এক চিলতে রোদ ২ পর্ব-০৬

0
523

#এক_চিলতে_রোদ- ২
#Writer_Nondini_Nila

৬.

বাসায় এসে মায়ের কাছে বকুনি খেতে হলো। তিনি আবার এসব কি করে জানলো আমার মাথায় ঢুকছে না। পরে জানতে পারলাম। পাশের বাসার রিতা আন্টি নাকি দেখেছে আমাকে রাস্তার মাঝখানে দাড়িয়ে থাকতে। তিনি বোনের বাড়িতে থেকে আসছিলো তখন দেখছে। এসেই মায়ের কাছে বলেছে। তখন থেকে আম্মু আমার চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে। আমি আম্মুকে কোন ভাবে শান্ত করে রুমে আসলাম। ব্যাগ রেখে বারান্দায় এসে রিতা আন্টির রুমের দিকে তাকালাম। রিতা আন্টি বারান্দায় বসে বসে কি যেন খাচ্ছে আমাকে দেখেই জিজ্ঞেস করলো আমি ওই ভাবে দাড়িয়ে ছিলাম কেন? উনি আবার সন্দেহ চোখে তাকিয়ে বলেছে।

‘তোর এফেয়ার‌ চলে নাকি রে? বয়ফ্রেন্ড এর সাথে রাগ করে এসব করেছিস নাকি?তোকে একটা ছেলে বাঁচালো সেটা কি বয়ফ্রেন্ড ছিলো নাকি?’

রিতা আন্টির কথায় চোখ গুলো বড় হয়ে গেল। কি সব বলছে? এসব আম্মু- আব্বু কে বললে কি হবে?
এমন কিছু তো না ।

‘ কী সব বলছেন আন্টি। এমন কিছুই না। আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন।’

‘ আরে লজ্জা পাই ও না। আমি তোমার মা বাবারে কিছু বলবো না। আমারে বলতে পারো।’

‘ আপনি আমাকে এমন ভাবেন আন্টি।’

‘ আরে আমি জানি তুমি খুব নম্র ভদ্র মেয়ে। কিন্তু প্রেম করা তো…..

‘ আন্টি আমার কোন বয়ফ্রেন্ড নাই‌। আর রাস্তায় আমি মরতে যাইনি। আমি রোড ক্রস করছিলাম তখন হঠাৎ বড় গাড়ি দেখে ভয় পেয়ে দাড়িয়ে পরেছিলাম।আমার সাথে আগেও এমন হয়েছে আমি একা রোড পার হতে পারিনা।’

বলেই আর দাঁড়ালাম না। দ্রুত চলে এলাম। রিতা আন্টি খুব একটা সুবিধার না। তিনি এই কথাটা সারা পাড়ায় বলে বেড়াবে। উনার এই গুনটা আছে।
কোথাও কিছু হলেই তা সবার কাছে বলে বলে নিন্দা করতে থাকে। আমাকে কিনা তার নজরেই পরতে হলো।

খাবার টেবিলে এ আব্বু ও কথাটা তুললো। আমি মাথা নিচু করে চুপচাপ খাচ্ছি। আব্বু এতো গুলো উপদেশ দিয়ে দিলো। সাথে কাল থেকে গাড়ি নিয়ে চলাচল করার নির্দেশ দিলো। আমি কিছু বলতে পারলাম না। আব্বু কে আমি খুব ভয় পাই। কারণটা জানি না। আব্বু আমাকে খুব ভালোবাসে তবুও তাকে আমার ভয় লাগে।

এরপর থেকে গাড়ি করেই বাসা থেকে বেরুতে হয়।
গাড়িতে বসে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছি। ঘরের দিকে তাকিয়ে আছি। আজকে আগেই বের হয়েছি। তুলি অনেকবার করে বলেছে আজকে আগে যেতে কারনটা বলে নাই।
স্কুলে এসে গাড়ি থেকে নামতেই তুলি আমার হাত ধরে বলল,

‘তোর ড্রাইভার কে বল আজকে চলে যেতে।’

‘কেন?আজকেও কি শপিং করবি নাকি? না বাবা আমি আর তোর সাথে শপিংয়ে যাচ্ছি না!’

‘আরে আজকে কোন শপিং টপিং করব না আজকে আমরা ফ্রেন্ডরা সবাই মিলে বেড়াতে যাব।’

‘আমি কোথাও বেড়াতে যাব না বাড়িতে বলে আসি নাই!’

‘আরে কিছু হবে না সন্ধ্যা লাগেই বাসায় ফেরত যাবো। ঠিক আছে চিন্তা করিস না তো। সবকিছু তেই তোর ভয় কেন এতো। ভীতু কেন তুই এতো? আর কয়দিন পর আমরা কলেজ উঠে যাব। কিছুদিন পর তো সবাই আলাদা হয়ে যাব! কোথায় ভর্তি হব কে জানে? যে কটা দিন আছি সবাই মিলে
আনন্দ করি না। আজকে থেকে মেলা শুরু হচ্ছে আমরা সবাই মেলায় যাব।’

‘ কিসের মেলা? আর কোথায় সেটা? এসময় কোন মেলা আছে আমার তো জানা নাই।’

‘ এই মেলা এবছর থেকেই শুরু হয়েছে। খুব বড় আয়োজন করা হয়েছে। চল প্লিজ।’

এতো অনুরোধ করলে কি আর আমি না করতে পারি।

‘ আচ্ছা। কতোক্ষণ টাইম লাগবে যেতে? আর কলেজ শেষে গিয়ে ফিরে আসতে তো রাত হবে মনে হচ্ছে।’

‘ না আমরা তো টিফিনে চলে যাব। আর রাত হবে না তারাতাড়ি ফিরে আসবো।’

‘ আচ্ছা।’

ড্রাইভার কাকা’কে আসতে মানা করে দিলাম। টিফিনে পিরিয়ডে সবাই বলতে আমরা বারোজন বের হলাম স্কুল থেকে লুকিয়ে। আমার এইভাবে যেতে একদম ভাল্লাগছে না কিন্তু কিছু করার নাই। দুজন ছেলে আছে আর সব মেয়ে। দুই অটো ভাড়া করা হলো। আমাদের অটোতে সব মেয়ে বসলাম। কিছুদূর আসতেই বুঝতে পারলাম আবার আমাকে মিথ্যা বলেছে। আমি কটমট করে তুলির দিকে তাকালাম।

‘ এই তোর আধা ঘন্টা এক ঘন্টা ধরে বসে আছি।’

‘ সরি রে এসব না বললে তো তুই আসতি না তাই। আর একটু খানি রাস্তা।’

‘ আমার বাসায় যেতে রাত হবে বুঝতে পারছিস না আম্মু আব্বু চিন্তা করবে আর আমাকে বকবে।’

‘ ফোন করে বলবি আমার বাসায় গেছিস‌। ‘

‘ তুই আসলেই একটা। আজ প্রতিজ্ঞা করছি আর জীবনে আমি তোদের সাথে কোথাও যাব না।’

তুলি অসহায় মুখে তাকিয়ে র‌ইলো। দেরঘন্টা পর আমরা গন্তব্য এসে পৌঁছালাম।
গাড়িতে থেকে নামতেই মানুষের গিজগিজ লক্ষ্য করলাম। অসম্ভব মানুষ বিকেল বলে আরো বেশি। স্কুল ড্রেস পরা আরো অনেকে আছে। আমাদের কলেজের অনেকেই আছে ওরা ক্লাস না করেই এসেছে। তুলি আমার হাত ধরে নাগরদোলার কাছে নিয়ে এলো এটাতে আমার যে কি পরিমান ভয় লাগে বুঝাতে পারবো না।নিচে নামার সময় আমার হার্ট বের হ‌ওয়ার উপক্রম হয়। কিন্তু তুলি আমাকে জোর করে উঠালো। চারজন করে বসতে হয় সবাই উঠে গেছে আমাদের টায় আমি আর তুলি বসে আছি আর দুজন লাগবে।

‘ আমি নেমে যাই প্লিজ। আমার ভয় করে।’

‘ আমাকে ধরে থাকিস কিছু হবে না। বেশি ভয় লাগলে চোখ বন্ধ করে রাখিস।’

একটু পর কোথা থেকে ইহান এসে বসলো হাসিমুখে। আর আমাদের দিকে তাকালো।

‘ তোমরা এখানে?’

আমি কিছু বলার আগেই তুলি বললো, ‘ আমরা তো স্কুল থেকে এসেছি।

‘ ওহ আচ্ছা। ঊষা কেমন আছো?’

‘ আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি কেমন আছেন?’

‘ ভালো‌ আছি। ওদিনের বিহেভ এর জন্য সরি। আসলে মাথা গরম হয়ে গেছিলো ওসব দেখে।’

আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। দুহাতে শক্ত করে তুলির হাত চেপে ধরে আছি চোখ বন্ধ করে।

‘ একটু আস্তে ধর। আমার হাতের মাংস উঠিয়ে নিবি তো সব।’

আমি শুনলাম না ওর কথা। জোর করে ওঠানোর সময় মনে ছিল না। এখন ওনার হাত ছাড়তে হবে। অসম্ভব আমি ছাড়বো না।হঠাৎ নড়াচড়ার শব্দ না পেয়ে চোখ মেলে দেখি আমি উপরে নিচের দিকে তাকিয়ে আমার আত্মা কেঁপে উঠলো। আমি ঢোক গিলে তাকিয়ে আছি সাথে সাথে নিচে নামতো আমার এবার চিৎকার করে কান্না আসছে নিচে নামার সময় আমার এত খারাপ লাগে। আমি কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছি না এবার আমি বাচ্চাদের মত কেঁদে উঠলাম। আমার কান্না দেখে আশেপাশের সবাই ভড়কে গেলো। ইহান ও আমার অবস্থা দেখে ভড়কে গেছে জিজ্ঞেস করছে কী হয়েছে কাঁদছি কেনো?

আমি যে এতটা ভয় পায় তুলিও বুঝতে পারে নাই এবার তুলিও ভয় পেয়ে গেছে আমার অবস্থা দেখে। তুলি ফটাফট সবকিছু বলে দিল ইহানকে। ততক্ষণে দোলনা নিচে চলে এসেছে দোলনা ইহান থামিয়ে দিল। উপরে ওঠার আগে আমাকে ধরে দোলনা থেকে নামিয়ে দিলো। আমি নিচে এসে ও স্বাভাবিক হয়নি। এখনো যেন আমার মাথা ঘুরছে। বুক ধুকপুক করছে। তুলি নামতে যাবে ইহান ওকে থামিয়ে বলে আমি আছি তুলি সম্পন্ন করেই আসো‌।

ইহান আমার এক হাত ধরে চেয়ার টেনে বসলো আর এক বোতল পানি এনে দিলো। আমি ঢকঢক করে পানি খেয়ে স্বাভাবিক হলাম। এবার শত রাজ্যের লজ্জা আমার চারপাশে এসে ঘিরে ধরল। আশেপাশের অনেকে এখনো আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আমার সামনে ইহান চিন্তিত মুখে তাকিয়ে আছে। সবাই কি ভাবছে এত বড় মেয়ে নাগরদোলায় উঠতে পারেনা।ইশ লজ্জায় আমার কান গরম হয়ে আসছে। আমি মাথা নিচু করে ছিলাম। ইহান মৃদু গলায় বললো,

‘এখন বেটার ফিল করছো কিছুটা ঊষা?’

আমি মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম। ইহান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ততক্ষণে তুলি দৌড়ে এসেছে। আর এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে। এবার মন খারাপ করে বললো,

‘আমাকে ক্ষমা করে দিস ঊষা। আমি জানতাম না তুই যে এতোটা ভয় পাস। এবারের মত ক্ষমা করে দে বোন। আর কখনো কোনো কিছু নিয়ে তোকে জোর করব না। আল্লাহ তোর যদি এখন কিছু হয়ে যেত আমি আঙ্কেল আন্টি কে কি জবাব দিতাম।’

তুলি ও খুব ভয় পেয়েছে ওর মুখ থেকে স্পষ্ট। আমাদের সাথে যারা এসেছিলো ওরা সবাই নিজেদের মতো ঘোরাফেরা করছে আমি আর তুলিই একসাথে কিছুক্ষণ বসে র‌ইলাম। ইহান ও আমাদের সাথেই ছিলো। এই ভয় পাওয়ার পর তুলি আর আমাকে কোথাও নিয়ে গেল না কিন্তু আমাকে একা রেখে কোথাও যেতে পারছে না। ইহান তুলি ডেকে বলল অন্যদের সাথে ঘুরতে আমাকে তার সাথে রাখবে। নাম্বার দিয়ে দিলো যাওয়ার আগে ওদের কাছে পৌঁছে দিবে। আমি বললাম,

‘ আমি এখন ঠিক আছি। আর কিছু হবে না।’

কিন্তু একটা অবাক করা ব্যাপার ঘটলো ইহান জোর করেই আমাকে তার সাথে রাখলো। একটা ছেলের সাথে থাকাটা আমার জন্য খুব অস্বস্তিকর। আমি ধমক খেয়ে চুপ করে আছি। এই নিয়েই ইহান আমাকে দুইবার ধমক দিলো। ঐদিন রাস্তায় ইহান আমাকে সেভ করে। আর এমন একটা ধমক দেয় আমার ভয়ে হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠে। আমি কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলি।
উনি বলেছিলেন, ‘আর ইউ ম্যাড? তোমার মাথায় কয়টা স্কু ঢিলা বলতো? এইভাবে কেউ রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে। চোখে দেখো না?কানে শোনো না? সামনে এতোবড় একটা গাড়ি আসছে দেখে সরার চেষ্টা করলে না। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছো। পাগল নাকি তুমি? আশেপাশের কত মানুষই তোমাকে সরতে বলছে সেসব তোমার কানে যায়নি ইডিয়েট গার্ল!’

আরো কত কথা যে বলে সে বলে বুঝাতে পারব না আমি। আমি তার লাল টকটকে চোখ, ও রাগী মুখের দিকে তাকিয়ে চুপসে গেছিলাম কোন কথাই বলতে পারি নাই। কি ভয়ঙ্কর রাগ! আজকে যখন রাগী চোখের একটা ধমক দিলো আমি আর কিছুই বলতে পারলাম না। মেলা ভর্তি গিজগিজ মানুষ উনি আমাকে মেলার একদম পূর্ব প্রান্তে নিয়ে আসলো যেখানে মানুষের আনাগোনা খুবই কম। আমি ওনার পিছুপিছু এসে দাঁড়িয়ে আছি। উনি দাঁড়িয়ে কাকে যেন ফোন দিল তারপর কয়েকটা কথা বলে ফোন কেটে দিলো। তারপর আমার দিকে তাকালো।

‘ আর কিসে কিসে ভয় পাও?’

‘ কিছুতেই না!’

‘ সিরিয়াসলি?’

‘ হুম।’

‘ওকে তাহলে চলো তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যায় পরে ভয় পেলে কিন্তু খবর আছে!’

‘আমি এত ভীত না!’

‘কেমন সাহসী তা তো দেখলামই!’

আমি চুপ করে গেলাম এখন নিজেকে সাহসী বলতে পারবো না। এই লোকটার সামনে কিনা আমাকে বারবার ভীতু প্রমাণ হতে হয়।

‘ না আমি কোথাও যাবেনা।’

‘ কেন? তুমি না বলে খুব সাহসী?’

‘ আমি যাব না বললাম না।’

‘ আবার ভীতু হ‌ওয়ার ভয়। আচ্ছা না গেলে চলো তাহলে কেনাকাটা করি কিছু?’

‘ আমি কিছু কিনবো না।’

‘ কেন? টাকা নাই?’

‘ আপনাকে বলতে হবে নাকি কেনবো না মানে কেনবো না।’

‘ এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে?’

‘ হুম।’

‘ আমি কিন্তু কেনাকাটা করতে যাবো তুমি চাইলে আমার সাথে আসতে পারো না। হলে তুমি থাকো আমি আবার তোমাকে নিতে আসবে নি।’

ইহান চলে গেল। আমি গাছের সাথে হেলান দিয়ে আছি ফোন বের করে আম্মুকে কল দিলাম। ফোন বের কিছুক্ষণ বকলো তারপর বললো তাড়াতাড়ি যেন ফিরে আসি। ঘড়িতে টাইম দেখে নিলাম চারটা বাজতে পনেরো মিনিট বাকি। সাড়ে চারটার ভেতরে রওনা দিতে হবে। না হলে রাত হয়ে যাবে।

হঠাৎ ও খেয়াল করলাম কিছুটা দূরে তিনটা ছেলে দাড়িয়ে আমার দিকে খারাপ নজরে তাকিয়ে আছে। ভয় পেয়ে আশেপাশে থাকালাম এদিকে বেশি লোক নেই। একা নিজে তাই আরো ভয় পেলাম। তারাতাড়ি দৃষ্টিতে সরিয়ে নিলাম। ইহান আসছে না কেন?

#চলবে……..