এক ফালি সুখ পর্ব-০১

0
98

#এক_ফালি_সুখ
#সূচনা_পর্ব
#তাসনিম_জাহান_মৌরিন

_”আমি কোনো ডিভোর্সি মেয়েকে বিয়ে করতে পারবোনা মা। এত খারাপ দিন চলে আসেনি আমার।”
ডাইনিং টেবিলের চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বেশ উচ্চস্বরেই কথাটা বললো ইলহাম আবসার তূর্য। দৃষ্টিতে তার রাগের আভা ফুটে উঠেছে। সকালে ব্রেকফাস্ট করতে এসে মায়ের থেকে এমন প্রস্তাব হয়তো সে আশাই করেনি। তূর্যর সঙ্গে সমানতালে রেগে গেলেন তার বাবা ইরশাদ আবসার। তিনিও খাওয়া ছেড়ে উঠে গিয়ে ইলমা আবসার এর উদ্দেশ্যে কড়া গলায় বললেন,
_”আক্কেল জ্ঞান কি পুড়োটাই হারিয়ে গেছে তোমার? শেষ পর্যন্ত কিনা একটা বিবাহিত মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিতে চাইছো!”

ইলমা খানিকটা নিচু গলায় বললেন,
_”ও বিবাহিত ছিল, ডিভোর্স হয়ে গেছে। আর আমিতো জোড় করিনি। মেয়েটা আমার পরিচিত,অনেক লক্ষি একটা মেয়ে তাই বলেছিলাম।”

_”কেন বলবে মা? কোন মা একটা ডিভোর্সি মেয়েকে ছেলের বউ করতে চায় বলতে পারো?”

কথাটা বলেই টেবিলের উপর জোড়ে হাত রাখলো তূর্য। ইলমা ভয় পেয়ে ছেলের পাশে গিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
_”শান্ত হ বাবা,আমি সত্যিই ওভাবে বলতে চাইনি।”

মায়ের হাতটা ছাড়িয়ে নিলো তূর্য,তার কপালে এখনো রাগের ভাজ বিদ্যমান। তূর্য বড়বড় নিঃশ্বাস ছেড়ে মায়ের সামনে আঙুল উঁচিয়ে বলে,
_”লিসেন মা, ইলহাম আবসার তূর্যের বউকে রূপে গুণে সব দিক থেকে উপরে থাকতে হবে। কোনো সাধারণ মেয়েকে আমি বিয়ে করবো এই চিন্তা করোনা। আর তোমার না আমার জন্য মেয়ে দেখার ই দরকার নেই, সেটাই ভালো হয়।”

চেয়ারে একটা লা*থি দিয়ে হনহন করে উপরে নিজের ঘরে চলে যায় তূর্য। ইলমা তাকে আটকাতে চাইলেই ইরশাদ তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে ওঠে,
_”এখন আটকাচ্ছো কেন? সকাল সকাল দিলে তো মাথাটা গরম করে, তোমার জন্য ছেলেটা না খেয়েই চলে গেলো। সত্যিই,প্রতিটা বিষয়ে ঝামেলা না করতে পারলে তোমার পেটের ভাত হজম হয়না।”

ইরশাদ ও চলে গেলেন নিজের ঘরে, আর ইলমা সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। সে তো এত কিছু ভেবে কথাটা বলেনি। নিজের বান্ধবীর মেয়ের কথাই বলতে চেয়েছিল, তাদের পারিবারিক অবস্থা ভালো না হলেও মেয়েটা যে অনেক নম্র,ভদ্র তা ইলমা আগে থেকেই জানে। মেয়েটাকে তার বেশ পছন্দ, একটা ভুল সিদ্ধান্তের জন্যই তার জীবনে দুঃখের পাহাড় নেমে এসেছে,তবে এতে তো মেয়েটার কোনো দোষ নেই।

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ইলমা, বুঝতে পারে তারই ভুল হয়েছে। ছেলের রাগ সম্পর্কে ভালোই ধারণা আছে তার, তাও যে কেন বলতে গেলো কথাটা! প্লেটের দিকে তাকিয়ে দেখলো তূর্য তেমন কিছুই খায়নি।
রান্নাঘরে গিয়ে তূর্যর জন্য নতুন করে স্যান্ডউইচ বানালেন ইলমা। সঙ্গে এক গ্লাস জুস নিয়ে পা বাড়ালেন তূর্যর ঘরের দিকে, ছেলেকে তো আর না খেয়ে থাকতে দিতে পারেননা।

_____
সদ্য গোসল করে হলুদ রঙের সেলোয়ার কামিজ পড়ে চুল মুছতে মুছতে বাথরুম থেকে বেড়িয়ে এলো মৌরিন। বিছানায় তার মা মারুফা বসে ছিলেন, চোখেমুখে তার চিন্তার ছাপ। মৌরিনকে বের হতে দেখেই উঠে দাড়ালেন তিনি।

_”বাড়িওয়ালা এসে আরো একমাস এর ভাড়া এডভান্স দিতে বলে গেছে।”

সাদা রঙের তোয়ালে টা চেয়ারের উপর রেখে মৌরিন ভ্রুকুঞ্চিত করে বলে,
_”মানে? একমাসের এডভান্স তো দেওয়া হয়েছে। উনি তো তাই বলেছিলেন।”

_”এখন এসে বলে গেলো আরো একমাসের ভাড়া এডভান্স দিতে হবে, এটাই নাকি নিয়ম।”

_”এমন নতুন নতুন নিয়ম বানালে তো চলবে না তাইনা।”

মারুফা হতাশ হয়ে বলে,
_”কি করবি তাহলে? ছেড়ে দিবি বাড়িটা?”

মৌরিন ড্রেসিং টেবিলের আয়নার দিকে তাকিয়ে চুল আছড়াতে নিয়ে বলে,
_”কি করে ছাড়ি বলোতো? সবে এক সপ্তাহ হলো উঠলাম। একেতো এক মাসের এডভান্স করা তার উপর এই সময়ে নতুন বাসা কোথায় পাবো? আমি একবার কথা বলবো বাড়িওয়ালার সাথে, তারপর বেশি কথা বাড়ালে তো দিতেই হবে টাকাটা।”

চুপ করে রইলেন মারুফা, মৌরিনের পিছনে এসে ক্ষীণ বলে,
_”কোনো টিউশন জোগাড় করতে পারলি?”

মৌরিন চিরুনিটা ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে মায়ের দিকে ঘুড়ে বলে,
_”কি করে পাবো,এই শহরে তো আমায় তেমন কেউ চেনেনা মা। না জেনে একটা মেয়েকে কেনই বা পড়াতে নিবে! তবুও আমি বলে রেখেছি কয়েকজন কে, দেখি ম্যানেজ করতে পারি কিনা।”

নিজের সাদা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছলেন মারুফা। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
_”তোর বাবার জন্য তোকে আজ কত কষ্টই না করতে হচ্ছে।”

বিরক্ত হয় মৌরিন, মারুফার দু কাধে হাত রেখে বলে,
_”প্লিজ মা,আমার ভালো লাগেনা এসব কথা শুনতে। যা আছে খেতে দাও এখন, ভার্সিটির এক ফ্রেন্ড এর বড়ভাই আছে। খুব ভালো মানুষ, দেখা করতে বললো আমায়। গিয়ে দেখি, কোনো কাজ জোগাড় করে দিতে পারেন কিনা।”

মারুফা আবারো নিজের চোখ মুছে বললেন,
_”কালকের ডিম আলুর তরকারি আছে, খেয়ে নিবি আয়।”

_”তুমি খেয়েছো তো?”

নজর নামিয়ে রাখলেন মারুফা, মৌরিন যা বোঝার বুঝে গিয়ে বললো,
_”বুঝেছি, চলো একসাথে খাবো।”

দুই রুমের বাসা, বাড়িটা বেশ পুড়নো। বড় খাট পাতানো ঘর থেকে বেড়িয়ে সামনের ঘড়ের ছোট খাটে বসলেন মারুফা। মৌরিন রান্নাঘরে গিয়ে দুটো প্লেটে খাবার নিতে লাগলো, মারুফা তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। এত মনের জোড় মেয়েটা কার থেকে পেলো তাই বুঝে উঠতে পারেন না তিনি।

____
তূর্যর ঘরের সামনে এসে দাড়ালেন ইলমা, দড়জাটা আটকানো। দু হাতে ধরে রাখা ট্রে টা একহাতে নিয়ে দড়জায় নক করলেন ইলমা। অনেক সময় দাঁড়িয়ে থাকার পর দড়জা খুললো তূর্য, তবে দড়জা খুলেই বিছানায় গিয়ে বসে পড়লো সে। বোঝাই যাচ্ছে মায়ের উপর রেগে আছে।

ইলমা ভিতরে প্রবেশ করে খাবারের ট্রে টা টেবিলের উপর রাখলেন। এরপর তূর্যর পাশে বসে বললেন,
_”খাবারের উপর রাগ দেখাতে নেই বাবা, খেয়ে নে।”

_”খাবোনা আমি,নিয়ে যাও ওটা।”

_”মায়ের উপর রাগ করে থাকেনা তূর্য, আমি কি কখনো তোর খারাপ চাইতে পারি বল?”

তূর্য বিরক্তির সঙ্গে চোখ বন্ধ করে বললো,
_”এখন তোমার ইমোশনাল কথার ঝুলি খুলে বসবে না প্লিজ”

_”কিন্তু খাবারটাতো খেয়ে নে। আচ্ছা বেশ, তুই বল তোর কেমন মেয়ে চাই। আমি তেমন মেয়ের সঙ্গেই তোর বিয়ে দেবো।”

তূর্য বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
_”তার কোনো দরকার নেই,তুমি আর আমার জন্য মেয়ে দেখার কথা মাথাতেই এনোনা।”

মনে মনে কষ্ট পেলেও তা প্রকাশ করলোনা ইলমা,উঠে দাঁড়িয়ে সামান্য হেসে বললো,
_”বেশ, তুই যাকে পছন্দ করবি তার সঙ্গেই বিয়ে হবে তোর। আর রাগ করিস না বাবা,খাবার টা খেয়ে নে।”

তূর্য বুকে হাত গুঁজে বলে,
_”তুমি যাও,খেয়ে নেবো আমি।”

প্রতিত্তরে কোনো কথা বললো না ইলমা। হালকা মাথা নাড়িয়ে চলে গেলেন ঘর থেকে। ইলমা চলে যাওয়ার পর দড়জা আটকে ট্রে থেকে একটা স্যান্ডউইচ হাতে নিয়ে বিছানায় বসে পড়লো তূর্য। বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে সে, ছোটবেলা থেকেই ভীষণ আদরে বড় হয়েছে। মায়ের থেকেও বাবা তাকে বেশি মাথায় তুলে রেখেছে, যখন যা চেয়েছে তাই এনে দিয়েছে।
পড়াশোনায় বরাবরেই ভালো ছিল তূর্য,চাইলেই কোনো বড় চাকড়ি কিংবা বিজনেস করতে পারতো। তবে তার ইচ্ছে ছিলো মিডিয়া জগতে আসার, অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ তার ছোট বেলা থেকেই। অনেক জনপ্রিয়তা অর্জন করতে চেয়েছিল তূর্য,নিজের ইচ্ছে পূরণ করতেও খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি তাকে। অল্প কিছু নাটকের কাজের মাধ্যমেই ব্যাপক দর্শক জনপ্রিয়তা লাভ করে সে, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মানুষ তাকে পছন্দ করেছে,তার অভিনয়ের প্রশংসা করেছে। আর এই সাফল্য তূর্যকে আরো বেশি অহংকারী করে তোলে। তার একটাই লক্ষ্য, সবার উপরে থাকতে হবে।

হাতে থাকা স্যান্ডউইচ এ কামড় দিয়ে তূর্য মনেমনে বলে,
_”আমার পছন্দের মেয়ে তুমি খুজতে পারবেনা মা। তাকে হতে হবে সবার চেয়ে সুন্দর,আমার পাশে যেমনটা মানায়। সবাই যেন হিংসে করে তাকে দেখে..আই জাস্ট ওয়ান্ট মোর এন্ড মোর পপুলারিটি।”

____
রিক্সা থেকে নেমে আশেপাশে তাকালো মৌরিন। পরনে তার হলুদ রঙের সেলোয়ার কামিজ, লম্বা চুলের বিনুনিটা একপাশে এনে রাখা। সাজের মধ্যে কেবল কপালে একটা ছোট্ট কালো রঙের টিপ,এটা তার জন্য ম্যান্ডেটরি।
বান্ধবী রিমির ভাই রাতুল এর বলা ঠিকানাতেই এসেছে সে। রাতুলের সঙ্গে এর আগে কখনো দেখা হয়নি তার। রাস্তার ওপারে সোজাসুজি চায়ের দোকানে বসে থাকা একজন লোককে দেখে অনেকটা রাতুলের মতোই মনে হলো, তাই দেখেশুনে রাস্তা পার হয়ে চায়ের দোকানের সামনে এলো মৌরিন। সেই লোকটির সামনে এসে জিজ্ঞেস করলো,
_”আসসালামু আলাইকুম, আপনি রাতুল ভাইয়া না?”

#চলবে?