একদিন নববর্ষা পর্ব-০৫

0
132

একদিন নববর্ষা – ৫
অদ্রিজা আশয়ারী
___________

বর্ষার মুখটা একখন্ড আদ্র মেঘের মতো হয়ে উঠল। ছুঁলেই যেন বৃষ্টি হয়ে ঝড়তে শুরু করবে। সেই আদ্র মেঘের খন্ডের ওপর আঁকা, ভাসা ভাসা চোখ দুটো খনে খনে আমার দিকে ভীত দৃষ্টিতে চাইছে, ফের চোখ সরিয়ে নিচ্ছে। দেখে আমি মুহুর্তে কাগজের কথা ভুলে বর্ষার ভয় কাটাতে ব্যাস্ত হয়ে উঠলাম। স্বর যথাসম্ভব শান্ত রেখে বললাম,
–” পুড়ে গেছে তাতে কি হয়েছে! আমি আবার লিখব। ওটা কোনো বড় ব্যাপার নয়। তাছাড়া দোষ আমারই ছিল। কাগজগুলোতে চা পড়েছিল। ওগুলোকে বাজে কাগজ ভাবার যথেষ্ট কারণ আছে। আমারই উচিত ছিল বেরোনোর আগে ওগুলোকে সরিয়ে রেখে যাওয়া। ”
মুহুর্তে আমার অবস্থার এই পরিবর্তন অবাক করল সামনের দুজনকে। আমার কথা শুনে বর্ষা ঝট করে একবার তাকাল আমার দিকে। সে কি কিছু একটা বুঝল? বুঝুক!
আমি আদতেই আনকোরা। কাউকে ভালোবেসে, দুনিয়াকে চিৎকার করে জানিয়ে, দুদিনেই সেই প্রেয়সীকে সম্পুর্ণ অধিকার করে নেয়ার মতো দক্ষ প্রেমিক আমি নই।

বর্ষার মুখের মেঘ কাটতে শুরু করেছে। রঙ ফিরছে ধীরে ধীরে। সে নিচু স্বরে বলল,
–“আমি যাবো?” সেই স্বরে স্পষ্ট একটা স্বস্তির ইঙ্গিত।

–” যাও।”

বর্ষা চলে গেল। আমি রশুর দিকে তাকালাম। সে ভুত দেখার মতো চমকে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি অস্বস্তি নিয়ে জানালার দিকে মুখ ফেরালাম। রশু থমথমে স্বরে বলল,” নবুদা, আপনি ঠিক আছেন তো? ”
গলা ঝেড়ে দূর্বল প্রতিবাদী স্বরে বললাম,” ঠিক থাকবো না কেন?”

–“না… এইমাত্র যা কিছু বললেন। সেসব দেখে আপনি ঠিক আছেন কিনা মনে সন্দেহ জাগল। ” রশু অল্পক্ষণ থামল।
–” আপনার মা অর্থাৎ চাচী আম্মা ছাড়া আর কারো সাথে আপনাকে এতটা কোমল হতে দেখিনি। বর্ষার সাথে হঠাৎ এত মেপে কথা বলার কারণ? ” রশু প্রশ্নাতুর চোখে তাকিয়ে উত্তর টা যেন নিজেই খুঁজে নিল। সে সামান্য হাসল৷ বারো বছরের পরিচয়ে এই প্রথম রশুর সাথে চোখাচোখি হতে লজ্জা পেলাম আমি।

***

তখন রাতের প্রথম প্রহর। বাইরে নিশুতি আঁধারের মধ্যে দিয়ে শুক্লপক্ষের চাঁদটা সবে পূর্বাকাশে উঠতে শুরু করেছে। চাঁদের চারপাশে হলুদ বলয়। শহরে রাতের আকাশে, চাঁদ মধ্যাকাশে স্থির হওয়া পর্যন্ত তার দেখা পাওয়া যায় না সাধারণত। আকাশচুম্বী অট্টালিকা গুলোর আড়ালে হলুদ আভা ছড়িয়ে, চাঁদ তৈরি হতে থাকে মধ্যাকাশে তার রূপালী আলো নিয়ে স্থির হওয়ার জন্য।
কিন্তু এখানে সন্ধ্যের আগেই গাছের ফাঁকে দেখা পাওয়া যায় আলোহীন পূর্ণ চাঁদের।
রাত বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে সে চাঁদের আলোর তীক্ষ্ণতা।

আমি বসে আছি কুঠি বাড়ির সামনে, বাঁশের মাচার একপাশে। মনে হচ্ছে চাঁদ দেখার সুবিধার্থেই যেন এই মাচা তৈরি। একটা মিহি বাতাস বয়ে চলেছে। আশেপাশের ঝোপগুলোতে ঝিঁঝি পোকাদের দিকভ্রান্ত আর্তনাদ। একটু দূরে রশু বর্ষনের সাথে কোনো একটা বিষয়ে গুরুতর আলাপে ব্যাস্ত। এখান থেকে রান্নাঘরের একাংশ নজরে আসে। বর্ষা সেখানে পিদিমের গৈরিক আলোর নিচে ব্যাস্ত রান্নায়।

রশু হঠাৎ আমার দিকে এগিয়ে এল। বর্ষন তখনো আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে কি একটা আবোলতাবোল ছড়া কাটছে।
–“নবুদা, আমি ওদেরকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি। ”

আমি রান্নাঘরের দিকে ফিরলাম।
–“বর্ষার কাজ শেষ হয়নি বোধহয়। তুমি বর্ষনকে পৌঁছে দিয়ে এসো। ওর কাজ শেষ হলে আমি ওকে পৌঁছে দেব। ”

কেন যেন মনে হলো আমার কথা শুনে রশু একটু হাসল। জোৎস্নার ফুটফুটে আলোয় আমি তার ঠোঁটের কোণে সেই হাসির রেখা স্পষ্ট দেখলাম।
মাথা নুইয়ে আচ্ছা বলে সে চলে যেতে লাগল। আবার ফিরে এলো। দূরত্ব বজায় রেখে চাপা স্বরে বলল,
–” নবুদা, বর্ষনের বোনকে কি এখনো বর্ষা বলেই ডাকবো। নাকি নামের পেছনে আরও কোনো সম্মোধন যোগ করতে হবে? ”

রশু করছে রসিকতা! আমিও সেই সুরেই বললাম,
–“সে অনুমতি দিলে অবশ্যই ডাকতে পারো। তবে দেবে বলে তো মনে হয় না। বড় বেশি কড়া।”

–” কি করে দেবে বলুন তো! আপনি জানিয়েছেন কিছু? ”

–“সবকিছুই কি জানাতে হয়? নিজেও তো কিছু বুঝে নিতে জানতে হয়। ” কিছুটা অভিমানী স্বরে বললাম।

রশু হাসলো –” গল্পে কতো লোককে আপনি ভালোবাসতে শেখান। অথচ নিজের জীবনে ভালোবাসা নিয়ে এতো সংকুচিত। কিভাবে বলবেন সেটাও বুঝতে পারছেন না। ভাবছেন বিপরীত মানুষ টা কেন নিজে থেকে বুঝে নিচ্ছে না। আসলে নবুদা মেয়েরা ভালোবাসার ক্ষেত্রে বড় বেশি জামানত চায়। নিজের মনকে সোপর্দ করার আগে পুরপুরি নিশ্চিত হয়ে নিতে চায়। যাকে সোপর্দ করা হচ্ছে সে আদতেও এর যথাযোগ্য সম্মান করতে পারবে কিনা।”

রশুর কথা যুক্তিযতই মনে হলো। আমি হেসে বললাম,
–” মনে হচ্ছে ভালোবাসা নিয়ে আজকাল বেশ ভাবছ। কবিতা লেখা শুরু করে দাও। রুদ্র গোস্বামী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এদেরকে ভুলে লোকে তোমার কবিতায় ডুব দেবে তারপর। ”
রশু আর কিছু বলবার আগে বর্ষন তাকে টেনে নিয়ে গেল।

***

বর্ষা আর আমি হাটছি জোৎস্নালোকিত পথে। চারপাশে সবকিছু থমকে আছে। সকল লৌকিকতা এখানে অনুপস্থিত। চাঁদের আলো ও এই অরণ্য পথ মিলে একটা অপার্থিব নিস্তব্ধতা সৃষ্টি করেছে। আমি পেছন ফিরে একবার দেখলাম। বর্ষা আমার সঙ্গে পা মিলিয়ে হাটছে না। সে আড়ষ্ট হয়ে আছে।
–“তোমাদের বাড়িটা কোনদিকে? ”
বর্ষা তর্জনী পূর্বে নির্দেশ করল।
–“ওইদিকে।”
–“আমি গান গাইলে তোমার কোনো অসুবিধা নেই তো?”
বর্ষা ডানে-বায়ে মাথা নাড়লো। আমি চাঁদের দিকে দৃষ্টি দিলাম। লেখালেখির মতো গানের ক্ষেত্রেও নাব্য দশজনের চেয়ে সেরা। পকেটে হাত রেখে হাটতে হাটতে আমি একটা গান ধরলাম।

“তোমারে লেগেছে এত যে ভালো
চাঁদ বুঝি তা জানে,
চাঁদ বুঝি তা জানে…

রাতের বাসরে দোসর হয়ে
তাই সে আমারে টানে,
তাই সে আমারে টানে….।”

রাতের ভয়ংকর নিস্তব্ধ এক পথে, যেখানে দুজন মানব-মানবীর উপস্থিতি ছাড়া আর সব ধূসর। গানটা সেখানে একটা দিব্য সুর তুললো। বর্ষা মাথা নুইয়ে হাটছে। তবুও আমার চোখ এড়ালো না তার ঠোঁটের এক চিলতে হাসি। একটা বেপরোয়া ইচ্ছে জাগল মনে। এই চাঁদনি রাতে, পথের অমানিশায় বর্ষার হাত ধরে হাটার ইচ্ছে।
আমি ধীরে পা ফেলে বর্ষার সাথে একই পদক্ষেপে হাটতে লাগলাম। বর্ষার হাত ধরলাম ভীত হাতে। তারপর হাটতে লাগলাম সেই হাত ধরে। এবং চাঁদের দিকে তাকিয়ে শপথ করলাম। পরের পঞ্চাশটি বছর আমি এই হাতেই হাত রেখে হেটে যাব।

নিয়তি বোধহয় আমার ঔদ্ধত্য দেখে হাসছিল সেদিন। সে জানতো, জীবনের সবচেয়ে বড় বিভ্রমে সেদিন নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছিলাম আমি!

***

–“বর্ষা, তোমার কি ফুল পছন্দ?” জঙ্গল ঘেঁষা ছোট্ট নদীর তীরে পাশাপাশি হাটতে হাটতে আমি বর্ষাকে জিজ্ঞেস করলাম। বিকেলের খরস্রোতা নদীর বুকের ওপর কয়েকটা চিল উড়ছে। মাঝে মাঝে নিজেদের ভাষায় অদ্ভুত একটা শব্দে ডেকে উঠছে চিল গুলো । বর্ষা সেদিকে চেয়ে মৃদু হাসল।
–” কদল ফুল। ”

আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম
–” থামো। চোখ বন্ধ করে দাঁড়াও এখানে। ” বর্ষা ভ্রু কুঁচকে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার পুরো মুখ জুড়ে অস্ফুট হাসির রেখা। দৌড়ে জঙ্গল ঘেঁষা গাছগুলোর দিকে গিয়ে আবার ফিরে এলাম আমি। বর্ষা তখনো ভ্রু জোড়া কুঁচকে, চোখ বুজে হাসি হাসি কৌতুহলী মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। তার গাঢ় নীল রঙা শাড়ির আঁচল অবাধ্য হয়ে উড়ছে। আমি বললাম
–“হাত পাতো।”
বর্ষা কলের পুতুলের মতো হাত পাতল।
একগুচ্ছ কদম আর গাঢ় নীল কাঁচের চুড়ি আমি তার হাতে তুলে দিলাম। বর্ষনের কাছ থেকে জেনে আগেই ওগুলো এনে রেখেছিলাম।
বর্ষা চোখ মেলে বিস্মিত হয়ে চেয়ে রইল। চোখ বড় বড় করে বলল,
–“আশ্চর্য! এইখেনে এইগুলা কই পাইলেন? ”
আমি হাসলাম,
–“ম্যাজিক!”
বর্ষা হেসে বলল,” কি সুন্দর! ” বলে সে কদম ফুলের ঘ্রাণ নিতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। আমি চুড়িগুলো ওর হাত থেকে নিয়ে নিলাম।
–“আমি পড়িয়ে দেই?”
বর্ষার ঠোঁটে আবার হাসির রেখা ঝিকমিক করে উঠল। হাসতে হাসতেই সে মাথা নাড়ল। বর্ষার বা গালে একটা তিল আছে। হাসলে সেই তিলটা টোলের মতো দেখায়। আমি চুড়ি গুলো বর্ষার দুহাতে পড়িয়ে দিয়ে তার দিকে ফিরেই হঠাৎ পেছাতে শুরু করলাম৷ বর্ষা অবাক হয়ে তাকাল। কিছুদূর পিছিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। দেখতে লাগলাম বর্ষাকে।
বিকেলের ঝড়ো আবহাওয়ায়, নদীর তীর ঘেঁষে এক নীল শাড়ি পরিহিতা মেয়ে, বাতাসে তার চুল উড়ছে, উড়ছে অবাধ্য নীল আঁচল, তার দুহাত ভর্তি গাঢ় নীল চুড়ি, হাতে একগুচ্ছ কদম। দৃশ্যটা মনে গেঁথে নিলাম। কখনো যদি বিশ্বাসঘাতকতা করে নিজের মন, সেই আশংকায় পকেট থেকে ফোন বের করে টুপটাপ বর্ষার কিছু ছবি তুলে নিলাম। তারপর আবার ফিরে চললাম বর্ষার কাছে।

***

–“তোমার বুবুকে বলে এসো আমাদের চা দিয়ে যেতে।” বর্ষন সঙ্গে সঙ্গে আজ্ঞা পালন করল। একছুটে রান্নাঘরে গিয়ে মুহুর্তে ফিরে এসে বলল,
–“কইছি।”
চায়ের ব্যাপারে বর্ষনের আগ্রহ প্রবল। কিন্তু ছোট বলে আর গ্রামে এসবের খুব একটা চল নেই বলে বর্ষনকে চা খেতে দেয়া হয় না।
–” তোমার জন্যও চা দিতে বলেছ তো?”
বর্ষন গোমড়া মুখে বলল
–” কইছি, তয় দিবে বলি মনে হয় না। ”
আমি কপট রাগ দেখিয়ে বললাম,
–“দেবে না মানে? আলবাত দেবে! আজ চা না দিলে শাস্তি পেতে হবে ওকে। তুমি পড়া শুরু করো। আজ তোমাকে চা না দিয়ে দেখুক বর্ষা!”

বলতে বলতেই বর্ষা এল। হাতে একটা মাত্র চায়ের কাপ নিয়ে। আমি বললাম, ” বর্ষনের চা কোথায়?”
–“ওর চা খাওয়ার দরকার নাই। ” বর্ষা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল৷
–“দরকার অদরকারের প্রশ্ন পরে। তোমাকে বলার পরও তুমি বর্ষনের চা আনো নি কোন সাহসে? এখন তোমাকে শাস্তি পেতে হবে। ”
দায়সারা ভাব ছেড়ে এবার সে ভীত চোখে তাকাল। আমি তাকে সত্যি সত্যি শাস্তি দিতে পারি এটা সে ভাবেনি বোধহয়।
আমি রূঢ় স্বরে বললাম, ” লেখাপড়া তো কোনো কালে শেখনি। অক্ষর চেনো?” বর্ষা ওপর নিচ মাথা নাড়লো।
–“বানান পড়তে জানো?”
বর্ষা নিচু স্বরে বলল,
–” একটু একটু..।”
আমি সামনে মেলানো বর্ষনের খাতা থেকে খানিক ছিড়ে তাতে খসখস করে কলম দিয়ে কিছু লিখে বর্ষাকে পড়তে দিলাম। গম্ভীর মুখে বললাম,
–“পড়তে না পাড়লে আগামী পাঁচদিন বর্ষনের কথামতো ওকে চা বানিয়ে দিতে হবে। ও যখন বলবে তখনি! ”
বর্ষা ফ্যাকাসে মুখে হাত বাড়িয়ে কাগজ টা নিল। কাগজের লেখার দিকে এমন ভাবে তাকাল যে মনে হল হিব্রু ভাষায় কিছু লেখা আছে ওতে।

বর্ষন তখন বোনকে এই মহা মুসিবতে পড়তে দেখে হাততালি দিয়ে হাসছে।
অনেক সময় নিয়ে কাগজের লেখাটা দেখার পর বর্ষা প্রথম অক্ষর টা উচ্চারণ করতে পারল। ততক্ষণে আমি অবশ্য আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম।
–” ভ… ভা…নো.. ভানো..” মাথা নেড়ে নিজেকে শুধ্রে নিয়ে বলল,
–” ভালো ” তারপর সরু চোখে চেয়ে রইল আরও কিছুক্ষণ।
হঠাৎ বিস্ফোরণের মতো চোখ বড় বড় করে একটানে বলল,
–” ভালোবাসি!” বলে ভ্রু কুচকে চোখ পাঁকিয়ে তাকাল আমার দিকে। কাগজ টা দলা পাঁকিয়ে আমার দিকে ছুড়ে মেরে চলে গেল হনহন করে। আমি আর বর্ষন একযোগে হেসে উঠলাম। বর্ষনের দিকে ঘুরে দুঃখী দুঃখী মুখ করে বললাম,
-“তোমার বুবুকে তো শাস্তি পুরোপুরি দেয়া গেল না। পাড় পেয়ে গেল বানান টা পড়তে পেরে। ”

বর্ষাকে বানান পড়তে গিয়ে যে কসরত করতে হয়েছে সেটা দেখে বর্ষন তখন কিছুটা হলেও খুশি। তাই সে হাত তুলে করুণা করার ভঙ্গিতে বলল,” থাক থাক, এবারের মত ওরে মাফ কইরা দিলাম।” আমি আবার হেসে উঠলাম।

***

রাতে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আজ একটু অন্যরকম লাগল। স্বাদটা অন্যদিনের চেয়ে আলাদা, চিনি বেশি। পেয়ালা হাতে নিয়ে, চেয়ার ছেড়ে উঠে উঁকি দিলাম রান্নাঘরে। অচেনা একজন মধ্যবয়সী মহিলা কাজ করছে। চা দিয়ে গেছে রশু, তাই রশুকেই ডাকলাম।
–“ব্যাপার কি? ইনি কে? আজ বর্ষা কোথায়?”

রশু ঠোঁট উল্টিয়ে বলল,” কিজানি। বর্ষার নাকি কি কাজ পড়ে গেছে। তাই ইনি এসেছেন। ইনি বর্ষার মা।”

–” ওহ! আমার হবু শাশুড়ী! ” মনে মনে বললাম।
রশু চলে গেল তার ঘরে। আমি এগোলাম রান্নাঘরের দিকে।
–“আসসালামু আলাইকুম। ভালো আছেন। ”
বর্ষার মা তড়িঘড়ি করে বেড়িয়ে এলেন রান্নাঘর থেকে। ইশারায় সালামের জবাব দিয়ে হেসে ব্যাস্ত সরে বললেন, ভালো আছি বাপ। আপনে ভালো তো?”
হেসে মাথা নাড়লাম।
–” আপনি ব্যাস্ত হবেন না। কি কাজ করছিলেন করুন। ”
বর্ষার মা হেসে রান্নাঘরে ফিরে যেতে লাগলেন। দেখে বুঝলাম ইনি বেশি কথা বলেন না। চুপচাপ ধরনের। আমি ইতস্তত করে শেষে আবার বললাম,
–” আ….আজ বর্ষা বা বর্ষন কেউ এলো না যে। ওরা কোথায়? ”
তিনি উনুনে ফু দিতে দিতে বললেন।
–” দক্ষিণের বাংলোতে নতুন লোক এসিছে তো। ওখানেও বসষ্যার ডাক পড়িছে। আজ ও সেখানেই গেছে। তাই আমি এইখেনে এলাম।”

আমার নিশ্বাস আটকে গেল। আমি শুধু স্পন্দনহীন ভাবে বললাম,
–” কোন বাংলোয়? যেখানে রাহিল উঠেছে?”
বর্ষার মা আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন,
–” হ, নাম তো সেরুকমি শুনছি।”

আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। রাহিলের বাংলোয় বর্ষা একা চলে গেছে। আমাকে না জানিয়ে। রাহিলকে আমি চিনি বহু বছর ধরে। শিকার কে বাগে পেলে সে কখনো বিনাকারণে তাকে ছেড়ে দেবে না। আর একমুহূর্ত ও না ভেবে ঘুরে হাটতে শুরু করলাম রাহিলের বাংলোর দিকে।

চলবে…..