এক বরষায় পর্ব-১৩+১৪

0
576

#এক_বরষায় [১৩]
লেখনীতে_জেরিন আক্তার নিপা

জেসমিন ওই কথা শোনার পর থেকে তার মুখে অন্য কোন কথাই নেই। সে সারাটা দিন মুনতাসীরকে নানান প্রশ্ন করে পাগল করে দিচ্ছে। কলেজে যাওয়ার সময়ও অনেক প্রশ্ন করেছে।

-আপনি আমাদের চিনতেন তাহলে বলেননি কেন মুনতাসীর ভাই?’

-তুমি তো আমাকে মনে রাখোনি।’

-কীভাবে রাখব। আমি তো তখন ছোট ছিলাম।’

-এখনও তুমি ছোটই আছো।’

-আমার বয়স তখন কত ছিল মুনতাসীর ভাই?’

-চার/পাঁচ হবে হয়তো।’

-এ মা! তাহলে তো অনেক ছোট ছিলাম।’

-আপুর কথাও তো আপনার মনে ছিল, না?’

-হু।’

-তাহলে আপুর সাথে কথা বলেন না কেন আপনি?’

এই প্রশ্নের জবাবে মুনতাসীর কিছু বলল না। উত্তর না পেয়েও জেসমিন প্রশ্ন করতে থামছে না।

-আপু তখন কত বড় ছিল?’

-ক্লাস থ্রি-তে পড়ত।’

-তাহলে তো মোটামুটি বড়ই ছিল। আপনি তখন কত বড় ছিলেন? কোন ক্লাসে পড়তেন?’

-টেন।’

-অনেক বড়।’

-আপনি আমার থেকে কত বছরের বড় হবেন?’

-তুমি নিজেই হিসেব করে বের করো।’

-দূর এত পেঁচি হিসাব টিসাব আমার দ্বারা হবে না।’
আমার দাদা ওখান থেকে কেন চলে এসেছিল বলতে পারবেন?’

মুনতাসীর থামলো। জেসমিনের দিকে দেখে বলল,

-বাচাল মেয়ে আমার ক্লাসের দেরি করিয়ে দিচ্ছ তুমি। চাকরি গেলে তখন আমি খাব কী? সারাজীবন কি আমাকে তোমাদের বাড়িতে থাকতে দিবে?’

জেসমিন জিভ কামড় দিল। বলল,

-থাকলে নাহয় থাকলেন। আমাদের কোন সমস্যা নাই। বাকিটুকু ছুটির পরে কিন্তু বলবেন।’

ছুটির পরেও এই মেয়ে তাকে শান্তি দিল না। এখন বাড়ি এসেও শান্তি দিচ্ছে না। তার ঘরে এসে খুঁটি গেড়ে বসেছে। সে বলেও পাঠাতে পারছে না। শেষে মুনতাসীর হতাশ হয়ে বলল,

-আর কী জানতে চাও তুমি? সবই তো বললাম।’

-আপু তাহলে আপনাকে চিনে না কেন?’

-সেটা আমি কীভাবে বলব? তোমার আপুই তো ভালো বলতে পারবে। ওকে গিয়েই জিজ্ঞেস করো।’

-আপনার মনে হয় আমার বোন আমার কোন কথার উত্তর দিবে? উল্টো এসব জিজ্ঞেস করতে গেলে গালে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিবে।’

-বোনকে এত ভয় পাও কেন?’

-পাব না? ওটা তো একটা শাঁকচুন্নি। তেঁতুল গাছের ভূত্নী। আচ্ছা মুনতাসীর ভাই, আপু কি ছোটবেলাও এরকমই ছিল?’

-না।’

-কেমন ছিল?’

-জেসমিন তুমি কিন্তু আজ প্রচণ্ড বিরক্ত করছো।’

-আপু তাহলে এমন হয়ে গেল কেন? কেমন মাস্টারনি সেজে থাকে। ওর এমন হওয়ার পেছনের কারণ জানতে চাই আমি।’

-তোমার ছোট মাথা এত খাটাতে হবে না। এই ব্রেইনটুকু পড়ায় কাজে লাগিও।’

-আপনি আপুর সাথে কথা বলেন না কেন? আর আপুকে আপনি, আপনি করে ডাকেন কেন? ছোটবেলা তো নিশ্চয় তুই ডাকতেন।’
_______________

-আপু মুনতাসীর ভাইয়ের সাথে তুই কথা বলিস না কেন?’

-কথা বলার দরকার পড়ে না তাই।’

-ওকে তো তুই চিনতি। এখন কি সত্যি সত্যিই ভুলে গেছিস?’

-হ্যাঁ।’

-তোর স্মৃতিশক্তি এত খারাপ কেন? এভাবে কীভাবে ভুলে গেলি! আমাদের ওখানে থাকার কথা তোর কিছুই মনে নেই?’

-না।’

-তোর কথা মুনতাসীর ভাইয়ের মনে আছে।’

এই পর্যায়ে এসে ধারা রেগে গিয়ে বলল,

-মনে আছে এখন আমার কী করতে হবে? উনাকে মাথায় তুলে নাচব?’

-নাচতে বলেছে কে? তুই এত রেগে যাচ্ছিস কেন?’

-কারণ তুই আমাকে বিরক্ত করছিস। একটা কাজে তো হাত দিতে পারিস না। সবকিছু আমাকে একা একা করতে হয়। কাজের সময় এসে আবার ঝামেলা করিস। আমিও তো মানুষ। কোন রোবট তো নই।’

কাজের জন্য আপু কোনদিন তাকে এভাবে বলেনি। আজ বলাতে একটু খারাপ লাগল। মুখ ভার করে বাইরে চলে গেল। জেসমিনকে এভাবে বলে ধারারও খারাপ লাগছে। সে আর পারছে না। দাদী পুরোনো কথা কেন তুলতে গেল। আগেই তো সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। বোনের কথায় কষ্ট পেয়ে সেদিন জেসমিন সব কাজ করল।

উঠান ঝাড়ু দিল। কলতলায় যে থালাবাসন ছিল সব নিজেই মাজল। ঘর থেকে তার কাপড় ধারার কাপড় সব এনে সাবান লাগিয়ে কেঁচে দিল। ধারা বোনের কাজকর্ম সব দেখেছে। কিন্তু কিছু বলেনি। দুপুরের রান্নাও জেসমিনই করতে গিয়েছিল। কিন্তু কীভাবে রাঁধতে হয় এটাই জানে না সে। জীবনে কোনদিন তো রান্নাঘরে ঢুকেনি। তারপরও যেভাবে সেভাবে ভাত বাঁধতে পারল। কিন্তু ভাতের মাড় ফেলতে গিয়ে হাত পুড়িয়ে বসে রইল। গরম মাড় হাতে পড়লে চিৎকার চেঁচামেচি করে জেসমিন বাড়ি মাথায় তুলল। ধারা রাগ করে কাছে যাবে না ভেবেও বোনকে কষ্ট পেতে দেখে গেল। কলে এনে হাতে পানি দিতে দিতে বলল,

-অনেক জেদ বেড়ে গেছে। কাজ করবি কর। আমি বাধা দেব না। তোর রাগ দিয়ে আমার কিছু যায় আসে না। হাত না পুড়িয়ে পুরো শরীর পুড়িয়ে ফেলতি। আমার কী? আমি তোর কে? কেউ না। এটা তুই প্রমাণ করে দিলি। ছোট থেকে এইজন্যই তো তোকে আগলে রেখে বড় করেছি। মা’র অভাব কোনোদিনও বুঝতে দেইনি। বোন হিসেবে যতটা করার ছিল তার থেকে বেশি করেছি। তোকে কিছু বলার আমি কে? তোকে শাসন করার অধিকার আমার থাকলে তো! আর কোনোদিন তোকে কিছু বলব না। নিজের মতো চলবি তুই। আজ যেমন সব কাজ করলি। এখন থেকে প্রতিদিন সেভাবে নিজের কাজ করবি। বোনের প্রয়োজন এখন ফুরিয়েছে তোর। তুই বড় হয়ে গেছিস এটা আমার বোঝা উচিত ছিল। ভুল আমারই।’

জেসমিন হাত পুড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা ভুলে গিয়ে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতেই বলল,

-তুই তো এখনও আমাকে বকছিস। আমাকে কেউ ভালোবাসে না। তুইও না। চলে যাব আমি এই বাড়ি থেকে।’
*****

নয়ন ভাই সে ঘটনার পর প্রথম কয়েকদিন ধারার সামনে আসেনি। যদিও কখনও ধারার সামনে পড়ে গেছে কিছু না বলেই তাৎক্ষণাৎ ওখান থেকে চলে গেছে। কিন্তু এরকমটা কিছু দিনই হলো। তারপর যে ছিল সে-ই। আবার প্রতিদিন দোকানের সামনে এসে বসে থাকতে লাগল। ধারা ভার্সিটি যাওয়ার সময় রিকশা ডেকে দেয়। ধারার সন্দেহ কুকুরের লেজ সোজা হয়ে গেলেও নয়ন ভাই সোজা হবে না। যতদিন না বিয়ে করে সে এই পাড়া থেকে চলে যাচ্ছে ততদিন নয়ন ভাই এসব করেই যাবে। একদিন বিরক্ত হয়ে সে বলেছিল,

-আপনি না ভালো হয়ে গেছিলেন নয়ন ভাই? আবার এই অধঃপতনের কারণ কী?’

নয়ন লজ্জা পেয়ে মাথা চুলকিয়ে উত্তর দিয়েছে,

-আমি জানি তোমার মন কোনোদিনও আমার প্রতি গলবে না। তবুও আমি এই কাজগুলো করতে চাই। এতে আমি শান্তি পাই ধারা। তুমি অন্তত আমার এই শান্তিটুকু কেড়ে নিও না। আমি তো তোমাকে উত্যক্ত করছি না। আর ভয় পেও না। আমি তোমার বিয়েও ভাঙব না।’

-আপনি ভাঙতে চাইলেও পারবেন না। আমার কপালে আল্লাহ যাকে লিখে রেখেছে সে আসবেই। কিন্তু আপনি কেন আপনার সময় নষ্ট করছেন?’

-সময় নষ্ট না। আমার সুখের খোরাক জোটাচ্ছি।’

-আপনার যা খুশি করেন। আপনাকে আমার আর কিছু বলার নেই। যে ভালো কথায় বুঝে না সে খারাপ কথায়ও বুঝবে না।’

-তুমি আমার উপর রাগ কোর না ধারা। আমি চেয়েছি কিন্তু পারিনি। কয়দিন তো চেষ্টা করে দেখলাম।’

-রাগ করছি না। আপনার উপর আমার করুণা হচ্ছে। এখন একটা রিকশা ডেকে দিন তো।’

ধারার এই কথায় নয়ন খুশি হয়ে গেল। ধারা নয়ন ভাইকে দেখছে। কেউ কি সত্যিই কাউকে এতটা নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসতে পারে? ভালোবাসা বলে কি সত্যিই কিছু আছে? তার খুব জানতে ইচ্ছে করে নয়ন ভাইয়ের কাছে ভালোবাসার মানে কী? চারটা বছর সে নয়ন ভাইয়ের দিকে ফিরেও তাকায়নি। তারপরও মানুষটা একটা দিনের জন্য তাকে ভুলেনি। এইযে এখন এসব করছে ধারাকে কোনোদিনও পাবে না জেনেই তো করছে। একেক মানুষের কাছে ভালোবাসা একেক রূপের হয়। কেউ পাবে না জেনেও ভালোবেসে যায়৷ কেউ ভালোবাসা পেয়েও ছেড়ে চলে যায়। তার দেখা মানুষের চরিত্র কত ভিন্ন হতে পারে। তারা মধ্যবিত্ত ছিল। হয়তো অনেক টাকা ছিল না। কিন্তু বাবার ভালোবাসার কি কোন কমতি ছিল? তারপরও ওই মানুষটা কীভাবে স্বামীর ছোট ভাইয়ের চোখে নিজের জন্য ভালোবাসা দেখতে পেলো? এগারো বছরের সংসার জীবনে কি বাবার ভালোবাসায় এতটাই কমতি ছিল যে, মানুষটা এগারো বছরের সম্পর্ক পায়ে ঠেলে কয়েক মাস বা বছরের সম্পর্কটাকে আপন করে নিল। নিজের দুইটা সন্তানকে পিছনে ছেড়ে যেতেও মন কাঁদল না! সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসায় কি কোন খাদ থাকতে পারে? মায়ের ভালোবাসা নাকি নিঃস্বার্থ হয়। তাহলে ওই মহিলা কেমন মা ছিলেন যে সন্তানের কথাও ভাবলেন না।
*****

রুমকি কাঁদছে। জেসমিন যতই ওকে বোঝাচ্ছে তার কান্না আরও বেড়ে যাচ্ছে। ধারা ঘরে ছিল। রুমকির কান্না শুনে বেরিয়ে এলো।

-কী হয়েছে তোর? কাঁদছিস কেন তুই?’

রুমকি কান্না না থামিয়েই চোখ তুলে ধারাকে দেখল। জেসমিন বলল,

-আপুকে বল। আপু রুমকির বাবা নাকি ওর বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। তাই ও কাঁদছে।’

-বিয়ে ঠিক করেছে এতে কান্নার কী আছে? বিয়ে তো খারাপ কিছু না।’

কাঁদতে কাঁদতে রুমকি বলল,

-কিন্তু আমি বিয়ে করতে চাই না ধারা আপু।’

-কেন চাস না? বয়ফ্রেন্ড আছে নাকি?’

-না।’

-তাহলে বিয়ে করবি না কেন?’

-আমি এখন বিয়ে করব না। আরও পড়তে চাই আমি।’

-বিয়ের পরে কি পড়া যায় না?’

-ওরা আমাকে পড়াতে দিবে না।’

-পড়তে দিবে না কেন? বুঝিয়ে বললেই দিবে।’

-তারপরও আমি বিয়ে করব না।’

-কেন সেটা তো বলবি৷ পছন্দের কেউ আছে? তাকে বিয়ে করবি?’

রুমকির কান্নার গতি বেড়ে যাচ্ছে। বোনকে পুলিশের মতো জেরা করতে দেখে জেসমিন রেখে গিয়ে বলল,

-আপু তুই যা তো এখান থেকে। তোর জন্য ও আরও বেশি কাঁদছে। যা করার আমিই করব। তুই যা।’

-তোরা বাচ্চা বাচ্চা মেয়ে কী করবি?’

-রুমকির বিয়ে ভাঙব।’

-একদম না। রুমকির ভালো ওর বাবা মা’র থেকে আমরা বেশি বুঝি না। তুই বাড়ি যা রুমকি। বাবা মা যা করে ভালোর জন্যই করে। আর ওরা তো তোর বাল্যবিবাহ দিচ্ছে না। আঠারো তো হয়েছেই তোর।’

রুমকি কান্না থামিয়ে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বলল,

-আমার বাবা মা আমার ভালো চায় না ধারা আপু। ওরা আমার খারাপ চায়। নইলে কি আর বাবার মতো বয়সী একটা লোকের সাথে আমার বিয়ে দিতে চায়? ওই লোকটা আগেও একটা বিয়ে করেছে। ওই বউয়ের ঘরে কোন বাচ্চা হয়নি। তাই আমাকে বিয়ে করছে। বাবা মা সব জানে। জেনেও বিয়ে দিচ্ছে কারণ ওদের অনেক টাকা। টাকা দিয়েই মেয়ের সুখ হবে ভাবছে। আমি মরে যাব ধারা আপু। তবুও এই বিয়ে করব না। ওই লোককে বিয়ে করে মরার চেয়ে এখনই মরে যাব।

চলবে_

#এক_বরষায় [১৪]
লেখনীতে_জেরিন আক্তার নিপা

—————
রুমকি চলে গেলে ধারা জেসমিনকে জিজ্ঞেস করল,

-কবে ওর বিয়ে?’

-আজ রাতেই নাকি।’

-বোকাটা সত্যি সত্যিই সুইসাইড ফুইসাউড করবে নাকি?’

-ধারা আপু তুমি রুমকিকে চেনো না। ও একটা পাগল। ও কিন্তু সত্যি সত্যিই মরে যাবে।’

-মরে গেলে যাবে। নিজের জীবনের মূল্য না থাকলে মরবে। জীবন যদি ওর কাছে সস্তা মনে হয় তাহলে আর কী করার।’

-তুমি কিছু করবে না?’

-আমি কী করব? ওর মা আমাদের দু-চোখে দেখতে পারে না। মেয়ের বিয়ে নিয়ে কিছু বলতে গেলেই ঝগড়া বাধিয়ে দিবে।’

ধারা জেসমিনকে এই কথা বললেও নিজে শান্তি পাচ্ছিল না। এটুকু একটা মেয়ে। সেদিন স্কুল পাস করে কলেজে ভর্তি হলো। এখনই এর বিয়ে দিতে হবে কেন? বিয়ের বয়স তো আর চলে যাচ্ছে না। তার উপর ওর থেকে বয়সে অনেক বড় একটা লোকের সাথে বিয়ে দিচ্ছে। লোকটা আবার আগে থেকে বিবাহিত। বাবা মা-রা কী ভাবে কে জানে? টাকাই কি সব? মনের সুখ কিচ্ছু না! মেয়েটার মতামত একবারও শুনবে না ওরা। নিজেরা যা ভালো মনে করে সন্তানের উপর চাপিয়ে দিবে।
ধারা কী করতে পারবে ভেবে না পেয়ে আতিফকে দিয়ে নয়ন ভাইয়ের কাছে খবর পাঠালো। নয়ন বাড়িতেই ছিল। আতিফ এসে যখন বলল,

-নয়ন ভাই ধারা আপুর নাকি তোমার সাথে জরুরি কথা আছে। তোমাকে এক্ষুনি যেতে বলেছে। আপু দোকানের কাছে দাঁড়িয়ে আছে।’

এই কথা শুনে নয়ন কোনকিছু ভাবার সময় পেল না। ধারা তাকে খবর দিয়েছে! তার সাথে দেখা করে কিছু বলতে চায়! খালি গায়েই বেরিয়ে পড়ছিল সে। আতিফ মনে করিয়ে দিয়ে বলল,

-একটা গেঞ্জি পরে নাও।’

গেঞ্জি পরতে পরতে দৌড়ে দোকানের দিকে আসতে লাগল নয়ন। পথে কয়েকবার হুঁচট খেয়েও দাঁড়াল না। ধারা মাথায় ওড়না দিয়ে দোকানটার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ তাকে এখানে দেখে ফেললে নানান কথা বানাবে। নয়ন যখন ধারার কাছে পৌঁছুলো ওর নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছে। ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারছে না। তাকে এভাবে হাঁপাতে দেখে ধারা বলল,

-বড় বড় করে দম নিল। মুখ খুলে শ্বাস টানুন। হ্যাঁ, হ্যাঁ। এভাবে দৌড়ে এসেছেন কেন? আমি তো চলে যাচ্ছিলাম না।’

হাঁপাতে হাঁপাতেই নয়ন বলল,

-তুমি অপেক্ষা করছিলে।’

ধারা যতবার নয়ন ভাইয়ের সামনে দাঁড়ায় নিজেকে অপরাধী লাগে।

-আতিফ বলছিল কী যেন বলবে।’

-বলছি। আগে আপনি ঠিকভাবে শ্বাস টানতে পারুন।’

ধারা রুমকির কথা সবটা নয়নকে বলল। নয়নের মুখ দেখে মনে হচ্ছে ও কিছুটা নিরাশ হয়েছে।

-এই কথাই বলার ছিল?’

-হ্যাঁ।’

-রুমকির কথা বলার জন্যই ডেকেছিলে?’

ধারা বুঝল নয়ন ভাই কী ভাবছিল। ধারা উপরে উপরে রাগ দেখিয়ে বলল,

-আর কোন কথা বলার জন্য ডাকব আপনাকে? আপনি তো জানেনই আপনার সাথে আমার কোন কথা নেই। জেনেও এখন তাহলে নিরাশ হচ্ছেন কেন?’

-কী করতে হবে আমাকে?’

-কী করবেন বুঝেন না। এতদিন যেভাবে আমার বিয়ে ভাঙতেন সেভাবেই রুমকির বিয়েটাও ভাঙবেন।”

-শুধু কি বিয়েই ভাঙব? ওর বাপ হালাটাকে একটু টাইট দিব না? মেয়ের বিয়ের এত তাড়া কেন? আর ওই বুড়ার বিয়ের শখ মিটিয়ে দেব আজ।’

-যা ইচ্ছা করেন। শুধু এসবে যেন আমার নাম না জড়ায়।’

ধারার কথায় নয়ন আহত হলো।

-তুমি না বললেও আমি তোমার নাম জড়াতে দিতাম না।’

-আপনি তো জেসমিনকে তুই করে বলেন। আমাকে তুমি কেন তাহলে? আমাকেও তুই করে বলবেন।’

নয়নের মুখটা ছোট হয়ে গেল। ধারাটা এত পাষাণ কেন? তুমি করে ডাকার অধিকারটাও নিয়ে নিচ্ছে!

-তুই না বললে হয় না?’

-না। তুই ডাক পৃথিবীর সবথেকে আপন ডাক জানেন তো! আমি কি আপনার পর নাকি? তুমি ডেকে আমাকে কেন পর করে রাখবেন?’

মুনতাসীর বাড়ি ফিরছিল। দোকানের পেছনে ধারাকে নয়নের সাথে দেখে নিল সে। নয়নের সাথে কথা বলছে অথচ ধারার মুখে হাসি! ধারা দোকানের পেছনে গিয়েই বা নয়নের সাথে কী কথা বলছে? হঠাৎ নয়নের সাথে ওর সম্পর্ক এত ভালো হয়ে গেল কীভাবে? তার সাথে তো এখন পর্যন্ত একটা শব্দ ব্যয় করেনি। আতিফ মুনতাসীরকে দেখে ধারাকে ডাকল,

-আপু মুনতাসীর ভাই বাড়ি যাচ্ছে।’

ধারা তাড়াহুড়ো করে চলে আসতে নিচ্ছিল। নয়ন ওকে একটা প্রশ্ন করে থামিয়ে দিল,

-ওই মাস্টার এতদিন ধরে তোমাদের, তোদের বাড়িতে থাকছে কেন?’

-বাবার মেহমান উনি।’

-মেহমান কি আজীবনের জন্য চলে এসেছে?’

-ভাড়া বাড়ি খুঁজছেন তিনি। পেয়ে গেলেই চলে যাবে।’

-ওর সাথে তুমি, না তুই কথা বলিস?’

-নয়ন ভাই, আপনি যা ভাবছেন তেমন কিছুই না। আমাকে কি আপনার এরকম মেয়ে মনে হয়? অন্য কিছু না ভেবে আপনাকে যা করতে বলেছি করুন। আমি এখন যাচ্ছি।’

ধারা বাড়ি আসার পথে আতিফকে জিজ্ঞেস করল,

-উনি কি আমাদেরকে দোকানের পেছনে দেখেছে?’

-মনে হয় দেখেছে। এদিকেই তো তাকিয়ে ছিল।’

-ওহ।’ ধারা আর কিছু বলল না। সবটুকু ঘটনা না জেনে তার সম্পর্কে কেউ অন্য কিছু ভেবে নিলে এতে তার কিছু করার নেই। নয়ন ভাইয়ের সাথে কাজের কথা বলছিল সে। প্রেমের কথা না।’
*****

ধারা, জেসমিন, মুনতাসীর একসাথে রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। আজ রাস্তায় একটা রিকশাও নেই। জেসমিন মুনতাসীরের পাশে দাঁড়িয়ে নানান গল্প করে যাচ্ছে। ধারা ওদের থেকে কিছুটা দূরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। জেসমিনকে দেখছে সে। এটা তার আপন বোন কেউ বলবে? বোনকে একা ফেলে রেখে অন্য একটা লোকের সাথে কী আলাপ জুড়ে দিয়েছে। সে-ও যে এখানে আছে তা খেয়ালই করছে না। জেসমিন হাসতে হাসতে বলল,

-কাল আপনি ওই আটার বস্তাটাকে যা টাইট দিয়েছেন না! ওই মুটি আর কোনদিন ক্লাসে বড়াই করতে পারবে না।’

-আমার ক্লাসে তুমি কোনোদিন পড়া না পারলে তোমাকেও একইরকম শাস্তি দেব।’

-তখন আমি আর কোনোদিন আপনার সাথে কথা বলব না।’

-কেন? বাড়িতে আমি তোমার আত্মীয় হলেও কলেজে শুধুমাত্র তোমার টিচার। টিচার তার সব স্টুডেন্টকেই পড়া না পারলে শাস্তি দেয়।’

-তারপরও আমি আপনার উপর রাগ করব।’

নয়ন অনেকটা সময় ধরে দোকানে বসে জেসমিনকে দেখছে। জেসমিন কি ওই লোকটার দলে নাম লিখিয়ে নিয়েছে! ওই পল্টিবাজ মেয়েকে আর কোনোদিনও একটা টাকা ধার দিবে না সে। ধার ধার করে বলে নিয়ে গিয়ে আজ পর্যন্ত এক পয়সাও ফেরত দেয়নি। স্বার্থপর মেয়ে সব ভুলে গিয়ে ওই লোকের দলে চলে গেছে!

-মুনতাসীর ভাই আপনি জানেন, আমাদের ক্লাসের অনেক মেয়েই কিন্তু আপনাকে পছন্দ করে।’

মুনতাসীর অবাক হওয়ার ভান করে বলল,

-তাই নাকি!’

-হ্যাঁ। ইভা, মিলি, রত্না… উম আরও থাকতে পারে। পাঁচটা মেয়ে আমাকে আপনার কথা জিজ্ঞেস করেছে। ওরা কীভাবে যেন জেনেছে আপনি আমাদের বাড়িতে থাকেন। আমার সাথে ভাব করতে চায়। দেখেছে তো আমি আপনার সাথে যাওয়া আসা করি।’

মুনতাসীর কিছু বলছে না। পাশ থেকে ধারার ইচ্ছে করছে তার এই বাচাল বোনটার ঠোঁটে সুপার গ্লো লাগিয়ে দিতে। কার সাথে কী কথা বলতে হয় কিচ্ছু জানে না। পাগলের মতো আবোলতাবোল বলতেই থাকে।

-ওরা প্রথমে ভেবেছিল আপনার সাথে আমার কিছু চলছে। পরে যখন জানলো আমি আপনাকে ভাই ডাকি। আপনি আমার ভাই হোন, তখন ওদের ভুল ভেঙেছে। মিলি আপনার নাম্বারের জন্য আমাকে পাগল করে দিচ্ছে মুনতাসীর ভাই। কিন্তু আপনার নাম্বার আমি ওকে দিইনি। মিলিকে আমার একদম পছন্দ না।’

-এসব মেয়েদের থেকে তুমি দূরে থাকবে জেসমিন। যাদের যাদের নাম বললে তাদের সাথে যেন তোমাকে আমি আর না দেখি।’

-আরে শুনুন না, ওদের আমি কি বলেছি জানেন? বলেছি আপনার বিয়ে ঠিক। যে মেয়েকে আপনি পছন্দ করতেন তার সাথেই আপনার বিয়ে হবে।’

এই কথা শুনে মুনতাসীর বিষম খাওয়ার মতো কাশতে লাগল। ধারা ঝট করে একবার মুনতাসীরের দিকে দেখল।

-পাগল মেয়ে, এসব কী বলেছ তুমি!’

-কেন খারাপ কী বলেছি? নইলে ওরা আপনাকে জ্বালাতন করতো। আমি ওদের হাত থেকে আপনাকে বাঁচিয়ে দিয়েছি। আমি ভালো কাজ করিনি মুনতাসীর ভাই?’

নয়ন আর দোকানে বসে থাকতে পারল না। সে এবার ভয়ে ভয়ে ধারার কাছে এগিয়ে এলো। দূর থেকে বলল,

-রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছো ধারা?’

ধারাও উত্তর দিল।

-হুম।’

নয়ন আশেপাশে দেখল। চিন্তিত গলায় বলল,

-রিকশা মনে হয় নেই৷ ঠিক আছে আমি ব্যবস্থা করছি।’

-একটু তাড়াতাড়ি করুন নয়ন ভাই। আমার ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

জেসমিন নিজের চোখ, কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। আপু নয়ন ভাইয়ের সাথে এত ভালো করে কথা বলছে! সে কানে ভুল শুনেনি তো? নয়ন কাউকে ফোন দিল। দু’মিনিটের ভেতর এদিকে একটা রিকশা পাঠাতে বলল। ফোন রেখে গলা নামিয়ে নয়ন ধারাকে জিজ্ঞেস করল,

-রুমকির ব্যাপারটা সমাধান করে দিয়েছি। ওর বাপ দুই বছর আগে আর মেয়ের বিয়ের নাম নিবে না।’

ধারা হেসে বলল,

-ধন্যবাদ নয়ন ভাই।’

জেসমিন হতভম্ব চোখে ওদের দু’জনকে দেখছে। মুনতাসীরের শার্টের হাতা টেনে অবিশ্বাস্য গলায় বলল,

-মুনতাসীর ভাই, ওখানে কি আপনি আমার আপু আর নয়ন ভাইকে দেখতে পাচ্ছেন? ওরা কি কথা বলছে? নাকি আমি ভুল দেখছি। আমার চোখের সমস্যা হতে পারে। নয়ন ভাইয়ের সাথে ধারা আপু জীবনেও কথা বলে না। আর এত মিষ্টি গলায় হেসে হেসে তো কিয়ামতের দিনও বলবে না। ধারা আপু কি মাথায় আঘাত পেয়ে বাংলা ছবির নায়িকাদের মতো আগের কথা ভুলে গেছে!’

রিকশা এলে ধারা উঠে বসল। জেসমিন এখনও পুরো ঘটনা হজম করে নিতে পারেনি। ধারা ওকে ডাকল,

-যাবি না তুই?’

জেসমিন পাশে দাঁড়ানো মুনতাসীরকে দেখে বলল,

-কিন্তু মুনতাসীর ভাই?’

-তাহলে পরে আয় তুই।’

কথাটা বলেই ধারা রিকশা ওয়ালাকে চলে যেতে বলল। মুনতাসীর, জেসমিন দু’জনই হতবুদ্ধি হয়ে চেয়ে আছে। নয়ন জেসমিনকে দেখিয়ে শিস বাজাতে বাজাতে চলে গেল।

-এটা কী হলো মুনতাসীর ভাই? আপু কি নয়ন ভাইকে পছন্দ করতে শুরু করেছে? কবে থেকে? আমি তো কিছু জানি না।’

চলবে_