একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব-২৩+২৪

0
359

#একটি_নির্জন_প্রহর_চাই
২৩
#WriterঃMousumi_Akter
মারাত্মক লজ্জা পেয়ে দূর্বল শরীর নিয়ে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালাম।ওয়াল ধরে দাঁড়িয়ে চোখ বোলালাম বাইরে।কী দারুণ দেখাচ্ছে চারদিক টা!কী স্নিগ্ধ সব কিছু!গাছের পাতাগুলি কেমন সতেজ হয়ে উঠেছে,উঠানে গাছের পাতায় ভরে গিয়েছে, বৃষ্টি যে তার সবটা উজাড় করে প্রকৃতি ভাসিয়ে দিয়ে গিয়েছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে।হঠাৎ মনে হলো তন্ময়ের কথা।তন্ময় কি সুস্থ হয়েছে!ছোঁয়া ঠিক আছে তো।নিশ্চয়ই ছোঁয়া ঠিক নেই।ঠিক তো থাকার কথা ও নয়।পৃথিবীতে সব অত্যাচার সহ্য করা গেলেও মানসিক অত্যাচার সহ্য করা যায় না।কারো কাছ থেকে প্রতারিত হওয়াটা প্রতিটা মানুষের জীবনেই সবথেকে বিষাদময় ক্ষণ।মন ভাঙার যন্ত্রণার মত আর কোনো যন্ত্রণা পৃথিবীতে নেই।যা মানুষের জীবন টাকেই বিষাক্ত করে তোলে।ছোঁয়া এবং তন্ময় দু’জনকেই ফোন করতে হবে।ওদের দু’জনের মিল হলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।আর আমি দায়িত্ব নিয়েই সবটা করব।জীবনে অন্তত এই একটা ভাল কাজ করি।

এরই মাঝে হঠাৎ তরীর চিৎকার আমার কানে ভেসে এলো।খুব করুণ সে চিৎকার! শরীরে ভীষণ আঘাত না পেলে কেউ এভাবে গুঙিয়ে ওঠেনা।মন টা কেঁদে উঠল আমার।ব্যাথা টা বোধহয় আমার গায়েই লাগল।আমার কানে স্পষ্ট ভেসে এলো,

‘আমি টাকা চু**রি করিনি।আমাকে আর মে**রোনা।আমি সহ্য করতে পারছিনা এ যন্ত্রণা।আম্মা আপনি তো আমাকে চেনেন? আমি কী কোনদিন চু**রি করতে পারি বলুন?আপনার ছেলেকে বোঝান না আম্মা!’
শাশুড়ি কঠিন কন্ঠে বললেন, ‘বাঁচতে চাইলে টাকা ফেরত দাও।না হলে আজ ভালো হবে না তরী।টাকা কোথায় পাচার করেছ বোনের বাড়ি?’

ওশান গালি দিয়ে বলছে, ‘ফকিন্নির বা*চ্চার গোষ্ঠিতে বিয়ে করে আমার কোনদিন ভালোই হলো না।’

শুধু দুড়ুম দুড়ুম আওয়াজ হচ্ছে।বোঝা যাচ্ছে তরীর গায়ে উরাধুরা আঘাত করছে।খুব বাজে গালিগালাজ করছে ওশান।শাশুড়ি ও খুব বাজে কথা শোনাচ্ছে,যত প্রকার কটুকথা আছে সব ই শোনাচ্ছে।ক্লান্তিতে আমি পা বাড়াতে পারছিনা।শরীর থরথর করে কাঁপছে।ওয়াল ধরে ধরে কোনরকম ওশানের রুমে গেলাম।ওশানের রুমে যেতেই আমার কী হয়ে গেল জানিনা।আমার ভেতরে কী কোনো অশরীরী শক্তি প্রবেশ করলো!র**ক্ত টগবগ করে উঠল রাগে।চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে আমার।সমস্ত শরীর কাঁপছে।ওশানের হাতে বড় একটা লোহার রড।তরীর মাথায় কেবল ই বাড়ি দিতে যাবে।তরী দুই হাত মুখের সামনে রেখে চোখ বন্ধ করে রেখেছে।ওর পালানোর ও পথ নেই, শাশুড়ি পথ আটকে রেখেছে।আমি দ্রুত তরীকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলাম।আঘাত টা স্লিপ করে আমার কপালে কিছুটা খোঁচা লাগল।রাগে রাগে শাশুড়ি কে ঠেলে এগিয়ে গিয়ে ওশানের দুই গালে দুইটা থা**প্পা** ড় মা**র**লা**ম।ওশানের বুকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে বললাম,
‘কী ভাবিস তুই নিজেকে?মানুষ তুই?নাকি অ’মানুষ!

ওশান কে দেখে মনে হচ্ছে নেশা করেছে।চোখ দু’টো লাল হয়ে টলমল করছে।ওর হাব ভাব ও ভাল নয়।আজেবাজে কিছু খেয়ে বাসায় এসেছে।আজ ছোঁয়া ব্লক করেছে, নিশ্চয়ই ছোঁয়া আরো গা**লি গালাজ করেছে।এইজন্যই মাথা ঠিক নেই।

ওশান তীব্র রাগে কটমট করতে করতে বলল,

‘আমাদের স্বামী- স্ত্রীর মাঝে তুমি কেনো এসেছো?আমার বউ আমি মা**র**ব তুমি বলার কে?’

‘কে তোর স্ত্রী? তুই তো তালাক দিয়ে দিয়েছিস।ইসলামি শরিয়তের নিয়ম অনুযায়ী তিনবার তালাক দিলেই তো তালাক হয়ে যায়।তুই তো মুখে মুখে অজস্রবার তালাক দিয়েছিস।তাহলে কীভাবে ও তোর বউ হয়?’

‘তালাক মেনে নিয়ে দূর হয়ে যায় না কেনো?ওর জন্য আমার জীবনের সব সুখ শান্তি শেষ হয়ে গিয়েছে।আজ যদি ওই আপদ আমার সাথে না থাকত ;লাক্সারিয়াস একটা লাইফ লিড করতে পারতাম।শুধুমাত্র ও জড়িয়ে আছে বলেই সমস্ত সুখ পেয়েও আমি হারালাম।আমি আজ ওর ব্যবস্থা করেই ছাড়ব।’

‘আমার তো মনে হয় তুই তরীর জীবনের আপদ।তোর মতো বেয়াদব এর সাথে তরীর বিয়ে না হলে একটা লাক্সারিয়াস জীবনযাপন ও নিজে করতে পারত।’

‘ওহ রিয়েলি!আমি ওকে তালাক দিচ্ছি এখনি।এক তালাক,দুই তালাক, তিন তালাক,কাবিনের সমস্ত টাকা এখনি পরিশোধ করে দিচ্ছি।এখনি যেন দূর হয়ে যায়।যেখানে গেলে লাক্সারিয়াস জীবন পায় সেখানে যাক।শুধু আমাকে মুক্তি দিক।’

তিন তালাক একটা মেয়ের জন্য যে কী তা শুধু একটা মেয়েই জানে!ডিভোর্সি মেয়েগুলোকে সমাজ অভিশপ্ত ভাবে।এক কথায় বলবে ভাল হলে কি তালাক দিতো!।শ্বশুর বাড়ি একটু আধটু যন্ত্রণা কে না ভোগ করে,স্বামীর ঘর করা অত সোজা নয়।মানে সব দোষ ই একটা মেয়ের।তাকে যে কেনো ডিভোর্স দেওয়া হল কেউ জানতেও চাইবে না।পাশে ও দাঁড়াবেনা।শুধু দূর থেকে কটু কথা ই শোনাবে।তরী ও আজ বুঝে গিয়েছে,এই সংসার থেকে সে ছুটি পেয়ে গিয়েছে।

তরী ছলছল নেত্রে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভাবি ছোঁয়ার নাম্বারে বারবার ফোন দিচ্ছে।কল যাচ্ছেনা বলে আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করছে।আমার কী দোষ বলুন?’

‘তুমি এখনো এই অমানুষটার সাথে থাকতে চাও তরী?এখনো?জুতা খোলো।এরে পি**টা**ও।কী হলো চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?’

‘ভাবি এ আর ছোঁয়া দুজন’কেই যদি পি**টা**তে পারতাম! আসলে আমি দূর্বল বলেই পেয়ে বসেছে।’

ওশান তরীর দিকে তেড়ে গিয়ে বলল,

‘তুই আবার ছোঁয়ার নাম মুখে আনছিস?আজ তোকে মে**রেই ফেলব।তোর জন্য আজ এত অশান্তি।’

আমি র*ক্ত চক্ষু নিয়ে ওশানের দিকে তাকিয়ে বললাম,

‘ওশান!আজ আমার হাতে তুই খু**ন হবি।কেউ আটকাতে পারবেনা।আমি আজ তোকে মে**রে জেলে যাব।আমার জীবনের সব থেকে প্রিয় মানুষটার জীবন তুই নষ্ট করেছিস।’

শাশুড়ি আমার কাঁধে হাত রেখে বলল,

‘বউমা তুমি অসুস্থ মানুষ। ওদের ব্যাপার ওদের বুঝতে দাও।তুমি যাওতো মা রেস্ট নাও। ওই ফকিন্নির বাচ্চা টাকা চু**রি করেছে।’

‘ আজ আপনি কোনো কথা ই বলবেন না আম্মা। আপনি তো মা হবার ই যোগ্য নন।আপনার নিজের মেয়ে নেই তো এইজন্য অন্য কারো মেয়ের দরদ আপনি বুঝতে পারেন না।আপনি যে আপনার ছেলেকে প্রশ্রয় দিলেন,এতে কী হতো?তরীর মাথায় ওই আঘাত টা লাগলে তরী মা**রা যেত।আপনার ছেলে জেলে যেত ওর ফাঁসি হতো।আপনি ছেলে হারাতেন,রোহান মা-বাবা হারাতো।কী হতো এতে?ভালোর ভালো কি কিছু হতো বলুন?আপনি তো আপনার ফ্যামিলি ই ম্যানেজ করতে পারেন না।আপনার ছেলের সাথে নিকৃষ্ট কাজের ভাগীদার আপনি হচ্ছেন।আপনি বিবেকের কাছে কী উত্তর দিবেন বলুন?আজ যদি আপনি প্রশ্রয় না দিতেন আপনার ছেলে এত বাড়ত না। বুঝেছেন? ‘

‘তুমি এসব কী বলছো সারাহ!আমি মেয়ের মর্ম বুঝিনা!কখনো দেখেছ আমি তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি?আর আমি কীভাবে থামাব ওদের ঝামেলা?তরী টা**কা চুরি করতে না গেলে কি এত ঝামেলা হতো?’

‘কী করেছে টাকা দিয়ে?আপনি দেখেছেন চু**রি করতে?’

‘ওশানের অনেক টাকা হারিয়ে গিয়েছে।তাছাড়া ও ফোন কিনেছে টাকা চু**রি করে।বাকি টাকা ওর বোনদের কাছে পাচার করেছে।’

‘ফোন আমি তরীকে কিনে দিয়েছি,আপনাদের টাকা চু**রি করে ও কেনেনি।অহেতুক অত্যাচার করা বন্ধ করুন।এত নিকৃষ্ট ফ্যামিলি আমি আগে দেখিনি।যেমন মা, তেমন ছেলে।’

‘তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলছ কেনো মা।আর তুমি এত দামি ফোন তরীকে কিনে দিয়েছ কেনো?ওর হাতে ফোন মানায়?’

‘কেনো মানায় না ফোন!আপনি ফোন ইউজ করতে পারলে তরী কেনো পারবেনা?আপনিও এ বাড়ির বউ তরী ও এ বাড়ির বউ।আপনি পারলে তরী কেনো পারবেনা?কী কম আছে তরীর?’

‘ফোন তুমি কিনে দিয়েছ সেটা তো বলল না।সকালে রোশান বাইরে যাবার আগে ওর হাতে ফোন দেখে বলল, সারাহ ফোন রেখে গিয়েছে। ও বলল হুম।
কিন্তু ওশান আমাকে বলল,’ আম্মা সারাহ’র ফোন ওই মডেল না।ও টাকা চু**রি করে ফোন কিনেছে।’

‘বউ কে ফোন কিনে না দিলে সে তো চু**রি করবেই।’

ওশান রাগী চোখে বলল,

‘আমি ওরে ফোন কিনে দিব?ও কি ফোন রিসিভ করতে পারে?আমার ঘর থেকে জিনিসপত্র নিয়ে বের হয়ে যা।’

ওশান তরীর সমস্ত জিনিস ছুঁড়ে ফেলে দিল। আরো গালি গালাজ করে বলল,

‘তোর জন্য ছোঁয়া আর আমার জীবনে আসতে চাইছে না। যতদিন তুই থাকবি ছোঁয়াকে পাব না।’

‘ওশান তুই ছোঁয়ার আশেপাশে ঘেষার চেষ্টা ও করিস না।’

‘সারাহ বেশি বাড়াবাড়ি করোনা।’

‘বাড়াবাড়ি তো শুরুই করিনি। ছোঁয়া তোর জীবনে আসবেনা, আমি বেঁচে থাকতে তো না।’

‘আমি তোমাকেও ছাড়ব না সারাহ।সব তোমার জন্য।ছোঁয়াকে না পেলে আমি তোমাকেও বাঁচতে দিব না।’

বলেই ওশান আমাকে ধাক্কা দিল।আমি পড়ে যেতেই কেউ আমাকে ধরে ফেলল।পেছনে তাকিয়ে দেখি রোশান স্যার দুই হাতে আমাকে আগলে ধরেছেন আর অগ্নি দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছেন ওশানের দিকে।
চলবে?

#একটি_নির্জন_প্রহর_চাই
২৪.
#WriterঃMousumi_Akter
রোশান স্যার দুই হাতে আমাকে আগলে ধরলেন।হঠাৎ যেন দেহে প্রাণ ফিরে পেলাম।দূর্বল শরীরে ওশানের ধাক্কায় মনে হচ্ছিল আমি কোনো পাহাড়ের চূড়া থেকে পড়ে যাচ্ছি।হৃৎপিন্ড কাঁপছে।কিছুক্ষণ আগেও আমি ছিলাম অগ্নিকন্যা। হঠাৎ আবার দূর্বল হয়ে পড়েছি।রোশান স্যার কঠিন মেজাজে তাকিয়ে আছেন ওশানের দিকে।এখনি হয়তো ওশানকে ভস্ম করে দিবেন চোখ দিয়েই।রাগে উনার শরীর কাঁপছে।পাশেই একটা চেয়ার ছিল,পা দিয়ে টেনে এনে আমাকে বসিয়ে দিলেন চেয়ারে।গেঞ্জির হাতা গোটাতে গোটাতে এগিয়ে গেলেন ওশানের দিকে।হাত মুষ্টিবদ্ধ করে গায়ের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে ওশানের নাক বরাবর ঘুষি দিয়ে বললেন,

‘হাউ ডেয়ার ইউ টাচ হার? রাসকেল!শী ইজ মাই ওয়াইফ।যদি ওর শরীরে একটা টোকা দেওয়ারও চেষ্টা করিস,তাহলে তোর এই হাত আমি ভেঙে গুড়িয়ে দিব!

ওশানের নাক নিয়ে সাথে সাথে র**ক্ত গড়িয়ে পড়ল।রোশান স্যার এটুকুতে ক্ষান্ত হলেন না, ওশান কে আবার ও আঘাত করলেন নাক আর ঠোঁট বরাবর।ঠোঁট কেটে বেরিয়ে এলো র**ক্ত।ওশান জানে, বল-শক্তি কোনটাতেই সে তার ভাইয়ের সাথে পারবেনা।তাছাড়া যেভাবে রেগে আছে ওশানের প্রাণ বাঁচানোটায় দায় এই মুহূর্তে। মনে হচ্ছে দীর্ঘদিনের রাগ মেটাচ্ছেন।ওশানের চোখে,মুখে কম হলেও ১০-১২ টা ঘুষি দিয়ে ওশান কে র**ক্তা**ক্ত করে ফেললেন।এতেও উনি শান্ত হলেন না।ওশানের গ* লা টি** পে ধরে রাখলেন।জিহবা খানিক টা বের হয়ে গিয়েছে।

শাশুড়ি তড়িৎ বেগে ছুটে গেলেন আর জোরে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠে বললেন,

‘ম** রে যাবে বাবা।ছাড় এবার।’

আমি কিছুই বলছি না।চুপচাপ দেখছি।কারণ ওশানের শাস্তির প্রয়োজন।এরই মাঝে শ্বশুর বাজার থেকে ফিরেছেন।বাজারের ব্যাগ ফেলে ছুটে এলেন।শ্বশুর -শাশুড়ি দুজনে মিলে উনার হাত ছাড়ালেন।রোশান স্যার রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন,

‘বলেছিলাম না যেদিন ধরব সেদিন ছা**ড়**ব না।এর আগে বহুবার ওয়ার্নিং দিয়েছি কানে যায়নি!তরীর সাথে যা করেছিস করেছিস আমি বারবার ছাড় দিয়েছি।কী ভাবতিস? আমি কিছুই জানিনা?সব আমার আড়ালেই হয়?আমি সব ই বুঝতাম শুধু মাত্র চুপ থাকতাম এই ভেবে যে, আস্তে আস্তে যদি সব ঠিক হয়ে যায়।সেপারেশন হয়ে গেলে রোহানের কষ্ট হবে।তুই নতুন বউ পাবি, তরীকেও বিয়ে দেওয়া যাবে ওই ছোট্ট বাচ্চাটার কী হবে?না পাবে মা,না পাবে বাবা।মা-বাবার সেপারেশন একটা বাচ্চার মনের উপর কী ভয়ানক প্রেশার পড়ে জানিস?তোর মত কুলাঙ্গার এটা কীভাবে বুঝবে!যার মা-বাবার সেপারেশন হয় সেই সন্তান জানে পৃথিবীটা কত বিষাক্ত।রোহান কোনদিন স্বাভাবিক একটা জীবন পাবেনা।শুধুমাত্র এই বাচ্চাটার জন্য আমি চুপ ছিলাম।কিন্তু আর নাহ!তুই তরীকে রেখে সারাহ’র গায়ে হাত দিয়েছিস।সারাহ’র দিকে কেউ চোখ তুলে তাকালে আমি পৃথিবী দেখার জন্য তার চোখ ই রাখব না। “মাইন্ড ইট।”

শ্বশুর মাথায় হাত দিয়ে বললেন, ‘ছিঃ! ছিঃ! বড় ভাবির গায়ে পর্যন্ত হাত তুলেছে!এই কুলাঙ্গারকে জন্ম দিয়ে সব থেকে বড় পাপ আমি করেছিলাম!’

শাশুড়ি বললেন, গায়ে হাত দিয়েছে কোথায়?ঝামেলার মাঝে ধাক্কা লেগে গিয়েছে।

উনি ওনার আম্মার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললে,

‘তুমিও মিথ্যা ও বলতে জানো আম্মা?’

‘না বাবা,আমিতো বউমাকে বলেছিলাম তুমি অসুস্থ মানুষ ওদের ঝামেলায় এসো না মা।’

‘আম্মা তুমি এসব জানতে না?তোমার ছেলে ঘরে বউ রেখে অন্য নারীতে আসক্ত জানতে না তুমি?’

‘জানতাম।’

‘শাসন করেছো কখনো?’

‘আমার কথা কি শোনে?’

‘কখনো বলেছ আমাকে বা বাবাকে?বলোনি।কারণ তুমি এর সম্পূর্ণ সাপোর্ট করে গিয়েছ।ছিঃ!আম্মা তুমি পরকিয়া সমর্থন করো!আমি একজন মটিভেশনাল স্পীকার। এসবের বিরুদ্ধে মটিভেশন দিয়ে থাকি।মানুষ তো আমার মুখে থু থু ফেলবে।যার আম্মা ছেলের পরকিয়া করে বিয়ে করাকে সমর্থন করে, তার ছেলে মটিভেশনাল বক্তব্য দেয়।’

শ্বশুর বললেন, ‘বিয়ে তোমার আম্মাকে দেওয়ার দরকার।আমার জীবনের সব থেকে ভুল সিদ্ধান্ত ছিল এই মহিলাকে বিয়ে করা।এই মহিলা কত খারাপ সেটা আমি ছাড়া কেউ জানেনা।সারা জীবনের লোভী মহিলা।আমি শাসন করতে গেলে উল্টো আমাকেই মা**র**তে আসে।জীবনের কী কুক্ষণে যে সম্পত্তির অর্ধেক এর নামে দিয়েছিলাম!কানের কাছে ফুসফুস করেছে তুমি যদি মরে যাও ছেলেরা আমাকে নাও দেখতে পারে।আমাকে লা**থি মেরে বাড়ি থেকে বের ও করে দিতে পারে।আমার ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমার নামে কিছু সম্পত্তি দাও।আর তখন থেকেই ওর পাওয়ার বেড়েছে।ও জীবনে আমার আত্মীয়ের পাতে ভাত দিতে চাইনি।তোমার দাদুকে তো এ বাড়ি রাখা নিয়ে কত জুলুম করে।আমার ভাই -বোনদের থেকে আলাদ রেখেছে।এর বিরুদ্ধে স্টেপ নিতে গেলেতো আমাকে আরেক টা বিয়ে করতে হতো।সংসারে আরেক অশান্তি শুরু হতো।তোমরা ভাবতে তোমাদের বাবার চরিত্রে সমস্যা ছিল এইজন্য দ্বিতীয় বিবাহ করেছে।তোমাদের মা ও তাই বুঝাতো।তোমরা সারাজীবন তাই ই জেনে আসতে।আমার ভাই-বোন,মা-বাবাকে কিছু দিলে চু**রি করে দিতে হয়েছে আমার।

‘বাবা আম্মার বিষয়ে আমি সব-ই জানি।আম্মা তো আম্মাই। সন্তান হয়ে তার বিচার কীভাবে করি?তার পায়ের নিচে তল বেহেশত।তার সাথে উচ্চস্বরে কথা বলাও পাপ।”

শাশুড়ি শ্বশুরের দিকে অগ্নি চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘এখন সব দোষ আমার।ঠিক আছে আমি খারাপ।এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি আমি। বিয়ে করলে না কেনো তখন ? আমি কি ধরে রেখেছিলাম?এখন ছেলে বৌমাদের৷ সামনে আমাকে খারাপ প্রমাণিত করছো!

‘যাওয়ার সময় ওই কু*লা*ঙ্গা*র কে নিয়ে যাও।আর আমি সব পুরুষকে পরামর্শ দিব বউ এর নামে যেন কেউ সম্পত্তি না দেয়।’

ওশান এবার আহত শরীরে গুঙিয়ে বলে উঠল, ‘আজ এর ফয়সালা হয়ে যাক।আমি তরীকে তিন তালাক দিয়েছি।আমি আর এক সেকেন্ড ও রাখব না তরীকে।তাতে যা হয় হোক।তোমরা অকারণ আম্মাকে দোষারোপ করছো।আম্মার কোনো দোষ নেই।’

‘তোমার আম্মা যে দুইটা ভাত খাচ্ছিল তা ভাল লাগছেনা।দাঁতে রস হয়ে গিয়েছে।এমন কষ্ট আসবে জীবনে ভাত ও পাবেনা।কথায় আছেনা” সুখে থাকলে ভূ**তে কিলাই।”এই মহিলার খুব খারাপ দিন আসবে।তরীর মত মেয়েকে পেয়ে গাঁধার খাটুনি খাটিয়ে নিল।তবুও বেচারি তরী ওর মন পেল না।এমন একদিন আসবে ও তরীর মর্ম বুঝবে।’

ওশান বলল, ‘আমি বেঁচে থাকতে আম্মার কোনদিন কষ্ট হবেনা।আমি এমন মেয়ে এনে দিব আম্মাকে মাথায় তুলে রাখবে।আম্মা তুমি কোথাও যাবেনা।ওই ফকিন্নির বাচ্চারে আমার মন থেকে তালাক দেওয়া হয়ে গিয়েছে।’

আমি আবার ও তেড়ে গিয়ে বললাম, ‘মুখ দিয়ে তিন তালাক উচ্চারণ করলেই কি অত সহজে তুমি রেহায় পেয়ে যাবে?

‘মুখে না হলে আমি কাগজে কলমে তরীকে ডিভোর্স দিব।আমার জীবন এটা, আমি কী করব, কী করব না সেটা আমার ব্যাপার। কেউ জোর করে আমার উপর কিছু চাপাতে পারবেনা।’

‘আমিও তরীকে বলব আইনের সাহায্য নিতে।দেখি তুই কত দৌঁড়াতে পারিস।আমি দৌঁড় করাব তোকে।আর একটা কথা আমি তরী নই, আমি সারাহ!একটু ভেবে চিন্তে লাগতে আসিস।ফলাফল খুব একটা ভাল হবেনা ওশান।আমাকে দূর্বল মেয়ে ভাবলে খুব ভুল হবে।এমন শিক্ষা দিয়ে ছাড়ব ইতিহাসে রেকর্ড হয়ে থাকবে।
তরী ও আর থাকবেনা তোর সাথে।’

তরীর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘তুমি থাকবে ওর সাথে?’

‘না,ভাবি।আমিও ক্লান্ত।আর আমি ওর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিব না।ওর বিচার করবে আল্লাহ।’

তরী কাঁদতে কাঁদতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।রোশান স্যার তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে ওশানের দিকে তাকালেন।আমাকে ধরে নিয়ে রুমে চলে এলেন।আমি মন খারাপ করে বিছানায় বসে রইলাম।উনি আমার পাশে বসে কপালের দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘কপাল ফুলে উঠেছে কীভাবে?’

‘ও কিছুনা।’

‘বুঝতে পেরেছি।ওশান কে মা**র টা কম দেওয়া হয়ে গিয়েছে।’

আমি চুপ হয়ে রইলাম।মনের মাঝে অশান্তি লাগছে।কিছুই ভাল লাগছে না।কী করব এখন! আমি যদি এই মুহূর্তে কিছু মানুষের সমস্ত যন্ত্রণা মুছে দিতে পারতাম।তরীর সব যন্ত্রণা যদি মুছে দিয়ে একটা সুন্দর জীবন দিতে পারতাম!ছোঁয়াকে সব অশান্তি থেকে মুক্তি দিতে পারতাম তবেই বোধহয় শান্তি পেতাম।উনি কখন উঠে গিয়েছিলেন জানিনা।এক টুকরো বরফ এনে কপালে ডলে দিতে দিতে বললেন,

‘বা**ঘি**নীর মন খারাপ কেনো?’

‘আমি বা**ঘি**নী?’

‘তবে সন্দেহ আছে কোনো?এই অসুস্থ শরীরে যদি এত তেজ থাকে তাহলে সুস্থ থাকলে কী করতে আজ?’

‘আমার মাথা ঠিক ছিল না।রাগলে আমার মাথা কাজ করেনা।’

‘বুঝতে পেরেছি বিষয়টা।’

‘কী?’

‘আমার ফিউচার দেখতে পাচ্ছি।’

‘কী দেখলেন।’

‘রাগী চোখের স**র্ব**না**শ!’

‘আমার চোখে স★র্ব★না★শ?’

‘ভয়ংকর সুন্দর তোমার চোখ।আমি কখনো কারো প্রশংসা করিনি।এই প্রথমবার, তাও কোনো মেয়ের।’

‘কেনো প্রশংসা করলেন?’

‘স★র্ব★না★শা চাহনি দিলে প্রশংসা তো করতেই হয়।’

কী সব বলছেন উনি!আর আজ এত রেগে গেলেন কেনো?আমি যেন স্পষ্ট দেখলাম আমাকে ধাক্কা দেওয়াতে উনি রাগ কন্ট্রোল করতে পারলেন না।এসবের মানে কী?কেনো করলেন এমন।আমি যা ভাবছি সেটাও কী সম্ভব।ইশ কী লজ্জা!

আমি উনার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আমি তরীকে একটা ফোন কিনে দিয়েছিলাম,চু**রি করে।কেউ জানে না।আপনি যে বললেন বাড়িতে ফোন রেখে এসছো ওটা তরীর ছিল। বাট তরী আপনাকে ভ**য়ে বলে নি।’

‘টাকা কোথায় পেলে তুমি?’

‘আমার কিছু জমানো টাকা ছিল।আর আমার এক ফ্রেন্ডের দোকান থেকে কিস্তিতে নিয়েছি।প্রতি মাসে দুই হাজার করে দিতে হবে।’

‘আর কত বাকি আছে?’

‘আট হাজার।’

‘দোকানদারের নাম্বার আছে?
‘কী করবেন?’

‘পেমেন্ট করে দিচ্ছি আমি।উনার বিকাশ নাম্বার টা জেনে দাও।’

‘আপনি দিবেন কেনো?আমি গিফট করেছি।আমি টাকা পরিশোধ করব।’

‘এই মুহূর্তে তো তোমার কাছে টাকা নেই।কীভাবে দিবে?’

‘কিস্তিতে নিয়েছি না।আস্তে আস্তে দিয়ে দিব।আপনার টাকা নিয়ে ঋণী হতে চাইছিনা।’

‘পরে শোধ করে দিও।’

‘আচ্ছা ফর্ম ফিল-আপ ৫০০০ ফোনের ৮০০০ এই ১৩০০০’।

‘আর বাকি টাকা?’

‘কীসের বাকি টাকা?’

‘তোমাকে বিয়ে করতে আমার যে খরচ হয়েছে সেটা কে দিবে?তোমাকে সাড়ে তিন লাখ টাকার গহনা +তোমার শাড়ি চুড়ি কসমেটিক্স অন্যান্য খরচ দিয়ে আরো দেড় লাখ গেছে।আমার শেরওয়ানি, বিয়ে উপলক্ষে দাড়ি শেভ করেছিলাম এসব খরচ ও লিখে রাখো।’

‘মানে কী?বিয়ে করেছেন নাকি ব্যবসা করেছেন।আমি এত টাকা কই পাব?’
‘আমি কীভাবে জানব সেটা?’

‘আপনাকে কি বলেছিলাম আমাকে বিয়ে করুন?’

‘আমাকে দেখে ক্রাশ খাবা আবার বিয়ে করবা না তাতো হতে পারেনা।’

‘আপনাকে দেখে আমি কবে ক্রাশ খেয়েছি?

‘ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে কেনো?মেয়েদের অত্যাচারে কালো হয়েও শান্তি নেই।’

‘স্যার এর দিকে তাকালেও দোষ!আর আপনি মোটেও কালো নন।’

‘তাহলে?’

‘শ্যামসুন্দর!’

চলবে,,?