#এক_বরষায় [২৩]
জেরিন আক্তার নিপা
_________
জেসমিনের পড়াশোনার প্যারা আবার শুরু হয়ে গেছে। বিয়ের জন্য এই কয়দিন ছুটি নিয়েছিল। এখন বিয়ে শেষ। কলেজে তো যেতেই হবে। কোন বাহানা চলবে না। ধারার জ্বর ভালো হলেও এখনও শরীর দুর্বল তাই আরও কয়টা দিন বাড়িতে থেকে রেস্ট করবে। কিন্তু তার টিউশনি তো আর না পড়িয়ে উপায় নেই। তিনটা টিউশনি ছিল, একটা ছেড়ে দিয়েছে। যে দুইটা এখন আছে তা মাসের শুরুতেই বেতন এডভান্স দিয়ে দেয়। তাই মিস করার কোন উপায় নেই। প্রতিদিন হেঁটে গেলেও আজ শরীর বলছে বেশিদূর হাঁটত পারবে না। তাই রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছে ধারা। বিকেল হয়ে গেলেও রোদের প্রখরতা এখনও কমেনি। ধারা বাম হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে রেখেছে যেন রোদ এসে চোখে না লাগে৷ এমনিতেই মাথা ব্যথায় জীবন ত্যানা ত্যানা করে দিচ্ছে।
মুনতাসীর হয়তো কলেজ থেকে ফিরছিল। ধারা ওকে দেখেই কেমন আড়ষ্ট হয়ে গেল। সেই রাতের পর থেকে মুনতাসীরের সামনে পড়েনি সে। ধারাকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুনতাসীর নিজের রিকশা ছেড়ে দিল। রিকশাটা ঠিক ধারার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মুনতাসীর নামল। ধারাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-এটা দিয়ে চলে যা।”
ও এমন সহজ ভাবে কথা বলছে যেন ওদের সম্পর্ক কত স্বাভাবিক! মুনতাসীরের মুখে তুই ডাক শুনে ধারা ঝট করে একবার ওর দিকে দেখল। সাথে সাথে আবার চোখ সরিয়ে নিল। মুনতাসীর রিকশাওয়ালাকে নির্দিষ্ট ভাড়ার থেকে আরও বেশি টাকা দিয়ে বলল,
-আপা যেখানে যাবে নিয়ে যান।”
ধারা বুঝল তার ভাড়াটাও মুনতাসীর দিয়ে দিয়েছে। এটা দেখে ওর মুখ আরও গম্ভীর হয়ে গেল। ধারা কি একবারও বলেছে আপনি আমার ভাড়া দেন। তাহলে কেন যেচে পড়ে এই সাহায্য করতে আসা। ধারা কিছু বলতেই যাচ্ছিল, মুনতাসীর ওকে সেই সময়টাও দিল না। ডান হাতে শার্টের কলারের কাছটা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল,
-কী গরম বাপরে! সূর্য যেন আগুন ছড়াচ্ছে।”
মুনতাসীর বাড়ির ভেতরে চলে গেলেও ধারা আরও কিছুটা সময় একই ভাবে দাঁড়িয়ে রইল। প্রথমে তো যেচে পড়ে তার উপকার করে, শেষে কোন কথা না শুনেই সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলে গেল! রিকশাওয়ালা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অধৈর্য হয়ে বলল,
-আপা কই যাইবেন? উঠেন না ক্যান?”
********
ধারা যতগুলো বাচ্চা পড়িয়েছে তাদের মধ্যে রোহান সবচেয়ে বেশি দুষ্ট। দুষ্টুমির দিক থেকে সে সবাই পেছনে ফেলে এক নাম্বারে আছে। ছেলেটার ব্রেন ভালো। কোন নতুন পড়াও সহজে আয়ত্তে নিয়ে আসে। কিন্তু ও পড়তে চায় না এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা। পড়াশোনায় ওর মন একেবারেই নেই। ধারা মুখ কালো করে ধমক দিলে উল্টো হেসে লুটোপুটি খায়। ওর বাবা মা দু’জনই জব করে। ফলে রোহান দাদীর কাছে থাকে। দাদী বুড়ো মানুষ ওর সাথে পেরে উঠে না। সারাদিন পাড়ার ছেলেদের সাথে খেলে বেড়ায়।
-মিস, আপনি এতদিন আসেননি কেন?”
-অসুস্থ ছিলাম।”
-এখন সুস্থ হয়েছেন?”
-হুম। তুমি গল্প না করে পড়া বের করো। হোমওয়ার্ক দিয়ে গিয়েছিলাম। ওগুলো করেছ?”
রোহান দাঁত বের করে হেসে বলল,
-না। আপনি ছুটি নিয়েছিলেন তাই আমিও ছুটি নিয়েছিলাম।”
ধারা হতাশ গলায় বলল,
-আমি ছুটি নিয়েছি দরকারে। তোমার তো বাড়িতে কোন কাজ ছিল না। হোমওয়ার্ক না করে কী করেছ বলো?”
রোহান ধারার এই প্রশ্নের ধারের কাছ দিয়েও গেল না। সে অন্য প্রশ্ন করে বলল,
-মিস, আপনি কবে বিয়ে করবেন?”
ধারার বিষম খাওয়ার অবস্থা। এই ছেলে হঠাৎ তার বিয়ে নিয়ে পড়েছে কেন? চোখ বড় বড় করে ধারা ধমকের সুরে বলল,
-আমার বিয়ে দিয়ে তোমার কাজ কি?”
-মা আমার মামার সাথে আপনার বিয়ে দিতে চায়। মা ফোনে নানুকে বলছিল। তখন আমি শুনেছি।”
ধারা কাকে কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। সে এখানে পড়াতে আসে। এরা যে মনে মনে তাকে বাড়ির বউ বানাতে চায় এটা কে জানতো? মানুষের কী খেয়েদেয়ে আর কোন কাজ নেই। ধারা এই বাচ্চা ছেলের সাথে আর কথা বাড়ালো না।
-বই বের করো।”
-আপনি আমার মামী হলে অনেক মজা হবে।”
-আর একটা আজেবাজে কথা বললে মা’র খাবে কিন্তু।”
রোহান ধারাকে সত্যি সত্যিই রেগে যেতে দেখে আর কিছু বলল না। ম্যামের অনেক রাগ। সে জানে। মাঝে মাঝে যে জোরে মার দেয়! অনেক ব্যথা লাগে। রোহান পড়ছে ধারা অন্যমনস্ক হয়ে কিছু ভাবছে। রোহানের মা’কে কি সে সরাসরি বলবে, দেখুন আমি আপনার ছেলেকে পড়াতে আসি। দয়া করে আপনি আমার বিয়ের ঘটকালি শুরু করে দিবেন না। কিন্তু রোহানের মা নিজে থেকে তাকে কিছু না বললে তো সে যেচে গিয়ে কথাগুলো বলতে পারবে না। রোহান ধারার ভয়ে ডাক পেরে পড়ছে,
আতা গাছে তোতা পাখি
ডালিম গাছে মৌ
এত ডাকি তবু কথা
কও না কেন বউ।
-মিস আমার বউ কথা না বললে আমি ওকে এক চড় দিয়ে কথা বলাব।”
পড়ার মাঝে রোহানের এই কথা শুনে ধারা কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে রইল। এই ছেলের মাথায় এসব কে ঢোকায়!
-এই ছেলে এই বয়সে এসব কী বলো তুমি!”
-কেন মিস?”
ধারা ছেলেটার মুখের দিকে তাকাল। ও মজা করছে বলে মনে হচ্ছে না। ধারা কোমল গলায় বলল,
-এসব পঁচা কথা বাবা। বউকে কেন? কাউকেই মারা উচিত না। বুঝেছ?”
-কিন্তু আমার বাবা তো আমার মা’কে মারে।”
ধারা স্তব্ধ হয়ে গেল। তার কী বলা উচিত?
-এসব কথা বলে না সোনা। বাবা মা’র কথা বাইরের কারো সামনে বলতে নেই। তুমি এসব কথা আর কখনও কারো সামনে বলবে না বাবা।”
-কিন্তু মিস আপনি তো বাইরের মানুষ না। আপনি আমার টিচার।”
-আমার কাছে বলেছ আর কারো কাছে বলবে না কেমন?”
-ঠিক আছে মিস। বলব না।”
-এই তো রোহান সোনা গুড বয়।”
ধারা বাড়ি আসার পথেও এই কথাই ভাবছিল। ছেলেটার সামনে তার বাবা তার মা’কে মারে! এতটুকু একটা বাচ্চার সামনে তার মায়ের গায়ে হাত তুলে! মহিলাটা নিজেও তো প্রতিষ্ঠিত। তারপরও স্বামীর অত্যাচার সহ্য করে কেন?
-ধারা! এই ধারা!”
নয়ন ভাইয়ের গলা শুনে ধারা দাঁড়াল। নয়ন দৌড়ে এসে বলল,
-তোর না জ্বর তারপরও পড়াতে গিয়েছিলি!”
ধারা কিছু বলল না। ওরা পাশাপাশি হেঁটে বাড়ির দিকে ফিরছে। ধারার মনে পড়ল একটা সময় নয়ন ভাইয়ের বাবাও তার মা’কে মারতো। একদিন ধারা স্কুল থেকে ফেরার পথে যা দেখেছিল তাতে তো নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। নয়ন ভাইয়ের বাবা ওর মা’র চুল ধরে ঘর থেকে টেনে বের করে নিয়ে এলো। বাড়ির বাইরে কত মানুষ জড়ো হয়েছে। সবার সামনে লোকটা স্ত্রীকে মারছে। সেদিনই নয়ন ভাইয়ের অদেখা এক রূপ দেখেছিল সবাই। লোকটা বউকে মারতে মারতে আধমরা বানিয়ে ফেলেছে তবুও ক্ষান্ত হচ্ছে না। তখন নয়ন ভাই কোথা থেকে যেন বাড়ি ফিরেছে। চোখের সামনে মা’কে মার খেতে দেখে তারও হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেলো। পাশ থেকে একটা আম গাছের ডাল নিয়ে তার বাবাকে এলোপাথাড়ি মারতে লাগল। সেদিনের সেই দৃশ্য ধারা অনেকদিন ভুলতে পারেনি। ওই দিনের পর থেকে নয়ন ভাইয়ের বাবা আর তাদের সাথে থাকে না। যে মহিলার জন্য নয়ন ভাইয়ের মা’কে মারতো। তাকে বিয়ে করে ওই মহিলার বাড়িতেই থাকে।
নয়ন ভাইকে অপছন্দ করার ওটাই একমাত্র কারণ ছিল ধারার।
-কিরে কী ভাবছিস এত?”
-কিছু না।”
-কিছু না তাহলে আমার কথার জবাব দিচ্ছিস না কেন?”
নয়ন ভাই এতক্ষণ কী বলেছে ধারা কিছুই শুনেনি।
ধারা কথা ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,
-রোজী আপা চলে গেছে?”
-না। কাল মনে হয় চলে যাবে।”
-নয়ন ভাই রোজী আপার বিয়েতে তার বাবা আসেনি?”
নয়নের মুখটা থমথমে হয়ে গেল। ওই কুলাঙ্গার বাপের নামও সে শুনতে পারে না।
-আপার কোন বাপ নেই। ওই লোক কবেই তো মারা গেছে।”
ধারা আর কোন প্রশ্ন করল না। খোঁচা দিয়ে কারো ক্ষত কাঁচা করতে চায় না সে। সব মানুষের জীবনেই এমন কিছু অধ্যায় থাকে যা তারা ভুলে থাকতে চায়। কারো সামনে আনতে চায় না।
*******
জেসমিন আলমারিতে কিছু খুঁজছে। ওর স্বভাব একটা জিনিস খুঁজতে গিয়ে পুরো আলমারির কাপড় এলোমেলো করবে। সে কী খুঁজছে তা কাউকে বলছেও না৷ ধারা বাইরে থেকে এসে ঘরের এই অবস্থা দেখে পেছন থেকে গিয়ে জেসমিনের মাথায় চাটি মারল।
-কী করছিস তুই? সবকিছু এলোমেলো করছিস কেন?”
-আমার একটা জিনিস খুঁজছি।”
-কী জিনিস আমাকে বল।”
-তোকে বলা যাবে না।”
-তাহলে সর এখান থেকে। আর এসবকিছু যেভাবে রাখা ছিল সেভাবে রাখ।”
জেসমিন তবুও নড়ছে না। কাপড়চোপড় হাতড়াতে হাতড়াতে সে ধারার যত্ন করে রাখা মুনতাসীরের সেই রুমালটা পেয়ে গেল। ওটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে বলল,
-এটা কী রে আপু?”
ধারা ওর হাত থেকে ওটা ছোঁ মেরে নিয়ে নিল। তাড়াহুড়ো করে আলমারিতে রাখতে রাখতে বলল,
-এতকিছু জেনে তোর তো কোন দরকার নেই।”
-এটা তো মুনতাসীর ভাইয়ের মনে হচ্ছে। মুনতাসীর ভাইয়ের কাছেও আমি এমন রুমাল দেখেছি।”
জেসমিনের কথা শুনে ধারার দম আটকে যাওয়া অবস্থা। এই মেয়ে এতো কিছু জানে কেন?
-রুমাল ফ্যাক্টরির মালিকরা তো তোর মুনতাসীর ভাইয়ের জন্য একটা রুমালই উৎপাদন করে। অন্য কেউ তো আর সেই জিনিস ব্যবহার করতে পারবে না।”
-কথা এটা না। কিন্তু তুই এই রুমালটা আলমারিতে কাপড়ের ভাঁজে লুকিয়ে রেখেছিস কেন?”
-কে বলেছে লুকিয়ে রেখেছি? আর তুই আমাকে এত প্রশ্ন করার কে? যা চোখের সামনে দেখে। আমার কাজ বাড়িয়ে এখন জেরা করছে।”
জেসমিন চলে যেতে যেতেও ঘাড় ফিরিয়ে কয়েকবার বোনকে দেখল। না আপুর হাবভাব তার কাছে সুবিধার মনে হচ্ছে না। মুনতাসীর ভাই আর আপুর উপর কড়া নজর রাখতে হবে। কোনভাবে ওদের মাঝে কিছু চলছে না তো? না, না এটা কীভাবে সম্ভব। উঁহু নজর রাখতে হবে।
চলবে_
#এক_বরষায়[২৪]
#জেরিন_আক্তার_নিপা
_____________
মুনতাসীর আর ধারার সম্পর্কটা তার প্রথম দিন এবাড়িতে আসার জায়গাতেই আটকে আছে। এত দিনেও, এত চেষ্টার পরেও ওদের সম্পর্কের কোন উন্নতি হলো না। বরং সেদিন তার মনের কথাগুলো বলে দেবার পর অবনতিই হয়েছে। ধারা আগে যা-ও তার সামনে আসতো এখন তা-ও আসে না। আগে তাকে খেতে দেওয়ার সময় সামনে থাকতো। প্রয়োজনে এটা সেটা এগিয়ে দিত, এখন তার খাওয়ার সময় হলে ধারা অন্য কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখে। মুনতাসীর ভেবে পাচ্ছে না আর কী কী করলে ধারার মন গলবে। তার প্রতি কিসের এত রাগ? উঁহু রাগ থাকার কথা না। তাহলে কি অভিমান? কিন্তু অভিমানই বা কেন করবে? ধারারা গ্রাম ছেড়ে চলে আসার আগে কাউকে জানায়নি। ধারার মা যে পালিয়ে গেছে মুনতাসীর তো এটাও জানতো না। সে গিয়েছিল অসুস্থ নানাকে দেখতে। এসে জানলো ধারার মা তার কাকার সাথে পালিয়ে গেছে। ধারা তো তখন অনেক ছোট। খবর পেয়েই সে ধারাদের বাড়িতে ছুটে গিয়েছিল। ওরকম একটা ঘটনায় কাউকে সান্ত্বনা দেবার মতোও কথা খুঁজে পেল না। আর ধারাকে তখন সত্যটা জানানোও হয়নি। মুনতাসীর তখন ক্লাস টেন এ পড়া যুবক। তবুও হয়তো ভালো করে দাড়িগোঁফ গজায়নি। সেদিন ধারার দাদা ওকে ডেকে নিয়ে কয়েকটা কথা বলেছিল। সেই কথাগুলো কি সে ভুলতে পারতো?
-শোন ভাই, ছোটবেলা থেকেই তোমারে আমি অতীব স্নেহ করি। তোমার দাদা আর আমি একটা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। সময়, পরিস্থিতি যেমনই হোক আশাকরি বড় হয়ে তুমি সেই কথা রাখবা৷ তোমার উপর আমার বিশ্বাস আছে। ভাইরে, বাপ মায়ের পাপ কাজে সন্তান কখনও দোষী হয় না। যার যার পাপ যার যার কাছে। আমার নাতনি দুইটা বাচ্চা মানুষ। জীবনের ঘোরপ্যাঁচ কিছুই জানে না। আজকের এই দিনের প্রভাব ওদের ভবিষ্যতে পড়তে এটা আমি জানি। কিন্তু এসবে তো ওদের কোন হাত নেই। আজ থেকে আরও দশ/বারো বছর পর ধারা সব ভুলে যেতে পারে। কিন্তু তুমি ভুইলো না। মানুষ কতদিন বাঁচবে কেউ জানে না। আমি যদি তখন না-ও থাকি তুমি আমার বড় নাতনির মাথার উপর ছায়া হইয়ো।”
মুনতাসীর চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দাদার কথা তো সে ভুলেনি। ঠিকই মনে রেখেছে। নিজের দাদার ও ধারার দাদার কথা রাখতে এতবছর পর ঠিকই ছুটে এসেছে। কিন্তু ধারা কেন এমন করছে? ও কি কিছুই জানে না? নাকি সত্যিই ও সবকিছু ভুলে গেছে? ছোটবেলায় ওদের বিয়ে ঠিক হওয়া নিয়ে কেউ কি ধারাকে জানায়নি?
-আমি এখানে তোকে ছোটবেলার কথা মনে করাতে আসিনি। আমি আমার বউ নিতে এসেছি। অনেক হয়েছে। জানি না তুই কেন আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছিস। কিন্তু এবার সত্যটা তোর সামনে আনতেই হবে। আমি এতগুলো বছর তোর জন্য অপেক্ষা করেছিলাম তোকে অন্য কারো বউ হতে দেখার জন্য না। দাদী তো এখনও বেঁচে আছে। তুই না মানলে তোর বাবার সাথে কথা বলব। আমার বউ তো তুই-ই হবি ধারা।”
****
রোজী আপা সকালে চলে যাবে। তাই ভার্সিটি যাবার পথে ধারা জেসমিনকে নিয়ে রোজী আপাদের বাড়ি হয়ে গেল। রোজী আপা ধারাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-তোর জ্বর শুনেও দেখতে যেতে পারিনি রে। রাগ করিস না।”
ধারা হেসে বলল,
-আমি ভেবেছিলাম তুই হয়তো আমার উপর রাগ করেছ।”
-না রাগ করিনি। তুই আমার শ্বশুরবাড়ি কবে যাবি বল? নয়নকে বলে গেলাম তোকে আর জেসুকে নিয়ে যাবে।”
-ঠিক আছে। আমার দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলেই যাব।”
ধারাকে দেখে মিথিলার শেষ আশাও মিইয়ে গেল। ধারার সামনে সে কিছুই না। নয়ন ধারাকে চার বছর ধরে ভালোবাসে। মেয়েটা রূপবতী বলেই কি এত দাম? মিথিলার কেনই যেন ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তার কয়েকদিনের অনুভূতির কি কোন মূল্য আছে? নেই। ভাইয়ের বিয়ের দিনই ভাবীর ভাইকে তার ভালো লেগে গিয়েছে। এই ভালোলাগা বাড়তে বাড়তে কখন ভালোবাসায় রূপ নিয়েছে সে নিজেও জানে না। মিথিলা হয়তো কোনদিনও বলতেও পারবে না। নয়ন ধারাকে রেখে তাকে কোনোদিনও গ্রহণ করবে না।
ওরা চলে আসার সময় জেসমিন বলল,
-আপু রোজী আপার ননদটা তোমাকে কীভাবে দেখছিল দেখেছ?”
-কীভাবে দেখছিল?”
-অন্যরকম ভাবে।”
-অন্যরকম কীরকম?”
-আমার মনে হয় মেয়েটা নয়ন ভাইকে পছন্দ করে।”
ধারা হেসে ফেলল। সব কিছুতে বোনের বাড়াবাড়ি দেখে বিরক্তও হলো।
-মেয়েটার তো আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই। তাকে নয়ন ভাইয়ের প্রেমে পড়তে হবে?”
জেসমিন কাব্যিক ভঙ্গিতে বলল,
-তোমার কাছে যা সহজলভ্য অন্যের কাছে সেটাই দুস্প্রাপ্য।”
-তোর যে কবিটবি হওয়ার শখ ছিল তা তো জানতাম না।”
জেসমিন বোনের দিকে তাকিয়ে মুখ মুচড়ালো। তার এই রসকষহীন বোনকে নিয়ে কী করবে সে?
নয়ন ভাইয়ের তো কোন চান্স নেই। তবুও যদি মুনতাসীর ভাইয়ের সাথে কিছু হতো। আপুটার থেকে কিছু আশা করাই ফাউ। তার থেকে ছলেবলে কৌশলে মুনতাসীর ভাইয়ের মনে আপুকে ঢোকাতে হবে।
*****
ধারা আজও রোহানকে পড়াতে গেল। ওখানে গিয়ে নতুন ঝামেলার উৎপত্তি ঘটল। রোহান বলেছিল, রোহানের মা নাকি তার মামার সাথে ধারার বিয়ের কথা ভাবছে। কিন্তু এই মহিলা যে এই ভাবনাটা এতটা গুরুত্বের সাথে নিয়েছেন তা কে জানতো। ধারা কলিংবেল চাপছে। প্রতিদিন রোহানের দাদী বৃদ্ধ মহিলা দরজা খুলেন। আজ দরজা খুললো অচেনা এক যুবক। বয়স ২৭/২৮ হবে হয়তো। তার বেশিও হতে পারে। ছেলেটা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে ধারার দিকে চেয়ে আছে। ধারাকে দেখে হাসছে নাকি? ধারা অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে গেল। এই ছেলে তো দরজার সামনে থেকে সরছেও না। শেষে ধারাই কথা বলল,
-রোহান বাড়িতে আছে?”
ছেলেটা মৃদু হেসে জবাব দিল,
-আছে। বইপত্র নিয়ে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।”
ছেলেটা দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়ালে ধারা ভেতরে ঢুকলো। তখনও ও বুঝতে পারল না এটাই রোহানের মামা। রোহানকে পড়ানো শুরু করার আগে বাচাল ছেলেটা বলল,
-মিস আমার মামাকে আপনার পছন্দ হয়েছে?”
ধারার চোখ কপালে উঠল। হতভম্ব ভাব কাটিয়ে উঠে বলল,
-কে তোমার মামা?”
-আমার মামাকে আপনি দেখেননি? মামা তো অনেকক্ষণ ধরে ড্রয়িংরুমে বসে আছে। আপনি এলে দরজা খুলে দিবে।”
ধারার মাথা ঘুরান্টি দিচ্ছে। এরা কি ওকে পাগল ভাবে? নাকি সবাই মিলে তাকে পাগল বানাতে চাচ্ছে? যার বিয়ে তার খবর নেই এরা তো পাত্রও আমদানি করে ফেলেছে। ভাইকে এখানে আনার আগে তার সাথে একবার কথা বলে দেওয়া উচিত মনে করেনি মহিলা! রাগে ধারার মাথা ফেটে যাচ্ছে। না, এই বাড়িতে আর পড়াতে আসবে না সে। পড়াতে এসে ভালো ঝামেলায় ফেঁসে গেছে দেখা যাচ্ছে। পারলে এরা জোর করে ওর বিয়ে দিয়ে দিবে।
-রোহান তোমার মা বাসায় আছে?”
-না মিস। কেন?”
-উনার সাথে আমার কিছু কথা আছে। কোন বিষয়েই বাড়াবাড়ি আমার একদম পছন্দ না। অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপারে তো না-ই।”
ধারা রেগে গিয়েই কথাগুলো বলেছে। রোহান মুখ কালো করে বলল,
-মিস আপনি কি রাগ করেছেন?”
-কাল থেকে আমি তোমাকে আর পড়াতে আসব না।”
ধারার মন মেজাজ ঠিক নেই তাই আজ বেশিক্ষণ পড়াতে পারল না। মাথায় অসহ্য রকমের যন্ত্রণা করছে। মানুষ নিজেকে কী ভাবে? নিজেদের মন মতোন সব হবে? অন্যের মতামত কিছু না?
ধারা রাস্তায় নামার দু’মিনিট পর খেয়াল করল ওই ছেলেটা তার পেছন পেছন আসছে। এ তো আরেক যন্ত্রণা! তার জীবনেই এত ছেলেদের আনাগোনা কেন? প্রথমে ছিল নয়ন ভাই। তারপর এলো বাবার মেহমান। এই মেহমান অবশ্য অনেক আগে থেকেই তার জীবনে ছিল। এখন তো সম্পূর্ণ নতুন এক ঝামেলা ঘাড়ে উঠতে চাচ্ছে। ধারা ভাবল দাঁড়িয়ে ছেলেটাকে বলবে,
” যতদূর এগিয়েছেন এখানেই ব্রেক চাপেন ভাই৷ আমার জীবনে অলরেডি অনেক মজনু আছে। আপনি দয়া করে ওদের দলে নাম লেখাতে যাবেন না। আপনার বোন আপনাকে কী পড়িয়েছে তা আপনার বোনই জানে। ওসবে আমার কোন হাত নেই। শুধু হাত কেন? হাত,পা,মাথা, মুণ্ড কিচ্ছু নেই।”
তারপর ভাবল, নিজেকে নিয়ে এত ভুল ধারণাও মনে রাখা ঠিক না। সবাই তাকে কেন পছন্দ করবে? তার মধ্যে তেমন বিশেষ কিছু নেই।
ছেলেটা হয়তো অন্য কোন দরকারে যাচ্ছে। যেহেতু এখন পর্যন্ত ছেলেটা পেছন থেকে ডেকে তার সাথে কথা বলতে চায়নি।
ধারা অস্বস্তি নিয়ে পুরোটা পথ হেঁটে এলো। একবারও পেছনে না তাকালেও বুঝতে পারল ছেলেটা তার পেছনেই আছে। ধারা মনে মনে বলল,
-চান্দু তুমি যদি ঠিক করে থাকো আমার বাড়ি পর্যন্ত এভাবেই যাবে। তাহলে তোমার জন্য একফোঁটা সমবেদনা। আমাদের পাড়ায় উঠলেই নয়ন ভাই তোমার ঠ্যাং ভেঙে দিবে। তুমি অবশ্য এটা জানো না।”
-এক্সকিউজ মি, এইযে মিস শুনছেন?”
যাক অবশেষে ছেলে মানুষ তার নিজের রূপে এসেছে। ধারা তবুও দাঁড়াল না। ঝামেলা তার ভালো লাগে না। তাই না শোনার ভান করে চলে আসছিল। ছেলেটা পেছন থেকে দৌড়ে তার সামনে এসে দাঁড়াল।
-বিরক্ত করার জন্য ক্ষমা করবেন। কিন্তু আমার ভাগ্নের কাছে শুনলাম আপনি নাকি ওকে আর পড়াতে আসবেন না। বেচারা কান্নাকাটি করে বাড়িঘর মাথায় তুলছে।”
ধারা তীক্ষ্ণ চোখে ছেলেটাকে দেখছে। মেয়েদের সাথে কথা বলার ভালো টেকনিক জানা আছে।
ধারা জবাব দিল,
-জি ঠিকই শুনেছেন।”
-যদি কিছু মনে না করেন তাহলে কেন পড়াতে আসবেন না তা জানতে পারি?”
-অনেক কারণের মাঝে এক কারণ, আমি গায়েপড়া স্বভাবের মানুষজন থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে পছন্দ করি।”
মুনতাসীর ধারার অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়ে ছিল। বাড়িতে তো ধারাকে একা পাওয়া দুষ্কর। বাড়ির বাইরেই যা একটু কথা বলার সুযোগ। কিন্তু ধারাকে একটা ছেলের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখে মুনতাসীরের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। এই ছেলে তো নয়ন না। এই পাড়ার বলেও মনে হচ্ছে না। ওই ছেলের সাথে ধারার কিসের কথা? ধারা সবার সাথেই কথা বলে তাহলে তার সাথে কেন বলে না!
মুনতাসীর এগিয়ে আসছে। সে ধারার কাছে এসে পৌঁছুনোর আগেই ছেলেটা চলে গেছে। মুনতাসীর দাঁত কিড়মিড় করে নাকের পাটা ফুলিয়ে ধারাকে দেখছে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল সে,
-ওই ছেলেটা কে?”
ধারা মুনতাসীরের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বোঝার চেষ্টা করল। জবাব দিল না সে। ত্যাড়া কথাও বলল না। চলে আসতে নিল। মুনতাসীরও তো সহজ পাত্র না। ধারাকে ভীষণ অবাক করে দিয়ে ওর হাত ধরে ফেলল।
-যা জিজ্ঞেস করেছি জবাব দিয়ে তারপর যা।”
ধারা হতবুদ্ধি বাকরূদ্ধ। চট করে একবার আশপাশটা দেখে নিল। না কেউ তাদের দেখে ফেলেনি। ধারা ঝাড়ি দিয়ে হাত ছাড়াতে চাইল।
-হাত ছাড়ুন।”
-আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দে। ছেলেটা কে?”
মুনতাসীরকে আজ ধারার থেকে বেশি জেদি লাগছে। উত্তর না পেয়ে যে ও ছাড়বে না তা ধারা বুঝে নিল। ধারা কাতর গলায় অনুরোধ করল,
-প্লিজ আমাকে যেতে দিন।”
-আটকে রাখার শখ তো আমারও নেই। ছেলেটা কে?”
-আমার স্টুডেন্টের মামা।”
-ওর সাথে কী কথা তোর?”
-এমনিতেই পেছন পেছন আসছিল। আমি বারন করে দিয়েছি।”
এবার মুনতাসীর কিছুটা শান্ত হলো। কিন্তু এখনও ধারার হাত ছাড়ল না।
-আর কোনোদিনও যদি কারো সাথে কথা বলতে দেখেছি! তাহলে তোর খবর আছে। আমার সাথে কথা বলতেই তোর যত আপত্তি। ঘাড়ত্যাড়ামি ছেড়ে দে। নয়তো আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। ভালো মানুষি দেখেছিস। খারাপ হতে বেশি সময় লাগবে না।”
মুনতাসীরের হুমকি ধামকি শুনে ধারা বোকার মতো ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে রইল। প্রতিবাদ করার শক্তি পেলো না।
মুনতাসীর আগে বাড়িতে ঢুকলো। তার একটু পরেই ধারা। জেসমিন পেয়ারা গাছ থেকে পেয়ারা পারছিল। ওদের দু’জনকে একসাথে বাড়িতে আসতে দেখে চোখে মুখে সন্দেহের ছাপ পড়ল। লাফ দিয়ে গাছ থেকে নেমে বলল,
-এবার তো আমি পাক্কা শিওর ওদের মাঝে ছ্যাড়াব্যাড়া কিছু একটা লেগেছে। এখন খুঁচিয়ে বের করার পালা কার মনের আগুন কতটুকু ছড়িয়েছে।”
চলবে_