#এক_বরষায় [১৯]
#লেখনীতে_জেরিন_আক্তার_নিপা
—————-
ধারা সাদা ব্লাউজের সাথে আকাশি রঙের একটা শাড়ি পরেছে। সে ভালো রেজাল্ট নিয়ে এইচএসসি পাস করার পর এই শাড়িটা তাকে বাবা এনে দিয়েছিল। খুশিতে ধারার সেদিন চোখে পানি এসে গিয়েছিল। তাদের দুই বোনের জীবন বাকি সবার মতো স্বাভাবিক না। মায়ের ভালোবাসা কখনও পায়নি ওরা। বাবা থেকেও যেন না থাকার মতো। দাদা, দাদী না থাকলে ওরা আজ কোথায় থাকতো কে জানে? তাদের কথা কেউই ভাবে না। বোঝ হওয়ার পর থেকে ধারা নিজেই নিজের প্রয়োজনের দিকটা দেখেছে। মাধ্যমিক দেওয়ার পর একটা দিনও বসে থাকেনি। টিউশনি করিয়ে নিজের সাথে জেসমিনের চাহিদাও মিটিয়েছে। বাবা মুখেই শুধু বলে ব্যবসা করে। কিন্তু ধারা তো জানে বাবার কোন ব্যবসা নেই। কোন কাজও করে না। বাবার আয়ের উৎস কোথাথেকে আসে তা ধারা ভালো করেই জানে। ওসব হারাম টাকা ছুঁতে ইচ্ছে করে না তার।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধারা আয়নার সামনে থেকে সরে এলো। তার নিজের চেহারা সে খুব একটা দেখতে চায় না। যাকে ধারা এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে এই মুখের সাথে ওই মানুষটার ভীষণ মিল আছে। কেন ধারা ওই মানুষটার মতো দেখতে হলো?
দাদী মুগ্ধ নয়নে ধারাকে দেখে বলল,
-মাশা-আল্লাহ! আমার নাতিটারে রাজকন্যার মতো লাগতাছে।”
দাদীর কথায় ধারা হেসে জবাব দিল,
-আমাকে রাজকন্যা বললে সত্যিকারের রাজকন্যাদের অপমান করা হবে দাদী। রাজকন্যা হবার কোন গুণ আমার মাঝে নেই। সেই কপাল নিয়েও আসিনি আমি।”
দাদী তার কথায় পাত্তা দিল না। তিনি তো জানেন তার এই নাতনি কোন অংশে রাজকন্যার থেকে কম না।
-মুখে একটু পাউডার লাগাবি না? ঠোঁটটা একটু লাল কর।”
-কেন? এক্ষুনি না বললে আমি রাজকন্যা। রাজকন্যাদের কি কৃত্রিম সৌন্দর্যের দরকার পড়ে?”
-অনেক কথা জানস তুই। তোর লগে আমি পারমু না। হাত খালি রাখবি নাকি? কয়টা চুড়িই পর।”
দাদী ধারাকে জ্বালিয়ে মারে। তাকে সাজতে দেখার এত শখ কেন এই মহিলার? ধারা দাদীর সাথে আর তর্ক করল না। জেসমিন রোজী আপার সাথে পার্লার থেকে সেজে আসবে। সেজন্য অনেকক্ষণ আগে ওবাড়িতে চলে গেছে। এই মেয়ের বাড়িতে এত কিছু থাকতে পার্লারে গিয়ে সাজতে হবে কেন কে জানে! জেসমিনের অনেক চুড়ি আছে। মেয়েটা চুড়ি পাগল। জীবনে চুড়ি কেনার পেছনে কত টাকা যে খরচ করেছে! ওখান থেকেই ধারা সাদা আর আকাশি কালার মিলিয়ে ডানহাত ভর্তি করে চুড়ি পরে নিল। কাচের চুড়ি পরার সমস্যা একটাই। একটু হাত নাড়াচাড়া করলেই টুংটাং শব্দ হয়। দাদীর দিকে ফিরে হাত উঁচিয়ে চুড়ি দেখিয়ে বলল,
-এবার খুশি?”
-হ। বাড়িতে কামের বেডি সকিনা সাইজা থাকস ভালো কথা। কোনদিকে গেলে একটু সাইজা টাইজা যাইস।”
-কেন? আমাকে কি পাত্রী দেখবে নাকি?”
-দেখতেও পারে। মাইয়া হইয়া জন্ম নিছস একদিন না একদিন পরের বাড়ি যাইতেই হইব।”
আতিফ ধারাকে ডাকতে ডাকতে ঘরে চলে এলো।
-তোমাদের এখনও হয়নি? কখন যাবে? বাহ ধারা আপু! তোমাকে তো হেব্বি সুন্দর লাগছে।”
ধারা ভুরু বাঁকিয়ে বলল,
-তোমাকে বারণ করেছি না এসব শব্দ ব্যবহার করবে না। জেসমিনের সাথে থেকে থেকে ওর সব খারাপ গুণ নিজের মধ্যে নিয়ে আসছো।”
-সরি ধারা আপু। তোমাকে অপূর্ব লাগছে।”
ধারা দাদীকে লাঠি এগিয়ে দিল। দাদী এখন এই লাঠিতে ভর দিয়েই হাঁটে। আতিফ দাদীর একটা হাত ধরে সাহায্য করছে। ওরা ঘর থেকে বেরুলে দাদী মুনতাসীরের ঘরের দিকে তাকিয়ে বলল,
-ওই পোলা যাইব না?”
আতিফ উত্তর দিল,
-যাবে। নয়ন ভাই মুনতাসীর ভাইকেও কার্ড দিয়ে দাওয়াত দিয়েছে।”
-অরেও ডাক। সবাই এক লগে যাই।”
এই পর্যায়ে ধারা বলল,
-আমরা যেতে থাকি না দাদী। উনার হয়ে গেলে তো উনি আসবেনই।”
-এক বাড়ি থেইকা যাইতাছি, এক লগে যাই।”
ধারা আর কিছু বলল না। তাকে অস্বস্তিতে ফেললে দাদীর মনে হয় ভালো লাগে। কাল রাতেও লোকটা যা করেছে! ধারা চাইলেও এখন আর উনার সাথে স্বাভাবিক থাকতে পারবে না। এতদিন তো বোবা হয়ে থাকত। এখন কেমন টিটকারির সুরে কথা বলে। ধারার অসহ্য লাগে।
মুনতাসীর আজও ক্যাবলা কান্তের মতো ধারার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা তার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছে নাকি? রোজ রোজ এভাবে শাড়ি পরে সামনে এলে তার যে সবকিছু উলটপালট হয়ে যাবে। ধারা অস্বস্তিতে কারো দিকেই তাকাতে পারছে না। দাদী মুনতাসীরের চোখের ভাষা বুঝতে পেরে মিটিমিটি হাসল। এই ছেলের জন্ম তার হাতেই হয়েছিল। ওদের দুই পরিবারের মিলও অনেক ছিল। কিন্তু ধারার মা পালিয়ে যাবার পর কিছুই আগের মতো রইল না। ছেলেটাকে তার ভালো লেগেছে। এর সাথে ধারাটার বিয়ে হলে মন্দ হতো না। আল্লাহ কার ভাগ্যে কী লিখে রেখেছেন তিনিই ভালো জানেন। নইলে এত বছর পর এই ছেলে তাদের বাড়িতেই কেন থাকতে এলো? কতগুলো বছর কেটে গেল, ওরা তো কোন খোঁজ রাখেনি। ভাগ্যই হয়তো ওকে টেনে এখানে এনেছে। তিনি অনেকদিন ধরেই এই কথাটা ভাবছিলেন, ছেলেকে বলে নজরুলের কাছে খবর পাঠাবে। নজরুল ধারাকে ছেলের বউ করতে আপত্তি করবে না। ওরা ছোট থাকতে এরকম কথাই তো হয়েছিল। ধারার দাদা, মুনতাসীরের দাদা দুই বন্ধু ছিল। ওরাই ঠিক করে গিয়েছিল তাদের বড় দুই নাতি নাতনির বিয়ে করাবে। তখনই বিয়ে পড়িয়ে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু ওরা ছোট ছিল বলে আর হয়নি। কিন্তু এখন তো কোন সমস্যা নাই। ছেলেটার কি ওসব কথা মনে আছে? ধারা তো এই ছেলের কথা মনে রাখতে পারেনি। তিনি মরার আগে ধারার বিয়ে দেখে যেতে পারলে শান্তিতে মরতে পারবেন।
*******
নয়ন ধারাকে দেখেও অন্য দিকে চলে গেল। ধারা তার সাথে ভালো করে কথা বলে দেখে হয়তো নয়ন একটু বেশিই ধারাকে আপন ভেবে নিয়েছিল। কিন্তু এই মেয়ে পাষাণ। এর বুকে মন নেই। নয়ন মজা করে ধারার মুখে একটু হলুদই তো লাগিয়েছিল। তাই বলে ধারা ওভাবে কথাগুলো বলবে? নয়ন গতরাতে এক মুহূর্তের জন্য চোখের পাতা এক করতে পারেনি। ধারার কথাগুলোই শুধু তার কানে বাজছিল। ধারা এতটা কঠিন কেন? কেন তাকে ভালোবাসতে পারে না?
রোজী আপা এখনও পার্লার থেকে ফিরেনি। কী এত সাজছে যে এত সময় লাগছে। ধারা আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে নয়নকে খুঁজলো। কাল হয়তো সে একটু বেশিই রাগ দেখিয়ে ফেলেছিল। নয়ন ভাইকে ভালো করে বুঝিয়ে বললেও হতো। নয়ন ভাই তো তার সব কথাই মানে। পাড়ার লোক এমনিতেই তাদের নিয়ে অনেক কথা বলে। তার উপর যদি নয়ন ভাইকে কেউ তার গালে হলুদ লাগাতে দেখে তাহলে তো হয়েই গেল। ওরা বিয়ে করে ছেলেমেয়ের মা বাবা হয়ে গেছে এই গুজব ছড়াতেও বেশি সময় লাগবে না। ধারা নিজের চরিত্রে কালি লাগতে ভীষণ ভয় পায়। বেখেয়ালি হয়ে হাঁটছিল ধারা। একটুর জন্য কাদা পানিতে পা দিয়ে ফেলতো। সকাল সকাল এক দফা বৃষ্টি হয়ে গেছে। তখনই নয়ন বলে উঠল,
-কী করছিস! দেখে হাঁট। পেছনে পানি।”
ধারা নয়ন ভাইয়ের গলা শুনে ওর দিকে তাকাল। মৃদু হেসে বলল,
-ধন্যবাদ নয়ন ভাই।”
নয়ন কিছু বলল না। ও অন্য কাজে যেতে লাগল। ধারা বুঝতে পারে মাঝে মাঝে সে নিজের অজান্তেই মানুষকে কষ্ট দিয়ে ফেলে। নয়ন ভাইকেও দিয়েছে। কিন্তু সে তো এমনই। তিক্ত বাস্তবতা তাকে এমন হতে বাধ্য করেছে। ধারাও নয়নের পেছনে যেতে লাগল।
-নয়ন ভাই শুনুন, রোজী আপারা কি এখনও ফিরেনি?”
-না।”
-কখন ফিরবে?”
-জানি না।”
-একটু ফোন দিয়ে জানুন না।”
নয়ন দাঁড়িয়ে পড়ল। ধারার দিকে তীক্ষ্ণ চাহনি দিয়ে বলল,
-কী হয়েছে তোর? আমার সাথে সেধে সেধে কথা বলছিস কেন? আমি কোন ভিআইপি না যে তোর আমার সাথে কথা বলতে হবে।”
ধারা গাল ফুলিয়ে বলল,
-নয়ন ভাই, আমি কিন্তু জেসমিনের মতো নাটক করতে পারি না। নাটক পছন্দও করি না। সোজাসুজি বলছি, আমি সরি। মন চাইলে ক্ষমা দেন মন না চাইলে নাই।”
বলেই ধারা যেতে লাগল। নয়ন হতভম্ব হয়ে মেয়েটাকে দেখছে। কই সে রাগ করেছে তার রাগ ভাঙাবে। উল্টো এই মেয়ে নিজেই তাকে রাগ দেখাচ্ছে। আচ্ছা যাক, ধারা সরি বলেছে এটাই তার কাছে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার সমান।
-ঠিক আছে একটা শর্তে তোকে আমি ক্ষমা করব।”
ধারা চোখ দু’টো ছোট ছোট করে ফেলে জানতে চাইল,
-কী শর্ত? আমি কোন শর্ত টর্ত মানতে পারব না। এমনিতে ক্ষমা করলে করুন।”
-তুই এমন কেন ধারা?”
-আমি এমনই।”
-যে তোর জামাই হবে তার কপালে ভীষণ দুঃখ আছে। বেচারার জীবন তেজপাতা করে ফেলবি তুই। শান্তিতে বাঁচতে দিবি না।”
-আপনি বেঁচে গেছেন তাহলে।”
কথাটা বলে মুখ টিপে হেসে ধারা নয়নকে হতবুদ্ধি অবস্থায় ফেলে চলে এলো।
রোজী আপারা পার্লার থেকে চলে এসেছে। রোজী আপাকে কতটা সুন্দর লাগছে বলে বোঝানো যাবে না। বিয়ের দিন সব মেয়েদেরকেই সুন্দর লাগে। বিয়ের কনের চেহারায় আলাদা একটা মাধুর্য ফুটে উঠে। কিন্তু ধারা পার্লারের সাজে নিজের বোনকেই প্রথমে চিনতে পারল না।
-আপু কেমন লাগছে আমাকে?”
ধারা চোখ মুখ কুঁচকে চেনার চেষ্টা করল এটা তারই বোন তো! জন্মের পর থেকে দেখে আসছে কিন্তু আজ তো পুরো চেহারা সুরতই পাল্টে ফেলেছে।
-তুমি কে? কে তোমার আপু?”
-ঢং করিস না। আমাকে চিনতে পারছিস না তুই! নাটক।”
ধারা বোনের সাজ দেখে শব্দ করে হাসতে লাগল। জেসমিন কিছুটা অপমানবোধ করে গাল ফুলিয়ে কান্না কান্না মুখ করল।
-হায় আল্লাহ! তোকে তো চেনাই যাচ্ছে না। মুখে কি আটার বস্তা পুরোটা মেখে ফেলেছিস! কী ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। বাচ্চারা তোকে দেখে ভূত ভেবে ভয় পেয়ে চিৎকার শুরু করবে। তাড়াতাড়ি মুখ ধো গিয়ে।”
জেসমিনের কান্না পেয়ে গেল। কত শখ করে জীবনের প্রথম পার্লারে সেজেছে। দেখতে ভালো না লাগলেও তার নিজের বোনটা কি একটু প্রশংসা করতে পারলো না। একটু মিথ্যে সান্ত্বনাই দিত।
জেসমিন কেঁদে ফেলতে নিলে ধারা বলল,
-এ বাবা! এখন আবার কাঁদবি নাকি? চোখের জলে কাজল লেপ্টে গিয়ে পুরো শাঁকচুন্নি লাগবে।”
-তুই আমার বোন না। তুই আমার শত্রু। তোর বিয়ের দিন আমি সাজবই না। তোকে অভিশাপ দিলাম তুই একটা টাকলা জামাই পাবি।”
জেসমিন চলে গেলে ধারা একা একাই হাসতে হাসতে বলল,
-পাগল!”
চলবে_
#এক_বরষায় [২০]
#লেখনীতে_জেরিন_আক্তার_নিপা
————-
মুনতাসীরের সাথে ধাক্কা খেয়ে জেসমিন দাঁড়িয়ে পড়ল। মুনতাসীর ওকে দেখে বলল,
-সাবধানে। কোথায় ছুটছিলে এভাবে?”
জেসমিন উত্তর দিল না। তার এখন কান্না পাচ্ছে। মুনতাসীর ভালো করে জেসমিনকে দেখে বুঝতে পারল ওর কিছু তো হয়েছে। সে জানতে চাইল,
-কী হয়েছে জেসমিন?”
-কিছু না।”
-তুমি কিছু না বললেও তো তোমার মুখ বলে দিচ্ছে কিছু হয়েছে। কী হয়েছে আমাকে বলো।”
জেসমিন টলমল চোখে মুনতাসীরের দিকে তাকাল। ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
-মুনতাসীর ভাই, আমাকে ভালো করে দেখে বলুন তো আমাকে কি সত্যিই শাঁকচুন্নির মতো লাগছে।”
মুনতাসীর বিষম খেতে গিয়েও সামলে নিল।
-একদমই না। এই কথা তোমাকে কে বলল?”
-আপনি আগে ভালো করে দেখে বলুন সত্যিই ভূতের মতো লাগছে না তো?”
মুনতাসীর জেসমিনের দিকে একটু ঝুঁকে এসে চোখ বড় বড় করে দেখে বলল,
-মোটেও না। বরং তোমাকে তো ভীষণ সুন্দর লাগছে। অপূর্ব। অসাধারণ। যে তোমাকে ভূতের মতো দেখতে বলেছে তার চোখে সমস্যা আছে। পরীর মতো একটা মেয়েকে কিনা ভূত বলছে! কার এত বড় সাহস!”
-কার আবার? আমার দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র শত্রুর মুখ থেকেই তো এই কথা বের হতে পারে।”
মুনতাসীর বেশ আগ্রহ নিয়ে বলল,
-শত্রুটা কে?”
-আমার বোন। দুনিয়ায় সব সমস্যা তো ওর চোখেই। আমাকে দেখে কী বলে জানেন?”
-কী বলে?”
-বলে কিনা, আমাকে দেখে নাকি ছোট বাচ্চা ভূত ভেবে ভয় পাবে। আমাকে কি এতটাই বাজে লাগছে বলুন? আমি কি এমনই ভয়ঙ্কর?”
মুনতাসীর মনে মনে হাসল। এই দুই বোনের কাণ্ড দেখে সত্যিই তার হাসি পায়। দুই বোন সারাক্ষণ এমন ভাবে লেগে থাকে দেখে মনে হবে একজন আরেকজনের জন্ম শত্রু। অথচ জেসমিন নিজেও জানে সে পৃথিবীতে সবথেকে বেশি তার বোনকেই ভালোবাসে। মুনতাসীর ওকে সান্ত্বনা দিতে বলল,
-বুঝলে জেসমিন, তোমার বোনের চোখেই শুধু সমস্যা না। সাজসজ্জার ব্যাপারে ওর জ্ঞান একেবারেই নেই। কিছু জানেই না তাই তোমাকে দেখে ওরকম বলছে। তুমি আমার কথা মানো, তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। নতুন বউয়ের থেকেও তোমাকে বেশি সুন্দর লাগছে।”
মুনতাসীরের কথা শুনে জেসমিনের মন খারাপ একটু একটু কমতে লাগল।
-আপনি সত্যি বলছেন তো?”
-মিথ্যা কেন বলব? সুন্দরকে সুন্দর বলতে আমি কৃপণতা করি না। তোমাকে সত্যিই অনেক সুন্দর লাগছে।”
এতক্ষণে জেসমিনের মুখে হাসি ফুটল। সে হেসে দিয়ে বলল,
-আপনি অনেক ভালো মুনতাসীর ভাই। আপনার মতো ভালো মানুষ আমি আর একটাও দেখিনি। আপনি সবার চেয়ে ভালো।”
মুনতাসীর পকেট থেকে রুমাল বের করে দিয়ে বলল,
-কে কী বলল তা শুনেই তোমাকে মন খারাপ করতে হবে নাকি? নিজের উপর তোমার কনফিডেন্স নেই? চোখ মুছো। কাজল লেপ্টে যাবে। তখন দেখতে আর ভালো লাগবে না।”
-আপনি মুছে দিন। আমি তো না দেখে পারব না। এখন আয়না কোথাও পাব।”
মুনতাসীর মনে মনে ইতস্তত করলেও ভাবল, জেসমিনকে সে ছোট বোনের মতো দেখে। মেয়েটার মনেও কোন প্যাঁচ নেই। লোকে কী বলল তা দিয়ে কার কী আসে যায়? মুনতাসীর জেসমিনের চোখের কোণ মুছে দিল। এই দৃশ্য ধারা কটমট চোখে দূর থেকে দেখে গেল। লোকটার কাছে গিয়ে নিজের বোনের নামে নালিশ করছে? কত বড় অসভ্য। তার নামে বদনাম করে কেমন নিজে ভালো সাজছে। সত্যিই এটা তার বোন না। হাসপাতালে অন্য বাচ্চার সাথে পাল্টে গেছে হয়তো।
******
-ধারা।”
নয়ন ভাইয়ের ডাকে ধারা দাঁড়াল। পেছন ফিরে বলল,
-কী দরকার নয়ন ভাই?”
নয়ন বড় বড় কয়েক কদমে ধারার সামনে এসে বলল,
-দরকার না।”
-তাহলে এমনি ডেকেছেন? বরযাত্রী চলে এসেছে নয়ন ভাই৷ সবাই গেট ধরতে গেছে।”
-তুইও যাচ্ছিস!”
নয়ন ভাইকে অবাক হতে দেখে ধারা বলল,
-আমি দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখব।”
ধারা লক্ষ করল নয়ন ভাই হাত পেছনে লুকিয়ে রেখেছে।
-আপনার হাতে কী?”
-হ্যাঁ! কিছু না।”
ধারা কপাল কুঁচকে নয়নকে দেখল। উঁকি দিয়ে সে নয়নের হাতে কী আছে দেখার চেষ্টা করছে। নয়ন হাতে থাকা জিনিসটাকে আরও লুকিয়ে রাখছে।
-আচ্ছা তাহলে আমি যাই।”
-ধারা দাঁড়া।”
-আবার কী নয়ন ভাই!”
নয়ন ইতস্তত করছে। ধারার মেজাজ সে বুঝতে পারে না। কখন রেগে যায় কখন মন ভালো থাকে। তাই জিনিসটা দিতে সাহস পাচ্ছে না। শেষে সাহস জুগিয়ে হাতে থাকা জিনিসটা সামনে নিয়ে এলো। ধারা বিস্মিত গলায় বলল,
-এটা কি?”
-বেলীফুলের মালা। তোর তো পছন্দ।”
-হুম। কিন্তু আপনি…
-আপার খোঁপায় লাগানোর জন্য তাজা ফুল আনলাম না। তখনই এটাও পেয়ে গেলাম। তুই রাগ করিস না। তোর জন্য এনেছি ভেবে ফেলতে পারলাম না।”
-এ বাবা! ফেলবেন কেন? আমার পছন্দের ফুল কেউ ফেলে দিলে আমি কষ্ট পাব।”
কথাটা শুনে নয়নের মুখ খুশিতে ঝলমল করে উঠল।
-তোর খোঁপায় লাগাবি?”
-অবশ্যই। আপনি জানেন না, যে মানুষটাকে আমি সবথেকে বেশি ঘৃণা করি সে-ও যদি আমাকে বেলীফুল দেয় তাহলেও আমি নিয়ে নিব।”
ধারা নয়নের হাত থেকে ফুলের মালাটা এক প্রকার ছিনিয়ে নিল। দু’হাতে নাকের কাছে ধরে ঘ্রাণ নিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। তার ঠোঁটে একটা মিষ্টি হাসি লেগে আছে। নয়ন মুগ্ধ হয়ে দেখছে।
ধারা মালাটা খোঁপায় লাগাতে গেলে একা একা পারল না। নয়নের খুব ইচ্ছে হচ্ছিল সে ধারাকে সাহায্য করুক। ওর খোঁপায় মালাটা পরিয়ে দিক। কিন্তু এই মেয়ের যা মেজাজ! ভয়ে আর নয়ন সাহস করল না। অনেকটা সময় নিয়েও ধারা পারছে না দেখে নয়ন বলল,
-আমি সাহায্য করব?”
ধারা চোখ তুলে নয়নকে দেখল। ওর এই চাহনিতে নয়নের কলিজা শুকিয়ে গেল। এক্ষুনি বুঝি কড়া কোন কথা বলে ফেলবে। কিন্তু ধারা কী যেন ভেবে বলল,
-ঠিক আছে।”
********
বিয়ে পড়িয়ে নানান আচার অনুষ্ঠান শেষ করে রোজী আপাকে নিয়ে বরযাত্রীর ফিরতে রাত হয়ে গেল। যাবার সময় রোজী আপা খুব কেঁদেছে। ধারা শেষ কবে কেঁদেছিল তার নিজেরও মনে নেই। কিন্তু আজ রোজী আপার কান্না দেখে তার চোখও ভিজে উঠেছিল। পরিবার আপনজনকে কেন ছেড়ে যেতে হয়? সারাদিনের হৈ-হুল্লোয় ধারার মাথা ধরে এসেছিল। সে বাড়ি চলে আসার আগে জেসমিনকে বলে এলো।
-আমি বাড়ি যাচ্ছি। তুই আর আতিফ দাদীকে নিয়ে আসিস।”
-এখনই চলে যাবে? একটু থাকো, কাকী নয়ন ভাই সবার মন খারাপ।”
-মাথাটা প্রচণ্ড ধরেছে।”
-আচ্ছা তাহলে তুমি চলে যাও।”
ধারা বাড়ির কাছাকাছি আসতেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। সে বৃষ্টি থেকে বাঁচতে দৌড় লাগাল। এই রাতের বেলা বৃষ্টিতে ভিজতে একদমই ইচ্ছে নেই তার। শাড়ির কুঁচি ধরে দৌড়ে আসছে সে। বাড়ির ভেতর ঢুকে গেট লাগাতে নিলে অন্ধকারে একজন মানুষকে দেখতে পেল। মানুষটা তার পেছনেই এসেছে! ধারা খানিকটা অবাকই হলো। ভিজে যাচ্ছে দেখে ধারা তাড়াহুড়ো করে ঘরের দিকে যেতে লাগছিল। তখনই একটা কন্ঠস্বরে নিজের নাম শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
মুনতাসীর দ্রুত পায়ে ধারার দিকে এগিয়ে এলো। এই লুকোচুরি খেলার সমাপ্তি ঘটাবে সে আজকে।
সকল ধোঁয়াশা আজ মিটিয়ে নিবে৷ ধারা কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে আবার চলে যেতে নিলে মুনতাসীর আবারও ডাকল।
-ধারা।”
ধারা যতবারই মানুষটার কন্ঠে নিজের নাম শুনছে তার বুকের ভেতর একেকটা বজ্রপাতের মতো আঁচড়ে পড়ছে। নামহীন অনুভূতিতে অসাড় হয়ে পড়ছে। মুনতাসীর ধারার সামনে এসে ওর এতটা কাছে দাঁড়াল যে ওর নিঃশ্বাস ধারার কপালে পড়ছে। ধারা কিছু বলতে গিয়ে বুঝল তার কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। অনেক চেষ্টা করেও একটা শব্দ বলতে পারল না। এদিকে বৃষ্টিতে ওরা দু’জনই ভিজে যাচ্ছে। মুনতাসীর ধারার চোখে চোখ রেখে শীতল গলায় বলল,
-আমাকে তুই চিনিস না?”
ধারার এবার মনে হলো সে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাবে। কতগুলো বছর পর সেই চিরচেনা ডাক। এই প্রশ্নের জবাব কী দিবে সে?
-আমার কথা কি সত্যিই তোর মনে নেই?”
ধারা এবারও কিছু বলতে ব্যর্থ হলো। সে বুঝতে পারছে আজ কিছু একটা ঘটবে। তাই ধারা এই মুহূর্তে মুনতাসীরের সামনে থেকে চলে যাওয়াই ঠিক মনে করলো। ধারা যেতে নিলেও পারল না। তার হাত ধরে মুনতাসীর তাকে বাধা দিল।
-আজ পালাতে পারবি না। আজ আমার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে তোকে।”
ধারা দুর্বল কম্পিত গলায় বলল,
-আমার হাত ছাড়ুন।”
-আমার কথা তোর মনে নেই? তুই জানিস না আমি কে? আমাকে না চেনার অভিনয় কেন করে যাচ্ছিস? তুই তো আমাকে ভুলিসনি।”
ধারা কোন জবাব দিতে পারছে না। সে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। মুনতাসীর হাতের বাঁধন আরও শক্ত করছে।
-আমাকে না চেনার ভান করে এড়িয়ে চলার কারণ কী? উত্তর দে ধারা। আমার সাথে কথা বললে তোর কী ক্ষতি হয়ে যাবে।”
-আমাকে যেতে দিন প্লিজ।”
-নয়নের সাথে তোর এত কিসের কথা? ওর সাথে যখন কথা বলিস তখন তো এত কঠিন থাকিস না।”
ধারা ফ্যালফ্যাল চোখে মুনতাসীরের মুখের দিকে তাকাল।
-নয়ন ভাইয়ের কথা আসছে কেন!”
-কেন আসবে না?” মুনতাসীর ধারার ঘাড়ের উপর ঝুঁকে পড়ে খোঁপা থেকে বেলীফুলের মালাটা একটানে খুলে নিয়ে এলো। রাগে আক্রোশে মালাটাকে দূরে ছুড়ে ফেলে দিল। এতক্ষণে ওরা দু’জনই চুপচুপে ভিজে গেছে। দাঁতে দাঁত পিষে মুনতাসীর বলল,
-ওর দেওয়া মালা তোর খোঁপায় জায়গা পাবে কেন? তোর খোঁপায় ফুল গুঁজে দেওয়ার এই অধিকার নয়নকে কে দিয়েছে? নিশ্চয় তুই-ই দিয়েছিস।”
-আপনার কি মাথা ঠিক আছে? কী বলছেন এসব! নয়ন ভাই…
-এই নামও যেন তোর মুখে না শুনি আমি। আর আমি তোর এতটা পর কবে ছিলাম? আমাকে কবে থেকে আপনি করে বলিস।”
মুনতাসীর কথাগুলো বলার সময় ক্রোধে ফেটে পড়ছিল। ধারা আজকের আগে মুনতাসীরের এই রূপ কখনও দেখেছে বলে মনে পড়ছে না। মুনতাসীরের হাতের মুঠোয় ধারার চুড়ি মটমট করে ভেঙে যাচ্ছে। ব্যথায় চোখ মুখ কুঁচকে ফেলল ধারা। কাতর গলায় বলল,
-আমার লাগছে।”
এবার যেন কিছুটা শান্ত হলো মুনতাসীর। ধারার চোখের দিকে অনেকটা সময় তাকিয়ে থেকে বলল,
-তুই আমাকে না চেনার ভান করে অপরিচিতের মতো আচরণ করিস, আমার কষ্ট হয় ধারা। আমি তো তোর অপর না। এতগুলো বছরেও আমি তোকে ঠিকই মনে রেখেছি। তাহলে তুই কীভাবে ভুলে গেলি? আমার দেখা ধারা তো এরকম ছিল না। এতটা কঠিন কীভাবে হলি? সামান্য কোন বিষয়েও মন খারাপ করে কেঁদে ফেলা সেই নমনীয় কোমল ফুলের মতো ধারাটাকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস? এই ধারাকে আমার পছন্দ না। আমার আগের ওই ধারাকে লাগবে। তুই আমার পুরোনো ধারাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দে।”
চলবে