এক বরষায় পর্ব-৩৫+৩৬

0
567

#এক_বরষায় [৩৫]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

_______________
জেসমিন নয়নকে নিয়ে বাড়ি পৌঁছুতে পৌঁছুতে এতক্ষণে শুভ কাজ সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। ছেলেরাও চলে গেছে। জেসমিন যখন জানলো তার বোনের আংটি পরানো হয়ে গেছে অথচ সে বাড়িতেই ছিল না। তাকে কেউ ডেকে আনার প্রয়োজন মনে করেনি। নিজেরা নিজেরাই সব করে ফেলেছে। তখন জেসমিন তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে দিল। চিৎকার চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলল।

-থাকব না আমি এই বাড়িতে। সত্যি সত্যিই চলে যাব। যে বাড়িতে আমার থাকা না থাকার কোন গুরুত্ব নেই, সেই বাড়িতে আমার না থাকাই সবার জন্য ভালো। এক্ষুনি চলে যাব বাড়ি ছেড়ে।”

মুনতাসীরের বাবার মৃত্যুর খবর শুনে এমনিতেই কারো মন ভালো ছিল না। শরিফুল ইসলাম এই প্রথম মেয়ের সাথে কঠিন গলায় কথা বললেন। বাবার থেকে এরকম ব্যবহার জেসমিন হয়তো আশা করেনি। শরিফুল ইসলাম থমথমে গলায় বললেন,

-এখানে কোন সার্কাস চলছে না। মা, কাজের সময় বাড়িতে না থেকে পরে এসে কার উপর চোটপাট দেখাচ্ছে তোমার নাতি? জিজ্ঞেস করো ওকে এতক্ষণ কোথায় ছিল। সে কি জানতো না আজ বাড়িতে মেহমান আসবে।”

জেসমিন বাবার মুখে মুখে আর কিছু বলার সাহস পেল না। বাবাকে সে দিনে দুপুরে মদ খেয়ে মাতাল হতে দেখেছে। কিন্তু কোনোদিনও এরকম রাগ করতে দেখেনি। বাবার রাগকে বরাবরই সে ভয় পায়। নয়ন জেসমিনকে বাঁচানোর জন্য বলছিল,

-কাকা ও বাচ্চা মানুষ। ওর কথা ধরবেন না। কখন কী বলে না বলে নিজেও জানে না।”

-ওর কথা না ধরতে ধরতেই তো এত ছাড় পেয়েছে। বড় হচ্ছে এখন বুঝেশুনে কথা বলা উচিত।”

জেসমিন কাঁদো কাঁদো মুখে বাবার দিকে তাকাল। বাবার রাগের কারণ কিছুটা বুঝতে পারছে। বড় মেয়ের বিয়ে ঠিক করে কষ্ট পাচ্ছে ঠিক আছে। কিন্তু সেই কষ্ট তার উপর দিয়ে দেখাচ্ছে কেন? সে কি বলেছিল, আপুর বিয়ে দাও তোমরা? নয়ন ধারাকে আশেপাশে দেখল না। ধারা কী ঘরে বসে আছে? সামনে আসছে না কেন? ধারার কি সত্যিই আংটি পরানো হয়ে গেছে? নয়নের বুকের ভেতর কেউ যেন আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে।
পুরোনো বন্ধুর মৃত্যুর খবর শুনে শরিফুল ইসলামের শরীরটা হঠাৎ করেই যেন খারাপ হয়ে গেছে। তার কিছু ভালো লাগছে না। ছেলেটা আজ প্রকৃত অর্থেই এতিম হয়ে গেল! আহা, ওর মুখের দিকে তাকাতেও বুক খাঁ খাঁ করছে। বন্ধুকে দেওয়া শেষ কথাও রাখতে পারলেন না তিনি। নজরুলের কী ইচ্ছে ছিল তিনি জানেন না। ওখান থেকে চলে আসার পর কারো সাথেই যোগাযোগ রাখেননি। সম্পর্কই শেষ করে দিয়েছিলেন বলা যায়। তিনি নয়নকে বসতে বলে নিজে চলে যাচ্ছিলেন।

-নয়ন তুমি বসো। আমার শরীরটা ভালো লাগছে না।”

নয়ন জিজ্ঞেস করবে না ভেবেও কথাটা বলেই ফেলল। হুট করে এভাবে ধারার বিয়ে ঠিক করে কি কাকা ঠিক কাজ করেছে? অন্তত ছেলেটার সম্পর্কে আগে খোঁজ খবর নেওয়া উচিত ছিল।

-কাকা ধারার বিয়ে ঠিক করার আগে ছেলেটার সম্পর্কে খোঁজ খবর নেওয়া উচিত ছিল না? অন্তত এক মাস পনেরো দিন সময় নিতেন।”

শরিফুল ইসলাম ক্লান্ত অবশ দৃষ্টিতে নয়নকে দেখলেন। নয়নের পড়াশোনা কম। কাজকর্ম কিছু করে না। তবুও নয়নকে তিনি অপছন্দ করতে পারেন না। নয়ন তার মেয়েকে পছন্দ করে এটা পাড়ার বাচ্চারাও জানে। নয়নের সাথে ধারার বিয়ে দিতেও কোন আপত্তি ছিল না তার। নয়ন এ পাড়ার ছেলে। ওর সাথে মেয়ের বিয়ে হলে ধারা চোখের সামনেই থাকতো। কিন্তু মেয়েটা তো নয়নকে পছন্দ করে না। আর নয়নও তো সাহস করে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়নি।

-খোঁজ খবর নিয়েছি। তারপরও তোমরা দেখো। আমার কাছে আমার মেয়ের সুখের আগে আর কোনোকিছু না। ঠিক হওয়া বিয়ে ভাঙতে কতক্ষণ?”

কাকা এই কথা বলে তার মনে শেষ আশার আলো জ্বালিয়ে দিল কি! তাহলে কি কাকাও চায় নয়ন খোঁজ খবর নিক। ছেলেটার কোন খুঁত বের হলে কাকা কি বিয়েটা ভেঙে দিবে? নয়ন মনে মনে কতটা খুশি হয়েছে ভাষায় প্রকাশ করতে পারল না। সে এক্ষুনি ওই ছেলের চৌদ্দ গোষ্ঠীর খবর বের করে ফেলবে। নয়ন চলে গেলে জেসমিন ঘরে এসে দেখল ধারা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। জেসমিন বাবার উপর রাগ দেখাতে না পারলেও বোনের সাথে তো পারবে। ঝাঁঝালো গলায় সে বলল,

-বাবার আদর্শ মেয়ে হতে হবে না! আদর্শ মেয়ে হতে গেলে তো জেনে-বুঝেই আগুনে ঝাপ দিতে হবে। আমার কি? জীবন যার তার মাথা ব্যথা না থাকলে আমি কার জন্য চিন্তা করছি?”

জেসমিন ঘরে এসেছে বুঝতে পেরেই ধারা চোখের জল লুকিয়ে ফেলল। এই চোখের জল গুলো তার একান্ত নিজের। কাউকে দেখাতে চায় না সে।
জেসমিন গজগজ করতে করতে যেভাবে এসেছিল সেভাবেই চলে গেল। মরার আতিইফাটাও দুই দিন পরপর মরতে বাড়ি চলে যায়। জেসমিন তখন পুরোপুরি একা হয়ে যায়৷ গাধা এসে দেখবে তার আহ্লাদের বোনের বিয়ে হয়ে গেছে।
*****

মুনতাসীর যে ফিরেছে এটা জেসমিন তখনও জানতো না। কারণ বাড়ি এসে মুনতাসীরকে দেখেনি সে। সন্ধ্যায় মুনতাসীরের ঘরে আলো দেখে এঘরে উঁকি দিয়ে দেখল ভেতরে মুনতাসীর ভাই। জেসমিন খুশিতে আত্মা কাঁপানো চিৎকার দিয়ে ঘরে ঢোকার সময় দরজার সাথে মাথায় বাড়ি খেল। ব্যথা পেয়েছে কি-না বোঝা গেল না।

-ও মুনতাসীর ভাই! আপনি এসেছেন! কোথায় চলে গিয়েছিলেন আর ফেরার নাম নিলেন না! আপনি জানেন এক যুগ ধরে আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করে যাচ্ছি। আজ আপনার আসার সময় হলো।”

অনেকদিন পর জেসমিনকে দেখে মুনতাসীরের ভালো লাগলো। ওর সব কথার উত্তরে মৃদু হাসল।
জেসমিন মুনতাসীরের কাছে এগিয়ে এসে গোপন কথা বলার মতো করে বলতে লাগল,

-ভেতরের কথা শুনেছেন? মুনতাসীর ভাই এখন কী হবে? আপুর যে ওই ছেলেটার সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে গেল! আমরা এখন কী করব মুনতাসীর ভাই? কীভাবে বিয়েটা আটকাবো? আপনি যে কেন এত দেরি করলেন?”

জেসমিন যতটা উত্তেজিত হয়ে কথাগুলো বলছে মুনতাসীর ততটাই শান্ত হয়ে শুনছে। জেসমিন এখনও চায় ওর সাথে তার বোনের বিয়ে হোক! মেয়েটা কেন তাকে এত পছন্দ করে?
জেসমিন মুনতাসীরকে দেখল। ওর চোখেমুখে সন্দেহ দেখা যাচ্ছে।

-মুনতাসীর ভাই, আপনার বাবা কি রাজি হয়নি?”

মুনতাসীর হাসল। জেসমিন স্পষ্ট বুঝলো এটা দুঃখের হাসি। এই হাসিতে খুশি নেই। তার মানে মুনতাসীর ভাইয়ের বাবা রাজি হয়নি? সেজন্যই মুনতাসীর ভাই ফিরতে এত দেরি করেছে! আহা বেচারা কতই না কষ্ট পাচ্ছে! জেসমিন মন খারাপ করা গলায় বলল,

-কেন রাজি হয়নি মুনতাসীর ভাই? আমার বোন কি খারাপ? আপনার বাবা তো আপুকে দেখেইনি।”

মুনতাসীর জানে জেসমিনের মন কতটা নরম। তাই বাবার মৃত্যুর সংবাদটা জেসমিনকে জানাতে চাইল না সে। কী দরকার মেয়েটাকে কষ্ট দেওয়ার।

-কী হলো মুনতাসীর ভাই? আপনি বোঝালেও কি তিনি বুঝবেন না? আপনি উনার ছেলে। আপনি বোঝালে ঠিক বুঝবেন। সব বাবারাই তো ছেলে মেয়ের সুখ চায়, তাই না? আমার বাবা কী চায় তা অবশ্য বুঝতে পারছি না।”
*****

ধারা পুরো সন্ধ্যা মনমরা হয়ে জানালার পাশে বসে রইল। কারো সাথে কথা বলল না। ওর মন খারাপ দেখে দাদী ভাবল বিয়ের পর সবাইকে ছেড়ে চলে যাবে ভেবেই হয়তো মন খারাপ লাগছে। দাদীও ধারাকে বিরক্ত করলেন না। কিছুটা সময়ের জন্য একা ছেড়ে দিলেন। এতদিন উনার চিন্তা ছিল, ধারাটার একটা গতি করে যেতে পারল না। এখন যখন ধারার বিয়ে ঠিক হয়েছে এখন মনে হচ্ছে বিয়েটা না হলেই ভালো হতো। বড় নাতনিকে ছেড়ে তিনি থাকতে পারবেন না।
রাতে আর রান্না হলো না। এখান থেকে উঠে যেতে ধারার ইচ্ছে করলো না। দুপুরে মেহমানদের জন্য করা পোলাও মাংস অনেক রয়ে গেছে। রাতে ওগুলোই গরম করে খাওয়া যাবে। ধারার মন খারাপের কথা সে কাউকে বলতে পারল না। থম মেরে অন্ধকারে বসে রইল।
রাতের খাবার সময় হলে জেসমিন কতক্ষণ চিল্লাপাল্লা করল।

-এসব ঠান্ডা পোলাও মাংস কে খাবে? আমি খাব না। এসবের থেকে ভালো আমার কাছে আলু ভর্তা। পেট ভরে ভাত খাওয়া যায়।”

দাদী চাপা গলায় জেসমিনকে ধমক দিয়ে বলল,

-একটা দিন খেয়ে নে। তুই তো দেখছি মানুষের মন বুঝস না। মেয়েটার কি আজ রান্ধনের মন আছে?”

-কেন থাকবে না? বিয়ে করতে বলেছে কে তোমার নাতনিকে? যে বিয়েতে রাজি হলে মনে খুশি থাকবে না ওই বিয়ে না করাই ভালো।”

দাদী এই ঘাড়ত্যাড়া জেদি মেয়েকে আর কিছু বললেন না। কথা বাড়ালে এমন কিছু বলে ফেলবে তাতে ধারা আরও কষ্ট পাবে।

-আজ পোলাডারে ঘরে খাবার দিয়া আয়। আমি তরকারি গরম কইরা দিতাছি।”

-ঘরে কেন? মুনতাসীর ভাই তো আমাদের সাথেই খায়।”

-আজ ঘরে বইসাই খাক। ছেলেটার মনের অবস্থা ভালো না। এখনও শোক কাটাইয়া উঠতে পারে নাই মনে হয়।”

জেসমিন কপালে ভাঁজ ফেলে দাদীর দিকে ফিরে বসল। মুনতাসীর ভাইয়ের আবার কিসের শোক? একটু আগেই তো কথা বলে এলো সে। কই কোন গণ্ডগোল তো চোখে পড়ল না।

-মুনতাসীর ভাইয়ের আবার কী হয়েছে?”

জেসমিনের কথায় দাদীও অবাক হওয়া গলায় বলল,

-কেন তুই জানস না?”

-কী জানবো? রহস্য না করে বলে ফেলো না ছাতা।”

দুনিয়ার কোনো খবরই রাখে না এই মেয়ে। তার খালি উড়নচণ্ডীর মতো ঘোরা। দাদীর ব্যথিত গলায় বলল,

-পোলাডার দুনিয়ায় আর কেউ রইল না। ওর বাপটাও ছেলে দুইটারে এতিম কইরা চইলা গেল। আল্লাহর কাম সবই ভালা।”

মুনতাসীর ভাইয়ের বাবা মা গেছে! মুনতাসীর ভাই এই কথাটা তখন কেন বলল না? সে না জেনে মুনতাসীর ভাইয়ের কষ্ট বাড়িয়ে দিয়ে এসেছে।
এই কথা শোনার পর জেসমিনের কান্না কেউ থামাতে পারল না। সে এক নাগাড়ে কেঁদেই যাচ্ছে। তার কান্না দেখে মনে হবে একটু আগে তার নিজের বাবা মারা গেছে। ধারা কতক্ষণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। জেসমিন তার কান্নার কারণও কাউকে বলছে না। দাদীও বুঝতে পারলেন না হঠাৎ করে মেয়েটা এরকম মরা কান্না কেন কাঁদছে। শেষে তার কান্না শুনে মুনতাসীর নিজের ঘর থেকে চলে এলো। জেসমিন কান্নার দমকে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। মুনতাসীরকে দেখে তার কান্না আরও বেড়ে গেল। মুনতাসীর যতই জিজ্ঞেস করছে, কী হয়েছে জেসমিন? কেন কাঁদছো তুমি? তার উত্তরে জেসমিন ফোঁপাতে ফোপাঁতে কী বলছে তা কারো বোধগম্য হচ্ছে না।

-মুনতাসীর ভাই আমি জানতাম না। বিশ্বাস করুন আমি সত্যিই জানতাম না। না জেনেই আমি আপনাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি।”

মুনতাসীর ওকে শান্ত করতে মাথায় হাত বুলিয়ে স্নেহভরা গলায় বলল,

-কী জানতে না তুমি? আর কিসের কষ্ট দেওয়ার কথা বলছো বলো তো?”

-আপনার বাবার কথা আমি জানতাম না। আমাকে কেউ বলেনি। জানলে তখন আপনার সামনে… আমি এখন কী করব মুনতাসীর ভাই? আমার যে কান্না থামছে না! আপনার কত কষ্ট হয়েছে! কষ্টের কথা মনে করিয়ে দিয়ে আমি তো আপনাকে আরও কষ্ট দিলাম।”

জেসমিনের এমন পাগলামি কাণ্ডে মুনতাসীর সত্যিই বাকরুদ্ধ। একটা মানুষ কতটা সরল হলে অন্যের কষ্টে নিজে এভাবে কান্না করে!
****

সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও ধারার চোখে তো আজ ঘুম ধরা দিবে না। ইলেক্ট্রিসিটি নেই। অন্ধকার এই ঘরটায় তার দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইল। ধারা শ্বাস নেওয়ার জন্য বাইরে বেরিয়ে এলো। খোলা বাতাসে যদি দম বন্ধ ভাবটা কাটে। বাইরে চাঁদের আলোয় উঠুন ফকফকা। আজ কি পূর্ণিমা? মুনতাসীরের ঘরের দিকে চোখ গেলে ধারার চোখ ভরে জল আসতে চাইল। দমকা কান্নায় বুক ফেটে যেতে চাইল। ধারা যা কখনও করার কথা ভাবেনি আজ তা-ই করল। মুনতাসীরের ঘরের সামনে চলে এলো। মানুষটাকে এক নজর দেখতে পারলেই যেন তার সব কষ্ট কমে যাবে। জীবনে এত সাহস হয়তো ধারা কখনোই করেনি। নিঃশব্দে মুনতাসীরের ঘরের দরজায় ঠেলা দিল। আর আশ্চর্যজনক ভাবে দরজাটা খুলেও গেল! ধারা তার পুরো জীবনে সবচেয়ে বড় দুঃসাহসিকতার কাজটা আজ করে ফেলল। সমাজ, পরিবার, লোকের কথা, কলঙ্কের ভয় কোনোকিছু না ভেবে ভেতরে ঢুকে গেল।

চলবে_

#এক_বরষায় [৩৬]
জেরিন আক্তার নিপা

____________

অন্ধকার ঘরে স্পষ্ট করে তেমন কিছুই দেখা না। ধারার বুক ধড়ফড় করছে। অন্তরাত্মা কাঁপছে। মানুষটা কি ঘরে নেই? ধারা হয়তো কোন ঘোরের মধ্যে থেকেই এরকম একটা কাজ করে ফেলতে পেরেছে। কিন্তু এখন সে বুঝতে পারছে জীবনে সবচেয়ে বড় ভুলটা সে করে ফেলেছে। নিজের মনের কাছে আজ হেরে গেছে। ধারার খেয়াল হলো, কী করছে সে? সে কি ভুলে গেছে আজই সে অন্য কারো নামে হাতে আংটি পরেছে। মুনতাসীর ঘরে নেই বা ঘুমিয়ে আছে। মধ্যরাতে নিজের ঘরে ধারার উপস্থিতি জেনে যাবার আগে ধারা ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াল। যে ভুলটা করতে যাচ্ছিল তা এখন শুধরে নিবে। ধারা দ্রুত পায়ে দরজা পর্যন্ত আসতেই এক ঝলক আলো ধক করে তার চোখে এসে লাগলো। ধারা চোখ বন্ধ করে নিল। তার নিঃশ্বাস আটকে আছে।
মুনতাসীরের ঘুম আসছিল না। গরমও লাগছিল। তাই বাইরে একটু হাঁটতে গিয়েছিল। রাস্তায় বেরিয়ে মনে পড়ল ঘরের দরজা খোলা রেখে এসেছে সে। গেট তো বাইরে থেকে যেকেউ খুলতে পারবে। দেয়াল টপকেও বাড়িতে ঢোকা যাবে। তাই মুনতাসীর হাঁটার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে ফিরে এলো। উঠোন থেকেই দেখল ঘরের দরজা খোলা। চোর টোর এসেছে নাকি? মুনতাসীর নিঃশব্দ পায়ে বারান্দায় উঠে এলো। পকেট থেকে মোবাইল বের করল। চোর হলে আজকে চোরের জীবনের শেষ চুরির দিন হবে। মুনতাসীর ফোনের লাইটের আলোতে যাকে দেখল তাকে দেখার প্রত্যাশা সে এই জীবনে করেনি। রাত এখন কয়টা? মধ্যরাতে সবার চোখের আড়ালে ধারা তার কাছে এসেছে! আচ্ছা এটা তার কল্পনা না তো! ধারা কি সত্যিই তার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মুনতাসীর নিজেও স্তব্ধ হয়ে অনেকটা সময় পার করে দিল। ধারার কাছে যদি অদৃশ্য হওয়ার ক্ষমতা থাকতো তাহলে এই মুহূর্তে সে অদৃশ্য হয়ে যেত। যেন আর কোনোদিন এই মানুষটার সামনে না পড়তে হয় সেটাও খেয়াল রাখত। আরও বেশি দেরি হয়ে যাবার আগে ধারা মুনতাসীরকে পাশ কাটিয়ে ওখান থেকে পালিয়ে আসতে চাচ্ছিল। কিন্তু মুনতাসীরও তো আজ ধারাকে এত সহজে ছাড়তে রাজি না। তার জন্য যদি তার মনে কোন অনুভূতি, ভালোবাসা না-ই থাকে তাহলে ধারা কেন এত রাতে তার কাছে এসেছে? অন্তত এই একটা প্রশ্নের উত্তর ধারাকে আজ দিতেই হবে। মুনতাসীর ধারার হাত ধরে ওকে আটকে ফেলল। ঘটনার আকস্মিকতায় ধারার মনে হচ্ছিল তার থেকে তার আত্মাটা কেউ বের করে নিয়েছে। মুনতাসীর জবাব চাওয়া গলায় বলল,

-কোথায় যাচ্ছিস? চলেই যাবি তাহলে এতরাতে আমার কাছে কেন এসেছিলি? জবাব দে।”

এই মুহূর্তে মৃত্যু হলেও ধারার কোন অভিযোগ থাকতো না। মরে গিয়ে সে বরং বেঁচে যেত। কীভাবে এরকম একটা ভুল সে করতে পারলো? মনের কাছে এরকমভাবে কীভাবে হেরে গেল?
ভয়ের একটা শীতল স্রোত ধারার সর্ব শরীরে বয়ে গেল যেন। এখন যদি বাবার ঘুম ভেঙে যায়। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বাবা তাকে এই ঘরে দেখে। তখন কী বাবা তাকে বুঝতে চাইবে? নাকি ভুল বুঝবে? ধারা কাঁপতে কাঁপতে অবরুদ্ধ গলায় বলল,

-আমাকে যেতে দিন।”

মুনতাসীর আজ ধারার কোন অনুরোধ শুনবে না। তার প্রশ্নের জবাব সে জেনেই ছাড়বে। মুনতাসীরও একগুয়ে গলায় বলল,

-আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দে। কেন এসেছিলি? কিসের টানে? আমার প্রতি তো তোর মনে কোন ভালোবাসা নেই।”

-হাত ছাড়ুন। আমাকে যেতে দিন।”

-তোকে আটকে রাখার সাধ্য, অধিকার কোনোটাই আমার নেই। যাবার আগে শুধু এটা বলে যা, যে মেয়েটা দিনের আলোয় আমার মুখোমুখি হয় না। সে মেয়ে রাতের অন্ধকারে আমার কাছে কী চাইতে এসেছে?”

-কিছু না। কোনকিছুই না।”

-কিছু না! হু, ঠিকই তো। আমার কাছে কী চাওয়ার থাকবে তোর? কিছুই তো না।”

মুনতাসীর মুখে এই কথাটা বললেও এখনও ধারার হাত ছাড়েনি। ধারা অধৈর্য হয়ে উঠেছে। বাবা, দাদী, জেসমিন তাকে এই ঘর থেকে যেতে দেখে নিলে তার যে কিছু বলার মুখ থাকবে না। কী জবাব দিবে সে? কেন এসেছিল এই ঘরে?

-আমার হাতটা ছাড়ুন প্লিজ।”

ধারার কাতর অনুরোধ শুনে মুনতাসীর হাতটা ছেড়ে দিল। ধারা ছুটে পালিয়ে আসার আগে আবার হাতটা ধরে ফেলল।

-শেষ একটা প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর দে। তারপর আর কোনোদিনও তোকে বিরক্ত করব না। কথা দিচ্ছি।”

ধারা অন্ধকারে অসহায় চোখে মানুষটাকে দেখল। মানুষটার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে সে যে নিজের কাছেই ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে।

-এই বিয়েটা কি তোর ইচ্ছেতে হচ্ছে ধারা?”

প্রশ্নটা শুনে ধারা থমকালো। ঠোঁট কামড়ে ধরে বুক ফেটে বেরিয়ে আসা একদলা কান্না আটকালো। কেন তার জন্য সবকিছু এতটা কঠিন করে দিচ্ছে মানুষটা?

-শেষ এই একটা কথার উত্তর দিয়ে তুই চলে যা। আমি তোকে আটকাবো না।”

ধারা স্থির অবিচল দাঁড়িয়ে আছে। এই প্রশ্নের উত্তরটা সে দিতে চায় না। দিলেও উত্তরটা সে নির্ভুল হবে না।

-বল। তোর ইচ্ছে বিয়েটা করছিস তুই?”

-হু।”

অন্ধকারে মুনতাসীর ধারার মুখটা দেখতে পেলো না। দেখলে হয়তো ধারার চোখের পানি দেখেই আসল উত্তর বুঝে নিত। ধারা ঠোঁট কামড়ে কেটে ফেলছে। তবুও তার কান্নার শব্দ মানুষটার কানে পৌঁছুতে দেওয়া যাবে না। মুনতাসীরের বুকের ভেতর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। গলাটা কেঁপে উঠল তার।

-তোর ইচ্ছেতে হচ্ছে না! ঠিক আছে। এবার তাহলে যা তুই।”

ধারা ঘরে এসেই বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়ল। নিজের হাতে সব শেষ করে দিয়ে এসেছে আজ। ধারার কান্নার শব্দে দাদী জেগে গেল। বিয়ে ঠিক হওয়াতেই মেয়েটা এভাবে কাঁদছে! ধারা কি বিয়েতে রাজি না? তিনি নাতনির মাথায় স্নেহের হাত রাখলেন,

-ধারা! ও নাতি, আমার সোনা বু। কানতাছোস কেন তুই? কষ্ট হইতাছে? কেন কষ্ট হইতাছে আমারে বলবি না? ও বু…

ধারার কান্না থামছে না বরং বেড়েই চলছে। কান্না চাপতে গিয়ে ফোঁপাতে ফোপাঁতে হেঁচকি তুলে ফেলল। ছোটবেলা থেকে ধারাকে কোনোদিনও এরকমভাবে কাঁদতে দেখেননি তিনি। যত কষ্টই হোক ধারা তো কোনোদিনও এমনভাবে কাঁদে না। আজ তাহলে কী হলো ওর? মেয়েটা কী নিয়ে এতটা কষ্ট পাচ্ছে? মা’র কথা মনে করে মেয়েটা এরকমভাবে কাঁদছে। না, মা’কে ধারা ঘৃণা করে। ওই মহিলার জন্য কখনও চোখের পানি ফেলবে না। তাহলে অন্য আর কী কারণ আছে। তাকে তো বলছেও না কিছু।

-ও ধারা, কী হইছে তোর? আমারে কস না বুবু। কার কথা মনে পড়াতছে?”

ওদের কথার শব্দে জেসমিনের ঘুমে সমস্যা হলে ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই সে বিরক্তি নিয়ে বলল,

-ঘুমাইতে দাও না। রাইতেও কিসের এত কথা! ঘুমাও সবাই।”
****

সকালে খাবার টেবিলে মুনতাসীর না এলে ধারা জেসমিনকে ওকে ডেকে আনতে বলল। তা শুনে জেসমিন বলল,

-মুনতাসীর ভাই তো কখন বেরিয়ে গেছে।”

-না খেয়েই!”

-হুম। কী নাকি কাজ আছে।”

-ওহ।”

বিয়ে হয়ে গেলেও ধারা পড়াশোনা বন্ধ করবে না। এমনই কথা হয়েছে। ছেলের বাড়ি থেকেও তাকে পড়তে দিবে। ধারা ভার্সিটি যাবার জন্য রেডি হয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াল। নয়ন আগে থেকেই ওর জন্য দাঁড়িয়ে আছে। নয়ন ভাইকে আজ অন্য দিনের মতো প্রফুল্ল লাগছে না। ধারা মনে মনে নিজেকেই দোষারোপ করল। কেন তোর জন্য কোন ছেলে কষ্ট পাবে। তুই তো অতি সাধারণ। মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার কী যোগ্যতা আছে তোর?
নয়ন ধারার কাছাকাছি চলে এসেছে।

-ভার্সিটি যাচ্ছিস?”

-হুম।”

নয়ন রাস্তার দুই দিকে দেখল। ওইদিক থেকে কোন রিকশা আসছে না। এদিক থেকেও দেখা যাচ্ছে না। নয়নের মন আজ বিশেষ ভালো নেই। ধারার বিয়ে হয়ে গেলে এভাবে আর প্রতিদিন সকালে ওকে দেখতে পারবে না। রিকশা ডেকে দিতে পারবে না। এমনকি ধারার ফেরার অপেক্ষায়ও থাকতে হবে না। এসব ভাবলেই নয়নের বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। ধারা কেন তাকে ভালোবাসতে পারল না। একটু ভালোবাসলে কী হতো? ভালো না-ই বাসত নয়নের চোখের সামনে থাকতো। এর থেকে বেশি কিছু তো নয়ন চায় না।

-নয়ন ভাই, আপনি কি কিছু বলবেন?”

-ছেলেটাকে কি তোর পছন্দ ধারা?”

হঠাৎ করে ধারা বুঝতে পারল না নয়ন ভাই কোন ছেলের কথা বলছে। তাই জিজ্ঞেস করল,

-কোন ছেলে?”

নয়ন অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল,

-যার সাথে তোর বিয়ে হবে।”

ধারা নয়নকে দেখল। তার দিকে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। দীর্ঘশ্বাস ফেলল ধারা।

-আমার মনে হয় কোন পছন্দ নেই নয়ন ভাই। বা থাকলেও আমি বুঝতে পারি না।”

*******
জেসমিন কলেজ থেকে ফিরে আতিফকে দেখে এই কয়দিনের সব রাগ ওর উপর ঝেড়ে নিল।

-ওই হারামি বাড়িতে দুইদিন পরপর কী এত মরা পড়ে? না বলে চলে যাস। আর এদিকে আমি একা পড়ে যাই।”

জেসমিনের বকা খেয়েও আতিফ আজ প্রতিবাদ করছে না। ছেলেটার মুখটা সত্যিই দুঃখী দুঃখী লাগছে। জেসমিন নরম হয়ে বলল,

-তোর মা কি বেশি অসুস্থ?”

-হুম।”

-ডাক্তার দেখাসনি?”

-দেখিয়েছি।”

-কী বলেছে ডাক্তার? রোগটা কী সেটা ধরতে পারেনি?”

এই কথার উত্তর দিয়ে গিয়ে আতিফের কান্না এসে গেল। তবুও জেসমিনের সামনে কাঁদল না। রোগটা যে ভালো হবার না। ডাক্তার বলেছে মা’র হাতে সময় খুব কম। মা’কে ছাড়া আতিফ এই দুনিয়ায় একা হয়ে যাবে। জেসমিন ওকে সান্ত্বনা দিতে বলল,

-চিন্তা করিস না। তোর মা ভালো হয়ে যাবে। দোয়া করে দিচ্ছি। এখন চেহারা ঠিক কর তো। কী দুঃখী দুঃখী লাগছে!”

আতিফ কষ্ট লুকিয়ে হাসতে চেষ্টা করল। জেসমিন ওর কাঁধে হাত রেখে বলল,

-এদিকের খবর জানিস কিছু? তুই তো ছিলি না। বাড়িতে যে কত ঘটনা ঘটে গেছে। ধারা আপুর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ছেলেরা আংটিও পরিয়ে গেছে। মুনতাসীর ভাইয়ের এখন কী হবে রে? আমি তো ভেবে পাই না। তুই এসেছিস এখন দু’জন মিলে কিছু ভেবে বের করব।”

*******
দুপুর থেকে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। উঠানে পানি জমে গেছে। ধারা চিন্তিত মুখে বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখছে। আসলে সে গেটের দিকে লক্ষ রাখছে। মুনতাসীরের ফেরার অপেক্ষা করছে। মানুষটা সকালে না খেয়ে বেরিয়েছে। এখন বিকেল হয়ে গেছে তবুও ফিরছে না। কলেজ তো কত আগেই ছুটি হয়ে গেছে। জেসমিন সেই কখন বাড়ি চলে এসেছে। ধারা জেসমিনকে জিজ্ঞেসও করতে পারছে না, প্রতিদিন তো একসাথে ফিরিস তোরা? আজ তাহলে একা ফিরলি কেন?
মাঝে মাঝে দমকা বাতাস বৃষ্টির ছাঁট ছিটিয়ে দিয়ে তাকে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। তবুও ধারা উঠে ঘরে চলে যাচ্ছে না। কাল রাতের কথা মনে হলে এখনও দম বন্ধ করা গুমট একটা অনুভূতি বুকের ভেতর কাজ করছে।
মুনতাসীর চুপচুপে ভিজে বাড়ি ফিরল। গেটের ভেতর পা দিয়েই ধারার সাথে চোখাচোখি হলো। কিন্তু ধারাকে দেখেও মুনতাসীর যেন তাকে দেখেনি এমন ভাবে ঘরে চলে গেল। সন্ধ্যার আগে আগে বৃষ্টি থামলে মুনতাসীর তার ব্যাগপত্র নিয়ে বেরিয়ে এলো। এ সমস শরিফুল ইসলাম বাড়িতেই ছিলেন। মুনতাসীর উনাকে বলে যেতে এসেছে। জেসমিন মুনতাসীরের ব্যাগপত্র দেখে চোখ বড় করে প্রশ্ন করল,

-মুনতাসীর ভাই, আপনি কোথাও যাচ্ছেন নাকি?”

মুনতাসীর হাসল। শরিফুল ইসলামের দিকে তাকিয়ে বলল,

-কলেজের কাছাকাছিই একটা বাসা পেয়েছি। আজই উঠতে চাচ্ছি। এতদিন আপনাদের এখানে থাকতে দিয়েছেন সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ।”

চলবে_