#এক_বরষায় [৪১]
জেরিন আক্তার নিপা
____________
দাদী বারবার জেসমিনকে ডাকছে। কিন্তু জেসমিন ঘর থেকে বেরোচ্ছে না। ওই ব্যাটা আস্ত শনি। তার জীবনে সকল অপ্রীতিকর ঘটনার কারণ। প্রথম দিন চোর ভেবে ঝাড়ুপেটা করল। দ্বিতীয় দিন নিজে জুতার বাড়ি খেল। আজ ব্যাটার সামনে ভালো জায়গা থেকে উস্টা খেয়ে পড়ে গেল। এখন ওই ঘরে গেলে আর কী কী ঘটবে আল্লাহ মালুম। তার থেকে ভালো শনি ব্যাটা না যাওয়া পর্যন্ত মানসম্মান যেটুকু আছে তা হাতে নিয়ে এখানেই ঘাপটি মেরে বসে থাকুক।
দাদী আবার ডাকছে,
-ওই ছেমরি, ডাকতাছি হুনতাছোস না? কানে বয়ড়া লাগছে নাকি? এই ঘরে আয়। দেইখা যা কেডা আইছে?”
জেসমিন বিরক্তিতে গলা উঁচিয়ে বলল,
-আমাকে ডেকো না দাদী। সামনে আমার পরীক্ষা।”
দাদী মাতিমের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
-ও বাবা, এ তো দেখি ভূতের মুখে রাম নাম!যেই মাইয়া জীবনে বই খুইলা দেখে না সে নাকি পরীক্ষার চিন্তা করতাছে!”
মাতিম হয়তো বুঝতে পেরেছে জেসমিন কেন এই ঘরে আসতে চাচ্ছে না। আসলে সে নিজেও জেসমিনের সামনে অপ্রস্তুত হয়ে যায়। প্রথম দিন থেকে ঘটনা গুলোই এমন ঘটছে। তাই মাতিম বলল,
-থাক দাদী। পরীক্ষা যখন তাহলে পড়ুক।”
দাদী আগের দিনের কথা মনে করে নানান গল্প করছেন। আতিফ ওদের সাথে বসে শুনছে।
ধারার বাবা বাড়ি ফিরেছে। মাতিমকে দেখে তিনি প্রথমে চিনতে না পারলেও পরে ওর পরিচয় জানতে পেরে চিনেছেন। নজরুলের ছেলে দুইটা কত বড় হয়ে গেছে! বন্ধুর কথা মনে পড়ে তার চোখ ভিজে উঠল। ফ্রিজে গরুর মাংস ছিল না। মুরগী ছিল। ধারা ওটাই রান্না করেছে। মাতিমের জন্য পায়েসও করেছে।
ওরা সবাই একসাথে খেল। খাবার সময় জেসমিনকে না চাইতেও আসতে হলো। কারণ বাবা ডেকেছে। বাবা, জেসমিন, আতিফ, মাতিম একসাথে খেতে বসেছে। দাদী রাতে খাবে না। ধারা পরে খাবে। টেবিলের নিচ দিয়ে ভুলবশত মাতিমের পা জেসমিনের পায়ের সাথে লেগে গেল। জেসমিন কড়া চোখে আতিফের দিলে দেখল। সে ভেবেছে এটা হয়তো আতিফের কাজ। তাকে বিরক্ত করার জন্য এমন করছে। তখন তাকে পড়ে যেতে দেখে কেমন দাঁত কেলিয়ে হাসল। জেসমিন ওইটার শোধ নিতে আতিফের পা ভেবে জোরে মাতিমের পায়ে লাথি মারল। সাথে সাথে মাতিম ভাত গলায় বাজিয়ে দিয়ে বিষম খেয়ে দম আটকে গেল। ধারা তাড়াতাড়ি ওকে পানি দিল। কী ঘটেছে বুঝতে পেরে এবার জেসমিনের সত্যি সত্যিই মরে যেতে ইচ্ছে করছে। এবারও ভুল করে ফেলেছে। আতিফ ভেবে শনিকে লাথি মেরেছে। ধারা মাতিমের পিঠে আলতো করে থাপড় দিচ্ছে।
-ইশশ, পানি খাও। ভাত গলা থেকে ছুটেছে? সাবধানে খাবে না!”
মাতিম পানি খেতে খেতে একবার জেসমিনকে দেখল। জেসমিন বেচারি মাথা তুলে তাকাতে পারলে তো!
খাওয়া শেষে মাতিম ধারার বাবার ঘরে বসে আছে। শরিফুল ইসলাম ভেতরে ভেতরে অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন। দুইটা মানুষ কতক্ষণ চুপ করে বসে থাকতে পারবে? তার কিছু বলা উচিত। কিন্তু কী বলবেন সেটাই ভেবে পাচ্ছেন না। মাতিমই আগে বলল,
-বাবা আপনাকে অনেক খুঁজেছে চাচা। আপনার কথা বাবা কখনও ভোলেনি।”
শরিফুল ইসলামের অস্বস্তি আরও বেড়ে গেল। বন্ধুর সাথে শেষ দেখাটাও করতে পারেনি এজন্য তিনি নিজেও অনুতপ্ত।
-বাবা যখন জানলো আপনারা এখানে থাকেন তখন নিজেই আসতে চেয়েছিল। কিন্তু এত বছরে আপনার উপর অভিমান জমেছিল। সেজন্যই ভাইকে পাঠিয়েছে। বাবা নিজেও আপনার কাছে আসতো। তার আগেই বড় একটা অসুখ ধরা পড়ে।”
মাতিম থামল। শরিফুল ইসলামের দিকে তাকিয়ে উনার মুখের ভাব বোঝার চেষ্টা করল। মাতিমের গলাটাও কেমন ধরে এসেছে। সে বলল,
-মৃত্যুর আগে বাবার শেষ ইচ্ছে কী ছিল জানেন চাচা! আপনাকে দেওয়া কথা রাখা। বাবা কখনও আপনাকে ভুল বুঝেনি। আর না আপনার মেয়েদের দূরে সরিয়ে দিয়েছে। আপনি বাবার কতটা কাছের ছিলেন জানেন চাচা? বাবা যত বারই আপনার কথা বলতো উনার চোখ ভিজে উঠতো। বাবা সবসময় চাইত ধারা আপুই যেন মুনতাসীর ভাইয়ের বউ হয়।”
শরিফুল ইসলাম, পাড়ার লোকেরা যাকে মাতাল বলে। নিজের মেয়েরা যাকে দায়িত্বজ্ঞানহীন পাষাণ বাবা ভাবে। সেই মানুষটাও আজ মৃত বন্ধুর স্মৃতি মনে করে ছোট বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। একটা মানুষের জন্য তার জীবনটা শেষ হয়ে গেল। আপন মানুষদের ছেড়ে আসতে বাধ্য হলেন। বেইমানটার দেওয়া ধোঁকা ভুলতে মদ ধরলেন। সমাজের চোখে মাতাল হলেন।
বাবার কান্না শুনে ধারা, জেসমিন দু’জনই ছুটে এসেছে। বাবার সমস্ত শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। জেসমিন হতভম্ব হয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। এই ছেলেটা বাবাকে কী বলেছে যার জন্য বাবা এভাবে কাঁদছে। ধারা বুঝে নিল, বাবা তার বন্ধুর কথা মনে করে কাঁদছে।
কাঁদতে কাঁদতেই শরিফুল ইসলাম বলছেন,
-আমাকে তুই ক্ষমা করে দিছ। আমি হয়তো তোর ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য না। তবুও বন্ধুকে মাফ করে দিছ।”
এতসবের মাঝে আতিফ দূরে দাঁড়িয়ে আছে। কাছে আসার সাহস তার হচ্ছে না। এসবের জন্য সে নিজেকেও দায়ী করে। সবাই যেদিন তার আসল পরিচয় জানবে সেদিন কি ওকে এই বাড়িতে থাকতে দিবে? আতিফ এই মানুষ গুলোকে তার জীবনে খুব করে চায়। এরাই যে তার পরিবার।
*****
মাতিম ভাইয়ের সাথে সরাসরি কথা বলতে চাইল। ধারা আপুর বিয়ে অনেক আগেই ভাইয়ের সাথে ঠিক হয়ে আছে। এটা তো ভাই জানে। তারপরও কেন ধারা আপুর বিয়ে হতে দিচ্ছে? কেন কিছু করছে না?
-ভাই তুমি তো জানো আমাদের বাবা দাদারা কী কথা দিয়ে গিয়েছিলেন। তারপরও তুমি এসব হতে দিচ্ছ কেন?”
-আমি কী করতে পারব বলবি? আমার হাতে কিছুই নেই।”
-কেন নেই? তুমি জানো না ধারাপু তোমার বউ।”
মুনতাসীর হাসল। বউ! ধারাই তার বউ হবে এটা সে নিজেও মনে প্রাণে বিশ্বাস করতো।
-আমি কিছু জানি না ভাই। যেভাবেই হোক ধারাপু শুধুমাত্র আমার ভাবী হবে।”
-তোর ভাবীই তো চায় না আমার বউ হতে। ওকে কি আমি জোর করব?”
-অবশ্যই করবে। তোমার জিনিস তুমি জোর করে হলেও আদায় করবে। অন্য কেউ তোমার জিনিস নিয়ে যাবে তুমি কিছু করবে না?”
-তুই আমার জায়গায় হলে কী করতি?”
মাতিম ঠোঁট কামড়ে ভাবল। তারপর বলল,
-আমি! আমি তোমার মতো ভালো মানুষ নই ভাই। আমি কিডন্যাপ করে হলেও বউকে বিয়ে করে ছাড়তাম। আমি বেঁচে থাকতে আমার জন্য ঠিক করা বউ অন্য কারো কেন হবে?”
ছোট ভাইয়ের কথা শুনে মুনতাসীর গভীর ভাবনায় পড়ে গেল। সে বড় ভাই হয়ে পিছিয়ে আছে! মাতিম ঠিকই তার থেকে এগিয়ে গেছে। মুনতাসীর তড়িঘড়ি করে বেরোতে নিলে মাতিম বলল,
-এখন আবার কোথায় যাচ্ছ?”
-এখন না গেলে তুই আবার ভাইকে ভীতু ভাববি। তোর ভাবীর কাছে যাচ্ছি।”
মাতিম হেসে ফেলে বলল,
-বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। ছাতা নিয়ে যাও।”
******
মুনতাসীর রাস্তায় বেরিয়ে কিছুটা এগিয়েই ধারাকে দেখতে পেল। ধারা একটা বড় আম গাছের পাশে ছোট্ট টিনের ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হয় টিউশনি থেকে ফিরছে। সাথে ছাতা নেই। হঠাৎ বৃষ্টিতে আটকে গেছে।
ধারা আজই শেষ দিন পড়াতে গিয়েছিল। আজ মাস শেষ করে দিয়ে ছুটি নিয়ে এসেছে। বেরোবার সময়ও আকাশ দেখে বোঝা যায় নি বৃষ্টি হবে। কিন্তু মাঝ রাস্তায় হঠাৎ বৃষ্টি ধরল। দৌড়ে এটুকু আসতে আসতেই গায়ের ওড়না ভিজে গেছে। ধারা ওড়না ঝেড়ে পানি ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। মুনতাসীরকে প্রথমে সে দেখেনি। মুনতাসীর কিছুটা এগিয়ে এলে ধারার চোখ ওর দিকে গেল। ধারা ভেবেছে মুনতাসীর হয়তো অন্য কোথাও যাচ্ছে। কিন্তু মুনতাসীরকে সোজাসুজি তার দিকে আসতে দেখে ধারার দম আটকে যাবার দশা। এত ভারী বৃষ্টি হচ্ছে এখন যে চলে যাবে এটাও সম্ভব না। মুনতাসীর এসে ছাতাটা পাশে রেখে ছাউনির নিচে এসে ধারার পাশে দাঁড়াল। ধারা খানিকটা দূরে সরে গেল। মুনতাসীর সেটা দেখে হাসল। অস্বস্তিতে সত্যিই ধারার দম বন্ধ হয়ে আসছে। মুনতাসীর কতক্ষণ বৃষ্টি দেখল। বৃষ্টির দিকে তাকিয়েই বলল,
-মত পালটেছিস?”
ধারা প্রশ্নটা ঠিক বুঝল না। ভুল করেই মুনতাসীরের দিকে তাকিয়ে ফেলল। সাথে সাথে চোখও সরিয়ে নিল।
-এখনও বিয়েটা করতে চাস?”
ধারা মৃদু স্বরে মাথা নেড়ে বলল,
-হু।”
-চান্স নেই। তুই চাইলেও এখন আর বিয়েটা হবে না।”
ধারা ঝট করে মুনতাসীরের দিকে দেখল। এবার চোখ সরালো না। চেয়ে থেকেই বলল,
-মানে!”
-মানে শেষ পর্যন্ত তোর বিয়েটা হবে না। তুই চাইলেও না।”
ধারা বিস্মিত না হয়ে পারল না। মানুষটার কি মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেছে? নাকি অতি শোকে আবোল তাবোল বলছে। সেদিন রাতে ধারার উত্তর স্পষ্ট ছিল। সেটা মেনে নিয়ে তিনিও চলে এলো। তার পর আর একটা দিনও দেখা মিললো না। আজ হঠাৎ এসে বলছে, তোর বিয়ে হবে না। কেন হবে না? ধারা মুখ ফোটেই বলে ফেলল,
-কেন হবে না?”
মুনতাসীর তীক্ষ্ণ চোখে ধারাকে দেখল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-বিয়ে করার জন্য মরে যাচ্ছিস মনে হচ্ছে!”
ধারা দমে গেল। এই লোকের থেকে এসব কথা আশা করা যায় না। নয়ন ভাই এমন পাগলামি করলেও না মানা যেত। কারণ নয়ন ভাইয়ের চরিত্রের সাথে এসব যায়।
-বাড়িতে গিয়ে তোর বাপকে বল বিয়ের আয়োজন বন্ধ করতে। নইলে আয়োজন, বর সবই থাকবে। মাঝখান থেকে মেয়েটাকেই পাবে না।”
মুনতাসীরের প্রতিটা কথা ধারার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। সে না চাইতেও বলে ফেলল,
-আপনার মাথা ঠিক আছে?’
-তুই আর তোর বাপ ঠিক থাকতে দিয়েছিস?”
এই লোকের সত্যি সত্যিই মাথা খারাপ হয়ে গেছে। বৃষ্টি না থামলেও ধারা চলে যেতে নিচ্ছিল। পাগলের প্রলাপ শোনার ধৈর্য তার নেই। মুনতাসীর ধারার হাত ধরে ফেলল। ভীষণ গম্ভীর মুখে বলল,
-ভালোবাসি কথাটা দিনে হাজারবার বলা যায়। কিন্তু সেই ভালোবাসা প্রমাণ করা সহজ নয়। আর ভালোবাসি বলা ছাড়াও দিব্যি ভালোবাসা যায়। কোন জিনিসই বেশি প্রকাশ করা ঠিক না। তাতে সে জিনিস সহজলভ্য হয়ে যায়। আমার ভালোবাসা সহজলভ্য নয়। শোন, তোর বাবাকে বলে দিস অন্যের বউকে বিয়ে দিতে চাওয়াও এক ধরনের অপরাধ কাজ। খুব শীঘ্রই তোদের বাড়ি এসে আমার জিনিস আমি বুঝে নেব।”
মুনতাসীর ধারার হাতে তার ছাতাটা ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-এটা নিয়ে যা। নইলে বৃষ্টিতে ভিজে বিয়ের আগে জ্বর বাঁধালে, বিয়ের দিন তিন কবুল বলতে নয়বার হাঁচি দিবি। শুভকাজে বাধা পড়বে। আমি কোনোরকম বাধাবিপত্তি চাই না। তুই নিজের খেয়াল না রাখলেও আমার জিনিসের খেয়াল তো আমাকেই রাখতে হবে।”
ধারা ফ্যালফ্যাল চোখে কতক্ষণ মুনতাসীরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার ভাবনাগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মস্তিষ্ক যেন কোন কথাই সহজ ভাবে নিতে পারছে না। সহজ কথাগুলোও দুর্বোধ্য মনে হচ্ছে। ধারা খেয়ালই করল না মুনতাসীর তার হাত ধরে রেখেছে। সেই রাতের পর মুনতাসীরের অভিমান জমেছিল। ধারা তাকে ভালোবাসে না। সে-ও ধারাকে বাধ্য করবে না। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে যেভাবেই হোক ধারাকেই তার চায়। ধারা ছাড়া আর যাই হোক এ জীবনে সুখী হতে পারবে না সে। ধারা তার একান্ত ব্যক্তিগত সম্পদ। মুনতাসীর ধারার হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
-বাড়ি যা।”
চলবে_