একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব-২৫+২৬

0
359

#একটি_নির্জন_প্রহর_চাই
২৫
#WriterঃMousumi_Akter.

আমি “শ্যামসুন্দর” কথাটা বলতেই উনি আশ্চর্যান্বিত হয়ে তাকালেন আমার দিকে।উনার চোখে মুখে কেমন স্নিগ্ধ আভা ছড়িয়ে পড়েছে।ওষ্ঠ জুড়ে কিঞ্চিৎ হাসির রেখা ফুটে উঠেছে।যেটা উনি আমার থেকে আড়াল করার ব্যর্থ প্রয়াস চালাচ্ছেন।কিন্তু আমার অভিজ্ঞ দৃষ্টি থেকে তা আড়াল করতে পারলেন না।আমাকে উনার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বোধহয় কিছুটা লজ্জা পাচ্ছেন।নিজেকে ধাতস্থ করতে হাতের বৃদ্ধ আঙুল দিয়ে কপাল চুলকে বললেন,

‘আমি শ্যামসুন্দর?’

ডিরেক্ট প্রশ্ন ছুঁড়লেন আমার দিকে।আমিও প্রশ্নের পিঠে উল্টো প্রশ্ন করলাম,

‘তাহলে কী আপনি?’

মুচকি হেসে জবাব দিলেন,

‘কালো ছেলেদের জন্য সান্ত্বনা মূলক বানী।তবে তোমার মুখে ভালোই লাগল শুনতে।জীবনে প্রথম কেউ মিথ্যা প্রশংসা করল আর আমার কানে শ্রুতিমধুর লাগল।কী অদ্ভুত তাইনা?আমিও কারো মিথ্যা প্রশংসায় ফেঁসে গেলাম!’

আমি হেসে প্রশ্ন করলাম,

‘ফাঁসলেন?’

আমার হাসি দেখে বললেন,

‘হাসছো!সে ফাঁসে সেই জানে!’
‘কিন্তু ওটা মিথ্যা প্রশংসা নয় স্যার;সত্য ছিল।আর আপনাকে নিয়ে মিথ্যা প্রশংসা করার মতো ক্ষমতা আমার নেই।’

এরই মাঝে দাদু দরজায় এসে বললেন, ‘আসবো?’
রোশান স্যার উঠে গিয়ে দাদুর হাত ধরে রুমে নিয়ে এলেন।দাদুর চোখে পানি।সে অঝরে কেঁদে যাচ্ছে।কাঁন্নায় ভেঙে পড়েছেন।উনি দাদুকে জড়িয়ে ধরে বোঝাচ্ছেন কাঁন্না না করতে।কিন্তু দাদু নিজেকে সামলাতে পারছেন না।শুধু বলছেন,

‘তরী এখন কোথায় যাবে?কী হবে তরীর!তরীকে ছাড়া কীভাবে থাকব আমি!আমাকে কে দেখবে”কে আমার ওষুধ দিবে!পায়ের নখ কে** টে দিবে,আমাকে গোসলের পানি দিবে,পান বেটে দিবে!এই সংসার টা একা হাতে সামলে রাখতো তরী।এ বাড়ির কেউ কোনকিছুর অভাব বুঝতে পারেনি।যার যা লেগেছে শুধু হুকুম করেছে,তরী সেটা হাজির করেছে।ও চলে গেলে এ সংসার আর সংসার থাকবে না!হাহাকার করবে সব কিছু!ওশান কী ভুল করল জীবনে!হীরা চিনতে পারল না!
দাদুর দিকে তাকিয়ে বললাম,

‘কেনো তরী কোথায় যাবে?এ বাড়িতেই থাকবে।আমার কাছে থাকবে তরী।’

দাদু বললেন,

‘তালাক এর পরে স্বামীর মুখ দেখা যায় না।তাই আর তরী চাইলেও এ বাড়িতে থাকতে পারবে না ।তরীও যেন হঠাৎ শক্ত হয়ে গিয়েছে। এক কাপড়ে বসে আছে এখনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে।এক সেকেন্ড ও আর থাকবেনা।মেয়েটা কাঁদছেও না।কেমন চুপচাপ হয়ে গিয়েছে।আমি বলে আসলাম কোথায় যাবি একটু অপেক্ষা কর।’

‘মুখের তালাক তো কুসংস্কার দাদু।এখনো তো আইনিভাবে ডিভোর্স হয়নি।তার জন্য তো তিনমাস সময় লাগবে।’

‘আমাদের মুসলিম ধর্মে তিন তালাক উচ্চারণ করলেই তালাক হয়ে যায়। রেগে, মজা করে,ভুল করে যেভাবেই বলুক না কেনো। তাছাড়া ওশান মন থেকেই তালাক দিয়েছে।’

রোশান স্যার বললেন,

‘দাদু তুমি ভেঙে পড়োনা।আমি আছিতো তরীর একটা ব্যবস্থা আমি করব।তরী আমার বোন হয়।আমি বোনের নজরে দেখি।আমি তরীর সাথে কোনো অন্যায় হতে দিব না।’
‘কী করবি? কোথায় রাখবি?ওর বোনদের ও তো অবস্থা তেমন ভাল নয়।ও গেলে তারা আবার বোঝা না ভাবে।তোর ফুফুর বাড়িতে রাখবি আপাতত।’

দাদুর কাঁধে হাত রেখে বললাম,

‘না তরীকে কারো সহানূভুতি নিয়ে বাঁচতে হবেনা।তরী এখন থেকে বাঁচবে নিজের প্রচেষ্টায়।কারো দয়ায় নয়।কারো কাছে রাখব দু’দিন পরে সে বিরক্ত হবে।কাজের বেটি টাইপ ব্যবহার করবে।কাজের হুকুম করবে।এই মুহুর্তে তরীকে যেখানেই রাখব সেই বোঝা মনে করবে।অনেক হয়েছে একটু খাওয়া পরার জন্য মানুষের অনুগত্য স্বীকার করা।’

রোশান স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘তাহলে কী করবে এখন?’

‘একটা জিনিস চাইলে দিবেন আমাকে?’

‘কী চাও?’

তরীকে একটা সুন্দর জীবন দিতে;যা করতে হয় করব।যতদূর যেতে হয় আমি যাব।এই জীবনে তো কোনো ভাল কাজ করার সুযোগ পাইনি আমি,এই একটা কাজ অন্তত আমি করতে চাই।আমাকে একটু সাহায্য করবেন আপনি?’

‘এই তোমার চাওয়া?’

‘হ্যাঁ। ‘

‘পৃথিবীর সমস্ত কাজে,তোমার যে কোনো সিদ্ধান্তে আমাকে পাশে পাবে।ডোন্ট ওরি।’

‘আমার বন্ধবীরা মেসে থাকে।মেস টা অনেক সেফ।আর ওটা আমার এক মামার।ওখানে চারদিক সিসি ক্যামেরায় নিয়ন্ত্রিত।আপাতত তরীকে ওখানেই রাখি।ওকে উন্মুক্ত তে ভর্তি করিয়ে দিব।তরীর অনেক গুন আছে।আমি ওর হাতের কাজ দেখেছি।এইজন্য ফোন কিনে দিয়েছি। টিউটোরিয়াল দেখে সাহায্য নিতে।ও রান্না সেলাই হাতের কাজ সব পারে।টিউটোরিয়াল এর সাহায্য নিয়ে তরী হলুদের গহনা বানাতে পারবে।এটা ও এমনিতেও ভাল পারে।পাশাপাশি একটা ট্রেনিং সেন্টারে ভর্তি করিয়ে দিব।সেখান থেকে ট্রেনিং নিবে।আমার ফ্রেন্ড মৃন্ময়ের বাবার গায়ে হলুদের গহনার বিজনেস আছে।মৃন্ময়কে বলব তরীর গহনা ওদের দোকানে পাইকারি রেটে নিতে।আমার বিশ্বাস তরী লেখাপড়ার পাশাপাশি নিজের একটা বিজনেস দাঁড় করাতে পারবে।পৃথিবীতে মানুষ চাইলেই সব পারে।শুধু চেষ্টার দরকার।’

দাদু বললেন,

‘সেতো ভালোই খরচ।কে দিবে এত টাকা।’

‘কেনো? আপনার বড় পোতা দিবে।আমি ধার হিসাবে নিয়ে রাখছি ফিউচারে শোধ করে দিবো।’

উনি হাসলেন আর বললেন,

‘আচ্ছা তোমার বান্ধবীদের সাথে কথা বলো।’

এক মিনিট অপেক্ষা করুন।

আমি ফোন নিয়ে মৃন্ময়ের নাম্বার ডায়াল করলাম।ফোনের ওপাশ থেকে মৃন্ময় বলল,

‘বিবাহিত মহিলা বল।’

‘তন্ময়ের কী খবর?’

‘শা**লা সুস্থ হয়েছে।যে প্যারা টা দিল।কাল মেসে আসবে।’

‘ওহ! শোন’

‘বল।’

‘তোর বোন না মেসে থাকে?’

‘হু’

‘মেসে একটা মেয়েকে রাখব।তুই একটু তোর বোনকে সাথে নিয়ে আয়।মেয়েটাকে নিয়ে যা।মেস মালিকের সাথে আমি কথা বলে নেব।’

‘সিঙ্গেল নাকি মেয়েটা?’

‘না বিবাহিত, বাচ্চা আছে।’

‘হৃদয় টা ভেঙে দিলি।’

‘তুই দ্রুত আয়।’

‘এ্যাহ! আইছেন আমারে হুকুম করতে।একজনের জন্য সারাদিন হসপিটালে দৌড়েছি, ক্লান্ত আমি!আমি কোনো মেয়ে টেয়ে আনতে যেতে পারব না এখন।ফোন রাখ।তাও আবার বিবাহিত মেয়ে।দেখা গেল ওর বাচ্চা আমারে বাপ ডেকে বসল।এমনিতে কোনো মেয়ে পাত্তা দেয়না।তাতে যদি আবার কেউ বাপ ডাকে। আমার আর বিয়ে হবেনা।’

‘এই মেয়ে যে সে মেয়ে নয়।সব সময় ফান করিস!এটা ছোঁয়ার প্রেমিকের বউ।মানে ওশানের ওয়াইফ,আমার জা।আজ ওদের মুখে মুখে তালাক হয়েছে।কিছুদিন পরে ডিভোর্স হবে আইনি ভাবে।ওর পৃথিবীতে কেউ নেই মৃন্ময়।প্লিজ আয় না।’

‘তোর ওই লুইচ্চা দেবর দুই দুইটা মেয়ে পেল কীভাবে?অথচ তন্ময়, আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভদ্র ছেলে হয়েও একটা মেয়ে পাইনা।’

‘পাবি কীভাবে?জীবনে ভাল কাজ করেছিস।এই একটা ভাল কাজ কর!মেয়ে পেয়ে যাবি। আমিন।’

‘আসতেছি আমি।’

জ্বরের তাপে পুড়ে যাচ্ছি তবুও কষ্ট করে বাইরে গেলাম।তরী বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।রোহান তরীকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে।সে তার মায়ের সাথে যাবে।শাশুড়ি রোহানের হাত ধরে টানছে।কিন্তু রোহান কিছুতেই ওর মায়ের কোমর ছাড়ছেনা।তরী অশ্রুসিক্ত চোখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে শাশুড়ির দিকে।নিশ্চয়ই এই হৃদয়হীন মহিলার ব্যবহারে অবাক হচ্ছে।কীভাবে একটা সন্তানের থেকে তার মা’কে আলাদা করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে!কীভাবে এতদিন এই সংসারের জন্য করে আসা পরিশ্রম কে ভুলে স্বর্থপরের মত ব্যবহার টা দেখছে।তরীকে এই দুনিয়া আরো নতুন ভাবে মানুষ চিনতে শেখাল।এই জঘন্য মানুষের বিপক্ষেই এই পৃথিবীতেই ভাল মানুষ আছে।খুব বেশি ভাল মানুষ আছে।হয়ত একদিন না একদিন সেই ভাল মানুষগুলির সাথেও তরীর দেখা হবে।কিন্তু দ্বিতীয় বার কী আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারবে!কখনো কী ভুলতে পারবে এই ভয়ানক দিন গুলোর কথা!কিন্তু আমি জানি একদিন না একদিন সব পরিবর্তন হয়ে যাবে।এই অশ্রুসিক্ত চোখে একদিন কাজল থাকবে,এই মলিন মুখে একদিন বিশ্বজয়ের হাসি থাকবে।অনেক গুলো মানুষ আফসোস করবে তরীকে হারানোর জন্য!

আমি এগিয়ে গিয়ে শাশুড়িকে বললাম,

রোহানের হাত ছাড়বেন নাকি আপনার ছেলেকে ডাকব?

রোহানকে নিয়ে ও কোথায় যাবে?রোহান আমাদের র** ক্ত। আমাদের সাথেই থাকবে।

প্লিজ আম্মা,এবার অন্তত থামুন।আর নিজের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবুন।কী ভাবছেন আমি আপনাকে দেখব?ওই আশায় থাকবেন না।

মনে মনে বললাম আপনার প্রতি আমার দায়িত্ব আছে। আপনাকে আমি দেখব তবে আপনার ভুলটাও স্বীকার করাব।

তরীর কাঁধে হাত রেখে বললাম,

‘আজ থেকে তোমার ছুটি।মুক্ত তুমি।তোমার কষ্টের দিন শেষ তরী।সামনে তোমার সুখের দিন আসছে।’

ঘন্টা খানিক পরে আমার দেওয়া ঠিকানায় মৃন্ময় ওর বোনকে নিয়ে হাজির হলো।সাথে একটা ইজি বাইক।আমি তরীকে এগিয়ে দিতে গেলাম,সাথে রোহানও আছে।এটা তরীর শেষ বিদায় এ বাড়ি থেকে। অনেক কষ্ট হচ্ছে তবুও চেপে রেখেছে।রাস্তায় ওশানের সাথে দেখা।ওশান বলল, ‘কাল আমার ছেলেকে পাঠিয়ে দিবি।না’হলে তোর কী অবস্থা হবে ভাবতেও পারছিস না!ভাইয়ার খুব দরদ না তোর প্রতি?তাহলে তোকে বিয়ে করলেই পারতো।’

তরী হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো।ওশানের গালে চোখ বন্ধ করে একটা থা**প্প**ড় মেরে বলল,

‘এটা আমার অনেক আগেই করা উচিত ছিল।সারাহ ভাবির সাথে অনেক আগে দেখা হলেই ভালো হতো।তোর মত বেয়াদব এর সাথে এতগুলো দিন কাটানো লাগত না।তোর এই মুখ যেন আমার কোনদিন দেখা না লাগে।আর ছেলে কে পাবে সেটা কোর্ট সিদ্ধান্ত নেবে।’

আমি ভীষণ অবাক হলাম তরীর এ ব্যবহারে।তবে ভীষণ আনন্দ লাগল।

আর কিছু পথ এগোতেই দেখি অটোতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মৃন্ময়।প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।মৃন্ময় এর বোন পিহুর সাথে আগে থেকেই চেনাজানা আছে আমার।সে আমাদের এক বছরের জুনিয়র। মৃন্ময় ওর বোনকে সবটা খুলে বলেছে।ওই একই মেসে আমাদের অন্যান্য বান্ধবীরাও থাকে।তাদের ও বলে দিয়েছি যেন তরীর খেয়াল রাখে।

পিহু তরীকে দেখে হাসিমুখে বলল আপু আসেন।আপনার কোনো সমস্যা নেই আমি আছি।আমাকে চোখ ইশারা দিয়ে বোঝাল চিন্তার কারণ নেই আমি আছি।মৃন্ময় কে বললাম সাবধানে নিয়ে যাস।মৃন্ময়কে দেখলাম তরীর দিকে অবাক নেত্রে তাকিয়ে আছে।রোহানকে কোলে নিয়ে বলল, ‘চলো বাবা।’

অটোটা ছেড়ে গেল।তরী তাকিয়ে আছে আমার দিকে।রোহান কিছুই বুঝল না কী হয়ে গেল ওর জীবনে!ওর মা-বাবা আর কোনদিন এক হতে পারবেনা।

বাড়িটা কেমন নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছে।রোহান ছাড়া বাড়িটা শূন্য লাগছে।রাতে আমার জ্বরের মাত্রা বহুগুন বেড়ে গেল। জ্বর ঠিক হতে আরো তিন দিন লেগে গেল।সম্পূর্ণ সুস্থ হতে সাত দিন লাগল।সাত দিন পরে সকাল আটটায়,ক্রমাগত কানের কাছে এলার্ম বেজেয় চলেছে । আমি ঘড়ি অফ করে আবার ঘুমোনোর চেষ্টা করলাম।চোখে মুখে পানির ছেটা পড়তেই চোখ খুললাম।তাকিয়ে দেখি, টাওয়াল পরা খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছেন রোশান স্যার।উনাকে হঠাৎ এ রুপে দেখে লাফ মেরে উঠলাম ঘুম থেকে।আমি কী দেখছি এসব!উনিতো কখনো এমন হট টাইপ ভাবে আমার সামনে আসেন না।হঠাৎ এ রুপে আগমন, কাহিনী কী!আমি উনার পা থেকে মাথা পর্যন্ত অবলোকন করছি।কী অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে উনাকে!উনি আমাকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে একটা শুকনো কাশি দিয়ে বললেন,

‘আজ ফ্রাইডে,তোমার না কোচিং আছে?’

‘হ্যাঁ আছে আজ এক্সাম, ফাইনাল প্রিপারেশন এর।’

‘এক্সাম দিবেনা।’

‘না ইচ্ছা নেই,আমি কিছু পড়িনি।কিছুই পারব না।’

‘গতবার ফেইল ছিল কয় সাব্জেক্টে?’

‘ইজ্জত রেখে কথা বলুন।ফেইল বলছেন কেনো?বলুন ইম্প্রুভমেন্ট ছিল।শুনতে মান সম্মত শোনা যাবে।’

‘মান উন্নয়ন পরীক্ষা মানুষ রেজাল্টের উন্নয়ের জন্য দেয়।আর তুমি কী করো? ‘

‘আমি ফেইল টাকে টেনেটুনে পাশে নেওয়ার চেষ্টা করি।’

‘এই দুইমাস তুমি আমার কাছে পড়বে রাতে।’

‘কী পড়ব?’

‘বই।’

‘রাতে কেউ বই পড়ায়?’

‘তাহলে বউ পড়ায়।’

‘হ্যাঁ বউকে বই পড়াব।হ্যাপি?’

‘বউকে কেউ রাতে বই পড়ায়।’

‘আশ্চর্য, হোয়াট ডু ইউ মিন?’
‘আই মিন টু ইউ সে, আপনার কিছু রোমান্টিক মুভি দেখা উচিত। যে মুভির কাপল বিবাহিত। তাহলেই অনেক কিছু বুঝবেন।’

‘হোয়াট?’

কথাটা বলেই উনি কী অদ্ভুত ভাবে তাকালেন দিকে!ইশ!একটু বেশি বলে ফেললাম।কী লজ্জাজনক কথা আমি বললাম!কী ভাবছেন আমাকে!আমার কথার মানে নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছেন।সিসুয়েশন চেঞ্জ করতে বললাম,

‘আপনি এভাবে নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো?’

‘কী বললে?’

‘যা সত্য তাই। কী বিশ্রী ভাবে খালি গায়ে আছেন।আমাকে কখনো দেখেছেন ওভাবে থাকতে?’

‘খালি গায়ে থাকতে চাও?তাহলে থাকো;আমার কোনো আপত্তি নেই।

ওহ শীট! আবার কী বলতে গিয়ে কী বলে ফেললাম!আস্তে করে উঠে ওয়াশ রুমের দিকে গেলাম।

উনি আমাকে ডেকে বললেন, ‘আজ জুম্মার দিন।পাঞ্জাবী ধোয়া নেই।কী পরব ভাবছি।এখন ধুয়ে দিলে কি শুকাবে?’

আমার একটা জিনিস খেয়াল হলো।গতকাল দেখেছি আমার কেনা সেই পাঞ্জাবীটা নিয়ে উনি ঘাটাঘাটি করছেন।বাই এনি চান্স উনার কি পাঞ্জাবী টা পছন্দ হয়েছে!আর আমি তো উনার জন্যই কিনেছিলাম।ব্রাশ করতে করতে পাঞ্জাবি টা বের করে উনার হাতে দিয়ে বললাম এটা পরুন আজ।

তোমার প্রেমিকের জন্য কেনা পাঞ্জাবি। আমি কেনো পরবো?

ধরুন প্রেমিককেই দিচ্ছি।পরে নিন।

না আমি অন্যর জিনিস পরব না।

নিজেই জানে আমার প্রেমিক নেই।তাও খোঁচাচ্ছে।আমার মুখ থেকে কিছু শুনতে চাচ্ছেন মনে হয়।আমিও বলব না।

শুনুন প্রেমিক কে পরে আবার কিনে দিব।এটা আপনি নিয়ে নিন।

সেদিন না বললে তোমার প্রেমিক নেই,তাহলে কাকে কিনে দিবে।

কবে বললাম।

জ্বরের ঘোরে।

আমি এসব বলেছিলাম কেনো?

তা তুমি জানো?

জানেন ই যখন তাহলে জিজ্ঞেস করছেন কেনো?ওটা আপনার জন্যই কেনা।বলেই যেন লজ্জা পেলাম।

ওয়াশ রুমে ঢুকে চেঞ্জ করে নিলাম।সেদিন রাতের মিষ্টি একটি মুহুর্ত মনে পড়ে গেল।আমি জ্বরে অচেতন হয়ে উনাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম,

‘আপনাকে আমি ভীষণ ভালবাসি রোশান স্যার।আপনি কেনো বুঝতে পারেন না!’

উনিও আমাকে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন,

‘তুমি আমাকে ভালোবাসো?আমি তো কালো।অনেক সুন্দর ছেলে থাকতে আমাকে ভালবাসো কেনো?’

‘জানিনা তো।আপনি ছাড়া কিছুই ভালো লাগেনা।’

তারপর কী হয়েছিল মনে নেই।ঘটনা টা যতবার মনে পড়েছে লজ্জা পেয়েছি আমি।আরো বেশি হারিয়ে গিয়েছি উনার ভালবাসায়।উনাকে জড়িয়ে ধরার অনুভূতি ছিল দারুণ।শ্যামসুন্দর পুরুষের মাঝে কি বিশেষ কিছু আছে?বিশেষ কোনো মায়া,দৈব কোনো শক্তি!যা সহযেই একটা মেয়েকে আকৃষ্ট করতে পারে,মনের দখল করে নিতে পারে।কী আছে এই শ্যামবর্ণের মানুষের মাঝে!যার দিকে তাকিয়েই আমার মন হারিয়ে যায়,আমি হারিয়ে যায় গহীনে!কই এই মানুষটা তো আমাকে আকৃষ্ট করতে কিছুই করেনি তবুও যেন কেনো মন ডেকে বলে মানুষটা আড়ালে আমার যত্ন করে,আমার কথা ভাবে।আগে আমার কাছে সুন্দর- অসুন্দরের ব্যাখা বলতে ছিল গায়ের রং সাদা আর কালো।সাদা মানে সুন্দর বুঝতাম আর কালো মানে কালো বুঝতাম বা অসুন্দর বুঝতাম।কিন্তু আজ আমি বুঝি ভালবাসার মানুষের চোখে তার প্রিয় মানুষটার গায়ের রং,হাইট,ব্রণ, চোখের নিচের দাগ,বয়স কিছুই ম্যাটার করেনা।এই মানুষটা নিজেও জানেনা সে আমার চোখে কত সুন্দর! কী হয়ে গেল এটা আমার সাথে!সিনেমার নায়ক দেখে হুট -হাট ক্রাশ খেয়েছি,সেই ক্রাশ যে সিনেমা থেকে বেরিয়ে এসে বাস্তব জীবনে প্রভাব ফেলবে বুঝতে পারিনি আমি।ক্রাশ নামক জিনিস টা বাস্তব জীবনে প্রথমবার ঘটেছিল কলেজ থেকেই।নবীন বরণে প্রথম যেদিন উনাকে দেখেছিলাম।কী তোলপাড় শুরু হয়েছিল বুকে!কিন্তু ক্রাশ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। তারপর এই মানুষের প্রতিই আমার তীব্র বিরক্তি আসে যখন আমার বাসায় নালিশ দিয়ে আমাকে বকা শোনাই।ক্রাশ আর বিরক্তির মাঝে আমাদের বিয়ে হয়ে গেল।রোজ সকালে তার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠতে উঠতে ভালবাসা কেমন স্থায়ী হয়ে গেল।এই মানুষ টা জানেনা সে আমার চোখে কত বেশি সুন্দর।

ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখি উনি বাইরে বাইকে হর্ণ দিচ্ছেন।নামায শেষ করে আমাকে সাথে নিয়েই বাসায় ফিরবেন।উনার পরনে আমার কিনে দেওয়া সেই পাঞ্জাবিটা।পাঞ্জাবি টা বোধহয় উনার জন্যই বানানো ছিল। কী দারুণ মানিয়েছে উনাকে!

কোচিং এর রাস্তার খানিকটা এপাশ থেকে বললাম,
‘আমাকে নামিয়ে দিন’।
‘তোমার কোচিং তো আরেকটু দূরে।’
‘হোক,আমি হেঁটে যাব।কেউ যদি দেখে ফেলে আপনি আমার ইয়ে তাহলে ক্ষেপাবে আমাকে।’
‘সারাজীবন কি লুকিয়ে রাখবে?’
‘তা অবশ্য না।তবে এক্ষুনি জানাতে চাইনা।’
বাইক থেকে নামার পরে উনি বললেন,’আমি এখানেই ওয়েট করব,চলে এসো।’
‘ওকে’।
কোচিং-এ বসে আছে তন্ময়। ফর্সা মুখশ্রী কেমন ফ্যাকাশে রূপ ধারণ করেছে।তন্ময় ফোনে গান শুনছে,
“আর নয় ভালোবাসা জানি তোর সাথে,মায়া যত রাখি লাভ কী বল তাতে!
একা করে আমায় চলে গেলি দূরে,এত বেশি করে ভালোবাসবে না কেউ তোরে।সেই যে গেলি চলে,আর এলিনা ফিরে!”
চলবে?

#একটি_নির্জন_প্রহর_চাই
২৬
#WriterঃMousumi_Akter.

নিস্তব্ধ পরিবেশ চারদিকে। কোথাও কেউ নেই।গায়ে এ্যাশ কালারের শার্ট, শার্টের হাতা গোটানো,সামনের একটা বোতাম খোলা,পরনে কালো জিন্স,পশ্চিম দিকে মুখ করে আনমনে বসে গান শুনছে তন্ময়।সিল্কি চুল গুলো মৃদু বাতাসে হালকা উড়ছে।ফর্সা মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, টানা নাকের ডগায় কালো একটা তিল।কী অপূর্ব সুন্দর দেখাচ্ছে তন্ময়কে!দেখেই মনে হয় কোনো হিন্দি সিরিয়ালের নায়ক।এত সৌন্দর্য থাকতেও কারো ভালবাসায় সে অবেহেলিত! ভীষণ অবহেলিত!শত মেয়ের ভালবাসা পাওয়ার পরেও সে নির্দিষ্ট করে যাকে চেয়েছে তাকেই পেল না।নিয়তি কী অদ্ভুত না!যে যা চায় সে তা পায় না।মুখে কোনো হাসি নেই তন্ময়ের।এদিক-সেদিক ও খেয়াল করছেনা।হাতে একটা কলম।কলম দিয়ে বেঞ্চে দাগ কাটছে অন্যমনস্ক হয়ে।নিজের অজান্তেই বেঞ্চে ছোঁয়ার নাম লিখে ফেলেছে।
আমি হুড়মুড় করে এসেই তন্ময়ের পাশে বসে পড়লাম।বেঞ্চে বসতেই একটা ঝাঁকুনি হলো।তন্ময় ঘুরে তাকালো আমার দিকে।আমাকে দেখে অনিচ্ছাকৃত ভাবে মৃদু হেসে বলল,

‘বিয়ে করে নিলি,বললি ও না!’

কাঁধ থেকে সাইড ব্যাগ টা রেখে, ওড়নার মুড়ো দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললাম,

‘তুই কোনো কথা বলবিনা তন্ময়।তোর সাথে কথা নেই।তুই কোন সাহসে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিলি বল?তোর কিছু হলে কী হতো বলতো?আন্টিকে কে দেখতো?আমি তো জাস্ট ভাবতে পারছি না তুই এমন বোকামো করবি!’

‘কেনো তোরা দেখতিস না আম্মুকে?’

তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে সিরিয়াস মুডে বললাম,

‘আমাদের দেখায় আন্টির কী যায় আসতো?আন্টির বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন তুই।তুই ছাড়া আন্টি বাঁচতো না।কেনো করলি এমন?তোকে আজ কৈফিয়ত দিতেই হবে!’

‘আচ্ছা! বাদ দে সারাহ।ওসব বাদ যাক।আমার ভুল হয়েছে আর এমন হবেনা।এইবার চোখ বন্ধ কর।’

‘কেনো?’

‘বন্ধ কর তুই।’

‘করছি, আগে বল এখন কেমন আছিস তুই?দেখ তন্ময় আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল তোর জন্য!’

‘তোরা থাকতে খারাপ থাকি কীভাবে সেটা বল?আমি জানি তোরা আমাকে কত বেশি ভালোবাসিস!’

‘এই ভুলের জন্য তোকে জরিমানা দিতে হবে।’

‘আচ্ছা দেবো।’

‘নে চোখ অফ করলাম।’

‘হাত টা বাড়া।’

হাত দুটো বাড়িয়ে মেলে ধরলাম।
হাতের উপরে ভারী কিছু একটা মনে হলো।চোখ খুলে দেখি গিফট পেপার দিয়ে সুন্দর ভাবে মোড়ানো কিছু একটা।বেশ ভারী লাগছে।গিফট পেতে বরাবরই আমার ভালো লাগে।আর সেটা খুলে দেখতে ইচ্ছা করে সাথে সাথে।

তন্ময় বলল, ‘চাকরি হলে তোকে গহনা বানিয়ে দিব।এখন সামান্য কিছু দিলাম।তোর বিয়ের গিফট। ‘

সাথে সাথে চোখ খুলে বললাম,

‘গিফট কেনো?আমি তো তোদের দাওয়াত ই দেই নি।তাহলে কিসের গিফট?আসলে না আমার বিয়েটা হুট করেই হয়ে গেছে।সুযোগ ই পাই নি।’

‘ইটস ওকে!খাওয়াটা তোর জামাই এর কাছে পাওনা রইলো।’

আমি গিফট পেপার টা খুলতে গেলেই তন্ময় আমাকে বাঁধা দিয়ে বলল,

‘না,এখন না।বাসায় গিয়ে খুলবি।’

এরই মাঝে দ্বীপ আর মৃন্ময় কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্পীড খেতে খেতে এসে হাজির হলো।বেঞ্চের ওপর ব্যাগ খুব জোরে ফেলে বলল,

‘দেখি তন্ময় তোকে কী গিফট দিছে!’

‘তোদের দেখাব না।’

মৃন্ময় তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘শা**লা আগে দিলি ক্যান?বললাম না আমরা দোকান থেকে এসে নেই!’

‘তোদের বিশাল প্লান।তোদের প্লানে সারাহ টাস্কি খাবে।আমার নির্ভেজাল গিফট আমি আলাদা ভাবেই দিলাম।’

দ্বীপ বলল, ‘শোন তন্ময়,তোর আশায় অনার্সে পড়ছি।তোর টা দেখে দেখে লিখি আর পাশ করি।তুই যদি ম**র**তেই চাস তাহলে আমার গ্রাজুয়েশন টা শেষ হোক আগে।এর আগে ম**রা**র প্লান বাদ দে।’

মৃন্ময় বলল, ‘তন্ময় এইবার কিন্তু ওরে আর দেখাবি না।সারা বছর কিচ্ছু পড়বেনা তোর টা দেখে লেখার আশায়।’

দ্বীপ বলল, ‘তুমি খুব পড়নেওয়ালা,সারারাত ফেসবুকে হৃদয়ভাঙা রমনী খুজে বেড়াও!’

‘হ খুঁজি।আমি চাই কারো ভাঙা হৃদয় জোড়া লাগাতে।তার সমস্ত অপূর্ণতাকে আমি পূর্ণতায় পরিণত করব।একটা বেরঙিন হৃদয়কে রঙিন করব।’

‘ যদি এমন মেয়ে না পাস?’

‘পেয়ে গেছি, মনে হচ্ছে।শুধু একটু পাত্তা দিলেই হয়।’

‘কই পাইলি রে?’

‘বলব না,আগে সারাহ’র সাথে ঝামেলা আছে মিটাই নেই।’

আমি চোখ বড় করে তাকিয়ে বললাম,

‘আমার সাথে আবার কী ঝামেলা গাইস?’

‘তোর জামাই এর পিক দেখা।কার সাথে বিয়ে হলো,কে এই আপদকে বিয়ে করল তার নিষ্পাপ মুখটা দেখতে চাই।’

‘উনার পিক নেই কাছে।’

‘পিক নেই মানে,ফাইজলামি?আগে পিক দেখা।’

‘আরে উনি যে আনরোমান্টিক,পিক টিক তোলেন না।’

মৃন্ময় অবাক হয়ে বলল,

‘আনরোমান্টিক?’

‘হ!প্রচুর।’

দ্বীপ বলল, ‘এখন তো এসব বলবাই।ছেলেরা বউ পাইলে কত আনরোমান্টিক থাকে আমরা তা বুঝি।যদি কোনদিন বলিস দোস্তো তোরা মামা হতে চলেছিস সেদিন খবর আছে।’

‘ট্রাস্ট মি গাইস।সে ব্যাক্তি এমন আনরোমান্টিক,জীবনে তোরা মামা ডাক শুনতে পাবিনা।’

মৃন্ময় বলল, ‘এতো ভারি টেনশনের বিষয়। সারাহ’র ফিউচার নষ্ট।’ বলেই হোহো করে হাসল দ্বীপ আর মৃন্ময়।হাসি থামিয়ে মৃন্ময় বলল,

‘ওয়েট তোর জামাইকে রোমান্টিক হওয়া মেডিসিন দিচ্ছি।’

‘কী?’

ওয়েট নিয়ে আসছি।মৃন্ময় আর দ্বীপ দুজনেই সামনের দোকানে গেল।দোকানে গিয়েই র‍্যাপিং করা বড়ো বড়ো কয়েকটা বাক্স নিয়ে এলো।বক্স গুলা বেশ বড়ো।আমার সন্দিহান মন ভাবছে কী আছে এই বক্সে!দুজনে এসে বক্স দুইটা আমার সামনে রেখে বলল,

‘নে তোর বিয়ের গিফট। ‘

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে বললাম,

‘এত্ত বড় বড় বক্সে কী রাখা আছে ভাই?’
মৃন্ময় বলল, ‘শোন এইগুলা দেখবি না এখন,তুই কিন্তু খুলবিও না।আর এই নে এই প্যাকেট টা সোজা গিয়ে তোর জামাই কে দিয়ে বলবি তোমার জন্য।তাও রাতে দিবি।’

‘এই ছোট প্যাকেটে কী রে?’

‘জামাইকে রোমান্টিক বানানোর মেডিসিন। একবার খেলেই রোমান্টিক হয়ে যাবে।তুই শুধু গিয়ে বলবি, ‘প্রাণের স্বামী এটা খেয়ে নিন।’

‘শোন, কাহিনী নেই তো কোনো?’

‘কোনো কাহিনী নেই।বাট প্রমিস কর খুলবি না।’

‘আচ্ছা খুলব না।’

‘বল আমার জামাই এর কসম খুলব না।’

‘কী হচ্ছে ইয়ার! বললাম তো।’

এইদিকে আমি অনেক অস্থির হয়ে আছি।মনে হচ্ছে ভেতরে কী আছে দেখতে না পেলে প* রা ণ ফেটে যাবে।এরই মাঝে ছোঁয়া এসে উপস্থিত হলো।ছোঁয়ার দিকে আমরা তিনজনেই তাকালাম।মেয়েটা ঠিক আছেতো!ছোঁয়া তন্ময়কে দেখেই বলল,

‘তোকে কতবার ফোন দিয়েছি,রিসিভ করিস নি কেনো?টেনশনে আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল।এইভাবে টেনশন দেওয়ার মানে কী তন্ময়?একবার রিসিভ করে বলবি তো ভালো আছিস!তুই ঠিক আছিস!’

তন্ময় ছোঁয়াকে দেখেই চুপ হয়ে গেল।হাসি মুখটা মলিন হয়ে গেল।অন্যদিকে ঘুরে তাকালো।আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম তন্ময় ছোঁয়ার সাথে আকাশসমান অভিমান করেছে।ছোঁয়া ও বুঝতে পারল তন্ময় তাকে ইগনোর করছে।ছোঁয়া এটাও জানে তন্ময় যতই রাগ করুক ছোঁয়া জোরাজোরি করলে তন্ময় রাগ করে থাকতে পারবে না। ইগনোর ও বেশি সময় করতে পারবে না।তন্ময়ের ফোনে সেই গানটা ক্রমাগত বেজেই চলেছে।

ছোঁয়া তন্ময়কে দিয়ে কথা বলানোর জন্য বলল,

‘ছ্যাঁকা খাওয়া গান শুনতেছিস।এই নাটকের কিছু স্ক্রিপ্ট তোকে বলি।যদিও নাটকে হলেও এটা সত্য।এই যে তুই এতদিন আমার পিছু পিছু ঘুরছিস, আমি তোর মুখে স্যান্ডেল দিচ্ছি।এরপর আমার পিছে ঘুরলে আমার জামাই তোরে জু**তা দিবে।ছ্যাঁকা খাওয়া গান বাদ দে।’

তন্ময়ের মাঝে তবুও কোনো পরিবর্তন নেই।ছোঁয়ার কথা যেন শোনেই নি।আমরা তিনজন ওদের দু’জনকে দেখছি।আমাদের তিনজনের ই আজ ভাল লাগছে।এমন দিন দীর্ঘদিন ধরে দেখতে চেয়েছি আমরা।ছোঁয়া তন্ময়কে আবার বলল,

‘কী? ব্যাপার কী?আর কতক্ষণ কথা না বলে থাকবি?আমি জানি কষ্ট হচ্ছে।অকারণ কষ্ট পাওয়ার দরকার কী?’

তন্ময় উঠে পেছনে ব্যাগ ঝুলিয়ে হাঁটা দিল।ছোঁয়ার মুখটা কালো হয়ে গেল।চোখে পানি চলে এলো।জীবনে সব থেকে বেশি প্রয়োরিটি পাওয়া মানুষটার অবহেলা সত্যি কষ্টদায়ক!ভীষণ কষ্টদায়ক!ছোঁয়া বোধহয় সেই কষ্টটা পাচ্ছে।এমনিতেই একাকিত্ব আর যন্ত্রণায় ছারখার হয়ে যাচ্ছে সেই মুহূর্তে তন্ময়ের অবহেলা!

আমি ছোঁয়ার কাঁধে হাত রেখে বললাম,
‘কষ্ট হচ্ছে তোর?’
‘এর থেকে হাজারগুন কষ্ট তন্ময় পাচ্ছে।কিন্তু চেপে যাচ্ছে।’

‘তন্ময় তোর সাথে রাগ করে থাকতেই পারবে না।’

মৃন্ময় আর দ্বীপ বলল, ‘ছোঁয়া ওর কলার ধরে টেনে নিয়ে আয়তো।আমরা তো ওর আশায় এক্সাম দিতে এসছি।চলে যাচ্ছে কই?’

‘ওর তো মুড অফ হলে পৌরপার্কে যায়।’

আমি সবার উদ্দেশ্য বললাম, ‘আজ এক্সাম বাদ,চল আজ পৌরপার্কে আড্ডা হবে।এত পড়ে কী হবে একদিন তো ম**রে**ই যাব।’

তন্ময়ের পিছু পিছু সবাই পৌর পার্কের দিকে গেলাম।এখান থেকে পাঁচ মিনিটের রাস্তা মাত্র।গিফট বক্স গুলা সবাই মিলে ভাগ করে ক্যারি করলাম।তন্ময় পার্কের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে।আমি ছোঁয়াকে বললাম,

‘যা তন্ময়ের সাথে কথা বল।’

ছোঁয়া তন্ময়ের পাশে গিয়ে দাঁড়াল।তন্ময়ের হাত ধরে বলল, ‘প্লিজ তন্ময় এইভাবে ইগনোর করিস না।আমার কষ্ট হচ্ছে খুব!’

তন্ময় ছোঁয়ার হাত ঝাড়া মেরে বলল,

‘না ছোঁয়া, প্লিজ না!আমাকে তুই আর ছুঁয়ে দেখিস না!তুই একবার আমায় ছুঁয়েছিলি চারটা বছর জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে গেলাম।আর একবার ছুঁয়ে দেখলে আমি পুরোটাই শেষ হয়ে যাব।আমাকে কখনো আর স্পর্শ করিস না।’

‘আমাকে এত ভালবাসলি কেনো তন্ময়?যে তোকে ভালবাসে তোর উচিত তাকে ভালবাসা, যাকে তুই ভালবাসিস তাকে নয়।তাহলে কেনো আমাকে ভালবাসলি তুই?’

‘বাহ!উপদেশ টা দারুণ ছোঁয়া।কিন্তু তুই ও আমার মতোই ভুল করলি।তোকে যে ভালবাসে তাকে ভালোবাসলিনা।’

‘আমি তোর যোগ্য নই তন্ময়।’

‘প্লিজ ছোঁয়া।কে কার যোগ্য আমি এটা শুনতে চাচ্ছিনা।আমার কিছুই ভালো লাগছেনা।প্লিজ লিভ মি!কখনো আমার কাছে আসিস না!’

‘তুই জানিস তন্ময় ওশান কী করেছে?’
‘জানি।’

‘তাও আমার সাথে এভাবে কথা বলবি।’

‘কোনভাবেই বলতে চাচ্ছিনা।’

‘আমি ঠকে গেছি তন্ময়, কিন্তু তোকে ঠকায়নি!তোর সাথে ভালবাসার অভিনয় করে তোর মন ভাঙিনি!ফ্রেন্ড হিসাবে তোকে মন প্রাণ দিয়েই ভালবেসেছি।শুধু প্রেমিক বলে মেনে নিতে পারিনি।সরি তন্ময় তোকে সারাজীবন কষ্ট দিয়ে এসছি!”

ছোঁয়া কাঁদছে,ভীষণ কাঁদছে।

তন্ময় কিছু না বলে আমার কাছে এগিয়ে এসে বলল,

‘ওকে কাঁদতে নিষেধ কর প্লিজ।আমার ভাল লাগছে না।’

আমি আর মৃন্ময় তরীকে নিয়েই কথা বলছিলাম এত সময়।মৃন্ময় তন্ময়কে বলল, ‘ ছোঁয়া লাইফের সব থেকে বাজে সিচুয়েশনে আছে।তোকে দরকার ওর পাশে।এই টাইমে ওকে ছেড়ে যাস না।’

‘ও আমাকে ভালবাসেনা।এবং পাশে ও চায়না।’

এরই মাঝে আমার ফোন বেজে উঠল।ফোনের স্ক্রিনে রোশান স্যারের নাম্বার ভাসছে।মুহূর্তের মাঝেই মনটা ভালো হয়ে গেল আমার।হাজার টা দুশ্চিন্তার মাঝে আমার জন্য উনি এক প্রশান্তি! অনেক সময় হয়ে গিয়েছে আমরা আড্ডা দিচ্ছি।উনি নামাজে যাবার আগে আমাকে একটা দোকানে বসিয়ে রেখে যাবেন বলেছিলেন।নামাজের আগেই আমাদের এক্সাম শেষ হবার কথা।তন্ময়,মৃন্ময়,দ্বীপ ওরাও নামাজে যাবে।সবাইকে বিদায় জানিয়ে একটা অটোতে উঠলাম গিফট গুলো নিয়ে।
কী আছে গিফট বক্সে জানিনা।ওরা কী মেডিসিন দিলো উনাকে রোমান্টিক বানাতে সেটাই ভাবছি,!আসলেই কি কোনো ওষুধ আছে যা খেলে কেউ দারুণ রোমান্টিক হয়ে যায়।ইশ কী লজ্জা!উনি রোমান্টিক হয়ে যাবেন।কী হবে তখন ভেবেই লজ্জা লাগছে!এরই মাঝে অটো এসে থামল নির্দিষ্ট গন্তব্যে।অটো থেকে মুখে বাড়িয়ে বাইরে তাকিয়েই মুগ্ধ হলাম। বাইক হেলান দিয়ে বুকে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছেন আমার অপেক্ষায়।আমাকে দেখেই সোজা হয়ে দাঁড়ালেন আর এগিয়ে এলেন আমার কাছে।কাছে এসে বললেন,

‘এক্সাম কেমন হলো?’

‘খুব ভালো।’

‘দেখি প্রশ্ন?’

‘বাসায় গিয়ে দেখাব।’

‘এগুলা কিসের বক্স নামাচ্ছো?’
‘ফ্রেন্ড্ররা গিফট দিয়েছে।’

‘জন্মদিন ছিল তোমার?’
‘না আপনার সর্বনাশের দিন ছিল।’

‘মানে।’

‘বিয়ের গিফট।আপনি না বলেন বিয়ে করে সর্বনাশ হয়েছে।’

উনি ভ্রু কুঁচকে তাকালেন আর বললেন, ‘আধাঘন্টা কোথাও যাবেনা এখান থেকে।বৌদির চায়ের দোকানে বসে থাকবে।’

‘ওই মহিলার দোকানে বসব,কিছু খাব না?এত কিপ্টা কেনো আপনি?শ্যামসুন্দর পুরুষ কৃপণ হবে কেনো?’

‘খেতে নিষেধ করেছি?’

‘খেতেও তো বলেন নি।’

‘যা ইচ্ছা খেও। ‘

দোকানে বসে চিপস খেয়েই যাচ্ছি।১২ প্যাকেট চিপ্স খেয়ে শেষ করে ফেললাম।বৌদিকে বললাম, ‘উনি আসুক টাকা দিচ্ছি।’

‘টাকা দিয়ে গেছে।’

‘কত?’

‘চা খেয়েছিল,২০০ টাকার নোট দিয়ে গেছিল।বলেছিল আপনার যা যা লাগে দিতে।এসে বাকি টাকা দিবে।’

‘আর কিছু খাব না।বাকি টাকা ফেরত দিন।’
‘এই নিন টাকা।’

‘এক টাকা কম দিছেন।’

‘একটা শ্যাম্পু দিচ্ছি, এক টাকা তো চলেনা।’

শ্যাম্পু নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এলাম।উনার নামাজ শেষ।আমাকে এসে বললেন, ‘কিছু খেয়েছ?’
‘বেশি কিছু খাইনি,আপনার টাকা খরচ করলে পরের দিন আর এভাবে খাওয়ার অফার দিবেন না।’

‘এমন উদ্ভট চিন্তা যে তোমার মাথায় কীভাবে আসে!’

বাড়িতে ফেরার পরে বসে আছি কখন রাত হবে আর উনাকে রোমান্টিক হওয়া মেডিসিন টা দিব!
চলবে?