এই মন তোমাকে দিলাম পর্ব-৬+৭

0
177

#এই_মন_তোমাকে_দিলাম
#পর্ব-৬
#আরাদ্ধা_সাদাত_খান
রূপন্তীকে নিয়ে পুরো বাড়ি ঘুরে দেখালেন জয়া। সব শেষে বাগানে রাখা দোলনায় এসে বসলেন দুজন।শ্বাশুড়িকে রূপন্তীর খুব পছন্দ হয়েছে। পরে অবশ্য অন্য কোনো রূপ না দেখালেই হয়।
জয়া শেষমেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলার জন্য মুখ খুললেন। খুবই নরম গলায় বললেন,
– আমি, সীমন্তী দুজনই জব করি। আমি আমাদের নিজের অফিসেই বসি। সীমন্তীর একটা ব্র‍্যান্ড আছে। কসমেটিক্সের, কাপড় দুটোরই। সে সেখানে বসে।ওরাও ঢাকায় থাকে। কিন্তু রুহি হওয়ার পর থেকে এখানে থাকে।রুহি একটু বড় হলে আবার চলে যাবে। অতঃপর তোমার সংসারে তোমার ননাশের কোনো হস্তক্ষেপ থাকবে না। যদিও তোমার আর সায়নের ঢাকায়ই থাকতে হবে। তবুও এখানে থাকতে কোনো সমস্যা হবে না।
এতটুকু বলে থামলেন। রূপন্তীর দিকে তাকিয়ে দেখলেন মেয়েটা মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনছে। অতঃপর তিনি আবার বলতে শুরু করলেন,
– আর রইল আমার কথা?! আমি কিন্তু তোমাকে ছেলের বউ হিসেবে আনিনি, মেয়ে হিসাবে এনেছি। এই যে কিছুক্ষণ আগে তোমাকে জামা পড়া নিয়ে বললাম, তোমার মনে হতেই পারে আমি বেশ টিপিক্যাল।আসলে কিন্তু তা নয়। শুনো মা, তোমার বয়সে আমিও বেশ উড়নচণ্ডী ছিলাম। এই ধরো তখনকার দিনেই আমি ফতুয়া, শর্ট কামিজ পড়ে ঘুরে বেড়াতাম। তবে গায়ে সব সময় ওড়না থাকতো। কিন্তু তখনকার দিনে এসব পড়া মানে বুঝো? আমি বেশ সনামধন্য পরিবারের মেয়ে ছিলাম। আমার বাবা তখনকার দিনের বিখ্যাত ব্যবসায়ী ছিলেন। তোমার শ্বশুরের সাথে আমার বিয়ে হয় ২২ বছর বয়সে। আমার পরিবারের মানুষজনের চিন্তা ভাবনা বেশ আধুনিক ছিল তখন। না হয় সে সময় মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হতো ১৬-১৭ বছর বয়সে। কিন্তু আমাকে বাবা পড়াশোনা শেষ করানোর পর বিয়ে দিয়েছে। তোমার শ্বশুরের সাথে বিয়ে হওয়ার পর আমি অন্য একটা কোম্পানিতে জব করতাম।সে সারাদিন নিজের রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। আর তার বাবা তাকে নিয়ে চিল্লাতো নিজেদের পারিবারিক ব্যবসা সামলানোর জন্য। শেষমেশ তোমার শ্বশুর আমাকে কাজে লাগিয়ে দিলেন। ওনাদের পারিবারিক ব্যবসা আমি সামলাতে লাগলাম। বিয়ের চার বছরের মাথায় সীমন্তি হলো।তার ছয় বছর পর আবার সায়ন হলো। ততদিনে তোমার শশুরদের কোম্পানি আমি বহু দূরে গিয়ে নিয়েছি। এরপর থেকে তোমার শ্বশুর একটু হাত লাগানো শুরু করলো।বলতে গেলে কোম্পানি এখনো আমি চালাচ্ছি। সীমন্তী চাইলে এই কোম্পানির হাল ধরতে পারতো কিন্তু তার ইচ্ছা আবার অন্যরকম ছিল। আর সায়ন তো মেডিকেল পড়লো। যেটাই হোক,বিয়ের পর ব্যবসা করলেও কিন্তু আমি সংসারের হাল ছেড়ে দেইনি। সংসারও সুন্দর করে সামলেছি,স্বপ্নও পূরণ করেছি। বেস্ট উইমেন ইনফ্লুয়েন্সার বা বিজনেসউইমেন হিসেবে কিন্তু আমি এওয়ার্ডও পেয়েছি। এখন তুমি বলতে পারো তুমি এসব জেনে কি করবে। তোমার আর আমার তফাৎ কিসে জানো?আমাকে বিয়ে দেওয়ার আগে আমার মা খালারা সবাই সংসারের ব্যাপারে বাস্তব জ্ঞান দিয়েছিলেন। আমি আমার মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার আগে অনেক কিছু বুঝিয়ে পড়িয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু তোমাকে বুঝিয়ে পড়িয়ে দেওয়ার মত কেউ ছিলনা। মন খারাপ করো না। আমাকে যদি মা মেনে থাকো তাহলে ভরসা করতে পারো। আমি তোমাকে সব কিছু শিখিয়ে দেবো। এই যেমন আজকে তোমাকে সকাল বেলা জামা পড়া নিয়ে বললাম। ওয়েস্টার্ন পড়ো ভালো কথা,একটা কথা খালি মাথায় রেখো, আমরা মুসলিম। তাছাড়া দিনকাল ভালো না। জানোয়ারদের লোলুপ দৃষ্টি তো আছেই মেয়েদের উপর।তার উপর তোমার দিন রাতে এদিক সেদিক যেতে হয়।তোমাকে আমি অবশ্যই বাধ্য করবো না। তবে অনুরোধ করব এখন থেকে একটা করে ওড়না কিংবা স্কার্ফ রেখো। দেখো রূপ দেখিয়ে চলাফেরার মাঝে কোন বীরত্ব নেই। নারীর ভূষণ হলো লজ্জা। তুমি আস্তে আস্তে চেষ্টা করো। ধরো এখন একটু সালোয়ার-কামিজ পড়ার চেষ্টা করো।ওড়না বা স্কার্ফ পড়তে সমস্যা হলে চেষ্টা করো কোটি পড়ে থাকতে।আমার সীমন্তিটাও বিয়ের আগে বড্ড উড়নচন্ডী ছিলো।পরে বুঝালাম। সে বুঝলো।তবে ঘুরতে গেলে, বেড়াতে গেলে নিজের মতো করে সাজতে পারো।সায়নের সামনে যেভাবে ইচ্ছা থাকতে পারো।আর যাই হোক সে তোমার জন্য হালাল।তবে তোমার বাবার সামনে মেইনটেইন করবে।চেষ্টা করবে মাথায় ওড়না রাখতে।আর নামাজ পড়বে পাঁচ ওয়াক্ত।সায়নকেও পড়াবে। মনে রাখবে আমাদের মরণ নির্ধারিত।পরকালে আমদের পাপের শাস্তি হিসেবে থাকবে জাহান্নাম। ঢাকায় গিয়ে কিভাবে কি করবে বুঝিয়ে দেবো।এখন চলো নাস্তা করবে।

রূপন্তী এতক্ষন মন দিয়ে প্রতিটা কথা শুনলো।আসলেই সে বাইরের দেশের কালচার এডপ্ট করে নিয়েছে।ধর্ম-কর্ম তো জীবনেও করেনি। কিন্তু এখন করা উচিৎ।
জয়ার পিছুপিছু সেও বাড়ির ভেতরে ঢুকলো।ডাইনিং টেবিলে ইতিমধ্যে তারিফ সাহবে বসে পত্রিকা পড়ছেন। রূপন্তী এগিয়ে গিয়ে তাকে সালাম দিলো।তারিফ সাহেব হেসে সালামের উত্তর দিলেন।এরপর টুকটাক কথা বলতে লাগলেন।জয়া রূপন্তীর এই ব্যাবহারে খুশি হলেন।মেয়েটাকে একটু ঘষে মেজে নিলেই জ্বল জ্বল করবে। তাছাড়াও মেয়েটা ভালোবাসা পাওয়ার জন্য অস্থির।!
তারিফ সাহেবের সাথে কথা বলার মাঝেই সীমন্তী নামলো।কিন্তু নামার সাথে সাথে রায়ান আবার ডেকে বলল,
– সীমন্তী, রুহি কাঁদছে। আমি ওয়াশরুমে যাচ্ছি।
সীমন্তী আবার দৌড় মারলো উপরে।কিছুক্ষনের মাঝে আবার রুহিকে নিয়ে নেমে এলো।
রুহিকে দেখে রূপন্তী এগিয়ে গেলো সেদিকে।সীমন্তীকে হাসিমুখে বলল,
– গুড মর্নিং আপু!
সীমন্তীও হেসে উত্তর দিলো,
– গুড মর্নিং।
রূপনন্তী এবার আবদারের সুরে বলল,
– আমি ওকে একটু কোলে নেই?
– হ্যা হ্যা অবশ্যই! নাও।
বলে রূপন্তীর কোলে রূহিকে দিয়ে দিলো।রূপন্তী সাবধানে ওকে নিজের সাথে ধরলো। এরপর সীমন্তীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– ওর নাম কী?
– রুহি।
– কয় মাস চলে?
– চার শেষ করে পাঁচ মাসে পড়বে।
রূপন্তী এবার রুহির দিকে ভালো করে তাকালো।পিচ্চিটা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।কয়েক সেকেন্ড পর রূপন্তীর ঘোমটার নিচে থাকা চুল গুলো নিজের ছোট্ট মুঠিতে পুরলো। তারপর সেটা টান মেরে মুখের ভেতর নিয়ে মনের সুখে কামড়াতে লাগলো।এদিকে রূপন্তী চুলে ব্যাথা পাচ্ছে, তার চেয়েও বড় চিন্তা কোমল ত্বকটা চুলের ধারে যাতে কেটে না যায়।
সীমন্তী আর সে মিলে শেষমেশ বাচ্চাটার হাত থেকে চুল বের করলো।রূপন্তী পুতুলটাকে আর ভালোমতো নিজের সাথে মিশিয়ে গাল গাল মিলালো।এবার রুহি এগিয়ে আসলো গাল কামড়াতে। রূপন্তী এবার রুহিকে সরিয়ে এনে ওর দিকে তাকালো।ফোলা ফোলা গালটাতে চুমু খেয়ে বলল,
– তুমি তো অনেক দুষ্টু!
রুহির কোনো কারনে তার মামিকে পছন্দ হয়ে গেলো।মুখ দিয়ে আজগুবি আওয়াজ বের করতে লাগলো।নিজের সব কথার ঝুড়ি খুলে বসলো রূপন্তীর সামনে।
সীমনন্তী নিজেই নিজের মেয়ের কারবারে অবাক হয়ে গেলো।রুহি অচেনা কারো কোলে যেতে চায় না। কিন্তু মেয়েটা দুজনের ক্ষেত্রে এই অবাক কান্ড দেখালো। সায়ন আর রূপন্তী,এই দুজনের সাথে তার যত আ,উ বলা।
সে একটু স্বস্তি পেলো।রূপন্তীকে বলল,
– তুমি ওকে এখন থেকেই তোমাকে মামণি ডাকা শিখাবা।আর ও তোমাকে অনেক পছন্দ করেছে, এজন্য তোমার সাথে গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসেছে। তাহলে তুমি একটু ওকে রাখো? আমি মাকে একটু সাহায্য করি।
রূপন্তী তড়িঘড়ি করে বলল,
– আমিও আসি আপু।
সীমন্তী এগিয়ে রূপন্তীর গাল টিপে ধরলো।আফসোসের সুরে বলল,
– আমার খুব ইচ্ছে ছিলো একটা ছোট বোন হবে।কিন্তু সায়নটা কই থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসলো।শুনো এখন থেকে আমি আর তুমি ওকে মিলিয়ে জ্বালাবো।
দুজনই হেসে উঠলো।সীমন্তী হাসির মাঝে গলার স্বর একটু গভীর করে বলল,
– তবে সায়নও আমার জীবনে ব্লেসিং ছিলো।দুজনে মারামারি কাটাকাটি সব করতাম।আমার মন খারাপ হলে ও এসে সেটা ভালো করতো।তার যত আবদার সব আমার কাছে। এখন দেখো, তার মাধ্যমেই আমি রেডিমেড একটা বোন পেয়ে গেলাম।শুনো তুমি আর আমি এখন একই দলে।সায়ন আর সায়নের দুলাভাই কি করবে সেটা ওদের ব্যাপার।আর তোমার কোনো আবদার থাকলে আমার কাছে বলবা।
তারপর রূপন্তীর হাত ধরে আস্তে করে বলল,
– সায়ন কিংবা আমাদের পরিবারের কোনো কিছু খারাপ লাগলে আমাকে বলবে। কখনো মাকে কিছু বলতে যাবে না।
রূপন্তী বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়লো।সীমন্তী ও রান্নাঘরের দিকে আগালো। রূপন্তীও রূহির সাথে কথা বলতে বলতে সোফায় বসলো।
#চলবে।

#এই_মন_তোমাকে_দিলাম
#পর্ব-৭
#আরাদ্ধা_সাদাত_খান
রুহির সাথে বসে বসে খেলার মাঝেই রায়ান নামলো।একেবারে রেডি হয়ে নেমেছে।বাচ্চাটা নিজের বাবাকে দেখে হুট করে পল্টি খেলো।রূপন্তীর কোলে ছটফট করতে লাগলো যেনো তার কোল থেকে ছুট পাওয়ার ইচ্ছা। মেয়েকে দেখে রায়ানও সেদিকে এগিয়ে গেলো।সাথে সাথে রুহি হাত বাড়িয়ে দিলো।রায়ানও মেয়েকে হাত বাড়িয়ে কোলে নিয়ে গালে পরপর কয়েকটা চুমু খেলো।তারপর রূপন্তীর পাশেই বসে পড়লো এবং টুকটাক কথা বার্তা বলতে লাগলো।
রায়ান হাসিখুশি মিশুক একটা মানুষ। রূপন্তীর প্রথমদিকে অস্বস্তি লাগলেও কথা বলতে বলতে ফ্রি হয়ে গেলো।এর মাঝেই রুহি কোল বদল করে আবার নিজের মামণির কাছে এসেছে। সে আপাতত রূপন্তীর বুকে শরীর এলিয়ে নিজের অসমাপ্ত মিশন শেষ করতে চাচ্ছে। সেটা হলো নিজের হাত দুটো মুখে পুড়ে গিলে ফেলা।বাচ্চাটা জানে না এই কাজটা যে অসম্ভব।
রায়ানের সাথে রূপন্তী অস্ট্রেলিয়ায় কোথায় ছিলো, কি কি ডিগ্রী নিয়েছে, সামনে কি ইচ্ছে এসব নিয়ে বলছিলো।এর মাঝেই জয়া ডাক দিলেন সবাইকে নাস্তা করার জন্য। রূপন্তীকে বললেন সায়নকে ডেকে নিয়ে আসার জন্য। রূপন্তী অনিচ্ছা থাকা স্বত্তেও বাধ্য মেয়ের মতো সায়নকে ডাকতে গেলো।
রুমে এসে দেখলো সায়ন উলটে পড়ে আরামে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। কোনো একটা কারনে তার সেটা সহ্য হলো না।তাই সে বাথরুমে গিয়ে এক মগ পানি নিয়ে আসলো।তারপর সেই পানি ঝপ করে সায়নের মুখে মারলো।
সায়ন ধড়ফডিয়ে উঠে বসলো।রূপন্তীর দিকে তাকাতেই আসল কাহিনী বুঝতে পারলো।বিছানা, বালিশ সব ভিজে গিয়েছে। মেজাজ গরম হয়ে গেলো।বিছানা থেকে নেমে ক্ষীপ্ত গতিতে রূপন্তীর দিকে তেড়ে গেলো।থাপ্পড় মারতে গিয়েও মারলো না।এমনেও গত রাতে যথেষ্ট মারমারি করেছে দুজন।কিন্তু তখন সবাই ঘুমে ছিলো।এখন মারামারি করা মানে সকলকে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে জানিয়ে দেওয়া।তাছাড়া মেয়েটা তার যতই জানের শত্রু হোক না কেন, সম্পর্কে তার বউ।একটা পবিত্র সম্পর্ক বিরাজ করছে তাদের মাঝে। নিজেরা না মানলেও সম্পর্কের পবিত্রতা টাকে তারা অপমান করতে পারে না।
অতঃপর হাত নামিয়ে খ্যাক করে চিল্লিয়ে উঠলো,
– সমস্যা কি তোর?আমার সাথে না লাগলে তোর হয় না?।
রূপন্তী দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দিলো,
– না হয় না।আমার জীবনটাকে হারাম করে নিজে আরাম করে ঘুমোচ্ছিস।সেটা আমার সহ্য হবে কিভাবে?
সায়ন হতবুদ্ধিকরের মতো জিজ্ঞেস করলো,
– আমি তোর জীবন হারাম করেছি?
পরমুহূর্তেই নিজে রেগে জিজ্ঞেস করলো,
– আমি হারাম করেছি নাকি তুই আমার জীবন হারাম করেছিস?
রূপন্তী আরো দ্বিগুণ রেগে বলল,
– তুই ই করেছিস।কোন বেকুবের বাচ্চা মেয়ের ব্যাপারে খোঁজ খবর না নিয়ে তাকে বিয়ে করতে যায়?
-কোন মেয়ে তার হবু জামাইর ব্যাপারে খবর না নিয়ে বিয়ে করতে যায়?
– আমি বাধ্য ছিলাম সায়ন।আমার বাপ মা বিয়েটা ঠিক করেনি যে তাঁদের মুখের উপর কথা বলবো।বিয়েটা অন্য কেও ঠিক করেছে যার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।কিন্তু সে যে আমার জীবনের চরম ক্ষতিটা করেছে সেটা সে নিজেও জানে না।
সায়ন এবার আরো জোরে বলল,
– আমিও বাধ্য ছিলাম।আমার পরিবার বরাবরই আমার জন্য ভালো সব কিছু বেছে নিয়েছে।সে হিসেবে আমি ভেবেছি আমার জীবনসঙ্গীও তারা দেখে শুনে ঠিক করেছে।তাছাড়া আমি আমার বাবাকে প্রচন্ড সম্মান করি এবং ভালোবাসি।তার মুখের উপর কথা বলার কোনো কারন আমি দেখি নাই।

রূপন্তী এবার দমে গেলো।পরিবারের প্রতি অনুভূতিটা তার জানা নেই। থাকলে হয়তবা সে বুঝতো। তাই আর কিছু না বলে থমথমে গলায় বলল,
– মা ডেকে পাঠিয়েছে। নাস্তা করার জন্য।
সায়ন ওয়াশরুমের দিকে হাটতে হাটতে বিরক্তিকর সুরে বলে উঠলো,
– নগদে সকালবেলাই মেজাজ খারাপ করে দিলি।না জানি সামনে আরো কিভাবে আমাকে জ্বালাবি। আমার পরিবার আমার ভালো করার জন্য যে আমার শত্রুকে তুলে এনে দিয়েছে সেটা জানলে তোকে এখনই বের করে দিবে।অসহ্যকর একটা!

রূপন্তী পেছন থেকে শ্রাগ করে উঠলো,
– শাট আপ বি*চ।
বিনিময়ে সায়ন ধাম করে দরজাটা লাগিয়ে দিলো।সাথে নিজেও শ্রাগ করে বলল,
– ইয়্যু টু বি*চ।

রূপন্তীর রাগে মাথাটা জ্বলছে।সায়নের জন্য কবে জানি রাগে তার শরীর জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এই ছেলের সাথে ঢাকায় একা থাকবে হবে?সে সিউর খুব শীঘ্রই তাকে জেলের ঘানি টানতে হবে।তার একমাত্র অপরাধ,”সে নিজের জামাইকে থাপড়াতে থাপড়াতে মেরে ফেলেছে।”
রুম থেকে বের হয়ে সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে বিড়বিড় করে বলল,
“সায়ইন্নার বাচ্চা,একমাত্র আল্লাহ পারবে তোকে আমার হাত থেকে বাঁচাতে।বেশি করে খোদা কে ডাক। ”
.
সকলে একসাথে ডাইনিং টেবিলে বসলো। সায়নও এসে বসলো। তখনই হুট করে রূপন্তীর আরাদ্ধাদের কথা মনে পড়ল। সে জয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
– আরাদ্ধারা কোথায় মা?
জয়া উত্তর দিলেন,
– ওহ!ওরা তো ফজরের নামাজের পরই চলে গেছে। আরাদ্ধাকে হসপিটালে যেতে হবে। রিয়ানেরও আজকে ভার্সিটিতে যেতে হবে।
রুপন্তীর মনটা হুট করেই খারাপ হয়ে গেল। আরাদ্ধার সাথে আর কথা বলা হলো না!
নাস্তা খাওয়ার মাঝেই হুট করে তারিফ সাহেব রুপন্তীকে জিজ্ঞেস করলেন,
– মা, তুমি কি ঢাকার কোনো হসপিটালে জব করো?
রুপন্তী বিনয়ের সাথে উত্তর দিল,
-জি বাবা। ঢাকার গুলশানের একটি প্রাইভেট হসপিটাল জব করি। ইচ্ছে আছে সামনে চেম্বার করার।
অতঃপর তারিফ সাহেব এবার সায়নের দিকে তাকালেন। ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন,
-তোর ও তো তেজগাঁওর একটা হসপিটালে জব হয়েছে।
সায়ন মাথা নাড়লো।তারিফ সাহেব আবার রূপন্তীকে জিজ্ঞেস করলেন,
– তুমি এই কয়দিন কোথায় থাকতে?
– আমি চার মাস আগে একবার দেশে এসেছিলাম। তখনই গুলশানের একটি অ্যাপার্টমেন্টে ফ্ল্যাট বুকিং দিয়ে রেখেছিলাম। এবার এসে বাকি টাকা শোধ করে ফ্ল্যাট উঠে গিয়েছি।এতদিন আমি নিজের ফ্ল্যাট থেকেই হসপিটালে আসা যাওয়া করি।
তারিফ সাহবে এবার ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-বাহ! তাহলে তো আর সমস্যা নেই। রূপন্তীর ফ্ল্যাটেই থাকতে পারবি তোরা। আলাদা কোন বাসার দরকার নেই আর।
এরপর ছেলের উদ্দেশ্যে ঠাট্টা করে বললেন,
– নাকি বউয়ের ফ্ল্যাটে থাকতে তোর মান ইজ্জতে লাগবে?

টেবিলের উপস্থিত সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।সায়নের মেজাজ খিচে এলো। প্রথমত রূপন্তীর এত ভালো ভদ্র ব্যবহার তার সহ্য হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত তার পরিবারের সকলে রূপন্তীকে নিয়ে অনেক আদিখ্যেতা করছে। এই বেয়াদব মেয়েটার প্রতি এত ভাল ব্যবহার তার সহ্য হচ্ছে না।
তবুও নিজেকে শান্ত করে সে বলল,
– না, সমস্যা হবে না।
তারিফ সাহেব এবার দুজনকেই জিজ্ঞেস করলেন,
-তাহলে তোমাদের ঢাকা যেতে হবে কবে?
দুজনেই একসাথে উত্তর দিল,
– আজ বিকেলেই চলে গেলে ভালো হয়।
রূপন্তী বলল,
– নতুন নতুন চাকরি করছি। এর মাঝে যদি প্রথমেই এত ছুটি নিয়ে নিই তাহলে সেটা পরে সমস্যা হয়ে যাবে।
সায়ন ও বলল,
-আমার আগামীকালকে জয়েনিং ডে।
তারিফ সাহেব আর কিছু বললেন না। এবার জয়া ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-তাহলে সব গুছিয়ে নে।আমি কয়েকদিন পর আসবো। এসে তোদের গোছ গাছ করতে সাহায্য করবোনে।কাল-পরশু অফিসে দুটো ইম্পরট্যান্ট মিটিং আছে। না হয় আজ যেতাম।
অতঃপর সকলে নাস্তা সেড়ে নিজেদের কাজে চলে গেলো।রায়ান দুজনের কাছ থেকেই বিদায় নিয়ে গেলো।সায়ন গেলো নিজের গোছগাছ করতে।যদিও আগে থেকেই গোছানো। তবুও কিছু জরুরী জিনিসপত্র নেওয়া বাকি।
জয়া রূপন্তীকে নিয়ে আবার বসলেন বিভিন্ন সাংসারিক জ্ঞান দিতে।সায়নের ব্যাপারে অনেক কিছু জানালেন।

অতঃপর সবার কাছে বিদায় নিয়ে বিকেল সাড়ে চারটায় এই নতুন দম্পত্তি রওয়ানা হলো নতুন এক জীবনের উদ্দ্যেশে।যেখানে সায়নের জন্য শুধু রূপন্তী আছে এবং রূপন্তীর জন্য সায়ন।
নিজেদের মাঝের এই পবিত্র সম্পর্কটাকে তারা মেনে এগিয়ে যেতে পারবে?নাকি রূপন্তীর ভাবনা মতো একজন আরেকজনকে থাপড়াতে থাপড়াতে মেরে ফেলবে?!
#চলবে।