একটি সাঁঝরঙা গল্প পর্ব-১৬+১৭

0
109

#একটি_সাঁঝরঙা_গল্প
#তানিয়া_মাহি
#পর্ব_১৬

নিশো তোয়ার ফোন পাওয়া মাত্র থানায় এসেছে। জাফর ইকবাল সাহেবকে থানার মধ্যে একটা বেঞ্চিতে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তিনি পিছনে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছেন।

রাত নয়টা বেজে গিয়েছে। অন্যান্য দিনে রাস্তায় কোন প্রকার জ্যাম থাকে না কিন্তু আজ অনেকদূর পর্যন্ত গাড়ির লাইন। কোনভাবেই, কিছুতেই এগুচ্ছে না। গাড়িতে বসিয়ে এক সেকেন্ড কাটানোও যেন সম্ভব হচ্ছে না নিশোর পক্ষে৷ সে যখন বুঝলো এই জ্যাম ছাড়তে অনেকক্ষণ সময় লাগবে তখন সে গাড়িওয়ালাকে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে রাস্তার এক পাশ দিয়ে ছুঁটতে শুরু করল।

বাবার এমন অবস্থায় কোন ছেলে স্থির থাকতে পারে? নিজের ইচ্ছেতে বা অন্যের ইচ্ছেতে সময় ব্যয় করতে পারে? বাবা-ছেলের কথা নেই, অভিমানে কেটেছে বেশ কয়েকটা মাস তাই বলে কী এতগুলো বছরের ভালোবাসা উধাও হয়েছে না-কি?

নিশো ছুঁটলো। তাকে ভীষণ ক্লান্ত,পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছে। মিনিট পনেরো দ্রুত গতিতে হেঁটে থানার গেইটে পৌঁছে শ্বাস টানলো সে। এতখানি পথ এভাবে হেঁটে আসায় হাঁপাচ্ছে সে। থানার গেইটের দারোয়ান নিশোকে দেখে এগিয়ে এলো। নিশো হাটুতে দুই হাতে ভর দিয়ে উঁবু হয়ে জোরে জোরে শ্বাস ফেলছিল। দারোয়ান এগিয়ে এসে নিশোর পিঠে হাত রাখলো।

“আব্বা, আপনে!”

নিশো মাথা বাঁকিয়ে একপাশে উঁচু করে দারোয়ানকে দেখে ভাঙা ভাঙা শব্দে বলল,“চাচা, একটু পানি হবে?”

লোকটা নিজের জায়গায় ফিরে গেল। সেখানে রাখা পানির বোতলটা নিয়ে আবার নিশোর কাছে ফিরে এসে বোতলটা নিশোকে ধরিয়ে দিল। নিশো একটা জায়গা খুঁজে সামান্য সময়ের জন্য বসে কিছুটা পানি ঢকঢক করে খেয়ে নিল। বোতলটা দারোয়ানকে ফিরিয়ে দিয়ে বলল,

“ধন্যবাদ, চাচা। ভালো আছেন তো?”

লোকটা মৃদু হেসে বলল,“আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ অনেক ভালো রেখেছে৷ তা তুমি এখানে কেন? দৌঁড়ে এসেছ? হাঁপাচ্ছিলে যে!”

নিশো থানার দিকে ইশারা করে বলল,“আমার বাবাকে নিয়ে এসেছে। কারণটা এখনো জানি না। আমার ভেতরে যেতে হবে, চাচা। পরে সব বলব ইন শা আল্লাহ। ”

নিশো আর এক মুহূর্ত সময় ব্যয় করল না। থানার ভেতরের দিকে আবার ছুটে গেল। দারোয়ান নিশোর যাওয়া দেখে কষ্টের হাসি হেসে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন,

“আমারে এমন একটা ব্যাটা কেন দিলা না, আল্লাহ?”

নিশো ভেতরে ঢুকতেই সামনের দিকে একটা বেঞ্চিতে বাবা জাফর সাহেবকে দেখতে পেল। অনাথের মতো চোখ বন্ধ করে দুটো হাত একসাথে করে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছেন তিনি। বাবাদের অসহায় দেখতে সন্তানদের ভালো লাগে না। নিশো দরজায় দাঁড়িয়েই থমথমে গলায় বলে উঠল,

“বাবা!”

জাফর সাহেব পরিচিত কণ্ঠে বাবা ডাক শুনে দরজার দিকে তাকালেন। নিশোকে দেখে বুকের ভেতর থেকে হাহাকার বেরিয়ে আসতে চাইছে কিন্তু পুরুষ মানুষ তো কষ্ট খুব সহজে প্রকাশ করতে পারে না। জাফর সাহেবও পারলেন না। শুধু মলিন মুখে, নির্জীব ভঙ্গিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

নিশো দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে বাবার পায়ের কাছে বসলো। মৃদু গলায় শুধালো,

“কী হয়েছে, বাবা?”

জাফর সাহেব মায়ামাখা চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। নিশোর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,

“ওরা আমাকে ধরে এনেছে। আমি নাকি ডেট এক্সপায়ার্ড পণ্য বিক্রি করি।”

নিশো পিছনের দিকে তাকিয়ে কয়েকজনকে দেখে আবার বাবার দিকে তাকালো। নিচুস্বরে বলল,

“পেয়েছে কিছু?”

জাফর ইকবাল সাহেব ওপর-নিচ মাথা ঝাঁকালেন। বললেন,“ কীভাবে এলো বুঝতে পারলাম না। আমি তো প্রতিমাসে ডেট চেইক দেই। দোকানের ছেলেটাকে দিয়েও চেক দেওয়াই কিন্তু ডালের প্যাকেটগুলো কীভাবে এরকম হলো বুঝতে পারলাম না।”
“শুধু ডালের প্যাকেট?”
“না।”
“আর কী কী?”

জাফর সাহেব মাথা চুলকালেন তারপর বললেন,“ডাল, সসের কৌটো, কয়েকটা কোম্পানির বিস্কিটের প্যাকেট ওহ হ্যাঁ তেলও। দুই একটা করে প্যাকেট, বোতল করে আছে।”
“ওগুলো কি নিয়ে এসেছে নাকি ওখানেই আছে?”

“ওখানেই আছে। দোকান তালা দিয়ে চাবি নিজেদের কাছে রেখেছে। আমাকে তুলে এনেছে। আমি তো ভেবেছিলাম আমাকে বাঁচাতে কেউ আসবে না।” বলেই অন্যদিকে মুখ ঘুরালেন জাফর সাহেব।

নিশো উঁঠে দাঁড়ালো। বাবাকে ধরে তুলে দাঁড় করালো আর তারপর বাবাকে নিয়ে বসে থাকা অফিসারের দিকে এগিয়ে গেল। চেয়ার পিছিয়ে দিয়ে বাবাকে বসতে বলল। জাফর সাহেব অফিসারের দিকে তাকালেন। তার সম্মতির অপেক্ষায় রইলেন। অফিসার ভদ্রতার সাথেই বললেন,

“বসুন।”

জাফর সাহেব বসতেই নিশো বলে উঠল,“দোকানে কয় পদের ডেট এক্সপায়ার্ড পণ্য পেয়েছেন?”

অফিসার নিশোর দিকে তাকিয়ে শুধালো,“আপনি উনার কে হন?”

নিশো অফিসারের দিক থেকে চোখ সরিয়ে বাবার দিকে তাকালো। দুই হাত দিয়ে বাবার দুই কাঁধ স্পর্শ করে বলল,

“উনি আমার বাবা।”

অফিসার মৃদু গলায় বলল,“ওহ আচ্ছা। প্রায় সাত রকমের পণ্য হয়তো পাওয়া গিয়েছে।”
“বাবা বলছেন, দোকানে এরকম পণ্য থাকার কথা নয়।”
“আমরা পেয়েছি ইভেন ওগুলো দোকানেই আছে।”
“আশেপাশের কোন দোকান চেক দিয়েছেন নাকি সরাসরি আমাদের দোকানে গিয়েছেন?”
“একটা আননৌন নম্বর থেকে কল এসেছিল। তারপর আমরা গিয়েছি।”
“আমার মনে হয় এটা চক্রান্ত।”
“কেন মনে হলো?”
“হয়তো কেউ বাবাকে পছন্দ করেন না তাই এরকম করে বাবাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে।”

অফিসার একটা কাগজ খুঁজে বের করে নিশোর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,“ ফাঁসানোর মতো কিছু দেখিনি। এটা নিন। জরিমানা দিয়ে বাবাকে নিয়ে যাবেন।”

নিশো কাগজ হাতে নিয়ে দেখল। দেড় লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিশো। জাফর সাহেব নিশোর দিকে তাকালে শুকনো হাসি হেসে বাবাকে বলল,“বাবা, চিন্তা করবে না। আল্লাহ আছেন। তিনি ঠিক কিছু না কিছু করবেন।”

হঠাৎ ফোন বেজে ওঠায় নিশো চমকে উঠল। পকেট থেকে ফোন বের করে দেখল জাভেদ সাহেব কল করেছেন৷ বাবার সামনে কল রিসিভ করবে কি না ভাবতে থাকলো সে। অতঃপর ভাবনার ইতি টেনে কলটা রিসিভ করে ফেলল। জাভেদ সাহেব ওপাশ থেকে থমথমে গলায় বলে উঠলেন,

“কী হয়েছে রে, আব্বা?”

নিশো বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,“চাচা, বাবাকে পুলিশ থানায় এনেছে। দোকানে মেয়াদোত্তীর্ণ কয়েকটা জিনিসপত্র ছিল।”
“কী বলছে অফিসার?”
“দেড় লাখ টাকা জরিমানা করেছে।”
“ভাই ঠিক আছে তো?”
“ঠিক থাকার তো কথা না।”
“ওখানে কোন অফিসার বসে আছে? নাম শুনে জানা তো, বাপ”

নিশো ফোনটা হোল্ড করে অফিসারের দিকে তাকালো। বলল,“স্যার, আপনার নামটা?”

অফিসার নিশোর দিকে তাকিয়ে বিরসমুখে বলল,“ আনাস, আনাস রহমান।”

নিশো এবার ফোন কানে নিল। বলল,“উনার নাম আনাস রহমান।”

জাভেদ সাহেব হাসতে হাসতে বললেন,“ওহ আচ্ছা উনি! ফোনটা দে তো, বাবা। উনার কাছে দে। আর আমি আবিরকে থানায় পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

নিশো ফোনটা অফিসারের দিকে এগিয়ে ফোনটা এগিয়ে দিল। অফিসার ফোনটা নিয়ে মিনিট দুয়েক কথা বললেন। হেসে হেসে কথা বলা দেখে নিশো একটু আলোর দেখা পাচ্ছে। হঠাৎ দোকানের সিসিটিভির কথা মনে পড়তেই নিশো বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“বাবা, ক্যামেরার কথা তুমি ছাড়া আর কি কেউ জানে?”

জাফর সাহেব নাবোধক মাথা ঝাঁকালেন। যার অর্থ কেউ জানে না। নিশোর মুখে হাসি ফুঁটলো। সে নিশ্চিত কেউ জেনে-বুঝে এমন কাজ করে তার বাবাকে ফাঁসিয়েছে। হতে পারে তাদেরই পাশের দোকানী। কারণ তারা চায় না জাফর সাহেব দোকান নিয়ে ওখানেই থাকেন। ভেতরে ভেতরে কিছুটা শত্রুতা সে খেয়াল করেছে।

অফিসার কথা শেষ করে নিশোকে ফোন এগিয়ে দিতেই নিশো বলে উঠল,“ স্যার আমার সন্দেহ হচ্ছে, একজন আমার বাবাকে ঠকাচ্ছে। দোকানে ক্যামেরা লুকোনো। আমি আর বাবা ছাড়া কেউ জানে না। ক্যামেরা দেখলে সবাই সতর্কতার সাথে হায় সাফাই করে বলে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। ওটা চেক করলে কিছু পাওয়া যেতে পারে। আপনি যদি অনুমতি দিতেন আমি ওটা দেখে আপনাকে জানাতাম।”

আনাস রহমান উঠে দাঁড়ালেন। টুপিটা মাথায় দিয়ে বললেন,“চলুন তবে। আর আপনার বাবাকে বাসায় নামিয়ে দিই চলুন।”

নিশো মৃদু হেসে বাবার দিকে তাকালো। সে জানে জাভেদ সাহেব সবটা সামলে নেবেন। আল্লাহর রহমতে উনি কথা বললে সব কিছুটা সহজ হতে পারে এটা নিশো জানতো। যার ধনসম্পদ, প্রতিপত্তি বেশি তার কথার জোরও বেশি।

নিশো বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,“বাবা, তোমার ভাই এবারেও তোমার ভাই হিসেবেই পাশে দাঁড়ালো। তুমিই মানুষ চিনলে না।”

নিশোর কথার পর জাফর সাহেবকে চুপচাপ এবং অন্যমনস্ক দেখালো। তবে কি ভাইকে নিয়ে ভাবা শুরু করলেন? নিজের করা ভুলের জন্য অনুতপ্ত হলেন!

নিশোর বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত বারোটা পার হলো। বাবাকে সে অনেক আগেই বাড়িতে পাঠিয়েছিল। সে নিজেই আবিরকে সাথে নিয়ে অফিসারের সাথে সবটা সামলেছে। সিসিটিভিতে মুখ্য আসামী ধরা পড়েছে। দোকানে থাকা ছেলেটাই মনিবের সাথে এমন নিমক হারামীটা করেছে। দোকান থেকে প্রমাণ-সমেত ছেলেটার বাড়িতে যাওয়া হয়েছিল। সে বাড়িতে নেই। পালিয়েছে। কোনভাবে হয়তো খবর পেয়েছে তার সম্পর্কে সবাই সবটা জেনে গিয়েছে তাই সে ধরা পড়ার ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। যদিও অফিসার ছেলেকে না পেয়ে বাবাকে ধরে আনতে চেয়েছিল কিন্তু নিশো বাধা দিয়েছে। তার মতে, ছেলের কৃতকর্মের শা*স্তি বাবার পাওনা নয়।

নিশো কলিং বেল চাপলেই সাথে সাথে দরজা খুলে গেল। ওপাশে বাবাকে দেখে একটু অবাক হলো নিশো। জোরপূর্বক হেসে ভেতরে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দিল সে। জাফর সাহেব নিশোকে একা দেখে বললেন,

“আবির কই?”

নিশো বাবার কথায় এবার অবাক হলো। এর আগে কখনো ওদের বাড়ির কারো কথা জানতে চায়নি মুখ ফুঁটে। সে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,

“ও বাসায় চলে গেছে। তোমার দোকানে থাকা ছেলেটা এই অকাজ করেছে। সে হয়তো মেয়াদোত্তীর্ণ জিনিস লুকিয়ে রেখেছিল। পুলিশকে সে নিজেই খবর দিয়েছে। তোমার ওপর রাগ ছিল?”

জাফর সাহেব দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। একটু ভেবে বললেন,”জিনিস চুরি করতো মাঝেমাঝেই। সেদিন রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে তিন চারজনের সামনে চড় দিয়েছিলাম তাই বলে এত বড় ক্ষতি করবে!”

#চলবে…….

#একটি_সাঁঝরঙা_গল্প
#তানিয়া_মাহি
#পর্ব_১৭

“শোন আপু, তুমি আজ বাড়িতে না আসলে তুমি তোমার ইচ্ছেমতো যেদিন বাড়িতে আসনে সেদিন কিন্তু আমিও দেখা করব না, কথাও বলব না। আমার নামও ইনাম ইয়াদ মনে রেখো, মাথায়ও রেখো। আমি এক কথার মেয়ে।”

ইনাম সকাল সকাল তোয়াকে ফোন করেছে। কোন এক জরুরি কাজে তার বাড়িতে যেতে বলছে। এদিকে তোয়ার টিউশনি আছে। বাড়ির কাজে মাকে সাহায্য করতে হয়। কাজের বেশি প্রেশার নিলেই রূম্পা বেগম অসুস্থ হয়ে পড়েন। সবকিছু ভেবে দেখল তোয়ার কিছুতেই যাওয়া হবে না। সে চাপা গলায় বলল,

“দিনে দিনে ব্যস্ততা বাড়ছে। মাকে কাজে সাহায্য করতে হয়। কালকে ভাইয়ার পরিক্ষা। আজকে কীভাবে তোর ওখানে যাই বল?”

ইনাম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,“ওহ কালকে ভাইয়ার পরিক্ষা? আমার খেয়াল ছিল না। তাহলে কী করব?”
“যেতে বলছিস কেন সেটা বল?”
“কালকে উনার সাথে দেখা করতে যাব। ভাবলাম রাতে আমি আর তুমি একসাথে গল্প করে কালকে তোমাকে সাথে নিয়ে দেখা করতে যাব। তুমি না বড় আপু।”

তোয়া এবার বিষয়টা বুঝল। সে বলল,“অ্যাই গাধী, তুই কোথায় দেখছিস যে বিয়ের আগে হবু বরের সাথে দেখা করতে বড় বোনকে কেউ নিয়ে যায়! কাউকে সাথে নিলে মন খুলে কথা বলবি কীভাবে? আর তোর বাপ এত তাড়াতাড়ি তোর বিয়ে কেন দিচ্ছে সেটাই বুঝতে পারছি না। মাত্র কলেজের মুখ দেখলি আর এখনই বিয়ে?”

ইনাম কিছু বলল না। তোয়া ইনামকে চুপ থাকতে দেখে বলল,“তুই না আবির ভাইয়াকে পছন্দ করতি?”

ইনাম এবার একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল,“তুমি আবির ভাইয়াকে নিয়ে পড়ে আছ? এর আগে আমি অন্যকাউকেও পছন্দ করতাম ভুলে গেছ? আবির ভাইয়াকে বিরক্ত করতে ভাল্লাগে তাই ওরকম করতাম। মামাতো ভাইয়ের সাথে বিয়ে বসবে কে? এমনিই মামিরা দেখতে পারে এটাই অনেক। শাশুড়ি হইলে দাঙ্গাল বাধবে। থাক বাবা তার চেয়ে আমার বাপ যাকে ঠিক করেছে তাকেই বিয়ে করে নিই। বাপের মনে কষ্ট দিতে চাই না। বড় কথা হচ্ছে লোকটা ভালো আছে।”

তোয়া উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল,“কোন লোক?”
“আরে যার সাথে আমার বিয়ে হবে।”
“তুই দেখেছিস?”
“হ্যাঁ।”
“বাসায় এসেছিল?”
“হ্যাঁ। উনার মা-বাবা, ছোট বোন আর উনি এসেছিলেন। সবাই অনেক ভালো, জানো!”

তোয়া মৃদু হেসে বলল,“তোর ভাগ্যটা অনেক ভালো হোক, ইয়াদ। তুই অনেক ভালো থাক ওই মানুষটার সাথে যাকে আল্লাহ আগে থেকে তোর জন্য ঠিক করে রেখেছেন।”
______

আজ নিশোর পরিক্ষা। রাতের শেষভাগে ঘুম থেকে উঠেছে সে। ঘুমোনো মানেই সময় নষ্ট করা ভেবে রাত সাড়ে তিনটার দিকে এলার্ম সেট করে রেখেছিল। মাসখানেক হলো এই রুটিন মাফিক চলছে সে। এলার্ম বেজে উঠতেই বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো। এলার্ম বন্ধ করে ওয়াশরুমে চলে গেল। দশ মিনিট পর একদম ফ্রেশ হয়ে ওযু করে বেরিয়ে এলো। জায়নামাজ নিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে গেল। একাধারে তাহাজ্জুদ, তিলাওয়াত শেষ করে রান্নাঘরে চলে গেল। রূম্পা বেগম উঁঠেছেন। চারদিকে ফজরের আজানের ধ্বনিতে চারদিক মুখরিত হচ্ছে। ছেলেকে রান্নাঘরে দেখে রূম্পা বেগম এগিয়ে এলেন।

শান্তস্বরে বললেন,“আমি চা করে দেই?”

নিশো মৃদু হেসে বলল,“না মা, আমি করে নিতে পারব। তুমি নেবে এক কাপ?”
“আমি নামাজ পড়ে খাব। তুই খা। বিস্কিট আছে র‍্যাকে। নিস ওখান থেকে।”
“ঠিক আছে।”
“আচ্ছা শোন।”
“জি।”

“তোর বাবা বলল..” থেমে গেলেন রূম্পা বেগম। কথাটা মন ভালো করার মতো হলেও এর আগে সেভাবে ঘটেনি তাই সঙ্কোচবোধ করছেন তিনি।

নিশো কাপে চা ঢালতে ঢালতে বলল,“থেমে গেলে কেন? বলো।”

রূম্পা বেগম ঘরের দিকে দেখে নিশোর দিকে তাকালেন। মৃদু হেসে বললেন,“তোর বাবা তোকে একটু অপেক্ষা করতে বলল। মসজিদে আগেই যাস না।”

চায়ের কাপ নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো নিশো। অবাক হয়ে বলল,“বাবা আমার সাথে মসজিদে যাবে?”

রূম্পা বেগম ওপর নিচ মাথা নাড়লেন। মুচকি হেসে বললেন,“আলহামদুলিল্লাহ বল। সবকিছু ঠিক হতে শুরু করেছে।”

নিশোও ঠোঁটে হাসি লেপ্টে বলল,”আমাকে ডাক দিতে বোলো। আমি ঘরেই আছি।”

নিশো ঘরে চলে গেল। ফালাকের কথা মনে পড়ছে তার। বাবাকে থানা থেকে ছাড়িয়ে আনার পর মোটে একবার কথা হয়েছিল তাদের। শুধু বাড়ির পরিবেশ আর বাবার কথা জানিয়েছিল তাকে। ফালাক হেসে বলেছিল- “দেখেছেন! বিপদ সবসময় হতাশা নিয়ে আসে না। আল্লাহ বিপদের পরপর সুখ দেন। এই বিপদটা প্রয়োজন ছিল। এবার আপনি ভালোভাবে নিশ্চিন্তে পরিক্ষা দিন আর আমাকে জিতে নিন। এই সুযোগ বারবার পাবেন না। এই ফালাককে হারালে কাঁদতে হবে আড়ালে, বুঝেছেন!”

সেদিনের পর দুজনের আর কথা হয়নি। নিশো নিজেও চায় না তাদের কথা হোক বা সাক্ষাৎ হোক। এখনই এভাবে ভালোবাসা এত প্রকাশ না করে মাস দেড়েক অপেক্ষা করা যাক। তবে আজ সে পরিক্ষা দিতে যাওয়ার আগে ফালাকের সাথে কথা বলবে বলে ঠিক করল।

চায়ে শেষ চুমুক দিতেই বাহির থেকে জাফর সাহেবের গলা শুনতে পেল নিশো। “আসছি, বাবা।” বলেই চায়ের কাপটা টেবিলের ওপর রেখে বেরিয়ে এলো। বাহিরে এসে দেখল জাফর সাহেব সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরে দাঁড়িয়ে আছে। নিশোকে আসতে দেখেই বললেন,

“চল, বাপ। জামায়াত শুরু হবে, সময় বেশি নেই।”

নিশো আর দেরি না করে পকেট থেকে টুপি বের করে বাবার সাথে রওয়ানা দিল।

ভোরের আলো ফুঁটতে শুরু করেছে। চারদিকে স্নিগ্ধ বাতাস। এ বাতাস যেন হৃদয়কে প্রশান্ত করে দিতে যথেষ্ঠ। নামাজ শেষ করে মসজিদ থেকে দলে দলে মানুষ বের হতে শুরু করেছে। নিশো আর জাফর সাহেব একসাথেই বের হলেন। দুজন হাঁটছে বাড়ির উদ্দেশ্যে। নিশো খেয়াল করল তার বাবা তার দিকে বারবার তাকাচ্ছে। কিছু বলার চেষ্টা করছে হয়তো। নিজেই বাবার সঙ্কোচ কাটাতে বলল,

“বাবা, কিছু বলবেন?”

জাফর সাহেব আমতা আমতা করে বললেন,“বলতে তো চাচ্ছিলাম কিন্তু কীভাবে কী বলব বুঝতে পারছি না।”
“বলেন সমস্যা নেই। আমিই তো।”

জাফর সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,“আমাকে মাফ করে দিস, বাপ। আমি তোর ওপর অন্যা*য় করেছি অনেক।”

নিশো চলা থামিয়ে দিল। বাবার মুখের দিকে তাকালো। জাফর সাহেব ছেলের চোখে চোখ রাখতে পারলেন না। মুখ নিচু করে নিলেন। নিশো মৃদু গলায় বলল,

“বাবাদের ক্ষমা চাইতে হবে কেন? এত বড় করেছেন। আমার ওপর হক আছে আপনার। আমি আপনাকে সম্মান করি।”

“কম কথা শোনাইনি তো তোকে। পারলে মাফ করে দিস।” বলে দুই হাত এক করে নিশোর সামনে তুলতে গেলে নিশো খপ করে বাবার হাত ধরে হাত নামিয়ে দিল। পরক্ষণেই বাবার এক হাত নিজের মাথায় নিয়ে বলল,

“আজ আমার পরিক্ষা বাবা। এই হাত দিয়ে মাফ চেয়ে আমাকে পাপী না বানিয়ে আমার মাথায় হাত রেখে দোয়া করে দিন, বাবা।”

জাফর সাহেব রাস্তার মাঝখানেই ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন। নিশোর যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। বাবা এমন একটা কাজ করে বসবে সেটা ভাবতেই পারেনি সে। মানুষ পরিবর্তন হতে শুরু করলে বুঝি এভাবেই হয়! নিশোও সময় ব্যয় না করে আলতো করে বাবাকে জড়িয়ে পিঠে হাত রাখলো। আহ শান্তি! কে বলে বাবারা ভালোবাসতে পারে না!
____

“আজ আপনার পরিক্ষা, আপনি এখনো আমাকে কিছু বললেন না। হঠাৎ পর করে দিলেন কেন? কী ভাবছেন বলুন তো? বাড়িতে আসতে হচ্ছে না, আমার সামনে পরতে হচ্ছে না, আমিও প্রেমিকার মতো আচরণ করছি না, দিনে আঠারো ঘণ্টা কল, মেসেজ করছি না বলে কী ভাবছেন আপনি? ক্যাডার হয়ে আবার অন্যদিকে দৌঁড় দেবেন না তো? আমি কিন্তু পা ভেঙে দেব আপনার।”

নিশো পড়ছিল। মোটামুটি সবরকম বিষয়ে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে ফালাককে কল দেবে বলে ফোনটা হাতে নিয়েছিল। পাওয়ার বাটন অন করতেই দেখল চারটা মিসড্কল আর একটা মেসেজ। ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখেছিল সে। ফোন, মেসেজ কিছুই টের পায়নি এতক্ষণ।

মেসেজ পড়েই মুচকি হাসলো সে। ‘পাগলী একটা!’ বলেই কল লাগালো ফালাকের কাছে।

বাবার সাথে বসে ছিল ফালাক। ফোন বেজে উঠতেই বাবার কাছে থেকে দৌঁড়ে নিজের রুমে চলে এলো। ফোন হাতে নিতেই ফোনস্ক্রিনে নিশোর নম্বর দেখে মৃদু হাসলো তারপর আবার মুখটা গম্ভীর করে কল রিসিভ করল।

“কল করেছেন কেন?”
“নিষেধ আছে নাকি?”
“অবশ্যই আছে।”
“আচ্ছা আজকের জন্য নিষিদ্ধ কাজটা করে ফেললাম।”
“শা*স্তি ভোগ করতে হবে তবে।”
“আজ শা*স্তি?”
“ তা নয়তো কী?”
“কী শা*স্তি শুনি!”

ফালাক এবার এদিক ওদিক দেখে বলল,” একটা জরুরি কথা বলার ছিল।”
“হ্যাঁ বলো।”
“বাবা কোনকিছু না জেনে আবির ভাইয়ার বিয়ের কথা ভাবছে।”
“কোনকিছু না জেনে মানে? কী জানতে হবে?”

ফালাক ফস করে শ্বাস ফেলে বলল,“ও আপনি তো আবার ভাই হন। বোনের হয়ে আবার তেড়ে আসবেন না তো?”
“ক্লিয়ার করো।”
“এখনই যে স্বর! আচ্ছা পরিক্ষা দিয়ে আসুন পরে বলব। এটা বলতেই আর একবার শুধু কল দিব। আর দিব না প্রমিস।”

নিশো মৃদু হেসে বলল,“ প্রমিস করতে হবে কেন? আমি কল দিতে না করেছি?”
“আপনি বুঝবেন না।”
“তুমি খুব বোঝো?”
“হ্যাঁ বুঝি।”
“হুম। দোয়া করবা আমার জন্য। বের হব আধাঘণ্টার মধ্যে। যেতে হবে, গাড়ির ব্যাপার আছে আবার।”
“ভাইয়া বলল, সে যাবে আপনার সাথে।”
“তার এত সুবুদ্ধি আসে কোত্থেকে!”
“আমার ভাই বলে কথা!”
“রাখি?”
“সাবধানে যাবেন। ভালো করে পরিক্ষা দেবেন। আল্লাহ ভালো কিছু দেবেন। ভরসা রাখুন।”
“ভরসা আছে। রাখছি এখন। আল্লাহ হাফেজ। ”

“ শুনুন, কেউ আপনাকে ভালোবাসে। আল্লাহ হাফেজ।” বলেই কল কাটলো ফালাক। ফালাকের শেষ কথায় হাসি ফুঁটলো নিশোর মুখে। এই ভালোবাসাকে হেলায় হারাবে না সে।

#চলবে……