একদিন নববর্ষা পর্ব-১৩+১৪+১৫

0
112

একদিন নববর্ষা -১৩
অদ্রিজা আশয়ারী
___________

বর্ষার মুখভার। বিবশতায় আচ্ছন্ন দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইলাম আমি। একটা কবিতার কিছু পঙক্তি মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আনমনে গুঞ্জন করে উঠলাম।

“কোথায় পাইমু কলসী কইন্যে, কোথায় পাইমু দড়ি,
তুমি হইও গহীন গাঙ, আমি ডুইব্যে মরি!”

কবিতার কথামালা শুনে বর্ষা খিলখিল করে হেসে উঠল।
ভেঙচি কেঁটে, ” ঢঙ। ” বলেই আমার পাশে এসে বসল।

বালু তীর ঘেঁষে একে অন্যের হাত ধরে আমরা সেদিন বসে রইলাম বহুক্ষণ। কত কথাই যে বলা হলো সেদিন বর্ষার সঙ্গে। আমাকে যেন কথা বলা রোগে পেয়েছে। অনুরাগের আতিশয্যে আমার রাশভারি চরিত্রের সকল সঙ্গিনতা যেন ছুটি কাটাতে চলে গেছিল সেই দুপুরে। মনে হলো আমাদের বয়সটাই উল্টে গেছে। আমি হয়েছি সদ্য কৈশোরে পড়া ষোলো বছরের মাতাল প্রেমিক। আর বর্ষা যেন সাতাশ বছরের ভীষণ গম্ভীর, ঔদার্যপূর্ণ, সমঝদার লেখক।

কত সময় পেরিয়েছে। তার হিসেব রাখা অনাবশ্যক মনে হচ্ছিল। বর্ষা ভীষণ আড়াল করতে জানে। কিভাবে কাটছে তার দিন, বাবা তাকে কষ্ট দিচ্ছে কিনা, কালকের ব্যাপার টা আবারো পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে কিনা….. এতগুলো প্রশ্নের একটিরও যুক্তিসঙ্গত উত্তর দিল না সে। বারবার শুধু হেসে এড়িয়ে গেল। আমাকে আশ্বাস দিল একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। এমনকি একটা নিগূঢ় সত্য, যা সেই প্রথম থেকে আমি বর্ষার মুখে শুনতে চাইছি। সে আমাকে ভালোবাসে কিনা। তার উত্তর স্পষ্ট করে কখনো দেয়নি বর্ষা। কখনো প্রতুত্তরে বলেনি।
-” আমিও ভালোবাসি নাব্য।”

তবে একটা ব্যাপারে আমার কৌতুহল নিবৃত্ত হল। বর্ষার প্রকৃত বাবার পরিচয়।
অনেক প্রশ্নের পর বর্ষা নিশ্বাস ফেলে বলল,
-” আমার বাবা আছিল ইস্কুল মাস্টার। এহনো মনে আছে ছয় বছর বয়সেও বাবার হাত ধরি তার সঙ্গে ইস্কুলে যেতাম আমি। কিন্তু হঠাৎ বাবার খুব অসুখ করল। কি যে হইল আমরা কেউ বুঝলাম না। বাবা খালি দিনরাত ঝিমাইতো, আর কাশতো। এত কাশতো যে কাশির সাথে রক্ত আসতো মাঝে মাঝে। একসময় তারে ইস্কুলও ছাড়তে হইল। তারপর একদিন কাশতে কাশতে বাবার মুখ দিয়া জমাট বান্ধা রক্ত বেরইতে শুরু করল। বাবা মারা গেল সেইদিনই বেহানবেলাতে। তার চারমাস পর মামারা মা’রে আবার বিয়া দিল। আমিও মায়ের সাথে সাথে তার নতুন স্বামীর বাড়িতে থাকার অনুমতি পাইলাম। আর বর্ষন…. বর্ষন হইল আমার দ্বিতীয় বাপের সন্তান। আমার সৎ ভাই।”

খেয়াল করলাম বর্ষার চোখের কোণায় ঝিলিক দিচ্ছে অশ্রু। সে একটু থেমে বলল,
বাবা যে আমারে কত্ত ভালোবাসতো! বাবার মতন কেউ আর কোনোদিন ভালোবাসে নাই।”

আমার হঠাৎ ভীষণ কষ্ট হল। বুকের ভেতরে চাপা আর্তনাদে সৃষ্ট ব্যাথাতুর হৃদয় চেঁচিয়ে বলতে চাইল,
-“কে বলেছে ভালোবাসেনি? এইযে আমাকে দেখছো। আমার সবটুকু শক্তি দিয়ে আমি শুধু তোমাকেই ভালোবেসেছি। এমনিভাবে আর কেউ কোনোদিন তোমাকে ভালোবাসতে পারবে না। তুমি মিলিয়ে নিও। ”

***

প্রকৃতির খেয়াল বোঝা দায়! যে রোদ ঝলমলে আকাশ দেখে মুগ্ধতায় ভাসছিলাম। ঘন্টার ব্যবধানে সে জায়গা দখল করে নিয়েছে ছাই বর্ণের জলপূর্ণ গুরুগম্ভীর মেঘেদের দল। প্রকৃতির এই রূপের সঙ্গে কোথায় যেন বিচ্ছেদের সুরের একটা মিল রয়েছে। অন্তত আমার কাছে তাই মনে হয়। এই দলছুট কালো মেঘেরা সঙ্গে করে নিয়ে আসে প্রচুর বিরহের সরঞ্জাম আর হাহাকারের নিরব আর্তনাদ। তবে এই আয়োজন কখনো আমার অন্তঃকরণে ভয়ের সঞ্চার করে নি এর আগে। হয়তো তখনো কাউকে হারানোর ভয় ছিলনা বলেই। অথচ আজ এই মেঘ আপনা থেকেই অশুভ একটা ইঙ্গিত দিচ্ছে খুব অস্পষ্ট ভাবে। খুব ভয়ংকর একটা ভাবনা থেকে থেকে উঁকি দিচ্ছে মনে। বর্ষার দিকে ফিরলাম। সে আমার পাশে বসে একদৃষ্টে চেয়ে দেখছে উত্তাল নদীর তরঙ্গায়িত ঢেউ। কি সুন্দর তার মুখখানি। মেঘের আলোয় ধূসর চারদিক। বর্ষার গালে এসে পড়ছে সেই আলোর রূপোলী ছটা। এত মায়া যে আর কোথাও নেই। কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে এই মুখ আজকের পর আমি আর কখনো দেখব না। আমার দৃষ্টি থেকে ভালোবাসারা প্রজাপতি হয়ে উড়ে আর কখনো ছুঁয়ে দেবে না বর্ষাকে। কি ভয়ংকর কল্পনা। বাস্তবায়িত হওয়ার কথা ভাবলেও বুক কেঁপে ওঠে!

এমন সময় কখনো না আসুক। যখন আমি চোখ মেললে বর্ষাকে দেখবো না, নিশ্বাস নিলে বর্ষার অস্তিত্ব টের পাব না, হাত বাড়ালে ছুঁতে পারবো না আমার প্রাণভোমরা কে।
কিন্তু নিয়তি যদি সহায় না হয়? আমি ভাবতে চাইনা আর সেইসব দুঃসহ সময়ের কথা…!

হঠাৎ বন থেকে ভেসে আসা একটা প্রকট শব্দ ঢেকে দিল নদীর কল্লোল আর বিষন্ন মেঘেদের গুড়ুম গুড়ুম শব্দকে। বর্ষা চমকে ফিরে চাইল। ভ্রুতে কুঞ্জন এঁকে উঠে দাঁড়িয়ে হাটা ধরল বনের দিকে। শব্দের উৎস কোনদিকে সেটা খুঁজতে। আমি বনের দিকে ফিরে তার অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমাদের একান্তে সময় কাটানোর ক্ষণে, এই বাঁধা আরও দীর্ঘায়িত হোক সেটা কোনোভাবেই চাইনা।

অথচ কয়েক মুহূর্ত পর বর্ষা ফিরে এল সম্পুর্ন অপরিচিত রূপে। শঙ্কিত গলায় বলল,
“বাজান বনে লোক নিয়া আসিছে গাছ কর্তনের জন্যি। বাজান কিংবা দলের অন্যকেউ যেকোনো সময় এদিকে চলে আসতি পারে। আপনি চলি যান। ”

আমার বুকে এক আকাশ ভার নেমে এল। ভীষণ দমে গেলাম আমি। কেন এত প্রাচীর আমাদের মাঝে!
-“কিন্তু বর্ষা….।”

আমাকে থামিয়ে দিয়ে বর্ষা ত্বরিতে বলল,
-“আর কোনো কথা না। আমি আসি। ভালো থাকবেন। আরেকটা কথা, কক্ষনো আমার খোঁজ করতে যাইবেন না অনুরোধ রইল। সময়ে সময়ে আমিই আপনেরে দেখা দিমু।” বলে বর্ষা ফিরতি পথ ধরল।

আমার বুকের ভেতর দ্রিমদ্রিম শব্দে হাতুড়ি পেটাচ্ছে একটা অজানা আশংকা। মনে হচ্ছে সবকিছু থেকেও কিছুই রইল না আমার। সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছি আমি এই কালহরণে। এই সময়ের পর কোনো কিছুই আর এরকম থাকবে না। মাত্র কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে মনে আর মস্তিষ্কে ওঠা এই অদ্ভুত, অপরিচিত চিন্তার ঝড় আমাকে বিহ্বল করে দিল৷ বর্ষার কথা অমান্য করে এই প্রথম ওর আঁচল টেনে ধরলাম আমি। অভিমানী স্বরে বললাম,
-” বর্ষা, তুমি কেন এত আড়াল হও? আমাদের কি কোনোদিন একসাথে একটা শংকামুক্ত ভোর দেখা হবে না? এইযে তুমি আর আমি ক্রমে সরে সরে যাচ্ছি……. এই দূরত্ব একদিন মিটবে তো?
আচ্ছা বাদ দাও এসব কথা। একটা শেষ প্রশ্নের উত্তর দাও।
বর্ষা, তুমি কি সত্যিই আমাকে ভালোবেসেছিলে?”

বর্ষা পেছন ফিরে, গাঢ় অঞ্জন খচিত টলমল আঁখি মেলে চাইল আমার দিকে। উত্তরের অপেক্ষায় আমি চাতকের মতো চেয়ে রইলাম। প্রকৃতি তার প্রলয়নৃত্য থামিয়ে দিল আচমকা। বাতাসের শো শো গর্জন নেই, আকাশে মেঘের রণহুংকার নেই। সকলেই যেন নাব্য নামের এক নিঃস্ব, পাগলাটে প্রেমিকের সাথে তার প্রেয়সীর থেকে ভালোবাসি কথাটা শোনার অপেক্ষা করছে।
তাদের সবার অনুসন্ধিৎসা কে পরাভূত করল সেই মেয়েটি। প্রেমিকের সকল অনুরাগ, অভিমানকে অগ্রাহ্য করে বিষাদক্লিষ্ট ওষ্ঠে কেবল অদ্ভুত ভাবে হাসল। আমার হাত থেকে আঁচল ছাড়িয়ে নিয়ে পরমুহূর্তেই রক্তিম আঁচল উড়িয়ে গহীন অরণ্যের মাঝে হারিয়ে গেল সবসময়কার মতো।

আমি হাটু মুড়ে বসে পড়লাম। আমার আর কোনো জোর নেই। ভালোবাসা নামক মরণব্যাধি শুষে নিয়েছে আমার সকল জীবনাশক্তি। এইবার আমি কেবল বাঁচার জন্যেই বেঁচে থাকবো।

অথচ আমি বুঝিনি। নিয়তি সেদিন থেকেই বদলে নিয়েছিল তার পথ। বর্ষার সাথে সে-ই ছিল আমার শেষ দেখা……।

***

ফজলুর সাথে শেষ সাক্ষাৎ হয়েছিল সেদিন বিকেলে বসির শেখের বাড়ি। তারপর থেকে ফজলু আর আসছে না। কিছু জিনিস কেনা দরকার, তার ওপর মফস্বলে না গেলে শহরের কোনো খবরাখবর পাওয়া যায় না। এইসব ভেবে তাই অবশেষে ঠিক করলাম আমিই একবার যাব মফস্বলের বাজারে। এমনিতেও দুপুরে নদী তীরে বর্ষার ওভাবে চলে যাওয়ার পর থেকে মন ভালো নেই।
বিকেলেই তাই বাড়ি তালাবদ্ধ করে বেরিয়ে পরলাম মফস্বলের উদ্দেশ্যে। গায়ে একটা ছাই রঙা সার্ট, হাতাটা ফোল্ড করে কনুই পর্যন্ত ওঠানো। পকেটে অকেজো সেলফোন। অকেজো বলার কারণ এখানে নেটওয়ার্ক পাওয়ার আশা করা বৃথা। তার ওপর চার্জ শেষ হয়েছে তারও কয়েকদিন পেরিয়ে গেছে।

মফস্বলের বাজারে কিছু লোকের সঙ্গে ইতোমধ্যে আমার পরিচয় ঘটেছে। মাঝে মাঝে বাড়ির খবরাখবর নেয়ার জন্য এখানে আসতে হয়। পুরনো দিনের মতো টাকার বিনিময়ে ফোনে কথা বলার সিস্টেম এখনো সচল আছে এখানে। অবশ্যি এসব ছাড়া উপায়ই বা কি! যেনতেন সিমের নেট পাওয়া দুষ্কর এই গহীন অঞ্চলে। তাই দোকানের বাটন ফোনে টাকার বিনিময়ে কয়েক মুহূর্তের আলাপনই ভরসা।

দোকানদার কায়সার দূর থেকে আমাকে দেখে হাসল। হাত নেড়ে বলল,
-“সাব, যাওয়ার সময় একবার ঘুইরা যায়েন দোকান থাইকা। জরুরি দরকার আছে। ”
আমি অন্যসময়ের অপেক্ষা না করে তখনি হাজির হলাম সেখানে। কায়সার ভেতর থেকে মুখ বাড়িয়ে উত্তেজিত স্বরে বলল,
-” সাব, কাল রাত থাইকা মেলা নম্বরের তন কল আইতাসে আমার এইনে। সবাই খালি আপনেরেই খোঁজে। একবার একটা মাইয়া ফোন কইরা খুব কানলো। কান্দার চোটে কি কইল কিছুই বুঝবার পারলাম না। কল কাইটা গেল। এদিকে আবার ঝড়বৃষ্টির লাইগ্যা নেটওয়ার্কএ ডিসটাব। তিনবার কল করলে একবার রিং হয়।”

কায়সারের কথা ভয় পাইয়ে দিল আমাকে। কে এতবার কল করে খুঁজেছে আমাকে। যে মেয়েটি কল করে কাঁদছিল কে সে? নিশ্চয়ই নিতিন! কিন্তু কেন। কি এমন হয়েছে।

কায়সারের কথায় সম্বিত ফিরল।
-“সাব, এইযে একটা নম্বর খুইজা পাইছি। আজ দুপুরেই কল আইছিল এই নম্বর থাইকা। ”

আমি অস্থির হয়ে বললাম,
-” তাড়াতাড়ি কল দাও তো এই নাম্বারে।”

কায়সার কল করে ফোনটা আমার হাতে ধরিয়ে দিল। রিং হচ্ছে। আমার হৃদস্পন্দন ভয়ানক বেড়ে গেছে। কয়েকবার রিং হয়ে কলটা কেটে গেল। আমি ফের কল করলাম। আবারও রিং হচ্ছে।
কয়েক মুহূর্ত পর। ওপাশ থেকে কান্নায় বসে যাওয়া গলায় নিতিন বলল,
-“হ্যালো। ”

-“নিতু, কি হয়েছে নিতু? সব ঠিক আছে তো?”

আমার কথা শেষ হতেই নিতিন হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো ফোনের ওপাশ থেকে।
-” দাভাই, দাভাই…..সব শেষ হয়ে গেছে।”

-“কি হয়েছে আপু? বল প্লিজ। আমাকে এভাবে ভয় পাইয়ে দিস না। আম্মা, বাবা, দাদি সবাই ভালো আছে তো?”

নিতিন এবার বাবা শব্দটা বলে অন্যরকম একটা আওয়াজে চিৎকার করে উঠল।
-” দাভাই, বাবা…..বাবা কথা বলছে না। চোখও মেলছে না। ওরা বলছে বাবাকে দাদুর কাছে রেখে আসবে।”

আমার নিশ্বাস আটকে গেল। দাদু আমাদের ছেড়ে গেছে দশ বছর আগে। তার বসতি এখন আজিমপুর কবরস্থানে অন্যান্য পরপার বাসীদের সঙ্গে।
(গল্পের মোড় ঘোরা শুরু…..)

চলবে…..

একদিন নববর্ষা -১৪
অদ্রিজা আশয়ারী
____________

সেদিন ভরা বাজারের মধ্যে, গলা পর্যন্ত উঠে আসা কান্নাটা খুব কষ্টে গিলে নিতে হয়েছিল। কুঠিবাড়ির কেয়ারটেকার ফজলুর কাছে চাবি হস্তান্তর করে বিকেলেই বিদায় জানালাম গরানবনকে। বর্ষার সঙ্গে শেষ দেখা হলো না। বর্ষার অজান্তে নাব্য হারিয়ে গেল। তার থেকে বহু দূর…।
পুরো যাত্রাপথে কোথাও আমি একবারের জন্য কাঁদিনি। এই আচমকা ধেয়ে আসা আঘাতটা ভেতর থেকে জমিয়ে দিয়েছে আমাকে।

আমার বাবা, ছোট বেলায় যার কাঁধে চড়ে পুরো শহর ঘুরে বেড়াতাম, যার চায়ের কাপের শেষাংশে সর্বদা আমার ছিল অখণ্ড অধিকার। হোক ঘরে কিংবা বাইরে। বাবা চায়ে কয়েকটা চুমুক দিয়েই আমাকে দিয়ে দিতেন। আমার জন্য বাবা জীবনে অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত করেছিলেন নিজেকে।

চোখ বুজে মাথা হেলিয়ে রেখেছিলাম সিটে। এইবার একটা জোড়ালো দীর্ঘ নিশ্বাস পরল। ছোট বেলায় নাব্যর চোখে বাবা ছিল সুপারম্যান। বড় হয়ে ক্রমে ক্রমে সেই বাবা তার চোখে ধূসর হয়ে আসছিল। আর আজ চিরকালের মতো বিদায় নিল। কোনো পিছুটান আটকে রাখতে পারেনি বাবাকে। ওপারে যাদের চলে যাবার হয়, তাদের কোনো পিছুটান ঠেকিয়ে রাখতে পারে না কখনো। এই হলো দুনিয়ার চিরায়ত রীতি। টের পেলাম আমার বা চোখ গড়িয়ে জলের ধারা নেমে এসেছে। দুহাতে মুখ ঢেকে ফেললাম।

পাসের সিটের লোকটি ইতস্তত করে বলল,”এনি ট্রাবল স্যার?”
নিজেকে সংযত করে মুখ থেকে হাত সরিয়ে মাথা না উঠিয়ে বললাম,”নো।”

-“আর ইউ শিওর? আসলে সকালেই আমি নিউজ টা দেখেছি। আপনার বাবার ফ্যাক্টরিতে লাগা আগুনটা সত্যিই ভয়াবহ ছিল। তিনি নিজে এর দ্বারা সরাসরি আক্রান্ত না হলেও প্রচন্ড মানসিক চাপে ভুগছিলেন। ফ্যাক্টরির সাত জন কর্মীর তো স্পট ডেড। সেই সঙ্গে প্রচুর লোকসান। সবার ধারণা এই ব্যাপার টাই ওনার প্রচন্ড মানসিক চাপের কারণ। তারপর এর থেকেই হার্ট অ্যাটাকের মতো ব্যাপার অবধি গড়াল অবস্থাটা। ”

আমি নিরব রইলাম। লোকটা ফের বলল,
-“মিডিয়া বোধহয় এই সময় সেখানে আপনার উপস্থিতি আশা করেছিল। তাই আপনার না থাকার ব্যাপার টা তারা ফলাও করে প্রচার করেছে। ”

কথা বলার মতো অবস্থায় নেই আমি। সবকিছু ভেসে যাক। কিছুর পরোয়া করি না। বাচ্চা ছেলের মতো জোড়ালো অভিমানে কান্না গলার কাছে উঠে আসছে বারবার। বাবা কেন আমাকে ছেড়ে গেলেন? আমিতো বরাবরই এমন ছিলাম৷ তবুও কেন আমাকে একটু সংকেত দিলেন না। অন্তত একটাবার এই কথাটা বলার সুযোগ পাওয়ার অধিকারতো আমার ছিল যে “বাবা, আমি সত্যি তোমাকে খুব ভালোবাসি। তুমি যতটা বাসো তার দশভাগের একভাগ হলেও বাসি।”
প্লেন ঢাকা বিমানবন্দরে প্রবেশ করছে। লোকটার কথা এড়াতে আমি হঠাৎ জানালায় সেদিকে মনোযোগী হয়ে পড়লাম।

***

রাবেয়া মঞ্জিল আজ আর শুনশান নীরবতায় আছন্ন নয়। প্রচুর মানুষ গেটের বাইরে, ভেতরের খোলা জায়গায় পায়চারি করছে, কেউবা বসে আছে। তাদের সবার মাঝে আড়াল করে আছে একটা লম্বা খাটিয়া। দূর থেকে দেখছি বাবার গায়ে মোড়ানো সাদা কাফনের কাপড় উড়ছে বাতাসে। আমি এই প্রথম শব্দ করে কেঁদে উঠলাম আশেপাশের সবার অস্তিত্ব ভুলে। এই সময়ের অনুভূতি কাউকে বোঝানো যায় না। মানুষ কতটা অসহায় আল্লাহ ছাড়া। দূরে আমার কাফনে মোরা বাবাকে দেখে তা উপলব্ধি করতে পারলাম। আমাদের জীবনের চাবি আমাদের হাতে নয়। যার কাছে তিনিই অসীম, সবচেয়ে পরাক্রমশালী।

হাটু মুড়ে বসে পড়লাম আমি। সামনে আর একপা এগানোর শক্তি নেই। আমাকে দেখে মামা ব্যাস্ত হয়ে ছুটে এলেন। বলে উঠলেন,
-” নাব্য এসে গেছে। এইবার লাশকে গাড়িতে তোলার ব্যাবস্থা করো তোমরা। জানাযার জন্য আর অপেক্ষা করা যাবে না।”

“লাশ” শব্দটা শুনে সারা দেহে মৃদু একটা শিহরণ বয়ে গেল আমার। দেহ থেকে প্রাণ বেরিয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে সে হয়ে যায় লাশ! বাবা মায়ের দেয়া ডাক নামটা তখন অকেজো। আর কখনো সেই নামে ঢাকা হয়না তাকে।

আমাকে কেউ একটু বাবার সাথে দু-দন্ড একান্তে কাটানোর সময় দিল না। সবকিছু ঘটতে লাগল নিদারুন ব্যাস্ততার সাথে। নিতিন, আম্মা এখন পর্যন্ত কারো সাথে দেখা করিনি। ওদের মুখোমুখি হওয়ার সাহস পাচ্ছি না আমি। সবাই জানাযার উদ্দেশ্যে রওনার জন্য তৈরি। বাবাকে গাড়িতে তোলা হচ্ছে। হঠাৎ নিতিন ভেতর থেকে পাগলের মতো ছুটে বেরিয়ে এল। তার পেছন পেছন রশু। দৌড়ে এসে বাবার খাটিয়ার কাছে ঝুকে পড়ল তার বিধস্ত মুখটা। বড় মামা এই অবস্থায় তাকে একটা কড়া ধমক দিলেন। নিতিন বেপরোয়া। ছুটে এসে আমার শার্ট খামচে ধরে হুংকার দিয়ে বলল,
-” তুমি আটকাচ্ছো না কেন? ওরা বাবাকে কোথায় নিয়ে যেতে চাইছে তুমি জানো? বাবাকে দাদুর কাছে রেখে আসবে।
আমার ভালো, সুস্থ বাবাকে ওরা লাশ বলছে। এইতো কাল সকালেই বাবা আমাকে বলেছে তার জন্য পায়েস বানাতে। আর দুপুরেই ওরা বলল বাবা নাকি মরে গেছে। তুমি বলো এরকম কি কখনো হতে পারে? ”
নিতিন পুরো পাগল হয়ে গেছে। চোখ দুটো ভীষণ ভাবে ফোলা, রক্তিম। চেহারা বিধস্ত। দেখে মনে হচ্ছে যেকোনো সময় জ্ঞান হারাবে সে। হয়তো বাবার মৃত্যুর মতো এত বড় একটা ব্যাপার এখনো স্বীকার করে নিয়ে পারেনি তার মস্তিষ্ক। বুঝলাম কাল থেকেই চলছে নিতিনের এই পাগলামি। তাই মামা তাকে এই পরিস্থিতিতেও ধমকাতে বাধ্য হয়েছেন।
তার পেছনে রশু অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে। নিতিন কে সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে বোঝা গেল।

আমি নিতিনকে খুব আলতো করে ধরে একটু দূরে সরিয়ে আনলাম৷ নিতিন বাবার দিকে আঙুল তুলে কিছু একটা আবার বলতে যাচ্ছিল। আমি চাপা স্বর বললাম,
-“চুপ চুপ। বাবা ঘুমোচ্ছে। কথা বলিস না। ”
নিতিন হঠাৎ চুপ হয়ে গেল।
আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে ফের বললাম,
-” তুই তো বাবাকে খুব ভালোবাসিস। তাহলে কেন এভাবে কষ্ট দিচ্ছিস? তোর কান্না শুনলে বাবার কষ্ট হয় জানিস না?”

নিতিন ফিসফিস করে বলল,
-“আমি আর কাঁদবো না। ” কিন্তু তখনো নিতিনের চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। সে হঠাৎ একেবারে চুপ হয়ে গেল। বাবার দেহটা গাড়িতে তোলা হলো। বন্ধ হয়ে গেল গাড়ির দরজা। নিতিন যেন সেই দৃশ্য না দেখে আমি তাই ওর মাথাটা নিজের সাথে চেপে ধরলাম। ওর মাথায় হাত রেখে চুপচাপ তাকিয়ে রইলাম গাড়িটার দিকে। চোখ থেকে নেমে আসা উষ্ণ স্রোতে ভিজে যেতে লাগল দু গাল। ধীরে ধীরে গাড়িটা গেট পেরিয়ে দৃষ্টির বাইরে চলে গেল। শেষ দৃশ্যটা নিতিন দেখে ফেলল। কয়েকবার হিচকি তুলে হাল ছেড়ে দেয়া গলায় সে আমাকে ডেকে উঠল,
-” দাভাই, আমাদের বাবা সত্যি মারা গেছে তাইনা? বাবা ঘুমায়নি। তুমি বলো, এটাই সত্যি তাইনা?”

নিতিন প্রশ্নাতুর চোখে উদ্ধিগ্ন হয়ে চেয়ে রইল আমার দিকে। আমি কিছু বলতে পারলাম না। শুধু মাথা নাড়লাম। নিতিন সম্পুর্ন ভর আমার ওপর ছেড়ে দিয়ে গগনবিদারী শব্দে চিৎকার করে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। ঠিক সেই মুহুর্তে আকাশ ভেঙে অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে বেজে উঠছে নিতিনের আর্ত কান্নার স্বর। তাকে ধরে আমি কাঁদছি। দূরে দাঁড়িয়ে কাঁদছে রশু। আর এইসব কে ছাড়িয়ে খুব ক্ষীণ একটা সুর আমাদের কানে বাড়ি খাচ্ছে। সেই সুর সকল জাগতিকতাকে ম্লান করে দিতে যথেষ্ট। কুরআনের সুর। দাদি সূরা ইয়াসিন পড়ছেন।

“নিশ্চয়ই আমি মৃতকে জীবিত করি এবং লিখে রাখি ওদের কৃতকর্ম ও যা ওরা পশ্চাতে রেখে যায়, আমি প্রত্যেক জিনিস স্পষ্ট গ্রন্থে সংরক্ষিত রেখেছি।”

_________________

বাবার মৃত্যু আমাদের পরিবারে অনেক পরিবর্তন নিয়ে এলো। আমার কলহাস্যময়, সদা প্রফুল্ল মা ভীষণ সিরয়াস হয়ে পড়লেন। সেই সাথে ভয়ানক দূর্বল। আমরা দুই মুহুর্ত চোখের আড়াল হলেই তিনি অস্থির হয়ে পড়েন।
নিতিন নিজেকে গুটিয়ে নিল। ফিরিয়ে নিল সব দিক থেকে। দাদি আজকাল সারাদিন জায়নামাযেই বসে থাকেন। ঘর থেকে বেরোন খুব কম। কথা বলেন খুব কম।

আর সবচেয়ে বেশি বদলালাম বোধহয় আমি নিজে। বেপরোয়া ভাব ছেড়ে বাবার রেখে যাওয়া ব্যাবসায় পুরোপুরি ডুব দিলাম। সব কিছু বুঝে নিতে লাগলাম। মায়ের আদেশে। লেখালেখি আর ভালোবাসা বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে রইল। আমি ছুটলাম ব্যাবসার পেছনে।
বোধহয় তিনমাস পেরোল। গরানবন থেকে দূরে, বর্ষা থেকে বিছিন্নতার।

বাবার মস্তিষ্কের একটা দিক সবসময় আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় ব্যাস্ত থাকতো। তিনি মারা গেছিলেন হার্ট অ্যাটাকে। তারপর থেকেই একটা গোপন অপরাধবোধে ভুগছি আমি। এতকাল পর্যন্ত পুরো ব্যাবসা একা হাতে সামলেছেন তিনি। ভেবেছিলেন হয়তো আমি সামর্থ্যবান হলে তিনি বিশ্রাম নেবেন। কিন্তু সেই সুযোগ কখনো দেইনি আমি। চিরকাল ব্যাস্ত থেকেছি নিজের শখ, মর্জি খেয়াল নিয়ে। বাবাকে হারিয়ে তাই আজ এত অনুগ্র আমি।

এক রাতে, সবে ফ্যাক্টরি থেকে ফিরেছি। ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি আম্মা বসে আছেন আমার ঘরে। বাইরে থেকে এসেই ঘামে ভেজা শার্ট খুলে ছুড়ে ফেলেছিলাম বিছানায়। আম্মা সেটা মাটিতে নামিয়ে রাখলেন। কোল থেকে কয়েকটা ছবি নিয়ে শার্টের জায়গায় রেখে গম্ভীর মুখে বললেন,
-” নাব্য, তোকে বিয়ে করতে হবে। কয়েকটা মেয়ে এর মধ্যে দেখা হয়েছে। এখন তুই একটা পছন্দ কর।”

আমি হাসলাম।
-” কি যে বলো আম্মা। বিয়ে কি কুরবানির গরু নাকি। যে কয়েকটা দেখে একটা পছন্দ হলো আর কিনে ফেললাম!”

আম্মা উত্তেজিত স্বরে প্রতুত্তর করলেন।
-” বিয়ে কুরবানির গরু না। বিয়ে বিয়েই। এখানেও দেখাদেখির ব্যাপার আছে। তুই একটা পছন্দ কর। আমি সামনে এগোই। ”

আম্মা ভীষণ সিরিয়াস। তাই এবার আমিও সেভাবেই বললাম,
-” পছন্দ তো করাই আছে। তুমি সামনে এগোতে পারো। ”

আম্মা যেন প্রথমটায় বুঝলেন ই না আমি কার কথা বলছি। তারপর হঠাৎ গলার স্বর কঠিন করে বললেন।
-” ওই মেয়েটা বাদ। এখান থেকেই একটা পছন্দ কর।”

-” বাদ মানে?”

-” নাব্য, অবুঝের মতো কথা বলিস না। ওই জংলী মেয়ের কোনো যোগ্যতা আছে তোর বউ হওয়ার? ”

-” যোগ্যতা অযোগ্যতার কথা জানি না। বর্ষা ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করা সম্ভব নয় আমার জন্য। ”

মুহুর্তের মাঝে আম্মার সব কঠিনতা উবে গেল। ছলছল চোখে তাকিয়ে বললেন,” মায়ের মুখের ওপর এইভাবে কথা বলতে পারলি তুই? একটা মেয়ের জন্য। তাও আবার এমন মেয়ে যার কোনো ফ্যামিলি স্ট্যাটাস নেই, শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই, মর্যাদা নেই! ”

-” আম্মা, তুমিও আর পাঁচটা সাধারণ বাঙালি মায়ের মতোই কথা বলছ। তুমি যে কারণ গুলো দর্শিয়েছ তার চেয়েও অনেক গুরুতর একটা বিষয় আমাদের জীবনের সবকিছু জুড়ে আছে। সেটাই মুখ্য এখানে। আমি বর্ষাকে ভালোবাসি। ”

চলবে…..

একদিন নববর্ষা -১৫
অদ্রিজা আশয়ারী
____________

-“মায়ের সামনে এভাবে কথা বলতে লজ্জা করল না তোর নাব্য?
একটা কথা শুনে রাখ। এটা কখনোই সম্ভব না যে আমার বাড়ির বউ হয়ে আসবে একটা বধ্য গাইয়্যা, অশিক্ষিত পরিবারের মেয়ে। ওকে তুই বিয়ে করলে এবাড়িতে হয় ও থাকবে নাহয় আমি থাকব।” আম্মা সরোষে বললেন।

নিজের সিদ্ধান্তে আমি অবিচল। আম্মা ভাবছেন এবাড়িতে না ফিরলে আমার মাথা গোজার ঠায় নেই। সেই ধারণা সম্পুর্ন তার মনগড়া।
-” বিয়ে আমি বর্ষাকেই করব আম্মা। তবে বর্ষাকে নিয়ে আমি এবাড়িতে কখনো ফিরব না। তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো। ”

আম্মা আহত চোখে চেয়ে রইলেন। তিনি অনেক জোর দিয়ে কথাগুলো বলেছিলেন। হয়তো ভেবেছিলেন আমি এখনো ততটা দূরে সরে যাইনি। একটি নতুন ভালোবাসাকে কাছে পেয়ে, পুরনো ভালোবাসা গুলো এখনো ততটা মলিন হয়ে পড়েনি আমার কাছে। কিন্তু তার ধারণা ভুল প্রমানিত হল। তিনি বুঝলেন এইবার আমি অনায়াসে ছেড়ে দিতে পারবো তাদের। আম্মা আর একটি কথাও বললেন না। উঠে চলে গেলেন ঘর ছেড়ে।

তারপর থেকে আমি প্রতি রাতে ভীষণ দেরি করে বাড়ি ফিরতে শুরু করলাম। ঘরে খাওয়া একেবারেই ছেড়ে দিলাম। বাইরেও যে নিয়ম করে খাই তা নয়। ছোট বেলা থেকেই রাগ করলে খাওয়া- দাওয়া বন্ধ করে দেয়া। এ আমার আজন্ম জেদের অংশ। আম্মা বিষয় টা খেয়াল করলেন। মায়েদের মস্তিষ্কের স্রোত বোধহয় অন্যসবার চেয়ে আলাদা ধারায় বয়। হোক অভিমান, মতের অমিল, রাগ কিংবা কষ্ট। সেখানে ভালোবাসাই সবকিছুর প্রধান নিয়ন্ত্রক। তাই হয়তো মায়েরা পারে। মমত্বের জন্য নিজের ইচ্ছে, অবিচলতা, রাগ, জেদ, চাহিদা সবকিছুকে বিসর্জন দিতে।

ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত বারোটা বেজে সাইঁত্রিশ মিনিট। ফ্যাক্টরি থেকে আজকাল সরাসরি বাড়ি না ফিরে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে চলে যাই। সেখান থেকে ফিরতে ফিরতে নিত্যি প্রায় এত রাত হয়। সবে এসিটা ছেড়ে আয়েশ করে বিছানায় গা এলিয়েছি। বাতিগুলো সব নেভানো। ঘরে মৃদু মৃদু কালচে আলো চুয়ে চুয়ে আসছে বাইরের ল্যাম্পপোস্ট থেকে। দরজায় হঠাৎ করাঘাত হলো। অ্যাশট্রের ওপর সিগারেট রেখে সেদিকে দৃষ্টি ফিরালাম। আজকাল বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে সিগারেট খাওয়ার পুরনো বদ অভ্যেস টা আবার চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। দরজার বাইরে থেকে আম্মার নরম গলার স্বর ভেসে এলো।
-” নবু ঘুমিয়েছিস? আসবো?”

-“ঘুমাইনি। এসো।” গম্ভীর মুখে বললাম। সন্তর্পণে বাম হাতে অ্যাশট্রে টা বিছানার আড়ালে সরিয়ে রেখে।

আম্মা ভেতরে এলেন। গলায় ব্যাস্ত স্বর।
-“কখন ফিরেছিস? ”

-” এই আধঘন্টা আগে। ”

ইতস্তত করে ফের বললেন, “খেয়েছিস কিছু?”

কয়েক মুহূর্ত থেমে উত্তর দিলাম।
-“হুম। বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি।”

উত্তর টা যেন আম্মার কাছে যুতসই হলো না। তিনি কয়েক মুহূর্ত পর সংকোচ করে বললেন,
-“আমি ভাত এনে তোকে খাইয়ে দিই? তোর বাবা বেচে থাকলে এভাবে অভিমান করে নিজেকে কষ্ট দেয়াটা কখনো চালিয়ে যেতে পারতি না তুই। তোর বাবা চলে গিয়ে আমাকে সন্তানদের সামনে অসহায় করে রেখে গেছে। ”

এতটা নির্দয় বোধহয় তখনো হয়নি আমার মন। বললাম,
-“আচ্ছা।”

রাত একটা বাজে। সবাই পাড়ি জমিয়েছে ঘুমের পুরিতে। আম্মা পাশে বসে আমাকে খাইয়ে দিচ্ছেন। কোনো কথা বলছি না আমরা একে অন্যের সাথে। চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছি। নিতিন জেগে থাকলে নিশ্চিত এতক্ষণে আমার খাবারে ভাগ বসাতে ছুটে আসত।
আম্মা হঠাৎ বললেন,
-“নবু, কথা বলছিস না কেন? আর কতো মাকে এভাবে কষ্ট দিস? ”

-“কি বলব?” বলার সময় গলার স্বরটা বোধহয় বেশি কঠিন শোনালো স্বাভাবিকের চেয়ে।

আম্মা চুপচাপ তাকিয়ে রইলেন। তারপর হঠাৎ দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন,
-“একটা কথা জানাতে এসেছিলাম। তুই এখন বড় হয়েছিস। নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নেয়ার উপযুক্ত হয়েছিস। যদিও তুই যেটা চাইছিস সেটা আমি সমর্থন করি না। তবে আজ তোর বাবা থাকলে তোর জীবনের ডিসিশন নেয়ার অধিকার টা সম্পুর্ন তোর ওপরই ছেড়ে দিতেন। সেটাই বোধহয় ঠিক।
তুই যা চাস তা করতে পারিস। ওই মেয়েকেই বিয়ে করতে চাইলে আমি আর বাঁধা দেব না। তবে কখনো আমাদের থেকে আলাদা হওয়ার কথা ভাবতে পারবি না। যাকেই বিয়ে করিস, এই বাড়িতেই থাকতে হবে। ”

এবার আমার অবাক হওয়ার পালা। ঘুরে তাকালাম আম্মার দিকে। ভ্রু কুচকে বললাম,
-” সত্যি বলছো? বর্ষাকে নিয়ে তোমার কোনো আপত্তি নেই? ”

আম্মা মলিন হাসলেন।
-“সত্যি বলছি।”

____________________

বাবা মারা যাওয়ার পর এই প্রথম একসাথে হাসি ফুটল আমাদের পুরো পরিবারের মুখে। তোরজোর চলতে লাগল। ঠিক হলো আমি আর রশু একদিন আগে চলে যাব গরানবন। সেখানে একটা বাংলো ঠিক করা হবে সবার থাকার জন্য। কুঠিবাড়িতে দুটো মাত্র ঘর। জায়গা সংকুলান অসম্ভব। পরদিন আম্মা নিতিন আর বড়মামাকে নিয়ে গরানবনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবেন।
নিতিন পুরো ব্যাপারটা নিয়ে ভীষণ এক্সাইটেড। সে কখনো গ্রাম দেখেনি। আর সেখানে সুন্দরবনের মতো অরণ্য। বর্ষা দেখতে কেমন হবে, বর্ষার কথাবার্তা কেমন হবে এসব নিয়েও সে যথেষ্ট কৌতুহলী।

আম্মার মতো দাদিও কেবল নিমরাজি হয়েছেন পুরো ব্যাপারটায়। অবশ্যি আপাতত তাতেই খুশি আমি। আগে ব্যাপার টা সামনে তো এগোক। বর্ষার সঙ্গে তাদের সখ্যতা গড়ে ওঠার জন্য অনেক সময় পড়ে আছে।

-“দাদি আসবো? ”

দাদি মুখ ফিরিয়ে আমায় দেখলেন,
-” আয়।”

-” তোমার জন্য একটা পার্মানেন্ট দাসি আনার ব্যাবস্থা করতে যাচ্ছি। দোয়া করো।”

দাদি আড়চোখে তাকালেন।
-” সেই তো দেখতাছি। আমার জন্য দাসি আনার চিন্তায় তোর রাতের ঘুম হারাম হয়া গেসে। যা যা নিয়া আয়। দাসি আইনা আমগরে একটু স্বস্তি দে।” বলে দাদি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।

আমি দাদির ভাজ পড়ে যাওয়া হাতটা কিছুক্ষণ ধরে রেখে তাতে চুমু খেয়ে বেরিয়ে এলাম।

বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে আম্মা ঠিক একই ভাবে আমার হাত ধরেও চুমু খেলেন। আড়াল করার অনেক চেষ্টার পরও আম্মার হাসির মুখোশ পড়া মুখের আড়ালে মলিন মুখখানা আমার নজর এড়ালো না।

আমি বুঝতে পারছি তিনি মন থেকে কিছুই মেনে নেননি৷ আমার খুশির জন্য মেনে নেয়ার অভিনয় করে যাচ্ছেন কেবল।

__________________

তোমার বাড়ির রঙ্গের মেলায়
দেখেছিলাম বায়স্কোপ
বায়স্কোপের নেশায় আমায় ছাড়েনা ।

আদতেই যেন বায়স্কোপের নেশায় আছন্ন হয়েছি। জীবনের সব রঙ, ধূসর স্বপ্নেরা আজকাল এখানেই এসে হাতছানি দেয় আমায়। গরানবনের এই জরাজীর্ণ পর্ণকুটিরে।
মনে অস্থিরতা ভীষণ। তিনমাস আগে শেষ দেখা হয়েছিল আমাদের। তারপর পুরোপুরি বিছিন্ন আমরা একে অন্যের থেকে। তিনমাস সময় টা নিশ্চয়ই কম নয়। বর্ষা আমাকে ভুল বুঝবে না তো! অবশ্যি চাইলেও যোগাযোগ সম্ভব ছিল না। বাবার মৃত্যু ওলটপালট করে দিয়েছিল আমাদের সাজানো গোছানো পরিবারটাকে। আচমকা আসা এই আঘাতের ঢেউ ভুগিয়েছে বেশ।

রশুকে নিয়ে বর্ষার বাড়ির আঙ্গিনায় পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভেতরের দ্রিমদ্রিম হাতুড়ি পেটানোর আওয়াজ টা অনুভব করতে পারলাম। আনন্দ আর শংকা মিশ্রিত অদ্ভুত এক ভালো লাগায় ডুবে আছি।

রোদ্দুর হেলে পড়া খাঁ খাঁ দুপুরে, বর্ষাদের ছোট বাড়িটি সারশূন্য হয়ে চেয়ে আছে যেন আমাকেই লক্ষ্য করে। রশু একবার ভ্রু কুচকালো। এই ভর দুপুরে পুরো বাড়িতে কেউই কি নেই!
-“বর্ষন, বর্ষন।” রশু ডাকল কয়েকবার৷ কেউ বেরিয়ে এল না।
এবার আমি ডাকলাম। অবশ্যই বর্ষার নাম ধরে। কিছুক্ষণ পর একটি বন্ধ দরজা খুলে বেরিয়ে এল বসির শেখ। সরু চোখে চেয়ে বিরক্তি মেশানো থামা থামা স্বরে বলল,
-“আরে সাহেব দেহি! হঠাৎ কি মনে কইরা? যদি ফজলু মিয়ার খোঁজ জানতে চান, সোজা বাজারে চলি যান। সেইখানেই পাবেন ওরে৷। কুঠিবাড়ির চাবিও ওর কাছে। ”

বসির শেখের তেড়া কথা আজ আর খারাপ শোনালো না আমার কানে। মুখে হাসির ক্ষীণ আভাস নিয়েই বললাম
-“ফজলুর খোঁজ নিতে আসিনি। দরকার টা আপনার সঙ্গেই। একটু কথা ছিল। ”

-“আমার সঙ্গে কি কথা ! আচ্ছা বলেন দেহি। ”

-” আমি বর্ষাকে বিয়ে করতে চাই। কাল আমার মা আসবেন আপনাদের সঙ্গে পাকা কথা বলার জন্য। আপনি..”

কথার মাঝপথে আমাকে থামিয়ে দিয়ে দায়সারা ভাব নিয়ে হেসে উঠল বসির শেখ। মুখ দিয়ে চু চু শব্দ করে বলল,
-” বড় আফসোসের কথা। এই সম্মন্ধ হওয়ার কোনো সুযোগ এহন আর নাই। আপনের আম্মা বিনা কারণে এতদূর কষ্ট কইরা আসব। ”

-“সুযোগ নেই মানে?” আমি কিছু বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

কনিষ্ঠা আঙ্গুল দ্বারা কানা চুলকাতে চুলকাতে বসির শেখ বলল,
-” সপ্তা পার হইল মেয়ার বিয়া হইছে। গায় গেরামে থাকি। তার উপর মেয়ার নামে কথা ছড়াইতে আরম্ভ করছিল। যাইহোক এহন আমি নিশ্চিত হইছি।খুশি মনে বিদায় দিসি মেয়ারে। ”

বসির শেখের কথাগুলো অর্থহীন মনে হল আমার কাছে। শূন্য মস্তিষ্কে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলাম সামনের লোকটির দিকে । তারপর ধীরে ধীরে ব্যাপার টা স্পষ্ট হতে লাগল। বসির শেখের কথার মানে বুঝতে পারলাম আমি। সঙ্গে সঙ্গে দু’পা এগিয়ে তে/ড়ে গিয়ে ওর কলার চে/পে ধরলাম।
-“বিয়ে হয়ে গেছে মানে? বিয়ে হয়ে গেছে মানে কি?” চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। পরমুহূর্তেই ওর কলার ছেড়ে ঘরের সামনে গিয়ে চিৎকার করে বর্ষাকে ডাকতে শুরু করলাম।
-“বর্ষা বর্ষা, কোথায় তুমি? জলদি বেরিয়ে এসো। এসব বাজে কথা কানে অসহ্য ঠেকছে আমার। তুমি সামনে এসো প্লিজ। একদম ভয় পেয়ো না। আমি আছি তো। এই লোকটা কিছু করতে পারবে না তোমায়। বর্ষা….”
আমার এত আকুলতা সত্ত্বেও বর্ষা ছুটে বেরিয়ে এল না। আমি ভাবলাম বর্ষাকে নিশ্চিত কঠিন ভাবে নিষেধ করা হয়েছে বাইরে বেরোতে। বা হয়তো ওকে মা’রধর কোনো একটা ঘরে আটকে রেখেছে বসির শেখ। বর্ষা হয়তো শুনছে আমার ডাক, হয়তো ছুটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু পারছে না।
সহসা বাড়ির পেছনে যে বন শুরু হয়েছে তার সম্মুখ ভাগের ঝোপটা দুলে উঠল। আমি শ্বাস আটকে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। নিশ্চয়ই বর্ষা আমার আসার খবর পেয়ে ছুটে এসেছে।
-“বর্ষা…”

চলবে….