এক বরষায় পর্ব-৪৮+৪৯+৫০

0
389

#এক_বরষায় [৪৮]
জেরিন আক্তার নিপা

_________
যে মেয়ের আজ বিয়ে সে এখনও ঘুম থেকেই উঠছে না। বেলা বাড়ছে। দাদী গিয়ে কয়েকবার ধারাকে ডেকে এসেছে। কিন্তু এই মেয়ের তো কোন হুঁশই নেই। জেসমিন তো জানে আপু কেন ঘুমাচ্ছে। সে দাদীকে শান্ত করতে বলল,

-তোমার নাতনি রাতে ঘুমোয়নি। তাই এখন ঘুমাচ্ছে। উঠে পড়বে। এত ডেকো না।”

-রাতে ঘুমায় নায় কেন?”

-আমাদের ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে তাই মন খারাপ করে অনেকক্ষণ কেঁদেছে।”

দাদী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বিড়বিড় করে বললেন,

– শ্বশুরবাড়ি তো যাইতেই হইব। কিন্তু সেইটা তো দূরে কোথাও না। নজরুলের পোলার লগেই তো বিয়া হইব।”

-কিছু বললে দাদী?”

-না। তোর বোনরে ডাক। কান্দোনের দরকার নাই। সবাইরেই তো শ্বশুরবাড়ি যাইতে হইব।”

তিনি ছেলের কাছে ছুটলেন। এবার মেয়েটাকে সত্য জানিয়ে দেওয়া উচিত। ছেলে কী বলেন শুনে এসেই তিনি জানিয়ে দিবেন।
ঘরোয়া ভাবে বিয়ে হলেও পাড়া প্রতিবেশিরা তো না এসে থাকবে না। সবাই এসে ধারাকে খুঁজছে। জেসমিন একা সবাইকে সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। এদিকে ধারা এখনও গভীর ঘুমে।
****

ধারাদের বাড়ি থেকে এখনও কোন খবর আসছে না দেখে নয়ন চিন্তিত। বরকে সে হলুদের আগের দিনই কিডন্যাপ করিয়ে নিয়েছে। ছেলের বাড়ি থেকে কি এখনও জানানো হয়নি ছেলেকে পাওয়া যাচ্ছে না। ছেলেকে না পাওয়া গেলে বরযাত্রী কি বর ছাড়া আসবে? আশ্চর্য কারবার! ধারাদের বাড়িতে তো দিব্যি বিয়ের আয়োজন চলছে। নয়ন রাসেলকে কল লাগাল।

-কিরে ছেলেটা কি পালিয়ে গেছে?”

-না ভাই। পলাইব কেমনে? হাত,পা,মুখ সবই তো বাইন্দা রাখছি। পলানির কোন সুযোগই নাই।”

-তাহলে ছেলের বাড়ির লোক কি জানে না ওদের ছেলেকে পাওয়া যাচ্ছে না?”

-দুই দিন ধরে ছেলে উধাও জানব না কেন ভাই?”

-আরে গাধার দলেরা আমি কীভাবে বলব? জানলে বিয়েটা এখনও হচ্ছে কীভাবে?”

-ওরা হয়তো ভাবতাছে সন্ধ্যার আগে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরা যাইব।”

-হুম। এটাও হতে পারে। বিয়ে তো রাতে হবে।”

-তাইলে রাইত পর্যন্ত অপেক্ষা করেন ভাই। ভাবীর বিয়া আজ হইব না নিশ্চিন্ত থাকেন।”
*****

রোজী এসে ধারাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে আকাশ থেকে পড়ল। এই মেয়ের কি কোন আক্কেল জ্ঞান নেই! বিয়ের দিন সমানে পড়ে ঘুমাচ্ছে। রোজী ধারার গায়ে ধাক্কা দিয়ে ডাকছে।

-এই ধারা, ধারা ওঠ। বিয়ের পরে মানুষের ঘুম বেড়ে যায়। তুই তো বিয়ের আগেই ঘুমে তাকাতে পারছিস না দেখছি।”

এভাবে অনেকক্ষণ ডাকার পর ধারার সাড়া পাওয়া গেল। জাগলেও ঘুমে তার চোখ বুঝে আসছে। ধারা বসে ঝিমাতে ঝিমাতে বলল,

-রোজী আপা আমার এত ঘুম পাচ্ছে কেন? চোখ খোলা রাখতে পারছি না।”

সামান্য সময়ের জন্য ধারা জাগলেও একটু পরেই আবার ঘুমিয়ে পড়ল। রোজী মহা চিন্তায় পড়ে গেল। জেসমিন ভয়ে রোজী আপার কাছে আসছে না। তার মিথ্যা রোজী আপা চট করে ধরে ফেলবে। রোজী জেসমিনকে ডেকে বলল,

-এর কী হয়েছে রে? এত ঘুমাচ্ছে কেন? উল্টাপাল্টা কিছু খেয়েছে নাকি?”

-আমি জানি না রোজী আপা।”
*****

দুপুরের পর ধারা একটু উঠে আসতে পারল। এখনও চোখে ঘুম আছে। কিন্তু বসে বসে বা দাঁড়িয়েই ঘুমিয়ে যাবে তেমন না। তার কী হয়েছে সে নিজেও বুঝতে পারছে না। আজ এত ঘুম পাচ্ছে কেন? নিজের বিয়ের দিন কোনো মেয়ে দুপুর পর্যন্ত ঘুমায়! কিন্তু সে তো ঘুমিয়েছে।
বরের বাড়ি থেকে শাড়ি গহনা পাঠিয়ে দিয়েছে। রোজী আপা ধারাকে শাড়ি পরিয়ে দিয়ে সাজিয়ে দিল। বধূ সেজে বসেও ধারার ঝিমুনী উঠে যাচ্ছে। বারবার হাই তুলছে সে। রোজী আপা একবার ধমক দিয়ে বলেছে,

-গাঁজা টাজা খেয়েছিস নাকি? এরকম করছিস কেন?”

আতিফ পাশেই ছিল। এই কথা শুনে বলে উঠল,

-গাঁজা খেলে কি ঘুম পায় রোজী আপা?”

রোজী কটমট চোখে আতিকে দেখে বলেছে,

-আমি তো সকাল দুপুর রাত তিনবেলা এসবই খাই। আমি না জানলে কে জানবে!”

আতিফ মুখ কাচুমাচু করে নিয়ে বলল,

-তাহলে বললে যে।”
******
মেহমান বলতে বাইরের কেউ নেই। পাশের বাড়ির কাকী আর পাড়ার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। এখনও বরযাত্রী আসবে না। জেসমিন বাবার কাছে শুনেছে বরযাত্রীও নাকি কয়েকজন মানুষই আসবে। জেসমিন চিন্তায় আছে। তিনটা ঘুমের ঔষধ না দিয়ে ছয়টা দেওয়া উচিত ছিল। আপুর তো ঘুম ভেঙে গেছে। ঘুমে ঢুলুঢুলু অবস্থায়ও কবুল বলতে পারবে। না খুব শীঘ্রই আরেক ডোজ দিতে হবে। কিন্তু কীভাবে দিবে? রোজী আপা তো ছায়ার মতো আপুর সাথে লেগে আছে। এখন সে আপুকে কিছু খাইয়েছে তারপরই আপু আবার ঘুমিয়ে পড়লে তার কপালে শনি নাচবে। কারোরই বুঝতে বাকি থাকবে না এসব ওর কাজ।
****
আতিফের মা এসেছে। ভদ্রমহিলার খাতিরদারি জেসমিনকে করতে হচ্ছে। মহিলা বোরখা, নেকাব কিছুই খুলছে না। বরযাত্রী নাকি রওনা দিয়ে দিয়েছে। জেসমিন গেট ধরতে যাবে। বিয়ে হোক আর না হোক গেট ধরার টাকা হাতছাড়া করা যাবে না। জেসমিন তাড়াহুড়োয় মহিলাকে আতিফের ঘরে নিয়ে গেল।

-খালাম্মা এটা আতিফের ঘর। আপনি এখানে বসুন। আমি একটু পরেই আবার আসব।”

জেসমিন চলে যেতে নিলে মহিলা তাকে ডাকলেন।

-শোনো মা!”

জেসমিনকে দাঁড়াতে হলো। এই মহিলা তো জ্বালিয়ে মারছে। বিয়ে বাড়িতে এসেছিস খেয়েদেয়ে বিদেয় হ। এত প্যারা দিচ্ছিস কেন? এমনিতেই কি তার নিজের প্যারা কম পড়েছে?

-তাড়াতাড়ি বলুন খালাম্মা। বরযাত্রী চলে আসবে।”

-তোমার নাম কি জেসমিন?”

-হুম। আমার নাম জেসমিন। যার বিয়ে হচ্ছে, আমার বড় বোন। তার নাম ধারা। এবার আমি যাই খালাম্মা?”

-তোমার বাবা মা..

-বাবা বাবুর্চিদের কাছে আছে। আর আমার মা বেঁচে নেই। দাদী আছে। দাদীকে আপনার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

কথা ক’টা বলে জেসমিন আর দেরি করল না। ছুটে চলে গেল। শরবতের গ্লাসে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে এসেছিল। আপুকে খাওয়ানোর সুযোগই পেল না। তার আগেই আতিইফার মা টপকে পড়ল। ওটা সাধারণ শরবত ভেবে অন্য কেউ খেলে ফেললেই সর্বনাশ। জেসমিন চলে গেলে মানুষটা চোখের পানি ছেড়ে দিলেন। নিজের আপন মেয়ে। যে মেয়েকে দশ মাস গর্ভে ধরেছেন তিনি। সেই মেয়ে তাকে চিনছে না। মা’র সামনেই বলছে, তার মা নাকি বেঁচে নেই। অবশ্য তিনি সেদিনই মেয়েদের কাছে মারা গিয়েছিলেন যেদিন মেয়েদের ফেলে রেখে বাড়ি ছেড়েছিলেন। জেসমিন তখন ছোট ছিল। তাই তাকে চিনতে পারেনি। কিন্তু ধারাও কি মা’কে চিনতে পারবে না? ধারার সামনে দাঁড়াতে তার ভয় হচ্ছে। মেয়েটার জীবনের এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ দিনে তার আসা ঠিক হয়নি। এই দিনে মেয়েটাকে আরও বেশি কষ্ট দিতে চায় না তিনি।
******
বরযাত্রী দেখে জেসমিন থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নিজেই নিজেকে জোরে চিমটি কাটল। ব্যথাও পেল ভীষণ। মুনতাসীর ভাইকে বর হিসেবে দেখে জেসমিনের মাথা আউলিয়ে গেল। হচ্ছে কী এসব? সাদাফ বেটার জায়গায় মুনতাসীর ভাই কী করছে? জেসমিনকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে মাতিম ওর চোখের সামনে হাত নেড়ে মনোযোগ আকর্ষণ করে বলল,

-হ্যালো! এই যে বেয়াইন, মুখে মাছি ঢুকবে। মুখ বন্ধ করুন।”

ধাক্কাটা জেসমিনের এমনভাবেই লেগেছে সে আর একটা কথাও বলতে পারল না। মুনতাসীর ভাবছে, জেসমিনের অবস্থা যদি এরকম হয়, তাহলে ধারার কী অবস্থা হবে কে জানে? বউটা বিয়ের আগে হার্ট অ্যাটাক না করলেই হয়। অন্তত কবুল বলার আগ পর্যন্ত যেন স্বাভাবিক থাকে।
জেসমিন কথাটা আপুকে বলতে ছুটে গেল। কিন্তু আপু তো ঘুমোচ্ছে। রাগে দুঃখে নিজের চুলই ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে ওর। কেন যে বেশি পাকনামি করে এই বুদ্ধি খাটাতে গেল! এখন যদি আপুর ঘুম না ভাঙে। তার জন্য যদি বিয়েটা না হয়! মাতিম কাল এজন্যই বলছিল ঘুমের ঔষধ ফেলে দিতে! ইশ রে, সে কেন বুঝল না। ওই বদ বেটা তাকে খুলে বলেনি কেন? মুনতাসীর ভাইয়ের সাথেই আপুর বিয়ে হচ্ছে জানলে বিয়েটাকে সম্পূর্ণ ভাবে উপভোগ করত সে। নাচত, গাইতো, প্রচুর সাজত। আপুর বিয়ে তো আর দ্বিতীয় বার হবে না।
*****

এতক্ষণ তো রোজী আপা ধারাকে ডাকছিল। জেসমিন গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরছিল। আপুর ঘুম না ভাঙলেই তার শান্তি। মুনতাসীর ভাইকে দেখে এসে এবার জেসমিন ধারাকে দু’হাতে ঝাঁকিয়ে ডাকছে। চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে দেওয়ার কথা বলছে। রোজী রেগে গিয়ে বলল,

-হঠাৎ তোর চরিত্রের এই অমূল পরিবর্তনের কারণ কী? ধারার এত ঘুমানোর পেছনে তোর হাত নেই না?”

-রোজী আপা, তুমি শুধু শুধু আমাকে দোষ দিচ্ছ। বিশ্বাস করো আমি কিছুই করিনি। নিজের বোনের বিয়েতে আমি উলটাপালটা কাজ কেন করব? আমি কি পাগল? আমার কি মাথার তার ছিঁড়া।”

-থাক থাক। তোকে বলেও আমার ভুল হয়েছে বোন।”

জেসমিন ধারার ঘুম ভাঙাতে কোন চেষ্টারই বাকি রাখছে না। ধারা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হু হাঁ করে জেসমিনের ডাকে সাড়া দিচ্ছে। জেসমিন মনে মনে কসম কাটল, আজকে ভালোয় ভালোয় আপুর বিয়েটা হয়ে গেলে সে আর জীবনে শয়তানি করবে না। সবকিছু বাদ দিয়ে একদম ভালো মানুষ হয়ে যাবে। তবুও আল্লাহ আজ আপুর বিয়েটা যেন হয়ে যায়। মুনতাসীর ভাই-ই যেন তার দুলাভাই হয়।

চলবে_

#এক_বরষায় [৪৯]
জেরিন আক্তার নিপা

_________
প্রতিটা মেয়েরই বিয়ে নিয়ে কিছু স্বপ্ন আশা আকাঙ্ক্ষা থাকে। ধারারও হয়তো ছিল। কিন্তু বিয়ে নিয়ে তার কোন স্বপ্নই সত্যি হলো না। সে এমন একজন মানুষকে বিয়ে করছে যাকে সে ভালোই বাসে না। কোনোদিন বাসতে পারবে কি-না তা-ও জানে না। সাদাফকে সে বিয়ে করতে চেয়েছিল শুধুমাত্র মুনতাসীরকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার জন্যই। কিন্তু যখন সে বুঝল যাকে সে দূরে সরিয়ে দিতে চাচ্ছে সে মানুষটা ছাড়া সে-ও ভালো থাকতে পারবে না। তখন বিষয়টা সাদাফকে জানিয়েছিল। সাদাফ তার সিদ্ধান্তকে সম্মান দিয়েছিল। বাবাকে ধারা তার ভালোবাসার কথা না জানালেও বলেছিল বিয়েটা সে করতে চায় না। কিন্তু বাবা তার কথা বুঝেনি। এত কিছুর পরেও বিয়েটা আজ হচ্ছে। ধারা চোখ খোলা রাখতে পারছে না। তার ভাবনা গুলোও কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আজ কী হয়েছে তার? এরকম ঘুম পাচ্ছে কেন? আচ্ছা ধারা কি আজ মরে যাবে? মানুষ মারা যাবার আগে কি এভাবে ঘুম পায়?

-আপু! এই আপু, আপু ওঠো না প্লিজ। আপু তুমি তো জানো না কী যে হতে যাচ্ছে! জানলে তুমিই সবচেয়ে বেশি অবাক হবে।”

ধারা ঘুম জড়ানো গলায় টেনে টেনে বলল,

-জেসমিন আমি কি আজ মারা যাব?”

-তওবা তওবা। মারা যাবে কেন? আজ তো তোমার সবথেকে খুশির দিন। আজকের পর থেকে মৃত্যু তোমাকে নিতে এলেও তুমি যেতে চাইবে না। মৃত্যুর ফেরেশতাকে বলবে তোমাকে যেন আরও কিছু সময় পৃথিবীতে থাকতে দেয়।”

ধারা হাসল। সোজা হয়ে বসে থাকতে পারছে না সে। ঘুমে ঢলে পড়ছে। জেসমিন বোনকে ধরে সোজা করে বসালো। মনে মনে নিজেকে বিশ্রী কিছু গালি দিল। তার জন্যই আপু সজ্ঞানে থেকে বিয়েটা করতে পারছে না। আপুর জীবনের শ্রেষ্ঠ দিনটা সে নষ্ট করে দিল।
******

ধারা এখনও মুনতাসীরকে দেখেনি। বা তার বিয়েটা যে মুনতাসীরের সাথে হচ্ছে এটাও জানে না। মুনতাসীর উঠোনের স্টেজে বসে আছে। ধারা ঘরে। তাকে ঘিরে পাড়ার কাকীরা মেয়েরা নানান গল্প করছে। এতো সোরগোল, এত ফিসফাস সবার মাঝে বসেই ধারা ঝিমোচ্ছে। বিয়ের লেখালেখির কাজ বাইরে থেকে সেরে কাজী একজন সাক্ষী সহ ধারার সাইন নিতে এসেছে। কলম ধরার শক্তিটুকুও যেন ধারার হাতে নেই। রেজিস্ট্রি খাতায় সই করার সময় ধারার দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসছিল। হাতটাও কেমন কাঁপছিল। কোনরকমে খাতায় সই করে দিল ধারা। তার সমানে হাই উঠছে। রোজী পেছন থেকে ধারার কানে বলল,

-কী হচ্ছে ধারা!”

ধারা অস্পষ্ট গলায় জবাব দিল,

-বুঝতে পারছি না রোজী আপা। আমার যেন কী হয়েছে। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।”

আইনি ভাবে বিয়েটা হয়ে গেছে। এবার ধর্মীয় ভাবে ছেলে মেয়ের কবুল বলার পালা। কবুল বলতে ধারা বেশি সময় নিল না। সমস্ত ভাবনাচিন্তা বাদ দিয়ে কবুল বলে ফেলল। কারণ সে জানে এতদূর এসে বিয়েটা আর কোনমতেই ভাঙবে না। ধারা একটু খেয়াল করলেই শুনতে পেত কাজী সাহেব ছেলের নাম ছেলের বাবার নাম বলার সময় কার নাম নিয়েছে। ধারা এত জলদি কবুল বলে দেওয়ায় সবাই নানান কথা বলাবলি করছে। ধারা কারো কথায় গুরুত্ব দিল না। মানুষের কাজই বলা। মানুষ কী বলবে ভেবে ভেবেই আজ মুনতাসীর ভাই চিরজীবনের জন্য তার পর হয়ে গেল। মানুষটা যখন তার পেছনে পাগল হয়ে ঘুরেছে তখন ধারা সমাজের কথা ভেবেছে। মেয়ে কবুল বলার পর কাজী সাহেব ছেলের কাছে চলে গেলেন। তার আরও দশ মিনিট পরেই ছেলেকে ঘরে নিয়ে আসা হলো। মহিলারা সবাই সরে গিয়ে জায়গা করে দিয়েছে। বরকে ধারার পাশে বসানো হয়েছে। ধারার তখনও একনজর পাশের মানুষটাকে দেখতে ইচ্ছে করল না। সে বসে বসে ঝিমোচ্ছে। মানুষ গুলো কখন যাবে? কখন সে একটু একা হবে? শরীরটা বড্ড বিছানা টানছে। তাদের দিয়ে এখানেও আরও কত নিয়ম-নীতি পালন করানো হলো। প্রথমে দু’জন দু’জনকে মিষ্টি খাইয়ে দিয়েছে। তারপর নাকি দুধও খেতে হবে। দুধের গ্লাস মুখের সামনে আনতেই ধারার বমি হয়ে যেতে চাইল। ছোটবেলা থেকে সে দুধ খেতে পারে না। সর্বশেষে বর বউকে আয়নায় দেখবে। আয়না আনা হলো। সবাই উৎসাহী গলায় জিজ্ঞেস করল,

-আয়নার ভেতর কাকে দেখতে পাচ্ছেন দুলাভাই?”

-আমার লাল টুকটুকে বউকে।”

কথাটা শোনে আবার সবার মাঝে ফিসফাস গুঞ্জন উঠল। ধারাও গলাটা শুনে চকমালো। বউ কথাটা শোনার পর সে-ও এক নজর না তাকিয়ে পারল না। আর তাকিয়ে যা দেখল তাতে ধারার চোখ জোড়া বিস্ফোরিত হয়ে রইল। এ কাকে দেখছে সে? মনে মনে ওই মানুষটাকে ভাবছে বলেই কি চোখের সামনেও ওই মানুষটাকেই দেখছে! যা কোনোভাবেই সম্ভব না তা কল্পনা করাও বৃথা। ধারার চোখ টলমল করে উঠল। বুকের ভেতরটা বড্ড পুড়ছে। মুনতাসীর আয়নার মধ্যেই ধারাকে দেখে হাসল। ধারা চোখ সরিয়ে নিল। এই মানুষটাকে সে হারিয়ে ফেলেছে। আর কখনোই তাকে নিজের করে পাওয়া হবে না।
*****

আপুর জন্য জেসমিন ভীষণ খুশি। শেষমেশ আপুর বিয়ে মুনতাসীর ভাইয়ের সাথেই হয়েছে। আল্লাহ তার ডাক শুনেছে। মাঝ থেকে শুধু শুধু উলটাপালটা আইডিয়া বেছে নিতে হয়েছে। জেসমিন আতিফের মা’র খুঁজে আতিফের ঘরে এসে দেখল মাতিম বিছানায় চোখ বুজে শুয়ে আছে। জেসমিন কপাল কুঁচকে ভাবল, এই লোক এখানে কী করে? আতিফের মা কোথায় গেল। জেসমিন কাছে এসে ডাকল।

-এইযে শুনছেন। আপনি তো আচ্ছা বদ লোক। বদগিরিরও একটা সীমা থাকে। আপনার তো তাও নেই। আপনি সব জেনেও আমাকে বলেননি। আপনি জানতেন আমি আপুকে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে দিব। তারপরও বলেননি আপনার ভাইয়ের সাথে আপুর বিয়ে হবে। আমি যদি তিনটা ট্যাবলেট না দিয়ে পাঁচ ছয়টা দিয়ে দিতাম! তখন তো আপু ঘুম থেকেই উঠতে পারত না। বিয়েটা কীভাবে হতো বলুন দেখি।”

মাতিমের কোন সাড়াশব্দ নেই। জেসমিন কোমরে হাত দিয়ে রেগেমেগে মাতিমের কানের কাছে এসে বলছে,

– এখানে শুয়ে আছেন কেন? ওদিকে আপনার ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। কেমন ভাই আপনি বলুন তো! ভাইয়ের বিয়ে রেখে এখানে এসে শুয়ে আছেন। আজব লোক!”

এবারও মাতিম তার ডাকে সাড়া দিচ্ছে না। লোকটা কি ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি? কী আজব! এই সন্ধ্যাবেলা ঘুমাবে কেন?

-এইযে, দুলাভাইয়ের ভাই। আপনি কি ঘুমোচ্ছেন? আজব লোক তো!”
******

নয়ন ধারাদের বাড়ির দিকে দৌড়ে আসছে। সাদাফের থেকে জেনেছে ধারা আগেই বিয়ে করতে না করে দিয়েছিল। ধারা একজনকে ভালোবাসে। কিন্তু কাকে ভালোবাসে এটা বলেনি। ধারার বাবা নিজে গিয়ে বিয়ে ভেঙে দিয়ে এসেছে। নয়নের খুশির সীমা মানছে না। ধারা কি তাহলে তাকে ভালোবাসে! নইলে আর কাকে ভালোবাসবে সে?
নয়ন ধারাদের বাড়িতে পৌঁছে হাঁপাতে লাগল।
কিন্তু নয়ন আসতে আসতে ততক্ষণে ধারার সাথে মুনতাসীরের বিয়ে হয়ে গেছে। নয়ন এটা জেনে থমাকলো। বাকরুদ্ধ হয়ে চেয়েই রইল। ধারা কি মুনতাসীরকে ভালোবাসে?
ধারার মধ্যে অস্বাভাবিকতা মুনতাসীরও লক্ষ করেছে। ধারা এরকম ঝিমোচ্ছে কেন? কী হয়েছে ওর? একটু পরেই ধারাকে নিয়ে চলে যাবে। ধারার মা সবার মাঝে থাকলেও সবার চোখের আড়ালে থাকছে। কেউ যেন তাকে চিনে না ফেলে। দূর থেকে নিজের স্বামীকেও দেখলেন তিনি। মানুষটা কতটা পাল্টে গেছে! স্বামীর সামনে যাওয়ার সাহস তার নেই। মেয়ে কবুল বলার সময়ও সবার পেছনে দাঁড়িয়ে শুনেছেন। আজ তার মেয়ের বিয়ে। কিন্তু মা হয়ে তাকে লুকিয়ে মেয়ের বিয়েতে আসতে হয়েছে।
****

ঘুমঘুম ভাবটা কাটানোর জন্য ধারা মুখে পানি দিতে এলো। কলপাড়ে জেসমিনের সাথে এসেছে। একটু পরেই নিজের বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে সে। এটা ভেবেই কান্নায় বুক ফেটে যাচ্ছে। মুখে পানি দিয়ে ঘরে যাবার সময় মানুষটার সাথে তার দেখা হয়। জেসমিন অবশ্য এখনও জানে না এটা তার মা। জেসমিন উনাকে দেখে বললেন,

-খালাম্মা কোথায় ছিলেন আপনি? আপনাকে খুঁজে পাইনি।”

তিনি বোরখা নিকাবের আড়ালে দুই মেয়েকে চোখ ভরে দেখছেন। ধারা উনাকে চিনলো না। জেসমিন চিনিয়ে দিয়ে বলল,

-আতিফের মা।”

কথাটা শুনেই যেন মুহুর্তে ধারার চেহারা পাল্টে গেল। কঠিন চোখে মানুষটাকে দেখছে সে। ধারা মনে মনে হয়তো জানতো মানুষটা আজ না এসে পারবে না। আজ তার মুখোমুখি দাঁড়াতেই হবে। এই দিনটার অপেক্ষাতেই ছিল সে। শুধুমাত্র এই দিনটার জন্যই আতিফের সত্য জেনেও ছেলেটাকে তাদের বাড়িতে থাকতে দিয়েছে। ধারা অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিল আতিফ কে। শুধু আতিফের উদ্দেশ্যটাই বুঝতে পারছিল না। কোন উদ্দেশ্যে এই ছেলে তাদের কাছে এসেছে? আতিফের উপর তার কোন রাগ নেই। ওই মানুষটার করা বেইমানির দায় যেমন তাদের দেওয়া যাবে না। তেমনি আতিফকেও দেওয়া যাবে না। আতিফ তো তখন জন্মও নেয়নি। তাদের প্রতি ছেলেটার ভালোবাসা দেখে ধারা নিজেও অনেকটাই নরম হয়ে গিয়েছিল। ধারার চোখ আজ ভিজে আসছে না। বরং অনেক বছর ধরে বুকের ভেতর ভিজে যাওয়া আগুনটা যেন হঠাৎ জ্বলে উঠল। দাদার বলা কথাগুলো কানে বাজতে লাগল। ক্ষমা করিস না দাদাভাই। কোনোদিনও ক্ষমা করিস না। ওই মহিলা তোদের মা না। কোনোদিনও যদি ওই মহিলার মুখোমুখি হোস তাহলে একটা কথাই শুধু বলবি, আপনাকে আমরা ঘৃণা করি। আপনি আমাদের কাছে মৃত।
ধারার তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে মানুষটা দাঁড়াতে পারছে না। মনে মনে অপরাধবোধে কুঁকড়ে যাচ্ছে। ধারা জেসমিনকে কিছু বলে ঘরে পাঠিয়ে দিল। অনেকটা সময় পর ধারা মুখ খুলল,

-এই জীবনে তাহলে আপনার মুখোমুখি হয়েই গেলাম।”

ধারা তাকে চিনে ফেলেছে। তিনি আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলেন না। কান্নায় ভেঙে পড়লেন। মানুষটাকে কাঁদতে দেখে ধারা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল।

-আমি কোনোদিনও আপনার মুখ দেখতে চাইতাম না। শুধু একটা কথা বলার জন্যই আপনার সামনা হতে চেয়েছিলাম।”

-মা রে..

-উঁহু। আপনার কোন কথা শুনতে চাই না আমি। আপনার মুখে মা ডাকটা শোভা পায় না। আমি শুধু বলতে চাই। আমি আপনাকে ঘৃণা করি। যতটা ঘৃণা পৃথিবীতে কেউ কাউকে করেনি ততটা ঘৃণা করি। আপনার প্রতি আমার ঘৃণা জনম জনমেও শেষ হবে না। আপনি আমাদের কাছে মৃত। এতগুলো বছরেও আপনার কথা কেউ মনে করেনি। সেদিনই আপনি আমাদের কাছে মারা গিয়েছিলেন। আপনার এটা জানা উচিত পৃথিবীর কোন স্থানে কেউ আপনাকে কতটা ঘৃণা করছে। এই ঘৃণা নিয়েই আপনাকে বেঁচে থাকতে হবে।”

নিজের মেয়ের মুখে কথাগুলো শুনে কোন মা-ই কি সহ্য করতে পারবে? তিনিও পারছেন না। ধারা তাচ্ছিল্যের গলায় বলল,

-আপনার চোখের পানির কোন মূল্য আমার কাছে নেই। জানি না কোন উদ্দেশ্যে আপনার ছেলেকে আমাদের কাছে পাঠিয়েছেন। আপনার পাপের শাস্তি আমি ওই ছেলেটাকে দিতে পারিনি। যার কারণে ওকে এতদিন আমাদের কাছে থাকতে দিয়েছি। কিন্তু আপনি এটা ভাববেন না আপনার ছেলেকে আমরা ভাই বলে মেনে নিয়েছে। এতদিনে ওকে দেখে যতটুকু বুঝেছি আপনার গর্ভে জন্ম নিলেও ও আপনার মতো হয়নি। আজ কেন এসেছেন আপনি? আমাদের ক্ষমা পাওয়ার জন্য? আপনাকে আমাদের কোন প্রয়োজন নেই। আপনি এখনই আপনার ছেলেকে নিয়ে চলে যাবেন। ভুলেও আমার বাবার সামনে যাবার চেষ্টা করবেন না। আপনার অপবিত্র বিষাক্ত ছায়াটাও যেন আমার বাবা, দাদী, বোনের উপর না পড়ে।”

চলবে_

#এক_বরষায় [৫০]
জেরিন আক্তার নিপা

_________
বিয়ের পুরোটা সময় মুনতাসীর মাতিমকে দেখেনি। কোথায় গেল ছেলেটা? এখন ওরা বিদায় নেবে। এখনও ওর দেখা নেই। কোথায় গিয়ে বসে আছে কে জানে। মুনতাসীর আতিফকে জিজ্ঞেস করল। আতিফ জবাব দিয়েছে, মাতিমকে দেখেনি সে। ভাইকে খুঁজতে খুঁজতে মুনতাসীর জেসমিনকে পেয়ে গেল। জেসমিন এখন তার শালিকা। জেসমিনের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।

-এইযে শালিকা!”

মুনতাসীর ভাইয়ের মুখে এই ডাক শুনে জেসমিন ফিক করে হেসে ফেলল।

-মুনতাসীর ভাই আপনার মুখে শালিকা ডাক শুনে কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগছে। আপনাকে দুলাভাই ডাকতেও লজ্জা লাগছে।”

-তুমি কবে থেকে লজ্জাবতী হয়ে গেলে?”

-আজ থেকেই। মুনতাসীর ভাই, কাজটা কিন্তু আপনি ভালো করেননি।”

মুনতাসীর ভ্রু বাঁকিয়ে মজা করে বলল,

-কোন কাজ? তোমার আপুকে বিয়ে করা?”

-না। এই কাজটাই ভালো করেছেন। কিন্তু আমাকে না জানিয়ে অন্ধকারে রাখা ওই কাজটা কি ভালো করেছেন?”

-আমি তো তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম।”

-আপনার সারপ্রাইজের জন্য আমার হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেলে তখন কী করতেন?”

-আমার এই ভুলের জন্য আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত শালিকা। এখন বলো, আমার ভাইটাকে দেখেছ?”

-ভাইকে খুঁজে লাভ নেই। আপনার ভাই অন্তত কাল দুপুরের আগে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে না।”

মুনতাসীর কৃত্রিম ভয় পাওয়ার ভান করল। আঁতকে উঠে বলল,

-কেন, কী করেছ তুমি আমার ভাইকে?”

-আমি কিছুই করিনি। তবে যা হয়েছে সেটা আপনার ভাইয়ের জন্য একদম উচিত শিক্ষা হয়েছে।”

-কী হয়েছে ওর?”

-আতিফের ঘরে গিয়ে দেখুন। মরার মতো পড়ে ঘুমাচ্ছে।”

মুনতাসীরের কপালে ভাঁজ পড়ল। মাতিম এই সন্ধ্যা বেলায় ঘুমাচ্ছে! জেসমিন মুনতাসীরের মুখের ভাব বুঝতে পেরে বলল,

-আমি শিওর জানি না। আবার এটাও ভাববেন না আমিই হয়তো ইচ্ছে করে করেছি। আমি ইচ্ছে করে কিছুই করিনি। যা হয়েছে তা ভুলবশত হয়েছে। না, ভাগ্যেই লেখা ছিল মনে হয়।”

-কী হয়েছে সেটা তো বলবে।”

-আমার মনে হয় আপনার ভাই ভুলে ঘুমের ঔষধ মেশানো শরবত খেয়ে ফেলেছে।”

-ঘুমের ঔষধ মেশানো শরবত!”

-হুম। আপনি তো আমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলেন। আমিও আপনার জন্য কিছু না করে থাকতে পারলাম না। তাই আপুর বিয়ে আটকাতে আপুকে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখার বুদ্ধিটাই মাথায় এলো।”

মুনতাসীর মাথায় হাত দিয়ে হায় হায় করে বলে উঠল,

-সর্বনাশ।”

-সর্বনাশ তো পুরোপুরি হয়নি। সাত আটটা না দিয়ে তিনটা মিশিয়েছিলাম। আপনার ভাগ্য ভালো আপু জেগে থেকে কবুল বলতে পেরেছে। কিন্তু আপনার ভাই পাঁচটা খেয়েছে। কাল সারাদিনেও উঠতে পারবে কিনা সন্দেহ।”

মুনতাসীর বিস্ময়ে কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। এই মেয়ের মাথায় এসব বুদ্ধি কোত্থেকে আসে? ধারার ঝিমুনীর কারণ এবার বুঝতে পারছে সে। ধারা হয়তো বুঝতেই পারছে না তার সাথে কী হচ্ছে। সত্যিই তার ভাগ্য ভালো ধারা শুধু ঝিমোচ্ছে। ঘুমিয়ে কাদা হয়ে পড়ে থাকেনি। কবুলটা তো বলতে পেরেছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, মাতিম কীভাবে ওই শরবত খেল?

-মাতিম কীভাবে ওই শরবত খেয়েছে?”

-আমি নিজেও জানি না। আপুকে পুরোপুরি ঘুম পাড়ানোর জন্য ওই শরবত আবার বানিয়েছিলাম। আপুকে খাইয়েই যেতাম যদি রোজী আপা আপুর সাথে না থাকতো। আতিফের মায়ের কাছ থেকে এসে দেখি ওই শরবতের গ্লাসটা যেখানে রেখে গিয়েছিলাম সেখানে নেই। ভয়ে ছিলাম কে না কে খেয়ে ফেলেছে। কিন্তু আপনার ভাইয়ের ভাগ্যেই ছিল এটা। গেটে শরবত খেয়েছিলেন না। কেউ হয়তো ওই শরবতটাও আপনাদের জন্য নিয়ে গিয়েছিল।”

ভাইয়ের জন্য সহানুভূতি হলেও মুনতাসীর মনে মনে না বলে পারল না। একটুর জন্য জান বেঁচে গেছে ওর। মানে মাতিমের জায়গায় ওই শরবত সে খেয়ে ফেললে অবস্থাটা কী হতো? মুনতাসীর বিছানায় পড়ে থাকা ভাইকে দেখল। এখানে এখন সে থাকতো। ধারার বিয়ে তখন কার সাথে হতো? বর তো মরে ঘুমাচ্ছিল। জেসমিনও এই কথাটা ভেবেই হাসতে লাগল,

-মুনতাসীর ভাই, আপনার ভাগ্য কতটা ভালো দেখেছেন? আপনার ভাই-ই কেন শরবতটা খেলো? আপনি কেন খেলেন না? কারণ আল্লাহ চেয়েছে আপনার বিয়ে আমার বোনের সাথেই হোক। তাই তো এত বাধাবিপত্তির পরেও আপনাদের বিয়েটা হয়েই গেল। আল্লাহ চাইলে যেভাবেই হোক কোন না কোন পথ খুলেই যায়।”
*******

ধারার বিদায়ের বেলা এসেছে। আদরের নাতনিকে বিদায় দিতে গিয়ে দাদীর চোখের পানি আটকানো কষ্ট হচ্ছে। আজ বাবার চোখেও পানি দেখল ধারা। জেসমিন কাঁদছে না। হাসি হাসি মুখে তাকে বিদায় দিচ্ছে। ওকে জড়িয়ে ধরে বলছে,

-আমি কাল সকালেই তোমাকে দেখতে আসব আপু।”

আতিফ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ওর কাছে আসছে না। ধারা ছেলেটাকে দেখল। এই ছেলে তার ভাই। তাদের বাবা আলাদা হলেও এক মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নিয়েছে ওরা। ধারা চাইলেও এই সত্য অস্বীকার করতে পারবে না। প্রথম যখন আতিফ তাদের বাড়িতে এসেছিল তখন ধারা ওকে একজন ভাড়াটিয়াই ভেবেছিল। কিন্তু দিন যাওয়ার সাথে সাথে ওর সন্দেহ হতে লাগল। শুধুমাত্র ভাড়াটিয়া না। এর বাইরেও আতিফের কোন পরিচয় আছে। অল্প দিনেই আতিফ তাদের এত আপন করে নিয়েছিল দেখেই সন্দেহ আরও গাঢ় হলো। আতিফের বাড়ি কোথায়, ওর বাবা মা কে তা খোঁজ করতে গিয়েই ধারা আতিফের আসল পরিচয় জানতে পারল। আতিফ তার মা’র ছেলে। বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার আরও এক বছর পর আতিফের জন্ম হয়। সম্পর্কে তার চাচা রূপী কলঙ্কিত ব্যক্তিটা এই দুনিয়ায় নেই। আতিফের বারো বছর বয়সে মারা গেছেন তিনি। মৃত ব্যক্তিটিকেও ধারা ক্ষমা করতে পারল না। এই লোক তার বাবার ভাই ছিল। সৎভাই হলেও বাবার বুকে এত বড় ছুরি বসানোটা তার উচিত হয়েছে কি? বড় ভাইয়ের বউয়ের সাথে পরকীয়ায় জড়িয়েছে। নিজের ছোট ছোট দুইটা ভাতিজিকে এতিম বানিয়ে তাদের মা’কে নিয়ে পালিয়ে গেছে। ওই মহিলাকেও আল্লাহ তার পাপের শাস্তিই দিচ্ছে হয়তো। মহিলার দুই কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে। মৃত্যুর আগেও মহিলা তাদের কথা ভাবছে না। স্বার্থপরের মতো নিজের ছেলের কথাই ভাবছে। তিনি মারা গেলে ছেলেকে কে দেখবে এই ভাবনা থেকেই ছেলেকে তাদের কাছে পাঠিয়েছে। ধারা কোনোদিনও এই দুইটা মানুষকে ক্ষমা করতে পারবে না। এদের কথা মনে হলে ধারার ঘৃণা হয়।
ধারা হাতের ইশারায় আতিফকে কাছে ডাকল। আতিফ যেন ওর ডাকের আশাতেই ছিল। সাথে সাথে আতিফ ছুটে এসে ধারাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কাঁদতে লাগল। ওর কান্না দেখে জেসমিন বিরক্ত মুখে ওকে দেখছে। তার নিজের বোনের বিয়ে সে কাঁদছে না। অথচ গাধাটা কেঁদে চোখের জলে সাগর বানিয়ে ফেলছে। আতিফ কিছু না বলে কেঁদেই যাচ্ছে। ধারা আলতো হাতে ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে নিচু গলায় বলল,

-তোমার উপর আমার কোন রাগ নেই আতিফ। তোমাকে আমি অপছন্দও করি না। তুমি যা যা করেছ তা হয়তো নিজের মা’র জন্যই করেছ। কিন্তু একটা কথা কী জানো আতিফ? চাইলেই পৃথিবীতে সব মানুষকে ক্ষমা করে দেওয়া যায় না। ক্ষমা মহৎ গুণ। তারপরও মাঝে মাঝে আমরা মানুষকে ক্ষমা করতে পারি না। হয়তো ক্ষমা করতে চাইও না।”

আতিফ ধারাকে ছাড়ল না। শক্ত করে ধরে রেখেই বলল,

-তোমার ক্ষমা পাওয়া কারো জীবনের শেষ ইচ্ছে এটা জানার পরও কি তুমি ওই মানুষটাকে ক্ষমা করবে না?

-ওই মানুষটাকে যেন আমি কোনোদিনও ক্ষমা না করি এটাও কারো জীবনের শেষ ইচ্ছে হতে পারে। এই কথাটা কি তুমি বিশ্বাস করবে? আর সেই মানুষটা এখন দুনিয়ায় নেই।”

আতিফ আর কিছুই বলতে পারছে না। সে ধারাকে ছাড়তে চাচ্ছে না। তার কেবলই মনে হচ্ছে ধারা আপুকে হারিয়ে ফেলবে সে। ধারা আপুকে কোনোদিনও নিজের আপু বানাতে পারবে না। ছেলেটার এরকম কাণ্ড দেখে সবাই অবাক। জেসমিন রেগেমেগে আতিফের পিঠে চড় লাগিয়ে দিয়ে বলল,

-গাধা কী করছিস? আপুকে ছাড়। আপু কি জীবনের জন্য চলে যাচ্ছে? ছাড় বলছি। আপুকে দুলাভাইয়ের সাথে যেতে দে। দরকার পড়লে তুইও আপুর সাথে চলে যা।

চলবে_