একদিন নববর্ষা পর্ব-১১+১২

0
125

একদিন নববর্ষা – ১১
অদ্রিজা আশয়ারী
_____________

নদীর এ-কূল ভাঙে,
ও-কূল গড়ে
এই তো নদীর খেলা।

আমাদের সম্পর্কের ভাঙন টাও যে এত ক্ষিপ্রবেগে ধেয়ে আসছে ভাবিনি আমরা কেউ। না বর্ষা না আমি। পরদিন সকালেই সেই ভাঙনের প্রথম ইশারা নজরে পরল। রোজ সকালে বর্ষার দেয়া চায়ে ঘুমের রেশ কাটে। আজ ঘুম ভেঙে দোর খুলতেই দেখি বর্ষার মা উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছে। আমাকে দেখেই কাজ ফেলে হেঁশেলের দিকে ছূটল। মিনিট ঘুরতেই ফিরে এল চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে।
-“সালাম সাহেব। আপনের চা।”

অনেকগুলো ভাবনা একই সময় আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। একটা অনিশ্চিত আশংকায় মুখের হাসি গায়েব হয়ে গেছে। নিশব্দে চা নিয়ে চুমুক দিলাম। সেদিনের মতো আজও চিনি ক্ষানিকটা বেশি। তবে বর্ষার মা যথাসম্ভব নিপুণ ভাবে কাজ করার চেষ্টা করছে তা বোঝা গেল।

একই ভাবে দাঁড়িয়ে বিমুঢ়ের মতো ভাবতে ভাবতে আরও কয়েকবার চায়ে চুমুক দিতেই কাপের তলানিতে জমে থাকা চিনি এসে ঠেকল মুখে। কড়া চিনি খাওয়ার অভ্যেস না থাকায় বাধ্য হয়ে মুখে থাকা অবশিষ্ট চা বা-পাশের মেহেদী গাছের গুড়িতে ফেললাম। আমার অসংযত জেদটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল ফের। চট করে বললাম,
-“বর্ষা কোথায়? ও আসেনি যে?”

ঝাড়ু ফেলে বর্ষার মা অপরাধীণির মতো ভয়ে ভয়ে বলল,
-” মাইয়ার অসুখ। এহন থেইকে আমিই কাম করুম। ”

বর্ষার মা মিথ্যে বলছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। বুঝতে বাকি রইল না আর। এ হলো বসির শেখের চক্রান্ত। বর্ষাকে আমার সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখার।

জানিনা কিভাবে এত সহ্যক্ষমতা এলো আমার। সবকিছু বুঝেও পরের দুদিন একেবারে ঝুম রইলাম।
আর হৃদয়ের বাটখারা ভারি হতে লাগল সেই অদৃশ্যময়ীর প্রতি অজানা, এক অহেতুক অভিমানে। বারবার মনে হলো তল্পিতল্পা গুটিয়ে এবার ফিরে চলি। আর কেন এখানে পড়ে থাকা! কিসের জন্য থাকা! সেই নিষ্ঠুর মানবী তো আমাকে ভুলেছে সর্বাঙ্গীণ। তবে আর কেন এই মৃগয়া ভূমে আমার অনর্থক বিচরণ!

এর পরদিনই কিন্তু মন বদলে গেল। অভিমানের সুর বদলে রুপ নিল প্রণয়ের গানে।
সব ভুলে লেখায় মন দিয়েছিলাম। যার অযুহাত টেনে ফের এই অরণ্য মধ্যে আসা। জানালা সংলগ্ন কাঠের টেবিলে ছড়ানো কাগজের পাতার আবেশে ডুবে ছিলাম পুরোপুরি। জানালায় ছোট পাথর ছুড়ল কে যেন। পাত্তা না দিয়ে লেখায় মন দিলাম। ফের একটা তীক্ষ্ণ আওয়াজ। বনের কোনো প্রাণী হবে ভেবে আবারও এড়িয়ে গেলাম।

হঠাৎ জানালার সামনে ভুতের মতো আচমকা ভেসে উঠল বর্ষার মুখ। জানালার গরাদে হাত রেখে, নির্মল দুটি চোখে চেয়ে বর্ষা হাসছে। আমি বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। গরাদে রাখা বর্ষার হাতের ওপর নিজের হাত রেখে অধৈর্য হয়ে বললাম,
-“বর্ষা, বর্ষা…. কেমন আছো তুমি?”
উত্তরে বর্ষা কেবল স্মিত হাসল। সেই হাসিতে প্রাণ অল্পই ছিল।

-“তুমি বাইরে কেন দাঁড়িয়ে? ভেতরে এসো। ” বলেই দরজার দিকে পা বাড়ালাম ওকে নিয়ে আসার জন্য।
এই প্রথম কথা বলল বর্ষা।
-“শোনেন…… শোনেন। এহন ভেতরে আসতে পাইরবো না। আপনি এইদিকে আসেন। স্থির হয়া বসেন এইখানে। আর বলেন কেমন আছেন?”

ভেবেছিলাম কোনো ভাবেই নিজেকে বিকাবো না এইবার। বর্ষা এলেও অভিমানে অবিচল থাকব। কিন্তু বর্ষা আসতেই আমার সব রোষাবেশ এক মুহুর্তে গলে জল হয়ে গেল। হঠাৎ জেদি বাচ্চার মতো অভিমানী স্বরে বলে উঠলাম,
-“বর্ষা তুমি এতোদিন আসো নি কেন? আমি কিভাবে ভালো থাকব ভেবেছো একবারো?” খেয়াল করলাম আমার গলার স্বর কাঁপছে ভীষণ আদ্রতায়।

বর্ষা মুখখানি অবিচল রেখে স্থির চোখে চাইল আমার দিকে। জানালার ফাঁকে হাত গলিয়ে আমার হাত ধরে ভীষণ সমঝদারের মতো গম্ভীর মুখে বলল,
-“এত অস্থির হয়েন না। আমি অপারগ। বাজান সব জাইনা গেছে। এইখানে আমার আর কাজে আসা হইব না। ”

-“সব জানার পর তোমাকে কোনো কষ্ট দেয়নি তো? ঠিক আছো তো তুমি? ”

বর্ষা ফের একবার আমাকে ফাঁকি দেয়ার হাসি হাসলো। সেই সময় প্রথম বর্ষার ঠোঁটের বা পাশে চেরা দাগটা আমার নজরে পড়ল। সাথে সাথেই নজর ঘুরল ওর দুই হাতে। সেখানে অসংখ্য খয়েরী রেখা। বুঝতে সময় লাগলো না ওগুলো মা/রের দাগ।
মুহুর্তে ভেতরে ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠল দপ করে। বর্ষা আর আমার মাঝে গরাদের প্রাচির আছে সেকথা ভুলে গিয়ে বর্ষার হাত টেনে ধরলাম স/জোরে।
-“এই দাগ কিসের?” আমার গলার স্বর ক্রোধে ভয়ানক ভাবে কাপঁছে।
-” ওরা তোমাকে মে/রেছে?”

প্রশ্ন করে আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে উঠে দাঁড়ালাম। গন্তব্য বসির শেখের বাড়ি। বর্ষা বুঝতে পেরে চেচিয়ে উঠে বাইরে থেকেই আমার হাত টেনে ধরল।
-“দোয়াই লাগে। আপনি কোথাও যাইবেন না। আল্লাহর কিরা। নাইলে আমি আর কোনোদিন আপনের সাথে দেখা কইরতে আসমু না। ”
শেষ কথাটা শুনে আমি বর্ষার মুখের দিকে ফিরলাম। তার চোখ মুখ শক্ত। বলার ধরনে দৃঢ়তা শতভাগ।

ছেলে বেলা থেকেই আমার জেদের বিশেষ মূল্য ছিল বাবা মায়ের কাছে। এমন কখনো হয়নি। কোনো একটা বিষয়ে জেদ করেছি আর সেটা পাইনি। রাগ দমানোর আগেই রাগের কারণ খুঁজে বের করে তা মিটিয়ে দিয়েছেন তারা। তাই রাগ নিয়ন্ত্রণের জন্য নিজের সাথে যুদ্ধে জড়াতে হয়নি কোনোদিন। জানি না কিভাবে অন্যের কথা ভেবে দমাতে হয় নিজের বেপরোয়া ক্রোধ!

আজ, হয়তো এ-ই জীবনে প্রথম, এত প্রচেষ্টা করতে হলো নিজের ক্রোধকে সংযত করার জন্য। দেহের প্রতিটি শিরা উপশিরা জ্বলছে ক্রোধে। ইতোমধ্যে আমার নিশ্বাস নিতে কষ্ট শুরু হয়েছে।

আমি নিরবে বসে পড়ে বর্ষার পানে চেয়ে অশান্ত মনকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছে। ভালোবাসার উগ্র শক্তির কাছে পরাজিত হয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছি আমি। নিজের বলতে আমার আর কোনো শক্তি নেই।
-“বর্ষা, তুমি কেন আমাকে থামাচ্ছো? ওরা তোমাকে মে/রেছে? আটকে রেখেছে। তবুও আমাকে চুপ থাকতে বলছো!
ওরা তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। তাই না? তুমি এসো। আর কক্ষণো যেও না ওবাড়ি। আমরা এখান থেকে অনেক দূর চলে যাব। কেমন?”

কতটা বিবশ হয়েছি। নিজের কথায় বুঝতে পারলাম। যেখানে বর্ষার গায়ের প্রতিটি আচড়ের বিনিময় শোধ তোলার কথা ছিল সেখানে আজ বর্ষার মুখপানে চেয়ে পালানোর প্রস্তাবে ওর অনুমতি প্রার্থনা করছি আমি!

অথচ বর্ষা আমার এই কথাটাকেও ছেলেমানুষি ভেবে হেসে উড়িয়ে দিল। একমুহূর্ত নিচু হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে জানালার গরাদের ফাঁক দিয়ে বাড়িয়ে ধরল একটা ফ্লাস্ক।
-” এইখানে তিনকাপ চা আছে। থাউকি বেলাতে আমি ফের বর্ষনরে পাঠামু। ওর হাতে ফ্লাস্ক দিয়া দিয়েন। ততক্ষণ পর্যন্ত এইটা দিয়া কাজ চালান। এহন আমি আসি৷ পলায়া বের হইছি বাড়ি থেইকে। কেউ দেখলে সর্বনাশ। আর একটা কথা। আপনি কক্ষনো ভুলেও আমাগর বাড়ির দিকে যাইবেন না। আল্লাহর কিরা। কথাটা মনে রাইখেন। ” বলে বর্ষা এক এক মুহুর্ত রইল না। যেভাবে উড়ে এসেছিল। ঠিক সেভাবেই উড়ে চলে গেল। মাঝখানে আমার বুকে রেখে গেল এক আকাশ দলছুট কালো মেঘ।

ফজলু মিয়ার সাথে বসির শেখের একটা ভালো বোঝাপড়ার সম্পর্ক আছে। সে ব্যাপারে আমি অবগত ছিলাম। বিকেলে সে রোজ একবার ঘুরে যায় এদিক থেকে। আমার কিছু প্রয়োজন কিনা জেনে অনেকসময় এনে দেয় মফস্বল থেকে। আমার ধারণা আমার আর বর্ষার ব্যাপার টাও সে পুরোপুরি অবগত। আজ বিকেলে যখন এলো, চলে যাওয়ার ঠিক আগ মুহুর্তে ফ্লাস্কের দিকে নজর পরল ওর। সবে তখন বর্ষন ওটা রেখে গেছে। হেসে বলল,
-” কই পাইলেন সাব? ভাবছিলাম জিজ্ঞেস করমু আপনেরে। মফস্বল থেইকে একটা আনন লাগব কিনা। ”

হঠাৎ কি জবাব দেব ভেবে পেলাম না। মিথ্যা বলা অসম্ভব। তার ওপর ওর অভিব্যক্তি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কে দিয়েছে ফ্লাস্কটা ইতোমধ্যে সেই বিষয়ে জ্ঞান আছে তার। দায়সারা হয়ে বললাম,
-“বর্ষন এনেছে।”
উত্তর টা ওর পছন্দ হবে না জানতাম। ফজলু মাথা নেড়ে দাঁত খিলাই করতে করতে উঠোনে নেমে গেল।
-“একটু বাজারতন ঘুইরা আসি। আপনের কিছু লাগব?”

-“না।”

-“আইচ্ছা।”

***

ভেবেছিলাম এভাবেই দিন কেটে যেতে থাকবে। চাচ্ছিলাম আর যাইহোক। একেবারে যেন সংযোগ বিচ্ছিন্ন না হয়ে পড়ে আমাদের। কিন্তু এক এক করে এরপর তিনদিন কেটে গেল। বর্ষা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। না বর্ষা না বর্ষন। ভাইবোন কারোর কোনো খবর নেই। এদিকে গত দুদিন থেকে বর্ষার মায়ের বদলে সম্পুর্ন অপরিচিত একটি মহিলা এসে কাজ করতে শুরু করেছে।

বর্ষার কথা মনে রেখেছি আমি। যত কষ্টই হোক। নিজের মনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নিজেকে বারবার রুখেছি ওবাড়ি যাওয়া থেকে। ভেতরে ভেতরে আমার বিষন্ন মনে জখম ছড়াচ্ছে। বুঝতে পারছি আমাদের অগোচরে যে ভালোবাসায় শিশমহল গড়েছিলাম আমরা, তা খুব নাযুক অবস্থায় আছে। ভেঙে খান খান হয়ে যাবে যেকোনো সময়।

এই সময় আমার পাশে রশুর প্রয়োজন খুব বেশি অনুভব করছি। আমার মাথাটা অকেজো এখন। চিন্তা শক্তি লোপ পেয়েছে। মস্তিষ্কের সমস্ত কার্যক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে ভালোবাসা নামক এক বিষাক্ত অনুভূতি!

রান্নার নতুন মধ্যবয়সী মহিলাটির নাম জমিলা। আমি ডাকি জমিলা চাচি। একেবারেই সহজ সরল । কাজে-কর্মে ভীষণ আন্তরিক।

বর্ষার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার চতুর্থ দিন। বিকেলে জমিলা চাচি উঠোন ঝাড় দিতে দিতে কথায় কথায় বললেন। এবাড়িতে করিমন বিবি অর্থাৎ বর্ষার মায়ের কাজ ছাড়ার কারণ। আজ বিকেলে পাশের গ্রাম থেকে পাত্র দেখতে আসবে বর্ষাকে। চায়ের পেয়ালা হাতে বারান্দায় বসে ছিলাম। জমিলা চাচির কথা পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই উঠে দাঁড়ালাম। পেয়ালা গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। চারিদিকে চায়ের ছড়াছড়ি। আমি ক্রোধে অন্ধ হয়ে হাটা ধরলাম পুবে। বর্ষার বাড়ির দিকে। বসির শেখের সঙ্গে আজ অন্তিম বোঝাপড়া সেরে আসব।
চলবে……

একদিন নববর্ষা -১২
অদ্রিজা আশয়ারী
__________

ক্রোধে দিকবিদিকশুন্য হয়ে ছুটে গেলাম বর্ষাদের বাড়ি। বাহির বাড়ির চৌকাঠ পেরোনোর আগেই বর্ষার মায়ের সঙ্গে দেখা। বর্ষার মা আমাকে দেখে থমকে দাঁড়াল।
-“বর্ষা কোথায়?”

উত্তরে বর্ষার মা মিনমিন করে কি বলল কিছুই বোঝা গেল না। আবার গলা উঁচিয়ে বললাম,
-” বসির শেখ কোথায়? ওর সাথে আমার কিছু বোঝাপড়া বাকি আছে। ডাকুন ওকে। ” বর্ষার মা জায়গা থেকে নড়ল না। কিছু বললও না। সেখানেই জমে দাঁড়িয়ে বিরবির করতে লাগল কিছু ।

তাকে পাশ কাটিয়ে আমি ভেতর বাড়িতে পা বাড়ালাম। উচু গলায় বসির শেখকে ডাকতে ডাকতে।

দিনের আলোয় আমি আর বসির শেখ কখনো একে অন্যের মুখোমুখি হইনি। বর্ষার মুখে শুনে ছিলাম বসির শেখের মুখে একবার থাবা বসিয়েছিল বাঘ। সেই ব্যাপার টা নিয়ে কখনো ভাবার প্রয়োজন অনুভব করিনি। তবে আজ ভেতর বাড়িতে পা রাখতেই একটা ব্যাপার আমার মনোযোগ সম্পুর্ণ রূপে কেড়ে নিল কয়েক মুহুর্তের জন্য। উচু গলায় হাঁকডাক থামিয়ে দাঁড়িয়ে পরতে বাধ্য হলাম। উঠোনের মাঝখানে চেয়ার পেতে বসে থাকা পঞ্চাশোর্ধ লোকটিকে দেখে ।
লোকটা সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে নির্বিবার চাহনিতে আমার পর্যবেক্ষণ করছে। মুখের বা পাশে, চোখের নিচ থেকে চিবুক পর্যন্ত অংশটুকুর চামড়া থেতলানো। সেখানে এত বড় একটা গর্ত যে দেখলে মনে হয় কেউ এক খাবলা মাংস তুলে নিয়ে, ইচ্ছে করেই একটা কুহর বানিয়েছে।

রাতের আঁধারে দু’বার মাত্র দেখা হয়েছিল আমাদের। বসির শেখের গলার স্বর মাত্রার অতিরিক্ত বিগলিত মনে হয়নি কখনো। সে কথায় আমার প্রতি আন্তরিক ছিল বটে। কিন্তু এজন্য তাকে চাটুকার বলা চলে না। অন্তত দিনের আলোয় আমার সামনে বসে থাকা এই লোকটি যদি বসির শেখ হয়। তাহলে তো নয়ই।

-“বর্ষা কোথায়?” আমি অধৈর্য হয়ে বললাম।

সিগারেটে শেষ টান দিয়ে মুখভর্তি ধোঁয়া ছাড়ল বসির শেখ। উঠোনে একদলা থুতু ফেলে নিরুত্তেজ স্বরে বলল
-” ওর যেইখেনে থাকার কথা সেইখেনেই আছে বোধহয়। আপনি বসেন। বাড়িতে আইজ কুটুম আইব। ভালো রান্নাবান্না হইছে। দুই মুঠ খায়া যান।
বর্ষন, সাহেবরে একটা চেয়ার দিয়া যাও।”
বর্ষন সাথে সাথে আজ্ঞা পালন করল। হুট করে কোথা থেকে ছুটে এসে বসির শেখের মুখোমুখি একটা চেয়ার পেতে দিয়ে গেল আমার জন্য।
-” বসেন সাহেব।”

-“এখানে বসতে আসিনি আমি। আগে বর্ষাকে ডাকুন। আজ নাকি দেখতে আসবে ওকে?”

-” তা আসব। বোঝেন ই তো। গায় গেরামে থাকি। মাইয়া ডাংগর হইছে। কহন কি কলঙ্ক লাইগা যায়। বড় ভয় হয়। যত তাড়াতাড়ি বিয়া দেওন যায় ততই ভালো। একদিন দুইদিন কইরা তো অনেক দিন হইল। এইবার আর দেরি করুম না।
এই ঝামেলার জন্যেই করিমনরে আপনের বাড়িতে কাজ বন্ধ করতে হইল। ভালোই হইছে আপনে আইসেন। এইসব ব্যাপারে একটা শিক্ষিত, বুঝদার মানুষের বড় প্রয়োজন। আপনে আর কিছুক্ষণ থাকেন সাহেব। ওরা অহনি আয়া পরব। আপনে সাথে থাকলে আমি একটু ভরসা পামু। ” বসির শেখ এতো বিনীত স্বরে বলল কথাগুলো যে আদৌ আমাদের বিষয়ে সে পুরোপুরি অবগত কিনা এ ব্যাপারে আমার সন্দেহ জাগলো মুহুর্তের জন্য। কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে পড়ল লোকটা ভয়ানক ধুর্ত। তাছাড়া তার গলার স্বর অসম্ভব দৃঢ়। সহসা বসির শেখের নিরীহ সাজার এই অভিনয় অসহ্য ঠেকল আমার কাছে।

-“বাজে কথা রাখুন। বর্ষা আর আমার সম্পর্কের ব্যাপার টা আপনি অবশ্যই জানেন। বর্ষার অন্যত্র বিয়ে হতে পারে না। আমি বিয়ে করবো ওকে। ” হিসহিসিয়ে বললাম আমি।

বসির শেখ যেন এক পাঁচ বছরের বাচ্চা ছেলের মুখে বিশ্বভ্রমণের গল্প শুনছে এমন চোখে তাকাল। সেই সাথে হাসল। যে হাসির মানে কঠিন না।
-” সাহেবের রসিকতা মন্দ না। এমন কথা শোনা আমার কানেরও সৌভাগ্য। তবে একটা ভুল হইছে সাহেব। আপনে বষ্যারে ভাবছেন বাজারের মেয়ে। গৃহকর্মের সাথে সাথে সে দেহকর্মও করবে। এই ধারণা ভুল।
তয় আমার মাইয়্যাও বিরাট ভুল কাম করছে। আপনেরে নাগর বানায় চৌদ্দ এলাকা ঘুইরা বেরাইছে। নাইলে আপনের এরকম ধারনার কোনো কারণ দেখি না। যাইহোক ওর অপকর্মের শাস্তি ও পাইসে।
এইবার শোনেন সাহেব। গরিব হইলেও এই বাড়ির মেয়ালোক কোনোদিন বাজারে যাইব না। অবশ্য আপনের একলা দোষ দেহি না। বড় বড় মানুষের বড় বড় সব ব্যাপার। গরিব মেয়া লোক দেখলেই গা চুলকায়। টাকা দিয়া কিন্না নিতে মন চায়। ”

কথাগুলো এত ভয়ংকর বাজে শোনালো আমার কানে যে কান গরম হয়ে গেল, ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগল কানের দুপাশ । আমি শ্যেন দৃষ্টি হেনে তাকিয়ে রইলাম সামনে বসা বিকৃত মস্তিষ্কের লোকটির দিকে। সে ঘটনাকে কোন দিকে ঘোরাতে চাইছে বুঝতে চেষ্টা করলাম।

অবশেষে শান্ত গলায় বললাম,
-” বর্ষা ঠিকই বলেছিল। আপনি তার আসল বাবা নন। হতেই পারেন না। নিজের বাবা হলে কখনো মেয়ে সম্পর্কে এমন কথা বলতে পারতেন না।
তবে সে আপনাকে বাবার মতো সম্মান করে। নাহয় আজ আপনার প্রতিটি কথার বিনিময় সুদে আসলে পরিশোধ করে দিতাম।”

বসির শেখ নিরুত্তর থেকে তাকিয়ে রইল। দুচোখে ইষৎ হাসির আভাস। সহসা উঁচু গলায় হাঁক ছাড়তে ছাড়তে ফজলু মিয়া প্রবেশ করল বাড়িতে। আমাকে দেখে এক মুহুর্তের জন্য থমকে দাঁড়াল সে।
-“সাব এইহানে?”
বলে অবাক হয়ে দেখল আমাকে৷ কিন্তু তার কথাটা বোধহয় আরো বেশি জরুরি যার দরুন পরমুহূর্তেই আমাকে ডিঙিয়ে বসির শেখের কাছে চলে গেল একলাফে। বসির শেখের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে কিসব বলতে শুরু করল। কিন্তু উত্তেজনার বসে ফিসফিস করে বলা কথাটাও জোরে শোনাল বেশ।

-” ওরা আর আসব না। আমগর গায়ের এক লোক সৈয়দ বাড়ি গিয়া খবর রটাইসে বষ্যার এক সাহেবের লগে পিরিত আছে। সেই ভিনদেশী নাগরের বাড়িতে রাইত কাটাইছে হে। এই খবর শুইনা সৈয়দ বেপারির মুখ চূন। কইসে এই বিয়ার সম্মন্ধ ক্যান্সেল। আমি নিজের কানে শুইনা আইছি।”

বসির শেখের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল মুহূর্তেই। অর্ধ বিকৃত মুখখানা ভয়ানক ক্রোধে আরও ভয়ংকর হয়ে উঠল। সহসা উঠে দাঁড়িয়ে কঠিন চোখে তাকিয়ে রইল সে ফজলুর উত্তেজিত মুখের পানে।

আজকের মতো এখানেই ব্যাপার টা থেমেছে ভেবে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম আমি।
-” দ্বিতীয় বার বর্ষাকে অন্য কোথাও বিয়ে দেবার চেষ্টা করবেন না। আপনার জন্য সেটাই ভালো হবে। ”
কথাগুলো বলে সরু চোখে বসির শেখকে দেখে ঘুরে হাটা ধরলাম বাড়ির দিকে।

***

সুন্দরবনের সকালের আকাশে ঝকঝকে রোদ। আকাশের মধ্যেখানটা কড়া নীল। পেজা তুলোর মতো সাদা মেঘে মেঘে সমাকীর্ণ দু’ধার। দেখলে মনে হয় যেন গাঢ় নীল আকাশ থেকে রাশি রাশি তুলোর পুঞ্জ গুলো ভার বহনে অসমর্থ হয়ে ক্রমে ক্রমে নিচে সরে এসেছে মাটির খুব কাছে।

বসে আছি বনের ভেতর ছোট্ট সেই নদীর তীরে। কি ভীষণ সুন্দর আজকের প্রকৃতি। এতো সুন্দর একটা সকাল কতদিন দেখা হয়নি দুচোখ মেলে। স্বচ্ছ জলরাশির প্রবল বয়ে চলায় আন্দোলিত নদীর গতিপথ। সবুজ গাছের পাতায় হিল্লোল তুলছে শীতল সমীরণ। তার মাঝে এই বালুময় তটভূমিতে আমি বসে একা।
এই সময় বর্ষার শূন্যতা টা প্রকট ভাবে অনুভূত হচ্ছে।
কিন্তু কোথায় সে রহস্যমানবী?
স্মৃতিতেই কেবল জেগে আছে ধূসর হয়ে…

ভাবনাটা ভাবতেই দূরে দৃষ্টি মেলে থমকে গেলাম। হাহ! বুক চিরে বেরিয়ে এল দীর্ঘ শ্বাস। আজকাল দিবাস্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে দুই চোখ। তাই হয়তো দূরের তীর ঘেঁষে হেটে আসতে দেখছে বর্ষাকে। গায়ে জড়ানো আমারই দেয়া সেই লাল তাঁতের শাড়িটা। দুহাত ভর্তি কাঁচের রেশমি চুড়ি। বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উড়ছে তার ভীষণ অবাধ্য চুল।

আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। রোদের প্রবল উত্তাপে সরু হয়ে এসেছে দুটি চোখ। অলীক ছবি দেখার এটা আরও একটি যুক্তিসঙ্গত কারণ। হাটু মুরে বসে একহাত ক্লান্ত ভাবে হেলিয়ে দিয়ে, মাথা নুইয়ে, অন্যহাতে বেছে বেছে পাথর ছুড়তে লাগলাম ক্ষর স্রোতা নদীতে বুকে। হঠাৎ মনে হল কিসের একটা ছায়া যেন এসে পরেছে গায়ে। চোখের কোন দিয়ে ভীষণ লাল কিছু একটা নজরে পড়ল তখনি। আমি ভয়ে ভয়ে সেদিকে তাকালাম। মনে মনে প্রবল ভাবে চাইলাম। যা ভাবছি তা যেন আমার ভ্রম না হয় কিছুতেই।

কিন্তু সামনের মানুষটির উপস্থিতি আমার হৃদকম্পন থামিয়ে দিতে যথেষ্ট ছিল। কয়েক মুহুর্ত সেদিকে থমকে তাকিয়ে থেকে সহসা চোখ বুঝলাম। ভাবতে চেষ্টা করলাম প্রকাশ্য দিবালোকে কোনদিন অশরীরীরা নেমে আসতে পারে কিনা!
কারণ সামনের মানবী টি যতটুকু না পার্থিব, তার চেয়ে অনেক খানি বেশি ঐশ্বরিক আভায় পরিব্যাপ্ত। আমার বর্ষা কোনো কালে এত অপার্থিব ছিল কিনা মনে করতে চেষ্টা করলাম। চোখ খোলার আগেই অনুভব করলাম সেই মানবী আমার খুব কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রবল সমীরে ওড়া তার আঁচল এসে বাড়ি খাচ্ছে আমার গায়ে।
তারপর সেই সুধা কণ্ঠে উচ্চারিত শব্দমালা। নাহ! কোনো ভুল নেই। বর্ষা ছাড়া এই গলার স্বর আর কারো হতেই পারে না।
-“এই! কি হইলো? আপনি চোখ বুজলেন কেন? আমারে বুঝি খুব খারাপ লাগতাছে দেখতে? এইজন্যই আমি আসতে চাইনাই। ধুর…..”

আমি চোখ খুললাম। আমার সামনে উপস্থিত আকাশলোক থেকে নেমে আসা পরীর মুখখানি মুহুর্তে ভার হয়ে এল কালো মেঘে। সে নৈরাশা মেশানো করুন দৃষ্টিতে চেয়ে রইল নদীর স্রোতের দিকে।

হঠাৎ আমার ভীষণ বেপরোয়া হতে ইচ্ছে জাগল। চিৎকার করে পৃথিবীকে বলতে ইচ্ছে হল,
-“শুনছো, শুনছো তোমরা কেউ? এই যে আসমানী মেয়েটিকে দেখছো ভীষণ অপার্থিব, সে শুধু আমাকেই ভালোবাসে। তার সব সুন্দরেরা শুধু আমারই প্রতিক্ষায় রত। আহ! কি ভীষণ সৌভাগ্যবান আমি! ”

চলবে ইন শা আল্লাহ