একদিন নববর্ষা পর্ব-০৬

0
108

একদিন নববর্ষা- ৬
অদ্রিজা আশয়ারী
___________

কাল রাতের প্রকৃতি ছিল জোৎস্নার আলোয় ধোয়া। অথচ তার ঠিক একদিন পর আজকের রাতের আকাশ মেঘ কালো অন্ধকার। গুড়ুম গুড়ুম শব্দে পশ্চিম থেকে আসা মেঘেরা ভেসে চলেছে পূর্বাকাশে। উত্তাল হাওয়া, চারিদিকে তার শো শো গর্জন। গাছ বাড়ি খাচ্ছে গাছের গায়ে। ধূলো উড়ছে। বাতাস ও ধূলোর আধিক্যে সামনে তাকানো দায়। তার মধ্যে দিয়ে আমি ছুটছি , যতদ্রুত সম্ভব। তবুও মনে হচ্ছে দেরি হয়ে যাচ্ছে।

বাংলোতে পৌঁছে দেখলাম গেট ভেতর থেকে বন্ধ।জোড়ে ধাক্কা দিতেই সেদিনের লোকটা বেরিয়ে এল। হ্যাজাক বাতি জ্বালিয়ে দেখল আমাকে। এই সময় আমাকে যে সে এখানে একদমই আশা করে নি সেটা তার মুখভঙ্গি দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। সে ফ্যাকাসে মুখে থতমত গলায় বলল ,
–” সাহেব!”
–“সরো, আমি ভেতরে যাব।”
লোকটা ভীত চুপসে যাওয়া মুখে একটু প্রতিবাদের রেখা ফুটল।
–“ভেতরে এখন কেউ যাবার অনুমতি নেই সাহেব। স্যারের নিষেধ আছে। ”
এর সাথে কথা বলে নষ্ট করার মতো সময় আমার হাতে নেই। ওকে ধাক্কা দিয়ে একপাশে সরিয়ে ভেতরে চলে গেলাম। লোকটা কিছুদূর আমার পেছন পেছন এসে শুধু বলতে লাগল,
–“স্যার নিষেধ করেছে। আপনি যাবেন না সাহেব..”

বাংলোর ভেতরে পা ফেলতেই গুমোট আবহাওয়া টা টের পেলাম। ভেতরে একটা অস্বস্তিকর থমথমে ভাব। নিচ তলায়, ঘরের কোণে শুধু একটা মোমবাতির শিখা দপদপ করে জ্বলছে। কারো কোনো সারাশব্দ নেই। আমি দ্রুত পদক্ষেপে ওপরে উঠে গেলাম। পাগলের মতো হাতড়ে বেড়াতে লাগলাম একেকটা দরজার নব। হঠাৎ একটা শব্দ এল কানে। কারো জোরে হেটে যাওয়া কিংবা চেয়ার টানার মতো মনে হল শব্দটা। মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে শব্দটার উৎস কোনদিকে সেটা বোঝার চেষ্টা করলাম। দোতালাটা ভীষণ অন্ধকার। তাছাড়া পুরনো আমলের বাড়ি, মোটা দেয়ালের জন্য ভেতরের খুব কম শব্দই কানে আসে। কিন্তু দরজার নিচ দিয়ে আলো তো আসার কথা। সেটা পাচ্ছিনা কেন। হঠাৎ পকেটে থাকা ফোনটার কথা মনে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে বের করে ফ্ল্যাশলাইট জ্বাললাম। আলো জ্বলতেই চোখে পড়ল সামনের বাঁক টা। সেটার ডানপাশে এক চিলতে করিডর। ওইপথ ধরে এগোতেই শব্দটা প্রথম আমার কানে এল। রাহিলের কণ্ঠ হঠাৎ গর্জে ওঠার শব্দ। দ্বিতীয় বার না ভেবে মুহুর্তে দরজা ঠেললাম। কেউ আসবে না জেনে রাহিল কাঠের দরজাটা লাগানোর প্রয়োজন মনে করেনি। ধাক্কা দিতেই ওটা খুলে গেল। ঘরের সবকিছু যেন থমকে গেল মুহুর্তে। রাহিল বিস্ফোরিত চোখে ঘুরে দাঁড়াল। তার কপালের দিকটা সামান্য চেড়া। সেখান থেকে চুইয়ে রক্ত ঝড়ছে। দৃষ্টিতে উগ্র হিংস্রতা। সে ঘরে তখন একটা মাত্র মোমবাতির শিখা দপদপ করে জ্বলছে। তার থেকে ছ-সাত হাত দূরে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বর্ষা। তার হাতে একটা কাঁচের ফুলদানি। ফুলদানিটা ধরে আছে আক্র’মনাত্মক ভাবে। আমাকে দেখে যেন বর্ষার আটকে রাখা রুদ্ধশ্বাস আবার স্বাভাবিক হলো। রাহিল ক্রোধে, বিস্ময়ে দিকবিদিকশুন্য হয়ে গর্জে উঠে বলল,
–“নাব্য, তুমি এখানে?”
এই মানুষ রূপী পশুর প্রশ্নের জবার দেয়া তখন বাহুল্য। দু-পা এগিয়ে রাহিলের কলার চেপে ধরে বললাম,
–“কেন, আমাকে এখানে একদম আশা করিস নি বুঝি? তোর সাহস হলো কি করে বর্ষাকে এখানে ডাকার? ” শেষের দিকে উচ্চগ্রামে বাজল আমার গলার স্বর।

আমার কথা শুনে রাহিল একটুও ঘাবড়ালো না। বরং হিংস্র জ্বলজ্বলে চোখে শয়তানি হাসি ফুটল।
–” রেগে যাচ্ছ কেন নাব্য? এতদিন ও তোমার সঙ্গে ছিল। একদিন নাহয় আমার সঙ্গে থাকবে। ওদের এসবে অভ্যেস আছে। তবে এই হারা’মজাদি টা সোজা কথায় রাজি হচ্ছিল না। আমার কপালে পিতলের গ্লাস ছুড়ে মেরেছে। তোমার সাথে শুতে রাজি অথচ এখানে এসেই যত ভঙ ধরেছে। ওর নখরা যদি আমি না ভাঙি…. ”

বাকি কথা শেষ করার আগেই রাহিলের মুখ বরাবর একটা ঘু’ষি পড়ল। তারপর আরও কয়েকটা ঘু’ষি দিয়ে ওকে মাটিতে ফেলে গ’লা চেপে ধরলাম। ক্রোধে তখন হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে গেছে আমার। হয়তো ওখানেই মেরে ফেলতাম। বর্ষা হঠাৎ ছুটে এসে চিৎকার জুড়ে দিল।
–“মরে যাইব, মরে যাইব। ছেড়ে দেন। অনুরোধ করছি ছেড়ে দেন। বর্ষনরে আগে খুঁজে বের করেন।”
শেষের কথাটা শুনে আমার টনক নড়ল। বর্ষনের কথাটা বেমালুম ভুলে বসেছিলাম আমি । রাহিলের কলার চেপে আবার চিৎকার করে উঠলাম,
–” কোথায় ও?”
রাহিল কাশির জন্য কথা বলতে পারল না, ভয়ে ভয়ে হাতের ইশারায় সামনের ঘরটা নির্দেশ করল।
–“ওর যদি কিছু হয় তোকে আজ আমি এখানেই খু’ন করব।”

আমি আর বর্ষা ছুটে গেলাম সেদিকে। ফ্ল্যাশলাইট টা হাতে নিলাম। বর্ষা ছিটকিনি খুলে ভেতরে বর্ষনের মুখে বাঁধা কাপড় খুলতেই সে গুঙিয়ে উঠল। ভাইবোন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করল।

ভাইকে কোলে নিয়ে অতঃপর বেরিয়ে এল বর্ষা। আমি ফের রাহিলের দিকে এগোতে চাইলে সে একহাতে আমার বাহু চেপে বলল,
–” দোহাই আর যাইবেন না। আমার ভাইটা খুব ভয় পাইতাসে। ”
বর্ষা তার ভাইয়ের কথা বলল। কিন্তু তার নিজের অবস্থা ও যে খুব সুবিধের নয় আমি বুঝলাম। বর্ষনকে ওর কোল থেকে নিয়ে অন্যহাতে ওকে ধরে সিড়ি ভেঙে নামতে শুরু করলাম। বাইরের ঝোড়ো হাওয়া ততক্ষণে ঝুম বৃষ্টিতে রূপ নিয়েছে। ভেতরের এই বৈরীতায় ভুলতে বসেছিলাম বাইরের বৈরভাবকে। বৃষ্টির মধ্যেই চলতে শুরু করবো কিনা ভাবতে ভাবতেই বর্ষা হঠাৎ কথা বলে উঠল। এত অন্ধকার যে কিছু স্পষ্ট দেখার সুযোগ নেই। গলার স্বর শুনে মনে হলো সে কাঁদছে।
–“এইখেনে আর এক মুহুর্ত ও না। চলেন।”
বর্ষা আর আমি একযোগে নেমে পড়লাম পথে, শীতল অন্ধকার রাতের ঝুম বৃষ্টিতে। বর্ষন দুহাতে আমাকে ধরে কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে আছে। আমার সাদা পাঞ্জাবি বৃষ্টির তোড়ে লেপ্টে গেছে গায়ের সাথে। আমি একহাতে বর্ষনকে ধরে রাখলাম। অন্যহাতে বর্ষার হাতটা নিয়ে নিজের বুকের কাছে চেপে আকাশের দিকে চেয়ে একটা বড় স্বস্থির নিশ্বাস ফেললাম। বর্ষা অন্য হাতে আমার বাহু চেপে ধরে রইল। আল্লাহ আজ অনেক বড় বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন। বর্ষার কিছু হয়ে গেল কি হতো! ভাবনাটা আসার সঙ্গে সঙ্গে আমি একটা কথা বুঝলাম। বর্ষাকে আমি কতটা ভালোবাসি। বুঝলাম তাকে ছাড়া পৃথিবীতে আর কাউকে আমি কখনো এত ভালোবাসিনি। বাসতেও পারবোনা হয়তো কোনোদিন।

মাঝপথেই রশুর সাথে দেখা। সে টর্চ হাতে নিয়ে ছাতা মাথায়, আমাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। বর্ষা তাকে দেখে আমার হাত ছেড়ে দিল। রশু এগিয়ে এসে আমাদের দেখতে পেয়ে নিজে ভিজে ছাতা বাড়িয়ে ধরল আমাদের দিকে। আমাদের তিনজনকে একসাথে দেখে অবাক হয়েছে ভীষণ।
–” নবুদা, কোথায় গেছিলেন আপনি? ভেবে ভেবে আমার জান যাওয়ার জোগাড়। ভয় হচ্ছিল আগের বারের মতো নদী আপনাকে আবার টেনে নিয়ে গেল কিনা!
তাছাড়া ওদেরই বা কোথায় পেলেন? করিমন খালা ভীষণ চিন্তা করছেন। এতো রাত হল, তার ওপর বৃষ্টি। ওরা দুজন কিভাবে ফিরবে তাই ভেবে।”

রশুর বলার ভঙ্গিতে বুঝলাম করিমন খালা মানে বর্ষার মা। তার মায়ের ওপর আমার তখন ভীষণ রাগ। নাম শুনেই ভেতর টা কঠিন হয়ে গেল। টাকার জন্য লোভী ছাড়া আর কেউ নিজের মেয়েটা এভাবে বাঘের হাতে ছেড়ে দেয় না। এখানে বর্ষা রাঁধতে আসে। সেই সূত্রেই আমি পেয়েছি তার দেখা। তবুও বর্ষার এভাবে পরের বাড়ি রেঁধে দেয়ার ব্যাপার টা আমার অপছন্দ। প্রতুত্তরে কেবল
-“চলো।” বলে হাটতে শুরু করলাম।

সকালেই খবর পেলাম রাহিল তার দলবল নিয়ে বাংলো ছেড়ে চলে গেছে। এবার অবশ্যি আমাকেও ফেরার আয়োজন করতে হয়। রশু কদিন ধরেই কথাটা মনে করিয়ে দিচ্ছে। প্রায় মাস পেরোতে চলল। এবার অন্তত একবার ফেরা উচিত। কিন্তু বর্ষাকে ছেড়ে যেতে হবে ভাবতেই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। চলে গেলে আবার কবে ফিরব…ততদিন বর্ষার সাথে যোগাযোগ পুরোপুরি বিছিন্ন থাকবে। তবুও যে যেতে হবে।

রশু এবার অনুমতি পেয়েই বন্দোবস্ত শুরু করে দিল। দুদিন পর আমরা যাত্রা শুরু করবো গরানবন ছেড়ে।

***

পিঙ্গল সন্ধ্যার আকাশে, সূর্য তখন বিদায় জানাচ্ছে পৃথিবীকে। আমি বসে আছি মাচায়। মাচার অন্যপাশে বর্ষা বসে পা দোলাচ্ছে। তার কানে গোঁজা নাগ চাঁপা ফুল, হাতে গাঢ় লাল রেশমি চুড়ি। পড়নে ঘিঁয়ে রঙা জমিনের, সোনালী পাড়ের সুতির শাড়ি। শেষ বিকেলের আলোয় আমার পাশে বসে থাকা, কানে ফুল গোঁজা মেয়েটিকে অপার্থিব দেখাচ্ছে। সে গুনগুনিয়ে গান গাইছে ফুরফুরে মেজাজে। এই মুহুর্তে বর্ষার মন খারাপ করিয়ে দেওয়ার মতো একটা খবর আমার কাছে আছে। তবে এখন সেটা বলতে একদমই ইচ্ছে হচ্ছে না।
হঠাৎ দেখলাম গান বন্ধ করে বর্ষা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমিও তার দেখাদেখি ভ্রু উঁচু করলাম। বর্ষা এবার হেসে ফেলল।
–” কি হইসে?”
–” কিছু না। ”
বর্ষা মাথা কাত করে আদুরে গলায় বলল
–” মন খারাপ? ”
–” উহু। ”
–” বলেন না।”
আমি বড় করে একটা নিশ্বাস ফেললাম।
–“কাল চলে যাচ্ছি। রশু সব বন্দোবস্ত করে ফেলেছে।” বলেই আমি ব্যাস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালাম। হঠাৎ বর্ষাকে রেখে হাটতে শুরু করলাম কুঠি বাড়ির দিকে। বর্ষা বিহ্বল হয়ে সেখানে বসে রইল। পরো মুহুর্তেই আমি ফিরে এলাম। বর্ষার সামনে দাঁড়িয়ে তার হাত টেনে নিয়ে গুঁজে দিলাম হাজার টাকার দশটা নোট।

চলবে….
অদ্রিজা আশয়ারী