একদিন নববর্ষা পর্ব-০৮

0
110

একদিন নববর্ষা – ৮
অদ্রিজা আশয়ারী
___________

আম্মা আমার কথা শুনে কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধত হয়ে রইলেন। শেষে বিমূঢ় ভাবে বললেন,
–“কি বললি তুই?”

আমি কি বলব, কিভাবে ব্যাপার টা বোঝাব আম্মাকে ভাবতে লাগলাম। নিজেকে ভয়ানক অসহায় মনে হচ্ছে। আম্মার চোখের দিকে চাইলাম। ক্রোধ ও বিস্ময় মিশ্রিত ব্যাথাতুর চাহনিতে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
নিশ্বাস ফেলে শান্ত স্বরে বললাম,
–” আম্মা, ব্যাপার টা যেমন ভাবছ তেমন নয়। পত্রিকায় প্রকাশিত ব্যাপার টা সম্পুর্ন সত্যি না আবার…. পুরোপুরি মিথ্যেও নয়। গরানবনে গিয়ে একটা মেয়ের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে সত্যি। ওর নাম বর্ষা। বর্ষা সেখানে যাওয়া পর্যটকদের রান্নার কাজ করে।
বর্ষা ভীষণ অন্যরকম মেয়ে আম্মা। তুমি দেখলে, তুমিও ওকে ভালোবেসে ফেলবে।
আম্মা, একটা অনুভূতি আছে না….কাউকে প্রথম দেখাতেই মনে হয়। আরে! আমি তো একে চিনি। এর সাথে তো আমার জনম জনমের পরিচয়।
বর্ষাকে প্রথম দেখে আমার ঠিক এই অনুভুতি টাই হয়েছিল। ”

আমার কথা শুনে আম্মা এমন ভাবে আমার দিকে তাকালেন। মনে হল যেন পাঁচ বছরের বাচ্চা ছেলে চাঁদে যাওয়ার বায়না ধরেছে।
–“আর এতেই তোর মনে হল এই মেয়েটিকে তোর চাই! ” আম্মা ঠান্ডা গলায় বললেন।

ঘরে থমথমে নিরবতা। আমি প্রতুত্তর না করে আম্মাকে সময় দিলাম। তিনি আবার বলতে শুরু করলেন,
–” তুই ওই জংলী মেয়ের সাথে সম্পর্ক গড়ার কথা ভাবলি কি করে। তোর লজ্জা করল না৷ একবার ভেবেছিস তোর আর ওর অবস্থানের ফারাক কতটুকু? তুই বই লেখিস। দেশের লাখ মানুষ তোকে চেনে। বড় বড় শিল্পপতি তোর বাবার পেছনে ঘোরে তোকে নিজের মেয়ের জামাই করার জন্য। সদ্য ইউনিভার্সিটির প্রফেসারিতে ঢুকেছে, কি যেন নাম মেয়েটার….. রেনুকা। ওদের এত আগ্রহের পরও রেনুকাকে তোর বাবা রিজেক্ট করেছে শুধুমাত্র তোর জন্য। তুই এখন বিয়ে করবি না বলে।

ছোট থেকে তুই সবকিছুর ওপরে নিজের জেদ কে প্রাধান্য দিয়েছিস। কখনো আমাদের ইচ্ছা, সম্মানের কথা ভাবিস নি।
আমার ছেলে পাইলট হবে। দিনরাত এই স্বপ্ন দেখত তোর বাবা। অথচ তোর কাছে নিজের জেদ টাই সবসময় অগ্রাধিকার পেয়েছে। গ্রাউন্ড কোর্সের পর রেজাল্ট দেখার সময়টা পর্যন্ত ধৈর্য রাখতে পারলি না। জেদ জুড়ে দিলি। লেখক হবো লেখক হবো বলে। পরীক্ষায় উতরে গিয়েও আর সেদিকে পা মারালি না। তখন চুপিসারে কত কেঁদেছে তোর বাবা। যেখানে তোর আকাশে ওড়ার কথা ছিল। আজ সেখানে তুই বনে বাদাড়ে ঘুরে কাগজের খাতায় সাহিত্য লিখিস। এখন একটা বন্য, জংলী মেয়ের প্রেমে পরেছিস। তোর হেয়ালির জন্য আত্মীয় মহলের কাছে রীতিমতো কৌতুকে পরিনত হয়েছে আমাদের পুরো পরিবার। ”

আমি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ম্লান স্বরে বললাম,
–” মাফ করে দাও আম্মা। তোমাকে আর বাবাকে আমার কারণে যে কষ্ট পেতে হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সাধ্যি নেই আমার।
তবে এটা আমার জেদের কথা না। কাউকে ভালোবাসার ব্যাপার টা জেদ থেকে আসে না। তুমি যেসব রিজন দেখিয়েছ। আমি মানছি তার একটাও মিথ্যে নয়। কিন্তু ছুড়ে দেয়া তীর যেমন আর ফেরে না। তেমনি কাউকে ভালোবাসলে পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে গিয়ে, এক লহমায় সেটার দ্য এন্ড হয়ে যেতে পারে না। ”
আম্মার এত কথার পর যে আমি এমন একটা প্রতুত্তর করতে পারি আম্মা বোধহয় সেটা ভাবেননি।
হয়তো ভেবেছিলেন কিছুটা হলেও মন ভিজেছে আমার। তিনি আঘাত জর্জরিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মনে হলো আম্মার দুচোখ ফেটে এখনি নায়াগ্রা জলপ্রপাত বইতে শুরু করবে। আমি আর সেখানে বসলাম না। উঠে নিজের ঘরের দিকে এগোতে শুরু করলাম। যেতে যেতে শুনলাম আম্মার শেষ কথাটা।
–” নাব্য, তুই এত নির্দয়! বাবা মায়ের ইচ্ছার কোনো মুল্য নেই তোর জীবনে। আমার গর্ভের কলঙ্ক হয়ে জন্মেছিলি তুই। ”

আম্মার বলা শেষ কথাটা আমাকে পোড়ায়নি সেদিন। বর্ষাকে ভালোবেসে আর সকল ভালোবাসার সম্পর্ক তখন ম্লান হয়ে গেছিল আমার কাছে। তাই মায়ের পর দাদি আর বাবার প্রত্যাখ্যানের ভয়টাও আমি উপেক্ষা করে যেতে পেরেছিলাম খুব সহজে।

দাদি মায়ের মতো অত চিৎকার চেচামেচি কিছুই করেন নি। দাদি ভীষণ অভিমানী। সবসময়ের মতো আমি দাদির ঘরে গিয়ে বিছানায় তার পায়ের কাছে বসলাম। আমার দিকে পিঠ করে দাদি জায়নামাযে বসে ছিলেন। আমাকে দেখেও মুখ ফেরালেন না। আমি দাদির কাঁধে মাথা হেলিয়ে দিলাম।
-” দাদি, কথা বলো। ” দাদি কথা বললেন না। নড়লেনও না।
-” দাদি, আম্মা আমাকে অনেক বকেছে। বাড়ির কেউ কথা বলছে না আমার সঙ্গে। তুমিও কথা বলবে না? ”
দাদি আমাকে আকাশসম ভালোবাসেন। এই কথা শুনে তিনি হাত বাড়িয়ে আমার মাথায় আদর করে দিলেন। কিন্তু কথা বললেন না।
-” পত্রিকায় যা বেড়িয়েছে সেসব সত্যি নয় দাদি। আমি কি এমন ছেলে যে তোমাদের কিছু না জানিয়েই নিজের বিয়ে নিজে ঠিক করে ফেলব!”

দাদি এবার ফিরলেন তির্যক দৃষ্টি নিয়ে।
-” তুই নাকি হেইনে গিয়া এক ছেমরির লগে প্রেম শুরু করসস। এইডাও কি মিছা কথা? ”

-“ইশশ্ নিতিন বুড়ি তোমাকে এসব বলেছে। তাই না? আম্মার সাথে কথা বলার সময় বাইরে থেকে সব শুনেছে ও। ”

-” এহন ক এইডা হাছা কথা না মিছা কথা?”

আমাকে মাথা চুলকাতে দেখে দাদি ঝাঁঝালো স্বরে বললেন,
-” কস না কেন?”

আমি হেসে ফেললাম। দাদি সিরিয়াস ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছেন। হঠাৎ বললেন।
-” কওন লাগতো না৷ বুঝছি। ” বলেই মুখ ফিরিয়ে নিলেন।

আমার ভ্রু কুচকে গেল,
-” কি বুঝেছ তুমি? ”

দাদি আড়চোখে ফের চেয়ে ঝাঁঝালো স্বরে বললেন,
-” চেহারার সুরত খানা দেখসস আয়নায়? ভাবসাব বেকুবের মতো হয়া গেসে!”

আমি তাড়াতাড়ি মুখে হাত রেখে বললাম,
-“বেকুবের মতো মানে?”

-” সর এইহান থাইকা। আমি নামায পড়মু। ”

-” আগে বলো দাদি, তুমিও কি আম্মার মতো নারাজ আমার প্রতি? বিশ্বাস করো। বর্ষাকে দেখলেই তোমরা বুঝতে পারবে। ও একদম তোমার মনের মতো হবে। প্রাচীনপন্থী। তোমার না শহুরে মেয়ে একদম পছন্দ না? তাহলে বর্ষাকে মেনে নিতে সমস্যা কোথায়?”

-” সমস্যা আমার কিছু না। তোর বাপ মায়ের।”

-” তারমানে তুমি রাজি?”

-” আমার কোনো মতামত নাই। তোর বাপ মা যা কইব হেইডাই আমার মতামত। ”
দাদি আর কথা বললেন না।

__________________

সুন্দরবন ছেড়ে আসার সাত দিন পেরিয়েছে। মনে হচ্ছে এক হাজার বছর বর্ষাকে দেখি না। আমার হাতে বর্ষার একটা ফটোগ্রাফ। নদীর ধারে, নীল শাড়ি পড়া, এক গুচ্ছ কদম হাতে বর্ষার সেই ছবিটা। বর্ষার মুখে নিকষিত হাসির রেখা। ভ্রুতে একটু কুঞ্চন। বর্ষার ব্যাপার টা আর গোপন নেই। সকলেই জেনেছে, এবং এটাকে আমার আরেকটা হেয়ালি ভেবে মেনে নিয়েছে।

দরজায় কড়া ঘাত পেয়ে পেছন ফিরে দেখি নিতিন উঁকিঝুঁকি মারছে।
ছবিটা বইয়ের ভাজে রেখে বললাম
-” আয়।”

নিতিন একছুটে চলে এল। দুই কাঁধে দুই বেণি দুলিয়ে, ঝিকিমিকি হেসে বলল,
-” কি লুকিয়েছ তাড়াতাড়ি বের করো। ”

আমি নিশ্বাস ফেলে একপ্রকার বাধ্য হয়ে ছবিটা বের করে তার হাতে দিলাম। নিতিন অনেকক্ষণ মনোযোগী ছাত্রীর মতো দেখল ফটোগ্রাফ টা। বুকে ধুকপুকানি নিয়ে ওকে প্রশ্ন করলাম।
-” কেমন দেখতে বলতো? খুব কি বাজে….? ” মা, দাদি আর বাবা তো আগেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এবার নিতিনও যদি বিমুখ হয় তাহলে ব্যাপার টা সামলানো কঠিন হবে আমার জন্য।

-” আরে এতো পুরো নায়িকা! ভাসা ভাসা চোখ, সুচালো নাক, সরু ঠোঁট…। মুখের আদল টায় একটা নির্মলতার ছোঁয়া আছে। ছবিটা দেখে একের পর এক সাহিত্যিক উপমা আসছে মনে। অথচ আম্মা যে বলছিল জংলী মেয়ে! আমি ভেবেছিলাম সেটা বুঝি সত্যি। দাভাই তুমি কোথায় এর দেখা পেলে? ”

আমি হাসলাম।

-” ওখানে কবে যাচ্ছ আবার? ” নিতিন উত্তেজিত গলায় বলল।

-” যাচ্ছি, খুব শীগ্রই। ভাবছি ওখানে গিয়ে উপন্যাসের বাকি লেখাটা শেষ করবো। ”

-” তাহলে আমাকেও সঙ্গে নিয়ে চল। প্লিজ প্লিজ দাভাই।” নিতিন লাফিয়ে উঠল।

-” অসম্ভব। আম্মা আমাকে ত্যাজ্য পুত্র করতে দ্বিতীয় বার ভাববে না তাহলে। নিজে সেখানে গিয়ে ফেঁসেছি। এবার তোকেও ফাঁসানোর প্ল্যান করছি।”

কথা শুনে নিতিন মুখ গোমড়া করে ফেলল।

-” রাগ করিস না বুড়ি। এমনেই বাড়ির সবাই আমার ওপর যথেষ্ট রাগান্বিত। তোকে নিয়ে গেলে ওরা আরও রেগে যাবে।”

তিনদিন পর আমি আবার আকাশে উড়লাম। বর্ষার কাছে, আমার হৃদয়ের প্রশান্তি যেখানে, সেখানে পৌছাবো বলে। আসার সময় নিতিন ছাড়া বাড়ির প্রতিটি মানুষ আমার থেকে অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু নিজেকে আমার পরোয়া হীন মনে হচ্ছে। আমি এখন কেবলমাত্র বর্ষা, শুধু বর্ষারই অভিমানের পরোয়া করি। বর্ষার জন্য আর সব ভালোবাসার সম্পর্ক আমি ছেড়ে দিতে পারব অনায়েসে। বর্ষা কি কখনো বুঝবে? বুঝবে আমি তাকে কতটা ভালোবাসি? পরিস্থিতি যদি কখনো প্রতিকূল হয়ে দাঁড়ায়। সে কি পারবে সব ছেড়ে শুধুমাত্র আমার হাত ধরতে?
হয়তো পারবে বা হয়তো পারবে না। তবে ভালোবাসলে সবকিছু কে তুচ্ছ ভাবার এক অমোঘ শক্তি আসে। নবীন ভালোবাসার জন্য পুরাতন ভালোবাসার সম্পর্ক গুলোকে ঝেড়ে ফেলা যায় খুব সহজে। বর্ষার জন্য আমি সে পথে পা বাড়াতে রাজি আছি নির্দ্বিধায়।
বর্ষা পারুক কিংবা না পারুক। আমি চিরকাল বর্ষাকেই ভালোবেসে যাব….।

চলবে….