এক্কা দোক্কা পর্ব-০৬

0
285

#এক্কা_দোক্কা – ৬
আভা ইসলাম রাত্রি

রাত আনুমানিক একটা বাজে তখন। জুভানের বন্ধু-বান্ধব বাকি নিয়ম পুঙ্খানপুঙ্খভাবে পালন করে তবে নিস্তার দিল তাদের। তারা চলে যেতেই জুভান সিটকেনি আটকে দিল। ঐশী ততক্ষণে বাথরুমে চলে গেছে। জুভান খানিকটা অবাক হলো। এই মেয়ের আচরন দেখলে কেউই বলবে না, মেয়েটা সদ্য বিবাহিত। লাজ-লজ্জাহীন এক আশ্চর্য্য মেয়ে! এই মুহূর্তে মেয়েটার লজ্জায় কুঁকড়ে যাওয়ার কথা! অথচ তা হলো না। বরং এতক্ষণ অব্দি মেয়েটার মুখে লজ্জার ছিঁটে-ফোঁটাও দেখা যায়নি। জুভান অবাক হলো বেশ! সে ফুস করে এক নিঃশ্বাস ফেলে গা থেকে শার্ট ছাড়িয়ে নিল। বড্ড গরম লাগছে তার। নাকের উপর বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে। জুভান টিস্যু দিয়ে মুখ মুছলো। টিস্যুটা বিনে ফেলে দিয়ে কাবার্ড থেকে একটা টি শার্ট বের কেউ গায়ে গলিয়ে নিল। গরমে অতিষ্ট হয়ে এসি ছাড়তেও ভুলে নি।
একটু পর বাথরুমের দরজা খোলার শব্দ হলো। জুভান তাকালো না সেদিকে। চুপচাপ ল্যাপটপ নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। ল্যাপটপ অন করতে করতে বলল,
-” আজ আমার রুমেই ঘুমিয়ে পড়। অনলরা আজ এ বাড়িতে ঘুমাবে। কাল ওরা চলে গেলে অন্য রুমে শিফট করে দেবো তোমায়। ”
ঐশী দ্বিমত প্রকাশ করলো না। লাগেজ থেকে ক্রিম আর ভেসলিন বের করে মুখে-ঠোঁটে দিয়ে দিল। অতঃপর জুভানের পাশে এসে দাঁড়াল। স্পষ্টভাবে প্রশ্ন করলো,
-” আমি কি আপনার সাথে বিছানায় ঘুমাবো? ”
ঐশীর প্রশ্ন শুনে জুভানের ভ্রু কুঁচকে এলো। করলার ন্যায় তিতা রস গলা ভিজিয়ে ফেললো। বিদঘুটে লাগলো ঐশীর কথা! জুভান ভ্রু বাঁকিয়ে ঐশীকে বললো,
-” তুমি কি চাইছ? টিভি সিরিয়ালের মত তুমি বিছানায় ঘুমাবে আর আমি সোফা বা ফ্লোরে ঘুমাবো? ”
ঐশীর রাগ লাগলো। বললো,
-” আমি কখন তা বললাম? ”
-” না, তোমার কথার মানে তো এটাই দাঁড়াচ্ছে। ”
ঐশী দিশেহারা হয়ে পড়ল। জুভান এভাবে তাকে কথার মারপ্যাঁচে হারিয়ে ফেলবে সেটা সে একটুও বুঝতে পারে নি। ঐশীর বেশ রাগ হলো। সেই রাগে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিতে চাইলো জুভানের কন্ঠনালী, যে কন্ঠনালী তার মস্তিষ্ক তারের ন্যায় পেঁচিয়ে দিচ্ছে! ঐশী কিছু একটা বলতে যাবে, তার আগেই জুভান ল্যাপটপে চেয়ে বললো,
-” কাভার্ডে একটা এক্সট্রা কাঁথা আছে। ওটা গায়ে দিয়ে বিছানায় নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়। আমার তোমার কাছ ঘেঁষার একটুও ইচ্ছে নেই। সো রিলাক্স! ”
জুভানের কথাটা ঐশীর মনে ধরলো। সে গটগট পায়ে হেঁটে কাবার্ড থেকে কাঁথা বের করে জুভানের পাশে শুয়ে পড়লো।
ঐশীর ঘুমানোর তালে বিছানায় যেনো ভূমিকম্প বেয়ে গেলো। জুভানের কোলের উপর থাকা ল্যাপটপটা অব্দি কেঁপে উঠলো। জুভান ল্যাপটপ শক্ত হাতে চেপে ধরো রক্তলাল চোখে ঐশীর পানে তাকালো। ঐশী যে রেগে আছে সেটা জুভান বেশ বুঝতে পারলো। রাগলে রাগুক, ওর কি? সত্য কথা কি কোনো নারীই সহ্য করতে পারে না? কি জানি। হয়তো না, হয়তো হ্যাঁ! নারী মন বোঝা এ ভুবনের কারো সাধ্য নয়। আল্লাহ তায়ালা নারীকে এমনভাবে রহস্য দিয়েই সৃষ্টি করেছেন। নারী মনের এই রহস্য পুরুষকে তাদের দিকে আকৃষ্ট করতে বাধ্য করে। পুরুষরা নারীদের রহস্য উন্মোচিত করতে চায়। রহস্যের মায়ায় তারা নারীদের সান্নিধ্যে আসে। ফলে তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয় প্রেমের বন্ধন। রহস্য রহস্যই রয়ে যায়। পুরুষরা সেই রহস্য উন্মোচন করতে ব্যর্থ হয়। সেই ব্যর্থতার গ্লানি ঢাকতে গিয়ে তারা নারীদের রহস্যমনের প্রেম পড়ে যায়। এভাবেই পুরুষ-নারীর মধ্যে প্রেম তৈরি হয়। হায়, বিধাতার লীলাখেলা বোঝা মানুষের কাম্য নয়।
______________________
জুভানের বাড়িতে রাতে ঘুমানোর জন্যে অনলদের দুটো কক্ষ দেওয়া হয়েছে। পুষ্পিতা আর অপর্ণা এক কক্ষে, অনল একটা অন্য কক্ষে।
অপর্ণা ঘুমিয়ে পড়বে, ঠিক তখন তার মনে হলো তার ত আজ মেডিসিন নেওয়ার কথা। একদম ভুলে গেছিল সে। অপর্ণা উঠে বসলো। পুষ্পিতার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-” পুষ্প, তোর কাছে আমার ডিপ্রেশনের মেডিসিন দিয়েছি?”
পুষ্পিতা হাই ছাড়লো। কোলবালিশটা গায়ের সাথে মিশিয়ে পাশ ফিরে বললো,
-” ঘুমা তো অপু। কি লাভ হয় প্রতিদিন এই ডিপ্রেশনের মেডিসিন খেলে? উল্টো তোর নিজেরই ক্ষতি। ঘুমা,আজ খাওয়ার দরকার নেই। জুভানের বিয়ের জন্যে তোর ডিপ্রেসন তো এমনিতেই কেটে যাওয়ার কথা। ”
অপর্ণা রেগে গেলো। থমথমে কণ্ঠে বলল,
-” তুই দিবি কিনা বল। রাগ উঠাস না আমার। ”
অপর্ণার কথায় পুষ্পিতা বেশ বিরক্ত হলো। ঘুমের মধ্যে ডিস্টার্ব তার একটুও পছন্দ না। পুষ্পিতা বিরক্ত হয়ে বলল,
-” আমার কাছে নেই। আমি এখানে আসার আগে অনলের কাছে দিয়েছিলাম। ওকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর। ”
রাগে দুঃখে এবার যেনো অপর্ণা কেঁদে ফেলবে। যার কাছ থেকে সে ক্রমশ পালাতে চায় সে’ই ঘুরেফিরে অপর্ণার কাছে চলে আসে। অপর্ণার মন চাইলো, পুষ্পিতাকে ঘুম থেকে তুলে শক্ত এক আছাড় দিতে। কি করে সে এত বেপরোয়া হতে পারলো? অপর্ণার চোখে জল চলে এল। সে পুষ্পিতার গায়ে জোরে এক থাপ্পড় দিয়ে বললো,
-” পুষ্প, তুই কি করে ঔ মেডিসিনের বাক্স অনলের হাতে দিতে পারলি। তুই আমার সব কথা জানিস, তাও এটা করতে পারলি? ”
অপর্ণার অশ্রুতে টইটুম্বুর কণ্ঠ শুনে পুষ্পিতার ঘুম চলে গেলো। সে উঠে বসে অপর্ণার দিকে ফিরল। অপর্ণার চোখে জল। যেকোন মুহূর্তে মেয়েটা এই কক্ষেই সাগর বইয়ে দিবে।
পুষ্পিতা অপর্ণাকে বোঝানোর ভঙ্গিতে বলল,
-” দেখ অপু। ভালবাসার কাছ থেকে কখনো পালানো যায়না। ভালোবাসাটা হলো অনেকটা শক্তিশালী চুম্বকের মত। তুই তার থেকে যত পালাবি ততই তোর মনের সাথে লেপ্টে যাবে। তুই একটুও পারবি না, একে অবহেলা করতে। আমার কথা বুঝতে পেরেছিস? ”
পুষ্পিতা অনেক ভালো করে অপর্ণাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেও অপর্ণা তা বুঝতেই নারাজ। সে এখনো পুষ্পিতার উপর রেগে আছে। এই রাগের কারণে সে পুষ্পিতার সাথে একটাও কথা বললো না। গায়ের হালকা গোলাপী রঙের টিশার্ট টেনেটুনে ঠিক করে অনলের কক্ষের দিকে চলে গেলো। পুষ্পিতা শুধু চেয়ে রইলো তার পথের দিকে।

-” অনল, দরজা খোল। কাজ আছে। ”
অনলের দরজায় দুবার টোকা দিয়ে অপর্ণা ডেকে উঠলো। অনল তখন মানিব্যাগে থাকা ঐশীর ছবির দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল। দরজায় করাঘাত আর অপর্ণার কণ্ঠ শুনে সে তাড়াহুড়ো করে মানিব্যাগটা পকেটে পুড়ে নিল। ভেজা চোখজোড়া মুছে নিয়ে দরজার লক খুলে দিল। অনল কণ্ঠানালি স্বাভাবিক করে জিজ্ঞেস করলো,
-” কি কাজ তোর? ”
অপর্ণা শুনতে পেলো না অনলের কথা। সে তখনও ভ্রু কুঁচকে অনলের দিকে চেয়ে। অনল কান্না করছিল, সেটা তার সচেতন মস্তিষ্ক বুঝতে পেরে গেলো ক্ষনিকেই। অপর্ণা নিজের কৌতূহল দমিয়ে রাখতে পারলো না। জিজ্ঞেস করে বসলো,
-” কি হয়েছে তোর? চোখ ভেজা কেনো? কান্না করছিলি নাকি? ”
অনল অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। নজর লুকানোর চেষ্টা করে বললো,
-” বাজে বকিস না তো। কি করতে এসেছিলি, করে বিদায় হ। আমার ঘুম পাচ্ছে, ঘুমাবো। ”
অনলের কথায় অপর্ণা কষ্ট পেলো। তার ঠোঁট থেকে কথা ফুরিয়ে গেল। চাপা কান্না উত্তাল-পাত্তাল করে ফেললো তার সর্বাঙ্গ। অপমানে মুখশ্রী লাল টকটকে হয়ে উঠলো। সে নতমুখে জিজ্ঞেস করলো,
-” আমার মেডিসিনের বক্স তোর কাছে আছে। ওটা দে। ”
অনল একবিন্দুও দাঁড়ালো না। হেঁটে গিয়ে তার ব্যাগ থেকে মেডিসিনের বক্স এনে অপর্ণার হাতে ধরিয়ে দিল। খচখচ কণ্ঠে বলল,
-” এবার যা। শান্তি দে একটু আমায়। ”
অনল অপর্ণার মুখের সামনে দরজা আটকে দিল। অপমানে অপর্ণার গলা তেতো হয়ে গেলো। গালদুটো হয়ে উঠলো সূর্যের ন্যায় উত্তপ্ত। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল দুফোঁটা অবাধ্য জল। এই অনলটা এমন কেনো?

#চলবে।