এক টুকরো মেঘ পর্ব-২২+২৩

0
747

#এক_টুকরো_মেঘ ☁️
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব::২২

— আমাকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরো,, নয়তো একটা চুমু খাও ।। তাহলে দেখবে এটা শুধু সাইকেল না,,, বাইকের থেকেই স্পীডে চলবে ।।( ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে ,,বাইক চালাতে চালাতে অরিশ)

এবার আমি পড়লাম মহা বিপদে ।। যদি অরিশকে জড়িয়ে না ধরি তাহলে সবাই আমাকে কি পচান টাই না পচাবে।। কিন্তু সামনে বসে কিভাবে জড়িয়ে ধরবো ,, সেটাও বুঝতে পারছি না।। তাই এবার পেছনে তাকিয়ে করুন সুরে বললাম…

— এভাবে সামনে বসে আপনাকে কিভাবে জড়িয়ে ধরবো।।একটা কাজ করুন আপনি আগে স্পীডে ড্রাইভ করুন পড়ে নাহয় আমি আপনাকে জরিয়ে ধরবো।।

— বাকির নাম ফাকি !! আমি অরিশ নগদে বিশ্বাসী ।
তাছাড়া দুটো অপশন দিয়েছি ।। হয় আমাকে নিজ থেকে জড়িয়ে ধর ,, নয়তো (ঠোঁটকে ইশারা করে অরিশ)চুমু খা।।

আমি অরিশের কথা শুনে সেখানেই স্তব্দ হয়ে আছি ।। আমার কোনো রিয়েকশন নেই দেখে অরিশ বলে উঠলো….

— ঠিক আছে আমাকে জরিয়ে ধরা বা কিস কোনোটাই তোকে করতে হবে না।।‌আমি আমার মতো আস্তেই চালাই ।।

কোনো উপায় না পেয়ে আমি একটু নড়ে পেছনে ফেরে অরিশের গাল হাত রাখতেই তিনি সাইকেল চালানো থামিয়ে আমার কাঁধে হাত রাখলেন।। আমি আস্তে করে তার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ছুয়াতেই ,, তিনি আমার চুলের বাজে হাত দিয়ে আমার ঠোঁট নিজের দখলে নিয়ে নিলেন।। কিছু বোঝে উঠার আগেই ছেড়ে দিয়ে আবার চালাতে শুরু করলেন।। আমি এখনো মাথা ঘুড়িয়ে তার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছি।। তিনি আমার দিকে একবার তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বললো…

— এভাবে চোখ রসগোল্লা করে তাকিয়ে থাকলে কোনো অঘটন হয়ে যাবে।। তার চেয়ে বরং তোর মাথাটা আমার বুকে রাখ।।স্পীডে চালাতে গেলে আবার হুমড়ি খেয়ে নিচে পড়ে গিয়ে ব্যাথা পারি + জেতাও হবে না।। দেখিস তখন আবার আমাকে দোষ দিস না।।

অরিশের কথা রাগ হলাম বটে আবার লজ্জাও পেলাম।।নিজেই আমাকে এমন পরিস্থিতিতে ফেলে এখন উপহাস করা হচ্ছে।। তিনি নিজেই আমার মাথাটা তার বুকে টেনে নিয়ে স্পীডে চালাতে শুরু করলো।।আমি চোখজোড়া খিচে বন্ধ করে উল্টো হাতে তার গলা জড়িয়ে ধরলাম।।যখন চোখ খুললাম তখন আমরা ভাঙা পুলটার কাছে চলে এসেছি।। আসে পাশে ওরা কেউ নেই।। অনেকক্ষন পরে ওরা সাইকেল নিয়ে এসেছে।। সত্যি ভাবতে পারছি না,,, এতো তাড়াতাড়ি আমরা এসে পৌঁছেছে।। আমি আগেই জানতাম অরিশ ভালো সাইকেল চালাতে পারে,, কিন্তু এতোটা ভালো পারে সেটা জানতাম না।।।

__________________________

মোটা পাইরের হলুদ রঙের শাড়ি পড়ছি আমি।।আজ পর্যন্ত কখনো একা একা শাড়ি পড়ি নি।। সবসময় মাম্মাম নয়তো মামনি পড়িয়ে দিয়েছে ।। এর এই ৫ বছরের শাড়ি তো দূরে থাক থ্রি পিস অবধি পড়ি নি। কিন্তু আজকে সামিরার জোরাজুরিতে পড়ছি।। এই অচপারা গায়ে পার্লার তো দূরে থাক একটা মেকাপ ম্যান পর্যন্ত নেই।। অনেক কষ্ট করে আমার নাম করে একজনকে আনা হয়েছে ,, সে সামিরাকে সাজিয়ে দিচ্ছে।।এখানে সবাই গায়ে হলুদ নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত যে আমার দিকে কারো নজর নেয়।।তাই একা একা ইউটুব দেখে দেখে শাড়ি পড়ার চেষ্টা করছি ,, কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছে না।।মনে হচ্ছে খুলে পড়ে যাচ্ছে ,, তাই শাড়িটা খুলে ড্রেসিং টেবিলের উপরে রেখে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।।। হঠাৎ কেউ ঠাস ঠাস পায়ে রুমে ঢুকে দরজা লক করে দিলো ।। একটু আগে আমি আরশিকে ডাক দিয়েছিলাম।। হয়তো আরশি এসেছে ,,তার দিকে না তাকিয়ে এক হাতে শাড়িটা তুলে নিয়ে তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম …

— এলি তো এলি ,, আগে আসতে পারতি না।।কতোক্ষন লেট হয়েছে হিসেব আছে।।এখন খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে না থেকে ব্লাউজের ফিতাটা লাগিয়ে দিয়ে ,, শাড়িটা পড়তে একটু হেল্প কর তো।। এমনিতেই শাড়ি আমি পড়তে পারি না,,তার উপর একা একা তো পড়া সম্ভবই না।।

কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো কথা শোনা গেল না।। সে ধীর পায়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে ফিতাটা বেঁধে দিলো ।। তার হাত আমার পিঠে রাখতেই কেঁপে উঠলাম আমি,, এটা আরশি না কিন্তু এই স্পর্শটা আমার অতি পরিচিত ।।ফিতাটা বেঁধে দিয়ে আমাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ,, মাথা থেকে পা অবধি পরখ করে নিলেন।। সামনে অরিশকে দাঁড়ানো দেখা লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে।। আমি হাত দিয়ে শরীর ঢাকার চেষ্টা করে ,, চোখ দুটো বন্ধ করে ,,মুখটা ডান দিকে ফিরিয়ে নিলাম।।তিনি শাড়িটা খুলে একটা কোনা আমার কোমরে গুজে দিয়ে ,, শাড়িটা ভালোভাবে পেঁচিয়ে দিয়ে ,, আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে কুঁচি গুলো সুন্দর করে সাজিয়ে, নিজেই আমার কোমরে গুজে দিলো ।। আমি তার স্পর্শে সাথে সাথে দু কদম পিছিয়ে গেলাম।। অরিশ আমাকে পেছন ঘুড়িয়ে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে বললেন…

— মাশাআল্লাহ।।(একটু থেমে আবার) তোমাকে দেখতে শুধু আমার তরীরানী লাগছে না,, মনে হচ্ছে আমার রাজ্যের তরী মহারানী।।জানো,,, ৫ বছর আমি এই দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম।।একটা কথাই ভেবেছিলাম ,,কবে আমি আমার তরীরানীকে এইভাবে সাজাবো।। তার মায়াবী মুখ ,, টানা টানা চোখ ,, পাতলা গোলাপী রঙের ঠোঁট ,, এই তুলোর মত নরম হাত দুটি।। যেগুলোকে আমি নিজের হাতে রাঙিয়ে দিবো।। একটা কথা খুব করে বলতে ইচ্ছে করছে….

🍃 কঠিন তোমার অন্তর খানি _____

আনমনে চলে ,, যখন তখন

🌺 ইশারায় শুধু পাগল করে________

— আজও আমি সেই একই কথা বলবো অরিশ ,, যেমনটা আগে বলেছিলাম।।আমাকে সুন্দর লাগছে কিনা জানিনা ।। এইটুকু জানি,, আমার পাশে তোমাকে দাড় করালে একদম রাতযোটক লাগে।।যাকে বলে মেইড ফর ইচ আদার।।(মনে মনে আমি)

মুচকি হাসি দিলাম আমি ।। লজ্জায় যেন‌ আমাকে বেশি করে ঘিরে ধরেছে।। অরিশ পকেট থেকে একমুঠো কাঁচের চুড়ি বের করে আলতো ভাবে আমার হাতে পরিয়ে দিলেন।। অনেকগুলো কাজলের স্যাপের মধ্যে থেকে একটা কাজল খুঁজে নিয়ে খুব যত্ন করে দিয়ে দিচ্ছেন।। কাজল দিতে বরাবরই আমার খুব ভয় করে ,,তাই সহজে দেই না,, কিন্তু আজকে অরিশের যত্ন করছে দেওয়া টানা টানা কাজল দেখে।। প্রতিদিন অরিশের হাতে এভাবে কাজল দিতে ইচ্ছে করছে।। তিনি কাজলটা দেওয়া শেষ করে একটা লিপস্টিক হাতে নিয়ে যখনই আমার ঠোঁটে লাগিয়ে দিবে তখনই তার ফোনটা বেজে উঠলো।।পকেট থেকে ফোনটা বের করতেই স্কিনে “‘ তৃনা”” নামটা জ্বলজ্বল করে উঠলো।।অরিশ আঢ় চোখে আমার দিকে একবার তাকিয়ে ফোনটা কেটে দিয়ে পকেটে রেখে দিলো।। এতোক্ষণ মনের ভেতরে যে ভালোলাগা,, ভালোবাসা কাজ করছিলো ,, মুহুর্তেই তা অন্ধকারে ঢেকে গিয়ে চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো।।এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে আর নিজের চোখের অশ্রু সামলাতে পারবো না।। বুকের ভেতর হাজার কষ্ট জমিয়ে রেখে ২ কদম এগুতেই পেছন থেকে অরিশ আমার হাত টেনে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো ।।আমি নিজেকে সামলে কড়া কড়া গলায় বললাম….

— আমার হাতটা ছারুন আর আমাকে যেতে দিন।।

অরিশ এখনো আমার হাত ধরে আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।। কিন্তু সেদিকে তোয়াক্কা না করে আবার চেঁচিয়ে বললাম…

— আমি আমার হাতটা ছাড়তে বলেছি ,, আপনি কি শুনতে পারছেন না ।।

— এমন করছিস কেন আগে লিপস্টিক টা পরাতে দে।। তারপর আমি তোকে সবটা খুলে বলছি !!

বলেই আমার ঠোঁটে হাত দিয়ে লিপস্টিক টা লাগাতে নিলেই ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিলাম তার গালে।।এতক্ষন চোখের কোনে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু অশ্রু গুলোকে আর দমিয়ে রাখতে পারলাম না,, টপ করে গাল বেয়ে নিচে গড়িয়ে পড়লো।। আমি কান্না মিশ্রিত গলায় বললাম….

— আপনি সত্যি আজও ঠিক আগের মতো আছেন ,,, আমি জানি,, আমাকে ভালোবাসা যায় না তাহলে কেন আসেন আমার কাছে ।। কেন আপনার শীতল স্পর্শ আমার গায়ে ছড়িয়ে দেন।। কতো কষ্ট হয় আমার,, আপনি কি একটুকুও বুঝতে পারেন না।। কবে মুক্তি পাবো এই দম ফাটা যন্ত্রনা থেকে।।যদি আত্মহত্যা পাপ না হতো ,,, তাহলে এই জীবনটার ইতি সেদিনই টানতাম যেদিন পাহাড় সমান কষ্ট নিয়ে দেশ ছেড়েছিলাম।।(একটু থেমে আবার আমি) আমার দেহটাই যদি সব হয় ,,তাহলে একটা কাজ করুন ,,, নিজের ইচ্ছেমত মিটিয়ে নিয়ে আমাকে মুক্তি দিন ।।

আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হচ্ছে না তাই দৌড়ে বের হয়ে গেলাম রুম থেকে ।। যখনই নদীর তীরে ছোট একটা কুড়ে ঘর বানানোর স্বপ্ন দেখি ,,, তখনই একটা ভারী শীতল স্রোত এসে সবটা তছনছ করে আমার ইচ্ছেগুলো কাঁচের মতো চুরমার করে দেয়।।

____________________________

ছাদের এক কোনে দাঁড়িয়ে আছি আমি ।।আর আমার পাশে দাড়িয়ে আছে রাফি,,আরশি স্যামি সামিরা আর অরিশ ।। সারাদিন নিজেকে সবার থেকে আলাদা রেখেছিল ,, কিন্তু জানি না কেন ওরা আমাকে টেনে এখানে নিয়ে এসেছে ।।পড়নে অরিশের পড়িয়ে দেওয়া সকালের সেই শাড়িটাই আছে ।। চুলগুলো অগোছালো,, চোখের কাজল খানিকটা লেপ্টে গেছে।। হাতের চুড়ি গুলো হাতেই আছে।। প্রায় ঘন্টা খানিকের নিরবতা ভেঙ্গে রাফি বলে উঠলো….

— আমি সত্যি জানি না তোরা একটু পর কেন এতো মনমালিন্য করিস ।। আমরা তোদের ব্যাপারটা শুনে সবাই ভেবেছি তোকে সবটা বলে দেবো।।তাই সারাদিন পর একটু সময় বের করে সবাই এখানে এসে যড়ো হয়েছি।।

— সকালে আমার ফোনে তৃনা নামটা দেখে তুই আমার সাথে বাজে বিহেব করেছিস ।।৫ বছর আগেই তোকে বলে দিতে চেয়েছিলাম,, কিন্তু বলার আগেই তুই আমার থেকে হারিয়ে গিয়েছিলি !! আবার হারিয়ে যাওয়ার আগেই তৃনার ব্যাপারটা তোর কাছে পরিস্কার করে দেওয়া দরকার !!!তাহলে শোন….
তৃষা নামটা যখন আমার নামের সাথে জড়ায় তখন আমি 9 কিংবা 10 পড়ি ।। প্রায় ১১/১২ বছর আগের কথা ।। তোর প্রতি আমার অদ্ভুত একটা নেশা কাজ করতো ।। হ্যা আমি তোকে ভালোবাসতাম।। কিন্তু সেটা আমি নিজেই জানতাম না।।আর তোর প্রতি ভালোভাবে কোনোদিন খেয়ালও করিনি।। কিছুদিনের মধ্যেই নতুন একটা মেয়ে আমাদের ক্লাসে এডমিট হয় ।।সে আর কেউ না তৃনা।।তৃনা দেখতে যেমন সুন্দরী তেমন ছিলো তার অহংকার।।হবেই তো বড়লোক বাবার একমাত্র সন্তান।। ক্লাসের প্রায় প্রতিটি ছেলেই ছিলো ,, তার প্রতি দুর্বল।।আমিও ছিলাম।।সবাই ওকে অনেক ভাবে,, অনেক রকমভাবে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করেছিলো ,, কিন্তু সে ইমপ্রেস হয়নি।। যখনই আমার সাথে দেখা হতো ,,তখনই কেমন অদ্ভুত ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো ।। সবাই বলাবলি করতো তৃনা নাকি আমাকে ভালোবাসে।। তখন খুবই মরিয়া হয়ে তৃনাকে প্রোপজ করি ,, আর সাথে সাথে সে এক্সসেপ্ট করে নেই।।

— তাহলে তো ভালোই হলো ।। আপনাকে আর কষ্টকরে কিছু করতে হলো না।। তাহলে আবার আমার কাছে কেন আসেন ,,, তৃনার কাছে গেলেই তো পারেন !!( অরিশকে থামিয়ে দিয়ে আমি)

— তুই চুপ করবি নাকি ডাফার ।।কানের নিচে ঠাটিয়ে দিবো দুইটা ।।

আমি মুখটা ভুতুম পেঁচার 🦉 মতো করে চুপ করে রইলাম।। তারপর তিনি আবার বলতে শুরু করলেন…

— প্রথম দিন ওর হাত ধরে পুরো এলাকা ঘুড়েছিলাম।। আমার বন্ধুদের ট্রিট দিয়েছিলাম।। কিন্তু সেখানে এক টাকাও আমার যায়নি ।।সবটা তৃনা একাই দিয়েছিলো।।সেদিনই তৃনার প্রতি আমার সব ভালোলাগা শেষ হয়ে গিয়েছিল।।আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম ,, আমাদের সম্পর্কটা বাঁচিয়ে রাখতে ,, কিন্তু পারলাম না।।ওর হাত ধরাটাই হয়তো আমার ইচ্ছে ছিলো,, কারন ওর শুধু আমার মোহ ছিলো‌।।।

চলবে..💞💞

#এক_টুকরো_মেঘ ☁️
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব::২৩

— আচ্ছা অরিশ ,, আমিও কি শুধু আপনার মোহ ।। আমার কাছ থেকে নিজের চাহিদা পূরণ করে ,, আমাকেও কি তৃনার মতো ছুঁড়ে ফেলে দিবেন।।(অরিশকে থামিয়ে দিয়ে,, করুন সুরে আমি)

— কানের নিচে এমন একটা ঠাডিয়ে দিবো না ডাফার ।।তোর এই প্রিন্ট করে নেকা কান্না একবারে থেমে যাবে !!(চোখ গরম করে অরিশ)

— ঋনি তুইও পারিস বটে !! দেখছিস যে অরিশ ভাইয়া কথা বলছে ,, তার মাঝখানে তোর কথা না বললে চলছে না!!(আরশি)

— যেমন ভাই তার তেমন বোন ।।দুজনেই আমাকে সারাদিন বকে ।।।(নেকা কান্না করে আমি)

— একদম চুপ….!! তারপর আবার বলতে শুরু করলো.
একসময় তৃনাকে পুরোপুরি অবহেলা করতে শুরু করে দেই।। একটাও কথা বলতাম না।। ওকে এড়িয়া চলাটা যেন আমার একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।।
হঠাৎ একদিকে ঘুম থেকে উঠে তৃনার নম্বর থেকে আমার ফোনে ৭৯ মিসিড কল দেখতে পাই ।।ফোনটা হাতে নিয়ে আবার রেখে দিতেই ,, আবার রিং বেজে উঠে।।বিরক্তি নিয়ে ফোনটা রিসিভ করতে আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।।‌ফোনটা তৃনার ছিলো না তৃনার মায়ের ছিলো।। তিনি কাঁদছিলেন আর একটা কথাই বলেছিলেন ,, তৃনা সুইসাইড করার চেষ্টা করেছে।তাতে আমার কোনো ভাবাবেগ হলো না।।আমি নিজের মতোই চলছিলাম।।রাতে যখন বাড়ি ফিরি একজন মধ্যবয়স্ক মহিলাকে আমাদের বাড়িতে দেখতে পাই।।প্রথমে বুঝতে অসুবিধা হলেও ,, পরে বুঝতে বাকি রইল না কে।। কারন তৃনার মুখের সাথে হালকা মিল খুঁজে পেয়েছিলাম। তিনি আমার হাত পা অবধি ধরেছিলেন যাতে তৃনার সাথে সম্পর্কটা কা্ন্টিনিউ করি।। কিন্তু আমি তো আমি তার কোনো কথা গায়ে লাগালাম না।। তিনি তার মেয়ের জন্য আমার পায়ে হাত অবধি দিয়েছিলেন ।। অবশেষে বাবা মায়ের কথা শুনে আমি তৃনার সাথে সম্পর্কটা কন্টিনিউ করি।। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমি আজও তোকে ভালোবাসি।‌

— আমাদের বিয়ের পরও যদি ঐ ভদ্র মহিলা এসে তোমার পা ধরে তাহলেও কি তুমি আবার তৃনার সাথে সম্পর্ক রাখবে।।(ইনোসেন্স ফেইস করে আমি)

কথাটা শেষ করার আগেই সবাই আমার দিকে চোখ বড়বড় করে তাকালো ।।আমি এবার লজ্জায় চুপশে গেলাম।।শেষে কি বলতে কি বলে ফেলেছি।।এতোক্ষণে খেয়াল করলাম,,কথার মাঝে আমি অরিশকে কখনো নাম ধরে আবার কখনো তুমি বলে সম্মোধন করছি।। যেমনটা আগেও অনেকবার করেছি।।অরিশ আমার দিকে তাকিয়ে একবার মৃদু হেসে বললেন….

— তাহলে তুমি আছো কি করতে।। আগে তো কথায় কথায় তোমার ঐ উষ্ণ গরম ঠোঁট দুটি আমার ঠোঁটে ছুঁইয়ে দিতে ,,এবারও যদি এমন কিছু হয় তাহলে তোমার গোটা ভালোবাসা দিয়ে,, আমাকে তোমার কাছে বেধে রাখবে।। তাছাড়া একটা ভালো ছেলে খুঁজে তৃনার বিয়ে দিখেছি,, এখন তার ৩ বছরের একটা ছেলে আছে।।তাই টেনশন নেওয়ার দরকার নেই।।

এবার যেন লজ্জায় মাথা তুলে তাকাতে পারছি না।।মাথা নিচু করে কৌতূহল নিয়ে বললাম…

— তাহলে তৃনা সকালে কেন ফোন করেছিলো,,আর আরশি সেদিন কেন আমাকে সবটা বললো না??

— ওলে বাবালে ।। আরশি সবটা জানতো নাকি !!সে আপনাকে বলবে !!( প্রিন্ট করে আরশি)

আমি আরশির দিকে চোখ গরম করে তাকাতেই চুপসে গেল সে।।আমার রাগ জেদের কাছে আরশি বরাবরই কাবু ,, ঠিক আগের মতোই।।

— তৃনার ছেলের জন্মদিন কালকে,, তাই ইনভার্ট করেছে।।সেটা তোর গরদপ মাথায় ঢুকবে না।।।আর কিছু জানার থাকলে বল ।।(জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমি)

— আরশি আর স্যামির ব্যাপারটা কিছু বুঝলাম না।।ওরা একসাথে ছাদে গিয়ে প্রেম আলাপ করছে ,,আর টাওয়াল রুম থেকে বেরুচ্ছে।। কিন্তু আরশি তো বলেছিলো,, ও ফারহানকে ভালোবাসে।।(আমি)

— তুই এখান থেকে যাবি !! মেজাজ টা শুধু শুধু গরম করছে!!(ধমকিয়ে অরিশ)

— আপনি ঠিক আগের মতোই আছেন কথায় কথায় আমাকে ধমকি দেন।। আমি যদি মরে যেতাম তাহলেই ভালো হতো।।আপনার এই কথায় কথায় বকা আমায় একদম শুনতে হতো না।।(নেকা কান্না করে আমি)

মুহুর্তের মধ্যেই যেন অরিশের চোখ দুটি লাল আকার ধারণ করলো।।আরশি সেদিকে তোয়াক্কা না করে বলতে লাগলো।।

— ভাইয়া তুই সারাক্ষন ওকে বকছিস কেন?? জানে না বলেই তো জানতে চাইসে।। সে বিষয়ে ভাইয়ার চেয়ে আমি একটু বেশি জানি ,, আমি বলছি।।আসলে ফারহান আর স্যামি দুজনেই এক ।।মানে একজন ২ ক্যারেক্টর ।।সেদিন যখন জানতে পেরেছিলাম,, তুই আমার কারনে সবাইকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলি।। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম।।সারাক্ষন নিজেকে দোষারোপ করতে শুরু করলাম।।।একটা কথাই ভাবতাম ,, যে মেয়েটার আমার ভাইটাকে এতো ভালোবাসে সে তার ভালোবাসার মানুষটিকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো।। শুধু মাত্র আমার জন্য।।তখন আমার কষ্ট এই ফারহান সহ্য করতে পারছিলো না।।তখন ও আমাকে এই বুদ্ধিটা দিয়েছিলো ।। সেখানে আমি আমার ভাইটাকে সামলাতে পারি ,,আর ফারহান নিজে তোকে।।এখন ভাবছিস তো ফারহান কিভাবে স্যামি হলো.।।আর সামিরাকে কোথায় পেল।। আগে একবার দুজনের চেহারা মেলাতো ,, কোনো মিল খুঁজে পাস কিনা।।

আমি আবার দু’জনে চেহারা ভালো ভাবে পরক করে আরশির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লাম।।যার অর্থ না।।

— বাকিটা আমি বলি!!!সামিরা আর আমি মামাতো ফুফাতো ভাইবোন ।।সেই সুবাদে পাসওয়ার্ড,,ভিসা সবসময়ই আমার কাছে ছিলো।।আরশির তোমার বাবার কাছ থেকে রাফির কন্টাক্ট নাম্বার নিয়ে আমাকে দিয়েছিলো।। আরশির চোখের অশ্রু আমি সহ্য করতে পারিনি ।।তাই সেদিনই রাফির সাথে কন্টাক্ট করে ইমার্জেন্সি ফ্লাইটে লন্ডনে চলে যাই।। লন্ডনের রাস্তাঘাট তেমনটা একটা আমি চিনি না,, তাই সামিরাকে সাথে নিয়ে রাফির সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম।।আর সেখানেই জানতে পারলাম ওদের সম্পর্ক টার কথা।। তখনই এই প্ল্যানটা করলাম।। একদিকে সামিরার আপন স্যামি ভাই সাজলাম।।অন্যদিকে রাফির বন্ধু।।তারপর থেকেই তোমার সব খবর আরশিকে দিতাম।।আর সে তার ভাইকে।। প্রথমে অরিশ ভাইয়া আমাদের ব্যাপারটা জানতো না ,,,পরে আরশি তাকে বলেছে।। এবার বল ,, তোমার সাথে আমার ৪ দিন পর দেখা হয়েছিলো তো ।।(একদমে কথাগুলো বলে থামলো ফারহান)

আমি মাথা নাড়ালাম।। সত্যিই তো ।।আমার অগোচরে এতোবড় একটা ব্যাপার ঘটে গেল আর আমি কিছুই জানি না।।আমি এখন আহাম্মকের মতো তাকিয়ে আছি।।বুঝতে পারছি না,, তাহলে সেদিন পুরোনো একটা ফ্যামিলি ফটোতে সামিরার সাথে একটা ছেলেকে দেখেছিলাম।।

— তুমি যাকে দেখেছো ,, ও হচ্ছে স্যামি আমার নিজের ভাই । প্রায় বছর সাতেক আগে ক্যান্সারে মারা গেছে।।

আর কিছু বলার আগেই কান্নায় ভেঙে পড়লো সামিরা।।আমরা সবাই যখন সামিরাকে সামলাতে ব্যস্ত।।তখন ঠাস ঠাস কোনো আওয়াজ পেয়ে ঘুড়ে তাকালাম অরিশের দিকে ।। তার মাথা থেকে রক্ত ঝরছে।। হাতে দুটো রক্তাক্ত ইট ।। বুঝতে বাকি রইল না,, সে তার মাথায় নিজেই আঘাত করেছে।। আমি সামিরাকে ছেড়ে দৌড়ে অরিশের কাছে গেলাম।।তার হাত থেকে ইট দুটি ছুঁয়ে ফেলে দিয়ে ,, মাথায় থাকা রক্ত গুলো মুছতে মুছতে কান্না করতে করতে বললাম….

— অরিশ কি করছো টা কি তুমি।।কতোটা রক্ত বের হচ্ছে তোমার ধারনা আছে।।আমি এখন কি করি!!

তিনি আমাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো….

— এখন এতো কষ্ট পাচ্ছিস কেন হ্যা ?? একটু আগে তো দিব্বি বলেছিলি ,, তুই মরে গেলে ভালো হতো ।। তাহলে আমি আর তোকে বকতে পারতাম না।। তুই তো কোনো দোষ করিস নি।। দোষ করেছি তো আমি ,, বারবার তোকে বকে ।। তাই মরলে আমি মরবো ,, শুধু শুধু তুই কেন মরবি!!!

বলেই হনহন করে হেঁটে চলে গেল।। সামান্য একটা কথায় যে এতোটা রিয়েক্ট করবে ভাবতে পারি নি।। আমি আর দাড়িয়ে না থেকে দৌড় লাগালাম অরিশের পেছনে।।। কিন্তু কোথাও তাকে খুঁজে পেলাম না।।আমি পৌঁছানোর আগেই ‌সে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।।

__________________________

হসপিটালের করিডোরে বসে আছি আমি ।। শুধু আমি একা নয় বাড়ির সবাই।।। সবার চোখে অশ্রু।।মামনি তো ভেঙ্গে পড়ছে।। তাকে মাম্মাম আর আন্টি মিলে শান্তনা দিচ্ছে।।আজ আমার চোখ থেকে এক ফোঁটাও অশ্রু ঝরছে না।।কথায় আছে না ,, অল্প শোকে কাতর অধিক শোকে পাথর।। আমার ঠিক সেই অবস্থা।।
পরশুদিন রাতে অরিশ ভাইয়ার চলে যাওয়ার পর তার সাথে আর কোনো কথা হয়নি।। হবে কিভাবে ,, তিনি একবারও আমার কাছে আসেনি।।দূর থেকে একবার চোখের দেখা দেখেছি।।কালকে দুমদাম করে রাফি আর সামিরার বিয়ে হয়েছে।।তারপর অরিশকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।। আমি অরিশকে খুঁজতে নদীর কাছে গিয়েছিলাম।।সেখানে অরিশকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে পাথর হয়ে গিয়েছিলাম আমি।। কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।। হঠাৎ ফোনের কথাটা মাথায় আসতেই সবাইকে ফোন করে সবটা জানাই।। অরিশ হয়তো চাইনি তার জন্য রাফি আর সামিরার বিয়েটা আটকে যাক।।তাই এই অঘটন টা আজকে ঘটিয়েছে।।
আমার ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে ডাক্তার অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হলেন।। আমরা সবাই তাকে গিয়ে ধরলাম।। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললেন…

— মাথায় আঘাতটা অনেকটা গভীর ছিলো।।তারউপর কিছুদিন আগেও মাথায় রক্তক্তরন হয়েছিলো।।আগেরটাই এখনো ভালো হয়নি।। এখন আবার নতুন।
আমাদের যা করার ছিলো আমরা করেছি ।। বাকিটা উপরওয়ালার হাতে।। তাকে ডাকুন সব ঠিক হয়ে যাবে।।

হঠাৎ করেই কেমন চারপাশটা অন্ধকার হয়ে গেল।।আর কিছু শুনতে পেলাম না।। শেষে কিনা আমার অবহেলার জন্য আমার ভালোবাসার মানুষটা হারাবো।। একবার মামুনির দিকে তাকালাম,, তিনি তার ছেলে জন্য পাগলের মতো করছে।। অরিশের কিছু হয়ে গেলে আমি নিজেকে কোনোদিনই ক্ষমা করতে পারবোনা।।

কিছুক্ষণ আগে জ্ঞান ফিরেছে অরিশের ।।সবাই ভেতরে তার সাথে দেখা করতে গেছে।। আমি যাবো ,,কি যাবো না।।সেই দিধা ধন্দে ভুকছি।। অনেক বলে নিজেকে শান্ত করে ঢুকলাম অরিশের কেবিনে।।আমি ঢুকতেই সবাই আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেল।। আমাকে দেখে অরিশ নিজের মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো।।

চলবে…💞💞