#এক_বরষায় [৩৯]
#জেরিন_আক্তার_নিপা
_________________
মাতিম জেসমিনের হাত ছেড়ে দিলে জেসমিন কাচুমাচু মুখে হাত নামিয়ে নিল। ঝাড়ুটা পাশে ছুড়ে রাখল। না বুঝে এমন একটা কাজ করে বসে আছে এখন ক্ষমা চাওয়ারও সাহস হচ্ছে না। আসলে তার বেশি বোঝার ফল এটা। কারো ঘরে অচেনা একজন মানুষ এলেই যে সে চোর হবে এটা কোথায় লেখা আছে? ভাইও তো হতে পারে। আর চোর হলেই চোরকে ঝাড়ু নিয়ে মারতে হবে! আল্লাহ, জেসমিনের আর মুখ দেখানোর জায়গা রইল না। অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে মিনমিনে গলায় জেসমিন বলল,
-আসলে আমি বুঝতে পারিনি। না বুঝে…
-না বুঝেই মানুষকে চোর ভেবে মারতে শুরু করবে!”
জেসমিন লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেলল। এখান থেকে ছুটে পালাতে পারলে বাঁচত। মানছে তার ভুল হয়েছে। মানুষ কী ভুল বুঝতে পারে না! সে-ও নাহয় একটু ভুলই বুঝেছে। সচেতন নাগরিক হয়ে চোরে মারতে গেলে। তাই বলে ছেলেটা তাকে এভাবে অপমান করবে!
মাতিম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেয়েটাকে দেখছে। এটুকু একটা হাফ সাইজ মেয়ে চোর মারতে এসেছে! সাহস কম না। আর সে চোর এটা কে বলেছে?
নিস্তব্ধ পরিবেশে মাতিম হঠাৎ কথা বলে উঠলে জেসমিন ভয় পেয়ে গেল। গমগমে গলায় মাতিম জিজ্ঞেস করল,
-তোমার নাম কি?”
-হ্যা? জেসমিন।”
-আমার ভাইকে চেনো তুমি?”
হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল জেসমিন।
-হু। মুনতাসীর ভাই আমার স্যার হয়।”
-ভাইয়ের কাছে কী দরকারে এসেছিলে?”
-কোন দরকার না। রাতের খাবার নিয়ে এসেছি। মুনতাসীর ভাইকে আমরাই খেতে দিই।” কথা বলেও জেসমিন বোকা হয়ে গেল। খেতে দিই কথাটা নিজের কাছেই কেমন যেন শোনালো। খেতে দিই মানে কি দয়া করে খেতে দিই? না না। সাথে সাথে জেসমিন আগের কথার সাথে আরও যোগ করল,
-মানে আমার আপু রেঁধে দেয়। আমাদের বাড়ি থেকে খাবার আসে। এখনও কাজের লোক পায়নি তো।”
-ঠিক আছে। ভাই বাড়িতে নেই।”
-কোথায় গেছে?”
-বাজারে।”
-ওহ, আচ্ছা আমি তাহলে চলে যাই।”
কথাটা বলে এক সেকেন্ডও দেরি করল না জেসমিন। ঝড়ের আগে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। মাতিম অবাক হয়ে ওর গমন পথে দেখছে। মেয়েটার মাঝে ভদ্রতার ছিটেফোঁটাও নেই। এত বড় একটা ভুল করেও তাকে সামান্য স্যরিটুকুও বলল না! কেমন অভদ্র মেয়ে রে বাবা! ভাই কলেজে এমন বেয়াদব মেয়েদের পড়ায়!
******
ধারা জেসমিনকে এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে দেখে কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করল,
-চলে এসেছিস! একটু আগেই না গেলি।”
-এসেছি দেখতেই তো পারছিস। আবার জিজ্ঞেস করছিস কেন?”
মেয়েটা ফুরফুরে মনে গেল এখন ফিরে এসেছে মেজাজ এমন খিটখিটে হয়ে আছে কেন? কিছু হয়েছে নাকি?
-কী হয়েছে? চেহারার বারোটা বেজে আছে কেন?”
-কিছু না।”
-কিছু না বললেই হলো। গেলি তো বেশ খুশি মনে। ফিরে এসে কী হয়েছে? পথে কারো সাথে ঝগড়া করেছিস?”
জেসমিন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলল,
-তোমার কি মনে হয় আমি সবসময় শুধু ঝগড়া করার তালেই থাকি? আমার আর কোন কাজ নেই।”
ধারা বুঝল সত্যি সত্যিই জেসমিনের মন খারাপ। কোন কারণ ছাড়া তো ওর মেজাজ খারাপ হয় না। নিশ্চয় বড় কিছু ঘটেছে। ধারা এবার নরম হলো। ছোট বোনটাকে কোলেপিঠে করে বড় করেছে সে। ওর থেকে কীভাবে কথা বের করতে হবে ভালো করেই জানে ধারা।
মুনতাসীরের ফ্ল্যাটে কী কী ঘটেছে সব বলে দিল জেসমিন। ধারা সব শুনে বলল,
-দোষ তো তোরই। শুধু শুধু ওকে মারতে গেলি কেন?”
-আমি কি জানতাম ওই ব্যাটা মুনতাসীর ভাইয়ের ভাই। চোর ভেবেই তো..
-চোর হলেই তোকে এত সাহস কে দেখাতে বলেছে? চোরের সাথে মারামারি করে পারতি তুই? ধর ওটা চোরই ছিল। চোরের সাথে ছুরিও থাকতে পারে এটা মাথায় আসলো না!”
-তখন এতকিছু ভাবিনি।”
-আচ্ছা থাক, এই বিষয়ে ভেবে মন খারাপ করতে হবে না। কাল ছেলেটাকে সরি বলে দিস। জেনে-বুঝে তো আর করিস নি। মানুষ মাত্রই ভুল। তোরও একটা ভুল হয়েছে।”
*****
ধারা নয়নকে আজ ঠিক পাঁচ দিন পর দেখল। নয়ন ভাই কি পাড়ায় ছিল না! কোথাও গিয়েছিল? ধারার বিয়ের কথা শুনেও চুপচাপ আছে। ধারার মনে তীক্ষ্ণ সন্দেহ কাজ করছিল নয়ন ভাই কোনো না কোন ভাবে এই বিয়েটাও ভেঙে দিবে। এর আগেও তো কত মানুষকে তাড়িয়েছে।
ধারা নিজেই নয়নের কাছে এগিয়ে গেল। নয়ন ফোনে কথা বলছিল। ধারাকে খেয়াল করেনি সে।
-নয়ন ভাই!”
নয়ন চমকে তাকাল। ধারা কখন এসেছে! ফোন কানে নিয়েই প্রশ্ন করল,
-তুই! কখন এসেছিস?”
-এখনই।”
-কোথাও যাচ্ছিস নাকি?” কথাটা ধারাকে বলে ফোনে কথা বলতে থাকল, “ঠিক আছে। নজর রাখতে থাক। সন্দেহজনক কোনোকিছু চোখে পড়লেই আমাকে জানাবি। রাখছি।”
ফোনে কথা শেষ করে ধারার দিকে ফিরল। ছেলেটার কোন বাজে অভ্যাস নেই। সিগারেট খায় না। নেশা করে না। মেয়ে গঠিত কোন বদনামও নেই। পড়াশোনা করেছে। ডাক্তার হয়েছে। এই ছেলেটা ধারার বর হবার যোগ্য। কিন্তু ধারার বিয়ে অন্য কারো সাথে হবে। ধারা এই পাড়া ছেড়ে চলে যাবে, ধারাকে দেখতে পারবে না ভেবেই নয়নের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
ধারা নয়নকে দেখছে।
-এই কয়দিন কোথায় ছিলেন নয়ন ভাই?”
-বাড়িতেই। কেন?”
-না এমনি। আপনার দেখা নেই তাই ভেবেছিলাম বাড়িতে নেই হয়তো।”
নয়ন বুকে কষ্ট চেপে মুখে হাসল। প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলল,
-বিয়ের আয়োজন কতদূর?”
ধারা নয়নের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা বোঝার চেষ্টা করছে। নয়ন ভাই কি পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছে? ধারার মুখে এতক্ষণ হাসি থাকলেও এখন হাসি ধরে রাখা কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে।
-জানি না। সব বাবা দেখছে।”
নয়ন শব্দ করেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
-ছেলেটা ভালো কি বলিস? আমাদের পাড়ায় কোন ডাক্তার নেই। তোর বিয়ে হলে পাড়ায় ডাক্তার জামাই হবে। বেশ খাতির পাবে।”
ধারার চেহারা নিভে গেল। তাহলে কি বিয়েটা হয়েই যাবে! নয়ন ভাই কিছুই করবে না!”
******
ওই ঘটনার পর জেসমিন ভুলেও মুনতাসীর ভাইদের দিকে যায় না। পালরে সে আরও ওই ছেলেটার থেকে পালিয়ে বাঁচে। ওই ঘটনা মনে পড়লেই লজ্জায় কান দিয়ে কুকারের সিরি বেরোয়। কী লজ্জা, কী লজ্জা! ঝাড়ু দিয়ে যে জোরে বাড়ি দিয়েছিল ছেলেটার পিঠ বেঁকে যাবার কথা। ওই ছেলে যদি তাকে হাতের কাছে পেয়ে প্রতিশোধ নিতে চায়! ওরকম একটা বাড়ি তার পিঠেও বসায়! না বাবা না। তাহলে জেসমিনের কুঁজো বুড়ির মতো বাকিটা জীবন লাঠি ভর দিয়ে হাঁটতে হবে। ধারাও বুঝতে পারছে জেসমিন কোন ভয়ে মুনতাসীরের কাছে যাচ্ছে না। সে আর জোরও করছে না। আতিফকে দিয়েই খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছে।
মুনতাসীর কলেজে জেসমিনের দেখা পেল। সে ভেবেছিল জেসমিন হয়তো অসুস্থ।
-কী ব্যাপার জেসমিন? দুই দিন ধরে যাচ্ছ না? ভাইকে ভুলে গেলা নাকি?”
-ভুলিনি মুনতাসীর ভাই।”
-তাহলে যাচ্ছ না কেন? আর সামনে তো তোমাদের পরীক্ষা। পড়াশোনার কী অবস্থা?”
-আর পড়াশোনা! আমি পড়লে যা না পড়লেও তা।”
-প্রাইভেটও তো পড়ছ না। কাল, না আজ থেকেই এসো।”
আজ থেকে! মুনতাসীর ভাইয়ের ওখানে পড়তে যেতে হবে? ওই ছেলেটাও তো ওখানে আছে।অসম্ভব। আচ্ছা ছেলেটা কি মুনতাসীর ভাইকে কিছু বলেনি? জেসমিন বুদ্ধি খাটিয়ে বলল,
-মুনতাসীর ভাই, আমি আরও কয়দিন পরে পড়ি?”
-কেন? বোনের বিয়ের তো এখন দেরি।”
জেসমিন বাধ্য হয়ে তার পড়তে না যাওয়ার আসল কারণটা বলেই দিল। গম্ভীর মুখে মুনতাসীর সবটা শুনলো। শোনা শেষে হো হো করে হেসে ফেলল। জেসমিন ভেবেছিল মুনতাসীর ভাই হয়তো তাকে বকবে। কিন্তু ইনি তো হাসছে। মুনতাসীর হাসি না থামিয়েই বলল,
-তুমি সাহসী জানতাম কিন্তু চোর ধরে পেটানোর মতো এতটা সাহসী তা জানা ছিল না।”
-আপনি হাসছেন! আমি ভেবেছিলাম রাগ করবেন।”
-না রাগ করিনি। তবে আমার নিরীহ ভাইটাকে চোর অপবাদ দেওয়া…
কথা শেষ করতে না দিয়ে জেসমিন বলল,
-অপবাদ দিই নি। ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে।”
-হু। ঠিক আছে। এই ভয়ে তুমি দু’দিন যাচ্ছ না! ভীতু।”
-ভীতু না। আসলে আমি উনার সামনে পড়তে চাচ্ছি না। আমি ভীষণ লজ্জিত।”
-লজ্জিত হতে হবে না। দেখা হলে সরি বলে দিও। ও বেচারা কিছু মনে রাখবে না।”
*****
জেসমিন অনিচ্ছা সত্ত্বেও আজ মুনতাসীর ভাইয়ের কাছে পড়তে যাচ্ছে। মুনতাসীর ভাই চলে যাওয়ার পর এই কয় দিন একটু পড়ার চাপ কম ছিল। কিন্তু ছাতার পরীক্ষা তার সুখ শান্তি নষ্ট করতে চলে এসেছে। কাঁধে ব্যাগ চাপিয়ে আতিফকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
পুরোটা পথে চুপ করে জেসমিন ভেবেছে কীভাবে পড়াশোনা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। আতিফ জেসমিনকে চুপ দেখে বলল,
-কী হয়েছে তোমার? পড়াশোনা ভালো লাগে না?”
-পড়াশোনা কি ভালো লাগার জিনিস? তোকে বিষ খাইয়ে দিয়ে বলি, কেমন লেগেছে? বিষ খেতে ভালো লাগছে?”
আতিফ হাসতে লাগল। জেসমিন বিরক্ত হলো। মুনতাসীর ভাইয়ের ফ্ল্যাটের সামনে এসেও জেসমিন ভাবল, না ফিরে যাই। আজ পড়তে হবে না। কিন্তু আতিফ ওকে টেনেটুনে নিয়ে এলো।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতেও জেসমিন ভাবছে, ছেলেটাকে কীভাবে সরি বলবে? মুখে না বলে চিরকুটে লিখে বললে কেমন হয়? না না। বেকার আইডিয়া। প্রেমপত্র লিখবে নাকি যে মুখে বলতে লজ্জা লাগবে।
মুনতাসীর আধশোয়া হয়ে বসে আছে। তার হাতে একটা বই। বই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ছোট ভাইয়ের সাথে গল্প করছে। মাতিম বলছে, সে এখন থেকে ভাইয়ের সাথেই থেকে যাবে। বাড়িতে একা তার ভালো লাগে না। তাছাড়া ভাইও এখানে একা। কথা বলতে বলতে হঠাৎ দেয়ালের দিকে চোখ গেল ওর। একটা টিকটিকি দেখে মাতিম চেঁচিয়ে উঠল। মুনতাসীর ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে ওদিকে দেখে হেসে ফেলল।
-এখনও টিকটিকি ভয় পাস? তুই না পুরুষ মানুষ।”
-ভয় কি নারী পুরুষ দেখে আসে? তুমিও তো কুকুর ভয় পাও।”
-সেটা তো ছোটবেলা দৌড়ানি খেয়ে ভয় এসে গেছে।”
-আমারও এই জিনিসে ভয় এসে গেছে।”
-ভয়ের কিছু নাই। পা থেকে জুতোটা খুল। আর দেয়ালে ছুড়ে মার। টিকটিকি তো পালাবেই সাথে ওর বাপও।”
মাতিম ভাইয়ের কথা মতোই কাজ করল। জুতো হাতে নিল। কিন্তু ততক্ষণে টিকটিকিটা দরজার কাছে চলে গেছে। টিকটিকি সেদিকেই যাচ্ছে মাতিম সেদিকেই লক্ষ স্থির করছে। মাতিমও এক দুই তিন গুনে জুতো ছুড়ে মারল ঠিক সেই সময় জেসমিন আতিফ দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। জুতো টিকটিকির গায়ে না লাগলেও দরজায় বাড়ি খেয়ে এসে জেসমিনের মাথায় লাগল। মাতিম কিছু বুঝতে না পেরে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জেসমিন মাথায় হাত দিয়ে একবার মাটিতে পড়ে থাকা জুতোটা দেখল। আরেকবার বোয়াল মাছের মতো মুখ হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকা মুনতাসীর ভাইয়ের ভাইটাকে দেখল। সেদিন সে ভুল বুঝে ঝাড়ু পেটা করেছিল। তাই আজ প্রতিশোধ নিতে সজ্ঞানে তার উপর জুতা ছুড়ে মারল! আতিফ প্রথমে বুঝতে পারেনি কী ঘটেছে। পরে বুঝতে পেরে মুখ টিপে হাসতে লাগল। জেসমিন আগুন চোখে আতিফকে দেখল। এত অপমান নিয়ে এখানে আর এক মুহূর্তও দাঁড়ানো যাবে না। জেসমিন রাগে, জেদে চিৎকার করে বলল,
-মুনতাসীর ভাই, আমি আর কখনও আপনার কাছে আসব না।”
জেসমিনের গলা শুনে মুনতাসীর বই থেকে মুখ তুলে এদিকে তাকাল। জেসমিন কখন এসেছে? একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার সম্পর্কে মুনতাসীরের কোন ধারনাই নেই। জেসমিনকে দৌড়ে চলে যেতে দেখে অবাক গলায় জানতে চাইল,
-কী হয়েছে ওর? ওভাবে চলে গেল কেন?”
মাতিম ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে কাচুমাচু মুখে বলল,
-আমি ইচ্ছে করে করিনি ভাই। আমি জানতাম না ওরা তখন দরজা দিয়ে ঢুকবে।”
-হু, কিন্তু হয়েছে কী?”
চলবে_
#এক_বরষায় [৪০]
#জেরিন_আক্তার_নিপা
(এডিট ছাড়া পর্ব। ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন)
___________
ধারার মাথা ব্যথা করছে। অসহনীয় মাথা ব্যথা যাকে বলে। সকাল থেকে তো ভালোই ছিল। সাদাফের নাম শুনেই কি তার মাথা ব্যথা শুরু হলো! ধারা ভাবে, যে মানুষটার নাম শুনলেই দুনিয়ায় সমস্ত অস্বস্তি এসে তার মাঝে ভীড় করে, সেই মানুষটার সাথে জীবন কাটানোর কথা ভাবছে কীভাবে? দাদী একটু আগে বলে গেছে সাদাফ নাকি আজ তাকে নিয়ে বেরোবে। বিয়ের শাড়ি গহনা কিনবে। ফেরার পথে একটু ঘোরাঘুরিও হয়ে যাবে। কথাটা শুনেই ধারার মন তেতো হয়ে গেল। শাড়ি গহনা তাকে সাথে নিয়ে গিয়ে কিনতে হবে কেন? প্রতিত্তোরে দাদী বলেছে,
-বউয়ের পছন্দে শাড়ি গয়না কিনবে এইটা ভালো না! বিয়ার আগেই নাতজামাই কেমন আমার নাতনির নেওটা হয়ে গেছে। বিয়ার পরে জামাই তোরে চোখের তারায় রাখব দেখিস।”
ধারা কারো চোখের তারায় থাকতে চায় না। না চায় ওই লোকটার চোখের সামনে থাকতে। তবুও যে কেন বিয়েটা করছে সে! ধারার আজ কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে নেই। বিশেষ করে ওই সাদাফ নামের হ্যাংলাটার সাথে তো না-ই।
-আমি কোথাও যাব না দাদী। তাছাড়া বাবাও যেতে দিবে না। তুমি বরং উনাকে না করে দাও।”
দাদী চতুর হেসে বলল,
-তোর মনে হয় নাতজামাই আমার কাঁচা কাজ করব? তোর বাপরে আগেই রাজি কইরা ফেলছে। তোর বাপই তোরে লইয়া যাওয়ার অনুমতি দিছে।”
ধারা অবাক না হয়ে পারল না। বাবা দুই মেয়ের বেলায় কখনও কাউকে ভরসা করেন না। মানুষটার সাথে তার বিয়ের কথা হয়েছে তবেই বাবা উনাকে বিশ্বাস করে ফেললেন! দাদী তখনও হাসি হাসি মুখে ধারার দিকে তাকিয়ে আছেন।
-বইয়া আছোস ক্যান ছেমরি? তাড়াতাড়ি উইঠা তৈয়ার হ। এই প্রথম জামাইয়ের লগে বাইরে যাবি। আজ একটা শাড়ি পর। চোখে গাঢ় কইরা একটু কাজল দে। হাতে কয়ডা চুড়িও পরিস।”
-আমি শাড়ি টাড়ি পড়তে পারব না। আমার মাথা ব্যথা করছে।”
-তোর ছাতার একটা মাথা! সারা জনমই বিষ বেদনা থাকব। এহন ওঠ তো। কথা কইস না। যা কইতাছি চুপ কইরা কর।”
দাদী যাবার পর থেকেই মাথা ব্যথাটা যেন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। ধারার মনে হচ্ছে তার মাথা হয়তো ফেটে যাবে। দাদী আলমারি থেকে শাড়ি বের করে দিয়ে গেলেও ধারা নড়ল না। থম মেরে বসে রইল।
সাদাফ এসে বাবার ঘরে বসে আছে। সাদাফ বাড়িতে ঢুকতেই জেসমিন ওর সামনে পড়ে গেল। লোকটার এই বাড়িতে আসা জেসমিনের একদম পছন্দ হলো না। সাদাফ ওকে দেখে দূর থেকেই হেসে বলল,
-আসসালামু আলাইকুম, শালি সাহেবা। কেমন আছেন আপনি?”
জেসমিন মুখ বাঁকাল। এই লোক যতই তার সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করুক জেসমিন একে জীবনেও পাত্তা দিবে না। তার বলতে ইচ্ছে করছিল,
-বিশ্বাস করুন, এতক্ষণ অনেক ভালো ছিলাম। যে-ই আপনাকে দেখলাম, মন মেজাজ মাথা সব খারাপ হয়তো গেল। আপনি দয়া করে আমাদের বাড়িতে আর কখনও আসবেন না।” কথাটা তার ঠোঁটের আগায় এসে গিয়েও আটকে গেল। বাড়িতে আসা মেহমান, তার উপর আবার যার সাথে দু’দিন পর বোনের বিয়ে হবে তার সাথে আর যাই হোক খারাপ ব্যবহার করা যায় না। জেসমিন না চাইতে হেসে বলল,
-ভালো। আপনি?”
-আমিও ভালো।” সাদাফ উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখছে ধারাকে দেখা যায় কি-না।
-তোমার বোন কোথায়? ও কি রেডি হয়েছে?”
জেসমিনের কপালের মাঝ বারবার তিনটা ভাঁজ পড়ল। এই লোক কি আজ আপুকে নিয়ে বেরোবে! বিয়ের আগেই এত বাড়াবাড়ি! মনে মনে অতন্ত্য বিরক্তি চেপে জেসমিন বলল,
-জানি না।”
-আচ্ছা। তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে? এবার তো ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে না?”
-হুম। শুনেছিলাম আপনি নাকি ডাক্তার। তাহলে তো আপনি একজন ভীষণ ব্যস্ত মানুষ। কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে আপনার হাতে অঢেল সময়। সময়ের কোন শেষ নেই।”
বোনকে নিয়ে একা বেরোবে বলে শালিকা অভিমান করে টিটকারি মারছে! সাদাফ জেসমিনের খোঁচা দেওয়া কথাটাও সহজ ভাবেই নিল। হেসে বলল,
-আমি যত ব্যস্ত মানুষই হই না কেন? তোমার জন্য আর তোমার বোনের জন্য আমার সময়ের অভাব হবে না।”
জেসমিন মুখ বাঁকাল। বলল,
-আপনার সময় নিয়ে আমি কী করব? আপনার সময় বরং আমার বোনকেই দিন। দুই দিন পর সে আপনার বউ হবে। আমি না।”
জেসমিন সাদাফকে বাবার ঘরে দিয়ে কেটে পড়ল। এই লোকের সাথে কথা বললেই তার রাগ উঠে। মানুষটা যে খারাপ সে তা বলছে না। তবে যে জায়গা মুনতাসীর ভাইকে দিতে চেয়েছিল সে জায়গা অন্য কেউ নিয়ে নিচ্ছে দেখে সহ্য হচ্ছে না।
জেসমিন বাবার ঘর থেকে বেরিয়েই ভাবল। তাদের পাড়াতে তো দুই তিনটা ফার্মেসি আছে। কোনোভাবেই কি সে দশটা ঘুমের ঔষধ জোগাড় করতে পারবে না! এক দোকান থেকে সবগুলো না কিনুক। তিনটা দোকান থেকে তিনটা তিনটা করে কিনলেও নয়টা হয়ে যাবে। থাক দশটা লাগবে না। নয়টা হলেই হবে। কিন্তু তাকে তো এই পাড়ার সবাই চেনে। তার কাছে কি কেউ ঘুমের ঔষধ বিক্রি করবে? আর করলেও প্রথমে হাজারটা প্রশ্ন করে নিবে। সেসব প্রশ্নের উত্তরে বলার মতো তার কাছে কিছুই তো নেই।
শেষ অবধি ধারা সাদাফের সাথে গেল না। তার মাথা ব্যথা কমেনি বরং বেড়েছে। সাদাফ অনেকক্ষণ বসে থেকে ধারাকে দেখতে এলো। ধারা শোয়া থেকে উঠতে পারছে না। তার কপালের দুই পাশের শিরা ফোলে উঠেছে। ওর হঠাৎ এমন মাথা ব্যথা শুরু হওয়ায় সবাই অস্থির হয়ে পড়ল। জেসমিন বোনের পাশে বসে উদ্বিগ্ন গলায় বলছেন,
-আগে মাঝে মাঝেই আপুর এমন মাথা ব্যথা হতো। কিন্তু অনেকদিন ধরে আর হয়না। আজ হঠাৎ করে মাথা ব্যথা আবার ফিরে এলো কেন?”
সাদাফ চিন্তিত মুখে জানতে চাইল,
-ধারার কি মাইগ্রেন আছে?”
-জানি না। আপু তো কোনোদিনও ডাক্তারের কাছে যায়নি।”
-আমার মনে হয় ধারার মাইগ্রেন আছে। নইলে শুধু মাথা ব্যথা এত কাবু করতে পারত না। ডাক্তারের কাছে যায়নি কেন?”
-ওর কিছু হলে কাউকে বলে নাকি? সবকিছু তো নিজের মাঝেই চেপে রাখে। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা বললে বলে, তার নাকি ডাক্তারের কাছে যাওয়ার মতো অসুখ হয়নি।”
সাদাফ ধারাকে দেখল। মেয়েটা কেমন কষ্ট পাচ্ছে। ধারাকে কষ্ট পেতে দেখে তার ভালো লাগছে না। বিয়ের পর ধারাকে সে কোনো কষ্ট পেতে দিবে না। ধারা মুখ ফোটে বলার আগেই ওর মনের কথা বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করবে।
সাদাফ চলে যাবার সময় নয়ন দোকানে বসে ছিল। ধারাদের বাড়ি থেকে সাদাফকে বেরিয়ে যেতে দেখে পারভেজ, রাসেল রেখে গেলেও নয়ন একটুও রাগলো না। বরং ওদের থামিয়ে দিয়ে অদ্ভুত কায়দায় হাসল। বলল,
-থাম তোরা। শুধু শুধু মাথা গরম করিস না৷ ওই ছেলে যত যা-ই করুক, ধারার বিয়ে ওর সাথে হবে না। ধারাকে নিজের করে পাওয়ার আশা আমি কোনোদিনও করিনি। এখনও করি না। তবে এই ছেলে ধারার জামাই হবে না। নিশ্চিন্ত থাক। ধারা যদি কখনও বিয়ে করতে চায় তাহলে সেই বিয়েটা হবে ওর পছন্দ করা ছেলের সাথে। আমি নিজে দাঁড়িয়ে ধারার পছন্দের ছেলের সাথে ওর বিয়ে দেব। বিয়ের সব দায়িত্ব তোরা দুইটা পালন করবি।”
রাসেল বলল,
-ভাই আমরা চাই না ভাবীর বিয়া অন্য কারো সাথে হোক। আমরা ভাবীরে আমাগো ভাবী বানাইতে চাই।”
নয়নের মনটা দমে গেল। তবুও মুখে হাসি রেখে বলল,
-আমি তো ওরে নিজের করে পাওয়ার জন্য ভালোবাসা না। ওরে ভালো না বেসে থাকতে পারি না। তাই ভালোবাসি।”
*****
জেসমিন মুনতাসীরের কাছে পড়তে যাচ্ছে না। তবে এই কয়দিনে আতিফের সাথে মাতিমের খাতির হয়ে গেছে। আতিফ মাতিমের থেকে বয়সে ছোট হলেও ওরা বন্ধুর মতোই ঘোরাফেরা করে।
সেদিন সন্ধ্যার পরে আতিফ মাতিমকে বাড়িতে নিয়ে এলো। জেসমিন ধারার ঘরের দিকে যাচ্ছিল। হঠাৎ মাতিমকে সামনে দেখে বারান্দা থেকে নামতে গিয়ে ধপ করে পড়ে গেল। তা দেখে আতিফ পেটে ফেটে হাসতে লাগল। মাতিম অবশ্য হাসছে না। লজ্জায়, অপমানে জেসমিনের মরে যেতে ইচ্ছে হলো। সে কি দুই দিন বছরের শিশু? দিব্যি তো ছোটাছুটি করতে পারে। তাহলে আজ এই ছেলের সামনেই কেন পড়ে যেতে হলো! মানসম্মানের ছিটেফোঁটাও থাকল না। জেসমিন আতিফের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে উঠে দাঁড়াল। এক মুহূর্তও ওখানে দেরি না করে ঘরে চলে এলো। এই ছেলে তার জীবনে শনি হয়ে এসেছে। নইলে এর আগমনের পর থেকে তার সাথে উদ্ভট উদ্ভট সব কাণ্ড ঘটছে কেন?
ধারা শুনেছে মাতিম এসেছে। ছেলেটাকে দেখার তার অনেক ইচ্ছে ছিল। সেই ছোটবেলা দেখেছিল। এখন তো চেহারাও ভালো করে মনে নেই। মাতিমটা কত বড় হয়ে গেছে! ধারা ওকে দেখে খুশি লুকিয়ে রাখতে পারল না। খুশি লুকানোর চেষ্টাও করল না। মাতিমকে আতিফের সাথে দেখে বলল,
-কেমন আছো মাতিম? কবে এসেছ?”
মাতিম হালস। ধারা আপু তাকে ভুলেনি। তবে তার ভাইকে ঠিকই ভুলে গেছে!
-ভালো। তুমি আমাকে চিনেছ?”
ধারা অবাক হওয়া গলায় বলল,
-তোমাকে আমি চিনব না? হ্যাঁ আগের থেকে অনেক পাল্টে গেছ। বড় হয়েছ।”
-আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাকেও ভুলে গেছ।”
ধারার মুখের হাসিটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। মাতিম কি তার ভাইয়ের থেকে কিছু জেনেছে?
-অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে। তাই ভেবেছি তোমার হয়তো আমাদের কথা মনে নেই।”
ধারা প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলল,
-ঘরে এসো। এখানে আছো কতদিন?”
-থাকব কয়েকদিন। ভাই একা থাকে। আমারও ওখানে কেউ নেই।”
ধারার মনটা খারাপ হয়ে গেল। নজরুল চাচা তাকে মেয়ের মতো স্নেহ করত। চাচাকে সে শেষ দেখাও দেখতে পারল না। চাচা নেই ভাবতেই বুকে অদ্ভুত ব্যথা হয়।
ভাই তাকে কিছু বলেনি৷ মাতিম যতটুকু জেনেছে তা আতিফের থেকে। ধারা আপুর নাকি আগের কথা কিছু মনে নেই। ভাইকে দেখেও চিনতে পারেনি সে। কিন্তু তাকে তো প্রথম দেখাতেই চিনতে পারল। আগের কথাও কিছু ভুলেনি। তাহলে ভাইয়ের সামনে এই অভিনয় কেন? মাতিম এখানে আসতে আসতে জেনেছে ধারা আপুর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ভাই তাকে এই কথাটাও বলেনি। অথচ ওরা ছোটবেলা থেকেই জানত ধারা আপু তার ভাইয়ের বউ হবে। ওদের দাদারা বিয়ে ঠিক করে গিয়েছিল। ধারা আপুর মা পালিয়ে যাবার পর ওরা কাউকে কিছু না চালিয়ে কোথায় নিরুদ্দেশ হলো। তারপর বাবা শরিফুল চাচা ও তার পরিবারের কত খোঁজ করল। কিন্তু কোথাও পেল না। এইতো ভাই এখানে আসার আগে জানতে পারল শরিফুল চাচারা এখানে থাকে। তারপরই তো ভাইকে ওদের বাড়িতে পাঠায়। শরিফুল চাচা কেন বাবার সাথে যোগাযোগ রাখেনি তা নিয়ে বাবা কোনোদিনও অভিযোগ করেনি। চাচার মনের অবস্থা বাবা বুঝতে পেরেছিল। বাবা নিজেই আসতো চাচার কাছে। কিন্তু মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়ল। সেই অসুখ আর সারলো না। বাবা চলে গেল। এখন মাতিম এখানে এসে শুনছে শরিফুল চাচা অন্য একটা ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছে? বাবা মারা গেছে শুনেও চাচা কীভাবে বাবাকে দেওয়া ওয়াদা ভাঙতে পারল!
-তুমি এবার কোন ক্লাসে পড়ো?”
ধারার প্রশ্ন শুনে মাতিম ভাবনার জগত থেকে ফিরে আসে।
-এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি।”
-ওহ।”
-চাচা বাড়িতে নেই ধারা আপু?”
-না। বাবা চলে আসবে। তুমি এখন যেতে পারবে না। রাতে আমাদের সাথে খেয়ে তারপরে যাবে। আতিফের সাথে বসে গল্প করো। আমি আসছি।”
রাতের রান্না হয়ে গেলেও ধারা আবার রান্নাঘরে ঢুকলো। ছেলেটা এই প্রথম তাদের বাড়িতে এসেছে। ধারা এবাড়ি থেকে চলে গেলে ওর সাথে আর কবে দেখা হবে কে জানে। আচ্ছা তার বিয়ে পর্যন্ত কি মাতিম এখানে থাকবে? বিয়ের কথা মনে হতেই ধারার বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। এই বাড়িতে তার আর কয়েকটা দিন বাকি আছে।
চলবে_