এক্কা দোক্কা পর্ব-০৮

0
264

#এক্কা_দোক্কা – ৮
আভা ইসলাম রাত্রি

রান্নাঘর উত্তপ্ত। চুলোর ঝাঁঝালো আঁচ ঐশীর মুখখানা রক্তিম করে তুলছে। নাকে, ঠোঁটে ঘাম জমেছে। শাড়ির আঁচল কোমরে গুটিয়ে রাখা। উন্মুক্ত নারীদেহের আকর্ষণীয় বাঁক। ঐশী আজ সকালেই জুভানের থেকে তার মামার কি কি পছন্দ সব জেনে নিয়েছে। জুভান ঐশীর এই আমূল পরিবর্তন সোজা চোখে না দেখলেও, বাঁকা চোখে যে দেখেছে তা নয়। মামার প্রতি ঐশীর এত যত্ন দেখে সে কিছুটা খুশি হলেও, ভেতরে ভেতরে একটা খচখচ তো থেকেই যায়।
ঐশী রান্নাবান্না শেষ করে নিজ কক্ষে চলে আসে। জুভান বলেছে, তার মামা যেদিন এ বাড়িতে আসবেন সেদিন ঐশী যেন জুভানের সাথেই ঘুমায়। নাহলে মামা সন্দেহ করবেন। ভেবে বসবেন, ঐশী আর জুভানের মধ্যে সব ঠিক না। জুভান মামাকে কষ্ট দিতে পারবে না দেখে, বাচ্চা পয়দা করার জন্যে এই সারোগেসি পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। এ ক্ষেত্রে ঐশীকে না ছুঁয়ে বাচ্চাও হয়ে গেল আর বিয়েও হয়ে গেল। এই সারোগেসি বিষয়টা দারুন। কত সহজে জুভানের সকল সমস্যার সমাধান করে ফেলল।
ঐশী বাথরুম থেকে বের হয়ে বারান্দায় জুভানের গানের গলার আওয়াজ পেল। জুভান গানের সুর তৈরি করছে। গিটারে টুংটাং আওয়াজ তুলছে আবার গুনগুন করে গানও গাইছে। ঐশী সেদিকে একপল চেয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে চাইলো। তবে জুভান পেছন থেকে ডেকে উঠলো,
-” ঐশী, দাঁড়াও। ”
ঐশী দাঁড়াল। জুভান বললো,
-” তোমার সাথে কথা আছে। আমার পাশে এসে বসো। ”
ঐশী বুঝতে পারলো না, জুভান ওকে কি বলতে চাইছে। কৌতুহলবশত সে জুভানের পাশে এসে দাঁড়াল। জুভান গিটারী তার ঠিক করতে করতে জিজ্ঞেস করলো,
-” মামা এ বাড়িতে আসায় তোমার কোনো কষ্ট হচ্ছে? ”
ঐশী কুটিল হাসলো। মনেমনে বললো,’ আমার সব কষ্ট মোচনের জন্যেও তো তাকে এ বাড়িতে আসতে হতো। ” তবে ঐশী মুখে বলল,
-” তেমন কিছু না। আপনার মামা আমাদের গুরুজন। তাকে সেবা করলে সাওয়াব হবে। ”
জুভানের ব্যাপারটা হজম হলো না। সে গিটার হাতে ভ্রুকুটি করে ঐশীর দিকে তাকাল। ঐশী সে তাকানোতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলো না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সে প্রশ্ন করে বসলো,
-” গান গাওয়া কি আপনার খুব পছন্দের? ”
জুভান ভ্রু কুঁচকে নিজে বলে উঠলো,
-” তুমি খুব অদ্ভুত, ঐশী। আমার মাঝেমধ্যে মনে হয়, তুমি আমার এত কাছে থাকা সত্বেও আমি তোমায় ঠিক চিনতে পারছি না। তোমার চোখটা কেমন যেন, ঐশী। আমি মাঝেমধ্যে তোমার চোখে হিংস্রতা দেখতে পাই। তুমি আসলে কে ঐশী? আমার মনে হয় তুমি নিজেকে যেমন প্রকাশ করো, তেমন তুমি না। কেমন যেনো; একটু অদ্ভুত, অনেকটাই দুর্বোধ্য। ”
ঐশী শব্দ করে হেসে ফেলল। তার হাসি থামছেই না। পেটে খিল ধরে যাচ্ছে ঐশীর। ঐশীর এত হাসির কারণ জুভানের ঠিক বোধগম্য হলো না। সে কপাল কু্ঁচকে হাস্যরত নারীর দিকে চেয়ে। জুভান একসময় বিরক্ত হয়ে বলল,
-” স্টপ লাফিং, ঐশী। ”
ঐশীর হাসি এখনো বিদ্যমান। জুভান একসময় বিরক্ত হয়ে ঐশীর হাত চেপে ধরে তাকে নিজের দিকে টেনে নিল। হঠাৎ জুভানের বক্ষবন্ধনীতে আবদ্ধ হওয়ায় ঐশী এক মুহূর্তের জন্যে হতবম্ব হয়ে পড়ল। হাসি থামলো বটে, তবে মুখে বিস্ময়ের ছাপ। জুভান ঐশীর চোখে চোখ রেখে কড়া কণ্ঠে বলল,
-” অট্টহাসি কি করে থামাতে সেটা আমার ভালো করে জানা আছে। ফারদার, আমার কথার উপর হাসবে না। আমার সেটা পছন্দ নয়। ”
ঐশী মুখ বাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-” করলে কি করবেন? গায়ে হাত তুলবেন? ”
জুভান মিহি হাসলো। ঐশীর কপালের চুলগুলো আলতো হাতে তার কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে বললো,
-” স্ত্রীর গায়ে হাত তোলার মত কাপুরুষ আমি নই, ঐশী। হাত তোলা ছাড়া কার্য হাসিল করার পদ্ধতি আমার জানা আছে। ”
ঐশী ডাগর ডাগর চোখে জুভানের দিকে তাকাল। জুভানের ঠোঁটে কুটিল হাস। ঐশী জোরপূর্বক জুভানের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। জুভান ছেড়ে দিয়ে ঠিকঠাক হয়ে বসলো। হাতে গিটার তুলে নিল। ঐশী বারান্দা থেকে চলে যেতে নিলে পেছন থেকে জুভান বলে উঠলো,
-” একটা কথা মনে রেখো ঐশী। অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ। অতি অবহেলাও যেমন পীড়াদায়ক তেমনি অতি ভক্তিও বেশ সন্দেহজনক। আমার তোমার প্রতি কিন্তু সন্দেহ সৃষ্টি হচ্ছে, ঐশী। ”
ঐশী থেমে গেল। জুভানের কথার অর্থ বুঝতে পেরে তার বুকে কম্পন সৃষ্টি হল। জুভানের মনে সন্দেহ সৃষ্টি করা ঐশীর একটুও উচিত হবে না। তাহলে সব পরিকল্পনা মাঠে মারা পড়বে। ঐশী আর এক মুহূর্ত সে স্থানে থাকলো না, হনহনিয়ে চলে গেলো কক্ষ ছেড়ে। জুভান এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও গিটার নিয়ে মশগুল হয়ে পড়ল।
____________________
-” মামা, চা খাবেন? ”
জুভানের মামা পেপার পড়ছিলেন। ঐশীর কথা শুনে তিনি পেপার ভাঁজ করে টেবিলে রাখলেন। শোয়া ছেড়ে উঠে বসলেন। ঐশীর উদ্দেশ্যে বললেন,
-” ভেতরে আসো মা। ”
ঐশী মুচকি হেসে ঘরের ভেতর প্রবেশ করলো। আমজাদ হোসেন ঐশীকে সোফায় বসতে বললেন। ঐশী বসলে, তিনি এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
-” জুভান এখন কেমন আছে, ঐশী? ”
ঐশী খানিক অবাক হলো। জুভানকে আজ সকালেও দেখেছেন তিনি। একসাথে নাস্তা অব্দি করেছে দুজনে। এখন ঐশীকে জিজ্ঞেস করছে, জুভান কেমন আছে? ঐশী বললো,
-” আপনি নিজের চোখে যেভাবে দেখেছেন, সে সেভাবেই আছে। ”
আমজাদ হোসেন হাসলেন। বড়ই বেদনাদায়ক হাস। তিনি বললেন,
-” জুভানের মেয়ে নেশা আছে, জানো তো? ”
ঐশী কিছুর অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। উত্তর দিলো না সে। আমজাদ হোসেন বলেন,
-” অপ্রস্তুত হওয়ার মত কিছু নেই এখানে। জুভানের মেয়ের নেশা দিনদিন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। তাই আমি ভেবেছিলাম, বিয়ে করলে বোধহয় সে ঠিক হবে। আমি শুধু একবার বলেছিলাম বিয়ের কথা। কিন্তু দেখো, সে দুদিনের মাথায় কাউকে না জানিয়ে তোমায় বিয়ে করে আনলো। বড্ড পাগল ছেলে। এত বড় হয়ে গেছে তবুও আমার কথার নড়চড় সে একটুও করে না। তুমি কিন্তু কষ্ট পেও না। তুমিও এ বাড়ীর লক্ষ্মী। জুভানের জন্যে আমার কাছে তুমিই ঠিক, বুঝলে ঐশী? ”
ঐশী সব কথা শুনে প্রশ্ন করে বসলো,
-” মাত্র একদিনে কি করে বুঝে গেলেন, আমি জুভান স্যারের জন্যে ঠিক? ”
আমজাদ হোসেন ঐশীর কথায় বিস্মিত হলেন। পরক্ষণেই হেসে বললেন,
-” অনেক কথা বলতে পারো তুমি। আই লাইক ইট। কিন্তু জানো আমি হলাম এ দেশের মন্ত্রী। একবার দেখেই বুঝে ফেলতে পারি, কে খাঁটি সোনা আর কার মধ্যে গলদভরা। কবিতা হয়ে গেলো, না? হা হা হা। ”
আমজাদ হোসেনের হাসায় তাল মেলালো ঐশী। লোকটা বেশ রসিক। ঐশী উঠে দাঁড়ালো। বললো,
-” আপনি বসুন। আমি আপনার জন্যে চা বানিয়ে আনছি। ”
আমজাদ হোসেন বাঁধ সাধলেন। বললেন,
-” চা না। কফি এনো। ”
ঐশী সায় দিয়ে চলে গেল রান্নাঘরে। মনেমনে ভাবল, এভাবেই সবার বিশ্বাস অর্জন করতে হবে তাকে। সবার বিশ্বাস অর্জন করে তার নিমিষেই চুর্নবিচূর্ণ করে ফেলবে ঐশী।

#চলবে।