এক আকাশ অভিমান পর্ব-০৬

0
124

#এক_আকাশ_অভিমান
#মার্জিয়া_জাহান_চাঁদনী
#পর্ব : ৬

মেঘাচ্ছন্ন আকাশ!
চারিদিকে অন্ধকার গ্রাস করে নিচ্ছে। বৃষ্টি নামবে নামবে ভাব। আষাঢ় মাস বলে কথা, যখন তখন বিনা নিমন্ত্রণে বৃষ্টি নামতে শুরু করে।
হটাৎ করেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। চাঁদ ওর দাদীর কাছে খেলা করছে। বৃষ্টি দেখে তরীর ইচ্ছা জাগলো বৃষ্টিতে ভিজতে। কাল বিলম্ব না করেই দৌড় লাগালো ছাদের উদ্দেশে।
ছাদের মাঝখানে এসে পা থামালো। মুহূর্তেই বৃষ্টির ফোঁটা ভিজিয়ে দিলো সর্বাঙ্গ।ঠান্ডা বৃষ্টির ফোঁটা শরীর স্পর্শ করতেই শিউরে উঠলো তরী।আকাশের দিকে তাকিয়ে অনিকের স্মৃতিচারণ করছে আর সাথে বৃষ্টি বিলাস।অনিকের অভাবটা বড্ডো পীড়া দিচ্ছে।
হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির ফোঁটা স্পর্শ করে বললো

” আর কটা দিন থেকে গেলেই পারতে,আমরা একসাথে বৃষ্টি বিলাস করতাম। আরো কিছু স্মৃতি জমা হতো, আমি সেগুলোই আকড়ে ধরে রাখতাম।তোমার দেখানো পথে আরো কিছুদিন হাত ধরে একসাথে হাঁটতাম।তোমার বলা গুলো পূরণ করে দিতে,আমি সেই স্বপ্নে বিভোর থাকতাম, হুট তোলা রিক্সা বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যা কিংবা রাত একসাথে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে পারতাম , তোমার উষ্ণ ছোঁয়ায় আমি নিজেকে আরও একবার হারিয়ে ফেলতাম। তোমার চোখের কোনে আমার জন্য জমানো অনুভূতি দেখে আমি আরো বহুবছর বাঁচার ইচ্ছা পুষতাম।
কথা দিয়েছিলে কোনো এক আষাঢ়ে তোমার কাধে মাথা রেখে বৃষ্টিতে ভিজবো। তিন বছরে বহুবার ভিজেছি তবে কেনো আজও তোমার বলা সেই প্রতিজ্ঞার কথা মনে পড়ছে আর নতুন করে ভিজতে ইচ্চা হচ্ছে? স্মৃতির পাতায় আরো একবার সেই অনুভূতি গুলো এঁকে দিয়ে যেতে, আমি বুকে লুকিয়ে রাখতাম।
এখনো তো তোমার সাথে সমুদ্রে ভাসতে বাকি। তবে কেনো পাহাড়ের চূড়ায় রেখে হাত ছেড়ে দিলে।আমি যে সেই পাহাড়ের চূড়ায় একা হয়ে আছি। বাঁচার কোনো আশা খুঁজে পাচ্ছি না। তোমার সাথে কাটানো মুহূর্ত গুলো আজও চোখের সামনে ভেসে ওঠে।আমি যে আর পারছি না। তোমাকে ছাড়া আমি গন্তব্যহীন পথিক।

আকাশের দিকে তাকিয়ে হুহু করে কেঁদে দিল তরী।বৃষ্টির ফোঁটার সাথে নিমিষের মুছে যাচ্ছে চোখের মুক্ত কনার মতো জল। চোখের জলের মতো বৃষ্টি যদি দুঃখ গুলো ধুয়ে নিয়ে যেতে পারতো তাহলে আজ প্রতিটা মানুষ বৃষ্টিতে ভিজে নিজের দুঃখ গুলো বিসর্জন দিতো।

বাড়ি ফেরার সময় হটাৎ বৃষ্টিতে বেশ বিরক্ত শ্রাবণ। বাইক টা পার্ক করে দ্রুত বাসার গেটের ভিতরে প্রবেশ করতে গিয়ে চোখ পড়লো ছাদের দিকে। দুর থেকে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে এক রমণী বৃষ্টিতে ভিজে দুঃখ বিলাস করছে।
ধক করে উঠলো শ্রাবণের বুক! এযে সেই নারী যার জন্য একটা সময় হাজারো দুঃখ বিলাস করেছে। আজও বুকের ভেতর ক্ষত গুলো তাজা হয়ে আছে।
ভিজে একাকার হয়ে গেছে শ্রাবণ। কিন্তু সে দিকে তার নজর নেই। সে ব্যাস্ত এক রমণী কে দেখতে।
কিছু একটা ভেবে পা বাড়ালো ছাদের উদ্দেশ্যে।

“আমাকে নীতি বাক্য শুনানো মানুষটা এত কেয়ার লেস হয় কি করে? সব সময় বাচ্চা মেয়ের দোহাই দিয়ে রাখে আর আজ বাচ্চা মেয়ের কথা মাথায় নেই তার ? আজব তো!!”

পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে পিছনে তাকালো তরী।
শ্রাবণ দাড়িয়ে আছে খুব নিকটে। সামান্য পরিমান দুরত্ব তাদের মাঝে। ধূসর রঙের শার্ট টা গায়ের সাথে লেপ্টে আছে।চুল গুলো কপাল ছড়িয়ে টুপ টুপ করে পানি পড়ছে।
চোখ সরিয়ে নিলো তরী। সামনে দাড়িয়ে থাকা মানুষটা অন্য কারো হৃদস্পন্দন মিস হওয়ার কারণ।

শ্রাবণ আবার বলে উঠলো
” তুমি বৃষ্টি বিলাস করছো করো, তাতে যে চাঁদের উপর ইফেক্ট পড়বে সেটা কি জানো না? ওর যদি শরীল খারাপ হয় তখন কি করবে? এখন তো আমাকে বলবে , আমার মেয়ের কথা আপনাকে ভাবতে হবে না। আরে আমি কেনো যেকোনো কানা যদি দেখে এটা সেও একই কথা বলবে। তোমার তো যত নীতিবাক্য সব আমার উপর। ”

” কানা দেখুক আর বোবা যাই বলুক না কেনো আমার মেয়ের কথা আমি ভাববো। অন্য কেউ না।আর আপনার তো ভাবার কোনো দরকারই নাই।”

” বোবা কি করে বলবে ?”

” কানা যে ভাবে দেখবে?”

নিচে নেমে গেলো তরী। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল শ্রাবণ। সত্যি তো কানা কি করে দেখবে? এই মেয়েটার কথার তেজ কমে না। সব সময় কথা বাড়াতেই হবে ।

বৃষ্টি তখন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। কয়েকটা ফোঁটা মাঝে মাঝে পড়ছে আকাশের বুক চিরে। শ্রাবণ দাড়িয়ে রইলো চাঁদের রেলিং ধরে।

” সেই তো বিধাতা তোমাকে আমার সাথেই জুড়ে দিলেন। তাহলে প্রথমেই কেনো না?কেনো তোমাকে মেনে নিতে পারছি না? আমি তো মন থেকে তোমাকে আজও চাই। অন্যকাউকে জীবনে জড়িয়েছি শুধু তোমাকে ভুলে থাকার জন্য । কেনো আমার সাথে প্র*তা*র*না করলে তরী?কেনো আমার বিশ্বাস টা ভেঙে দিলে? কেনো আমার হাত ধরে হাজারো বসন্ত পার করলে না? কেনো এই বৃষ্টির দিনে আমার হয়ে রইলে না?আমি যে চেয়েও তোমার প্রতি কঠোর হতে পারছি না। তোমার করা অন্যায়ের শাস্তি দিতে পারছি না। যত চাই তোমাকে কষ্ট দিয়ে শেষ করে দিবো ততই আমি তোমার প্রতি দুর্বল হয়ে পরি। তোমার প্রতি ঘৃনা নেই তবে #এক_আকাশ_অভিমান জমে আছে……!!


বৃষ্টির কারণে কাচা মাটির রাস্তা কাদায় পিচ্ছিল হয়ে আছে। গ্রামের রাস্তা ধরে এগিয়ে আসছে শামীম। হাতে কিছু বাজারের ব্যাগ।খুবই সাবধানে পা ফেলছে শামীম। তবুও শেষ রক্ষা হলো না। বেখেয়ালে পা পিছলে কাদায় পরে গেলো শামীম। চারিদিকে আগে চোখ বুলিয়ে নিলো কেউ দেখেনি তো? না কেউ নেই আশে পাশে। খুশি হয়ে উঠতে যাবে তখন ধপাস করে আবারও পড়ে গেলো। কাদায় মাখামাখি অবস্থা। তখনই। শুনতে পেলো কারো ঝংকার তোলা হাসির শব্দ। চোখ ঘুরিয়ে বুঝার চেষ্টা করলে কে সেই মানবী।
গাছের সাথে হেলান দিয়ে হেসে কুটোকুটি হচ্ছে রিনি।
বেশ মজা পেয়েছে এই দৃশ্য দেখে।
রিনি কে হাসতে দেখে হৃদপিণ্ড থমকে গেছে শামীমের।
তার হৃদয় হরনী পিচ্ছি মেয়ে প্রাণ খুলে হাসছে।সেই হাসি দেখার জন্য হাজার বার এই রাস্তায় পড়ে যেতে রাজি।

” এই পিচ্ছি! এভাবে পেত্নীর মতো হাসার কি আছে ? তরে কি ভূতে কিলায়? সারা দিন এই রকম রাক্ষসীর মতো দাঁত কেলিয়ে হাসার কি আছে। সাধারণ পাবলিক তো ভয়ে মরে যাবে। ”

শামীমের কথা শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো রিনি।
” উগান্ডার প্রবাসী,নাইজেরিয়ার হবু জামাই, পাতি হাসার লেজ একটা। তুমি আমাকে পেত্নী বল্লা? তুমি একটা ছাগল, তুমি হলে বিটকেল।!”

” হ আমি বিটকেল আর তুই কটকটি! ”

” কটকটি তোমার বউ”

” তুই কটকটি তারমানে কি তুই আমার বউ?”

” আমার ঠেকা পড়ছে তোমার বউ হতে।”

বলেই মুখ বেকিয়ে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করলো রিনি। শামীম বাজার গুলো তুলে হাঁটা শুরু করলো বাড়ির পথে। পিচ্ছি মেয়েটা কে কবে যে মনের কথা টা বলতে পারবে নিশ্চয়তা নেই। শুধু মাত্র বেস্ট ফ্রেন্ড শ্রাবণের বোন বলেই হয়তো এতো জড়তা।


হাঁচি দিতে দিতে রুমে প্রবেশ করলো তরী। বিছানায়। শুয়ে ফোন টিপছে। আড়চোখে তরীর দিকে তাকালো।
চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। একটু পর পর নাক ঠানছে।
নাক টা পাকা টমেটোর মতো লাল। এই মেয়ের যে ঠান্ডায় সমস্যা হয় সেটা ভুলে যায় কি করে? রাগ হলো শ্রাবণের।তবে কিছু না বলে চুপ করে রইলো।
মেয়েকে দোলনায় রেখে সে সোফায় শুয়ে পড়লো।
শ্রাবণ অবাক হলো না। বিগত দুইদিন ধরে তরী এটাই করে আসছে।চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু ঘুম আসছে না। তরী একটু পর পর কুকিয়ে উঠছে। বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ালো শ্রাবণ। তরীর মাথায় হাত রেখে দেখলো জর এসছে। এই ভয়টাই পাচ্ছিল।কোলে করে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ওষুধ খাইয়ে দিল।চাঁদ কে রাবেয়া বেগমের কাছে রেখে তরীর মাথায় জলপট্টি দিলো…!

সকাল বেলা ফোনের রিংটোনে ঘুম ভাঙলো তরীর। চোখ খুলে দেখলো বেশ বেলা হয়ে গেছে। শ্রাবণ চাঁদ কেউ রুমে নেই। অচেনা নাম্বার দেখে ভাবলো ধরবে না। আবার কল এলো।এই বার রিসিভ করলো

” কি তরী রানী ! খুব সুখেই আছো তাহলে?”

” নদী? ”

” হ্যা ঠিক ধরেছিস। শুনলাম শ্রাবণ নাকি সারারাত সেবা যত্ন করেছে। ভালোই হাত করে নিয়েছিস মনে হচ্ছে। তুই নাকি খুব মহান ব্যাক্তি? তাহলে শ্রাবণকে কেনো আটকে রেখেছিস। সে তো আমার তাই না ? তাহলে তুই ওকে ছেড়ে দিচ্ছিস না কেনো ?” এত লোভ তোর কেনো রে ? আমার জিনিস কেনো বার বার তুই কেড়ে নিচ্ছিস? লজ্জা করে না তোর?”

” লজ্জা আমার না তোর করা উচিত। শ্রাবণ কে আমি তোকে দান করেছিলাম। তোর লোভ ছিল তার প্রতি। আমাদের আলাদা করার জন্য অনেক কিছু করেছিস তুই সেগুলো শ্রাবণ জানে না। আমার লোভ হলে তুই শ্রাবণের জীবনে থাকতে না। আর আমি মানি না মানি সে আমার স্বামী। তাকে ছাড়বো কি ছাড়বো না সেটা আমার বেপার। তোকে তো আমি শ্রাবণের দায়িত্ব দিয়েই দিয়েছিলাম তুই তাকে আটকে রাখতে পারিস নি। সেটা তোর ব্যার্থতা।
বলেই ফোন কেটে দিলো ….!!

#চলবে ইনশা আল্লাহ!!