একদিন নববর্ষা পর্ব-০৯

0
105

একদিন নববর্ষা – ৯
অদ্রিজা আশয়ারী
___________

কুঠিবাড়ির দেখাশোনা করে যে লোকটি। তার নাম ফজলু মিয়া। সে মফঃস্বলের বাজার থেকেই আমার সঙ্গে সঙ্গে এল। দরজার তালা খুলে দিয়ে বলল,
-” সাব, আপনের রান্ধনের ব্যাবস্থা করতাছি। তয় আগে বাজার করতে হইব। আর বসির শেখের বাড়িতে গিয়া তার বৌ-ঝি রে একটা খবর দিতে হইব। ”

আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে ওয়ালেট থেকে টাকা বের করে ওকে দিলাম।
-” ফজলু মিয়া, আমি এখানে যতদিন থাকব। তুমি প্রতিদিন আমার বাজার করে দিও। আমার সাথের ছেলেটা এবার আসতে পারে নি। তুমি রোজ বাজারটা করে দিলে ভীষণ উপকার হয়। আর হ্যাঁ, যে টাকা বাঁচবে ওটা তুমি রেখে দিও। ”

ফজলু মিয়া টাকা হাতে নিয়ে খুশি হয়ে বলল
-” আপনে ভাইব্বেন না সাব, আমি পত্তেদিন আপনের বাজার কইরা দিমু৷ আচ্ছা এহন আসি। বসির শেখের বাড়িতে খবর দিয়া বাজারে যামু।”

ফজলু মিয়া চলে গেল। আমি জিনিসপত্র গোছগাছ করতে লাগলাম। ঘরজুড়ে একটা গুমোট ভেপসা গন্ধ। আমি যাওয়ার পর আর কেউ এখানে এসেছিল বলে মনে হয় না। জানালার খড়খড়ি টেনে সেখানে দাঁড়ালাম। বহুদিন পর আবার কানে আসতে লাগলো ঝিঁঝি পোকার মসৃণ ডাক, অচেনা পাখিদের তীক্ষ্ণ কলরব। সেইসাথে বুনো গন্ধ আর ভেজা হাওয়া।

কাঠের চৌকাঠে খট্ শব্দ শুনে সেদিকে ফিরতেই দেখি বর্ষন ছুটে আসছে৷ এসেই সে আমার একদম গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি হাটু ভাজ করে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম।
-” ভালো আছেন বর্ষন সাহেব? ”

বর্ষন দ্রুত মাথা নেড়ে হাসলো। অধৈর্য হয়ে বলল,
-” আপনি এতদিন আসেন নাই কেন? আমি আর বুবু আপনের কথা কত মনে করছি…। রোজ রোজ বড় সড়কের ধারে গিয়া আমি অপেক্ষা করতাম আপনের জন্য। বুবুও মাঝে মাঝে যাইত আমার লগে। ”

-” ইশশ্ ভীষণ ভুল হয়ে গেছে। কাজে আটকে গেছিলাম তো, সেজন্য আসতে এত দেরি হয়ে গেল। তোমার জন্য একটা গিফট আছে। দাঁড়াও দিচ্ছি। ”

লাগেজ খুলে চকলেট বারগুলো বের করে বর্ষনকে দিতেই সে খুশিতে লাফিয়ে উঠল।
-“সবগুলা আমার?”

-” হুম, তোমার দাঁত গুলো ভীষণ সুন্দর তো। আমার ভারী হিংসা হয়। তাই দিলাম। খেয়ে দ্রুত দাঁতে পোকা করে ফেল। তাহলে আর হিংসেও হবে না আমার। ”

বর্ষন সবে একটা চকলেট খুলতে শুরু করেছিল। আমার কথা শুনে কাজ থামিয়ে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইল।
আমি হেসে ওর নাক টেনে দিয়ে বললাম,
-” মজা করছিলাম। আচ্ছা, বর্ষন সাহেব। আজকের রান্নাটা কি তুমিই করবে? তোমার বুবু আসছে না যে?”

-” বুবু আইতাসে, আমি দৌড়াইতে দৌড়াইতে আইছি তো, তাই আগে আইসা পরছি। ” বলে সে চকলেট খাওয়ায় মন দিল। মুখের চকলেট গুলো না গিলে হঠাৎই সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
-“আপনে বুবুর জন্য কিছু আনেন নাই? বুবুও তো আপনারে আমার মতো খুব পছন্দ করে। ”
বলেই মুখ গোমড়া করে ফেলল।

–“বুবুর জন্য কিছু আনলে আমার মতো সেও খুব খুশি হইত। কিন্তু….এহন শুনলে বুবু খুব কষ্ট পাইব।”

-” তাহলে তো বিরাট ভুল হয়ে গেল দেখছি! এখন কি করা যায় বলো তো?”

বর্ষন একটা চকলেট বার দ্রুত আমার দিকে এগিয়ে ধরল।
-“আপনে এইটা বুবুরে দিয়েন। কইবেন ওর জন্যে আনছেন। তাইলেই হইব। ”

-“এটা তো তোমাকে দিয়ে দিয়েছি। এখন কিভাবে ফেরত নিই! এরচেয়ে বরং লাগেজে খুজে দেখি দেবার মতো আর কিছু পাওয়া যায় কিনা।”

চকলেট বার টা আবার নিজের অধিকারে পেয়ে বর্ষন আর দ্বিমত করল না।

আমার জামাকাপড় আগেই বের করেছিলাম। লাগেজ খুলতেই তাই বর্ষার জন্য আনা কারুকাজ খচিত কাঠের বাক্সটা প্রথমে নজরে পড়ল। ভ্রু কুচকে বললাম,
-“এর ভেতর কি আছে চলো তো দেখি।”
বর্ষন ঝুঁকে এল। চিন্তাগ্রস্থ কৌতুহলী চোখে তাকাল বাক্সটার দিকে।

ভেতরের জিনিস সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই এরকম একটা মুখভঙ্গি করে বাক্সটা খুললাম। খুলতেই প্রথমে নজরে পড়ল একটা সোনালি পাড়ের লাল শাড়ি, তার ওপর একটা চিরকুট, দুটো সোনার মিহি চুড়ি, অন্যপাশে বিভিন্ন রঙের পনেরো ডজন কাঁচের রেশমি চুড়ি।

-” এগুলো ছাড়া আর কোনো কিছু তো দেখছি না আপাতত। তোমার বুবু এসব দিলে রাগ করবে না তো?”

আমার লাগেজে বিনাকারণে কেন অতগুলো মেয়েলি জিনিস বোঝাই করা বর্ষনের ছোট্ট মস্তিষ্কে সেই প্রশ্ন এলো না। সে বরং চাকচিক্যে ঘেরা জিনিস গুলো দেখেই খুশি। বোনের উপহার দেখে সন্তুষ্ট হয়েছে বোঝা গেল। বর্ষন উত্তেজিত গলায় বলল,
-” শাড়ি, চুড়ি তো বুবুর খুব পছন্দ। বুবু এগুলা দেখলে কিযে খুশি হইব..।”

তখনি বর্ষা এল। আমি দ্রুত বাক্স বন্ধ করে একপাশে রেখে দিলাম। খোলা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বর্ষা একটুখানি হাসলো। বর্ষা খুবই অচঞ্চল মেয়ে। কিংবা হয়তো বেশি দৃঢ়। সে এক পা ও এগিয়ে এলো না আমার দিকে। আমিই গেলাম।
-“কেমন আছো?” আমার গলার স্বরে অস্থিরতা ঝরে ঝরে পড়ছে।
-” ভালো। আপনি?”
-” এতক্ষণ কেমন ছিলাম বলতে পারবো না। তবে এখন খুব ভালো। ”
পেছন ফিরে একবার বর্ষনকে দেখে নিয়ে বললাম,
-” আমার প্রতি তোমার চেয়ে বোধহয় বর্ষনের আকর্ষণবোধই তীব্র। তুমি এসে পৌঁছানোর অন্তত কুড়ি মিনিট আগে বর্ষন এসে পৌঁছেছে।”

বর্ষা ফের হাসলো। চোখে কৌতুক খেলিয়ে বলল,
-“আমার আরও আগে আসার কথা ছিল নাকি? আইসা কি করতাম? বর্ষনের চকলেটের অংশীদার হইতাম? ”

-“আগে কিংবা পরে যখনই এসো। বর্ষনের চকলেটে তোমার কোনো অংশীদারত্ব নেই।”

-“তাইলে আর কি! আমি এহন যাই। আমার কাজ তো শুধু রান্ধন। ফজলু ভাই আসলে তখন ডাক আবার পাঠায়েন।” বলে সত্যি সত্যি ফিরতি পথ ধরল বর্ষা।

-” আরে! সত্যি চলে যাচ্ছ নাকি? কে বলল তোমার কাজ শুধু রান্না? এইযে আমাকে দেখছো। এই মূর্তিমান পুরো আমিটাই তো তোমার দায়িত্ব! ”

দরজার আগল ছেড়ে দাঁড়িয়ে বর্ষা বাঁকা চোখে তাকিয়ে মুখে ভেঙচি কাটল। তারপর বাড়ির সামনের সরু রাস্তার দিকে চোখ পড়তেই সোজা উঠোন পেরিয়ে চলে গেল হেশেলের দ্বোর খুলতে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে রাস্তায় তাকিয়ে দেখলাম ফজলু মিয়া গলা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে বাজার নিয়ে ফিরছে।

***

বিকেলের রোদে তেজ কমে এসেছে। বাড়ির সামনের প্রহরী গাছগুলোর নিচে মাচায় বসে বর্ষার জন্য অপেক্ষা করছি। বর্ষার আগমনের কোনো চিহ্ন নেই। অপেক্ষা টা অসীম মনে হচ্ছে। পেছনে বর্ষার আগমন পথের পানে আর চেয়ে না থেকে সামনে দৃষ্টি ভিড়ালাম। গাছপালার জঙ্গল ছাড়িয়ে শুরু হয়েছে বিস্তীর্ণ খোলা ভূমি। বেশিরভাগ টাই চলাচলের অনুপযুক্ত। জোয়ারের লবণাক্ত পানি নিরর্থ করে দিয়েছে বিশাল জমিটাকে। সেই ভূখণ্ডের পেছনে পাহাড়ের মতো আঁকাবাঁকা গাছের সারির ওপর সীমা শূন্য নীল আকাশ। পাহাড় প্রতিম গাছের সারি গুলোর একেবারে গা ঘেঁষে ভেসে বেড়াচ্ছে পুঞ্জ পুঞ্জ সাদা মেঘ। মেঘেরা দ্রুত উড়ে যাচ্ছে পুর্ব থেকে পশ্চিমে। সন্ধ্যের আগে নীড়ে ফেরার তাড়া যেন ওদেরও খুব। মনযোগী ছাত্রের মতো আকাশের গায়ে মেঘের এই লুকোচুরি খেলা দেখতে দেখতে একবার আমার বা পাশে রাখা কাঠের বাক্সটার দিকে তাকালাম। তখুনি মাচাটা মৃদু দুলে ওঠায় হুট করে ডানে তাকাতেই দেখি বর্ষা উঠে বসেছে সেখানে। সামনের আকাশের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বলল,
-“এত ধ্যান ধইরে কি দেখতেছিলেন আকাশে?”

-” মেঘেদের খেলা।”

-” হু।” বলে বর্ষা তির্যক দৃষ্টিতে একবার বাক্সটার দিকে তাকাল।
-” কি এটা?”

-“খুলে দেখো। ” বলে ওর দিকে বাড়িয়ে ধরলাম ওটা।

বর্ষা একটু দ্বিধা নিয়ে খুলল বাক্সটা। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। কাঁচের চুড়ি গুলোর ওপর হাত বুলিয়ে বলল,
-” এত্তো চুড়ি! ” তারপর শাড়িটা ধরতে গিয়ে সোনালি চুড়ি দুটো খেয়াল করল। হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে হঠাৎ শান্ত মুখে আমার দিকে ফিরে চাপা স্বরে বলল,
-“সোনার চুড়ি?”

উত্তরে আমি কেবল ছেলেমানুষী হাসলাম। বর্ষার মুখটা হঠাৎ গাম্ভীর্যে ছেয়ে গেল।
-” এইসব কেন আনছেন আপনি? কত টাকা নষ্ট করছেন! আমার এইসব লাগব না।”

আমি বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে গিয়ে বললাম,
-“আরে, এসব তো আমি এমনেই তোমাকে দিয়েছি। আমার ভালোলাগে বলেই। তোমাকে চাইতে হবে নাকি! আমার ইচ্ছে হলে আমি দিতে পারি না? ”

-” তাই বইলা…. ” বর্ষা কোলের ওপর বাক্সটার দিকে তাকিয়ে থেমে গেল।

-” প্লিজ এটা নিয়ে আর কোনো কথা না। এখন হাত বাড়াও।”

বর্ষা ম্লানমুখে হাত বাড়িয়ে দিল। সোনার চুড়ি দুটো বর্ষার দু’হাতে পড়িয়ে দিয়ে বললাম।
-“কখনো খুলবে না। মনে থাকে যেন। নায়হ আমি কিন্তু ভীষণ রেগে যাবো। ”

শেষ কথাটা শুনে বর্ষা হেসে ফেলল। আমি ভ্রু কুচকালাম। মনে হল কথাটা আরেকটু দৃঢ় স্বরে বলা উচিত ছিল। রাগত্ব স্বরে বললাম,
-” হাসছো কেন?”
বর্ষা আমার রাগের একদমই পরোয়া না করে ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
-“রেগে গিয়ে কি করবেন বলেন তো শুনি ?”

-“মুখ বেঁধে ঢাকায় নিয়ে চলে যাব। তারপর ভালো মালদার বিদেশি পার্টির কাছে পাচার করে দেব। এরপর শুধু টাকা আর টাকা….”

কথা শুনে বর্ষা খিলখিল করে হেসে উঠল।
সন্ধ্যের আযানের ধ্বনি কানে আসতেই হাসি থামিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। আদ্র স্বরে বলল,
-” এহন আসি?”
আমি মাথা নেড়ে বললাম,
-” ভালোবাসি।”
এক চিতলে হেসে বর্ষা ত্রস্ত পায়ে হেটে বাড়ির ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি সম্মোহিত হয়ে শুনতে লাগলাম দূর থেকে ভেসে আসা আযানের সুর।
চলবে……….