এক বরষায় পর্ব-৫১ এবং শেষ পর্ব

0
779

#এক_বরষায় [৫১ এবং শেষ]
জেরিন আক্তার নিপা

________
গাড়িতে উঠার সময় ধারার মাথাটা দুলে উঠল। সে হয়তো পড়েই যেত তখনই যদি একজোড়া হাত তাকে ধরে না ফেলত। ধারা নিজেও জানে না তার আজ কী হয়েছে। সারাদিন ঘুমঘুম ভাব নিয়ে কাটিয়েছে। এখন মাথাটাও কেমন চক্কর দিচ্ছে। ধারা মাথা ঝাঁকিয়ে ঝিম ধরা ভাবটা কাটিয়ে উঠতে চাইল। মুনতাসীর ধারাকে ধরে গাড়ির ভেতর বসিয়ে দিয়েছে। ধারার পর্যাপ্ত ঘুম হয়নি। তাই ওর এমন লাগছে। ধারার ঘুমের প্রয়োজন। মাতিম কালকের আগে উঠতে পারবে না। তাই মাতিমকে আজ রাত এখানেই রেখে যেতে হচ্ছে। মুনতাসীর ধারার বাবা, দাদীর থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে এসে বসল। ধারা মুনতাসীরের দিকে তাকিয়ে কী যেন দেখছে। বারকয়েক চোখ পিটপিট করে আবার দেখছে। মুনতাসীর ধারাকে এরকম করতে দেখেও কিছু বলল না। তার বউ হয়তো এখনও ঘুমের ঘোরে আছে।
ধারা নিজেও বুঝতে পারছে তার কোথাও ভুল হচ্ছে। সাদাফের জায়গায় সে মুনতাসীরকে দেখছে। মুনতাসীর এখানে কীভাবে আসবে? মুনতাসীরের সাথে তার বিয়েটা হওয়া কি এই জন্মে আর সম্ভব? সে তো অন্য একজনের বউ হয়ে গেছে। আচ্ছা ধারা কি এখন ঘুমিয়ে আছে? এতে পারে সবই তার স্বপ্ন। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এই স্বপ্নগুলো দেখছে সে। ঘুম ভেঙে গেলেই মুনতাসীর চলে যাবে। মুনতাসীরের জায়গায় সাদাফ চলে আসবে। ধারা গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে পড়ে রইল। এটা যদি স্বপ্ন হয় তাহলে ধারা এই স্বপ্ন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দেখতে চায়। এই স্বপ্নটা যেন কোনদিনও না ভাঙে। মুনতাসীরই যেন তার পাশে থাকে। সাদাফকে সে ভালোবাসে না। কোনোদিনও ভালোবাসতে পারবেও না। মুনতাসীর লক্ষ করল ধারার চোখের কোল বেয়ে পানি পড়ছে। সে অবাক হলো। কাঁদছে কেন ধারা? মুনতাসীর ধারার হাত ধরল। পাশে বসা মানুষটা তার হাত ধরতে ধারা থরথর করে কেঁপে উঠল। তার ঠোঁট জোড়া তিরতির করে কাঁপতে লাগল। কান্না চাপতে ঠোঁট কামড়ে ধরল ধারা। মুনতাসীরের স্পর্শকে সে চিনতে পারেনি। তার মন মস্তিষ্ক এটাই ভেবে যাচ্ছে সাদাফের সাথে বিয়ে হয়েছে তার। সাদাফ তার পাশে বসে আছে। এখনও সাদাফই তার হাত ধরেছে। ধারা হাত ছাড়িতে নিতে চাইল। মুনতাসীর এতে আরও বিস্মিত হলো। ধারা এমন করছে কেন? ধারা কি বিয়েটা করতে চায়নি? তবুও মুনতাসীর ধারার হাত ছাড়ল না। শক্ত করে ধরে রাখল। এদিকে ধারা ভাবছে এই হাত দু’টোর মালিক যদি সত্যিই মুনতাসীর ভাই হতো!
গাড়ি মুনতাসীরের বাসার সামনে এসে দাঁড়াল। অল্প পথ হলেও পুরোটা পথ মুনতাসীর ধারার হাত ধরে রেখেছে। ধারা গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। মুনতাসীর ধারার মাথা ওর কাঁধে রেখে দিয়েছিল। গাড়ি থামতে মুনতাসীর গাড়ি থেকে নামল। ধারার দিকের দরজা খুলে দিয়ে দেখল ধারা মাথা হেলিয়ে সিটে পড়ে ঘুমোচ্ছে। এত ঘটনার পর তার বিয়েটা হবে এবং বিয়ের দিনটা এভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে ভাবেনি সে। মুনতাসীর ধারার দিকে তাকিয়ে হাসল। জেসমিনের বুদ্ধির বাহার দেখে ওকে অস্কার দিতে মন চাইছে। মুনতাসীর ধারাকে কোলে তুলে গাড়ি থেকে নামিয়ে আনলো। কোলে করেই সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় তার ফ্ল্যাটের সামনে চলে এলো। দরজায় তালা দেওয়া দরজা খুলতে হবে। ধারাকে নামানো যাবে না। কোনরকমে ধারাকে কোলে নিয়েই মুনতাসীর ঘরের দরজা খুলল। ভেতরে পা দিয়ে নিজের ঘরটাকেই চিনতে পারল না মুনতাসীর। এসব কে করেছে? কখন করেছে? নিশ্চয় এসব মাতিমের কাজ। পুরো ঘর রজনীগন্ধা, গোলাপ, কাঠগোলাপ, গাঁদা আরও কত ফুল দিয়ে সাজানো হিসেব করে শেষ করতে পারল না সে। দরজা খুলতেই মেঝেতে ফুল বিছিয়ে বড় একটা হার্ট সেইপ আঁকা হয়েছে। পুরো বিছানা ভর্তি ফুল। রজনীগন্ধার ঘ্রাণে চারপাশ মৌ মৌ করছে। কেমন একটা মাতাল করা আচ্ছন্নতা ঘেরে ধরছে। মুনতাসীর মেঝেতে থাকা ফুলগুলো ডিঙিয়ে এসে ধারাকে ফুল ভর্তি বিছানায় শুইয়ে দিল। হাজার হাজার ফুলের মাঝে একটা জ্যান্ত ফুল ঘুমিয়ে আছে। এই দিনটার কথা মুনতাসীর অনেকবার কল্পনা করেছে। এই দিন তার জীবনে কখনও আসবে কিনা এটা নিয়েও শঙ্কা ছিল। অবশেষে প্রকৃত অর্থেই এই দিন তার জীবনে এসেছে।
********

দুঃস্বপ্ন দেখে ধারার ঘুম ভাঙলো। ধারা ঝট করে শোয়া থেকে উঠে বসলো। ঘেমে ভিজে গেছে ও। এরকম একটা স্বপ্ন দেখার মানে কী? প্রায়ই খারাপ স্বপ্ন দেখে সে। কিন্তু আজকের স্বপ্নটা অন্য সব দিনের স্বপ্নের চেয়ে আলাদা। ধারা চোখ ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করল কোথায় আছে সে। ড্রিম লাইটের নিয়ন আলোতে স্পষ্ট করে কিছুই বুঝতে পারল না। ফুল দিয়ে সাজানো ঘর আর নিজেকে এতগুলো ফুলের উপর আবিষ্কার করে ধারার মনে পড়ল, আজ তার বিয়ে হয়েছে। গাড়িতে উঠে বরের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল। তারপর আর কিছু মনে নেই। তারপরে কি ঘুমিয়ে গিয়েছিল সে। ধারা পুরো ঘর জুড়ে একজনকে খুঁজলো। কিন্তু কাউকেই দেখতে পেল না। নিজেই বিছানা ছেড়ে উঠল সে। খুঁজে খুঁজে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।
মুনতাসীর ঘরে এসে দেখে বিছানায় ধারা নেই। সে ধারাকে খুঁজতে খুঁজতে ওকে ডাকতে যাবে তখনই ওয়াশরুমে পানির শব্দ পেল। মুনতাসীর ভাবল, ধারা কখন জেগেছে।
চোখে মুখে ঠান্ডা জলের ঝাপটা দিয়ে রুমে ফিরে এসেছে ধারা। আর তখনই সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে অবিশ্বাস্য চোখে নিঃশ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে রইল। ঘুমিয়ে ওঠার পর, চোখে পানি দেওয়ার পরও চোখে ভুল দেখছে সে! এখনও তার সামনে মুনতাসীর দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ধারা জানে এখানে সাদাফ থাকার কথা। মুনতাসীর ধারার চেহারার ভাব দেখে হয়তো বুঝে গেছে। সে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি নিয়ে ধারার দিকে এগিয়ে আসছে। ধারা নড়বে চড়বে বা কিছু বলবে এই শক্তিটুকুও পেল না। মুনতাসীর ধারার খুব কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। ওদের মধ্যে দূরত্ব খুবই সামান্য। সহজ গলায় মুনতাসীর জিজ্ঞেস করল,

-ঘুম হয়েছে? এই প্রথম কোন বউ দেখলাম যে বাপের বাড়ি থেকে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে শ্বশুরবাড়ি এসেছে। এবং বর তাকে কোলে করে রুমে এনেছে।”

এই লোকটাকে মুনতাসীরের মতো লাগছে। লোকটার গলাও মুনতাসীরের সাথে মিলে যাচ্ছে। ধারা তার ঘোর কাটানোর জন্য নিজের হাতেই জোরে চিমটি কাটল। ভীষণ ব্যথা পেয়ে চোখ বন্ধ করে নিল। মুনতাসীর তা দেখে হাসল। তার সাথেই যে ধারার বিয়ে হয়েছে এই মেয়ে এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না। মুনতাসীর ধারার হাতটা ধরে চিমটি কাটা জায়গায় ঠোঁট ছোঁয়াল। ধারা চকিতে চোখ খুলে বড় বড় করে মুনতাসীরের দিকে তাকাল। মুনতাসীর মৃদু হেসে বলল,

-চিমটি কেটে যাচাই করতে হবে না এটা স্বপ্ন নাকি সত্যি। আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি এটা আসলেই স্বপ্ন নাকি সত্যিই তোর সামনে আমি আছি।”

ধারা কিছু বলার আগেই মুনতাসীর আলতো করে ধারার গালে চুমু খেয়ে ফেলল। এতেই ধারার চোখ হাঁসের ডিমের আকৃতির হয়ে গেল। তারপর মুনতাসীর আর যে কাজটা করল সেটার জন্য ধারা হয়তো তার স্বপ্নেও প্রস্তুত ছিল না। ওর চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইল। সত্যিই তাহলে এসব তার সাথে ঘটছে! কী আশ্চর্য, মুনতাসীরের সাথে তার বিয়ে হয়েছে! ধারা কিছু জানে না কেন?
********

ধারা মুনতাসীরের বুকে ঠেস দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। মুনতাসীর পেছন থেকে ধারাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখছে ওরা। আজকের চাঁদটাকে পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে। ধারার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। কীভাবে কী হলো? মুনতাসীর তাকে কিছুই বলছে না। ধারা জিজ্ঞেস করলে জবাবে বলছে,

-যেভাবেই হোক বিয়েটা তো তোর আমার সাথেই হয়েছে। অন্য কারো বউ তো তোকে হতে দিইনি। আমার কথা আমি রেখেছি।”

প্রায় এক ঘন্টার মতো ওরা এভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কিছু বলছে না। কারো কোন তাড়া নেই। সময় যেন ধমকে গেছে। ধারা মুনতাসীরের আলিঙ্গনে আবদ্ধ থাকলেও সব তার কাছে স্বপ্নের মতোই লাগছে। ওভাবে আরও কতটা সময় কেটে গেল কারো খেয়াল নেই। শুনশান রাতের নিরবতা ভেঙে ধারাই আগে জিজ্ঞেস করল,

-আপনি আমাকে ভালোবাসতেন?”

মুনতাসীর প্রশ্নটা শুনে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। এটা কেমন প্রশ্ন? এত কিছুর পরেও এই কথা জিজ্ঞেস করতে হচ্ছে! এই মেয়ে সত্যি পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের মধ্যে একটা। মুনতাসীর ধারার মাথার চুলে থুতনি ঘষে বলল,

-আমাকে এই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে?”

-হুম। কবে থেকে আপনি আমাকে ভালোবাসতেন।”

-দিন, তারিখ, সাল, বারও বলতে হবে?”

-মনে থাকলে বলতে সমস্যা কী?”

মুনতাসীর হাসল। ধারাকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল,

-তখন এসএসসি পরীক্ষা হচ্ছিল তোর। পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে তুই-ই এমন একজন ছিলি যার জন্য বাইরে কেউ অপেক্ষা করে ছিল না। তুই পরীক্ষা দিয়ে বেরুলি, জানিস তোর জন্য কেউ অপেক্ষা করে নেই তবুও একটা বার আশেপাশে চোখ বুলিয়ে কাউকে খুঁজলি। নিজের কোন পরিচিত মুখ দেখতে না পেয়ে হাঁটা ধরলি। সেদিন গরম ছিল ভীষণ। একটা দোকান থেকে পানি কিনে লোকটাকে একশো টাকার একটা নোট দিলি। ওই নোটটা সামান্য ফাটা থাকায় লোকটা নিতে চাইল না। তোর কাছে আর হয়তো টাকাও ছিল না। পানির বোতল রেখে চলে আসতে নিলে দোকানদার লোকটা পেছন থেকে ডাকল। টাকা ছাড়াই তোকে পানির বোতল দিতে চাইল। কিন্তু লোকটা তো আর জানতো না মেয়েটার আত্মসম্মানবোধ কতটা! কোনভাবেই তুই টাকা ছাড়া পানি নিবি না। শেষে বাধ্য হয়ে লোকটাকে সত্যি বলতে হলো,

-পানির টাকা একজন দিয়া দিছে৷ আপনি এইটা নিয়া যান।’

-কে দিয়েছে?’

-কে দিছে তা তো কইতে পারমু না। কিন্তু লোকটা কইল আপনি ওর পরিচিত।’

কে টাকা দিয়েছে সেটা না জেনেও তুই পানি নিবি না। লোকটা শেষে তোকে জোর করে পানির বোতল হাতে ধরিয়ে দিল। তুই পানির বোতল হাতে আশেপাশে কাউকে খুঁজতে লাগলি। কিন্তু যে তোকে পানি কিনে দিয়েছে তাকে পেলি না।

ধারা বিস্মিত চোখে মুনতাসীরকে দেখছে। এই ঘটনা তো কারো জানার কথা না। এই কথা কাউকে বলেনি ধারা। সে নিজেও তো ভুলে বসে ছিল। কিন্তু পাঁচ বছর আগের এই ঘটনা মুনতাসীর ভাই কীভাবে জানলো? ওকে কে বললো? ধারা হতভম্ব গলায় জানতে চাইল,

-তুমি কীভাবে জানলে এই কথা? তুমি ওখানে ছিলে! তার মানে তুমি, তুমিই সে লোক যে সেদিন আমাকে পানি কিনে দিয়েছিল?’

ধারার গলা আটকে আসছে। খুশিতে নাকি কান্নায় বুঝতে পারছে না সে। মুনতাসীর হাসলো। ধারা নিজের অজান্তেই তাকে তুমি করে বলছে। ছোটবেলায় অবশ্য তুমি করেই বলত। কিন্তু ওর মুখ থেকে আপনি ডাকটাও খারাপ লাগতো না। প্রথমে এটা শুনে খুশি হলেও ধারা এবার অভিমানে মুনতাসীরের থেকে দূরে সরে গেল। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,

-তুমি আমার এতটা কাছে ছিলে তবুও সেদিন আমাকে তোমার পরিচয় দিলে না? একটা বার আমার সামনেও এলে না! সেদিন কেন দেখা দিলে না আমাকে?’

-কীভাবে দেখা দেব? ততদিনে তুই তো আমাকে ভুলে গিয়েছিলি। তোর সামনে এলেও কি চিনতে পারতি?’

-সামনে এসেই দেখতে। চিনতে না পারলে নাহয় অভিযোগ করতে।’

-আমি ভেবেছিলাম তুই আমার কথা ভুলে গেছিস। অবশ্য ভুলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। তখন তুই অনেক ছোট ছিলি। বড় হয়ে আমাকে মনে না-ও থাকতে পারে।’

ধারা এবার কেঁদেই ফেলল। এতক্ষণ আটকে রাখা চোখের জল গাল গড়িয়ে পড়তে লাগল।

-আমি তোমাকে ভুলে যাব? তোমাকে? কীভাবে ভাবলে! তুমিই তো আমার সবথেকে আপনজন ছিলে। এখানে আসার পরে সবার চেয়ে বেশি তোমার কথাই আমার মনে পড়েছে।’

মুনতাসীর ধারাকে নিজের কাছে টেনে নিল। সামনে থেকে ওকে নিজের সাথে মিশিয়ে ধারার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,

-তুই কি আমাকে ভালোবেসেছিলি ধারা?’

-নয় বছর বয়সী ছোট্ট মেয়েটা কি বুঝবে ভালোবাসা কী? তখন কি আমার ভালোবাসা বোঝার বয়স ছিল। তুমি আমার থেকে অনেক বড় হলেও আমার বন্ধুর মতোন ছিলে। কারণ তুমি আমার সব চাওয়া পূরণ করতে। আমার সব আবদার মেটাতে। আমার যখন যা ইচ্ছে হতো তোমার কাছে চাইতে পারতাম। সেইজন্যই হয়তো তুমি আমার কাছে সবার থেকে একটু বেশি আপন ছিলে।’

মুনতাসীর হাসলো। বলল,

-তখন তো তুই বাচ্চা বিড়ালছানা ছিলি।’

-তুমি আমাকে কবে থেকে ভালোবেসেছ?’

-ঠিক বলতে পারব না। তবে সেই ছোটবেলা থেকে না এটা শিওর। নাক টিপলে দুধ বের হবে এই মেয়েকে কীভাবে ভালোবাসতাম। তবে মায়া ছিল। তোরা চলে আসার পরও তোকে ভুলতে পারতাম না। অনেক বছর পরও মনে হতো তুই কতটা বড় হয়েছিস? দেখতে কেমন হয়েছিস? আমার কথা তোর মনে আছে কিনা।’

-আমাকে প্রথম কবে দেখলে?’

-ওইদিনই। পানির বোতলের ঘটনার দিন। তোর আত্মসম্মান দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম।’

-এতদিন পর দেখে আমাকে চিনলে কীভাবে?’

-চিনব না? তুই তো শুধু হাতে পায়ে বড় হয়েছিস। চেহারা সেই বাচ্চা কালের মতোই আছে।’

-আমরা যে এখানে আছি। আমি কোন স্কুলে পড়ছি এসব জানলে কীভাবে?’

-এসব জানা কি খুব কঠিন কাজ?’

-তুমি আমাকে কখনো ভুলোই নি। পাঁচ বছর আগেও আমাকে দেখেছ। আমাদের খোঁজ রেখেছ। আমাদেরই এলাকায় চাকরি নিয়ে আমাদের বাড়িতেও উঠলে তবুও এমন ভাব করে থাকলে যেন তুমি আমাকে চেনো না। আমাদের কথা তোমার মনে নেই। এমনটা কেন করলে?’

-তুইও তো প্রথম দিন থেকেই এমন ভাব করেছিলি যেন আমার কথা তোর মনে নেই। যেদিন প্রথম তোদের বাড়িতে এলাম আমাকে না চেনার ভান করেছিলি কেন? আমার চেহারা নাহয় তোর মনে ছিল না। মানলাম এত বছরে স্মৃতি ঝাপসা হয়ে গেছে। কিন্তু আমার নামটাও কি তোর মনে ছিল না? কেন প্রথম দিন বললি না মুনতাসীর ভাই আমি তোমাকে চিনি। তোমার কথা এখনও আমার মনে আছে। তোমাকে ভুলিনি আমি।’

-আমি ভেবেছিলাম তুমি হয়তো আমাকে ভুলে গেছ।’

-আমি কি তোর মতো বাচ্চা ছিলাম নাকি যে এত সহজে ভুলে যাব। আমার স্মৃতিশক্তি তোর মতো খারাপ না।’

-রাগ করছো কেন?’

-রাগ করবো না? চোখের সামনে ছিলি তবুও মনে হচ্ছিল তুই আমার থেকে অনেকটা দূরে চলে গেছিস। জেসমিন তো আমাকে না চিনেও, মনে না রেখেও আমার সাথে কথা বলতো। আমার কাছে আসতো। তুই চিনে জেনেও দূরে দূরে থেকেছিস। সত্যিই বড্ড পাষাণ রে তুই। নয়ন বেচারা তোকে ভালোবেসে জীবনের সবথেকে বড় ভুলটা করেছে।’

-নয়ন ভাইয়ের জন্য তোমার কষ্ট হচ্ছে বুঝি!’

-হচ্ছেই তো একটু একটু।’

-তাহলে নিজে বিয়ে না করে ওকেই সুযোগটা দিতে পারতে।’

-সেটা তো সম্ভব না। ওর কয়েক বছরের ভালোবাসার সাথে কি আমার ভালোবাসার তুলনা দেওয়া যাবে! একটা মজার কথা জানিস? তুই বাচ্চা কাল থেকেই আমার বউ।”

-মানে! কীভাবে?”

-তোর বাবা আর আমার বাবা যেমন বন্ধু ছিল। তেমনি আমাদের দাদারাও বন্ধু ছিল। বুড়ো দু’জন তোর জন্মের পরেই ঠিক করে রেখেছিল তুই আমার বউ হবি।”

-সত্যি! এই কথা তুমি জানতে? আমাকে তো দাদাজান কোনোদিনও এই কথা জানায়নি।”

-কী জানি কেন জানায়নি। কিন্তু আমি অনেক আগে থেকেই জানতাম। তোকে দেখে মনে মনে ভাবতাম আর হাসতাম, এই বাচ্চা মেয়েটা আমার বউ হবে কীভাবে!”

-এখন তো হয়েছি।”

-সেটা তো আমার জোরে। নইলে তো দেখছিলাম দিব্যি অন্য একজনকে বিয়ে করে নিচ্ছিলি।”

-তা তোমার ঠিক হওয়া বউকে তুমি অন্য কারো বউ হতে দিবে কেন? আমি তো আর জানতাম না।”

-হুম। এখন তো এই কথা বলবিই। আমি তোকে ভুলিনি। এমনকি তোকে ভালোবাসি এই কথা জেনেও তো তুই আমার অনুভূতির দাম দিসনি। দিব্যি আমার চোখের সামনে অন্য একজনকে বিয়ে করার জন্য রাজি হয়ে গেলি।”

ধারার মুখটা ছোট হয়ে গেল। মুনতাসীরের সাথে চোখ না মিলিয়ে অপরাধী গলায় বলল,

-আমি ভয় পেতাম। এটা ভেবে ভয় পেতাম আমি যদি তোমাকে তোমার মতো করে ভালোবাসতে না পারি যতটা তুমি আমাকে ভালোবাসো। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি। লোকে বলে মেয়েরা মায়ের মতো হয়। আমি যদি আমার মায়ের মতো হই। আমার জন্য যদি তুমি কষ্ট পাও। আমার বাবাকে তো দেখছো। সে ভয়েই আমি তোমার থেকে দূরে যেতে চেয়েছিলাম। তার জন্যই বিয়েতে রাজি হয়েছিলাম।”

ধারা আরও কিছু বলতো। কিন্তু মুনতাসীর তাকে সেই সুযোগ দিল না। ধারাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে সামান্য ঝুঁকে চট করে ধারার ওষ্ঠদ্বয় দখল করে নিল। ধারার চোখ জোড়ায় বিস্ফোরিত চাহনি। কিছুটা সময় পর মুনতাসীর ধারাকে ছেড়ে ওর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসল। ধারা লজ্জায় বেহুশ হবার দশা। এই লোক কি তাকে লজ্জা দিয়ে মেরে ফেলতে চাচ্ছে?

-তুই অন্য কাউকে বিয়ে করতে চাইলেও আমি হতে দিতাম না। যে তোকে যতই ভালোবাসুক, দিন শেষে তুই আমার। তুই আমার বউ হবি, হয়েছিসও। এখন আমার সাথে সংসার করবি। আমার বাচ্চাকাচ্চার মা হবি। আমার নাতি নাতনির নানী হবি। আমার সাথে বুড়ী হবি। তারপর একদিন দু’জন টুপ করে পরপারে পাড়ি জমাবো। সেখানেও আমি তোকে একা ছাড়ব না। তোর সাথে আমি আমার ইহকাল পরকাল সব কাটাতে চাই।”

সমাপ্তির আগে পরিশিষ্ট,,,

১| রোজ রাতে নিয়ম করে কল করা মেয়েটাকে নয়ন খুঁজে পেয়েছে। নয়নের বুদ্ধি ভালো হলেও এই কাজে ধারারই অবদান বেশি। ধারাই মেয়েটাকে খুঁজে বের করেছে। বরং নানা ভাবে নয়নকে মানতে বাধ্য করিয়েছে মিথিলার থেকে ভালো ওর জন্য আর কেউ হতে পারবে না।
মিথিলা সত্যিই নয়নকে ভালোবাসে। নয়নেরও উচিত মিথিলাকে একটা সুযোগ দেওয়া। ধারা এক সপ্তাহ নয়নকে সময় দিয়েছিল। এক সপ্তাহ পর মুনতাসীর কলেজ থেকে ফিরলে ওকে নিয়ে নয়নকে প্রায় অপহরণ করে নিয়ে মিথিলাদের বাড়িতে উপস্থিত হলো। রোজী আপাও তৈরি হয়েই ছিল। সেদিন রাতেই নয়ন মিথিলার আকদ হয়ে গেল। এক মাস যেতেই নয়ন মিথিলার ভালোবাসার জালে ফেঁসে গেল। এখন ধারাকে না পাওয়ার জন্য তার ততটাও খারাপ লাগে না। মনে হয়, যা হয়েছে ভালোই হয়েছে।

২| আজকাল জেসমিনের আবোলতাবোল পাগলামি কাজকর্মও মাতিমের কাছে বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে না। বরং জেসমিন এখন চুপ থাকে তার দিনটা খারাপ যায়। তোতাপাখির মতো জেসমিন যখন একনাগাড়ে কথা বলে যায় তখন মাতিম মুগ্ধ হয়ে জেসমিনকে দেখে। জেসমিন একদিন ভাইয়ার কাছে পড়তে না এলে মাতিমের আসফাস লাগে। তার সাথে এসব কেন হচ্ছে সে নিজেও বুঝতে পারছে না। এই বিষয়টা নিয়ে কারো সাথে আলাপও করতে পারছে না। ভাবীর সাথে কথা বলবে? ভাবী নিশ্চয় বলতে পারবে কেন তার এমন হচ্ছে।

৩| আতিফের মা মারা গেছে। আতিফ তার মামাদের কাছে চলে গিয়েছিল। ওখানে গিয়ে সে এক সপ্তাহও থাকতে পারেনি। অসুখ বাঁধিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। ছেলেটা বেহুঁশ অবস্থায়ও বোনদের কথাই মনে করেছে। ধারা, জেসমিন, মুনতাসীর গিয়ে ওকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে। আতিফ এখন থেকে এখানেই থাকবে। তাকে কেউ কোনোদিন যেতে বলবে না। ধারার বাবা না জানলেও দাদী, সে জেসমিন আতিফকে মেনে নিয়েছে।