এক্কা দোক্কা পর্ব-০৭

0
312

#এক্কা_দোক্কা – ৭
আভা ইসলাম রাত্রি

রাত পেরিয়ে ভোর এলো। উত্তপ্ত সূর্য মেঘের আড়ালে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। মেঘের সাথে সূর্যের দুষ্টুমিপূর্ণ লুকোচুরি খেলা চলছে। ঐশী বারান্দায় দাঁড়িয়ে তার পরবর্তী পরিকল্পনার ছক সাজাচ্ছিল। এখন থেকে সে শত্রুর দূর্গে অবস্থান করছে। এই বিয়ে দ্বারা সে শত্রুর দূর্গে নিজের খুঁটি শক্ত করে ফেলেছে। শত্রুর সান্নিধ্যে থেকে একে একে সব দুশমনকে খেয়ে ফেলবে সে। এক জঘন্যতম মৃত্যু প্রদান করবে তাদের। তাদের সে মৃত্যদণ্ডে আসমান-জমিনসহ পুরো ব্রহ্মাণ্ড কেঁপে কেঁপে উঠবে। ঐশী ঠোঁট টেনে হাসলো। সময় তবে এসেই গেল। এগারোটা বছর ঐশী অপেক্ষা করেছে এই দিনের। আজ সব ঐশীর হাতের মুঠোয়। ঐশী ঘাড় ঘুরিয়ে বিছানার দিকে তাকালো। জুভান নিশ্চিন্তে উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে আছে। ঘুমন্ত অবস্থায় ছেলেটার চেহারার সৌন্দর্য্য যেন সীমা ছাড়িয়ে যায়। ঐশী আর বিলম্ব করল না। বারান্দা থেকে বেরিয়ে নিজের ব্যাগ থেকে একটা সুতি শাড়ি নিয়ে বাথরুমে চলে গেল।

বাথরুম থেকে ঐশী পুষ্পিতা ও অপর্ণার কণ্ঠ শুনতে পেল। ওরা জুভানের সাথে কথা বলছে। আসলে এদের কথা শুনে কেউ ভাববে না যে তারা শুধু কথা বলছে। মনে হচ্ছে খ্যাকখ্যাকিয়ে ঝগড়া করছে তারা। ঐশী হেসে ফেলল। বন্ধুদের সাথে কথা বললে সেও এমনই করে। চুলে গামছা পেঁচিয়ে ঐশী বাথরুম থেকে বের হল। ঐশীকে লক্ষ্য করতে পেরে পুষ্পিতা এগিয়ে আসল। ঐশীর দিকে চেয়ে বলল,
-” আজ জুভানের মামা এ বাড়িয়ে আসবেন। উনার জন্যে ভালোমন্দ কিছু রাঁধতে হবে। তুমি দেখিয়ে দিবে, আমি চটপট রেঁধে ফেলব। ”
ঐশী হাসলো। ঐশীর এ হাসিটা পুষ্পিতার কাছে আলগা আলগা মনে হল। কেমন করে যেন হাসে মেয়েটা। তবে পুষ্পিতা পাত্তা দিল না। বললো,
-” আচ্ছা, তুমি তৈরি হয়ে নাও। আমি রান্নাঘরে যাচ্ছি। ”
ঐশী বাঁধ সাধলো। বললো,
-” না! আজ সব রান্না আমি একা হাতে রান্না করব। তুমি শুধু আমার হেল্প করবে, তাতেই হবে। ”
পুষ্পিতা বেশ অবাক হল। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
-” আর ইউ সিউর, তুমি রান্না করবে? ”
ঐশী ঠোঁট টেনে হাসলো।
-” হু, আমি আসছি। তুমি অপেক্ষা করো। ”
পুষ্পিতা আর কথা বাড়ালো না। জুভানকে ঘুম থেকে উঠতে বলে রান্নাঘরে চলে গেলো। পুষ্পিতার পিছু পিছু অপর্ণাও বেরিয়ে গেলো। ওরা বেরিয়ে যেতেই ঐশী মাথায় গামছা খুলে বারান্দায় মেলে দিল। শাড়ির আঁচল কাঁধে তুলে বেরিয়ে গেলো কক্ষ থেকে। জুভান পেছন থেকে ভ্রু কুঁচকে ঐশীর দিকে চেয়ে। মেয়েটার হঠাৎ এমন বউ-বউ ব্যবহার করা তার বেশ খটকা লাগছে। হঠাৎ কি হলো এই মেয়ের?
_____________________________
দরজায় করাঘাতের শব্দে ঘুম ভেংগে গেল অনলের। গতকাল ঐশীর চিন্তায় কখন যে ফ্লোরেই ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়াল করেনি। অনল দুহাত দিয়ে চোখ কচলে দেয়ালে ঝোলানো ঘড়ির দিকে তাকালো। দশটা বিশ বাজে। অনল একপল নিজের দিকে তাকালো। বিধ্বস্থ লাগছে তাকে। গায়ের ইন করা শার্ট এলোমেলো হয়ে আছে। চুলগুলো উল্টে পাল্টে বিশ্রী অবস্থা! অনল শার্ট টেনেটুনে ঠিক করার চেষ্টা করলো। কিন্তু শার্ট ঠিক হওয়ার পরিবর্তে আরো এলোমেলো হয়ে গেলো। অনল হাল ছেড়ে দিল। ঘরময় সিগারেের বিশ্রী গন্ধ নাকে লাগছে। সেই গন্ধে তার নিজেরই গা গুলিয়ে আসছে। অনল ঘর ঠিক করতে করতে পুনরায় দরজায় করাঘাত করে উঠলো। ওপাশ থেকে পুষ্পিতা ডেকে উঠলো,
-” অনল, নাস্তা খাবি না? বেরো ঘর থেকে। ”
অনল আর অপেক্ষা করল না। বিধ্বস্থ ঘরকে তার মত করেই ছেড়ে দিয়ে দরজা খুলে দিল। চোখ কচলে বললো,
-” তোরা যা। আমি নাস্তা করবো না। ”
অনলের কথা শুনে পুষ্পিতার ভ্রু অটোমেটিক কুঁচকে এলো। সে হাত বাড়িয়ে অনলের কপাল পরীক্ষা করলো। না, জ্বর নেই। পুষ্পিতা জিজ্ঞেস করলো,
-” কি হয়েছে তোর? রাত থেকে এমন করছিস কেন? আর ঘরের এ কি অবস্থা করেছিস? তুইও না। আস্ত এক পাগল। সর, ঘর ঠিক করতে দে আমায়। ”
কথাটা বলে পুষ্পিতা অনলকে পাশ কাটিয়ে তার ঘরে প্রবেশ করলো। ঘরে সিগারেটের গন্ধে পুষ্পিতার গা গুলিয়ে এলো। সে মুখে হাত চেপে সম্পূর্ণ ঘর পরিষ্কার করতে লেগে গেল। অনল দুবার বাঁধা দিতে চাইলো। তবে পুষ্পিতার রক্তলাল চোখ দেখে আর কথা বলতে পারলো না। সেখানেই দমে এলো। পুষ্পিতা একা রুমে রেখে অনল বাথরুমে চলে গেল। পানির টেপ ছেড়ে দু আজলা ভর্তি পানি নিজের মুখে ছিটিয়ে নিল। কষ্টে হাত পা কাঁপছে তার। মনে হচ্ছে এখুনি ফ্লোরে লুটিয়ে পড়বে সে। মুখ থেকে সিগারেটের গন্ধ আসছে। ব্রাশ করার পরও যাচ্ছে না। তাই অনল উপায় না পেয়ে মুখে পারফিউম স্প্রে করে নিল। ইশ, বিদঘুটে টেস্ট। অনলের বমি চলে এলো। মুখে হাত চেপে সে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো। পুষ্পিতা তার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অনল খাবার ঘরে যেতে যেতে গম্ভীর সুরে পুষ্পিতাকে বলল,
-” চল মেরি মা। ”
পুষ্পিতা মুচকি হেসে অনলের পিছু পিছু এগিয়ে এলো।

খাবার টেবিলে একে একে সবাই বসে আছে। জুভান, ঐশী পাশাপাশি বসে আছে। ঐশী বসতে চায়নি। কিন্তু পুষ্পিতার কথায় শেষপর্যন্ত বসতে বাধ্য হলো। জুভান সেই কখন থেকে লক্ষ্য করছে, অপর্ণা শুরু থেকে একটাও কথা বলছে না। জুভানের বেশ খটকা লাগলো। সে অপর্ণার কাঁধে হাত রাখলে অপর্ণা চমকে উঠে। জুভান স্বাভাবিক সুরে জিজ্ঞেস করে,
-” কি হয়েছে তোর? মন খারাপ লাগছে কেন তোকে? ”
অপর্ণা ব্যতিব্যস্ত হয়ে অনলের দিকে তাকালো। অনল তখন ভ্রু কুঁচকে ঐশীর দিকে চেয়ে। অপর্ণা তাড়াহুড়ো করে চোখের কোণার জল মুছে নিল। বললো,
-” আরে কিছু না। বাদ দে। নাস্তা শেষ করে। আমার বাসায় যেতে হবে, মম ফোন করছে বারবার। ”
জুভান বিশ্বাস করলো না অপর্ণার কথা। জুভানের সচেতন মস্তিষ্ক তাকে মুহূর্তেই জানান দিল, ‘ অনল আর অপর্ণার মধ্যে কোনো ম্যাজোর সমস্যা হয়েছে। ‘ তবে অপর্ণা যখন বলতে চাইছে না, তখন বাদ দেওয়াই উচিত। কারো এভাবে প্রাইভেসি নষ্ট করার কোনো অর্থ নেই।

হঠাৎ জুভানের বাড়ির কলিংবেল বেজে উঠলো। সার্ভেন্ট এগিয়ে এসে দরজা খুলে দিল। দেখা গেল এক মধ্যবয়স্ক লোককে। তাকে দেখেই জুভানের চোখ উজ্জ্বল হয়ে গেল। সে খাবার ছেড়ে উঠে গিয়ে লোকটাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। লোকটা নিজেও জুভানের পিঠে হাত রেখে চোখ বুজলেন। জুভান সরে এলো লোকটার থেকে। তাকে চেয়ার টেনে বসতে বললো। লোকটা সবাইকে ‘ গুড মর্নিং ‘ বলে চেয়ারে বসে পড়লো। জুভান তাকে ঐশীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল।
-” ঐশী, ইনি আমার মামা হন। আমার মা-বাবা, আমার সবকিছু হলেন আমার মামা আমজাদ হোসেন চৌধুরী। তার কথামতই তোমাকে আমি বিয়ে করেছিলাম। ”

ঐশী হাসলো। উঠে আমজাদ হোসেনের পা ধরে সালাম করলো। আমজাদ হোসেন ঐশীর মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া দিলেন। ঐশী আবারও চেয়ারে বসলো। জুভান আর তার মামা আপাতত একে অন্যের সাথে গল্প করতে মশগুল। আপাতত তাদের কাছে পুরো দুনিয়া অদৃশ্য। ঐশী ওদের দিকে চেয়ে মুচকি হাসল। অনল ঐশীর সে হাসিটা দেখতে পেলো। তবে ঐশীর সে রহস্যময় হাসির রহস্য উদঘাটন করতে পারল না। এমন কি আছে, যা ঐশী লুকাতে চাইছে?

#চলবে।