#এক_বরষায় [১১]
লেখনীতে_জেরিন আক্তার নিপা
-আপনি কেন আমার পিছু ছাড়ছেন না নয়ন ভাই? কেন রোজ রোজ আমাকে বিরক্ত করেন? আমার এসব ভালো লাগে না। আপনি কেন বুঝতে চান না আমি আপনাকে পছন্দ করি না। আপনি যা চান তা কোনোদিনও সম্ভব না। আমি তো কোনোদিনও আপনাকে বলিনি আমি আপনাকে পছন্দ করি। বা কোনোদিন তো এমন কোন ইঙ্গিতও দেইনি যে আপনার উপর আমার দুর্বলতা আছে। নয়ন ভাই বাস্তবতা মেনে নিন। আপনার উপর আমার সামান্যতম দুর্বলতাও নেই। আপনি শুধু শুধু আপনার সময় নষ্ট করছেন। আমি আপনাকে কোনোদিনও ভালোবাসতে পারব না৷ আপনাকে আমি বিয়েও করব না।’
ধারার নিষ্ঠুরতায় নয়নের চোখ টলমল করছে। ওর তীক্ষ্ণ কথার আঘাতে বুকটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। মেয়ে জাতি নাকি মায়াবতী হয়। ওদের অন্তর দয়ামায়া দিয়ে পরিপূর্ণ থাকে। কথাটা সম্পূর্ণ ভুল। অন্তত ধারাকে দেখে নয়নের এটাই মনে হচ্ছে। কিছু মেয়েদের মনে কোন দয়ামায়া থাকে না। আরে মন থাকলে তো দয়া মায়া থাকবে। ধারা এই কথাগুলো এত নিষ্ঠুরভাবে বলতে পারল!
-আমি জানি নয়ন ভাই আপনি আমার কথায় কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু নয়ন ভাই এই কথাগুলো তো সত্যি। আমি যদি আগেই আপনাকে এই কথাগুলো না বলি তাহলে পরে গিয়ে আপনি আরও কষ্ট পাবেন। আপনার জন্য সবকিছু আরও কঠিন হয়ে যাবে। ভবিষ্যতের সেই কষ্ট থেকে বাঁচাতেই আপনার সাথে এখন আমার কঠিন হতে হচ্ছে। আপনার দিক থেকে যা কিছু আছে তা শুধুই একতরফা। আমার দিক থেকে তেমন কিচ্ছু নেই বিশ্বাস করেন। তাই আপনার জন্য এটাই ভালো হবে আপনি এই অনুভূতি গুলোকে আঁকড়ে ধরে থাকবেন না। প্লিজ নয়ন ভাই, আমার কথা বোঝার চেষ্টা করুন।’
নয়ন ধারার দিকে তাকাতে পারছে না। ধারার সামনে তার চোখ থেকে পানি পড়লে ভীষণ লজ্জা পাবে সে। তার কান্না দেখেও ধারার মন নরম হবে না।
-আমি এখন যাই নয়ন ভাই। আমার জন্য আপনি কষ্ট পেলে আমি নিজের কাছেই অপরাধী হয়ে যাব, জানেন তো?’
ধারা চলে যাচ্ছে। নয়ন অশ্রুসক্ত চোখে ধারার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। নয়ন সবসময়ই জানতো ধারা কোনোদিনও তাকে ভালোবাসবে না। এই দিনটা যে একদিন আসবে নয়ন এটাও জানতো। কিন্তু তার যে এতটা কষ্ট হবে তা জানতো না। এমন কষ্ট কোনোদিনও হয়নি তার। বাবা যেদিন মারা গেছে সেদিনই শেষ বার কেঁদেছিল সে। তারপর আর কাঁদেনি। আজ কেন তাহলে চোখ দিয়ে পানি পড়ছে? ধারাকে কি একেবারেই হারিয়ে ফেলল সে?
ধারাকে সে পাবে না এটা জানলেও ক্ষীণ একটা আশা ছিল যে, না হয়তো কোনোদিন ধারার মন গলবে। তার উপর দয়া হবে। আজ তো সেই আশা টাও শেষ হয়ে গেল।
নয়ন কাঁদছে। কিন্তু ওর কান্না শব্দহীন। দু-চোখ দিয়ে উষ্ণ অশ্রু ধারা গড়িয়ে পড়ছে শুধু। মুনতাসীর কলেজে যাচ্ছে। মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছেলেটাকে কাঁদতে দেখে খানিকটা বিস্মিত হলো সে। দাঁড়াবে নাকি চলে যাবে ভাবছে। পুরুষের কান্না মেয়েদের মতো হয় না। মেয়েরা সবার সামনেই কাঁদতে পারে। কিন্তু একজন পুরুষ তা পারে না। অন্য কেউ তার অশ্রু দেখা লজ্জার৷ মুনতাসীর দাঁড়াল না। একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে হাঁটতে লাগল সে।
*****
বাড়ি ফেরার সময় ধারা আর নয়নকে ওই দোকানটার সামনে দেখতে পেলো না। ধারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যাক নয়ন ভাই তার কথা বুঝেছে। নয়ন ভাই তার পেছনে চারটা বছর নষ্ট করেছে। এর আগেও ধারা অনেকবার বলেছে। কিন্তু নয়ন ভাই তার কথা শুনেনি। পড়াশোনা সে আগেই ছেড়েছিল। তারপরও চাইলে কোন কাজটাজ জোটাতে পারত। কিন্তু নয়ন ভাই চাকরির সন্ধান না করে তার পেছনে ঘুরেছে। একবার আসতে, একবার যেতে সারাটাদিন এই দোকানে বসেই কাটিয়েছে। এভাবে কি কারো জীবন চলে? নয়ন ভাই বেকার হলেও ভালো ছেলে। পাড়ার কেউ তাকে খারাপ বলতে পারবে না। পাড়ার কারো কোন প্রয়োজনে সবসময় নয়ন ভাইকে পাওয়া যায়। কিন্তু তাই বলে ধারা কোনোদিনও নয়ন ভাইকে নিয়ে অন্য কিছু ভাবতে পারেনি। ভবিষ্যতেও পারবে না।
-আজকের কথাগুলো হয়তো একটু বেশিই কঠোর ছিল। কিন্তু আপনার ভালোর জন্যই আমাকে নির্দয় হতে হয়েছে। আমি দোয়া করি আপনার জীবনে এমন কেউ আসুক যে আপনাকে আপনার থেকেও বেশি ভালোবাসবে। সেই মানুষটার সাথে আপনি সুখী হবেন নয়ন ভাই।’
****
সন্ধ্যার একটু আগে জেসমিন কোথায় থেকে এসে গেটের বাইরে থেকেই ধারাকে ডাকতে লাগল। ধারা তখন রান্নাঘরে। জেসমিন অসহিষ্ণু কন্ঠে তাকে ডেকে যাচ্ছে। এই মেয়েকে নিয়ে পারে না ধারা। আবার কী হলো এর? ধারা কিছুটা রেগে গিয়েই বাইরে বেরিয়ে এলো।
-কী হয়েছে তোর? আজও যদি ফালতু কোন কথা শোনার জন্য আমাকে এভাবে ডেকে থাকিস তাহলে তোর গালে গরম খুন্তির ছ্যাকা দিয়ে দেব আমি।’
-আপু, আপু নয়ন ভাইকে দেখেছিস তুই? নয়ন ভাইকে নাকি কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। সকালে বেরিয়েছে। নয়ন ভাইয়ের চামচা দু’টা বলছে, নয়ন ভাই নাকি কোনকিছু নিয়ে অনেক কেঁদেছে। আর বলছিল ওর সব শেষ। তার পরে যে কই গেল আর কোন খোঁজ নেই। রাসেল পারভেজ সারাদিন খুঁজেছে ওকে। রোজী আপা ভীষণ কান্না করছে।’
ধারার বুকটা কেঁপে উঠল। সকালে সে যা বলেছে তার জন্যই কি নয়ন ভাই এখন নিখোঁজ? মুনতাসীর ঘরেই ছিল। জেসমিনের কথা শুনেছে সে। সকালে নয়নকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদতে দেখেছে। তখন কিছু জিজ্ঞেস করেনি সে। কেন যে ছেলেটাকে একা ছেড়ে দিল তখন! মুনতাসীর বেরিয়ে এসেছে। ধারা পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুনতাসীর পরিস্থিতি আরও উত্তেজিত হতে না দিয়ে বলল,
-নয়ন হয়তো কোন বন্ধুর বাড়িতে গেছে জেসমিন। এখনও তো তেমন রাত হয়নি। মাত্র সন্ধ্যা হলো। ফিরে আসবে ও। ওর বাড়ির লোককে না করো এত টেনশন করতে।’
-আপনি বুঝতে পারছেন না মুনতাসীর ভাই। আজ নয়ন ভাইয়ের বোন রোজী আপনাকে দেখতে আসার কথা ছিল। নয়ন ভাই-ই সব ঠিক করেছিল। আজ সে বাড়ি না এসে বন্ধুর বাড়ি যাবে এমনটা হতেই পারে না।’
-হয়তো কোন কাজে কোথাও গিয়ে আটকে পড়েছে। এত চিন্তা করার তো কিছু নেই।’
-কাজে আটকে পড়লে নিশ্চয় ফোন করে জানাতো। ফোনও তো ধরছে না। আর ওই পারভেজ যে বলল নয়ন ভাই নাকি কাঁদছিল আর কীসব যেন বলছিল। ওরা ভেবেছিল রোজী আপার বিয়ের কথা ভেবেই হয়তো কাঁদছে। আপনারা কেউই বুঝতে পারছেন না। নয়ন ভাইয়ের সাথে কিছু হয়েছে। আমার মন বলছে খারাপ কিছু ঘটেছে।’
ধারা আর চুপ থাকতে পারল না। কারণ সে জানে নয়ন ভাই আজ কতটা কষ্ট পেয়েছে। ভেতরে ভেতরে ভেঙে গেছে মানুষটা। ধারা নয়ন ভাইদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়ে বলল,
-চল জেসমিন। আমিও নয়ন ভাইদের বাড়িতে যাব।’
মুনতাসীর ধারাকে দেখল। নয়নের জন্য ওকে এতটা বিচলিত হতে দেখে কিছু ভাবল। সকালে ধারাই কি নয়নকে এমন কিছু বলেছে যার জন্য নয়ন নিরুদ্দেশ হয়েছে! মেয়েটার কথার যা তেজ! সেদিন সামান্য বাজার আনা নিয়ে তাকেও কথা শোনাতে ছাড়ল না।
****
রাত দশটার পর পাড়ার কেউ কেউ পুলিশে খবর দেওয়ার জন্য বলল। রোজী আপা ভাইয়ের কথা ভেবে কেঁদেই চলছে। এসবের জন্য ধারার নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। কী দরকার ছিল নয়ন ভাইকে ওই কথাগুলো এত কঠিন ভাবে শোনানোর। তার পেছনে ঘুরছে ঘুরুক না। এতে তার কি? লোকটার ভালো করতে গিয়ে খারাপই করে ফেলল। নয়ন ভাই উলটাপালটা কিছু না করে বসলেই হয়। চার বছরের জমানো অনুভূতি এক সেকেন্ড তছনছ করে দিয়েছে ধারা। ধাক্কাটা যে সহ্য করতে পারবে না তা কে জানতো?
কাউকে পুলিশের কাছে যেতে হলো না। এক পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে নয়ন নিজেই বাড়ি ফিরল। বাড়ির সামনে এত মানুষ দেখে নিজেও কিছুটা অবাক হলো। বাড়িতে কার কী হয়েছে? আজ তো আপাকে দেখতে আসার কথা ছিল। ওরা হয়তো কখনই চলে গেছে। তাহলে এত মানুষ কেন?
নয়ন হাফ ভাঙা পা নিয়েই দ্রুত হাঁটতে লাগল। ওকে দেখে সবাই হৈচৈ করে উঠলো।
-নয়ন ফিরে এসেছে। নয়ন এসেছে। ওর কিছু হয়নি।’
নয়নের পায়ে ব্যান্ডেজ দেখে কারো বুঝতে বাকি রইল না ওর সাথে কী ঘটেছে। অ্যাক্সিডেন্ট করেছে বেচারা। রোজী আপা কাঁদতে কাঁদতে ভাইয়ের গালে চড় থাপ্পড় দিতে লাগল। সবার থেকে সব শুনে নয়ন হেসে ফেলে বলল,
-আমাকে নিয়ে এই গুজব কে ছড়িয়েছে তোমাদের মাঝে?’
জেসমিন কাঁদো কাঁদো গলায় ফট করে বলে উঠল,
-কে আবার? তোমার ওই চামচা। তুমি নাকি সকালে অনেক কাঁদছিলে। আর কী হারিয়ে গেছে, শেষ হয়ে গেছে বলছিলে।’
এই কথা শুনে নয়নের মুখ থেকে হাসি চলে গেলেও কাউকে বুঝতে দিল না সে। ধারার দিকে এক নজর চেয়ে বলল,
-দূর পাগল! ওরা এসব বলল আর তোরা সবাই তা বিশ্বাস করে নিলি? আমি কেন কাঁদতে যাব? পারভেজ, রাসেল ওরা বানিয়ে বলেছে।’
নয়ন চোখ পাকিয়ে ওদের দিকে তাকালে পারভেজ রাসেল তর্ক না করে মাথা নামিয়ে নিল।
-গাধা দু’টোকে জিজ্ঞেস করো না কেন বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলল। বাজারে আমার অনেক দিনের পুরোনো একটা বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে গেছিল। ওর বোনের বিয়ে নাকি এ’দিকেই দিয়েছে। বন্ধু ওর বোনের বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য জোড়াজুড়ি শুরু করে দিল। আমি ভেবেছিলাম দুপুরের আগে চলে আসব। রাস্তায় অ্যাক্সিডেন্ট করলে তারপর কী হলো আমার আর মনে নেই। ও-ই মনে হয় আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছিল। আমার মোবাইলটাও ভেঙে গেছে তাই বাড়িতে খবর দেওয়ার উপায় ছিল না।’
ওর এই বানানো গল্প সবাই বিশ্বাস করে নিলেও তিনটা মানুষ বিশ্বাস করল না। একজন ধারা, সে জানে আজ কী হয়েছে। রোজীও তার ভাইটাকে রগে রগে চেনে। যত গুছিয়েই মিথ্যা বলুক বোনের কাছে সবসময় ধরা পড়েই যায়। মুনতাসীরও এই গল্প বিশ্বাস করতে পারল না কারণ সে সকালে নয়নকে কাঁদতে দেখেছে।
ধারা জেসমিনকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে চাইলে মুনতাসীরও ওদের সাথে এলো। আসার সময় জেসমিন কথা বলে যাচ্ছে।
-আপু তুমি কি কিছু বুঝতে পেরেছ নয়ন ভাইয়ের কি হয়েছে?’
-না।’
-তুমি জিজ্ঞেস করলে নয়ন ভাই বলবে ওর কী হয়েছে।’
ধারা কঠিন গলায় বলল,
-আমি কেন জিজ্ঞেস করব? কার কী হয়েছে এসব জানার আমার কোন আগ্রহ নেই।’
জেসমিন চুপ করে গেল। আপুটা কথায় কথায় এত রেগে যায় কেন? মুনতাসীর মনে মনে নয়নের জন্য আফসোস করে বলল,
-বেচারা! দুনিয়ায় এত মেয়ে থাকতে এই হৃদয়হীনার মায়ায় নিজেকে জড়ালো!’
চলবে_
#এক_বরষায় [১২]
লেখনীতে_জেরিন আক্তার নিপা
আজ জেসমিনের রেজাল্ট বেরিয়েছে। কোনোরকমে টেনেটুনে পাস করেছে। এত ভালো রেজাল্ট না হলেও জেসমিনের খুশি দেখে মনে হচ্ছে পুরো বোর্ডে সে প্রথম হয়েছে। অথচ এই রেজাল্ট নিয়ে জীবনে ভালো কিছু করতে পারবে না সে। বোনের খুশিতে ধারা গদগদ করতে পারছে না। তার এবং বিরক্ত লাগছে। জেসমিন খুশিতে নাচতে নাচতে বোনের সামনে এসে বলল,
-আতিইফাকে পাঠিয়ে একটু মিষ্টি আনা না আপু।’
-কোন খুশিতে?’
-আমি পাস করেছি। আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করেছে। এই খুশিতে মানুষকে একটু মিষ্টি মুখ করাবি না?’
-যে ঢঙের পাস করেছিস মিষ্টির কথা বলতে লজ্জা করছে না? রুমকিও তো তোর থেকে ভালো পয়েন্ট পেয়েছে। এই ল্যাডা মার্কা পয়েন্ট নিয়ে আবার মানুষকে মিষ্টি খাওয়াতে চায়।’
ধারার কথা শুনে জেসমিনের মুখের খুশির ঝলমলে ভাবটা চলে গেল। বোনের উপর চটে গিয়ে বলল,
-তুই মানুষ না জানিস। তুই, তুই একটা পাষাণ। জন্মের পর কেউ তোর মুখে একটু মধু দেয়নি। সেজন্য কথায় এত তিক্ততা। আমি দোয়া করি তোর জামাইটা যেন একটা খাটাশ হয়। খাটাশের সাথে সারাজীবন থাকবি। তখন মজা বুঝবি।’
ধারা হাসতে লাগল।
-আমার উপর রাগ ঝাড়তে না পেরে আমার জামাইয়ের উপর চলে গেলি! ওই খাটাশ তো তোর দুলাভাই হবে। তুই হবি খাটাশের একমাত্র শালি।’
ধারা আরও হাসতে লাগল। জেসমিন রেগে গিয়ে বলতে লাগল,
-তোর জামাই তোকে প্রতিদিন সকাল দুপুর রাত তিনবেলা পিটাবে। মার খেতে খেতে মরবি তুই। তোর কপালে একটা বুইড়া জামাই জুটবে। এত বড় ভুঁড়ি আর টাক মাথার বুড়োর সাথে বিয়ে হবে তোর। আমার বদদোয়া লাগবে দেখিস। গুনে গুনে বত্রিশটা দাঁত আমার। আমার বদদোয়া বিফলে যাবে না।’
জেসমিনকে আরও রাগিয়ে দিতে ধারা কোন কথা না বলে হেসেই যাচ্ছে। এর থেকে বেশি রাগা জেসমিনের পক্ষে সম্ভব না।
-দূর! ভাল্লাগে না। তোর মত একটা শাঁকচুন্নি যে কেন আমার বোন হলো।’
এই পাগলীর পাগলামি দেখে ধারা অনেকদিন পর মন খুলে হাসল। ধারা যে হাসতে পারে আর হাসলে ওকে কতটা সুন্দর দেখায় অন্য একজন তা আজ জানতে পারল। মুনতাসীর মুগ্ধ হয়ে ঘর থেকে ধারাকে দেখছে। সে ভেবেছিল ধারা হয়তো হাসতে জানে না। মেয়েটা এরকম কেন?
****
মুনতাসীর ভাড়া বাড়ি পেয়ে গেছে। তার এই বাড়ি থেকে চলে যাবার কথা শুনে জেসমিন আতিফ দু’জনই মন খারাপ করে বসে আছে। জেসমিন মানতেই রাজি না।
-আপনি কেন চলে যাবেন মুনতাসীর ভাই? আমাদের বাড়িতে থাকতে আপনার সমস্যা কি?’
-সমস্যা কিছু না। কিন্তু কথা তো এটাই ছিল আমি তোমাদের বাড়িতে কিছু দিন থাকব। সেই কিছুদিন এক মাসের উপরে হয়ে গেছে।’
-থাক। এক মাস কেন আপনি এক বছর থাকলেও আমাদের কোন সমস্যা নেই।’
-তা আমি জানি।’
আতিফ বলল,
-তাহলে থাকুন না মুনতাসীর ভাই। আপনি চলে গেলে আমাদের ভালো লাগবে না।’
মুনতাসীর ভালো ঝামেলায় পড়ে গেল। এই বাচ্চা দু’টা এভাবে তার মায়ায় পড়ে গেল কীভাবে?
এরা সহজে ওকে যেতে দিবে না বোঝা যাচ্ছে।
-আরে আমি তো বেশি দূরে যাচ্ছি না। মাঝে মাঝে তোমাদের দেখতে আসব। আর জেসমিনের সাথে তো কলেজে দেখা হবেই।’
জেসমিন ধরা গলায় বলল,
-তবুও আপনি যাবেন না। প্লিজ।’
******
-আপু মুনতাসীর ভাই চলে যাবে। শুনেছিস তুই?’
ধারা হাতের কাজ করতে করতে জবাব দিল,
-হুম।’
-তুই কিছু বলবি না?’
-কি বলব?’
-উনাকে যেতে নিষেধ করবি। বলবি এখানেই থেকে যেতে।’
-কেন?’
ধারার কথায় জেসমিন রেগে যাচ্ছে।
-মানুষটা এতদিন আমাদের সাথে থাকল এখন চলে গেলে খারাপ লাগবে না?’
-না। আমার তো বরং ভালোই লাগবে। আমার ঘর দখল করে বসে আছে। কতদিন নিজের ঘরে যাই না আমি।’
জেসমিন কেঁদে ফেলে বলল,
-তুই এত পাষাণ কেন আপু? তুই এমন কেন?’
ধারা কোন উত্তর দিল না। অন্যমনস্ক হয়ে কাজ করতে লাগল। কাউকে কিছুই করতে হলো না।
শরিফুল ইসলাম নিজেই বললেন,
-আর কয়েকদিন থেকে যাও। তুমি চলে গেলে আমার ছোট মেয়েটা কষ্ট পাবে। তোমার বাবা আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু ছিল। আমার উপর ওর অনেক দায় আছে।’
এই কথার পর আর মুনতাসীরের যাওয়া হলো না। সে থেকে গেল। এর মাঝে জেসমিনও কলেজে ভর্তি হয়ে গেছে। এখন রোজ সকালে মুনতাসীরের সাথে কলেজে যায় সে। রাতে আতিফ আর সে মুনতাসীরের কাছে প্রাইভেট পড়ে। পড়াশোনা নিয়ে ধারার আর ছোট বোনকে বকতে হয় না।
এর মাঝে একদিন বাড়িতে কেউ নেই। আতিফ, জেসমিন কোথায় কে জানে। দাদীর শরীর ভীষণ খারাপ করল। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল দাদীর। ধারা একা বাড়িতে। এখন ও কী করবে বুঝতে পারছে না। দাদীকে হাসপাতালে নিতে হবে। একা কীভাবে নিবে সে? ওই লোকটা কি বাড়িতে আছে? আজ তো কলেজ বন্ধ। ধারা কিচ্ছু ভাবল না। দৌড়ে মুনতাসীরের ঘরে চলে এলো। ঘরে ঢুকতে অনুমতি নিল না। ঘাড় ফিরিয়ে ওকে দেখে মুনতাসীর থমকালো। সে কি ধারাকেই দেখছে? ধারা অস্থির চিত্রে বলতে লাগল,
-দাদীর শরীর ভালো না। দাদীকে হাসপাতালে নিতে হবে। বাড়িতে কেউ নেই।’
ধারাকে আর কিছু বলতে হলো না। তার আগেই মুনতাসীর ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ধারাও পেছন পেছন গেল। মুনতাসীর দাদীকে কোলে করে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল। রাস্তায় বেরিয়েই রিকশা পেয়ে গেল। তিনজন এক রিকশায় উঠে পড়ল। মুনতাসীর লোকটাকে বলল,
-হাসপাতালে নিয়ে যান ভাই।’
আশেপাশে কী ঘটছে ধারা দেখছে না। তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে শুধু। দাদীর কিছু হলে ধারা একা হয়ে যাবে। দাদীই তার কাছে মায়ের মতন।
-দাদী কিছু হবে না তোমার। তুমি ঠিক হয়ে যাবে। ও দাদী, কথা বলো না। তোমার কিছু হবে না দেখো।’
মুনতাসীর ধারাকে দেখছে। ধারা নিজেকে যতটা কঠিন দেখায় আদতে কিন্তু সে ততটা কঠিন না। ধারাকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখে মুনতাসীর বুঝতে পারল, এই মেয়ে সবার থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখে। মুনতাসীর এটাও লক্ষ করল, ধারার একটা হাত তার হাতের উপরে। মেয়েটার হাত কাঁপছে।
*****
দাদীকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে শুনেই জেসমিন কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। আতিফকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটে এসেছে। আপুকে দেখেই কান্নার বেগ আরও বেড়ে গেল তার। ধারার বুকে পড়ে বলতে লাগল,
-দাদীর কী হয়েছে আপু? দাদী কেমন আছে? দাদীর কিছু হবে না তো। আমার ভয় করছে আপু। আমার ভীষণ ভয় করছে।’
ধারা বোনের মাথায় হাত রেখে বলল,
-ভয় পাস না। দাদী ভালো হয়ে যাবে। ডাক্তার বলেছে আজই বাড়ি নিয়ে যেতে পারব। কাঁদিস না।’
জেসমিন তবুও কান্না থামাতে পারছে না। বোনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই যাচ্ছে। সারাদিন ওরা হাসপাতালেই ছিল। রাতে দাদীকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে। মুনতাসীর এক মুহূর্তের জন্যও ওদের দুই বোনকে একা ছেড়ে কোথাও যায়নি। আতিফ রুটি কলা এনে দু’জনকে জোর করে খাইয়েছে।
ধারা বাড়ি ফিরে এখন ক্লান্তি অনুভব করছে। গোসল করে নিল সে। ঘরে এসে চুল মুছতে মুছতে ভাবল, লোকটাকে একটা ধন্যবাদও দেওয়া হয়নি। এতটা করেছে ওদের জন্য। আজ উনি না থাকলে ধারা একা কী করতো কে জানে? উনি ছিলেন বলেই দাদীকে হাসপাতালের নিয়ে যেতে পেরেছে।
****
মুনতাসীর ধারার দাদীর সাথে দেখা করতে এলো। এ ঘরে আগে আর কখনও আসেনি সে। দাদী এখন অনেকটা সুস্থ। ওকে দেখেই তিনি বিছানায় উঠে বসলেন। হাত বাড়িয়ে ওকে কাছে ডাকলেন। মুনতাসীর দাদীর পাশে একটা টুলে বসল। ধারাও তখন ঘরেই ছিল। ধারাকে আড়চোখে দেখল একবার।
-তুমি নজরুলের পোলা না? হায় আল্লাহ! দেখছো সেই দিনের পোলাডা কত বড় হইয়া গেছে! এখন তো জোয়ান বেডা হইয়া গেছো।’
মুনতাসীর দাদীর এসব কথায় লজ্জা পেল।
-এই পোলা আমারে চিনো না তুমি? আমাগো কথা তোমার মনে নাই?’
মুনতাসীর উত্তর দিল,
-চিনি দাদী।’
-চিনবা না কেন? আমরা যখন এখানে আসি তখন তো তুমি অনেক বড়। এই ধারা ওরে তুই চিনস না? ছোটবেলা তো মুনতাসীর ভাই মুনতাসীর ভাই কইয়া পাগল কইরা দিতি। ওর কথা তোর মনে নাই? এই মাইয়া সব ভুইলা গেল কেমনে!’
ধারা ঝট করে একবার মুনতাসীরের মুখের দিকে দেখল। এখন দাদীর এসব কথা বলা কি খুব জরুরি ছিল। তার চেনা না চেনাতে কার কী এসে যায়। জেসমিন কলেজে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে মুনতাসীরকে খুঁজতে খুঁজতে এই ঘরে চলে এলো।
-কে কাকে ভুলে গেছে দাদী? কার কথা বলছো তোমরা?’
-তোর বইনের কথা কই। ছোটবেলার কোন কথাই তো দেখি মনে নাই ওর।’
-আমারও তো মনে নেই। ছোটবেলার কথা মনে থাকে নাকি কারো।’
-তুই তো তখন অনেক ছোট আছিলি। তোর মনে না থাকারই কথা। কিন্তু ধারার তো ভুলবার কথা না।’
-কী ভুলেছে আপু সেটা তো বলবে।’
-এই পোলারে।’
ধারার ইচ্ছে করছে এই ঘর থেকে ছুটে পালিয়ে চলে যায়। সে লোকটার সামনে দাদীকে চুপ করতেও বলতে পারছে না। তাই জেসমিনকেই ধমক দিল,
-তোর কলেজের সময় হয়নি? এখানে এসেছিস গল্প শুনতে? এক্ষুনি কলেজে যা।’
-এখনও অনেক সময় আছে। আমি তো আজ তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে গেছি। প্রতিদিন আমার জন্য মুনতাসীর ভাইয়ের দেরি হয়।’
জেসমিন মুখ মুচড়ে বোনকে কথাগুলো শুনিয়ে দাদীর কাছে ফিরল।
-তুমি বলো দাদী। কী কথা বলছিলে তোমরা? আপু মুনতাসীর ভাইকে ভুলে যাবে কীভাবে? আপু কি উনাকে আগে চিনতো।’
দাদী গল্পে গল্পে জেসমিনকে বলে দিল ওরা যে আগে মুনতাসীরদের বাড়ির কাছে থাকতো। জেসমিন চোখ গোল গোল করে অবাক হয়ে বলল,
-এটা আমাদের স্থানীয় বাড়ি না! আমরা আগে অন্য কোথাও থাকতাম? এখানে কবে এসেছি? আর ওখান থেকেই বা কেন চলে এসেছি দাদী?’
-তোর বুড়া দাদা আইছে। আমার তো কোন ইচ্ছাই ছিল না।’
জেসমিন কৌতূহলী হয়ে বলল,
-আমরা কি ছোটবেলা মুনতাসীর ভাইদের সাথে থাকতাম? আমাদের বাড়ি কি পাশাপাশি ছিল?’
-হ।’
এটা শুনে জেসমিন উত্তেজিত হয়ে মুনতাসীরের হাত ধরে জিজ্ঞেস করতে লাগল,
-আপনি আমাকে চিনতেন? আমার কথা আপনার মনে আছে?’
মুনতাসীর হেসে বলল,
-আছে তো।’
-তাহলে তো আপুর কথাও আপনার মনে আছে।’
মুনতাসীর মনে মনে দীর্ঘশ্বাস চাপল। ধারার দিকে দেখে বলল,
-আছে।’
-ইশ! আমারই কিছু মনে নেই। আপনি আমাদের চিনেও বলেননি কেন মুনতাসীর ভাই। আমি যেচে গিয়ে ভাব করাতে কথা বললেন। আপনি তো আপুকে দেখে এমন ভাব করেন যেন আপুকে আপনি চিনেনই না। অথচ আপনি আগে থেকেই আমাদের চিনেন। আমরা বড় হয়ে গেছি বলে কি লজ্জা পেতেন?’
ধারা এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। সে কোন একটা অজুহাত দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। দাদীর এসব কথা জেসমিনের সামনে বলার কি কোন দরকার দিল! এই মেয়ের মন যে কৌতূহলী। জেসমিন যেন কোনভাবেই ছোটবেলার সেই কালো অধ্যায়ের কথা জানতে না পারে। তার কিছুই মনে নেই। সে সব ভুলে গেছে। সবাইকে ভুলে গেছে।’
চলবে_