এই মন তোমাকে দিলাম পর্ব-০৮

0
175

#এই_মন_তোমাকে_দিলাম
#পর্ব-৮
#আরাদ্ধা_সাদাত_খান
সূর্য নিজের অবস্থান পরিবর্তন করে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে হেলেছে। প্রস্তুতি নিচ্ছে নিজেকে ডুবিয়ে ফেলার। যার দরুন চারপাশ ছেয়ে আছে কমলা আভায়।
গাড়ির নিয়ন্ত্রণ সায়নের হাতে। তারা রওনা হয়েছে প্রায় এক ঘন্টা হবে। যেহেতু রূপন্তীর বাসা গুলশানে তাই তারা উত্তরা দিয়ে ঢাকায় ঢুকবে। রাস্তা খারাপ সেই দরুন সায়নের আস্তে গাড়ি চালাতে হচ্ছে। রূপন্তী গাড়িতে ওঠার পর থেকে নন স্টপ ফোন টিপেই চলছে। সায়ন বিরক্ত হলো। এই মেয়েটার মধ্যে নুন্যতম ম্যানার্স টুকু ও নেই।এই যে সে বোবার মত গাড়ি চালাচ্ছে, তার একটুও ভালো লাগছে না। মানে পাশে একজন জলজ্যান্ত মানুষ বসে আছে তবুও তার চুপচাপ গাড়ি চালাতে হচ্ছে। অবশ্য রূপন্তী তার সাথে কথা বলা মানেই ঝগড়া। তবুও সে চেষ্টা করল। হালকা গলা কিসে জিজ্ঞেস করল,
– তোর ফ্ল্যাট কয় রুমের?
-তিনটা বেডরুমের।
-কত স্কয়ার ফিট?
– ২১০০স্কয়ার ফিট।
সায়ন খালি গলায় বিষম খেলো। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
– তুই কি ফ্যামিলি প্লানিং করে বাসাটা কিনেছিস?
রুপন্তী ভ্রু কুচকালো এরকম উদ্ভট কথা শুনে।সেভাবেই জিজ্ঞেস করল,
– মানে কি? ফ্যামিলি প্লানিং করে কেন বাসা কিনবো?
– না হলে এত বড় বাসা একা মানুষের জন্য কেন কিনবি?
– আজব!বিয়ে তো এক সময় করতামই। সেটার সাথে বাসার কি সম্পর্ক?
– এত বড় বাসায় তুই আর তোর জামাই কি ফুটবল খেলতি?
রুপন্তীর মেজাজ খিচে এল। এই ছেলের তার বড় বাসা নিয়ে সমস্যাটা কোথায়?! অতঃপর সে দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দিল,
-সেই ইচ্ছেই ছিলো।শুধু ফুটবল না আরো অনেক খেলা খেলার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু আফসোস জামাই নামক মানুষটা তুই। তাই আর শুধু ফুটবল কেন কোনো খেলাই খেলতে পারবো না।
সায়ন চোখ মুখ কুঁচকে বলল,
– ছি!মেয়ে হয়ে এমন নষ্ট কথাবার্তা বলতে তোর লজ্জা করেনা?!
– কেন? ছেলেরা বলতে পারলে মেয়েরা কেন বলতে পারবে না? তাছাড়া তুই প্রশ্নগুলোই এমন করছিস যে আমি আর কোন ভাল উত্তর খুঁজে পাইনি।
প্রথমবারের মতো রুপন্তী সায়নকে চুপ করিয়ে দিল। আর কিছু খুঁজে পেল না বলার মতো।আবার সেই নীরবতা!
কিছুক্ষণ পর অবশ্য রূপন্তীই আবার নিজে থেকে কথা বলল। সায়নকে ওর পড়াশুনার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করল। অতঃপর সেটা নিয়েই কথাবার্তা শুরু হলো। তারা দুজনেই অস্ট্রেলিয়া থেকে এফসিপিএস এর দুটো পার্ট শেষ করে এসেছে। এখন সামনের ডিগ্রী গুলো দেশ থেকে নিবে নাকি অন্য দেশ থেকে নেবে সেটা নিয়ে আলোচনা।তাদের কথা বলার ধরন দেখে এখন কেউ বুঝতেই পারবে না তাদের মধ্যে সাপে নেউলের সম্পর্ক বিরাজ করে।
.
বিকেলবেলা রওনা দেওয়াটা যে চরম ভুল একটা সিদ্ধান্ত ছিল, রুপন্তী আর সায়ন সেটা টের পেল উত্তরায় ঢুকে। যেহেতু রূপন্তীর বাসা গুলশানে তাই তারা উত্তরা হয়ে ঢাকায় ঢুকেছে। কিন্তু ওই যে অফিস টাইম শেষ হয়েছে, সেই দরুন ট্রাফিকের অবকাশ নেই।তাছাড়া রাস্তার কাজ তো চলছেই। গত ১৫ মিনিট ধরে তারা একই জায়গায় থেমে আছে। সামনের গাড়িগুলো এক চুলও নড়ছে না।গাড়িতে বসে দুজনেই বিরক্ত এখন। সায়ন নেমে দাঁড়াবে তার আগেই সামনের গাড়িগুলো ছোটা শুরু করল।সেও গাড়ি টান দিল। পাঁচ সাত মিনিট চলার পর আবারও জ্যামে আটক করল। আবারো এখন বসে থাকতে হবে। রুপন্তী আশেপাশে তাকিয়ে দেখছে। একটা রেস্টুরেন্ট দেখতেই হুট করে তার মনে পড়ল বাসায় গিয়ে খাওয়ার কিছু নেই। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল প্রায় আটটা বেজে এসেছে। যদিও এত তাড়াতাড়ি ওরা কেউ ডিনার করে না কিন্তু আজ বাসায় গিয়ে সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়বে এটা শিওর। অতঃপর এখন ডিনার করলে কোন ক্ষতি নেই। সে সায়নের দিকে তাকালো। বিরক্তিতে ছেলেটার চোখ কুঁচকে আছে।
– ইয়ে,বাসায় গিয়ে আসলে খাওয়ার মত কিছু নেই। ডিনার করতে হলে চল সামনের রেস্টুরেন্ট এ করে নেই।
রুপন্তীর কথা শুনে সায়ন ঘড়ির দিকে তাকাল। মাত্র আটটা বাজে।এত তাড়াতাড়ি ডিনার?!
তবুও কি মনে করে আর মানা করলো না।

সামনের রেস্টুরেন্ট টাতে জ্যাম ঠেলে আগাতেই ওদের লেগে গেল আরো ১৫ মিনিট। গাড়ি পার্ক করে দুজনেই নেমে দাড়ালো।
বিয়ের পর এই প্রথম রূপন্তীকে আপ টু বটম খেয়াল করলো সায়ন।মেয়েটা কী একদিনে একটু সুন্দর হয়েছে?বরাবরই রূপন্তীকে ওয়েস্টার্নে দেখেছে সে।এই প্রথমবার সালওয়ার কামিজে বেশ সুন্দর ঠেকলো সায়নের নিকট।জার্নির দরুন মুখটা তেলতেলে হয়ে আছে।চোখগুলোও তর্জমা করা যায়।ঠোঁটের রঙ কালচে গোলাপি। এমন কালচে মূলত যারা সিগারেট খায় তাদের হয়।তাহলে কি এই মেয়ে সিগারেট খায়?তবে মেয়েটা ফর্সা হওয়ার দরুন সেই কালচে গোলাপি ঠোঁটটাই যেনো বেশি আকৃষ্ট করে।
রূপন্তী এতক্ষন হাত পা নাড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙছিলো।সায়নের দিকে তাকিয়ে দেখলো ছেলেটা এক নজরে তার দিক তাকিয়েএ আছে। কোন ধ্যানে গেছে আল্লাহ জানে!সেই ধ্যান থেকে ফিরাতে রূপন্তী ওর নাকে ধাম করে একটা বাড়ি মারলো।
সায়ন তখন রূপন্তীর রূপে মুগ্ধ হওয়ার পথে ছিল।কিন্তু নাকে বাড়ি পড়ায় সে পথভ্রষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে পরলো।অতঃপর তার মনে হলো সামনে দাঁড়ানো এই মেয়েটার রূপ বাদে আর কোনো ভালো দিক নেই।তথা এই বেয়াদব মেয়ের রূপে মুগ্ধ হওয়ারও কিছু নেই।

রূপন্তী এবার ওর সামনে তুড়ি বাজিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– কিরে?কই মরলি।
সায়ন নাক ডলতে ডলতে উত্তর দিলো,
– মরার আগে অবশ্যই তোকে মেরে যাবো। এটা আমার জন্য ফরজ কাজ।
রূপন্তী উত্তরে কিছু বলবে তার আগেই সায়ন থামিয়ে দিলো,
– খবরদার রাস্তার মাঝে এখন ঝগড়া করবি না। হিসাব নিকাশ সব বাসায় গিয়ে হবে।

দুজনে রেস্টুরেন্টে ঢুকলো। খাবার হিসবে নিলো খিচুড়ি। খাওয়া শেষে আবার ঝগড়া লাগলো।বিষয়- বিল।রূপন্তী দিয়ে দিতে চাইছিলো।সায়নের ইগোতে লাগলো।রূপন্তী নাকি পরে তাকে এটা নিয়ে খোটা মারবে। রূপন্তীর কথা হচ্ছে, সব রেখে সে কেনো বিল নিয়ে খোটা মারবে। খোটা মারার জন্য আরো বহুত বিষয় বস্তু আছে। সায়ন তবুও রাজি হলো না।শেষমেশ পুরো টাকাটা ভাগ করে দুজনেই অর্ধেক অর্ধেক দিলো।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে আবার গাড়িতে উঠতে উঠতে নয়টার বেশি বেজে গেলো।এবার রাস্তা ফাঁকা।আধা ঘন্টার মাঝে তার বাসায় পৌঁছে গেলো।
এক দেখায় সায়নের ফ্ল্যাটটা পছন্দ হয়ে গেলো।দশ তলার এই বাসাটা বেশ খোলামেলা। আলো বাতাসের অভাব হবে না।সব কয়টা রুমই বড় বড়।সে বাসা ঘুরে ঘুরে দেখার মাঝেই রূপন্তী ফ্রেশ হয়ে বের হলো।সে এসেই গোসল করতে ঢুকে গিয়েছিলো।এখন আরাম লাগছে।
বের হয়ে দেখলো সায়ন ওর বিছানায় বসে আছে৷ওকে দেখেই বলে উঠলো,
– যাক!আমি আলাদা রুমে থাকতে পারবো।তোর সাথে আর শুতে হবে না।
কথাটা রূপন্তীর নিকট অপমানজনক ঠেকলো।উত্তরে ভেংচি কেটে বলল,
– তোর সাথে ঘুমানোর জন্য তো আমি মরে যাচ্ছি!
সায়ন উঠে দাঁড়ালো। নির্বাক গলায় বলল,
– মরতেই পারিস!গত রাতে তো আমার কলিজার মধ্যে ঢুকে ঘুমাচ্ছিলি।খুব কষ্ট করে ছুটিয়েছি।ট্রাস্ট মি তারপর তোকে ছুড়ে মারার লোভটাও খুব কষ্ট করে সামলেছি।

রূপন্তীর কান ঝা ঝা করে উঠলো।এই অসভ্য ছেলে এসব কি বলে?সে কখন তার কলিজার মধ্যে ঢুকে ঘুমিয়েছে?!
তেজী গলায় বলে উঠল,
-মিথ্যা বলার একটা সীমা থাকে সায়ন। তোর কলিজার মধ্যে ঢুকে কখন ঘুমালাম আমি? এসব নোংরা কথা বলতে লজ্জা লাগে না তোর?
বিনিময়ে সায়নও এবার তেঁতে উঠলো,
– আরেকবার আমার সাথে ঘুমাস।সরাসরি প্রমাণ দেখাবো।
বলেই রুম থেকে বের হয়ে গেলো।এবং মিনিট পাঁচেকে মধ্যে আবার ফের‍ত এলো।রূপন্তী তখন ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হাতে পায়ে লোশন মাখাচ্ছে। আয়নার মাঝে দিয়েই সায়নের দিকে তাকালো।চোখে চোখ পড়তেই সায়ন জিজ্ঞেস করলো,
– কোনো রুমেই বিছানা নাই।তোর কাছে এক্সট্রা ম্যাট্রেস বা তোশক আছে?
রূপন্তী মাথা নেড়ে না বোঝালো।
– তাহলে আমি শুবো কোথায়?
– জানি না।মাটিতে।
সায়ন সরু চোখে তাকালো।রূপন্তী পাত্তা দিলো না।ফাইল নিয়ে বিছানায় বসলো।সেদিন আরাদ্ধার এসিস্টে যেই পেশেন্টের ও.টি করেছে সে এখন তার আন্ডারে।হসপিটালে ফোন দিয়ে একটা খবর নেওয়া লাগবে। কিছু পেশেন্টের রিপোর্ট চেক করা লাগবে। এসব শেষ করে ঘুমিয়ে পড়বে।

রূপন্তীর আর কোনো পাত্তা না পেয়ে সায়ন রুম থেকে চলে গেলো।প্রায় ২৫ মিনিট পর আবার এলো। হাতে ল্যাপটপ।মাথার চুল ভেজা। গোসল করেছে। এসে রূপন্তীর জানালার পাশে রাখা ডেস্কে বসলো রূপন্তীর আপাতত আশেপাশে কোনো ব্যাপারে মাথা ব্যাথা নেই। সে নিজের কাজে ব্যাস্ত।
প্রায় পয়তাল্লিশ মিনিট পর সে তার কাজ শেষ করলো।সায়ন তখন ল্যাপটপে কোনো কাজে মগ্ন। সে নিজের ফাইল গুছিয়ে রাখলো।তারপর বিছানায় শুয়ে গায়ে কাঁথা জড়িয়ে সায়নের উদ্দ্যেশ্যে বলল,
– যাওয়ার সময় লাইট অফ করে দরজা টেনে যাস।
সায়ন সাথেই সাথেই উঠে দাঁড়ালো।লাইট অফ করলো,দরজা বন্ধ করলো।তারপর রূপন্তীর পাশে ধপ করে শুয়ে পরলো।রূপন্তী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– এটা কি হলো?
সায়ন অপরপাশে ফিরে বলল,
– কালকে নতুন বিছানা কিনে আনবো।আজকে এখানেই শুবো।আর একটা কথাও বলবি না।বললেই থুতু খাবি।

এই হুমকি শুনে হোক বা অন্য কারনে হোক রূপন্তী আর কিছু বলল না।ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো সাড়ে বারোটার বেশি বাজে।তার নিজেরও প্রচুর ঘুম পাচ্ছে।অতঃপর কিছুক্ষনের মাঝেই দুজন দুইদিকে ফিরে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো।
.
রাত তিনটা বাজে। ঘুমের মাঝেই রূপন্তীর মনে হলো সে উড়ে যাচ্ছে। তারপর ধপাস করে কোথাও ল্যান্ড করলো এবং সাথে সাথে ঘাড় পিঠে চরম ব্যাথা অনুভব করলো।চোখ খুলতেই নিজের অবস্থান দেখে হকচকিয়ে গেলো।
#চলব।

#এই_মন_তোমাকে_দিলাম
#পর্ব-৯
#আরাদ্ধা_সাদাত_খান
রুপন্তী নিজেকে ফ্লোরে আবিষ্কার করল। পিঠের দিকটা ব্যাথায় ছিড়ে যাচ্ছে।চোখ মুখ কুঁচকে শুয়ে থাকা অবস্থায়ই মুখের সামনে কেও ফোন ধরলো।দামি ফোনটার ঝকঝকে স্ক্রিনে একটা ছবি দেখা যাচ্ছে। ছবিটা মূলত একটা সেলফি যেটা সায়ন তুলেছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে যে রূপন্তী সায়নের বুকে একদম চিপকে শুয়ে আছে।
অপরদিকে সায়ন এবার নিজেকে দেওয়া কথা রাখলো।চোখ খুলে রূপন্তীকে বুকের মধ্যে আবিষ্কার করতেই আগে একটা ছবি তুলেছে। এটা প্রমাণ হিসেবে কাজ করবে।এরপর রূপন্তীকে সুন্দর ভাবে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে।
রূপন্তী ছবিটা দেখে একটু হকচকালো।নিজের দোষ কিভাবে ঢাকবে বুঝতে পারলো না।তাই কাঁদোকাঁদো গলায় বলল,
– একটু নাহয় বুকে মুখ গুজেছিলাম।তাতে কি তোর বউ মরে যাবে?
সায়ন এবার নেমে দাঁড়ালো। বুকে হাত গুজে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
– লিসেন,এতদিন বিদেশে থাকা স্বত্তেও আমি ভার্জিন। কারন আমি আমার ভার্জিনিটি শুধুমাত্র আমার প্রকৃত ভালোবাসার মানুষটার মাঝে খোয়াবো। অন্য কেও আমাকে তার আগে ছুঁতে পারবে না।সেখান তুই আমার বুকে এক ভাগ নিয়ে গেছিস।
– মানি কী?
– মানে হলো আজ আমার ঘুম ভেঙেছে বুকে খামচি খেয়ে। চোখ খুলে দেখলাম তুই তোর জন্তুর মতো নখ নিয়ে আমার বুক খামছে ধরে রেখেছিস। টিশার্টের উপর দিয়েও আমার বুকে দাগ বসে গেছে।পরে আমার বউ দেখলে বলবে আমি আরো কার কার সাথে জানি শুয়ে এসেছি।
– ছি!কথার কি ছিরি!
তারপর আবার কাঁদোকাঁদো গলায় বলল,
– তাই বলে এভাবে পাষাণের মতো আমাকে ছুড়ে মারবি?অনেক ব্যাথা পেয়েছি।
সায়ন বিরক্ত হয়ে বলল,
– ন্যাকামি করবি না একদম।তোকে সেটাতে মানায় না।অন্যান্য মেয়েদেরকে তাও কিউট লাগে। আর তুই মাঝে বালিশ দেস নি কেন?নাকি তুই আগে থেকেই জানতি বালিশ থাকলেও তুই কন্ট্রোল করতে পারবি না।
– চুপ থাক অসভ্য।

সায়ন হেলেদুলে বিছানায় গিয়ে শুলো আবার।মাঝে একটা বালিশ রাখলো। তারপর চোখ বন্ধ করে রূপন্তীর উদ্দ্যেশ্যে বলল,
– বেশি ব্যাথা হোক কিংবা কম ব্যাথা, উঠে এসে শুতে পারলে শো। নাহয় ফ্লোরেই ঘুমা।গুড নাইট!
রূপন্তী এই প্রথমবার সায়নের আচরণে রাগের বদলে কষ্ট পেলো।মানুষ এতটা নির্দয় কেমন করে হয়!এই যে বিয়েটা হয়ে যাওয়ার পর রূপন্তীর মন অজান্তে হলেও এই সম্পর্কটাকে একটা সুযোগ দিতে চেয়েছিলো।চেয়েছিলো সায়নকে মেনে নিতে।তার জীবনে ভালোবাসার বড্ড অভাব। সায়নের পরিবারকে তার খুব ভালো লেগেছে। সেখানে সায়নকে মেনে নেওয়া তার জন্য খুব বেশি কঠিন হতো না।কিন্তু একটা সম্পর্ক আগাতে হলে দুইপক্ষকেই সমানতালে চেষ্টা করতে হয়।এই যে ছেলেটা ভার্জিনিটি,বউ নিয়ে এত কিছু বলে গেলো,তার মাথায় একবারও আসে নি যে ফ্লোরে পড়ে থাকা মেয়েটা তার বউ?!না আসেনি।এজন্যই এমন ব্যবহার করতে পেরেছে।
রূপন্তী খুব কষ্টে বিছানায় উঠে বসলো।আসলেই ঘাড়ে অনেক ব্যাথা পেয়েছে। পাশে ড্র‍য়ার হাতিয়ে পেইন কিলার বের করে খেয়ে নিলো।তারপর চুপচাপ শুয়ে পরলো।মাঝে অনেক দূরত্ব।
রূপন্তী হুট করে খেয়াল করলো তার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে।সে নিজের জীবন নিয়ে হাপিয়ে উঠেছে।আর কত!
সেই পানিভর্তি চোখ ই সে বন্ধ করলো।তার মন তাকে বার বার জানিয়ে দিচ্ছে,
“YOU GUYS ARE NOT MADE FOR EACH OTHER! ”
.
পরেরদিন ঘুম থেকে উঠে সায়ন রূপন্তীকে পাশে পেলো না।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো আটটা বাজে।তাকে নয়টার সময় যেতে হবে। উঠে ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বের হলো।রূপন্তী ডাইনিং টেবিলে বসে কছু একটা লিখছে। সে ইতিমধ্যে রেডিও হয়ে গেছে। সায়ন আস্তেধীরে চেয়ার টেনে বসলো।একটা গ্লাস নিয়ে পানি ঢাললো।রূপন্তী তার দিকে তাকালোও না।তার পানি খাওয়ার মাঝেই উঠে কিচেনে চলে গেলো।এবং পাঁচ মিনিটের মাঝে এসে সায়নের সামনে একটা প্লেট রাখলো।প্লেটে তিনটা টোস্টেড ব্রেড আর ডিম পোচ। রূপন্তীর নিজের কাজ করতে করতে এই প্রথম একটা কথা বলল।একটা কেবিনেট ইশারা করে বলল,
– ওইখানে নিউটেলা আর জেলী রাখা আছে। যেটা ইচ্ছা নিতে পারো।
সায়ন সবেমাত্র পাউরুটিতে একটা কামড় দিয়েছে। সেটা মুখে নিয়ে বিষম খেলো।এই মেয়ে তাকে ‘তুমি’বলে কেন?কণ্ঠও অনেক গম্ভীর। সায়নের দিকে চোখ তুলে একবারও তাকায়নি।
সায়নের এমনেও রাতে কাহিনীর জন্য অল্প হলেও খারাপ লাগছিলো।সে আসলেই একটু বেশি বেশি করে ফেলেছে। আচ্ছা রূপন্তী রাগ করেছে?!
সে খাওয়া শেষ করার মাঝেই রূপন্তী এপ্রন গায়ে ব্যাগ নিয়ে রুম থেকে বের হলো।সায়নের সামনে একটা চাবি রেখে পানির বোতলে পানি ভরতে লাগলো।এত তাড়াতাড়ি রূপন্তীকে বের হতে দেখে সায়ন অবাক হলো।মাত্র সাড়ে আটটা বাজে।আর এই মেয়ে রোগী দেখা শুরু করে দশটা থেকে।হসপিটালও কাছে। এত তাড়াতাড়ি গিয়ে এই মেয়ে করবে কি?
কৌতুহল না চাপাতে পেরে সে প্রশ্ন করলো,
-এত তাড়াতাড়ি যাচ্ছিস যে?তুই তো দশটা থেকে রোগী দেখিস।
রূপন্তী প্রথমে কিছু বলল না।খানিকবাদে গম্ভীর গলায় বলল,
– কিছু কাজ আছে। এজন্য আগে বের হচ্ছি।
– ও।
রূপন্তী সায়নের সামনে রাখা চাবিটা ইঙ্গিত করে বলল,
– দরজা ভালোমতো বন্ধ করে বের হইয়েন।
– আচ্ছা।
রূপন্তী চলে গেলো।সায়ন পানি খেতে গিয়ে কিছু একটা মনে পড়তেই বিষম খেলো।এই মেয়ের সকাল সকাল মাথা খারাপ হয়ে গেছে? একবার তুমি,আরেকবার আপনি,মানে কি!
তাহলে কি মেয়েটা সত্যিই ওর সাথে রাগ করেছে?
দোনা মোনা করতে করতে সে রেডি হলো।বের হয়ে দরজায় তালা মারার সময় ঠিক করলো রূপন্তীকে এসে একটা সরি বলে দেবে।
.
সায়নের হসপিটালটা পছন্দ হলো।কথা বার্তা শেষে ওর কেবিন দেখিয়ে দেওয়া হলো।আজকে রোগী নাই। থাকবে কেমনে সে তো নতুন!সারাদিন ফ্লোরের বাকি ডাক্তাররা এসে পরিচিত।এরমাঝে রীতিমতো এক মহিলা ডাক্তারের প্রেমে পড়ে গেলো। এত সুন্দর!সে প্রথম দেখায় মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলো।মহিলার নাম রিত্তিকা।খুবই সুন্দর করে কথা বলে।
কিন্তু রিত্তিকা ম্যারিড।তিন বছরের ফুটফুটে একটা ছেলে আছে।
সায়ন তখন নিজেই নিজেকে শাষালো।এক মুহুর্তের জন্য নিজের ব্যাক্তিত্বের কথা ভুলে গিয়েছিলো সে।আর যাই হোক ওয়ার্ক প্লেসে নিজেকে নিয়ে কোনো স্ক্যান্ডেল তৈরী করতে চায় না।
দুপুরের পর কিছু রোগী এলো।সায়নও শেষমেশ ব্যাস্ত হলো।
রাতে ফিরলো সাড়ে আটটার দিকে। রূপন্তী তখনো আসেনি।
সায়ন প্রথমেই রূপন্তীর বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে রইলো।তারপর হুট করে মনে পরলো তার আজ বিছানা কেনার কথা। এখন তো আর সময়ও নেই। নিজের মাথা চাপড়াতে ইচ্ছে করছে।আজও রূপন্তীর সাথে ঘুমাতে হবে?!
আর বসলো না।উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলো।গোসল করে বের হয়ে দেখলো মেঝেতে একটা নতুন ম্যাট্রেস, দুটো বালিশ আর একটা কম্ফোর্টার রাখ।বিছানায় রূপন্তীর ব্যাগ। তারমানে তারই কাজ এসব। সায়নের খারাপ লাগাটা আরো বেড়ে গেলো।রুম থেকে বের হয়ে দেখলো রূপন্তী কিচেনে।এগিয়ে কিছু বলবে তার আগেই রূপন্তী প্লেটে খাবার বেড়ে আনলো।সাথে বলল,
– আমি কালকে বাজার করবো।আজ বাহিরে থেকে খাবার নিয়ে এসেছি।তুই খাওয়া শুরু কর।আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।
সায়ন টেবিলে বসলো। রূপন্তী আসলে একসাথে খাবে তাই অপেক্ষা করার জন্য ফোন স্ক্রল করতে লাগলো।পনেরো মিনিটের মাঝে রূপন্তী চলে এলো।সায়নের মুখোমুখি চেয়ারটা টেনে বসলো।সায়ন আমতা আমতা করে কিছু বলবে তার আগেই তার ফোনে একটা কল আসলো।ফোনটা ধরতে ওপাশ থেকে একটা গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠ শুনতে পাওয়া গেলো,
– সায়ন চৌধুরী বলছেন?
– জ্বী!
– আমি গুলশান থানার ওসি বলছি।
সায়ন ভ্রু কুঁচকালো। অতঃপর উত্তর দিলো,
– জ্বী বলুন!
– আপনার নামে নারী নির্যাতনের উপর একটা কেস আছে। আপনার বউ আজ সকালে করে গিয়েছে। তবে বলেছে আপনাকে যাতে আগামীকাল এরেস্ট করা হয়।আপনি চাইলে কোনো লয়ার এপয়েন্ট করতে পারেন।
সায়ন কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেললো।মাথা উঁচু করে তাকাতেই চক্ষুগোচর হলো সম্মুখে বসে থাকা নারীর ঠোঁটের বাঁকা হাসি।অতঃপর চোখে চোখ পড়তেই রূপন্তী ডান চোখ টিপ মারলো।
#চলবে।