#একদিন_বিকালে_সকাল_হয়েছিল
লেখাঃ শারমিন আক্তার সাথী
পর্বঃ ০১
১!!
‘এতদিন যাকে মামা বলে ডাকতাম আজ থেকে তাকেই স্বামী হিসাবে মানতে হবে। ভাগ্যের র্নিমম পরিহাস না হলে এরকম কেন হবে? পনেরো বছর বয়স থেকে যাকে মামা হিসাবে জেনেছি, মেনেছি আজ চব্বিশ বছর বয়সে এসে তাকে স্বামী হিসাবে মানতে হবে। যদিও তার সাথে আমার দূর দূর পর্যন্ত কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই। তবুও ভাবতেই কেমন গা গোলাচ্ছে। সে আমার মামার বন্ধু হবার সুবাদে তাকে মামা বলে ডাকতাম এবং মামাই মানতাম। আমার মামা আমার থেকে প্রায় বারো বছরের বড়। সে হিসাবে সেও প্রায় আমার মামার-ই বয়সি।
যখন বিয়ে ঠিক হলো তখন আমার মা আর কাকিকে বলেছিলাম যাকে এতদিন মামা হিসাবে জেনেছি তাকে স্বামীর স্থান কী করে দিব?’
বড়কাকি বেশ তাচ্ছিল্য করেই বলেছিলেন,
‘তোর কপালে বর জুটেছে সেটাই অনেক। নয়তো বিয়ে ভাঙা, অপয়া বিধবা, মেয়েকে কে বিয়ে করবে? তোর কপালে বর জুটেছে সেই ঢের বেশি। বেশি খুত ধরিস না। বরং তোর মতো খুত ওয়ালা মেয়েকে বিয়ে করছে তার জন্য তার পায়ের কাছে সারাজীবন বসে থাকলেও তোর কপালে অপয়া নাম মোচন হবে না।’
‘কাকির কথায় প্রচন্ড কষ্ট পেলেও, বেশি কষ্ট পেলাম মায়ের নীরবতায়। মা যেনো নীরব থেকে বড় কাকির কথায় মৌন সম্মতি প্রদান করলেন। সেখান আর দাড়িয়ে থাকতে পারলাম না, চলে আসলাম। তারা এমন ভাবে কথা বলছে যেনো সব দোষ আমার। অথচ দোষ কিন্তু সত্যিকার অর্থে তাদের। হ্যাঁ আমার আগে একবার বিবাহ হয়েছিলো। বিয়ের সাতদিনের মাথায় সে স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। তাছাড়া বিয়ে হওয়ার পূর্বে আমার আরেকটা বিয়ের সব ঠিক হয়েও ভেঙে গিয়েছিল। সে গল্প নাহয় এখন থাক। আমার বর মারা যাবার পর সবার কাছে আমি স্বামী খেকো অপয়া হিসাবেই পরিচিত হলাম। প্রথম বিয়ে সব ঠিক হওয়ার পরও যখন বিয়েটা ভেঙে গেল তখন থেকেই সমাজের লোক আমার আত্মীয় স্বজন আমাকে বাঁকা চোখে দেখতে শুরু করে। তারপর যখন বিয়ে হবার সাতদিন পর স্বামী মারা গেল, তখন থেকে সমাজের চোখে আমি অপয়া, কুলটা, স্বামীখেকো। কোনো শুভ অনুষ্ঠানে অমার প্রবেশ নিষেধ হলো। আত্মীয়দের বাড়ি যাওয়া বন্ধ হলো। কাজিনদের থেকে দূরে গেলাম। আমি দেখতে অসুন্দর নই যে সে কারণে বিয়ে ভেঙেছিল। আমাকে বেশ সুন্দরীদের কাতারে অনায়াসে রাখা যায়। কিন্তু কথায় আছে না, কপালের লিখন না যায় খন্ডন! যাই হোক মনে এক রাশ দুঃখ কষ্ট আর বিষণ্নতা নিয়ে চললাম আমি শ্বশুর বাড়ি। আমি জানি সেখানেও আমার জন্য তেমন ভালো কিছু অপেক্ষা করছে না।’
গাড়িতে বসে অতীতের সব কথা ভেবে চলছে রেনু। রেনুর পাশেই ওর বর শিহাব বসা। আর আরেক পাশে ছয় সাত বছরের ছোট্ট একটা বাচ্চা। কার বাচ্চা রেনু সেটা জানে না। জানার ইচ্ছাও তেমন নেই। কনে বিদায় বেলায় সবাই কাঁদলেও রেনু কাঁদেনি। ওর চোখ থেকে এক ফোঁটাও জল ঝরেনি। রেনু জানে, ওর বাবা মা সহ সবাই যে কাঁদছে তা নিতান্তই লোক দেখানো কৃত্রিম কান্না। তারা মনে মনে খুব খুশি, কারণ আজ তাদের ঘাড় থেকে সবচেয়ে বড় বোঝাটা নেমে গেলো। এত দিন যে কাটাটা গলায় বিঁধে ছিলো আজ তা নেমে গেছে বরং বিনা ওষুধেই নেমে গেছে। কারণ রেনুকে বিয়ে করার বদলে শিহাবের একটা শর্ত ছিলো, সে শুধু রেনুকে চায় বাকি রেনু তার সাথে করে বাবার বাড়ি থেকে দেয়া কিছু নিয়ে যেতে পারবে না। না গয়না আর না ঘর সাজানোর আসবাবপত্র। বলতে গেলে রেনুর দিকের কয়েকজন আত্মীয় স্বজনকে খাওয়ানোর খরচ ব্যতিত রেনুর বাবার আর কোনো খরচ হয়নি। বরযাত্রী হিসাবে শিহাবরা মাত্র সাতজন গেছিলো। শিহাব, শিহাবের বাবা নূর ইসলাম, ওর বড় ভাই-ভাবি সাজ্জাত এবং লিপি আর শিহাবের দুইটা বন্ধু আর একটা ছয় বছরের পিচ্চি। পিচ্চিটা সাজ্জাত আর লিপির ছেলে।
বিদায়ের পর থেকেই রেনু একদম চুপচাপ বসে আছে। লিপি দু একটা প্রশ্ন করলে শুধু হু হ্যাঁতেই জবাব দিচ্ছে। শিহাবও চুপ করেই বসে আছে শুধু মাঝে মাঝে রেনুর চুড়িতে আঙুল দিয়ে নাড়া দিচ্ছে। রেনু তাতে কেঁপে কেঁপে উঠছে। ঘন্টা খানিক সময় পর রেনু শিহাবের বাড়ি পৌঁছালো। বাড়িতে বিয়ের কোনো আমেজ নেই বললেই চলে। কেমন নীরব নিস্তব্ধ বাড়ি। যেনো বাড়িতে বিয়ে হয়নি বরং কোনো দূর্ঘটনা ঘটেছে। আর তার শোকে সবাই ডুবে আছে। অবশ্য অবিবাহিত ছেলে বিবাহিত মেয়েকে বিয়ে করলে তাদের ঘরে এমন নীরবতা থাকা অস্বাভাবিক কিছু না।
রেনুর শাশুড়ি হাসি বেগম যখন বরন করে ঘরে তুললেন তখন তার মুখটা ছিলো কালো মেঘের মতো অন্ধকার। ঐ যে এক রকম কালো মেঘ আছে না, যা দেখলে মনে হয়, এখনি ঝড় বৃষ্টি শুরু হবে, ঠিক তেমন কালো মেঘের মতো অন্ধকার ছিলো তার মুখ। থাকবেইবা না কেন, অবিবাহিত ছেলে ঘরে বিবাহিত সেকেন্ড হ্যান্ড বউ আনলে সব মায়েদেরই মনে হয়ত ঝড় হবে। তিনি রেনুকে বরন করেই চলে গেলেন। কোনো কথা বললেন না, তারপর মুখখানাও আর রেনু সেদিন দেখেনি। লিপি আর সাথে দুই তিন জন মহিলা রেনুকে শিহাবের রুমে নিয়ে আসল। লিপি রেনুকে রাতে খাবার খাইয়ে যাবার সময় ঠোঁটের কোনে হাসি এনে বলল,
‘তোমাকে আর কি শিখিয়ে পড়িয়ে দিব। তুমি তো আগে থেকেই সব জানো। এটা তো আর তোমার প্রথম বাসর নয়।’
লিপির কথায় রেনু একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস নিজ মাঝেই গোপন করে রাখল।
কিছুক্ষণ পর শিহাব আসল। শিহাব রেনুর পাশে বসে বলল,
‘কেমন আছো রেনু?’
হালকা ঠোঁট নেড়ে রেনু উত্তর দিলো,
‘ভালো।’
‘রেনু তোমার মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগছে আমি কেন তোমাকে বিয়ে করলাম?’
‘না।’
‘কেন?’
‘আমি উত্তর জানি।’
‘কী জানো?’
‘আপনি আমাকে আমার কিশোরী বেলা থেকেই পছন্দ করতেন। কিন্তু আমার মামার বন্ধু হওয়ার কারণে আর আপনাকে আমি মামা ডাকতাম সে কারণে লজ্জায় আপনি কখনো আমাকে কিংবা আমার ঘরের লোককে আপনার মনের কথা বলেননি।’
‘তুমি এসব কী করে জানলে?’
‘আপনার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হবার পর ছোট মামা আমাকে সব বলেছিলেন। তিনি আপনার সম্পর্কে সব জানেন।’
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শিহাব বলল,
‘হ্যাঁ। তোমার মামা সব জানত। কিন্তু আমার বোকামির কারণে আমি বলতে পারিনি। বললে হয়ত এটা তোমার দ্বিতীয় বিয়ে হতো না। আর আমাদের বিয়েতে সবার এত নিরুৎসাহ থাকত না। তখন হয়ত আর পাঁচটা বিয়ের মতো আমাদের বিয়েও স্বাভাবিক হতো।’
‘হয়ত। তবে যা হয়েছে তা হয়ত আমার ভাগ্যের লিখন। আর ভাগ্যে যা লেখা থাকে তা-ই নাকি হয়। তাই এসব বলেইবা কী লাভ?’
‘হ্যাঁ তা অবশ্য ঠিক বলেছ। রেনু তোমায় একটা কথা বলি?’
‘জি বলুন।’
‘আমি তোমাকে ভালোবাসি।’
রেনু মাথা নিচু করে রইল। শিহাব আবার বলল,
‘তুমি কি আমাকে ভালোবাসার চেষ্টা করবে? জানি এত তাড়াতাড়ি পারবে না, তবে ভালো বাসতে চেষ্টা তো করতে পারো?’
‘হুঁ আমি আপনাকে মন থেকে ভালোবাসার চেষ্টা করব।’
গভীর রাত রেনু আয়নার সামনে দাড়িয়ে ভেজা চুলগুলো মুছছে। শিহাব জড়িয়ে ধরতেই রেনু যেনো আবার র্নিজীব পাথরের ন্যায় শক্ত হয়ে গেলো। শিহাব হেসে রেনুর গালে গাল ছুঁইয়ে বলল,
‘আজব আমাকে এত ভয় পাবার কী আছে? আমি তো তোমারই স্বামী।’
রেনু স্মিত হাসল শুধু।
শিহাব পরম আদরে রেনুর গালে ঠোঁট ছুঁয়ে বলল,
‘ভালোবাসি রেনু।’
রেনু এবারও শুধু মৃদু হাসল।
ভোর সারে চারটায় রেনুর ঘুম ভাঙল। আযানের শব্দ শুনে চুপচাপ শুয়ে রইল। কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে উঠে ওযু করল। কিন্তু নামাজের পাটি খুঁজে না পেয়ে শিহাবকে ডাকার জন্য গেল। কিন্তু কি নামে ডাকবে ভেবে পাচ্ছে না। এত বছর তো মামা-ই ডেকেছে। এখন এ মানুষটা ওর স্বামী। তাকে কিভাবে মামা ডাকবে? কথাটা ভেবে রেনু মনে মনে বলল,
‘ছি ছি কি সব ভাবছি আমি।’
তারপর শিহাবের মাথায় হাত দিয়ে বলল,
‘এই যে শুনছেন?’
ঘুম জড়ানো কন্ঠে শিহাব বলল,
‘হ্যাঁ বলো?’
‘জায়নামাজ কোথায়?’
‘আমার রুমে নেই।’
‘কেন? আপনি নামাজ পড়েন না?’
‘পড়ি তবে নিয়মিত পড়া হয় না।’
‘আজ থেকে নিয়মিত পড়বেন।’
শিহাব কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বিছানা থেকে উঠে বলল,
‘আচ্ছা। তুমি একটু অপেক্ষা করো আমি জায়নামাজ এনে দিচ্ছি।’
জায়নামাজ এনে শিহাব বলল,
‘নাও নামাজ পড়ো।’
‘আপনি পড়বেন না?’
‘এখন থেকেই পড়তে হবে?’
‘হ্যাঁ। একটা কথা আছে না, কাল করে সো আজ, আজ করি তো এখন।’
শিহাব মৃদু হেসে বলল,
‘আচ্ছা।’
যাবার পূর্বে রেনুর কপালে প্রাগাঢ় চুমো খেয়ে বলল,
‘এই যে ছোট ছোট বিষয়ে অধিকার খাটাচ্ছো। সত্যি ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে তুমি আমাকে সত্যি মন থেকে স্বামী হিসাবে মেনে নিয়েছো।’
‘হ্যাঁ সত্যি মেনে নিয়েছি।’
মনে মনে বলল, আমি আমার নিয়তিকে মেনে নিয়েছি শিহাব। চাইলেও আমি আমার নিয়তিকে বদলাতে পারব না। তারচেয়ে বরং তাকে মেনে নিয়ে সুখী হওয়াটাই উত্তম। জীবনে কম তো দুখী হলাম না, এবার নাহয় একটু সুখী হবার চেষ্টা করি। নিজেকে স্রোতের বিপরীতে না ভাসিয়ে আমি স্রোতের সঙ্গেই ভেসে চলে সুখী হতে চাই।’
২!!
ঘরের মধ্যে বেশ শোরগোল শুনে শিহাব রুম থেকে বের হলো। শিহাবের পিছু পিছু রেনুও বের হলো। শিহাব বের হতেই শিহাবের ছোট বোন শশী চেঁচিয়ে বলল,
‘সবার নিষেধ করা সত্ত্বেও তুই ঐ অপয়া বিধবা মেয়েটাকে বিয়ে করে কেন আনলি ভাই। তোর কাছে ঐ অপয়া মেয়েটাই সব? আমরা কেউ নই? তোকে বিয়ে থেকে আটকানোর জন্য আমি রাগ করে বাড়ি থেকে চলে গেলাম, ভাবলাম তাতে যদি তুই ফিরিস কিন্তু তুই কী করলি? সবাইকে একদিকে রেখে ঐ মেয়েটাকে একদিকে রাখলি? লজ্জা করে না তোর এত বছর যাকে ভাগ্নি মনে করতি আজ তাকে বিয়ে করে স্বামী স্ত্রীর মতো থাকতে?’
শশীর কথা শুনে রেনু আর সেখানে দাঁড়ালো না। চুপচাপ নিজের রুমে চলে গেলো। ও জানে এখানে আজ ওর কিছু বলা বেমানান।
শিহাব শশীর মাথায় হাত দিয়ে বলল,
‘অনেকদূর জার্নি করে এসেছিস আগে বস, বিশ্রাম নে তারপর তোকে সবটা বুঝিয়ে বলছি। আশাকরি তোর বুদ্ধি এতটা লোপ পায়নি যে, ভাইয়ের বিয়ের পরের দিন তুই তামাশা করে লোক জড়ো করবি?’
শশী বেশ রাগ করে চেঁচিয়ে বলল,
‘তুই যে তামাশা করে রাখছিস তারপর আমরা যা-ই করি না কেন তা তোর তামাশার ন্যায় ক্ষুদ্র মনে হবে। এত বছর জেদ ধরে রইলি বিয়ে করবি না বলে। শেষ মেস বিয়ে করলি তাও একটা বিধবা মেয়েকে। যে মেয়ে কিনা বিয়ের সাত দিনের মাথায় স্বামী খেয়েছে। শোন ভাই ঐ মেয়ের খারাপ ভাগ্যের কারণে তোর যদি কোনো ক্ষতি হয় ওকে আমি খুন করে ফেলব। কোথায় অপায়া বজ্জাতটা? প্রথম স্বামী খেয়ে আবার র্নিলজ্জের মতো নাচতে নাচতে দ্বিতীয় বিয়ে করে ফেলছে। কোথায় সে?’
শশী রেনুর ঘরের দিকে রওনা দিলো।
চলবে_______