এই মন তোমারি পর্ব-০৬

0
171

#এই_মন_তোমারি

#পর্ব_৬

#লেখনীতে_নুজাইফা_নূন

-” সূরা কে নিচে বসে খেতে দেখে মাজেদা এগিয়ে এসে বললো , এমা নতুন ব‌উ তুমি চেয়ার টেবিল ছেড়ে নিচে বসে খাচ্ছো ক্যান? টেবিল চেয়ারে বসে বুঝি খেতে পারো না?”

-” হ্যাঁ।আসলে আমি তো কখনো টেবিল চেয়ারে বসে খাই নি। আমি খেতাম মাটি তে বসে। মনিরুল কাকা যখন বাড়িতে থাকতো তখন সবাই একসাথে বসে খেতাম। কিন্তু কাকা যখন কাজের জন্য শহরে আসতো তখন চাচি আমাকে ঠিক মতো খেতে দিতো না।সবার খাওয়া শেষ হলে যদি অবশিষ্ট কোনো খাবার থাকতো সেটুকু দিতো আমাকে। অথচ তার ছেলে মেয়ে খাবার খেতে না পেরে নষ্ট করতো।একদিন তো পেটের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে বাসন মাজতে গিয়ে মলি আপা আর সুজন ভাইয়ের ফেলে দেওয়া খাবার খাইছিলাম বলে চোখের পানি মুছতে লাগলো সূরা।”

-” তোমার কি আর একটু পরোটা লাগবে ব‌উ? আমি কি এনে দিবো?”

-” না খালা। এটুকু খেলেই আমার পেট ফুলে কাঁঠাল হয়ে যাবে।মনে হবে আমি যেন সাত মাসের পোয়াতি।হা হা হা হা।”

-” সূরার কথা শুনে হেসে উঠলো মাজেদা। পরক্ষণেই তিনি বললেন, দেখ মা তুমি এখন এ বাড়ির ব‌উ।এ বাড়ির নিয়মকানুন আচার আচরণ শিখতে হবে তোমাকে।তোমাকে শাফি বাজানের যোগ্য হয়ে উঠতে হবে।টেবিল চেয়ারে বসে খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে।”

-” আমি তো টেবিলে খেতে চাইছিলাম খালা। কিন্তু আমি আমি সকালে শুনেছি আমার শ্বশুর আমাকে পছন্দ করেন না। আমার জন্য তিনি ভালো মার সাথে ঝগড়া করেছেন। এখন তিনি যদি আমাকে টেবিলে খেতে দেখে নিজে না খেয়ে চলে যান ।তাইতো আমি টেবিল থেকে চলে আসলাম।”

-” বাহ্ তুমি তো খুব বুদ্ধিমতি নতুন ব‌উ। কিন্তু এইভাবে শ্বশুরের থেকে আড়ালে আড়ালে থাকলে তার মন জয় করতে পারবে না নতুন ব‌উ।তোমাকে তোমার শ্বশুরের মন জয় করতে হবে।”

-” আমি পারবো না খালা।উনাকে দেখে আমার ভয় করে। মনে হয় যেন উনি কোনো মানুষ না , আস্ত একটা দৈত্য।”

-” এটা অবশ্য তুমি ঠিক বলেছো নতুন ব‌উ বলেই হো হো করে হেসে উঠলো মাজেদা আর সূরা।”

-” দূর থেকে সূরা আর মাজেদা কে হাসাহাসি করতে দেখে শফিকুল দেওয়ান বললো, খুব তো বড়ো মুখ করে বলেছিলে এই গাইয়া মেয়েকে তুমি শাফির যোগ্য করে তুলবে? কিন্তু তুমি বোধহয় জানো না কু’কু’রে’র পেটে কখনো ঘি হজম হয় না।দেখ কিভাবে চেয়ার টেবিল ছেড়ে নিচে বসে রাজহাঁসের মতো খাবার গপগপ করে খাবার গিলছে।যেন এমন খাবার জীবনেও চোখে দেখে নি ।ঐ মেয়েটা এই বাড়ির কাজের মেয়ে হ‌ওয়ার ও যোগ্যতা রাখে না।আমি তোমাকে আবারো বলছি নাজমা , আশেপাশের লোকজন জানার আগেই তুমি মেয়েটাকে যেখান থেকে নিয়ে এসেছিলে সেখানে রেখে এসো।মেয়েটা আমাদের মানসম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিবে।”

-” তুমি কি চায়ছো আমি এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই? বুঝতে পারছি না একটা অসহায়, এতিম মেয়েকে নিয়ে তোমার এতো সমস্যা কিসের? মেয়েটার এতো মায়াবী চেহারা। দেখলেই কেমন যেন মায়া লাগে। বুকে জড়িয়ে নিতে ইচ্ছে হয়। কথায় কথা‌ বাড়ে। তবুও এই কথা টা আমি না বলে থাকতে পারছি না শফিকুল। ভুলে যেও না তুমি ও একজন এতিম ছিলে।কাকা কাকি রোড এক্সিডেন্টে মা’রা যাওয়ার পর আমার বাবা তোমাকে আদর স্নেহ দিয়ে বড় করেছেন। পড়ালেখা শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করে তুলেছেন। তবেই না তুমি আজ শহরের একজন নামকরা বিজনেস ম্যান হতে পেরেছো ।ক‌ই আমি বা আমার পরিবার কখনো তোমার সাথে এমন আচরণ করি নি।তোমাকে এতিম বলে ছুড়ে ফেলে দেই নি। একবার সূরার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে দেখো শফিকুল।আমরা যদি তখন তোমাকে ছুড়ে ফেলে দিতাম আজ তুমি ও সূরার মতো অশিক্ষিত, গেঁয়ো , আনস্মার্ট হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে।”

-” তুমি আমাকে খোঁটা দিচ্ছো নাজমা?”

-” খোঁটা নয় শফিকুল। আমি তোমাকে তোমার পরিস্থিতির কথা বুঝাতে চাইছি। পরিস্থিতি মানুষ কে কখন কোথায় নিয়ে যায় এটা কেউ বলতে পারে না।সূরার পরিচয় নিয়ে তোমার সমস্যা তাই তো? ঠিক আছে আমি যতোদিন না পর্যন্ত সূরা কে এই বাড়ির উপযুক্ত ব‌উ হিসেবে গড়ে তুলতে না পারছি ততোদিন কেউ সূরার আসল পরিচয় জানবে না। সবাই এটাই জানবে যে সূরা আমার বোনের মেয়ে।”

___________________________________

-” শাফায়াত নাস্তা শেষ করে অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিল এমন সময় সূরা এসে বললো, এ পুলিশ পুলিশ । তুই কি আমার উপর রাগ করছিস , থুক্কু রাগ করছেন?আমি আপনার শার্টে নাকের পানি মুছছি তাই? আমি আপনার শার্ট একদম পরিষ্কার করে ধুয়ে দিবো। তবুও তুই আমার উপর রাগ করে থাকিস না।”

-” তুমি যে কাজ করেছো তাতে তোমার উপর রাগ করবো না তো কি করবো? তোমাকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াবো?”

-” সূরা খুশি হয়ে তার দুই হাত উঁচু করে দিয়ে বললো, সত্যি কোলে নিবি পুলিশ?নে না?”

-” শাফায়াত সূরার কথায় বিরক্ত হয়ে তার হাতে থাকা চিরুনি নিচে ছুড়ে ফেলে দিয়ে সূরার দুই বাহু চেপে ধরে বললো, তুমি আবারো এসেছো ঘ্যান ঘ্যান প্যান প্যান করতে? তোমার জন্য যে আমাদের সুখের সংসারে অশান্তির সৃষ্টি হয়েছে এটা কি তুমি বুঝতে পারছো না? শুধু মাত্র আম্মি আর বাবার মধ্যে তোমার জন্য দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের সংসার টা শেষ হতে চলেছে।”

-” শাফায়াত সূরার বাহু এমন ভাবে চেপে ধরেছে যে ব্যাথায় চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে সূরা।সূরার চোখে পানি দেখে শাফায়াত তৎক্ষণাৎ সূরার বাহু ছেড়ে দিয়ে বললো, তোকে যেন আর কখনো আমার চোখের সামনে না দেখি। তাহলে কিন্তু একদম খু’ন করে ফেলবো তোকে বলে শাফায়াত বেরিয়ে গেল। শাফায়াতের যাওয়ার পানে তাকিয়ে সূরা ধপ করে নিচে বসে পড়ে বললো, সত্যিই তো আমার জন্য তাদের সংসারে অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে। আমি আসলে একটা অপয়া, অলক্ষী।বাপ মা যে কেন আমাকে একা রেখে চলে গেল? আমি কি করবো এখন? কোথায় যাবো? কাকার সংসারে থাকাকালীন আমি তাদের সংসারে অশান্তির কারণ ছিলাম।আর এখন এই সংসারের অশান্তির কারণ হয়ে গেছি। অতঃপর সূরা চোখের পানি মুছে বললো, না না আমি কারো অশান্তির কারণ হতে চাই না। আমি চাই আমার পুলিশ বর ,ভালো শ্বাশুড়ি, দৈত্য শ্বশুর সবাই ভালো থাকুক বলে সূরা নিচে এসে দেখলো দরজা খোলা রয়েছে অথচ নিচে কেউ নেই।সবাই হয়তো যার যার রুমে রয়েছে। সূরা কোনো কিছু না ভেবে তৎক্ষণাৎ বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো।সে জানে না তার গন্তব্যে কোথায়? সে হাঁটতে হাঁটতে শহরের মধ্যে চলে আসে। শহরে এতো গাড়ি দেখে সূরার হাত পা কাঁপতে থাকে। সকাল সকাল সাধারণত যানজট সমস্যার সৃষ্টি হয়। সবাই তাড়ায় আছে তাদের নিজেদের গন্তব্যে সময় মতো পৌঁছানোর জন্য।সূরার দিকে কারো কোনো খেয়াল নেই।সে বুঝতে পারছে না কোন দিক থেকে কোন দিকে যাবে। হঠাৎ সূরার খেয়াল হয় শাফায়াত রাস্তার অপর প্রান্তে পুলিশের ইউনিফর্ম পরে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে কারো সাথে কথা বলছে।যা দেখে সূরার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে। মূহুর্তের মধ্যে সূরা ভুলে যায় তার পুলিশ বরের করা অপমানের কথা।সে কোনোদিকে না তাকিয়ে এ পুলিশ বলে দৌড়ে তার পুলিশ বরের কাছে যেতে যায় কিন্তু তার আগেই একটা গাড়ি এসে ধাক্কা দিয়ে সূরা কে ফেলে দেয়। মূহুর্তের মধ্যে সূরার কোমল র’ক্তা’ক্ত দেহ নিচে পড়ে যায়।

চলবে ইনশাআল্লাহ।।