এক ফালি সুখ পর্ব-২৯

0
72

#এক_ফালি_সুখ🌼 |২৯|
#তাসনিম_জাহান_মৌরিন
অপর পাশ থেকে কোনো সাড়া পেলোনা তূর্য। সেদিকে খেয়াল না করেই মৌরিন এর পিছনে ছুটলো তূর্য। অপরাধীর সুরে বলতে লাগলো,
_”আমি নিজের মধ্যে ছিলাম না মৌরিন,ট্রাই টু আন্ডার্সট্যান্ড। এভাবে চলে যেওনা প্লিজ।”

থামেনা মৌরিন,সে আরো দ্রুতগতিতে পা বাড়ায়। তূর্য কিছুটা উচ্চস্বরে বলে,
_”স্টপ মৌরিন, ইউ হ্যাভ টু আন্ডার্সট্যান্ড মাই ফিলিংস।”

স্থির হয় মৌরিন। লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে পিছন ঘুরে বলে,
_”আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু আন্ডার্সট্যান্ড এনিথিং।”

এগিয়ে আসে তূর্য। কপাল সঙ্কুচিত করে বলে,
_”কিন্তু কেন? আমি নিজের চেঞ্জ দেখতে পারছি আর তুমি দেখতে পারছো না?”

মৌরিন সামান্য ঢোক গিলে কয়ে সেকেন্ড পর বলে,
_”বললাম তো,আমি কিছু দেখতে চাইছিই না।”

অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তূর্য। মৌরিন অন্যদিকে ঘুরে পা বাড়ায় কয়েক কদম, পুনরায় ঘাড় ঘুরিয়ে বলে,
_”কাজের জায়গা ব্যতীত আমার সামনে না এলে খুশি হবো।”

সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো তূর্য। এতক্ষনে বৃষ্টির বেগ অনেকটা বেড়েছে, যা ভিজিয়ে দিচ্ছে দুজনকেই। মৌরিন হাটা শুরু করলো নিজের পথে। তূর্য সেখান থেকেই উচ্চস্বরে বলে উঠলো,
_”তুমি এতো পাষাণ কেন মৌরিফুল? কেন এই ঝুম বৃষ্টিও তোমার অন্তর শীতল করতে পারছে না?”

কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি কতৃক কোনো উত্তর পেলোনা তূর্য, ধীরে ধীরে অন্ধকার এ মিলিয়ে গেলো সে। হতাশা সঙ্গী হলো তূর্যের, মাথাটা এমনিতেও ঝিমঝিম করছে। সচরাচর ড্রিংক করেনা সে, আজ বন্ধুদের সঙ্গে মিলে অল্পস্বল্প খেয়েছিল। নেশা খুব একটা হয়নি, তবে জড়তা কেটেছে অনেকটা। তাইজন্যই মৌরিনের সম্মুখে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পেরেছে, সম্মানে লাগেনি তার। নইলে কথাগুলো কবে বলতে পারতো জানা নেই। ফিরে এসে গাড়িতে বসলো তূর্য,এখানে দাঁড়িয়ে থেকে তো আর লাভ নেই। বেশ ভালোই বুঝতে পারলো, মৌরিন এত সহজে দূর্বল হয়ে পরার মতো মেয়ে নয়। তাকে দূর্বল করতেও চায়না তূর্য, তার এই কঠিনতার ই সঙ্গী হতে চায় কেবল। এটা কি মৌরিন বুঝতে পারছে না?

________
‘সোশাল মিডিয়ায় ঘুরপাক খাচ্ছে কিছু ছবি, আজকের ট্রেন্ডিং এ থাকা ছবি এগুলোকেই বলা চলে। হবে নাই বা কেন? ছোট পর্দার জনপ্রিয় অভিনেতা ইলহাম আবসার তূর্য কিনা একটা মেয়ের সঙ্গে? তাও আবার এতটা কাছাকাছি? কে এই মেয়ে? তিনি কি তূর্যের গার্লফ্রেন্ড? তূর্য কি তাকে লুকিয়ে রেখেছেন সকলের থেকে? সবকিছু জানতে হলে আমাদের সঙ্গেই থাকুন।”

ভিডিওটা অফ করলো মৌরিন। সে বরাবরের মতোই শান্ত আজও। যেন সে জানতো,এমন কিছু ঘটবে। যেই ছবিগুলো সকলের নিউজফিড এ ঘুরছে সেগুলো আর কারোর নয়, বরং তূর্য আর মৌরিন এর গতকাল রাতের ছবি, যেখানে তারা খুবই কাছাকাছি অবস্থান করছে। যে কেউ দেখে ভেবেই নেবে তাদের মধ্যকার সম্পর্কের নাম।

ছবিগুলো আজ সকাল থেকেই সোশাল মিডিয়ায় ঘুড়ছে। অবাক হয়নি মৌরিন, সে কাল রাত থেকেই জানতো সকালে এমন কিছুই হতে চলেছে।
গতকাল রাতে বাড়ি ফেরার পথেই মৌরিনের দেখা হয় আরাফের সঙ্গে, তার চোখেমুখে ছিলো খুশির ঝলক। যেন প্রতিশোধ নেওয়ার একটা সুযোগ পেয়েছে সে। তবুও শেষ একটা সুযোগ দিতে চেয়েছিল মৌরিন কে। তবে মৌরিনের মাঝে কোনো ভয় লক্ষ্য করলোনা আরাফ, ছবিগুলো মৌরিনকে দেখানোর পরও তার মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া এলোনা। কেবল একটা কথাই বললো, “যা খুশি তাই করতে পারো”।

মূলত মৌরিনের মনে সমাজ নিয়ে কোনো ভয়ই নেই। সর্বোচ্চ কি হবে? মানুষ ওকে রাস্তায় দেখে মিটিমিটি হাসবে? হাজারটা প্রশ্ন করবে? এই তো, মাসখানেক বাদে সবাই সবকিছু ভুলেও যাবে। এভাবেই তো চলছে। আর বাকি রইলো আত্মীয়রা কি বলবে? যার আত্মীয় বলতেই কিছু নেই তার আবার সেই ভয় কিসের? আপনজন বলতে কেবল মারুফাকেই চেনে মৌরিন।

নিজের কাধে হাতের স্পর্ষ পেতেই পিছনে ঘুরে তাকায় মৌরিন,মারুফাই দাঁড়িয়ে আছে,মাথায় তার নামাজের হিজাব। পাশে সরে গিয়ে মারুফাকে বসার জায়গা করে দেয় মৌরিন। মারুফা বসেন সেখানে, বেশ কিছুক্ষন চুপ থেকে বলেন,
_”ছেলেটাকে পছন্দ করিস তুই?”

_”আমি তোমার থেকে কখনো কিছু লুকিয়েছি মা?”

শান্ত স্বরেই কথাটা বলে মৌরিন। মারুফা মাথা নাড়িয়ে না সূচক মত প্রকাশ করে। মৌরিন নিজ অবস্থানে স্থির থেকে বলে,
_”তাহলে আজ কেনো লুকোবো? আর তোমার প্রশ্ন? তার উত্তরে আমি একশব্দে চাইলেই ‘না’ বলে দিতে পারি। সেটা বলছি না। কারণ সেটা বলতে হবে আমার মনের বিরুদ্ধে গিয়ে, যা আমি তোমায় কখনো বলিনি। বলবোও না ইনশাল্লাহ। আসলে বিষয়টা কি জানোতো মা, মানুষের মনটাই বড্ড খারাপ। যতই তাকে একপথে স্থির রাখতে চাইনা কেন,সে ঠিকই অন্যপথে হাটতে চাইবে। আমার ক্ষেত্রেও হচ্ছে ঠিক তেমনটাই। মন বলছে নিজেকে একটা সুযোগ দিতে। তবে তোমার মেয়ে বোকা নয় মা, মন যে বারেবারে নিজের মত বদলায় তা আমি জানি। তাই সেই বোকামি টা আমি করবোনা, মনের উপরে আমি মস্তিষ্ক কে প্রাধান্য দিতে ভালোবাসি। তবে দু একসময় চিন্তাশক্তি হ্রাস পায়, যেমনটা বলতে পারো কাল হয়েছিল। আমি চাইলেই তূর্যকে সরিয়ে দিতে পারতাম আগে থেকেই, পারছিলাম না। ঐযে বলে না, দুজন ছেলে মেয়ে একসাথে থাকলে তাদের মাঝে শ’য়’তা’ন থাকবেই। আর সেই শ’য়’তা’ন আমার পিছনেই পরে আছে, তবে তাকে আমি জিততে দেবোনা। মন আর মস্তিষ্কের খেলায় আমি মস্তিষ্ক কেই বিজয়ী করবো। না তাকে হারতে দেবো, আর না’ই আমি নিজে হেরে যাবো।”

কথাটা বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মৌরিন, জড়িয়ে ধরে মারুফাকে। চোখ বন্ধ করে থাকে অনেকক্ষণ। এই বিষাদের জীবনে একটু সুখ চাই তার। মানুষ নাটক সিনেমায় যতই বলুক না কেন,”তোমার মাঝে আমি নিজের সুখ খুজে পাই”, সেই কথায় বাস্তবে বিশ্বাস করেনা মৌরিন। নিজের সুখ নিজেকেই অর্জন করে নিতে হয়, হয়তো তার মাঝে কিছু অংশ একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তির মাঝে নিমজ্জিত থাকতে পারে। তবে অধিকাংশই থাকে নিজের মাঝে, নিজের মাঝেই নিজের সুখ খুজে পাওয়া যায়,খুজে নিতে হয়।

______
আরো একমাস কেটে গেলো। রাতুল আর তন্নির মধ্যকার সম্পর্কের ও উন্নতি হয়েছে অনেকটা,এখন শুধু তন্নি নয় বরং রাতুলও অনেকটা কেয়ারিং হয়ে উঠেছে। মুখে তেমন কিছু না বললেও কাজের মাধ্যমে দুজনেই প্রকাশ করছে নিজ নিজ অনুভূতি। কিছু কিছু সম্পর্ক খুবই সুন্দর হয়, কোনো ঝামেলা থাকেনা, থাকেনা কোনো বিদ্বেষ। ধীর গতিতে তাদের সম্পর্কের সূচনা ঘটতে থাকে। দুজনকে পাশাপাশি বেশ মানায়,মৌরিনের ও খুব ভালোলাগে ওদের একসঙ্গে দেখতে।

বাসে জানালার পাশের সিটে বসে আছে মৌরিন,সিলেট যাচ্ছে প্রায় তিনমাস পর। তাও শুটিং এর কাজেই। রাতুল,তূর্য আর অন্য এক নায়িকা, সঙ্গে বাকি সহকর্মীরাও যাচ্ছে। মৌরিন এর ধারণা ঠিকই ছিলো, পনেরো বিশদিন ছবিগুলো নিয়ে অনেক মাতামাতি হলেও বর্তমানে তার কথা কারো তেমন একটা মনেও নেই। তূর্যের সঙ্গে সেদিনের পর এই প্রথম শুটিং এর কাজে দেখা হচ্ছে। নিজেকে সামলে নিয়েছে মৌরিন, সঙ্গে নিজের অনুভূতিগুলোকেও।
তূর্য থেমে থাকেনি,আজও থেমে নেই। প্রতিনিয়ত মৌরিন এর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে সে,তবে সে ব্যার্থ হয়েছে প্রতিবারে। মৌরিন খুবই শান্তভাবে এড়িয়ে গেছে তাকে।

বাস থামলো চা বাগানের সামনে এসে, এখানেই শুটিং হবে আজ। নামলো সকলেই, শুটিং এর জন্য সবকিছু গোছানো হলো। ঘণ্টাখানেক এর মাঝে শুটিং ও শুরু হলো।
মৌরিন এখন ফ্রি, আশেপাশে তাকিয়ে দেখছে। কত পরিচিত সবকিছু। তবে এই জড় পদার্থগুলোর মাঝে দেখা মিললো এক পরিচিত ব্যক্তির। অবাক হয়নি মৌরিন,তবে বিরক্ত হলো কিঞ্চিত। যার সম্মুখীন হতে চায়নি, সে’ই কিনা সামনে চলে এলো!

#চলবে?