ করা। নিজের গালে নিজেরই একটা কষে চড় মারতে মন চাইলো।এখন রাত বিরাতে কোথায় ঘুরে বেড়াবে?!এই মুহূর্তে কোনো রুম খালি পাওয়াও টাফ।কি মনে করে একটু আগের হোটেলটাতে আবার ফোন দিলো।জানতে চাইলো কোনো রুম খালি আছে নাকি।হোটেল থেকে তাকে একটু অপেক্ষা করতে বলা হলো।এবার বোধহয় ভাগ্য একটু সহায় হলো। কেননা কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই জানানো হলো রুম পাওয়া যাবে।রূপন্তী সবার আগে আল্লাহ’র নিকট শুকরিয়া জানালো।তার এয়ারপোর্টের কাছেই একটা হোটেল দরকার ছিলো।কেননা আগামীকাল সকালে তার রাজশাহীর একটা ফ্লাইট আছে।রাতেই আবার ফেরতে চলে আসবে।
হোটেল কাছে থাকায় দ্রুত পৌঁছে গেলো।কিন্তু বাহিরে বেশ কিছুক্ষন বসে থাকা লাগলো।আর তাছাড়াও এয়ারপোর্ট থেকে আধ ঘন্টার রাস্তা পাড় করতে এক ঘন্টার বেশি সময় লেগেছে।
এতক্ষন পর সে রুমে ঢুকতে পারলো। দেরি করলো না আর। সবার আগে লাগেছে থেকে সিল্কের একটা পাজামা সেট বের করে ওয়াশরুমে দৌড় লাগালো।ফ্রেশ হয়ে এসে আর কোনো দিক বেদিক না তাকিয়ে সোজা নরম ফোমের বিছানায় নিজের শরীর এলিয়ে দিলো।রাত তখন সাড়ে এগারোটা এগারোটা।
।তার ফ্লাইট ল্যান্ড করেছিলো ৬টার দিকে।এরপর এতসব ভেজালে দেরি হয়ে গেলো।বেশিক্ষন রেস্ট নিতে পারবে না।ভোর সাড়ে সাতটায় আবার রাজশাহীর ফ্লাইট। সেখানে তার এক নানি থাকে। মূলত সে যেই এতিমখানায় থাকতো, সেখানকার মাদার ছিলো।তার কাছে রূপন্তীর নামে তার বাবা কিছু সম্পত্তির উইল রেখে গিয়েছিলেন।সেগুলো নিতেই যাবে সে।চার মাস আগে এসে অবশ্য এসব ঠিক ও করে গিয়েছিলো।তখন সে জমি বিক্রি করেছে। কেননা ঢাকার এক আভিজাত্য এলাকার একটি এপার্টমেন্টে সে একটা ফ্ল্যাট কিনেছে। প্রতি মাসে বাহিরে থেকেই টাকা ট্রান্সফার করতো।কাল জমির টাকাটা পেলে অনেকটুকুই মিটিয়ে দিতে পারবে।বাকিটা ব্যাংক লোন নেওয়া আছে।পরবর্তীতে ব্যাংক লোন মিটাতে পারবে। কিন্তু ফ্ল্যাটের জন্য টাকার ব্যাপারটা মিটে যাবে। আগামীকালের পুরা দিনের সিডিউল কষতে কষতেই চোখ লেগে এলো।কিছুক্ষনের মাঝেই গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেলো।
.
রাত তিনটায় সায়নের ঘুম ভেঙে গেলো।তবুও সে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করলো।কিন্তু পারলো না।কেননা অস্ট্রেলিয়ায় এখন সকাল সাতটা বাজে। অতএব সেখানে সকাল।সায়ন ঘুমিয়েছে রাত ১০টার দিকে।জেট লেগ!
আর ঘুম আসবে না এখন। সে উঠে কিছুক্ষন অসহায়ের ন্যায় বসে রইলো।এই মধ্যরাতে সে এখন কি করবে?!ভাবনার মাঝেই টের পেলো ক্ষুদায় গা গুলিয়ে আসছে।
ওয়াশরুমে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে আসলো।এরপর দরজা খুলে বাইরে উঁকি মারলো।যে যার রুমে ঘুমাচ্ছে।বাহিরে ভূতুড়ে পরিবেশ!হলওয়ে তে আলো জ্বলছে।শব্দহীনভাবে নিচে নামলো।ডাইনিং এ গিয়ে আলো জ্বালাতেই দেখলো টেবিলে সব খাবার দাবার রাখা আছে।
কিন্তু তার খেতে ইচ্ছে করলো না।ঘুমানোর আগেই তো ডিনার করলো।
ফ্রিজ হাতালো,কিছু পেলো না!হাতাহাতি করে ক্যাবিনেট থেকে কাপ নুডুলস পেলো।থার্মাল জারে পানি গরম করলো।কাপ নুডুলসে পরিমাণমতো দিয়ে বাকিটা দিয়ে কফি বানালো।ট্রেতে করে সেগুলো নিয়ে উপরে আসলো।আগে বিছানা গুছালো। এরপর ল্যাপটপ আর খাবার নিয়ে সেখানে বসে পড়লো।দেশে আসার আগে বেশ কয়েকটা হসপিটালে এপ্লাই করেছিলো।কোনোটা থেকে কল আসেনি এখনো। তাই ইমেইল চেক করলো। তেজগাঁও’র একটা হসপিটাল থেকে ডাক এসেছে।আগামী পরশু যেতে হবে ।
সায়ন স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো।যাক!একটা কর্ম জুটেছে।কিছু করার না পেয়ে নেটফ্লিক্সে ঢুকলো। হুট করে রূপন্তীর কথা মনে পড়লো।মেয়েটা কি এখনো রেগে আছে?!
#চলবে।